আরেকবার আবর্তন পর্ব-০২

0
18

#আরেকবার_আবর্তন ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৩>
এরপরের এক মাস অদ্ভুত একটা থমকে যাওয়া সময়ের মধ্যে কাটলো শিউলির | শরৎ সত্যিই সেইদিনের বলা কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে | ও আজকাল শিউলিকে দেখলেও না চেনার মতন মুখ করে চলে যায় | চেষ্টা করে যত দূর সম্ভব এড়িয়ে চলার | শরৎ যেন নিজের এই ব্যবহারে শিউলিকে বাস্তবটা বোঝাতে চায় ! ওর যাতে শরতের প্রতি কোনো রকম ফিলিংস বাকি না থাকে আর সেই চেষ্টাই করে যায় ও | যেমন সেবারের লক্ষ্মী পুজোয় শিউলি এসেছিলো ওদের বাড়ি প্রসাদ দিতে | শরতের জন্য নিজে হাতে পায়েস বানিয়েছিলো | আসলে কিছু কিছু জিনিস হয়তো একটা অভ্যেসের মতন হয়ে যায় জীবনে ! যতই আঘাত পাই , আবার যেন সেই আঘাতের কাছেই ছুটে যাই ! আর শিউলি নিজের এই অভ্যেসটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলো না কিছুতেই | তাই তো দশমীর দিন , লক্ষ্মীপূজোর আগে অব্দি শিউলি বেশ কয়েকবার কল করেছিল শরৎকে | দুটো কথা বলতে চেয়েছিলো ওর সাথে ! শুধু কি বন্ধু হয়ে থাকা যায় না ! এটাই জিজ্ঞেস করার ছিল ওর | তবে ফোনটা শরতের বার বারই রিং হয়ে কেটে গেছিলো | ওপাশ থেকে সেই চেনা গলার স্বরটা শিউলি আর শুনতে পায়নি | তবে সেদিন লক্ষ্মী পুজোয় যখন প্রায় এক ঘন্টা ড্রইং রুমে অপেক্ষা করার পরও শরৎ সত্যি নিজের ঘর থেকে বেরোলো না একবারও , সেই মুহূর্তে যেন একটা ধাক্কা লাগলো শিউলির | খুব ছোট লাগলো নিজেকে নিজের কাছে ! সেইদিনই শেষ ছিল তবে | এরপর শিউলি আর ওই এক মাসে শরতদের ফ্ল্যাটে যায়নি একবারও | বাস স্টপে , পাড়ার মোড়ে , ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে , যতবার শরতের সাথে দেখা হয়েছে , শরৎ যেমন অচেনা থেকেছে ! শিউলিও সেই রকম কথা বলতে যায়নি নিজে থেকে | অনেক বুঝিয়ে নিজেকে আটকে রেখেছিলো ও | এতদিনের অভ্যাস , এতদিনের টান , এতদিনের ফিলিংস সব কিছুকে নিজের মধ্যে জমা করে রেখেছিলো যেন | আসলে মনে হয়েছে যার এসবের কোনো দরকারই নেই , তার কাছে বার বার যাওয়ার কোনো মানে হয় না | তার থেকে নিজের সঙ্গেই থাকা ভালো | তবে শরতের নিউইয়র্ক যাওয়ার আগেরদিন ও আর নিজেকে এতো হিসাবের মধ্যে রাখতে পারেনি ! হয়তো শেষ বারের জন্য একবার কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিলো ওই শান্ত ছেলেটাকে ! আর শেষ বার নিজের পুরোনো অভ্যাসটা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলো নিজের জীবনে | তাই অল্প রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলো শরতদের ফ্ল্যাটে | তারপর আর কোনো অপেক্ষা না করেই চলে গিয়েছিলো সোজা শরতের ঘরে | যদিও শরৎ আচমকা এরকম শিউলিকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়েছিল ! তবে আজ চাইলেও খুব কঠিন হতে পারেনি | শিউলিকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারেনি নিজের মুখে | তবে শিউলি সেদিন ওর কাছে এসে কিছু বলেছিলো , খুব দৃঢ় গলায় , ওর শেষ কথা .———– ” সরি , তোমার কথা পুরোপুরি মানতে পারলাম না | খুব নির্লজ্জ তো | তাই এতদিন এতো এভোয়েড করার পরও শেষবার দেখা করতে চলে এলাম | তোমার ওই চিংড়ি মাছের তরকারিটা খুব ভালো লাগতো না ! ওটা বানিয়ে এনেছি | খেও | আর সাবধানে থেকো |”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গিয়েছিলো শিউলি | শরৎ সেই মুহূর্তে আবার একটু কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে বলেছিলো ওকে , ——– ” এসব কেনো করলি ? আমি তো বারণ করেছিলাম | তোর আর আমার মধ্যে একটা ডিসটেন্স থাকাই ঠিক | এটা তোকে বুঝতে হবে |”
শিউলি কথাটা শুনে আলতো হেসেছিলো হঠাৎ | তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একটু দৃঢ় গলায় উত্তর দিয়েছিলো , ——— ” বুঝে গিয়েছি | খুব ভালো করে এই এক মাসে | আর এই আজ শেষবার এলাম | এরপর আর কোনোদিন আসবো না | আই প্রমিস | ভালো থেকো |” …….
কথাটাকে শেষ করেই শিউলি আর অপেক্ষা করেনি কোনো প্রত্তুত্যরের | ঘরটা ফাঁকা করে দিয়ে চলে গিয়েছিলো শরতের কাছ থেকে | হয়তো সারা জীবনের জন্য | তবে এই মুহূর্তে হঠাৎ যেন ভেতর থেকে লাগলো এই শান্ত ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটার ! এরকম তো আগে কখনো মনে হয়নি ! শিউলি কি সত্যি কখনো আর ওর সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করবে না ! প্রশ্নটা না চাইতেও আনমনে করে ফেললো নিজেকে | তবে এই যোগাযোগহীন হয়ে থাকতেই তো শরৎ চেয়েছিলো এক মাস ! তাহলে আজ হঠাৎ এরকম খারাপ কেন লাগলো ! কারণটা নিজে ঠিক বুঝতে পারলো না | কিন্তু পরের দিন এয়ারপোর্ট যাওয়ার আগে ওর সাথে পাড়ার অনেক চেনা লোক , কিছু বন্ধু , আত্মীয় স্বজন প্রায় অনেক চেনা মুখই দেখা করতে এসেছিলো | তবে শরৎ না চাইতেও আনমনে ওই মেয়েটার মুখটাকে খুঁজছিলো আজ | বুঝতে পারছিলো না কেন যাওয়ার আগে একবার দেখা করে ‘ভালো থাকিস’ বলতে ইচ্ছে করছিলো খুব | কাল হয়তো ওর সামনে অতটা কঠিন না হলেও চলতো ! তিন বছর তো এমনিও দেখা হবে না ওদের | মেয়েটা তো ওর জন্যই রান্না করে এনেছিল ! কথাগুলো ভেবে না চাইতেও কেমন একটা খারাপ লাগা এসে ভিড় করছিলো মনে | তবে ট্যাক্সিতে ওঠার আগের মুহূর্তেও যখন অনেক চেনা মুখের আড়ালে সেই মুখটা এলো না আর ! তখন বুঝলো শিউলির কালকের কথাগুলো ঠিক | ও আর সত্যি হয়তো আসবে না কখনো শরতের কাছে ! কথাটা মনে হতেই এই প্রথম চলন্ত রাস্তার আড়ালে হঠাৎ একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওর | দুটো বড়ো বড়ো চোখের মিষ্টি একটা মুখ দেখতে পেলো স্পষ্ট | তবে রাস্তাটা থামলো না ! মাইলের পর মাইল এগিয়ে গেলো ছবিটার থেকে ! অনেকটা সময় আর দূরত্ব এসে ভিড় করলো জীবনে |

<৪>
এইসবের পর ছটা মাস কেটে গেছে | আজ জুন মাসের তিন তারিখ | শরতের জন্মদিন | যদিও ও যতদিন ইন্ডিয়াতে ছিল , নিজেদের লোকের মাঝখানে , ততদিন দিনটার ব্যাপারে আলাদা করে কখনো কিছুই মনে হয়নি ! তবে আজ এই বাইরের দেশে এসে অনেক অচেনার ভিড়ে এই দিনটা না চাইতেও আলাদাভাবে মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছে ওর | প্রত্যেকবার সকালে বাবা ঘুম থেকে ডেকে তুলতো আজকের দিনে | জোর জবরদস্তি করে মন্দির অব্দি টেনে নিয়ে যেত ওকে পুজো দেয়ার জন্য | নিজের হাতে শরতের পছন্দের সবজি বাজার করে আনতো ছেলেকে খাওয়াবে বলে | তখন অবশ্য এইসব বাড়াবাড়ি মনে হলেও আজ এই সসেজ আর গ্রিল্ড স্যান্ডুইচ চিবোতে চিবোতে আলু পোস্ত , দই ফুলকফিকে বড্ডো মিস করছে মনে মনে | যদিও বাবার সাথে কিছুক্ষন আগে স্কাইপে কথা হয়েছে | কিন্তু ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখা , আর সামনাসামনি দেখার মধ্যে তো আকাশ পাতাল তফাৎ ! আর আজকাল মাঝে মাঝে এই বিদেশী মুখগুলোর মধ্যে কেমন যেন মনে হয় হারিয়ে ফেলছে নিজেকে | এতো বড়ো শহর , চোখ ধাঁধানো রাস্তাঘাট , এতো ফাস্ট লাইফের মাঝে নিজের চেনা কলকাতাকে অদ্ভুতভাবে মনে পরে যায় ওর কেমন | ওই ভিড় রাস্তাঘাট ,কালো হলুদ ট্যাক্সি , ভিড়ে ঠাসা বাস , উত্তর কলকাতার পুরোনো ভাঙাচোরা, গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলো চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পায় শরৎ | এই সময় মাঝে মাঝে মনে হয় এতো পারফেকশন কি সত্যি দরকার ছিল জীবনে ! ছোট থেকে ওই ইম্পারফেক্ট শহরটায় বড়ো হয়ে সেটারইযেন একটু অভ্যাস হয়ে গেছে ওর | ওই প্যাচপ্যাচে গরম , রাস্তায় ফুটপাথে হকারদের চিৎকার , অটোর লাইন এইসবই খুব নিজের | সেইসব ছেড়ে এতো দূরে দিনের পর দিন পরে থাকতে কেমন একটা দম বন্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে | আগে ওই শহরে থাকতে কোনোদিনও বোঝেনি , তবে আজকাল রোজ মনে হয় এতটা রাস্তা পার করে আবার ওই পুরোনো গলিগুলোতে ফিরে যেতে পারবে তো ! ওই ফ্ল্যাটের চেনা সিঁড়ি , পুরোনো ছাদটা , শেষ দেখা সূর্যাস্তটার সামনে আবার গিয়ে দাঁড়াতে পারবে তো ! আচ্ছা বাবা ছাড়া কি সেখানে আর কেউ আছে যে আজও অপেক্ষা করছে ওর ? যে হয়তো ক্যালেন্ডারের পাতায় আনমনে মাঝে মাঝে চোখ রাখছে , দিনগুলোর হিসেবে করছে ! কথাটা আজ আবার মনে হতেই শরতের চোখটা আনমনে মোবাইল স্ক্রিনে চলে গেলো হঠাৎ | কিন্তু সেখানে এখনো নিঃস্তব্ধতা ছাড়া আর কিছুই ফেরত এলো না | শিউলি কি তাহলে সত্যি ওকে একবারও জন্মদিনে উইশ করবে না ! মেইলবক্সটাও এতক্ষনে বেশ অনেকবার চেক করা হয়ে গেছে | কাজের কিছু মেলস , আর চেনা বন্ধুবান্ধবের ম্যাসেজ ছাড়া ওতে আর কিছু নেই | তাহলে কি সত্যি আজকের দিনটা ভুলে গেলো মেয়েটা ! যে আগের বছরও এই দিনে ইউটিউব দেখে কেক বানিয়ে এনেছিল সন্ধ্যেবেলা , সে এই বছর একবারও উইশ অব্দি করলো না ! ব্যাপারটা যেন কিছুতেই মানতে পারছে না শরৎ | হ্যাঁ , ও নিজেই শিউলিকে একটা সময় দূরে থাকতে বলেছিলো ওর কাছ থেকে , তবে তার মানে যে আর কোনোদিনও চিনতেই পারবে না ওকে , এতটাও কিছু বলেনি ! না কি শেষদিন একটু বেশিই রুড ছিল শরৎ ! মেয়েটা নিজে থেকে দেখা করতে এসেছিলো ওর ঘরে | কিন্তু শরৎ তো ভালোভাবে কথা অব্দি বলেনি | আচ্ছা , ওর কি উচিত ছিল যাওয়ার আগে একবার শিউলির সাথে দেখা করে যাওয়া ! আসলে এই বাইরের দেশে এতো নতুন নতুন মুখের আড়ালে নিজের লোকের ভীষণ অভাব যেন | তাই পুরোনো সময়ে নিজের যেই ব্যবহারগুলো খুব সহজে করে ফেলেছিলো কিছু না ভেবে , আজকাল সেইসব কিছুই ভীষণ বেশি করে ভাবিয়ে তোলে শরৎকে | মনে হয় এতটা অযত্ন হয়তো না করলেও হতো পুরোনো লোকগুলোর সঙ্গে | বাবার সাথে সন্ধ্যেবেলা একটু অদরকারি কথা বললে হয়তো ভালো হতো , শিউলির সাথে দেখা হলে ওকে হাসি মুখে কেমন আছিস জিজ্ঞেস করলে হয়তো আজকে ফোনটা এইভাবে সাইলেন্ট হয়ে পরে থাকতো না ! সেদিন ছাদে ওকে ঐভাবে একা ফেলে রেখে চলে না এসে ওর হাতটা যদি শক্ত করে ধরে আর একটু ভালোভাবে বোঝাতো নিজের কথাগুলো , তাহলে হয়তো বন্ধুত্বটা টিকে যেত ওদের | না চাইতেও এই ভাবনাগুলো এখন চলে আসে শরতের মনে | তবে নিউইয়র্ক আর কলকাতার মাঝের রাস্তাটা এতো বেশি , যে ভুলগুলোকে ঠিক করা আর হয়ে ওঠে না ওর | ভাবনাগুলো সব মনেই জমে থাকে তাই | নিজের মধ্যে |
এইভাবেই চোখের পলকে সময় কেটে যাচ্ছে | দিন মাসের হিসেবগুলো উল্টে পাল্টে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারে | এর মাঝে আজকাল একটা মুখ মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখতে পায় শরৎ | যখন দিনের পর দিন মেয়েটা সামনে ছিল , তখন তো কখনোই এতো মন দিয়ে দেখেনি শরৎ শিউলিকে ! তবে এতো কিলোমিটার দূরে থেকে , আজকাল কেন সেই মুখটাই স্বপ্নে ভেসে ওঠে শরতের কে জানে ! কেন আনমনে হঠাৎ গলার আওয়াজটা শুনতে পায় ও নিঃস্তব্ধ শীতের এই দেশে ! যাকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়ার কথা ছিল তাকেই যে কেন এত বেশি বেশি করে মনে পরে শরতের তার কারণ সত্যি ঠিক বুঝতে পারে না ও | হয়তো মানুষের মন এরকমই | এতো জটিল , এতো গভীর , যে অনেক সময় নিজেরই হিসাবের বাইরে ভেবে ফেলে অকারণে | যাইহোক , এই বেহিসাবি ভাবনার ভিড়ে প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে ওর নিউইয়র্কে | এতদিনে এখানকার কঠিন শীতের সাথে মানিয়ে নিতে পারলেও এই ফাঁকা ফাঁকা জীবনটার সাথে কিছুতেই মানাতে পারেনি শরৎ | কাজ , বাড়ি , রান্না , ঘুম , এই দেশে শুধু এই চারটে জিনিস করেই দিন কেটে যাচ্ছে ওর | ব্যাংক , কোনো সরকারি অফিসে কাজ , সব কিছুই এতো সিস্টেমেটিক , যে কাজগুলো শেষ হতে সময় লাগে পাঁচ সাত মিনিট | তারপর বাকি থাকে অফুরন্ত সময় | তখন ইউনিভার্সিটি ছাড়া দু কামরার এপার্টমেন্টটাই সঙ্গী | বাকি নাইটলাইফ , ক্যাসিনো , ডিস্ক , এইসবে গিয়ে টাইম পাস্ করা যায় | কিন্তু তার জন্য যেই টাকাটা দরকার সেটা শরতের কাছে নেই | স্কলারশিপের টাকায় , আর ইউনিভার্সিটির কিছু ক্লাস নিয়ে ওকে বেশ হিসেব করেই চালাতে হয় এখানে | এরপর বাড়তি এন্টারটেইনমেন্টের জন্য হাতে কিছু বাঁচে না | যাইহোক , এইভাবে দিনগুলো কাটতে কাটতে হঠাৎ একদিন একটা ঘটনা ঘটলো | শরতের বাবার ফোনে গলাটা খুবই থমকে যাওয়ার মতন শোনাচ্ছিল সেইদিন | শরৎ ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল , তাই নিজেই জিজ্ঞেস করে উঠেছিল , ——— ” কি হয়েছে বাবা ? সব ঠিক আছে ওখানে ? তোমাকে কেমন অন্য রকম লাগছে !”
কথাগুলো শুনে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে উনি উত্তর দিয়েছিলো , ———– ” না , আসলে সকালে একটা ঘটনা ঘটে গেলো এখানে যে মনটা খারাপ ! শিউলির বাবার হঠাৎ স্ট্রোক এটার্ক করেছে | অবস্থা খুবই খারাপ ছিল প্রথমে | এখন যদিও আউট অফ ডেঞ্জার | কিন্তু কোমর থেকে প্যারালাইসিস হয়ে গেছে | বুঝতেই পারছিস | ওর বাবাই তো একমাত্র আর্নিং মেম্বার | এখন যে কি হবে !”
সেইদিন কথাগুলো শুনে শরৎও কিছুক্ষনের জন্য চুপ ছিল | শিউলির বাবার হাসি মুখটা হঠাৎ মনে পরে যাচ্ছিলো ওর | লোকটা সত্যি ভালো মানুষ | এতদিন পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেছে , কোনোদিনও ওনার গলার আওয়াজ শুনতে পায়নি শরৎ ,এতোই শান্ত লোক | তার সাথে এরকম একটা ঘটনা ঘটলো ! ভেবেই খারাপ লাগছিলো ওর | আর শিউলি এই সময় কি করছে ! মেয়েটা তো এমনিতে খুবই নরম সরম | ও এরকম একটা ক্রাইসিস একা একা সামলাচ্ছে কি করে ! কথাটা ভেবে শরৎ সেইদিন আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনি | দেড় বছর বাদে শিউলির নাম্বারটা ডায়েল করেছিল ফোনে | নিউইয়র্কে তখন মাঝ রাত | ইন্ডিয়াতে তার মানে নিশ্চই দুপুর | কথাটা ভাবতে ভাবতেই ওপার থেকে সেই চেনা গলার আওয়াজটা অনেকদিন বাদে ভেসে উঠেছিল কানে | একটু যেন ইন্টারন্যাশনাল নাম্বার দেখে অবাক হয়েই প্রশ্নটা করেছিল শিউলি , ——
” হ্যালো … কে বলছেন ?”
প্রশ্নটা শুনে শরৎ কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলেছিলো , ——- ” আমি শরৎ | কেমন আছিস ? বাবার মুখে কাকুর কথাটা শুনলাম | কেমন আছে এখন কাকু ? ”
প্রশ্নগুলো একসঙ্গে করে ফেলেছিল শরৎ | তবে শিউলি হয়তো ওকে এতদিন বাদে এক্সপেক্ট করেনি এইভাবে | তাই মনে হয় সঙ্গে সঙ্গে উত্তরও দিতে পারেনি | কিছুক্ষন থেমে বলেছিলো , ——- ” আই.সি.ইউ থেকে জেনারেল এ শিফ্ট করেছে বাবাকে | তবে , কোমর থেকে প্যারালাইসিস হয়ে গেছে | জানি না কবে রিকোভার করবে !”
না , বাবাকে ছাড়া এর বেশি নিজের আর কোনো কথা বলেনি শিউলি | শরৎ সেটা আনমনে খেয়াল করেছিল যদিও | তাও কিছু কথা ভেবে বলেছিলো , ———– ” কলকাতায় খুব ভালো নিউরো সার্জেন ডক্টর এম.কে মুখার্জীকে আমি কনসাল্ট করতে পারি তুই চাইলে | উনি মেডিক্যাল কলেজে নিউরো ডিপার্টমেন্টের হেড | আমার সাথে ভালো আলাপ আছে | কাকুর রিপোর্টগুলো আমাকে মেল্ করে দিলে আমি কথা বলতে পারি |”
শিউলি এতো কিছু শুনে একটু ভেবে একটা অন্য কথাই জিজ্ঞেস করেছিল সেইদিন , —— ” ওনার ফিজ কত ?”
শরৎ প্রশ্নটা শুনে একটু ইতঃস্তত হয়ে বলেছিলো , —— ” সেটা তো ভালোই | একটা এপয়েন্টমেন্টের জন্য সাত থেকে দশ হাজার মতন চার্জ | কিন্তু সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না | আমি রিকুয়েস্ট করলে উনি এমনিই দেখে দেবেন |”
শিউলি এরপর আর বেশি কথা বাড়ায়নি শরতের সঙ্গে | কথাটাকে ওখানেই থামিয়ে বলেছিলো , ——– ” না থাক | দেখাতে হলে তো বার বার এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে | আর প্রত্যেকবার তুমি কেন রিকুয়েস্ট করবে আমাদের জন্য ! এইসবের দরকার নেই | আমরা যেই রেঞ্জের ডাক্তার এফোর্ট করতে পারবো তার কাছেই যাওয়া ভালো | কিন্তু তুমি যে এতো ব্যস্ততার মধ্যে আমার বাবাকে নিয়ে এতটা ভেবেছো , তার জন্য সত্যি থ্যাঙ্ক ইউ | যাইহোক , আমাকে একটু বেড়োতে হবে এখন | কিছু কাজ আছে | রাখছি | ভালো থেকো |”
কথাটা শেষ করেই শিউলি আর কোনো প্রত্তুত্যরের অপেক্ষা করেনি | ফোনটা রেখে দিয়েছিলো নিজে থেকেই | শরৎ তবে একটু অবাক না হয়ে পারেনি থাকতে ! আজ অব্দি শিউলি ওর কোনো কথায় না বলেনি | এই প্রথম এইভাবে ওর কথাটাকে এড়িয়ে গেলো মুখের ওপর | তা ও এরকম একটা বিপদের সময়ে ! আর শেষে কি বললো যেন ! ‘ব্যস্ততার মাঝে ফোন করার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ !’ তার মানে এই দেড় বছরে ও কি শরৎকে এমন একটা মানুষ ভাবতে শুরু করেছে যে শুধু নিজের কাজ , নিজের জগৎ ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না | যার কাছ থেকে একটা সামান্য ফোন কলও আর আশা করা যায় না ! কথাগুলো না চাইতেও এই মুহূর্তে মনের মধ্যে এসে ভিড় করলো শরতের | আর মনে পরে গেলো সেই ফেলে আসা এক মাস | সেই সময় যতবার শিউলির সাথে রাস্তায় ঘাটে , ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে , করিডোরে দেখা হয়েছে , শরৎ মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে | ঐবার লক্ষী পুজোয় শিউলি প্রায় দু ঘন্টা অপেক্ষা করেছিল ওর একবার দেখা পাওয়ার জন্য | কিন্তু শরৎ ইচ্ছে করেই নিজের ঘর থেকে বেড়োয়নি | ওর ফোন ধরেনি | যতটা সম্ভব শুধু এভোয়েড করে গেছে ওকে | সত্যিই তো , একটা সময় যার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার কেউ পেয়েছে , তার হেল্প হঠাৎ সে নেবে কেন ! শরৎ হলে তো ফোনে কথা অব্দি বলতো না | শিউলি তো তা ও ভদ্রতা করে কিছু শব্দ খরচ করেছে | কথাগুলো ভেবে নিজেরই নিজের ওপর রাগ হচ্ছে এখন | হঠাৎ কারোর কাছ থেকে খুব দূরে সরে যাওয়ার কষ্ট হচ্ছে মনে মনে | আসলে শিউলির সাথে এখন ওর যেই দূরত্বটা , সেটা শুধু রাস্তার না , মনের | আর এই মনের দূরত্ব কমানো খুব সহজ কাজ না | আর যেই দূরত্বটা আবার ও নিজেই যেচে পরে তৈরী করেছিল একটা সময়ে ! সেটা শেষ করা তো আরোও অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে |
চলবে।