#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২৪
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
____
সামনের সিটে বসে ড্রাইভিং করছে আয়ুশ। পাশেই বসে আছে প্রহর।প্রেমা আর প্রণয় প্রণয়ের বাইকে করে যাচ্ছে।
প্রথমে প্রেমা প্রহরের সাথে গাড়ি করে যেতে চাইছিলো। কিন্তু প্রণয় পরে প্রেমাকে বুঝালো,প্রহর আর আয়ুশকে একটু একলা ছাড়া প্রয়োজন।যেন ওদের সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক হয়।
প্রেমা কি বুঝলো,সেটা প্রণয় জানে না।তবে প্রণয়ের কথা শুনে প্রেমা প্রণয়ের সাথেই বাইকে উঠে গেল।
গাড়ি চলছে তো চলছেই । মাঝখানে হঠাৎই গাড়ি থেমে গেল।না না,এবার আর গাড়িতে কোনো সমস্যা হয়নি।এবার গাড়ি থামাতে হলো জ্যামের জন্য।
এই জ্যামটা যে কতো ভোগান্তির।তা শুধু যারা জ্যামে আটকে যায়,তারাই জানে।তারাই বুঝে।
আয়ুশ আর প্রহর জ্যামে আটকে আছে প্রায় ৩০ মিনিট হয়ে গেল।
আয়ুশ এতোক্ষণ ফোন ঘাটছিলো। হঠাৎ তার চোখ যায় প্রহরের দিকে।প্রহর জ্যামে এতো বিরক্তি অনুভব করছিলো যে সে,ঘুমিয়ে পড়েছে।আয়ুশ ও তাকে আর জাগায়নি।
প্রহর মাথায় সবসময় হিজাব পড়ে।আজও তার ব্যাতিক্রম নয়।গাড়ির ঝাঁকুনিতে প্রহরের হিজাবের পিন খানিকটা আগলা হয়ে গিয়ে তার কপালের বরাবর কিছুটা চুল চলে এসেছে।
প্রহর ঘুমিয়ে পড়ার দরুন খেয়াল করেনি।এটা মাত্রই আয়ুশের দৃষ্টিগোচর হলো।
প্রহরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে,তার দিকে একটু ঝুঁকে আলগোছে প্রহরের হিজাব ছেড়ে বেরিয়ে আসা চুলগুলো হিজাবের ভিতর রেখে হিজাবটা আবার সুন্দর করে পিন দিয়ে আটকে দিলো আয়ুশ।
কারো হাতের স্পর্শে প্রহর সজাগ হয়ে গেলো প্রহর।সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলো আয়ুশকে। তার দিকে ঝুঁকে আছে আয়ুশ।চকিত নয়নে আয়ু্শের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
প্রহরের চমকে যাওয়া দেখে আয়ুশ প্রহরকে খানিকটা লজ্জা দিতে চাইলো।সে প্রহরের দিকে ঝুঁকেই রইলো।এদিকে আয়ুশ প্রহরের সামনে থেকে সরছে না দেখে প্রহর আরো বেশি বিব্রতবোধ করতে লাগলো। কিন্তু আয়ুশকে কিছু বলতে পারলো না।
আর কোনো উপায় না পেয়ে প্রহর গলা খাঁকারি দিলো।
-—“ উঁ..হু..আ…হু!”
আচমকা প্রহরের গলা খাঁকারানোর আওয়াজ শুনে আয়ুশ প্রহরের সামনে থেকে সরে গিয়ে হাসতে লাগলো।প্রহর অবুঝ বালিকার ন্যায় চুপটি করে বসে রইলো।
এদিকে আয়ুশ হেসেই যাচ্ছে।প্রহর ও কিছু বুঝতে পারছে না।এবার সে বলেই ফেললো,
-—“ আপনি এভাবে হাসছেন কেন?”
প্রহরের কথা শুনে আয়ুশ হাসি থামিয়ে বললো,
-—“ আপনি যে এভাবে গলা খাঁকারি দিতে পারেন,তা আজকে জানলাম ম্যাডাম।”
-—“ তো এতে হাসির কি হলো?এভাবে হাসতে হবে?”
-—“ না মানে,আজকেই প্রথম কোনো মহিলাকে এভাবে গলা খাঁকারি দিতে শুনলাম।”
-—“ ঠিক আর কতোগুলো মহিলাকে দেখেছেন আপনি?”
ভ্রু পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো প্রহর!
-—“ হিসেব আছে নাকি। রাস্তায় বেরুলেই তো কতো মেয়ে দেখা যায়।”
-—“ কি…..! তারমানে আপনি রাস্তায় বের হয়ে মেয়ে দেখেন?”
-—“ কখন বললাম,আমি মেয়ে দেখি!”
অবাক হয়ে বললো আয়ুশ।
-—“ ওমা!একটু আগেই তো বললেন ‘হিসেব আছে নাকি!রাস্তায় বেরুলেই কতো মেয়ে দেখা যায়!’
আয়ুশকে নকল করে বললো প্রহর।
প্রহরের নকল করা দেখে আয়ুশ এবার জোরে হেসে ফেললো।
-—“এর জন্যও হাসতে হয়?” নাক মুখ কুঁচকে বললো প্রহর!
আয়ুশ এবার প্রহরকে রাগানোর জন্য আরও বেশি হাসতে লাগলো।
কিন্তু প্রহর অতোটাও রাগলো না।সে আয়ু্শের একটু কাছে গিয়ে হাতের কনুইয়ের দ্বারা আয়ুশের হাতে একটা মিষ্টি গুঁতো দিতে গেলে আয়ুশ প্রহরের হাত খপ করে ধরে প্রহরকে তার একটু কাছে নিয়ে এলো।
প্রহর কুঁচকানো চোখমুখ আরো খানিকটা কুঁচকে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
প্রহরের মুখের অঙ্গভঙ্গি দেখে আয়ুশ আবারো হেসে ফেললো। আয়ুশের হাসির আওয়াজ শুনে প্রহর চোখ খুলে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে বললো,
-—“ আবার হাসছেন?”
-—“ তো হাসবো না?একটা মাত্র বউ আমার!আর বউটা এমন এমন কথা বলে,না হেসে পারাই যায় না।”
-—“ আমি কি জোকার?”
-—“ না,আপনি আমার ম্যাডাম!”
-—“ তো ম্যাডামের কথা কতটুকু শোনেন আপনি?”
-—“ সবটুকু!”
-—“ কতটুকু?”
-—“ অনেকটুকু,সবটুকু?”
-—“ শুধু মুখে বলছেন কেন?হাত দিয়ে বড় ছোট পরিমাণ করে দেখান।”
-—“ এই যে এতটুকু…….” বলতে বলতে প্রহরের হাত ছেড়ে ওই হাত আর আরেক হাত নিজের সামনে দুই পাশে এনে অনেক বড় করে দেখালো আয়ুশ।
-—“তাই?”
-—“ হ্যাঁ?”
ততক্ষণে প্রহর আয়ুশের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়া পেয়ে আয়ুশের থেকে দূরে গিয়ে বসলো।তারপর বললো,
-—“ এবার ঠিক আছে?”
প্রহরের কথা শুনে প্রহরের চালাকি ধরে ফেললো আয়ুশ।তারপর বিড়বিড় করে বললো,
-—“ নাহ!আমার ম্যাডাম বাচ্চা হলেও পাকনা আছে কিন্তু।”
আয়ুশ বিড়বিড় করছে দেখে প্রহর আয়ুশের থেকে খানিকটা দুরত্ব রেখে জিজ্ঞেস করলো,
-—“ কিছু বলছেন?”
আয়ুশ দু দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে না বললো।
প্রহর গাড়ির আটকানো কাঁচের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আনমনেই মিটিমিটি হাসতে লাগল।আর আয়ুশ….
আয়ুশ প্রহরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ করেই প্রহর আয়ুশের দিকে তাকালো।প্রহর খানিকটা দুষ্টুমি করেই জিজ্ঞেস করলো,
-—“ কি দেখছেন এতো?”
-—“ আমার ম্যাডামকে!”
বলে প্রহরকে আবারো লজ্জায় ফেলে দিলো আয়ুশ।প্রহর এবার নিজের ফোন বের করে অযথাই ফোন ঘাটতে থাকলো।আর আয়ুশ আবারো প্রহরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
প্রহরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার অবসান ঘটলো একটু পরেই।গাড়ির গ্লাসে টোকা পড়ার আওয়াজ হলো।আয়ু্শ পাশ ফিরে দেখলো প্রেমা আওয়াজ দিয়েছে।আয়ুশ ভিতর থেকে গাড়ির লক খুলে গাড়ির দরজা খুলে দিলে প্রেমা ভিতরে এসে বসলো।
প্রহর ও বোনকে দেখে তার সাথে পিছনে এসে বসলো।আর মনে মনে বোনকে ধন্যবাদ দিয়ে ভাবতে লাগলো,
“ যাক,ভালো একটা সময়ে প্রেমা এসেছে।নয়তো কী লজ্জায়ই না পড়ে গিয়েছিলাম!”
আর এদিকে আয়ুশ মনে মনে ভাবছে,
“ কী এক সময়ে এলে শালিকা!”
__
রাত নয়টা বেজে গিয়েছে।সেই সন্ধ্যা থেকে সেই যে জ্যাম লেগেছে,এখন পর্যন্ত ছুটেনি। ঢাকায় আজ এতোটাই বিদঘুটে জ্যাম লেগেছে যে প্রণয় মোটরসাইকেল চালিয়েও প্রহরদের এক গাড়ি আগে বসে আছে।যেতে পারেনি।
আসরের নামাজ পড়ে বাসা থেকে বেরিয়েছিলো আয়ুশ,প্রহর,প্রণয় আর প্রেমা। আধা ঘন্টার রাস্তা পেরোনোর পরপরই তারা পরে তীব্র যানজটে।
সামনের কোনো এক ব্রিজের এক পাশ নাকি একটু ভেঙে গিয়েছে,পাশের রাস্তায় কাজ চলছে। তাছাড়া আরও নানাবিধ কারণে যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
যানজটের ভুক্তভোগী আজ তারা চারজনেই।
প্রথম থেকেই এতো যানজট যে,প্রেমা বাইক থেকে নেমে পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার দাবার,একটা দোকান থেকে পানি কিনে প্রহরের কাছে গিয়ে বসেছে।
প্রণয়কে বলে গিয়েছে,প্রহর হয়তো বোরিং ফিল করছে।তাই সে যাবে।
প্রেমার কথা শুনে প্রণয় তাকে যেতে দিয়েছে।
__
যানজট ছাড়ার আশঙ্কা নেই দেখে একে একে আয়ুশ নিকটবর্তী এক মসজিদে নামাজ পড়ে এসেছে।প্রণয় তাদের গাড়ির খেয়াল রেখেছে।তারপর প্রণয় নামাজ পড়ে আসার পর প্রেমা আর প্রহর মহিলা মুসাফিরদের জন্য আলাদা করে নামাজ পড়ার ব্যাবস্থা করে রাখা কাছাকাছি একটা জায়গায় নামাজ পড়ে এসেছে।
___
রাত সাড়ে নয়টা বাজতে চললো।এখনও যানজট একরত্তি কমেনি।একটানা বসে থাকতে থাকতে প্রায় সব যাত্রীই হাঁসফাঁস করছে।কেউ কেউ গাড়ি থেকে নেমে বাইরে একটুখানি জায়গায় হাঁটাহাঁটি করছে।এজন ও-জনের সাথে ফোনে কথা বলছে,কেউবা ফোন ঘাটছে,কেউবা রাস্তার সাইডে থাকা রেস্তোরাঁয় নাস্তা করার জন্য চলে গিয়েছে।সব মিলিয়ে আশেপাশের অবস্থা কেমন ঘোলাটে হয়ে রয়েছে।
ওইসময় আয়ুশ ঠিক করলো।তারা আজ আর প্রহরদের বাড়িতে যাবে না।
একটু আগেই তার একটা ফোনকল এসেছিল,অফিস থেকে। কয়েকটা কাজের জন্য আগামীকাল সকাল সকাল অফিসে যেতে হবে।কয়েকটা দিন ব্যাস্ত থাকতে হবে তাকে!
তাছাড়া এই জ্যামে বসে থাকতে তাদের অবস্থাও কাহিল।আজকে আর এতো দূরে যাওয়া ঠিক হবে না।
আয়ুশ গিয়ে ফিরে আসতে পারলেও প্রহরকে রেখে আসতে পারবে না।আর প্রহর একদিনেই এতো বেশি জার্নি সহ্য করতে পারবে না।উল্টো তার উপর বেশ ধকল যাবে।এই ভেবে আয়ুশ আর যেতে চাইলো না।সে সবাইকে অফিসের বিষয়ে জানিয়ে বললো,প্রহরদের বাসায় কয়েকদিন পর যাবে।
প্রণয় বাসায় ফোন করে তাদের যেতে না পারার খবর জানিয়ে দিলো।শুনে সাবিনা বেগম খানিকটা মর্মাহত হলেন।আজকে প্রহরদের জন্য অনেক কিছুর আয়োজন করেছিলেন যে!
__
রাত দশটার পর জ্যাম ছুটলো।প্রেমা আয়ুশের গাড়িতেই বসে ছিল।প্রেমা আর প্রহরকে নিয়ে আয়ুশ ইউটার্ন নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বাসায় ফিরে এলো।প্রণয় মোটরসাইকেল করে চলে এলো।আয়ুশ তাকে যেতে মানা করলো
__
পরদিন গোধূলি লগ্নে…
এদিকটায় রাস্তা বেশ ফাঁকা বললেই চলে।এইসময় তো আরও বেশি ফাঁকা।তবে একটু সময় পর জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হতে পারে।
সামনেই একটা ব্রিজ।ওখানেই রাতে অনেক ভিড় হয়।ব্রিজের পাশের রাস্তাটায় রাতের বেলায় বিভিন্ন কাপড়,নানান শিল্প বেচাকেনা হয় বিধায় রাতেই সবাই আসে।কেউ কেউ ব্রিজে দাঁড়িয়ে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করে।বিকেল থেকেই আসা শুরু হয়।রাতে লোক চলাচল আরও বেশি থাকে।
কিন্তু রাতে না এসে এই গোধূলি লগ্নে এসেছে দুইজন ।ব্রিজে পাশাপাশি হাঁটছে তারা।
চলবে…..