আলোছায়াতে প্রণয়াসক্তি পর্ব-০৭

0
778

#copyrightalert❌🚫
#আলোছায়াতে_প্রণয়াসক্তি
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৭
বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর মিস্টার নয়নকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। গলা ছেড়ে স্ত্রীকে চা বানাতে বলে ব্যালকনির কাঠের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। মিসেস আয়েশা চা নিয়ে এসে কঠোর ভঙ্গিতে টেবিলে তা রাখলেন। নিঝুমের বিয়ের দিনের পর থেকে স্বামীর সাথে তার অতিরিক্ত রা নেই। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। চায়ের কাপ রেখে চলেই যাচ্ছিলেন তখন মিস্টার নয়ন তাকে ডাকলেন,

“শোনো আয়েশা, খুশির খবর আছে৷ আমার কম্পানির সব লোন পরিশোধ হয়ে গেছে। নতুন প্রজেক্টটাও শীগ্রই শুরু হতে যাচ্ছে৷ দেখবে এই প্রজেক্টটাতে চৌধুরী কম্পানি আবার নিজের পুরোনো রূপে ফিরবে।”

“ওহ। ভালো।”

মিসেস আয়েশার এই সামান্য অভিব্যক্তিহীন প্রত্যুত্তরে নিরাশ হলেন মিস্টার নয়ন। এতোটাও অনাগ্রহের সংবাদ তো সে দেয়নি। কম্পানির দূরাবস্থার সময় তো আয়েশাই তাকে সাহস দিয়েছে। যখন রাত-দিন চিন্তার চাদরে ডুবে থাকতেন, তখন তো স্বীয় স্ত্রীর আশ্বাসবাণীতেই শান্ত হতেন। তবে আজ যখন ভালো সময় আসছে, তবে কেন এতো অনাগ্রহ? তিনি বললেন,

“তোমায় দেখে মনে হচ্ছে খুশি হওনি।”

ঘাড় ঘুরিয়ে ত্যাক্ত দৃষ্টিতে চাইলেন মিসেস আয়েশা। খরখরে কণ্ঠে বললেন,
“কারও জীবন নষ্ট করে নিজেদের উন্নতিতে খুশি হওয়ার কথা? তোমার মতো অতো পাষাণ তো নই আমি।”

মিস্টার নয়ন চোখ থেকে চশমাটা খুলে রাখলেন। আর বললেন,
“কন্যা আমার না হলেও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা আমি। সুপাত্র হাতছাড়া করিনি। এতে যদি আমার ব্যাবসায় একটু উন্নতি হয় তো ক্ষতি কী?”

“জায়ান আহমেদ যদি সুপাত্র হয় তবে তুমি থাকো তোমার সুপাত্র নিয়ে।”

তাচ্ছিল্য স্বরে বলেই মিসেস আয়েশা স্থান ত্যাগ করলেন। পাছে মিস্টার নয়ন বললেন,
“একদিন তুমিও জায়ানকে সুপাত্র বলবে।”
অতঃপর চায়ের কাপ উঠিয়ে নিলেন।

—-
সকাল সকাল ইউনিভার্সিটির জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছে নিঝুম। আলফিও অফিসের জন্য তৈরি। সাদা শার্টের সাথে কালো টাই ও কালো প্যান্ট। হাতে কালো ব্লেজার। ফর্মাল লুক। শার্টের স্লিভস কনুই অবধি গোটাতে গোটাতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। আর বলছে,
“ব্রেকফাস্টে এগ স্যান্ডুইচ ও ফ্রুটস।”

নিঝুম হা করে চেয়ে আছে আলফির দিকে। তার অক্ষিগোলকের নড়নচড়ন নেই৷ পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেছে। আলফি নিঝুমের সামনে এক হাত পরিমাণ দূরত্বে দাঁড়ায়। তারপর ভ্রুঁ নাচালে নিঝুমের সম্বিৎ ফেরে। সে আমতাআমতা করে বলে,
“চলো নাস্তা করি।”

তারপর সে দ্রুত ডাইনিং টেবিলের কাছে যায়। আলফি মৃদু হাসে। সেও নাস্তা খেতে বসে। নাস্তা খেতে খেতে নিঝুম আর একবারও চোখ তুলে তাকায়নি। আলফির খাওয়া আগে শেষ হয়৷ সে নিজের প্লেট ধুঁয়ে রেখে সোফা থেকে ল্যাপটপ তুলে নেয়। ততক্ষণে নিঝুমেরও খাওয়া শেষ। তারপর দুজনে বের হয়। গাড়ি চলছে তার গতিতে। হঠাৎ নিঝুম প্রশ্ন ছুঁড়ে,

“তুমি কীসে জব করো?”

“কেন?”

“এরকম বস বস ভাইবে যাচ্ছো তো তাই।”

আলফি হাসলো। তারপর বলল,
“তেমন কিছু না। এটা আমার ড্রেসকোড।”

কিছুক্ষণ পর ওরা ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছায়৷ নিঝুম আলফিকে বায় বলে যেতে নিলে আলফি ডেকে বলে,
“কারও সাথে আননেসেসারি কথা বলার দরকার নেই।”

নিঝুম সন্দিহান হলো। বলল,
“ইউনিভার্সিটিতে ফ্রেন্ড বানাব না?”

“বানাবে৷ কিন্তু বুঝেশুনে। আমার সাথে তোমার পরিচয়ের সময় তুমি যেমন ছিলে, তেমনটা সবার প্রতি হয়ো না। এটাই বুঝিয়েছি।”

নিঝুম ভ্রুঁকুটি করে শুধায়,
“কেমন ছিলাম?”

হাসে আলফি৷ বলে,
“ছটফটে একটা দূরন্ত মেয়ে। কনভারসেশন স্টার্ট তোমার মাধ্যমেই। এখন যাও। লেট হচ্ছে। বায়।”

নিঝুম মিষ্টি করে হেসে আলফিকে হাতের ইশারায় বায় বলে চলে যাচ্ছে৷ আলফি কাউকে ফোন করে বলে,
“কিপ এন আই অন হার।”

—–
দিনের মধ্যাহ্ন। নিঝুম ক্যান্টিনে খাবার কিনে বসেছে। খাবারে চামচ নাড়তে নাড়তে ভাবছে, তার সাথে করে আনা টাকা (ডলারে কনভার্ট করা) দিয়ে বেশিদিন চলবে না। তারপর কীভাবে চলবে? আলফির বাড়িতে থাকছে বলে লিভিং কস্ট দিতে হচ্ছে না। কিন্তু একজনের বাড়িতে কতোদিনই বা থাকা যায়? তারউপর একটা ছেলের সাথে এক বাড়িতে। এখন পার্টটাইম জবও তো সহজে পাওয়া যাবে না। নির্ঝরের কাছেই চাইতে হবে৷ কিন্তু ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে যদি ওর বড়ো আব্বু জেনে যায়? ভেবেছিল ডিভোর্স হয়ে যাবে। তাহলে বড়ো আব্বু জানলেও সমস্যা নেই৷ কিন্তু এখন বড়ো আব্বু জানা মানে জায়ানেরও জানা। এসব চিন্তা করতে করতেই বেখেয়ালিতে খাচ্ছে। তখনি নিজের সামনের চেয়ারে কাউকে বসতে দেখলো। ব্যাক্তিটিকে সে চেনে। আলফির বন্ধু অ্যালেক্স। অ্যালেক্সই প্রথমে ‘হাই নিঝুম’ বলল। নিঝুমও সৌজন্যে উত্তর করে। অ্যালেক্স বলে,

“ফার্স্ট ডে এট দ্যা ইউনিভার্সিটি। হাউ ডু ইউ ফিল?”

“গুড।”

“জাস্ট গুড? ইই ডিডেন্ট মেক এনি ফ্রেন্ডস?

নিঝুম প্রত্যুত্তরে স্বল্প স্বরে বলল,
” নট ইয়েট।”

তৎক্ষনাৎ অ্যালেক্স প্রস্তাব দিলো।
“কুড উই বি ফ্রেন্ডস?”

ইতস্তত করছে নিঝুম। কিন্তু অ্যালেক্স সেসব পাত্তা না দিয়ে হুট করে নিঝুমের হাতের সাথে হাত মিলিয়ে বলে,
“ফ্রেন্ডস!”

অপ্রস্তুত হাসলো নিঝুম। অ্যালেক্স বলে,
“আই হিয়ার, ইউ আর ম্যারিড?”

ভড়কালো নিঝুম। বলল,
“হাউ ডু ইউ নো?”

“আলফি টোল্ড মি দিস।”
আলফির কথা শুনে নিঝুম নিভলো৷ আলফিটা সবার কাছে ও-কে বিবাহিতা বলে পরিচয় করাচ্ছে কেন? আর সেও বারবার তার বিয়ের টপিকটা নিয়েও বলে। নিঝুম আর অ্যালেক্সকে কৃত্রিম হাসি দিয়ে চটজলদি খেতে থাকে। তারপর ক্লাসের বাহানায় উঠে পড়ে।

——
বিকেলে ইউনিভার্সিটির গেইটে আলফির জন্য অপেক্ষা করছে নিঝুম। আলফি বলেছে সে প্রায় চলে এসেছে। মিনিট দুয়েক পর আলফির গাড়ি থামে। নিঝুম গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি চলছে সেই সাথে পরিবেশেও নিরবতা। আলফি বলে,

“কেমন কাটলো দিন?”

“ভালো।”

নিঝুমের সংক্ষিপ্ত জবাবে আলফি হালকা পাশ ফিরে দেখলো। নিঝুম সিটে গা এলিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আলফি শুধালো,
“মন খারাপ?”

নিঝুম এবার সোজা হয়ে বসলো। কাটকাট স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তুমি অ্যালেক্সকে বলেছ, আমি ম্যারিড?”

কথাটা ও বলার ধরণ ভালো লাগলো না আলফির। সে গাড়ি থামালো। এটা একটা পার্কের সামনে। খোলাম মাঠ। সকল বয়সের মানুষজন এখানে হাঁটাহাঁটি করছে। বাচ্চারা খেলছেও। আলফি গাড়ি থেকে নামে। তারপর নিঝুমের সাইডের দরজা খুলে নামতে বলে। নিঝুম বুঝলো না হঠাৎ কেন গাড়ি থামালো৷ নিঝুম গাড়ি থেকে নেমে আসলে ওরা পার্কের ভেতরে যায়৷ হাঁটতে হাঁটতে আলফি বলে,

“অ্যালেক্স একটু অন্যরকম। যাকে বলে প্লেবয়। ও এই পর্যন্ত অনেক মেয়ের সাথে রিলেশনে গেছে। বলতে পারো এটা ওর হবি। রিসেন্ট যার সাথে রিলেশনে আছে, সেই মেয়েটা খুব ভালো৷ ও-কে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। কিন্তু অ্যালেক্স বলছে ওর সাথেও ব্রেকাপ করে ফেলবে। হতেও পারে ও তোমার প্রতি ইন্টারেস্টেড। তাই বলে রাখলাম। যাতে তোমাকে ডিস্টার্ব না করে।”

“ওহ। আমি অ্যালেক্সের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াবার কোনো ইন্টারেস্টই নেই৷ তাও সে এসে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইলো।”

“ওর শুরুটা এমনি। তুমি ওর সাথে বেশি কথা বলো না।”

এরপর ওরা পার্কের একটা বেঞ্চে বসলো। সামনেই বাচ্চারা ফেনা বেলুন উড়িয়ে খেলছে। নিঝুম মুগ্ধ হয়ে সেসব দেখছে। পার্কের প্রতিটি কোণায় প্রকৃতির শরতের ছোঁয়া। মৃদুমন্দ শীতল বাতাস বইছে। আকাশ পরিষ্কার। তুলোর মতো মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। নিঝুম বলল,
“এই সুন্দর ওয়েদারে চা হলে বেশ হতো।”

আলফি কথাটা শুনে উঠে গেলো। কিছুক্ষণ পর দু কাপ কফি নিয়ে হাজির। বলে,
“কফি হবে। চা হবে না।”

নিঝুম মুচকি হেসে কফির কাপটা নিলো। তারপর দুজনে একসাথে বসে পার্কের পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলো।

—–
কিছুদিন পেরিয়ে গেলো এভাবেই। নিঝুম পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত৷ নির্ঝরকে বলে রেখেছিল জায়ানের ছবি একটা তাকে কালেক্ট করে দিতে। জায়ানের কোনো মুখ দেখানো ছবি অনলাইনেও নেই। চোখে কালো গ্লাস ও মুখে মাস্ক সহ ছবিই সব। নির্ঝর বলেছে পেলে তাকে দেখাবে।
আজ নিঝুমের ইউনিভার্সিটিতে ছুটির দিন। আলফিকে অফিসে যেতে হয়েছে৷ নিঝুম বাড়িতে একা। কিছুক্ষণ পড়ে নিঝুম বাড়ির পেছনে চলে গেলো। আলফি বলেছে সে অনলাইনে খাবার অর্ডার করে পাঠিয়ে দিবে। কারণ নিঝুম খুব একটা রান্না পারে না। তাই অলস সময় কাটাতে বাড়ির পেছনে এসেছে৷ জায়গাটা সে দিনের আলোয় আজকেই দেখছে৷ দিনের আলোয় খুব সুন্দর লাগছে৷ গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। যার দরুণ গাছের পাতাতে এখনও পানি লেগে আছে। নিঝুম বৃষ্টিসিক্ত কমলা বর্ণের ম্যাপল পাতার ছবি তুলছে। আপেল গাছের আপেলগুলোতেও রঙ হয়েছে। ইচ্ছে করলো একটা গাছ থেকে পেরে খেতে। তাই করলো সে। আপেলের স্বাদটাও খুব মিষ্টি৷ তখনি মেইন গেইটের বেল শুনতে পেলো। নিঝুম ছুটে গেলো সেদিকে। তারপর খাবারের পার্সেল রিসিভ করে নিয়ে আসলো। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই আলফির কল। কল রিসিভ করে। আলফি বলল,

“এখানে দুজনের খাবার আছে৷ আমি আসছি। একসাথে খাব। তারপর একটু বেরোবো। তোমার তো অটোয়া দেখা হয়নি।”

নিঝুম সানন্দে রাজি হয়ে সায় দিয়ে ফোন কাটে। এদিকে বাড়ির ভেতরে আসতেই নেট কানেক্ট হয়েছে। নির্ঝরের মেসেজও এসেছে। নির্ঝর বলেছে,
“আজকেই জায়ানের ছবি পাওয়া যাবে৷ একজনকে বলেছে। একটু সময় লাগবে।”

নিঝুম অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। যার সাথে তার বিয়ে হলো তাকে সে আজ প্রথমবার দেখবে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,