আয়ুর প্রহর পর্ব-২৭

0
753

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২৭
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
__

অনীতার মৃত্যুর খবর আয়ুশ বেশ দেরীতেই পেয়েছে ‌‌।কারণ হিসেবে বলা যায়,গত কয়েকমাস ধরেই সে তার অফিসিয়াল কাজে ব্যাস্ত।হাতে নানা কাজ এসে পড়েছিল। বিভিন্ন কেস নিয়েই পড়েছিলো এতোদিন।একদিনের ছুটিটুকু পর্যন্ত পায়নি আয়ুশ।একাধারে তিনদিন ছুটি নেওয়ার জন্য গত তিন মাস ধরে বেশ পরিশ্রম করছে আয়ুশ।এতোটাই পরিশ্রম করছে সে,যা দেখে প্রহর আয়ুশকে বলেছিলো,ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের জব ছেড়ে অন্য কোনো জব করতে।

কেননা,আয়ুশের ডাক পড়তো হঠাৎ করেই ।যেকোনো সময়েই। পড়ন্ত বিকেলে,মধ্যরাতে, প্রচন্ড বৃষ্টিতে, কাঠফাঁটা রোদে।ডাক এলেই চলে যেতে হতো তার!

কোনো কোনো সময় সারাদিন শেষে গভীর রাতে ফিরতো সে।প্রহর অপেক্ষা করেই যেতো। অপেক্ষা করতে করতে কখনো কখনো ঝিমুতো।তবুও আয়ুশের একটা ডাকের অপেক্ষা করতো সে।

দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরার পর ওড়নার আঁচল দিয়ে আয়ুশের কপালের ঘর্মাক্ত মুখ মুছে দিতে কার্পন্য করতো না প্রহর। তবুও অর্ধাঙ্গের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এতো চাপ সহ্য হতো না তারই।তবুও কি আর করা!

আয়ুশ বলেছে,তার জন্য ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে থাকাটা জরুরি।দেশে ক্রাইম বেড়েছে প্রচন্ড পরিমাণে। কিছু সৎ অফিসার থাকলে দেশের উন্নতি হবে।আয়ুশ এখন যে পদে আছে সে পদে থেকে মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে,অসহায় কে সাহায্য করতে পারবে।নির্দোষকে ফাঁসানোর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে,দোষীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবে। মানুষের জন্য কাজ করতে পারবে।

নিজের কাজে নিজেকে সবসময় সৎ রাখে আয়ুশ।তাই সে মনে করে তার থাকাটা জরুরী।যতোদিন না অফিস থেকে তার নামে কোনো রিপোর্ট না আসে,ততোদিন সে মানবকল্যাণেই নিজেকে নিয়োজিত রাখবে,দেশের কল্যাণে কাজ করবে এমনটা বলেছে সে।

তবে সাথে এও বলেছে, স্ত্রীর দায়িত্বে কখনো হেরফের করবে না সে। বিন্দুমাত্র অবহেলা নয়।ঠিকমতো সময় দিবে সে প্রহর কে।তবে আপাতত কিছুদিন তাকে খুব ব্যাস্ত থাকতে হবে।শুরুতে এতো কাজ থাকলেও পরবর্তীতে কাজের চাপ আস্তে আস্তে কমে যাবে।

এমনি করে নানান ব্যাস্ততায় মাস তিনেক কেটে গেলো। সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে আয়ুশ তার ডেস্কে বসে কিছু ফাইল দেখছিলো।তখন হঠাৎ করেই তার ফোনে অনীতার মামার ফোন কল এলো,অনীতা আর নেই!

আকস্মিক এ খবর আয়ুশের মতো শক্তপোক্ত মানুষ ও মেনে নিতে পারলো না।আয়ুশ দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো।ফোনের ওপাশ থেকে এমন খবর শুনে মুহুর্তের মধ্যেই সে বসে পড়ে।হাত থেকে ফোন আপনাআপনি পড়ে যায় ফ্লোরে!

বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে সে।নিজেকে একটু সময় দেয়।

একটু পরই আকাশে নেমে আসে অন্ধকার।ধেয়ে আসে বিশাল এক ঝড়।আয়ুশ নিজের কেবিনে বসে থাকতে পারে না।কেবিনের লাগোয়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টি অনুভব করে আয়ুশ।

হঠাৎ কি মনে করে প্রহরকে ফোন দেয় আয়ুশ।ওপাশ থেকে প্রহর আয়ুশ কে সালাম দেয়।
-—“ আসসালামু য়ালাইকুম।”
-—“ ও_য়ালাইকুমুস.. সালাম ” কোনোমতে সালামের উত্তর দেয় আয়ুশ। বিষণ্ণ শোনায় তার কন্ঠ!

-—“ আপনার কন্ঠস্বর এমন লাগছে কেন? কিছু হয়েছে?” আয়ুশের কথা বলার ধরণে ভয় পেয়ে যায় প্রহর!

আয়ুশ নিরুত্তর।প্রহর আবার জিজ্ঞেস করে,
-—“ কিছু হয়েছে আপনার?আপনার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?কিছু বলছেন ও না।কিছু বলুন!”

-—“ আমার সব হারিয়ে গিয়েছে প্রহর।সব হারিয়ে গিয়েছে।সব শেষ হয়ে গিয়েছে আমার! কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু নেই।”

-—“ কিচ্ছু শেষ হয়নি আপনার।সব ঠিক আছে? কিন্তু আপনি এমন বলছেন কেন?”

-—“ আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা প্রহর। কিচ্ছু না।মনে হচ্ছে সব হারিয়ে ফেলেছি।আমার অন…”
অনীতার মৃত্যুর কথা বলতে গিয়েও বলতে পারে না আয়ুশ।তার কন্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে।

কিছু একটা বুঝতে পারে প্রহর।বেশি কথা বাড়ায় না সে।আস্তে করে আয়ুশকে জিজ্ঞেস করে,
-—“ মন খারাপ?”
-—“ ভীষণ রকম!”
-—“ তাহলে একটা কাজ করুন।বাইরে তো ঝড় বইছে।আপনি নিজের কেবিনে বসে জোরে জোরে কাঁদুন। বৃষ্টি কমে এলে জানালা দিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখুন।যত খুশি পারেন কাঁদুন।এই ঝড়ে আপনার কান্নার আওয়াজ সৃষ্টিকর্তা ব্যাতীত আর কেউ শুনবে না।আপনি সৃষ্টিকর্তাকে মনের আকুলতা সব জানান।সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।”

প্রহরের কথা শুনে সাথে সাথেই ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দেয় আয়ুশ।প্রহরের কথানুযায়ী চিৎকার করে কাঁদতে যেয়ে থমকে যায় সে।
প্রহরের কথা থেকে আরেকটু বেড়ে একটু বাদেই তার সহকর্মীদের অবাক করে দিয়ে এই ঝড়েই ছুটে চলে যায় অফিসের বাইরে।ঝড়ো বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে আয়ুশ।তার সারা শরীর বয়ে চলে পানির ধারা।সাথে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অগণিত অশ্রু।যা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো দৃষ্টিগোচর হয়নি।

রোদন করার সাথে সাথে ভিতরে জমে থাকা সব ব্যাথা প্রকাশ করে চিৎকারে,যা সৃষ্টিকর্তা ব্যাতীত আর কেউ শুনতে পায়নি।

___

তমস্যাচ্ছন্ন রাত।বিকেলের দিকে ধরনীর এই প্রান্তে প্রচন্ড ঝড় বয়ে গিয়েছে।সারাদিনের গরম হাওয়া খন্ডন হয়ে শীতল আবহাওয়া বইছে চারদিকে।বিকেলে বৃষ্টি হলেও আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে।তবে তা আকাশের এক কোণে!যেন গোটা অন্ধকার রুমটার এক কোণে আবছা আলোয় কোনো বালক,বালিকা হাঁটুতে মুখ গুঁজে একা একা কাঁদছে!

কথাটুকু কাল্পনিক হলেও সত্যিই এমন হচ্ছে।তবে কান্না কোনো বালক বালিকার নয়। কাঁদছে আয়ুশ!তার কান্না দেখে কেঁদে দিচ্ছে তার অর্ধাঙ্গিনী;প্রহর!

আয়ুশ অনেক কষ্টে তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে রাতেই।ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরেছে সে।এসে গোসল করে কাপড় পাল্টে একটা সাদা পাঞ্জাবি,সাদা পায়জামা পরিধান করেছে।যেহেতু আজ অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে,তাই ঠান্ডা লেগে গিয়েছে তার।ঠান্ডা লাগার দরুন শরীরে একটা সাদা রঙের চাদর পেঁচিয়ে রেখেছে সে।

বাইরে শীতল আবহাওয়া।প্রহর একটা লম্বা কামিজ পড়েছে আজ।বাইরে ঠান্ডা বাতাস বওয়ার কারণে ওড়নার উপর দিয়ে আরেকটা ধুসর বর্ণের চাদর গায়ে জড়িয়েছে সে।

দু’জন দাঁড়িয়ে আছে ছাদের উপরে‌।ছাদের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দুই হাত বুকে গুঁজে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে দু’জন।

আয়ুশ বাসায় ফিরেও প্রহরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছে।আয়ুশের কান্না দেখে প্রহর ও কেঁদে দিয়েছে।অনীতাকে না দেখলেও আয়ুশের মুখ থেকে অনীতার কথা শুনেছে প্রহর।প্রিয় মানুষের রক্তের এমন পরিণতি দেখলে কান্না আসারই কথা।

এখন সব শান্ত।প্রচুর কেঁদেছে আয়ুশ।চোখমুখ ফুলে আছে তার।চুপ করে প্রহরকে সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বলে প্রহর,

-—“ অনীতা আপুকে দেশে নিয়ে আসা হলো না কেন?”

-—“ বোনটা আমার বলে গিয়েছে,ওকে যেন মামার লন্ডনের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।তাই…”

-—“ আচ্ছা,তাহলে লন্ডন যাবেন কবে?”

-—“ আপাতত যাওয়ার প্রচন্ড আগ্রহ থাকলেও যেতে পারছি না।অফিসে খুব কাজের চাপ। কোনোমতে তিনদিনের ছুটি নিয়েছি।এর বেশি ছুটি নেওয়া সম্ভব নয় এখন।আর আমার পক্ষে তিনদিনে লন্ডনে গিয়ে ফিরে আসাও সম্ভব নয়।”

-—“ আচ্ছা!”

-—“জানো প্রহর!আমার না খুব আফসোস হচ্ছে।বোনটা বেঁচে থাকতে তাকে দেখতে পারলাম না।বুঝতে পেরেছিলাম ও আমার থেকে কিছু লুকিয়েছে। কিন্তু কী সেটা জানতে পারিনি।আজ যখন জানলাম,তখন সে আর এ ধরায় নেই।”
বলতে বলতে চোখে পানি চলে এলো আয়ুশের।

প্রহর আয়ুশের কাঁধে হাত রেখে বললো,

-—“ আপনি এভাবে আর কাঁদবেন না।জোরে জোরে কান্না করলে আপুর আত্না কষ্ট পাবে‌।গুনাহ হবে। স্বাভাবিক হয়ে কান্না করুন। জোরে কান্না করলে বা বেশি মাতম করা ইসলামে জায়েয নেই‌।ইসলাম এটা সমর্থন করে না।দয়া করে আর এভাবে চোখের পানি খরচ করবেন না।আমি আপনাকে একটা কথাই বলি,যদি কাঁদতেই ইচ্ছে হয়,একাকী কাঁদবেন,নিভৃতে!প্রভুর কাছে।কারো সামনে কখনো কাঁদবেন না।”

প্রহরের কথা শুনে আয়ুশ প্রহরের দিকে ফিরলো।চোখে পানি নিয়েই মৃদু হেসে প্রহরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রহরের দু’গালে দু হাত রেখে আয়ুশ বললো,

-—“ কি মিষ্টি তুমি!কি সুন্দর করে সবসময় আমায় বুঝাও,কতো সুন্দর করে কথা বলো!সবসময় এরকমই থাকবে তো প্রহর!আমার হয়ে?”
প্রহর নিজের গালে রাখা আয়ুশের দু হাত নিজের হাতে ধরে বললো,
-—“ সবসময় ইন শা আল্লাহ।আমি আপনারই আছি। মৃত্যুর পরজীবন অব্দি আপনারই থাকবো।”

আয়ুশ আলতো করে প্রহরকে জড়িয়ে ধরে!

চলবে…