আরেকবার আবর্তন পর্ব-০৫

0
17

#আরেকবার_আবর্তন ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
সেদিনের পর দুটো দিন কেটে গেছে | শরৎ এর মধ্যে একটা হসপিটালে জয়েন করেছে এখানে | আজই ফার্স্ট ডে ছিল | ফিরতে রাত আটটা বেজে গেছিলো তাই | তবে ওদের এপার্টমেন্টের সামনে এসেই পা টা থমকে গেছিলো হঠাৎ | গেটের একটু সামনে শিউলি দাঁড়িয়ে | মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওর জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলো এতক্ষন | তবে ওর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আজ শিউলি ওর দিকে এগিয়ে এলো নিজে থেকে | তারপর শরৎকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজে বলে উঠলো ,
———- ” তুমি কেন টাকা দিয়েছো আমাদের ? আমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে যাওয়ার আগে একবারও আমার সাথে কথা বলার দরকার মনে করলে না ! একবারও জিজ্ঞেস করার কথা মনে হলো না যে আমি কোনো হেল্প চাই কি না ! তিন বছর আগে তো তুমি আমাকে হঠাৎ করে চেনাই বন্ধ করে দিয়েছিলে | তাহলে এখন কি হলো ? না কি এতদিন বিদেশে থেকে ফেরার পর দেশে এসে গরিব দুঃখীদের জন্য কিছু চ্যারিটি করতে ইচ্ছে করেছে , তাই আমাকে দেখে নিজের ইচ্ছে পূরণ করলে ! দ্যাখো , আমি চাই না তুমি কোনো ঝামেলায় জড়াও | এই দেশে অনেক অনাথ আশ্রম , বৃদ্ধাশ্রম আছে , যদি চ্যারিটি করার খুব ইচ্ছা থাকে তাহলে সেখানে গিয়ে হেল্প করো | কিন্তু আমাকে নয় | আর আমার আর আমার ফ্যামিলির ব্যাপার থেকে এরপর তুমি দূরে থাকবে | এটা আমি তোমায় রিকুয়েস্ট করছি না , বলছি | আর আমি এই বিয়েটা করবো | বাবা আমাকে কিছু না বলে পার্থর বাবাকে টাকা দিয়ে এসেছে আজ সকালে | আমি এখনই সব টাকা ফেরত নিয়ে এসে তোমাকে দিচ্ছি | আর এটাই শেষ | এরপর আর তুমি আমার কোনো ব্যাপারে থাকবে না | আমরা যেরকম অচেনা ছিলাম , সেরকমই ঠিক আছি | ”
কথাটা শেষ করেই শিউলি এবার এগিয়ে যাচ্ছিলো শরতের উত্তরের অপেক্ষা না করে | শুধু শুধু একটা বাইরের লোক ওর ঝামেলায় জড়াক এটা শিউলি কিছুতেই হতে দেবে না ! এই ভেবেই দু পা এগিয়েছিল সেইদিন , কিন্তু হঠাৎ থমকে গেছিলো একটা গাড়িকে খুব স্পিডে ওদের দিকে আসতে দেখে | এটা পার্থর গাড়ি তো ! এর মানে বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে নিশ্চই ও জেনে গেছে এতক্ষনে | তাই হয়তো ঝামেলা করতে এসেছে ! কিন্তু শরৎ যে টাকা দিয়ে ওদের হেল্প করেছে সেটা জানেনি তো ! কথাটা মনে আসতেই আচমকা গাড়িটা ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো | তারপর চোখের পলকে পার্থ আর ওর দুটো বন্ধু রড নিয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ির বন্ধ দরজা খুলে , আর শরতের ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো ওরা | শিউলি কিছু বোঝার আগেই পার্থ রডটা দিয়ে শরতের মাথায় একটা বারী মারলো | ওর মাথা ফেটে লাল রক্ত এসে উপচে পড়লো হঠাৎ | ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো শিউলির সামনে | তারপর পার্থ আর পার্থর বন্ধুরা ওকে এলোপাথাড়ি রড দিয়ে মারতে শুরু করলো | পার্থর চোখে যেন আগুন জ্বলছিল আজ | ও শরৎকে মারতে মারতে এক নাগাড়ে একটা কথাই বলে যাচ্ছিলো সেইদিন , ————- ” তুই ভেঙেছিস আমার বিয়ে ! তুই দিয়েছিস টাকা এই মেয়েছেলেটার জন্য ! তোর জন্য ওকে নিয়ে আমার শোয়া হলো না শেষ পর্যন্ত | তোকে আজ আমি ছাড়বো না | শেষ করে দেব আজ | ”
না , এই ঘটনাটা হঠাৎ শিউলিকে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দিলেও এই দৃশ্যটা দেখে যেন ঘোরটা কাটলো ওর | ও কি করবে বুঝতে না পেরে জোরে জোরে চিৎকার করতে শুরু করলো এখন আর দৌড়ে শরতের কাছে এগিয়ে গিয়ে পার্থ আর ছেলেগুলোকে ওর ওপর থেকে প্রানপনে সরানোর চেষ্টা করতে লাগলো ! তবে এর মধ্যে ওর চিৎকার শুনে আসে পাশের লোক আসতে শুরু করেছিল ওদের কাছে | তাই পার্থ আর বেশি কিছু করার সুযোগ পেলো না ! লোকজনদের গলার আওয়াজ শুনেই ও ওর বন্ধু সমেত দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো | তারপর আবার গাড়িটা স্পিডে ছুটিয়ে শিউলির চোখের পলকে হারিয়ে গেলো দূর রাস্তায় | তবে এই সবের মধ্যে শরৎ আর নিজের সেন্সে ছিল না ঠিক | শিউলি খেয়াল করলো শরতের মাথার পাশ দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে | জামার হাতাটা ছিঁড়ে গিয়ে কালশিটে পরে গেছে গায়ে | কেমন ছন্নছাড়া ভাবে ছেলেটা পরে আছে রাস্তায় | কি হলো এটা ! ওর কারণে এই অবস্থা হলো একজনের ! কথাটা ভেবেই কান্নায় ভেঙে পড়লো শিউলি | তবে এইভাবে ওর এলোমেলো হলে হবে না | শরৎকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে এখন | কথাটা মনে আসতেই ও আসে পাশের লোকজনের হেল্প নিয়ে কোনো মতে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করলো | তারপর শরৎকে নিজের কোলে শুইয়ে ওর মাথায় নিজের ওড়নাটা চেপে ধরলো | রক্তটা যদি কোনোভাবে আটকানো যায় ! এই চেষ্টাটা সেদিন সারাটা রাস্তা জুড়ে করেছিল শিউলি | তারপর হসপিটালে এসে এডমিট করেছিল শরৎকে | এতক্ষনে শরতের বাবা , শিউলির মা বাবাও খবর পেয়ে চলে এসেছিলো হসপিটালে | ওরা অবাক হয়ে দেখেছিলো শিউলির হালকা সাদা রঙের চুড়িদারটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে এখন | কোনো কথা বলার মতন অবস্থায় ছিল না ওরা এই দৃশ্য দেখার পর ! টানা দু ঘন্টা চুপচাপ অপেক্ষা করেছিল সবাই ও.টির বাইরে শরতের একটা খবর পাওয়ার জন্য | শিউলি এই সময়টায় ভেতরে ভেতরে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো যেন আজ | বার বার মনে হচ্ছিলো কেন নিজেকে আর একটু লুকিয়ে রাখতে পারলো না শরতের সামনে ! কেন মারের দাগগুলো শরতের চোখের সামনে চলে এসেছিলো সেদিন ! কেন ওই মাতাল পার্থর নোংড়ামি খুব স্পষ্ট ভাবে দেখতে পেয়েছিলো শরৎ সেই রাতে ! এইসবের জন্যই তো আজ কোনো কারণ ছাড়া এই ছেলেটা শুধু শুধু এইভাবে রক্তাত্ব হলো ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সেদিন সময়টা পার হয়ে গিয়েছিলো ওর | তারপর ডাক্তার এসে বলেছিলো ইন্টারনাল কোনো ইনজুরি নেই শরতের | মাথায় সাতটা স্টিচ পড়েছে তবে | আর হাতে একটা ছোট ফ্র্যাকচার হয়েছে | কয়েকদিন রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে সব | কথাগুলো শুনে যেন অনেক্ষন বাদে প্রাণ ভোরে নিঃশ্বাস নিয়েছিল শিউলি | দম বন্ধ করা কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে উঠেছিল ও |
<১০>
এরপর প্রায় এক ঘন্টা বাদে ওরা শরতের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলো ওর কেবিনে | শিউলি তবে থমকে ছিল যেন ! শরতের মাথায় ব্যান্ডেজ , ওর হাতে স্যালাইনের চ্যানেল , আরেকটা হাতে লাল রঙের ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিলো খুব | কিছুক্ষন আগেও তো এই ছেলেটা একেবারে সুস্থ ছিল | যদি এই ঝামেলাটা না হতো ওর জন্য , তাহলে এই মুহূর্তে শরৎ নিজের বাড়িতে থাকতো | ঠিক থাকতো | কথাগুলো বার বার মনে এসে ভিড় করছিলো শিউলির | তবে সেদিন শরতের সেন্স আসার পর শিউলির অন্ধকার মুখটা দেখে ও নিজেও বুঝতে পারছিলো মেয়েটার মনে কি চলছে এখন ! নিজেকে কতটা দোষ দিচ্ছে ও মনে মনে ! কিন্তু সবটা জেনেও শরৎ শুধু ওকে বোঝাতে পারছিলো না যে যেটা হয়েছে তার জন্য শিউলির নিজেকে দোষ দেয়ার কোনো কারণ নেই ! আর এই বিয়েটা ভাঙার জন্য ওর শরীরে যতই চোট লাগুক , কিন্তু মনে অদ্ভুত একটা শান্তি আছে এখন | আসলে এই একটা জায়গায়ই শরতের প্রব্লেম ছোটবেলা থেকে | ও যা ভাবে সেটা ঠিক গুছিয়ে বলে উঠতে পারে না কাউকে | শব্দগুলোকে ঠিক ঠিক ভাবে সাজাতে পারে না লোকের সামনে | তাই ওর খারাপ ভালো লাগাগুলো ওর মধ্যেই রয়ে যায় সারাক্ষন | কিন্তু একটা কথা হঠাৎ আবার মনে উঠলো এরপর | আচ্ছা , এই ঘটনাটা ঘটার পর শিউলি আরোও ভয় পেয়ে আবার ওই পার্থর কাছে ফিরে যাবে না তো ! ও হয়তো এখন শরতের দিকটাও ভাবছে | ভাবছে আবার না পার্থ শরতের সাথে কিছু খারাপ করে ফেলে ! আর এই ঝামেলাটা হওয়ার আগেও তো শিউলি ওকে এইসবই বলছিলো | ও না কি পার্থদের বাড়ি গিয়ে সব টাকা ফেরত নিয়ে চলে আসবে | ওর কোনো ঝামেলায় শরৎকে থাকতে দেবে না ! এই কথাগুলো মাথায় আসতেই নিজে আর চুপ থাকতে পারলো না কিছুতেই | শরতের বাবা , শিউলির বাবা মা সবার সামনেই কিছু কথা ভেবে বোঝানোর চেষ্টা করতে যাবে যাবে , এরকম সময়ই কেবিনের দরজা দিয়ে পুলিশ এসে হাজির | হসপিটাল থেকেই খবর দেয়া হয়েছিল আসলে এডমিশনের সময় | শরতের চোটগুলো দেখে খুব সহজেই ডাক্তার বুঝেছিলো যে এটা কোনো একসিডেন্ট কেস নয় | ইনটেনশনালি মারা হয়েছে ওকে | ধুর , এই রকম একটা টাইমে পুলিশকে ইনভেস্টিকেট করতে আসতে হলো ! শিউলি তো এবার আরো ভয় পেয়ে যাবে | পার্থর বাবা কি সব পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে | শিউলি নিশ্চই পার্থর বাবার ভয়ে পুলিশের সামনে আরো কিছু বলবে না ! এইসবই ভাবছিলো শরৎ , তখনই পুলিশ এর একজন ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করে উঠলো ওকে , ————- ” কি করে হলো আপনার এরকম ? আপনি জানেন কে করেছে এইসব ? চেনেন আপনি লোকগুলোকে ?”
কথাটা জিজ্ঞেস করতেই শরতের কিছু বলার আগেই ওর চোখের পলকে শিউলি আচমকা বলে উঠলো , ———— ” আমি চিনি লোকগুলোকে | আমি নিজের চোখে দেখেছি সবটা | পার্থ সামন্ত আর ওর বন্ধুরা মিলে হঠাৎ গাড়ি করে এসে এই কাজটা করেছে | ওর বন্ধুগুলোকে দেখলেও আমি চিনতে পারবো | এছাড়া ওর বাড়ির এড্রেস , ওর গাড়ির নাম্বার সব আমার জানা | ওদের এগেনস্টে আমি একটা এফ.এই.আর লজ করতে চাই | আই হোপ এইসবের পর আপনারা নিশ্চই পার্থকে এরেস্ট করবেন আজ !”
এক নিঃশ্বাসে দৃঢ় গলায় কথাগুলো বলেছিলো সেদিন শিউলি | আর অবাক চোখে শরৎ তাকিয়ে ছিল ওর দিকে ! বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে সত্যি শিউলি এট লাস্ট ওই নোংড়া ছেলেটার এগেনস্টে মুখ খুলেছে সবার সামনে ! ওর ভয়টা ভেঙেছে ! কথাটা মনে আসতেই শিউলির মা খুব ঘাবড়ে গিয়েই জিজ্ঞেস করেছিল ওকে , ——– ” তুই সত্যি পার্থর এগেনস্টে এফ.আই.আর করবি ? ওরকম একটা ডেঞ্জারাস ছেলে ! ও যদি আবার শরৎ বা আমাদের কারোর সাথে কিছু করে !”
কথাটা শুনে শিউলি সেই দৃঢ় গলায়ই ওর মাকে উত্তর দিয়েছিলো , ——- ” চিন্তা কোরো না মা | আমাদের ধার শোধ হয়ে গেছে | এরপরও ভয় পেলে সারা জীবন ভয়েই বাঁচতে হবে | তাই আর না | আর পার্থর এতদিন যা যা করার , ও করেছে | আমি চুপ ছিলাম কারণ যেটা হচ্ছিলো , আমার সাথে হচ্ছিলো | আমার আশেপাশের লোকজনের সাথে নয় | কিন্তু এই ঘটনাটার পর আর চুপ থাকা সম্ভব না | ওকে এবার জেলে যেতেই হবে | আর পার্থ যাতে নিজের ঠিক জায়গাটায় পৌঁছতে পারে , তার জন্য যা যা করার আমি করবো |”
সেদিন কথাগুলো শেষ করে এরপর শিউলি এক পলক তাকিয়েছিলো শরতের দিকে আনমনে , আর খেয়াল করেছিল ওর হাসি মুখটা | এতটা যন্ত্রনা নিয়েও অদ্ভুত একটা হাসি মুখ | না , শিউলি আর বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারেনি শরতের দিকে সেইদিন | আজকে সন্ধ্যেবেলা এই ছেলেটার সাথেই তো কতটা খারাপভাবে কথা বলেছিলো ও ! তবে আর সেই পুরোনো কাজটা করবে না কখনো | শরৎ যেটা শিউলির জন্য করছে , সেটা মন থেকেই করছে | নইলে এতটা যন্ত্রনা নিয়েও কেউ হাসতে পারে না ! তাই এবার শরৎ যেটা চায় ,শিউলিও সেটাই করবে | আরেকবার নতুন করে সব কিছু ঠিক করার চেষ্টা করবে ওর জীবনে | নতুন করে বাঁচবে আবার |
চলবে।