আলোছায়াতে প্রণয়াসক্তি পর্ব-২৪

0
337

#copyrightalert❌🚫
#আলোছায়াতে_প্রণয়াসক্তি
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৪
ঠিক রাত ১২টা। পরিবারের সবাই একসাথে মিলে নিঝুমের জন্মদিনের কেক কাটছে। সন্ধ্যার একটু পরেই আলফির ফুফা-ফুফি ও টিনা এসে পৌঁছেছে। নিঝুম কেক কেটে প্রথম পিস তার বড়ো আম্মুকে খাওয়ালো। তারপর আলফিকে। একে একে সবাইকে কেক খাইয়ে গেলো তার বড়ো আব্বুর কাছে। মিস্টার নয়ন সবার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে শান্ত দৃষ্টিতে নিঝুমের দিকে চেয়ে আছেন। নিঝুম উনার মুখের সামনে কেক ধরে বলল,

“বড়ো আব্বু, আব্বুকে তো আমি সেই ছোটো বেলায় হারিয়েছি। তারপর আমার কাছে বাবা মানে তুমি আর মা মানে বড়ো আম্মু। ছোটো থেকে তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। আমাকে সহ্য করতে না পারলেও আমাকে কিন্তু রাস্তায় ফেলে দাওনি। জোর করে বিয়ে দিলেও আমার পছন্দের মানুষের সাথেই অজান্তে বিয়ে দিয়েছ। আমার কোনো জিনিসের অভাব রাখোনি৷ একটাই কষ্ট ছিল আমার যে তোমার থেকে বাবার আদরটা পাইনি। তাও আমার আজ দুঃখ নেই।”

বলতে বলতে নিঝুমের চোখের কোণে অশ্রু ভীড় করলো। তেমনটা মিস্টার নয়নের ক্ষেত্রেও। নিঝুম আরও বলল,

“আমি আজ তোমার কাছে একটা শেষ আবদার করব। রাখবে প্লিজ?”

মিস্টার নয়ন ইশারায় সম্মতি দিলে নিঝুম অশ্রুসিক্ত নয়নে হালকা হেসে বলল,
“আমার রিসেপশনে আমি তোমার ও বড়ো আম্মুর হাত ধরে হাঁটতে চাই।”

মিসেস আয়েশা ওড়নার কোণায় চোখ মুছলেন। মিস্টার নয়ন মৌন সম্মতি দিয়ে একটু রুমের দিকে গেলেন। তারপর ফিরে এসে নিঝুমের হাতে একটা পেপার দিয়ে বললেন,
“এটা তোমার। এতোদিন আমার কাছে আমানত ছিল। তোমার বাবা তোমার নামে বান্দরবানের রিসোর্টটা লিখে দিয়ে গিয়েছিল। তোমার ২০ বছর বয়স হতেই তুমি এর সম্পূর্ণ মালিক হলে। এটা নিয়ে আমাকে এর ভার থেকে মুক্ত করো।”

নিঝুম নিতে চাইলো না। মিসেস আয়েশা বললেন,
“তোর বাবা মৃত্যুসয্যায় আমাকে ও তোর বড়ো আব্বুকে বলে গেছেন, এটা যেন তোকে দেওয়া হয়। উনাদের শেষ স্মৃতি। তোর জন্মস্থান। তাই না করিস না।”

অতঃপর নিঝুম নিলো। হুট করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিঝুম মিস্টার নয়নকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। মিস্টার নয়নও এতক্ষণ যাবত আটকে রাখা অশ্রুকণাদের ছেড়ে দিলেন। আগলে নিলেন মেয়েকে। উপস্থিত সকলে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে।

রাত গভীর হতে গভীরতর। টিনা ও মিসেস মুমতাহিনা মিলে নিঝুমকে মেহেদী পরাচ্ছে। মিসেস আয়েশাও বসেছিলেন কিন্তু এতো লম্বা জার্নি করে আসাতে নিঝুম উনাকে জোর করে ঘুমাতে পাঠিয়েছেন। টিনা যদিও সুন্দর করে ডিজাইন করতে পারছে না। তাও কোনোমতে পরাচ্ছে। মিসেস মুমতাহিনাও নিঝুমের এক হাতের পৃষ্ঠে মেহেদী পরিয়ে চলে গেছেন। অতঃপর রাত তিনটার দিকে টিনা ও নিঝুম সোফাতেই গা এলিয়ে ঘুমিয়ে গেছে।
আলফি নিচে নেমে এলো। হাতে দুইটা ব্ল্যানকেট। টিনা ও নিঝুমের গায়ে জড়িয়ে দিলো। যদিও রুম হিটারের কারণে শীত ভাবটা নেই। আলফি নিঝুমের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে অপলক ঘুমন্ত নিঝুমকে দেখছে। নিঝুম মেহেদীর জন্য বেকায়দায় শুয়ে ঘুমিয়েছে। আলফি ও-কে সোজা করে শুইয়ে দেয়। তারপর কপালে নিজের উষ্ণ ঠোঁ-টের স্পর্শ দিয়ে পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসে থাকে।

ভোরের উজ্জ্বল আলো ফুটতেই নিঝুমের ঘুম ভেঙে যায়। মোটা কাঁচ ভেদ করে ভোরের শুভ্রতায় অন্ধকার দূর হয়েছে। নিঝুমের ঘুম ভেঙছে। হাতের মেহেদী শুকিয়ে টানটান অবস্থা। নিঝুম উঠে বসে। তারপর দেখে তার পাশের সিঙ্গেল সোফায় আলফি বসে বসে ঘুমাচ্ছে। অপরপাশের সোফায় টিনাও ঘুমাচ্ছে। নিঝুম নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। আলফির সোফার কাছে গিয়ে কয়েক সেকেন্ড মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আলতো হাতে ওর এলোমেলো কপালের উপর আসা চুলগুলো সরাতে চাইলো। কিন্তু অবাধ্য চুলগুলো আবারও কপালেই এসে ভীড় করছে। নিঃশব্দে হাসলো নিঝুম। তারপর পা টিপে টিপে কিচেনে গিয়ে সিংকে শুকনো মেহেদী গুলো ঝেড়ে ফেলল। মেহেদীর রং হাতের তালুর পৃষ্ঠে বেশ সুন্দর লাল হলেও পিঠের পৃষ্ঠে তেমন রঙ হয়নি। সে শুনেছে পানিতে লবঙ্গ ফু-টিয়ে এর ভাপ নিলে মেহেদীর রঙ গাড়ো হয়। তাই ভাবলো চা বানাবে আর তাতে লবঙ্গ দিবে। যেই ভাবা সেই কাজ। চা বানাতে লেগে পড়লো। প্রথমে পানিতে লবঙ্গ ফু*টিয়ে হাতে ভাপ নিলো। তারপর ফ্রিজ থেকে মিল্ক বের করে ফুটন্ত লবঙ্গের পানিতে পুরোটাই ঢেলে দিলো! যেহেতু সবার জন্য বানাবে। এখন গুড়ো দুধ খুঁজছে। পা উঁচু করে কিচেন কেবিনেটে খুঁজছে। তখনি কোমড়ে পুরুষালী হাতের স্পর্শ অনুভব করে। অতঃপর কাঁধেও থুতনির স্পর্শ। শরীরে দারুণ শিহরণ বয়। নিঝুম বুঝে যায় আলফি। আলফি ঘুম ঘুম স্বরে বলে,
“সুইটহার্ট, হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?”

নিঝুম লাজুক হেসে জবাব দেয়,
“সবার জন্য চা বানাচ্ছি৷

“উম..আমারটায় সুগার অর সুগার ফ্রি দিও না। জাস্ট ওয়ান টি স্পুন হানি।”

বলতে বলতে আলফি নিঝুমকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে হালকা করে না না*ক ঘষে। নিঝুম কেঁপে উঠে। কাঁপা লাজুক স্বরে বলে,
“কী করছো? বাড়িতে কিন্তু সবাই আছে।”

“দে আর স্লিপিং। সো ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।”

আলফি আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাইলো। হুট করে সসপ্যানে চায়ের জন্য বসানো দুধ উতলে উঠে পড়ে যেতে ধরলে নিঝুম দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চু*লা বন্ধ করে। তারপর কোমড়ে হাত গুঁজে বলে,

“দেখলে! তোমার জন্য দুধ উতলে পড়ে যাচ্ছিলো। যাও তো। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।”

আলফিকে এক প্রকার ঠেলেই সেখান থেকে পাঠায়। যাওয়ার আগে আলফি নিঝুমের গালে টুপ করে ঠোঁ*ট ছুঁইয়ে যায়। লজ্জাবতী লতার ন্যায় নিঝুম মাথা নুইয়ে আবার চা বানানোতে মনোযোগ দেয়।

——–
সাদা ফুল নেক ও ফুল স্লিভসের প্রিন্সেস গাউন পরেছে নিঝুম। চুলগুলো কার্লি করে ছেড়ে রাখা। মাথায় ডায়মন্ডের খুব সুন্দর একটা ক্রাউন পরেছে। কানে ডায়মন্ড এয়ারিং ও হাতে একটা করে ডায়মন্ড চুড়ি। নিঝুম তৈরি। টিনা তৈরি করেছে ও-কে। মিসেস আয়েশা নিঝুমের সাঁজ হয়েছে কীনা দেখতে এসে মেয়েকে অপলক নয়ন ভরে দেখলেন। তার প্রিন্সেসকে আজ সত্যি প্রিন্সেস লাগছে। তিনি ‘মা শা আল্লাহ’ বললেন কয়েকবার। টিনা বলল,
“বলো আন্টি, কেমস সাঁজিয়েছি?”

“অনেক সুন্দর। আমার প্রিন্সেসকে সত্যি প্রিন্সেস লাগছে।”

“তাহলে তো আমাদের প্রিন্স চার্মিংয়ের আর রক্ষে নেই! বেচারা আজ বেঁহুশ না হয়ে যায়!”

টিনার সাথে সাথে মিসেস আয়েশাও হাসলেন। নিঝুম লাজুক হেসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। তখন দরজায় নক পড়লো। টিনা দরজা খুলে দেখে নির্ঝর।
“কী চাই?”

নির্ঝর ভ্রুঁ কুঁচকালো। বলল,
“কী চাই মানে? গেস্টরা গার্ডেনে এসে পড়েছে। আর কতক্ষণ?”

“ওর সাঁজ হয়ে গেছে৷ নিয়ে আসছি।”
বলেই টিনা নির্ঝরের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। নির্ঝর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কয়েক সেকেন্ড বোকার মতো বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বিরক্তিতে কিড়মিড় করতে করতে চলে যায়।

মিস্টার নয়ন এসে দাঁড়িয়েছেন নিঝুমের রুমের দরজার সামনে। নিঝুম তার কাছে আবদার করেছে, আজ সে যেন নিঝুমকে নিয়ে হেঁটে আলফির হাতে তুলে দেয়। তিনি দরজায় নক করলেন। এবারও টিনা নির্ঝর মনে করে বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দেখে মিস্টার নয়ন। তারপর অপ্রস্তুত হয়ে মোলায়েম স্বরে ভেতরে আসতে বলে। মিস্টার নয়ন বলেন,

“সময় হয়ে গেছে। নিঝুম কই?”

তখনি নিঝুম এগিয়ে আসে। মিস্টার নয়ন নিঝুমকে দেখে আড়ালে চোখোর কোণে জমা পানিটুকু মুছে নিয়ে নিজের কনুই বাড়িয়ে দেয়। নিঝুমও আপ্লুত হয়ে কোনোমতে নিজের আবেগী ভাব লুকিয়ে মিস্টার নয়নের হাত ধরে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,