আলগোছে আছো হৃদমাঝারে পর্ব-০৪

0
73

#আলগোছে_আছো_হৃদমাঝারে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চার

“আমার হবু বউয়ের শরীরে স্পর্শ করার সাহস আপনাকে কে দিয়েছে?”
জাইহান জায়রাকে কোলে তুলে সবে মাত্র গাড়ির সামনে এসেছে। তৎক্ষনাৎ এহেন শব্দ শুনতেই ঘুরে তাকাল। ২৫/২৬ বয়সী একজন ছেলেকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বিস্মিত হওয়ার ভান করে শান্ত বাক্যে প্রশ্ন করল,
“দুঃখিত। কিন্তু আপনি কে?”
রিজভান জাইহানের প্রশ্নে রাগান্বিত স্বরে জবাব দিল,
“আমি জায়রার হবু বর।”
জাইহান কথাটা শুনে মুচকি হাসল। ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
“দুঃখিত। এই মুহূর্তে আমি আপনাকে পাত্তা দিতে পারছি না।”
বলেই জায়রাকে গাড়িতে তুলে নিজেও উঠে বসল গাড়িতে। জায়রাকে এক হাতে বুকে চেপে ধরল। গম্ভীর বাক্যে নিলয়কে আদেশ করল,
“গাড়ি স্টার্ট করো। সি.এম.এইচ ছাড়া অন্য কোথাও গাড়ি থামবে না৷ ক্লিয়ার?”
নিলয় নিচু স্বরে,
“ইয়েস, স্যার।”
বলতে বলতে গাড়ি স্টার্ট করল। জাইহান এক পলক রিজভানের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু রহস্যময় ইশারা করে গেল। রিজভান রাগে বিরবির করে বলে উঠল,
“তোর প্রাণ ভোমরা জায়রাকে খুব শিঘ্রই আমি আমার করে নিব৷”



সি.এম.এইচের জরুরি বিভাগের সামনে এসে গাড়ি থামতেই জাইহান নিলয়কে বলল,
“ভেতরে ডা.মনিকা ম্যাম আছেন নাকি একটু দেখো…।”
নিলয় আদেশ পেয়ে দৌড়ে ভেতরে গেল। জায়রার দিকে তাকাতেই জাইহানের বুকটা কেঁপে উঠল। মেয়েটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। কী হয়েছে ওর? এই অবস্থা কি করে হলো? কেন যেন খুব ভয় হচ্ছে। বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে৷ জায়রার বাবাকে কী একটা খবর দেওয়ার প্রয়োজন? হ্যাঁ! অবশ্যই প্রয়োজন। ভেবে জায়রাকে এক হাতে বুকে চেপে ধরে, অন্য হাতে ফোন বের করে ডায়াল করল আমির সাহেবের নাম্বারে। রিসিভ হতেই জাইহান খুব শান্ত স্বরে বলল,
“স্যার, একবার সি.এম.এইচ আসতে পারবেন? একটু জরুরি দরকার ছিল।”
ওপাশ থেকে আমির সাহেব চিন্তির বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“কেন? কার কি হয়েছে?”
জাইহান পুনরায় বলল,
“স্যার, আপনি একটু কষ্ট করে আসুন। এখন কিছু বলতে পারছি না।”
বলেই জাইহান ফোন রেখে দিল। জায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আলতো করে৷ জাইহানের হাত কাঁপছে চিন্তায়, বুক কাঁপছে ভয়ে। কী আশ্চর্য! ক্যাপ্টেন জাইহান চৌধুরী ভয় পাচ্ছে? এই প্রথম নাকি এর আগেও এমন হয়েছিল? এর মধ্যেই টের পেল জায়রা নড়ছে। তারমানে ওর জ্ঞান ফিরছে। জাইহান দ্রুত জায়রাকে বুক থেকে সরিয়ে দিল। সিটের সাথে আলতো করে ঠিক করে বসিয়ে দিতে দিতে ডাকতে শুরু করল,
“শুনছো? এই যে…?”
আচ্ছা কি নামে সম্মোধন করা যায়? মেয়েটা তো সবদিক দিয়ে পারফেক্ট। এলোকেশী কন্যা? নাকি রূপবতী কন্যা? নাকি নাম ধরে? উফফ! এত এত কনফিউশানে জাইহান জীবনে পড়েনি৷ অনেক ভেবে ঠিক করল নাম ধরেই ডাকবে। জায়রা ইতোমধ্যে অল্প অল্প করে চোখ খুলছে। অস্পষ্ট স্বরে বলছে কিছু। কিন্তু শুনতে পারছে না জাইহান। তাই একটু কাছে গেল। জায়রার কাছে ঘেঁষে শোনার চেষ্টা করল কি বলছে? জায়রা অস্পষ্ট স্বরে থেমে থেমে বলছে,
“তুমি এত বাজে কেন? কেন এত বাজে তুমি? ত…।”
আর কিছু শুনতে পারল না। ঢলে পড়ল জাইহানের বুকে। জাইহান দ্রুত জায়রাকে সামলে নিল। পুনরায় জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা। কাকে বাজে বলছিল? নিশ্চয়ই চেনা কেউ? নয়তো তুমি বলা সাজে না। তাহলে কী তখনের ছেলেটা? জাইহানের মস্তিষ্কে কথাটা জানান দিতেই জাইহানের টনক নড়ল। বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“যে হাত আমার ফুলকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেছে, সে হাতকে আমি আস্ত রাখব না।”
নিলয়ের অপেক্ষা না করে জাইহান নিজেই জায়রাকে কোলে তুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ডাক্তারের কেবিনের সামনে গিয়ে দরজার সামনে থাকা দায়িত্বরত একজন সৈনিককে বলল,
“ম্যাম, ভেতরে আছেন? একটু ইর্মাজেন্সী।”
সৈনিক ব্যক্তি জাইহানকে সালাম দিয়ে জবাব দিল,
“ম্যাম, একটু ব্যস্ত আছেন। আপনি উনাকে বেডে নিয়ে শুইয়ে দিন। আমি ম্যামকে জানাচ্ছি।”
“প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করুন।”
অনুরোধ বাক্যে কথাটা বলে জাইহান জায়রাকে নিয়ে গিয়ে একটা বেডে শুইয়ে দিল। জায়রা কিছু চুল ছিড়ে জাইহানের হাতে প্যাঁচিয়ে আছে। জাইহান একবার অসহায় চোখে জায়রার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল। নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে জায়রাকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। কে এই কাজ করেছে? কে? এর মধ্যেই পেছন থেকে মেয়েলী স্বরে শুনতে পেল,
“জাইহান? এনি প্রবলেম?”
জাইহান পেছন ঘুরে মনিকা বেগমকে দেখে মুখে কোনোরকমে হাসি টানার চেষ্টা করল। তা দেখে মনিকা বেগম ছেলের কাঁধে হাত রেখে হাসি মুখে বললেন,
“মায়ের সামনে সন্তানরা কখনো নিজের ভেতরের যন্ত্রণা মুখে হাসি টেনে চা’পা দিতে পারে না।”
তা শুনে পেছন থেকে নিলয় চকিতে তাকাল। ডা.মনিকা জাইহানের মা? কই আগে তো জানতো না? ধুর জানবে কি করে? জাইহান কখনো নিজের পরিবার নিয়ে বাইরে কথা বলে না। জাইহান মনিকা বেগমের কথার পৃষ্ঠে বলল,
“মা! জায়রাকে দেখো আগে।”
মনিকা বেগম জায়রার পাশে গিয়ে আগে পার্লস চেক করলেন। জাইহান কিছুটা উদ্বিগ্নতার স্বরে বলে উঠল,
“ওর জ্ঞান ফিরছে না কেন, মা?”
মনিকা বেগম ছেলের উদ্বিগ্ন স্বর শুনে শান্ত বাক্যে বললেন,
“ফিরবে। তবে এখন না। এখন ওর জ্ঞান ফিরলে সেটা মঙ্গলজনক হবে না।”
বলেই তিনি নার্সকে একটা ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য আদেশ করলেন। অতঃপর তিনি জাইহানকে নিয়ে নিজের কেবিনে চলে আসলেন। জাইহান কেবিনে ঢুকেই চিন্তিত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“জায়রার কি হয়েছে, মা?”
মনিকা বেগম ছেলের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“আগে তুমি শান্ত হও, বাবা। তুমি একজন সাহসী সৈনিক। এভাবে ভয় পাওয়া তোমার মানায় না।”
জাইহান পানির গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে এক গ্লাস পানি শেষ করে জোরে শ্বাস ফেলল। মনিকা বেগম এবার কিছুটা ভাবুক স্বরে বললেন,
“জায়রার সাথে কি হয়েছে সেটা আমার থেকে ভালো জায়রা বলতে পারবে।”
“মানে?”
জাইহানের পাল্টা প্রশ্নে মনিকা বেগম বললেন,
“আমি যদি ভুল না হই তাহলে জায়রাকে কেউ মলেস্ট করার ট্রাই করেছে।”
জাইহানের বুকটা ধক করে উঠল। চকিত তাকাল মায়ের দিকে। চেঁচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল,
“কি বলছো?”
মনিকা বেগম ছেলের মুখ পর্যবেক্ষণ করে সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
“ভালোবাসো, জায়রাকে?”
জাইহান নড়েচড়ে বসল। দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। তা দেখে মনিকা বেগম মুচকি হেসে বলল,
“আমার বউমা কিন্তু লাখে একটা৷ আগলে রেখো। কোনো খারাপ স্পর্শ যেন ছুঁতে না পারে আমার মেয়েকে। অল দ্যা বেস্ট।”
বলে তিনি চলে গেলেন। জাইহান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। হেসে ফেলল।



“স্যার, আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছি এই কাজ কে করেছে?”
আমির সাহেব মেয়ের বেডের সামনে চিন্তিত মুখে বসে ছিলেন। জাইহানের থেকে কথাটা শুনে অবাকপানে তাকালেন। তড়িঘড়ি শব্দে জিজ্ঞেস করলেন,
“কে সে?”
জাইহান খানিক থেমে দৃঢ় স্বরে শুধাল,
“রিজভান।”
আমির সাহেব উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। রাগান্বিত বাক্যে বলে উঠলেন,
“ওকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব। আমার মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে। ওর কলিজা ছিড়ে এনে কু’কুর দিয়ে খাওয়াবো।”
জাইহান কিছুটা হাস্যজ্বল স্বরে বলল,
“স্যার, এতটা উত্তেজিত হবেন না। কিছু কিছু সময় ঠান্ডা মাথায় গুটি চালতে হয়। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। রিজভানের শাস্তির দায়িত্বটা না হয় আমি নিলাম। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
জাইহানের থেকে ভরসা পেয়ে আমির সাহেব শান্ত হলেন। বিশ্বাস করে দায়িত্বটা তুলে দিলেন জাইহানকে।



“জায়রার এই অবস্থা আমি করিনি, আংকেল।”
কথাটা বলতে না বলতে রিজভানের গালে সপাটে একটা থাপ্পড় পড়ল। রিজভান গালে হাত দিয়ে সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“আপনি আমাকে থা’প্পড় মারলেন? কোন সাহসে?”
সামনের ব্যক্তিটি হাসতে হাসতে বলল,
“আমার সাহস সম্পর্কে তুমি জানো না, বাজান? প্রশ্ন করছো যে?”
“সব জায়গায় সাহস দেখাতে যাবেন না, আংকেল। জানেন তো আপনি কার বাবা? ঠিক জায়গায় বোম ফাটালে আপনার কি হবে আংকেল?”
“ভয় দেখাচ্ছো?”
“ভয় পাচ্ছেন তাহলে?”
বলেই রিজভান হাসল। হু*মকির স্বরে বলল
“আমার গায়ে হাত দেওয়ার মতো সাহস পরবর্তীতে দেখাবেন না, আংকেল। ভুলে যাবেন না, আপনার সব অপকর্মের প্রমাণ আমার কাছে। আবার আমাকে মা*রতেও পারবেন না। আমাকে মারলে আপনি যে জায়রাকে পাবেন না…।”

#চলবে