আলগোছে আছো হৃদমাঝারে পর্ব-০৬

0
71

#আলগোছে_আছো_হৃদমাঝারে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ছয়

রাস্তার মাঝে সেনাবাহিনীর পোষাকধারী এক সৈনিকের কলার চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে জায়রা। রাস্তায় উপস্থিত জনগণের চোখ বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। কী আশ্চর্যকর সাহস মেয়েটার! সৈনিকটির চোখে ভয়। তবুও রাগান্বিত বাক্যে বলল,
“ম্যাম, আমার কলার ছাড়ুন। আপনি কিন্তু বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিবেন না।”
জায়রাও কম কিসে? দ্বিগুন রাগী বাক্যে প্রশ্ন ছুড়ল,
“বাড়াবাড়ির কিছুই দেখেননি। এবার দেখবেন। আপনার নাম কী জাহিশ চৌধুরী?”
সৈনিকটি ভীত স্বরে জবাব দিল,
“জ্বি, দেখতে পারছেন না?”
জায়রা চোখ রাঙিয়ে বলল,
“জ্বি, দেখতে পারছি। অন্ধ না আমি। তবুও জিজ্ঞেস করে শিওর হয়ে নিলাম।”
জাহিস এবার অধৈর্য কণ্ঠে কিছুটা হুমকি দিয়ে বলল,
“ম্যাম, আমার কলার ছাড়ুন। আপনি কিন্তু আমাকে ভরা রাস্তায় হেনস্তা করছেন। আমি কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে বাধ্য হবো।”
জায়রা মুচকি হাসল। চোখে মুখে কোনো রকম ভয়ের চিহ্ন দেখা গেলো না। বরং জায়রা খুব শান্ত। যেন জাহিশের কথায় পাত্তা দিচ্ছে না। জায়রা সামান্য হেসে বলে উঠল,
“স্যরি, আমি ভয় পাচ্ছি না।”
জাহিশ জায়রার মুখের হাসির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। মেয়েটা খুব সুন্দর করে হাসে। কী মনোমুগ্ধকর সে হাসি! আচ্ছা সব মেয়েরাই কি এত সুন্দর করে হাসে? কই জাহিশ তো আগে দেখেনি। নাকি খেয়াল করেনি কাউকে সেভাবে? কি জানি? জায়রা জাহিশকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“আমি মানুষ। এলিয়েন না। এভাবে দেখার কোনো দরকার নেই, মিস্টার সৈন্য।”
‘সৈন্য’_____ সেটা আবার কে?” প্রশ্নটা দমিয়ে রাখতে না পেরে করে ফেলল,
“সৈন্য কে?”
“কে আবার? আপনি।”
জাহিশ ভড়কাল। রাস্তার জনগনের দিকে একবার চোখ দিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“আমার কলারটা ছাড়ুন, প্লিজ। রিকুয়েষ্ট করছি। আমাকে সম্মান না দিন সমস্যা নাই। কিন্তু আমার ইউনিফর্মটাকে অন্তত সম্মান দিন। আমি সব মেনে নিলেও, আমার গায়ের ইউনিফর্মের অসম্মান মানতে পারিনা।”
জায়রা ছেড়ে না দিয়ে বলল,
“আগে কার্ড দেখান।”
জাহিশ পকেট থেকে কার্ডটা বের করে দেখাল জায়রাকে। জায়রা সাথে সাথে জাহিশের কলার ছেড়ে দিল। কিছুটা অনুতপ্তের স্বরে বলে উঠল,
“দুঃখিত। তবে আপনি আমার সাথে অন্যায় করেছেন। আর অন্যায়কারী কাউকে আমি ছেড়ে দেই না। এমনকি নিজের ভালোবাসার মানুষটাকেও না…।”
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে জায়রার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল। জাহিশের দৃষ্টিতে জায়রার ছলছল চোখ এড়াল না। মেয়েটা বাকি সবার থেকে অন্যরকম। সবসময় বাঘিনী ন্যায় আচরণ। একটা ভুলের জন্য জাহিশের মতো শক্তপোক্ত ছেলেকে ছাড়ল না। আর বাকি ছেলেরা তো কিছু না। জাহিশ কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল। জাহিশকে একা একা হাসতে দেখে জায়রা গর্জে উঠে জিজ্ঞেস করল,
“হাসছেন কেন?”
জায়রার সন্দিহান চাহনী দেখে জাহিশ ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
“দেখুন মিস, আমি আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি আপনাকে ইচ্ছাকৃত জড়িয়ে ধরিনি। আমি একজনকে তাড়া করেছিলাম, তাকেই ধরতে যাওয়ার সময় আপনি সামনে এসে পড়লেন। একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে৷ প্লিজ, ক্ষমা করবেন। আসি।”
জায়রা সৌজন্যতার হাসি উপহার দিল। জাহিশ চোখে সানগ্লাস পড়তে পড়তে বলে উঠল,
“এই যে মিস বাঘিনী, পরের কোনো ছেলেকে পেলে এভাবে হামলে পড়বেন না। সব ছেলেরা আমার মতো ভালো হয় না। বুঝলেন? আসি, আল্লাহ হাফেজ।”
বলেই জায়রাকে কিছু বলতে না দিয়ে চলে গেল। জায়রা কিছুক্ষণ একা একা বকবক করে কলেজের ভেতরে ঢুকে গেল।



জাহিশ অফিসে এসেই সোজা জাইহানের রুমে ঢুকে গেল। চেয়ারে পা উঠিয়ে বসতে বসতে বলল,
“জানিস আজকে কি হয়েছে?”
জাইহান কিছু একটা করছিল। এর মধ্যে জাহিশের এমন উদ্ভট প্রবেশ দেখে চোখ তুলে তাকাল। শান্ত বাক্যে বলল,
“আমার কি কোনো এক্সট্রা পাওয়ার আছে?”
জাহিশ দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
”না তো।”
“তাহলে জানব কিভাবে?”
জাহিশের মুখ চুপসে গেল। পরক্ষণেই জাইহানের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে উঠল,
“আরে শোন না, ভাই।”
“আমি তো বধির না।”
জাহিশ মুখ গুমরা করে ফেলল। বলল,
“সবসময় ফাজলামি ভালো লাগে না, ভাই। একটা দরকারি কথা শেয়ার করতে এসেছি। আর তুই কিনা এমন হেয়ালি করছিস?”
জাইহান চোখ তুলে তাকাল। জাহিশের গুমরা মুখ দেখে নরম সুরে বলল,
“আচ্ছা, বল শুনছি।”
জাহিশ গুমরা মুখ করেই বলল,
“রিকুয়েষ্ট করে বলে বার।”
জাইহান মুচকি হাসল। কথা না বাড়িয়ে অনুরোধ বাক্যে বলল,
“আপনার মহামূল্যবান কথাটা বলে আমাকে উদ্ধার করুন, ভাইজান।”
জাহিশ হেসে ফেলল। জাইহানও হাসল বটে। জাহিশ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল,
“আমি না একটা মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
জাইহান হাতের কলম রেখে চকিতে তাকাল। চোখের পাতা ঝাপটে প্রশ্ন করল,
“ভুল শুনছি?”
জাহিশ লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“না। ঠিক শুনছিস।”
জাইহান কেশে উঠল। জাহিশ পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আগে পানি খা, নে।”
জাইহান হাত দিয়ে থামিয়ে বলে উঠল,
“তুই তো কবে যেন আমার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে ফেলবি রে। তা ঘটনা কি আগে বল।”
জাহিশ রাস্তায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটা শেয়ার করল। তা শুনে জাইহান হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
“যে মেয়ে ভরা রাস্তায় তোকে অপমান করল আর তুই তাকে ভালোবেসে ফেললি? লজ্জা নেই তোর?”
জাহিশ রাগে বিরবির করে উঠে বলল,
“তুই চুপ থাক। নিজের কাজ মনোযোগ দিয়ে কর।”
বলে উঠে দাঁড়ালো। বিরবির করতে করতে চলে গেল। জাইহান জাহিশের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে উঠল,
“দোয়া করি, তুই তোর ভালোবাসার মানুষটাকে খুব তাড়াতাড়ি নিজের করে পেয়ে যা।”



“খালা, কি হয়েছে? এভাবে কান্না করছেন কেন?”
জাইহান বাড়ি ফিরে দেখে আমেনা বেগম ড্রয়িং রুমে বসে হাউমাউ করে কান্না করছে। পাশে মনিকা বেগম বসে আছেন। কিছু একটা বলে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আমেনা বেগমকে আজকে বাড়িতে দেখে জাইহান বেশ খানিকটা অবাক হয়েছে। তিনি তো গ্রামে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন থেকে আসার কথা। তাহলে আজ কেন আসল? কান্নাই বা করছে কেন? জাইহানের কথা শুনে আমেনা বেগম দৌড়ে আসলেন জাইহানের দিকে। জাইহানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন,
“বাবা গো, ও বাবা। আমার সব্বোনাশ হইয়া গেছে। আমারে বাঁচাও, বাবা।”
জাইহান তাকে শান্ত করতে বলে উঠল,
“খালা, আপনি কান্না থামান। কি হয়েছে? আমাকে বলেন। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব, আপনাকে সাহায্য করার। আংকেলের কিছু হয়েছে? অসুস্থ হয়ে পড়েছে?”
আমেনা বেগমকে এনে সোফায় বসাল। মনিকা বেগম এক গ্লাস পানি এনে দিলে বললন,
“আপনি সব গুছিয়ে বলুন, জাইহানকে। ও নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করবেন, আপা।”
আমেনা বেগম পানিটুকু শেষ করে সবটা গুছিয়ে বলল জাইহানকে। সব শুনে জাইহান দাঁড়িয়ে পড়ল। অবাক বাক্যে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি ওইটুকু মেয়েকে কি করে একজনের সাথে পাঠিয়ে দিলেন? খালা, আজকাল কেউ বিশ্বাসী না। এখন আমি কি করব?”
জাইহানের মাথা কাজ করছে না। তবুও আমেনা বেগমকে স্বান্তনা দিয়ে বলে উঠল,
“লিলিকে সেফ করে আনার আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, খালা। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। আল্লাহকে ডাকুন।”
বলেই জাইহান বেরিয়ে গেল। যে করেই হোক লিলিকে বাঁচাতে হবে। লিলির কোনো ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না।



একটা ভাঙাচূড়া রুমে বন্দি হয়ে আছে লিলিসহ কয়েকটা মেয়ে। লিলির হাত পা বাঁধা। মুখ বাঁধা। কিশোরী লিলির মন, মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু ভয়। চোখ দুটো ভয়ে চাতক পাখির মতো বাঁচার উপায় খুঁজছে। এটা কোথায়? কোন জায়গা? লঞ্চ, ট্রলারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কোনো নদীর পাড়ের এলাকা হয়তো। লিলি তো কিছু চিনে না। জানেও না। কয়েকটা মেয়ে গোঙ্গাচ্ছে। ওদের জামা-কাপড় রক্ত লেগে আছে। সদ্য নাইনে উঠা লিলি বুঝতে পারল না এ রক্ত কিসের? তাহলে কি লোকগুলো ওদের এভাবে মে*রেছে? কেন মে*রেছে? বাকিটা সবাই কাঁদছে। এর মধ্যেই রুমে প্রবেশ করল এক ছেলে। বয়স কত হবে? ২৮/২৯ নাকি এর চেয়ে বেশি? কে জানে? বুঝতে পারল না লিলি। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালো হলেও লিলির একটুও ভালো লাগছে না। কেমন যেন লাগছে। নেশা করেছে? চোখ দুটো এমন লাল কেন? চোখের চাহনীটাও কি বিশ্রি? মুখের হাসিটাও বিশ্রি। ছেলেটা লিলির দিকে এগিয়ে আসতেই লিলি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। ছেলেটা এসে লিলির একদম গা ঘেষে বসল। বলে উঠল,
“কী সুন্দর ঘ্রান! আমার পার্টনার হিসেবে তোমাকে চাই। হবে কি আমার বেড পার্টনার?”
লিলি বুঝতে পারল না। হুট করেই লোকটা লিলির বুকের আর্কষনীয় অংশে চেপে ধরল। দুইহাতে শক্ত করে চেপে ধরতেই লিলি ব্যাথায় নড়েচড়ে উঠল। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারল না। কেমন দম আটকে আসছে ওর। কি হবে ওর সাথে? ছেলেটা লিলির বুকে হাতে দিয়ে নিজের খায়েশ মিটাতে মিটাতে বলে উঠল,
“আই নিড ইউ, বেবস। আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেল্ফ।”
বলেই লিলিকে কোলে তুলে নিল। লিলি চেয়েও কিছু করতে পারতাছে না। আজ নিশ্চয়ই ওর সাথে খারাপ কিছু হবে? তাহলে কি আজ লিলির মৃ*ত্যুদিন?

#চলবে…