আলোছায়াতে প্রণয়াসক্তি পর্ব-০১

0
1088

#আলোছায়াতে_প্রণয়াসক্তি
#নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব

বধূবেশে ছুটতে ছুটতে এয়ারপোর্টের ভেতরে প্রবেশ করছে একটা মেয়ে। মেয়েটির পেছন পেছন একটা ছেলেও ছুটছে। ছেলেটির হাতে একটা নীল রঙের বড়ো লাগেজ। এয়ারপোর্টের সকল যাত্রী কৌতুহল নিয়ে এই দুজনকেই দেখছে। কেউ কেউ তো নানান কথাও বলাবলি করছে। এরপর মেয়েটি ও ছেলেটি ওয়েটিং এড়িয়াতে গিয়ে ফ্লাইটের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। তন্মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা এসে মেয়েটির পাশে এসে বসে। মেয়েটির সেদিকে খেয়াল নেই। সে তো ফ্লাইটের সময় হয়েছে কী না তাই বারবার ঘড়িতে দেখছে। বয়স্ক মহিলাটি মেয়েটিকে বারকয়েক দেখে অতঃপর জিজ্ঞাসা করেই বসলো,
“বিয়ে থেকে পালাচ্ছো?”

মেয়েটি তৎক্ষনাৎ পাশ ফিরলো। জিজ্ঞাসু নয়নে চাইলে বয়স্ক মহিলাটি ফের শুধায়,
“বিয়ে থেকে পালাচ্ছো বুঝি?”

মেয়েটি এবার উত্তর করে,
“বিয়ে করে পালাচ্ছি!”

মেয়েটির উত্তর শুনে মহিলাটি বোকা বনে যায়। মেয়েটি সেসবে পাত্তা না দিয়ে আবারও ঘড়িতে সময় দেখছে। তখন মেয়েটির পাশে ছেলেটি বলে,
“নিঝুম, জুয়েলারিগুলো খুলে লাগেজে রাখ। আমি পানি কিনে আনি।”

কথাটা বলে ছেলেটা উঠে যায়। নিঝুম নামের মেয়েটি কথাটা আমলে নিয়ে জুয়েলারি খুলে লাগেজে রাখে। পাশের মহিলাটি সব দেখছে। অতঃপর আবার জিজ্ঞাসা করে,
“ছেলেটা কি তোমার হাজবেন্ড?”

চমকে বড়ো বড়ো চো’খ করে তাকায় নিঝুম। তারপর হড়বড়িয়ে বলে,
“ও আমার বড়ো ভাই!”

উত্তর শুনে মহিলাটি অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্তত করে। তারপর আবারও শুধায়,
“তোমার হাজবেন্ড কোথায়?”

নিঝুম আবারও সময় দেখে। তখনি মাইকে ঘোষণা হয়। ইতোমধ্যে নিঝুমের ভাই নির্ঝরও চলে এসেছে। নিঝুম পানি পান করে মহিলাটিকে বলে,
“হাজবেন্ড হাজবেন্ডের বাসায়। যেহেতু এখানে দেখতে পাচ্ছেন না তাহলে বাসায়ই হবে!”

তারপর সে আর দাঁড়ায় না। লাগেজ নিয়ে চলে যায়। চলতে চলতে নিঝুম নির্ঝরকে বলে,
“ওই গু*ন্ডা যদি ঝামেলা করে তবে আমার সাইন করা ডিভোর্স পেপার মুখের উপর ছুঁ*ড়ে দিবি।”

নির্ঝর একটু চিন্তিত স্বরে বলে,
“যদি সে রিজেক্ট করে?”

“করলেও কী? আমাকে তো খুঁজে পাবে না। এয়ারপোর্ট থেকে খোঁজ নিয়ে শুধু কোন দেশে যাচ্ছি সেটা জানতে পারবে। আর কিছুই পারবে না। আমার ফ্রেন্ড আলফি বলেছে আমাকে টরেন্টোতে নেমে একদিন সেখানে তার ফ্রেন্ডের বাড়িতে থাকতে। তারপর সে এসে আমাকে অটোয়াতে নিয়ে যাবে।”

নির্ঝর ভ্রুঁকুটি করে শুধায়,
“আলফি ছেলে?”

নিঝুম অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
“হ্যাঁ। ও আমার ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পাওয়ার সব ঠিক করে দিয়েছে। আলফিও ইউনিভার্সিটি অফ অটোয়াতে মাস্টার্সে পড়ে। অনলাইনে পরিচয়। সে এখন অটোয়াতে নেই। জরুরী কাজে কোথাও গেছে। নাহলে নিজেই আমাকে রিসিভ করতো।”

“আলফি জানে, যে আজ তোর জায়ান আহমেদের সাথে বিয়ে হয়েছে?”

“জানে। আমি তিনদিন আগে যখন বড়ো আব্বু আমাকে ওই গু*ন্ডা জায়ান আহমেদকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলো সেদিনই আমি আলফিকে জানিয়েছি। তারপর আলফি বলেছিল বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে। একদিন কোনো ফ্রেন্ডের বাসায় থাকতে। তারপর তো আজকে ফ্লাইটই। কিন্তু বড়ো আব্বু হুট করে আমার রুমে এসে আমার ফোন নিয়ে নেয় আর আমাকে লক করে দেয়। কিছুক্ষণ আগেই গাড়িতে বসে আমি আলফিকে মেসেজে সবটা বলেছি। তখন সে বলেছে আমাকে ওর ফ্রেন্ড রিসিভ করবে।”

নির্ঝরের মনে সন্দেহ। সে জানতো না তার বোন একটা ছেলেকে এতো বিশ্বাস করে যাচ্ছে। নির্ঝর ও নির্ঝরের মা শুধু জানে নিঝুম স্কলারশিপ পেয়েছে তাই কানাডাতে পড়তে যাচ্ছে। নিঝুমের পাসপোর্ট ও ভিসা সবের ব্যাপারে নির্ঝর ঠিক করে দিয়েছে। নির্ঝর বলে,
“যদি আলফি ছেলেটা খারাপ হয়? আলফি সম্পর্কে তুই কি কি জানিস?”

নিঝুম নির্ঝরকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“না ভাইয়া। আলফি খুব ভালো। ওর মা কানাডিয়ান। বাবা বাংলাদেশি কানাডিয়ান সিটিজেন। দেখে মনেই হয় না যে ওর বাবা বাংলাদেশি। দাঁড়াও তোমাকে ছবি দেখাচ্ছি…”

নিঝুম ছবি দেখাবে তখনি আরেকবার মাইকে ঘোষণা হলো। নির্ঝর বলে উঠে,
“ছবি দেখাতে হবে না। জলদি যা। বেস্ট অফ লাক। নিজের স্বপ্ন পূরণ কর।”

বলেই নির্ঝর নিঝুমের মাথায় আদুরে স্পর্শ দেয়। নিঝুম একরাশ স্বপ্ন চোখে নিজের স্বপ্নের দেশের দিকে পা বাড়ায়।

——-

এদিকে চৌধুরী বাড়িতে বিশাল ঝড় চলছে। জায়ান আহমেদে রাগের তোপে সবাই। নিঝুমের বড়ো আব্বু নয়ন চৌধুরী থম মে*রে বসে আছেন। তার অতো বড়ো বিজনেস বুঝি এবার ডুবলো! জায়ান আহমেদ যদি শেয়ার উইথড্র করে ও তার লোন পরিশোধ করতে সাহায্য না করে তবে সে পথে বসবে। ব্যাংকরাপ্টও হয়ে যেতে পারে। জায়ান আহমেদ বলে,

“মিস্টার চৌধুরী, আপনার ভাতিজিকে আপনার স্ত্রী ও ছেলে মিলে পালাতে সাহায্য করলো কিন্তু আপনি তা আটকাতে পারলেন না!”

নয়ন চৌধুরী ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে স্ত্রী আয়েশা চৌধুরীর দিকে তাকালেন। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে জায়ানকে আমতা আমতা করে বললেন,
“দেখো জায়ান, বিয়ে তো হয়ে গেছে। বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি নিঝুমকে কড়া পাহারাতে রেখেছিলাম। তারপর আমি ভাবিওনি যে ও বিয়ের পরও পালাবে। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও আসলে..”

নয়ন চৌধুরীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আয়েশা চৌধুরী বলে উঠেন,
“তোমার মতো গু*ন্ডা মা*ফি*য়াকে আমার মেয়ে স্বামী হিসাবে মানতে পারবে না। ওর মর্জির বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ও নির্ঝরও এতে রাজি ছিলাম না।”

নয়ন চৌধুরী ইশারায় আয়েশা চৌধুরীকে শাসাচ্ছেন। আয়েশা চৌধুরীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে জায়ান আহমেদ বলে,
“জোর করেছে আপনার স্বামী। আমি শুধু আপনার স্বামীর কাছে অপশন রেখেছিলাম। সে এই অপশনটা চুজ করেছে। শত হোক নিজের মেয়ে তো না!”

আয়েশা চৌধুরীর চোখের কার্ণিশে অশ্রু জমে উঠলো। সেই তিন বছর বয়স থেকে সে ছোট্ট নিঝুমকে বুকে আগলে বড়ো করেছেন। নিঝুমের বাবা-মা রোড অ্যা*কসিডেন্টে মা*রা গেছে। নিঝুম এইচএসসি দিয়েছে এক বছর হলো। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে প্রথম সেমিস্টার শেষ করেছে। কিন্তু প্রথম থেকেই তার ফরেন কান্ট্রিতে পড়াশোনা করা ইচ্ছের জন্য স্কলারশিপের এপ্লাই করছিল। এই ব্যাপারে নয়ন চৌধুরী কিছু জানেন না। তাকে জানানো হয়নি কারণ তিনি নিঝুমকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন, নিঝুমের কারণেই তার ছোটো ভাই ও ছোটো ভাইয়ের বউ এই দুনিয়ায় নেই।
আয়েশা চৌধুরী বলেন,
“নিঝুম আমার মেয়ে। ছোটো থেকে ও-কে আমি নিজে কোলেপিঠে করে বড়ো করেছি।”

“হাহ্! আপনাদের এসব ইমোশনাল ড্রামা বাদ দিন। নিঝুম কোথায় গেছে তা বলুন।”

“আমার প্রা’ণ থাকতে আমি বলব না। আমার মেয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে গেছে। ও-কে মুক্ত করে আপনি আদারস অপশন বেছে নিন। তার জন্য যদি আমাদেরকে পথে বসতে হয় তো হোক!”

আয়েশা চৌধুরীর আবেগপ্রবণ কথায় নয়ন চৌধুরী হুংকার ছাড়েন।
“এই এক মেয়ের জন্য আমার ভাই, ভাইয়ের বউ সবাই নিজের প্রাণ উৎসর্গ করলো। এখন তুমি বলছো ওই মেয়ের জন্য আমি আমার সর্বস্ব খোয়াব? কখোনো না! আমি নিজে নিঝুমকে পাতাল থেকে হলেও খুঁজে বের করব।”

“সেটা আপনাকে করতে হবে না। আমার বউকে আমি খুঁজে বের করব।”

এই বলে জায়ান সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো।

চলবে।