#আরেকবার_আবর্তন ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>
এসবের পর তিনটে দিন কেটে গেছে | তবে শরৎ এই তিনদিন যতবার চোখ বন্ধ করেছে ততবার ওই পাঁচ আঙুলের দাগ বসানো নিষ্পাপ একটা মুখ ভেসে উঠেছে চোখের সামনে | শিউলি এইভাবে মারধর সহ্য করে কি করে এরকম একটা ছেলের সাথে রিলেশন রেখে চলেছে এটাই মাথায় ঢুকছে না ওর ! এর মধ্যে কয়েকবার কল করে জিজ্ঞেস করার চেষ্টাও করেছিল শিউলিকে কারণটা | কিন্তু শরতের নম্বর দেখেই মনে হয় , শিউলি ওর ফোন রিসিভ করেনি | এই সময় অসহ্য লাগছে শরতের | এতো অচেনা হয়ে থাকার কি আছে মেয়েটার ! তিন বছর আগে কি বলেছিলো সেই কথা ধরে এতদিন ধরে বসে থাকতে হবে ! আরে বাবা মানুষের তো ভুল হয় না কি ! ওই শেষ এক মাস ধরেই কি সারা জীবন জাজ করে যেতে হবে ! কথাগুলো আজও আনমনে মনে এসেছিলো ওর | এই সময় কেমন গুমোট লাগে ভেতরে | কলকাতার ওয়েদার , নিজের ঘর , চারিদিকের দেয়ালগুলোকে যেন অসহ্য লাগে একসঙ্গে | তাই ব্যালকনিতে গিয়েছিলো শরৎ একটু খোলা আকাশ পেতে | কিন্তু ব্যালকনিতে এসেই নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লাল গাড়িটার দিকে চোখ আটকে গেলো হঠাৎ | শিউলিকে নিয়ে ওই পার্থ ছেলেটা ওর চোখের সামনে গাড়িতে উঠলো | দৃশ্যটা দেখেই কেমন ওই পাঁচ আঙুলের দাগটা মনে পরে গেলো শরতের | এই ছেলেটার সাথে কোথায় যাচ্ছে শিউলি ! এইরকম একটা ছেলের সঙ্গে কি ওর একা বেড়োনো ঠিক ! কথাটা ভাবতেই ও আর এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না ব্যালকনিতে | সোজা নিচে নেমে নিজের গাড়িটা বার করলো | ততক্ষনে যদিও ওই লাল গাড়িটা বেড়িয়ে গেছে | তবে কিছুটা রাস্তা যেতেই শরতের চোখ ভিড় রাস্তার মাঝে ওই গাড়িটা ঠিক খুঁজে পেয়ে গেলো | তারপর ফলো করতে করতে যেখানে এসে দাঁড়ালো সেটা একটা কলকাতার হোটেল এন্ড বার | অদ্ভুত তো , এই রাত্রিবেলা নটার সময় একটা মেয়েকে নিয়ে কেউ এরকম জায়গায় আসে ! কথাগুলো আপনাআপনি মনে এসে ভিড় করলো | তবে এই মুহূর্তেই শরৎ যদি শিউলির আর পার্থর সামনে যায় তাহলে শিউলি হয়তো ওকে দেখেই চলে যেতে বলবে এখান থেকে ! এই মেয়ে তো আবার আজকাল নিজের কোনো ব্যাপারেই জড়াতে চায় না শরৎকে | কিন্তু শরৎ তো ওর কথা শুনে অন্ধের মতন বসে থাকতে পারে না ! তাই ওদের থেকে দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসেছিল সেইদিন | কিছু কিছু সময় আড়ালে থাকাই ভালো | অন্তত শিউলি চোখের সামনে তো আছে | যে কেউ যখন তখন ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না | এইসবই ভাবছিলো দূরে বসে বসে | আর অপেক্ষা করছিলো | যদি আজ এই ছেলেটার শিউলির সাথে কোনো রকম উল্টো পাল্টা কিছু করতে আসে , তাহলে সত্যি আজ শরতের একদিন কি ওর | এইসবে ভাবনার ভিড়েই দু ঘন্টা কেটে গেলো | আর শরতের চোখের সামনেই ছেলেটা মদের নেশায় চুর হয়ে টেবিলের ওপর ঝিমিয়ে পড়লো আস্তে আস্তে | তার মাঝখানে বার ডান্সারদের সঙ্গে নাচ , বেহেল্লাপনা সবই করেছে লিমিটলেস ভাবে | আর শিউলি এইসবের মধ্যে একটা মোমের পুতুলের মতন ওদের টেবিলে বসেছিল চুপচাপ | যেন অপেক্ষা করছিলো কখন এই ছেলেটার পার্টি শেষ হবে আর এইভাবে মদ খেয়ে ঝিমিয়ে পড়বে নিজেই ! শরৎ অবাক হয়ে যাচ্ছিলো সেদিন শিউলির এই রিয়্যাকশনে ! এইরকম একটা ছেলেকে ও এতক্ষন ধরে সহ্য করছে কি করে ! কিছু মাথায় ঢুকছে না ওর | তখনই খেয়াল করলো ঝিমিয়ে পড়া পার্থকে এবার শিউলি নিজের কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে করে দাঁড় করালো | তারপর ওকে বয়ে বয়ে বাইরের গাড়ি অব্দি নিয়ে এলো | তবে এর মধ্যে পার্থ ছেলেটা নেশার ঘোরে নানা রকম উল্টো পাল্টা গালাগালি দিতে শুরু করেছে | শিউলি সেসবের মধ্যেই কোনোমতে ওকে সামলানোর চেষ্টা করছিলো | তবে গাড়ি অব্দি এসেই পার্থ আর টাল রাখতে পারলো না নিজের | হঠাৎ উল্টে পরে গেলো রাস্তার ওপর | শিউলি কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন থমকে গেছিলো এই সময়ে | রাস্তার অনেক লোকই আসলে এখন ওদের দিকে তাকিয়ে | পার্থ এতক্ষন ধরে এতো লেভেলের মাতলামি করছিলো আসলে ! কিন্তু শিউলি এর মধ্যেও দু সেকেন্ড সময় নিয়ে আবার পার্থকে রাস্তা থেকে তোলার চেষ্টা করলো | ওদের গাড়ির ড্রাইভারটাও এগিয়ে এলো এবার , পার্থকে ধরে তুলবে বলে | তবে এই মুহূর্তে হঠাৎ আরো একজন চোখের পলকে শিউলির সামনে এসে হাজির হলো | শরৎ অনেক্ষন ধরে দূর থেকে পার্থর চরম মাতলামোটা দেখছিলো | তবে পার্থ উল্টে পরে যাওয়ার পর আর সেটা সম্ভব ছিল না | শিউলির রাস্তার এতো লোকের সামনে লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ও আর আটকাতে পারলো না নিজেকে | শিউলির পারমিশন ছাড়াই ওকে হেল্প করতে চলে এলো তাই | তবে শিউলি হঠাৎ এই দূরের মানুষটাকে দেখে বলে উঠেছিল অবাক হয়েই ,
——- ” তুমি এখানে কি করছো ?”
শরৎ এবার একটু দৃঢ় গলায়ই উত্তর দিলো , ——- ” সেটা পরে জানলেও চলবে | আগে এই মাতালটাকে গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করি |”
শিউলি কথাটা শুনে কেমন নিরুত্তর হয়ে গেলো | দু দিন বাদে ওর এইরকম একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে এটা শরৎ জেনে গেলো ! ভেবেই কেমন লজ্জা লাগছে নিজের | যাইহোক , ওরা সবাই মিলে এরপর ধরাধরি করে পার্থকে কোনো মতে গাড়িতে তুললো, অনেক কষ্টে | কিন্তু শিউলি এবার পার্থর গাড়িতে উঠতে যাওয়ার সময়ই হঠাৎ ওর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো শরৎ | তারপর শিউলির কিছু বলার আগেই নিজে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিলো | শিউলি এই সময় বেশ অবাক হয়েই ওর দিকে তাকিয়ে ছিল , তখন শরৎ সেই দৃঢ় গলায়ই বললো , ———- ” তোকে এই মাতালটার সঙ্গে এতো রাত্রে একই গাড়িতে আমি কিছুতেই যেতে দেব না | তুই আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরবি | এখনি |”
সেদিন শরতের গলায় এতো অদ্ভুত একটা জোর ছিল যে শিউলিও মুখের ওপর না বলতে পারেনি | হঠাৎ যেন ছোটবেলা থেকে চেনার একটা অধিকারবোধ এসে জমা হয়েছিল ওর গলায় | শিউলি তাই কিছু না বলেই সেই সময় শরতের সঙ্গে ওর গাড়িতে গিয়ে বসেছিল | তারপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওই বার , ওই রাস্তা , ওই মদের নেশার গন্ধে ভরা পরিবেশটা ছেড়ে ওরা বেড়িয়ে এসেছিলো অনেক দূরে , কলকাতার এলোমেলো রাস্তায় | শিউলি এই পুরো সময়টাই চুপ ছিল | অনেক্ষন গুমোট হয়ে থাকার পর গাড়ির জানলার কাঁচ ভেদ করে যেই দমকা হাওয়া এসে লাগছিলো ওর চোখে মুখে , তাতে প্রাণ ভোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো শিউলি | সেই মুহূর্তেই হঠাৎ শরৎ গাড়িটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লো মাঝ রাস্তায় | শিউলির কিছু বোঝার আগেই ওকে এবার বেশ উত্তেজিত গলায় ডিরেক্টলি জিজ্ঞেস করলো শরৎ , ——– ” কি করছিস তুই এইসব ? কেন বিয়ে করছিস এইরকম একটা যা তা ছেলেকে ? প্রব্লেমটা কি তোর ? ”
শিউলি এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে শুনে দু সেকেন্ড চুপ ছিল | তবে ও জানতো , শরৎ পার্থর যেই রূপ দেখেছে , এরপর এই প্রশ্নগুলো করবেই | কিন্তু ওর এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলার নেই | তাই দৃঢ় গলায়ই উত্তর দিলো , ———– ” আমি কি করবো নিজের লাইফে সেটা আমার ডিসিশন | এই ব্যাপারে তোমার না জানলেও চলবে | তুমি এতদিন বাদে দেশে ফিরেছো , নিজের লাইফটাকে এবার এনজয় করো | শুধু শুধু বাইরের লোকেদের ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়ে লাভ নেই |”
শরতের এবার সব ধৈর্য শেষ হয়ে গেছে | ও আর নিজের রাগটা কন্ট্রোল করতে পারলো না | চেঁচিয়েই বলে উঠলো তাই , ——— ” তোর কি সত্যি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে ? এখনো আমাকে কিছু শেয়ার করবি না ! বুঝতে পারছিস এই লোকটার সাথে বিয়ে হলে তোর পুরো লাইফটার কি অবস্থা হবে ? মারে ও তোকে | মদ খেয়ে মাতলামো করে সবার সামনে | আর এটা কোনো পুরোনো বাংলা সিনেমা না , যে বিয়ের পর তোর মাতাল হাজবেন্ড একদম রোম্যান্টিক , ভালো , ভদ্র হয়ে যাবে | তোকে বিশাল ভালোবাসতে শুরু করবে ! বাস্তবটা অনেক কঠিন | আর বিয়েটা কিন্তু সারা জীবনের জন্য শিউলি |”
না , এতো কথা শুনে শিউলিও আর চুপ থাকলো না | সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো এবার , ——— ” জানি আমার পুরো লাইফটা কি ভয়ঙ্কর হবে এই পার্থর সাথে বিয়ের পর | খুব ভালো করে জানি | আর এখন আমি বাস্তবেই বাঁচি | আর সবার প্রথম বাস্তবটা চিনতে তো তুমিই শিখিয়েছিলে | তিন বছর আগে | খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলে লাইফে ফেয়ারিটেল লাভস্টোরির কোনো জায়গা হয় না | আর আমি সেইসব আমার জীবনে আর এক্সপেক্টও করি না | যেটা করছি সেটা আমাদের অবস্থার কথা ভেবেই করছি | আমার বাবা মার্ কথা ভেবে করছি | এবার প্লিজ এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন কোরো না | আর যদি করোও , আমি কোনো উত্তর দেব না | ”
এতগুলো কথা একসঙ্গে শুনে শরৎ এবার নিজে কেমন নিরুত্তর হয়ে গেলো | সত্যিই তো | তিন বছর আগে বাস্তবটা চিনতে শরৎই তো শিখিয়েছিলো শিউলিকে | তবে ভাবেনি যে শিউলি সত্যিই এই তিন বছরে সেই শেখাটাকে এতো বেশি করে নিজের জীবনে নিয়ে চলবে ! ওই পুরোনো ‘আমি’ টা কে একেবারে হারিয়ে ফেলবে নিজের মধ্যে ! খারাপ লাগা , কষ্টগুলোকে চেপে রেখে রেখে বাইরে থেকে একটা কঠিন পাথরের মতন হয়ে যাবে ও ! যে আর নিজের কথা কাউকে বলে না | নিজের ইমোশনস কারোর সাথে শেয়ার করে না | শুধু চুপচাপ সহ্য করে যায় | কিন্তু শরৎ তো নয় অনেক দূরের লোক ! কিন্তু শিউলির মা বাবা ! তারাও কি কিছু জিজ্ঞেস করে না ওকে ! ওর মারের স্পষ্ট দাগগুলো দেখতে পায় না চোখের সামনে ! ওর গালের পাঁচ আঙুলের ছাপটা কি নজরে আসে না ওদের ! কি করে পারে তারপরেও পার্থর মতন একটা ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে ! প্রশ্নগুলো সেদিন চলন্ত রাস্তায় ড্রাইভ করতে করতে বার বার মাথায় এসে ভিড় করছিলো ওর | কিন্তু উত্তর খোঁজার জন্য শুধু ভাবলেই চলবে না | ডিরেক্ট গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে ওদের | শিউলি চুপ থাকলেও ওর বাবা মা অন্তত একটা উত্তর নিশ্চই দেবে শরৎকে |
<৮>
কথাটা মনে আসার পরের দিনই শরৎ দেরি না করে হাজির হয়েছিল শিউলিদের ফ্ল্যাটে | ইচ্ছে করেই দুপুরের দিকে গেছিলো ও , কারণ এই সময়ে শিউলি স্কুলে পড়াতে যায় | ওর না থাকাটাকে কাজে লাগিয়েই শরৎ আজ ডিরেক্টলি প্রশ্নগুলো করে ফেলেছিলো শিউলির মা বাবাকে | কোনো রকম ভনিতা না করেই বলেছিলো ও, ———–
” আপনারা পার্থর ব্যাপারে ঠিকভাবে খোঁজ নিয়েছেন কখনো ? জানেন ও ড্রিংক করে মাতলামো করে , গালাগালি দেয় ? এমনকি আপনাদের মেয়েকে ধরে ধরে চড় থাপ্পড়ও মারে মাঝে মাঝে ! আপনারা কখনো খেয়াল করেননি ওর গায়ে মারের দাগগুলোকে ? আপনারা কি সব জেনে শুনেই শিউলির বিয়ে দিচ্ছেন ওরকম একটা ছেলের সঙ্গে ?”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেছিলো ও | তারপর খেয়াল করেছিল শিউলির মা বাবার অন্ধকার মুখগুলোকে | জলে ঝাপসা হয়ে যাওয়া ওদের চোখ দুটোকে | আর পুরো ঘরটায় ছড়িয়ে থাকা অদ্ভুত একটা নিঃস্তব্ধতাকে | যেন শরৎ ওনাদের সামনে একটা আয়না ধরে দাঁড়িয়ে আছে আজ ,দেখেও না দেখা অনেক কথা , অনেক প্রশ্ন নিয়ে |তবে বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারেনি ওরা | এতদিনের চাপা যন্ত্রনাটা হঠাৎ যেন এই প্রশ্নগুলোর সামনে এসে থমকে গেছিলো কয়েক মুহূর্ত | তারপর শিউলির বাবা ঘরের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠেছিল , ———– ” আমার হাত পা বাঁধা যে শরৎ | জেনেও কিছু করার ক্ষমতা নেই আমার এই হুইল চেয়ারে বসে | আমার যখন সেরিব্রাল স্ট্রোকটা হলো , হুট্ করে যেন সব কিছু বদলে গেলো চারিদিকে | প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতাম | যা জমানো ছিল সেই টাকা দিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কিনেই সব শেষ | ভরসা শুধু ছিল ওই মাইনের কটা টাকা | কিন্তু পা দুটো কাজ করা বন্ধ করে দেয়ায় চাকরিটাও চলে গেলো হাত থেকে | তখন বাধ্য হয়ে সংসার খরচ , আমার ট্রিটমেন্টের জন্য পার্থর বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলাম | ভেবেছিলাম ছোটবেলার বন্ধু | এই টুকু হেল্প নিতেই পারি | আস্তে আস্তে শোধ করে দেব | কিন্তু এক বছর বাদে পার্থর বাবা শর্ত দিলো হঠাৎ ! হয় ওর পুরো টাকা ইন্টারেস্ট সমেত ফেরত দিতে হবে কদিনের মধ্যে , নইলে আমার মেয়ের সঙ্গে ওর ছেলের বিয়ে দিতে হবে | এমনকি একদিন তো বাড়িতে গুন্ডা অব্দি পাঠিয়েছিল শাঁসানোর জন্য | আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো ওরা হুইল চেয়ার থেকে | তোমার কাকিমাকে পর্যন্ত ছাড়েনি | দেয়ালে চুলের মুঠি ধরে মাথা ঠুকে দিয়েছিলো ওরা | আর ভয় দেখিয়ে গিয়েছিলো যে ওদের কথা না শুনলে ওরা আমার মেয়েটাকে রাস্তায় ফেলে রেপ করে দিতে পারে যে কোনো সময়ে |আসলে পার্থর বাবা পার্টি করে | তাই অনেক পলিটিক্যাল কনেকশন আছে | অনেক ক্ষমতা ওর | তখন আমি কি করতাম বলো ? রাজি না হয়ে কোথায় যেতাম ! ওর ছেলে ক্যারেক্টারলেস , মাতাল সব জেনে শুনেও বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলা ছাড়া তো আর কোনো উপায় ছিল না আমার কাছে ! জানি আমি , শিউলি কোনোদিনও এইরকম একটা বিয়ে করে সুখী হবে না জীবনে | শান্তি পাবে না ও | তবে বেঁচে তো থাকবে ! বিয়েটা না দিলে তো ওরা হয়তো যে কোনো দিন আমার মেয়েটাকে রেপ করে মেরে ফেলবে চোখের সামনে ! তখন কি করবো আমি ! আর তো ফিরে পাবো না মেয়েটাকে ! তাই সব জেনে শুনেও আমাকে চুপ থাকতে হচ্ছে |”
কথাগুলো এক টানা বলে শিউলির বাবা এবার থামলো | গলার স্বরটা আসলে বন্ধ হয়ে আসছে ওনার , কান্নায় | নিজের মেয়েকে একটা ভয়ঙ্কর কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেয়ার যন্ত্রনা এসে ভিড় করছে ওনার গলায় | কেন যে সেইদিন কোনো কিছু না ভেবে বিশ্বাস করে টাকাগুলো ধার নিয়েছিল ! নইলে আজ দিনগুলো হয়তো একটু অন্য রকম হতো | মেয়েটার জীবনটা বেঁচে যেত ! কথাগুলো মনে আসতেই এবার শরৎ একটা প্রশ্ন করলো ,—— ” কত টাকা দিতে হবে পার্থর বাবাকে আপনাদের ? এমাউন্টটা কি ? ”
শিউলির বাবা কথাটা শুনে নিজের মনেই বলে উঠলো , ——— ” দশ লাখ টাকা | ইন্টারেস্ট মিলিয়ে |”
শরৎ এবার কিছু না ভেবেই বলে উঠলো , ——– ” টাকা যদি আমি দিই ? তাহলে বিয়েটা বন্ধ হবে ?”
শিউলির বাবার কথাটা শুনে হঠাৎ যেন ঘোরটা কাটলো | খুব অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন উনি , ——- ” তুমি টাকা দেবে ! কিন্তু তুমি এতো টাকা কেন দিতে যাবে ! আর তোমার কাছ থেকে এইভাবে টাকা আমিই বা নিই কি করে ? না না | এইভাবে হবে না |”
শরৎ ওনার কথাগুলোকে আর এগোতে না দিয়ে এখন বেশ জোর দিয়েই বললো , ———– ” কাকু ওরকম একটা খারাপ লোকের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়ার থেকে আমার থেকে নেয়াটা ভালো নয় কি ! এট লিস্ট আপনার মেয়েটা তো বেঁচে যাবে | প্লিজ , আমার কথাটা শুনুন | ঐরকম একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে শিউলি হয় সুইসাইড করবে , নইলে ওই পার্থই মেরে মেরে কোন দিন ওকে খুন করে দেবে | তাই বলছি , আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দিয়ে দিন ওকে | ইন্টার্নশিপ থেকে যা পেয়েছি , আর এই তিন বছর বাইরে স্কলারশিপ থেকে যত টুকু জমাতে পেরেছি তাতে পাঁচ লাখ হয়ে যাবে | আর বাকি পাঁচ লাখ আমার বাবা আমার জন্য ফিক্স ডিপোজিট এ রেখেছিলো সেটা থেকে নিয়ে নেবো | ইজিলি হয়ে যাবে দশ লাখ | ”
শিউলির বাবা এতো কিছু শুনে এবার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন শরতের দিকে | বিশ্বাস হচ্ছে না , কেউ নিজের সব টুকু দিয়ে ওর মেয়ের জন্য ভাবতে পারে ! তাই আপনাআপনিই বলে ফেললেন উনি , ———– ” তুমি সত্যি এতো বড়ো একটা হেল্প করবে আমাদের ? এতটা করবে আমাদের জন্য ?”
শরৎ এই কথার আর কোনো উত্তর দিলো না এই মুহূর্তে | শুধু শিউলির বাবার অসহায় হাত দুটো খুব শক্ত করে ধরলো নিজে থেকে | কিছু প্রশ্নের আসলে কোনো উত্তর হয় না ! শব্দগুলো খুব বেমানান হয়ে যায় তখন | আর শুধু কি শিউলির জন্য ! ও তো নিজের জন্যও নিজের সব টুকু দিচ্ছে | তবে এই সত্যিটা শুধু শরতের মন জানে | আর কেউ না |
চলবে।