আলোছায়াতে প্রণয়াসক্তি পর্ব-০৮

0
710

#copyrightalert❌🚫
#আলোছায়াতে_প্রণয়াসক্তি
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৮
আলফি এলো কিছুক্ষণ পর। এরপর একসাথে দুপুরের খাবার খেলো ওরা। এখন বেড়াতে যেতে তৈরি। আলফি খেয়াল করলো নিঝুম কেমন বেখেয়ালি। বারবার ফোন দেখছে। তার চোখেমুখে খুব অস্থিরতা। যেন জাগতিক সকল কৌতূহল, আগ্রহ ভর করছে চোখ জুড়ে। আলফি বলল,
“এতো রেস্টলেস হয়ে ফোনে কী দেখছ?”

নিঝুম তার উৎসুক চোখজোড়া ফোন থেকে হটিয়ে আলফির দিকে নিবদ্ধ করলো। অতঃপর আগ্রহী স্বরে বলল,
“ওহ তোমাকে তো বলা হয়নি, নির্ঝর বলেছে কেউ একজন ও-কে আজ জায়ানের ছবি দিবে। আমি তো জায়ানকে কখনো দেখিনি৷ কোনোদিন যদি জায়ান আমার সামনেও আসে, চিনতে তো পারব না।”

আলফি তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর গাড়িতে বসার ইশারা করলো। গাড়ি ছুটে চলল একটা বিচ সহ পার্কে। মুনি’স বে পার্ক। এটি রিডো নদীর তীরবর্তী। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত স্থির রাখলেও মনোযোগ তার স্থির না। নিঝুমের আগ্রহ আকাশচুম্বী। আলফি দৃষ্টি ফের সামনে ঘুরিয়ে বলল,

“যদি কখোনো প্রুভ পাও, জায়ান আহমেদ সম্পর্কে যা রিউমার শুনেছ সব মিথ্যা। তাহলে কী করবে? মেনে নিবে ও-কে?”

থমকালো নিঝুম৷ এতক্ষণের জায়ানের ছবি দেখার আগ্রহে ভাটা পড়লো। ঠিকই তো। যদি জায়ান আহমেদ সম্পর্কে সে ভুল বুঝে তাকে তবে? স্বামী তো তার। কিন্তু মনের মাঝে এই ভাবনা খানিকের বেশি টিকতে দিলো না। ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,
“প্রমাণ তো হয়নি। তাহলে এই কথা উঠছে কেন?”

“প্রমাণ হতে কতক্ষণ? যে এলি*গেশন এনেছিল সেও কোনো অর্ডিনারি কেউ না। পাঁচ বছর আগে এনুয়াল বিজনেস এওয়ার্ড জিতেছিল। বিজনেস ওয়ার্ল্ডে বিজনেসম্যানদের ক্রাশ ছিল। ইভেন এখনও।”

নিঝুমের মনের ভেতর আশংকা হচ্ছে। আলফির চেহারা ভালো ভাবে দেখলো। ছেলেটা জায়ান আহমেদ সম্পর্কে এমন ভাবে কথা বলে যেন খুব পরিচিত। কিন্তু ছেলেটা কি বোঝে না নিঝুম এসব শুনতে চায় না। তার মনে যে আলফির জন্য অনু়ভূতির সম্ভার। যদি আকস্মিকভাবে বিয়েটা না হতো তবে তো আলফিকেই মনের অব্যক্ত কথাগুলো ব্যক্ত করতো। হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিবেশ করলো।

মুনি’স বে পার্কে পৌঁছেছে ওরা। নদীর তীরবর্তী ও গাছপালায় প্রকৃতিক রঙরূপে পরিপূর্ণ। আদুরে রোদ্দুর ও শীতল হাওয়া। রিডো নদীর বুক থেকে যেন শীতল হাওয়া ধেয়ে এসে শরীরে মৃদু কাঁপন ধরায়। আলাদা হাঁটছে ওরা। আলফি কয়েকহাত সামনে আগে আগে হাঁটছে। নিঝুম পিছুপিছু। যেন হুট করেই দুজনের মাঝে তাল ছুটে গেছে। পার্কে আরও অনেকেই আছে। কেউ কেউ সাইকেলিংও করছে। কাপল হিসেবেও বসা অনেকে। এটা ফ্রেন্ডসদের নিয়ে পিকনিক স্পট হিসেবেও পরিচিত। নদীর শীতল পানিতে হাত ডুবালো নিঝুম। ত্বরিত নিঝুমের ফোনের নোটিফিকেশন আসলো। নির্ঝর ছবি পাঠিয়েছে। অস্থিরতা ঝেঁকে ধরলো নিঝুমকে। বুকের মাঝে ঢিপঢিপ শব্দ সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। কয়েকবার বড়ো করে শ্বাস-প্রশ্বাস ছেড়ে আলফির দিকে তাকালো। ছেলেটা তার থেকে কিছুটা দূরে পকেটে হাত গুঁজে নদীর সম্মুখে মুখ করে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। নিঝুম নির্ঝরের মেসেজ দেখলো। ছবিটা লোড হয়ে ফোনের স্ক্রিনে ভাসতেই চমকে গেলো। কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে ছবিটির দিকেই চেয়ে রইল। তারপর আলফির দিকে চাইলো। কোনো নড়নচড়ন দেখা গেলো না তার। নিঝুম হতাশ স্বরে বলল,

“ছবি তো দিলো কিন্তু অস্পষ্ট ছবি! কানে ফোন নিয়ে কথা বলছে। এক সাইড কোনোমতে বোঝা যায়। এটা দিলেও কী না দিলেও কী!”

তড়িৎ বেগে পাশ ঘুরলো আলফি। অবিশ্বাসের নজরে নিঝুমের হতাশায় মূর্ছিত মুখখানা দেখলো। গত পরশু সে টরেন্টো গিয়েছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের জন্য। সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরেছে। এই মিটিংটা নিউইয়র্কে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিঝুমকে একা ফেলে যেতে পারবে না। নিঝুম এখানে এসেছেই গুণে গুণে আজ সপ্তম দিন। সেই মিটিং শেষে বেরিয়ে গাড়িতে উঠার সময় ফোনে কথা বলছিল। মাস্ক নামানো ছিল। সানগ্লাসটাও খুলে আরেক হাতে ধরা। এক লোক তার সাইড ছবি তুলেছিল। লোকটাকে ধরতে পারেনি। এমনকি তার মুখটাও দেখতে পারেনি। সেই ব্যাক্তিই তবে নিঝুমের কাছের ছবির সোর্স। হ্যাঁ সে জায়ান আহমেদ আলফি। নিজের স্বাভাবিক জীবনে যেন কোনো হেরফের না হয় তাই সে বিজনেস ওয়ার্ল্ডের বাইরে কাউকে জায়ান বলে পরিচয় দেয় না। খুব তো বেশি সময় হয়নি তার এই বিজনেস ওয়ার্ল্ডে। বাবার জোড়াজুড়িতে সে এই বিজনেস জগতে এসেছে। ইউনিভার্সিটি অফ অটোয়া থেকে আরও বছর পাঁচেক আগে বায়োকেমিস্ট্রিতে গ্রাজুয়েশন করে নিউইয়র্ক যেতেই বাবার আকস্মিক হার্ট অ্যা*টাকের মুখোমুখি হয়। তারপর নিউইয়র্কের স্বনামধন্য এক ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে (এমবিএ) ভর্তি হয়। ছোটো থেকে বাবাকে দেখতে দেখতে অনেক কিছুই সে বুঝে। তার দাদার শুরু করা বিজনেসটাকে তার বাবা এতোকাল সামলেছে। তাদের দেখে শিখেছে অনেক। কিন্তু নিজে কখোনো পাকাপোক্ত ভাবে বিজনেস সামলানোতে তেমন আগ্রহী ছিল না। কিন্তু বাবার অসুস্থতায় এতো বড়ো বিজনেস তো ভাসিয়ে দিতে পারে না। তখন থেকেই সে চেহারা লুকিয়ে শুরু করে এই পথচলা। নিজের বুদ্ধিদীপ্ততায় আরও শক্ত ঘাঁটি গড়ে ফেলেছে বিজনেস জগৎটাতে।
অতীতের খানিক রোমন্থন করে কিঞ্চিৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। এগিয়ে গেল নিঝুমের কাছে৷ বলল,

“ক্যানোয়িং করবে?”

নিঝুম মাথা উঁচু করে তাকালো। পলক ঝাপটালো কয়েকবার৷ আলফি ওর হাত ধরে টেনে তুলল। উত্তরের অপেক্ষা না করে একটা ক্যানো (নৌকা) ঠিক করে। তারপর নিঝুমকে সাবধানে উঠিয়ে নিজেও উঠলো। নিঝুম দেখলো আলফির চোখে অদৃশ্য অধিকারবোধ। এই অধিকারবোধ কীসের তার? প্রথমদিন অটোয়াতে আলফির বাড়িতে আসার পর আলফি বলেছিল,
“রাইট না হলে তুমি এখানে আসতে না।”

নিঝুম তাকালো আলফির পিঠের দিকে। দুজনে মিলে ক্যানো নামক নৌকাটাকে চালাবে। অতঃপর অনির্দিষ্ট গন্তব্যের মতো চলতে লাগলো। বিকেলটা রিডো নদীর বুকে ক্যানোয়িং করেই কাটালো তারা। সময়টাও উপভোগ করলো দুজনে। দুজনে দুজনের মনের খবর জানে না৷ প্রকৃতিতে গোধূলি। দুজন একটা মনোরোম প্রিয় প্রহরে গোধূলি বেলা উপভোগ করছে। ওরা নৌকাটা নিয়ে ফিরে আসলো। সূর্য অস্তমিত হওয়ার প্রান্তে। আস্তে আস্তে নদীর গর্ভে যেন তলিয়ে যাচ্ছে। নিঝুম ও আলফি সেই দিকেই দেখছে। একজনের দৃষ্টি স্থির তো আরেকজনের চঞ্চল৷ নিঝুম চঞ্চল চিত্তে এই গোধূলির আলোয় আলফির দিকে এক পলক চাইলো। আলফির এক পাশের ফর্সা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যুক্ত গালে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের শেষ আলো এসে পড়েছে। কপালের উপর অবিন্যস্ত ঈষৎ বাদামী ও কালোর মিশেলের চুলগুলো চিকচিক করছে। সেকেন্ড দুই পেরোতেই দৃষ্টি আবার সম্মুখে অস্তমিত রবির দিকে নজর ঘুরালো। মনের মাঝের দামামা সে স্পষ্ট শুনতে পেলো। তার মন বলছে,

“তোমার পাশে দাঁড়ানো যুবকটিকে তুমি ভালোবাসো। এই যে রক্তিম শরতের গোধূলি, সময়টা প্রিয় মানুষের সাথে উপভোগের। তুমি তাকে সম্পূর্ণ না জেনেই ভালোবাসো।”

দুজনের হাতের সাথে হাতে সামান্য স্পর্শ পেলো। তাকালো দুজন দুজনার দিকে। সূর্য আজকের মতো বিদায় জানিয়েছে পশ্চিম দিগন্ত দিয়ে। পাখিদের কিচিরমিচির ঘরের ফেরার লক্ষ্যে। ওদেরও তো ফিরতে হবে। আজকের বিকেলটাতে কিছু মিশ্র অনুভূতির সাক্ষী ওরা।

চলবে ইন শা আল্লাহ,