#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২৮ (সমাপ্তি পর্ব)
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
পথ-ঘাট পেরিয়ে,মাঠ-ঘাট ছাড়িয়ে,মেঠোপথের বালু উড়িয়ে মধ্যমগতিতে একটা গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে।গাড়ির ভিতর বসে আছে প্রহর আর আয়ু্শ।প্রহর আয়ুশের সাথে সামনেই বসেছে।
আয়ুশের কাজের কারণে প্রহররা আর তার বাসায় যেতে পারেনি।তাই প্রণয় আর প্রেমা কয়েকদিন পরেই নিজ বাসায় চলে গিয়েছিলো।
গতকাল আয়ুশ অফিস থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়েছে।এর মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রহরদের বাড়ি যাবে।
প্রহরের বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে।কতোদিন পর বাড়ি যাচ্ছে সে!তবে তার তেমন সুখকর অনুভূতি হচ্ছে না।
গাড়ি থামলো।আয়ুশ গাড়ি থেকে নামলো। প্রহর বের হওয়ার জন্য তার সাইডের গাড়ির দরজা খুলে দিলো।
হাত দিয়ে প্রহরকে নামতে অভিবাদন জানালো।তা দেখে প্রহর কিঞ্চিৎ হেসে ফেললো। মৃদু আওয়াজে বললো,
-—“ বডিগার্ড!”
-—“ শুধু আপনার ম্যাডাম!”
__
সাবিনা বেগম খবর পেয়েছেন তার মেয়ে আর মেয়েজামাই আজ ফিরবে।তাই মাহতাব হোসেনকে দিয়ে আগেই বাজার করিয়ে রেখেছেন।
প্রণয় বাড়িতে নেই।দুই মাস আগে লন্ডন চলে গিয়েছে।সেখানেই স্যাটেল হতে চায় সে।সাবিনা বেগম চেয়েছিলেন তাকে বিয়ে করিয়ে দিতে। কিন্তু প্রণয় রাজি হয়নি।তার কোনো পছন্দ আছে কি না জিজ্ঞেস করলে সে শুধু মাথা নাড়ায়।বলে ‘কেউ নেই’!
মেয়ের আগমন উপলক্ষে সাবিনা বেগম বেশ আয়োজন করেছেন আজ।হরেক রকম পদ করেছেন তিনি। সঙ্গে প্রহরের প্রিয় হরেক রকম ভর্তা,সাথে ঘন ডাল।
কলিংবেল বেজে উঠলে নিজে গিয়ে দরজা খুললেন তিনি।দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন প্রহর আর আয়ুশকে।আয়ুশ সাবিনা বেগমকে সালাম দিলো।
সাবিনা বেগম সালামের উত্তর নিয়ে প্রহরকে জড়িয়ে ধরলেন।বুঝ হওয়ার পর এই প্রথম মায়ের থেকে এমন উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে প্রহর যেন আদুরে বাচ্চা হয়ে গেলো।চোখে পানি এসে গেলো তার।
একটু সময় প্রহরকে নিজের বুকে জড়িয়ে রাখলেন সাবিনা বেগম। হঠাৎ করেই উষ্ণ পানির স্পর্শ পেলেন তিনি।প্রহর কাঁদছে!
সাথে সাথে মেয়ের মাথা উঠিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো চোখের পানি মুছে দিলেন তিনি।নিজেও কেঁদে উঠলেন।
“ কে গো?প্রহররা এসে পড়েছে নাকি?” সাবিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে এগিয়ে আসছিলেন মাহতাব হোসেন।এসেই দেখতে পান মা-মেয়ের আবেগঘন দৃশ্য।নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাও জোর গলায় বলে উঠেন,
“ ওদেরকে এভাবেই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?ভিতরে নিয়ে এসো।”
সাবিনা বেগমের সম্বিত ফিরে।তিনি মেয়ে আর মেয়েজামাইকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসেন।তাদেরকে সোফায় বসান।
তখনি মাহতাব হোসেন মেয়ের দিকে তাকান।প্রহর তখন বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে বলে উঠে,
-—“বাবা!”
আর কিছু বলতে যাবে,তখনি গলা ভেঙে আসে তার। দাঁড়িয়ে পড়ে সে।
তা দেখে মাহতাব হোসেন মেয়ের দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
-—“ এদিকে আয় প্রহর!আমার বাচ্চা!”
বাবার মুখে প্রহর নামটা শুনে প্রহর তৎক্ষণাৎ বাবার দিকে এগিয়ে যায়। ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবাকে ধরে কাঁদতে থাকে।তাদের আবেগঘন দৃশ্য থেকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে আয়ুশ ও।মনে পড়ে যায় নিজের বাবার কথা।সোফার কভার শক্ত করে চেপে ধরে নিজের আবেগ সংবরণ করে সে।
একটু পর সে প্রহরের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-—“ আমি একটু ফ্রেশ হতাম!”
-—“ হ্যাঁ বাবা এসো এসো। এইদিকে!প্রহরিকা আয়ু্শকে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দাও !”
প্রহর বাধ্য মেয়ের মতো বাবার কোল ছেড়ে দেয়। আয়ুশকে নিয়ে যায় ফ্রেশ হতে।
___
খাবারদাবারের পর্বের সমাপ্তি হলো।ড্রয়িং রূমে বসে আছে মাহতাব হোসেন,সাবিনা বেগম, আয়ুশ প্রহর
আর প্রেমা।
সাবিনা বেগম প্রহরের হাত ধরে বসে আছেন।বারবার বলছেন,“ আমাকে মাফ করে দিস মা,তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি।”
-—“ কি বলছো মা এসব!মা তো মা’ই হয়।সন্তানের কাছে মায়ের কোনো ভুল নেই।ভুল হলেও তার গ্রহণযোগ্যতা নেই।”
-—“ কিন্তু আমি তো ভুল করিনি রে মা।আমি তো অন্যায় করেছি তোর সাথে।দিনের পর দিন,মাসের পর মাস,বছরের পর বছর আমি অন্যায় করে গিয়েছি তোর সাথে।আমায় ক্ষমা করে দিস মা।”
প্রহর আবার কিছু বলতে যাবে,তখন আয়ুশ সাবিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-—“ প্রহরের সাথে এমন কেন করতেন আপনি?”
-—“ উত্তরটা আমি দিই।ওর বলতে অস্বস্তি লাগবে।” বললেন মাহতাব হোসেন।
-—“ একজন বললেই হবে। কিন্তু আমি সঠিক কারণটা জানতে চাই।আপনি সঠিক ও সত্যটা জেনে থাকলে অবশ্যই বলুন।”
-—“ বলছি শুনো!
সাবিনার একটা বোন ছিল।বড় বোন।সাবিনার সাথে তার বড় বোনের খুব মিল ছিলো।দু’জন দু’জনের জান-প্রাণ।দু বোন নয়,যেন একটা প্রাণ।
দু’বোনেরই বয়স হচ্ছে।তাদের মা-বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুর শাশুড়ি তাদের বড় মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজে চলেছেন।
সাবিনার গায়ের রঙ ফর্সা হলেও সাবিনার বড় বোন অর্থাৎ আপার গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা।তাই আপার জন্য বিয়ে তেমন আসতো না।
কিন্তু আপা রুপে তেমন না থাকলেও গুণে ছিলেন ভরপুর।এ কথাটি অনেকেই জানতো।
আস্তে আস্তে পাত্র দেখতে দেখতে একটা পাত্র পরিবারের সবারই পছন্দ হয়।আপাকে জিজ্ঞেস করা হয়,তার অন্য কোথায় পছন্দ আছে কি না! আপা নির্দ্বিধায় না বলে দেয়।বাড়ির সবাই বিয়ের তোড়জোড় করা শুরু করে দেয়।
কিন্তু আপার বিয়ের একদিন আগে আপাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,আপা পালিয়েছে।কার সাথে,সেটা কেউ জানে না।
আপা ছিলেন সাবিনাদের পরিবারের বড় মেয়ে।তাই প্রায় সব আত্নীয়দেরকেই দাওয়াত করা হয়েছিলো।আপার পালানোর ঘটনা সবাই জানতে পেরে আপাকে ছি ছি করতে থাকে।আত্মীয়দের এ কথা ও কথায় সাবিনার বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুর ব্রেন স্ট্রোক করে। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।সাবিনার মাও প্যারালাইসিস হয়ে যান।
সাবিনার আর কোনো ভাই-বোন ছিল না।মা-বাবার এমন করুণ পরিস্থিতিতে কোনো আত্নীয় স্বজন তাদের পাশে ছিল না।মা-বাবাকে একাই দেখতে হতো তার।
মাস পেরিয়ে বছর হতে চললো,মেয়ে ঘরে ফিরলো না।মেয়ের শোকে শোকে বাবা আরো কয়েকবার স্ট্রোক করে মা’রা গেলেন।কয়েকদিন পর মারা গেলেন মা।
জীবন নামক নদীর মাঝসমুদ্রে মা-বাবাকে হারালো সাবিনা।নিজের আপন বলতে কেউ রইলো না।
মা-বাবা যেহেতু আপার জন্য চিন্তা করতে করতে অতিরিক্ত টেনশনে মারা গিয়েছেন তাই বাবা-মায়ের মৃত্যুর জন্য আপাকেই দায়ী করে সাবিনা।”
মাহতাব হোসেন এতটুকু বলে থামলেন।ততক্ষণে সাবিনা বেগমের চোখে পানি চলে এসেছে।
মাহতাব হোসেন কথা শেষ করার পর সাবিনা বেগম ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,
“ আপাকে আমি এখনো বাবা-মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করি। বাবা মা চলে যাওয়ার পর এক আত্মীয়ের সুবাদে এই ভালো মানুষটার সাথে আমার পরিচয় হয়।আমার বিয়ের পর আপাকে আমি অনেক খুঁজেছি।প্রণয়ের যখন ছয় বছর বয়স আপার সাথে একবার যোগাযোগ করেছিলাম এরপর আর তার সন্ধান পাইনি।তাই আপার প্রতি ক্ষোভটা রাগে পরিনত হয়েছিলো।
প্রণয়ের ছয় বছর পর দুনিয়ায় আসে প্রহরিকা।সে জন্মের পরপরই যখন তাকে আমার কাছে দেওয়া হয়,তখন প্রহরিকার মধ্যে আমি আপার ছায়া দেখতে পাই। হুবুহু আপার গায়ের রঙ।আপার চোখ!
আপার প্রতি ক্ষোভ তখনো কাজ করছিলো আমার।তাই প্রহরিকাকে কোলে তুলে নেওয়ার বদলে আমি প্রহরিকাকে অস্বীকার করি।বলি প্রহরিকা আমার সন্তান না।”
এতটুকু বলে কেঁদে ফেলেন সাবিনা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,“ আমি অনেক অন্যায় করেছি আমার মেয়েটার সাথে। মাঝেমধ্যে ভিতরে খুব অনুশোচনায় ভুগতাম। কিন্তু আপার কথা মনে হলেই আমি একটা ট্রমায় চলে যেতাম।নিজের পেটে ধরা মেয়েকে সহ্য হতো না আমার!”
তারপর আবার প্রহরকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
-—“ আমায় ক্ষমা করে দে মা!”
প্রহর মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে বলে,
“ করে দিলাম।’
মা প্রহরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন।প্রহর ও মাকে ধরে বসে থাকে।
আয়ুশ কিছু বলতে চেয়েছিলো।তবে এই মুহূর্তে তার আর বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না ভেবে সে আর কিছু বললো না। শুধু তাদের দেখে গেলো আর শুনলো।
_____
মাহতাব হোসেন রুমে চলে গিয়েছেন।প্রেমা আর প্রহর কথা বলছে।আয়ুশ ফোন ঘেঁটে একজনের ছবি দেখছে।সাবিনা বেগম একটু বেসিনের দিকে গিয়েছিলেন।আসার সময় উনার চোখ যায় আয়ু্শের ফোনের দিকে।কিছু একটা দেখে তড়িৎ পায়ে আয়ুশের দিকে আসেন তিনি।কেমন কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,
-—“ ফটোটা দেখি আয়ুশ!”
সাবিনা বেগমের আচমকা কথায় চমকে যায় আয়ুশ।প্রহর আর প্রেমার আলাপ ও ভেঙে যায়।আয়ুশ ফোনটা এগিয়ে ফটোটা সাবিনা বেগম দেখায়।সাবিনা বেগম ফোনটা হাতে নিয়ে ফটোটা ভালো করে দেখেন।আয়ুশকে জিজ্ঞেস করেন,
-—“ এটা কে?তোমার ফোনে এর পিক কেন?”
-—“ এটা আমার মা।”
-—“ মা!” বিস্মিত হয়ে যান সাবিনা বেগম।
-—“ জি!মা!”
-—“ একেই হ’ত্যা করে..”
-—“ জ্বি আমার মাকেই হ’ত্যা করেছিলেন উনার স্বামী আর উনার স্বামীর পরকীয়া প্রেমিকা।”
আয়ুশের কথা শুনে মাথা ঘুরাতে থাকে সাবিনা বেগমের।তিনি ঢলে পড়ে যেতে চাইলে আয়ুশ তাকে ধরে ফেলে।প্রহর আর প্রেমা এগিয়ে আসে।প্রেমা উচ্চস্বরে বাবাকে ডাকতে থাকে।
সাবিনা বেগমের মাথায় পানি ঢালা হয়।আধা ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে আসে তার।জ্ঞান ফিরলেই তিনি চোখ বন্ধ করে কান্না করতে থাকেন।বলেন,
“ আমার আহানা আপা!”
আয়ুশ বিস্ফোরিত চোখে সাবিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্ফুট স্বরে বলে,
-—“ তার মানে?”
-—“ তোমার মাই সাবিনার আপা আয়ুশ।” মাহতাব হোসেন বললেন।
কিছুক্ষণ সবাই নিরব থাকে।সাবিনা বেগম কাঁদতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর একটু থেমে জিজ্ঞেস করেন,
-—“ আপা কবে মারা গিয়েছে আয়ুশ!”
-—“ যখন আমার বয়স ছয় তখন।”
-—“ আপার সাথে যখন কথা হয়েছিলো,তখন আপা বলেছিলো,‘ জানিস,আমার একটা ছেলে হয়েছে।পুরো রাজপুত্তুর।একদিন তাকে নিয়ে তোদের বাসায় আসবো।তাকে দেখে সব রাগ ভুলে যাবি তুই’।
আপাকে বলেছিলাম তোমার রাজপুত্রর একটা ছবি পাঠাও।আপা বলেছিলো সামনাসামনি দেখবি। কিন্তু তারপর তো আর……..”
সাবিনা বেগম একটু থামেন।উনার কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আছে।ওদিকে আয়ুশ কিছু একটা মনে করে বলে,
“ আমার আবছা মনে পড়ে।তখন আমি খুব ছোট।মা কার সাথে কথা বলেছিলেন খুব হাসিমুখে।তারপর আমায় বলেছিলেন,তোমার খালামণির সাথে দেখা করবে?আমি সায় জানালে মা বলে আমায় একদিন নিয়ে যাবে।
যখন মা আমার সাথে এসব কথা বলছিলেন তখন মিস্টার শামসুজ্জামান চলে আসেন।উনি মাকে কঠিন আদেশ করেন,যেন এখনই পরিবারের সাথে যোগাযোগ না করে।
মা এর প্রতিবাদ করলে বাবা মাকে অনেক কথা শোনান।মাকে প্রায় বন্দীই করে ফেলেন।কোথাও যেতে দিতেন না।”
-—‘ এতোটা অমানুষ ছিলেন আপার পছন্দ করা মানুষটি।যার হাত ধরে পালিয়েছিলো,তার হাতেই কিনা মরতে হলো!আমার আপার কি কপাল!বাবা-মা বেঁচে নেই এটা একপ্রকার ভালোই হয়েছে।ওরা বেঁচে থাকলে হয়তো সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু আপার জন্য কষ্ট হয় আমার,যাকে ভরসা করে গিয়েছিলো,সেই..”
মাঝপথে কথা আটকে দেয় আয়ুশ।বলে,
-—“ মা পালায়নি!”
-—“ পালায়নি?” আশ্চর্যবোধক প্রশ্ন সাবিনার মুখে।
-—“ নাহ ! মা পালায়নি!বাবা মাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন!”
-—“ তুমি কিভাবে জানলে?”
-—“ মায়ের একটা ডায়েরী ছিল।ওইটা পড়েছিলাম ।ওখানেই মা লিখেছিলো,
মাকে রাস্তায় কয়েকদিন উক্ত্যক্ত করে মিস্টার শামসুজ্জামান।মা সেটা বাসায় সবাইকে না জানিয়ে শুধুমাত্র মায়ের বাবা অর্থাৎ আমার নানাভাইকে জানান।
নানাভাই একদিন রাস্তায় মিস্টার শামসুজ্জামানকে দেখতে পেয়ে মাকে উক্ত্যক্ত করতে নিষেধ করেন।পরিবর্তে মায়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো মিস্টার শামসুজ্জামান।কিন্তু নানাভাই প্রস্তাব নাকচ করে দেন।কেননা,তিনি মিস্টার শামসুজ্জামানের চরিত্র সম্পর্কে জানতেন।একটা চরিত্রহীন ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে নারাজ ছিলেন তিনি।
মায়ের বিয়ের আগেরদিন মাকে কল দেয় মিস্টার শামসুজ্জামান।কল দিয়ে বলে,যদি মা মিস্টার শামসুজ্জামানের সাথে না পালায়,তাহলে নানাভাই-নানীসহ পরিবারের সবাইকে মে’রে ফেলবে।
মিস্টার শামসুজ্জামান বখাটে টাইপের ছিলেন।রাজনৈতিক দলের কিছু লোকের সাথে তার উঠাবসা ছিলো।তাই মা তার কথা শুনে ভয় পেয়ে যান।পরিবারের লোকদের,অতি কাছের মানুষদের প্রাণনাশের আশঙ্কায় তিনি পালিয়ে যান।”
-—“ তার মানে আমরা এতোদিন আপাকে ভুল বুঝেছিলাম!আপার প্রতি ক্ষোভ রাখা যথাযথ হয়নি!”
-—“ একদম!”
-—“ আয়ুশ!আমার কাছে একটু আসবে বাবা!তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখি।আপার ঘ্রাণ তোমার মধ্যে থেকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করবো একটু!নয়তো মনের এ জ্বালা যে নিবারণ হবে না রে বাবা!”
সাবিনা বেগমের কথা শুনে আয়ুশ সাবিনা বেগমের পাশে গিয়ে বসে।সাবিনা বেগম আয়ুশের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আয়ুশের হাত ধরে বলেন,পুরো আমার আপার মতো হাতগুলো।আয়ুশের গালে-মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে একটা স্নেহের চুমো খান সাবিনা বেগম।
তারপর বলেন,
-—“ আপা চেয়েছিলেন,যেন আমাদের পরিবারের কারো ক্ষতি না হয়। কিন্তু ক্ষতি তো হলোই।না জেনে আমার আপা’টা মিথ্যে অপবাদের ভুক্তভোগী হলো।বাবা মা চলে গেলো।সাথে আপা নিজেও অকালে প্রাণ হারালো।”
-—“মায়ের দোষ নেই। কিন্তু ভুল ছিলো।না বোঝার কারণে ভুলটা বুঝতে পারেননি।মা আশঙ্কা করেছিলেন পরিবারের জন্য। কিন্তু শামসুজ্জামানের সাথে বিয়ের পর থেকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ ও করতে পারেননি।মারা যাওয়ার আগে এটাও জানতে পারেননি উনার বাবা মা মারা গিয়েছে।আপনার সাথে কোনোমতে যোগাযোগ করেছিলো একবার। কিন্তু……!
যাই হোক, সবকিছুর মুলে রয়েছেন মিস্টার শামসুজ্জামান।আর উনি উনার কৃতকর্মের সর্বোচ্চ শাস্তি অবশ্যই পাবেন।এই দুনিয়ায় ও,ওই দুনিয়ায় ও!”
-—“ এটাই শান্তি! তবে আমার আক্ষেপ আমি আপাকে ভুল বুঝলাম।আপাকে ভুল বুঝে রাগ ঢাললাম নিজের মেয়ের উপর।”
এতটুকু বলে সাবিনা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন।বললেন,
-—“ তোর উপর অবিচার করেছি মা।তোর জীবনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিয়ে নামক জিনিসটার উপর অবিচার করেছি। কিন্তু মনে হচ্ছে,ভুল মানুষটার হাতে তোকে দেইনি।আয়ুশ আমাদের নিজেদের ছেলে।তারপরও যদি তোর মনে হয়, জীবনসঙ্গী ভুল,তুই নির্দ্বিধায় ফিরে আসতে পারিস।আমি ব্যাবস্থা করবো।”
মায়ের কথা শুনে প্রহর বলে,
-—“ আমাকে মেরে ফেলতে চাও মা?”
-—“ মানে?এমন কেন চাইবো?”
-—“ চাইছো নয় তো কী!তাহলে কীভাবে বললে,আমার আয়ু রেখে ফিরে আসতে।আমার আয়ু যে উনি মা!আমার আয়ু ছাড়া আমি বাঁচবো না!”
সব লজ্জা কাটিয়ে বলে উঠে প্রহর।
-—“ আয়ু?” বুঝতে একটু অসুবিধে হয় সাবিনা বেগমের।
-—“ আয়ু নয়তো কি মা!উনার উসিলায়ই তো আল্লাহ আমাকে জীবনের সুন্দর রুপটা দেখিয়েছেন।নয়তো কীভাবে যে বেঁচে থাকতাম! তাইতো উনি আমার আয়ু!আমি আমার আয়ু ছাড়া বাঁচতে পারবো না মা!আমার আয়ু ছাড়া আমি কখনোই থাকতে পারবো না।আর কখনো এমন বলো না প্লিজ।”
এবার সাবিনা বেগম বুঝতে পারেন প্রহরের কথা। মিটিমিটি হেসে বলেন,
-—“ আচ্ছা,আর বলবো না।এখন তোরা দুইজনে আমার পাশে এসে বস।আয় এদিকে!”
আয়ুশ বসাই ছিল।তার পাশে এসে বসলো প্রহর।এগিয়ে এলেন মাহতাব হোসেন। আয়ুশ আর প্রহরের দুই জোড়া হাত একসাথে করলেন সাবিনা বেগম।হাত রাখলেন দুই জোড়া হাতের উপর।মাহতাব হোসেন হাত রাখলেন তিন জোড়া হাতের উপর।সাবিনা বেগম আর মাহতাব হোসেন আয়ু্শকে উদ্দেশ্য করে একসাথে বললেন,
-—“ আমাদের মেয়েটাকে তেমন যত্ন করে বড় করতে পারিনি আয়ুশ।তুমি তাকে দেখে রেখো।কখনো কষ্ট দিয়ো না।যত্নে রেখো তাকে!”
-—“ আমরণ ইন শা আল্লাহ!”
ব্যাস এই একটা কথাই যথেষ্ট!আর কি লাগে!
__
আয়ুশ আর প্রহর এখন নিজেদের বাড়িতে ।একদিন প্রহরদের বাড়িতে থেকে আজই ফিরেছে তারা।
এখন তারা দুইজন ছাদের কোণে রাখা এক দোলনায় বসে আছে।প্রহর আর আয়ুশ একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ আয়ুশ বলে উঠলো,
-—“ তারপর! আমার লজ্জাবতী ম্যাডামের লজ্জা কোথায় গিয়েছিলো ওইদিন!”
-—“ কোনদিন?” আয়ুশের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে প্রহর।”
-—“ ওইযে যেদিন তোমার মাকে বললে,তুমি তোমার আয়ু ছাড়া বাঁচবে না।তোমার আয়ু ছাড়া থাকতে পারবে না!” প্রহরের মাথা টেনে নিজের কাঁধে রেখে প্রহরের কাঁধে হাত পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়ুশ!
আয়ুশের কথা শুনে একটু লজ্জা পেল প্রহর। মৃদুস্বরে বললো,
-—“ এগুলো বলতে লজ্জা পেতে হয় না।মনের সাহস থাকা লাগে বলতে।হুহ!”
-—“ বুঝেছি,আমার ম্যাডামের প্রচুর সাহস!”
প্রহর মৃদু হাসলো।
-—“তো চলুন ম্যাডাম!আজকে থেকে নতুনভাবে নিজেদের গুছাই।নিজেদের শুরু করি নতুনভাবে ।বিলীন করি একে অপরের মাঝে!”
-—“ তবে শুরু করা যাক নিজেদের! নতুনভাবে!” বলে প্রহর আয়ু্শের কথায় সম্মতি দিলো।
তারপর আয়ুশ প্রহরের দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠলো,
“ তুমি সন্ধ্যামালতীর চেয়েও,
ভীষণ মনোমুগ্ধকর
এরপর প্রহর গেয়ে উঠলো,
“ তুমি আমার আয়ু!
আমি আয়ুর প্রহর!”
সমাপ্ত….!