আশার হাত বাড়ায় পর্ব-৩৮+৩৯

0
223

#আশার_হাত_বাড়ায়|৩৮|
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকল নিয়ম পালন করে শ্রেয়াকে আনা হলো ফারাজের ঘরে।আজ থেকে এটা শুধু ফারাজের নয় শ্রেয়ার নিজেরও ঘর।অর্পা ও অহি মিলে নিয়ে আসলো শ্রেয়াকে।সাথে মিমিও আছে।মিরাজ নিয়ে আসলো ফারাজকে।ফুলে সজ্জায়িত বিছানা।চারপাশ থেকে রজনীগন্ধার ঘ্রাণ।পরিবেশটা দেখে কিছুটা লজ্জা পেলো শ্রেয়া।পাশে ছোট বড় দুজন মানুষ আবার মিরাজ আছে।দুজনকে এক জায়গায় দার করিয়ে মিরাজ মিটিমিটি হাসতে থাকে।ফারাজ ভ্রুকুটি করে বলে,”ভেবলার মতো হাসছিস কেনো?”

“আজ তোমার বাসর ভাই।”

“তো!”

“বড়ভাইয়ের বাসরের ব্যাবস্থা করতে যেয়ে নিজের বাসরের কথা মনে পড়লো তাই।”

চোখ বড়বড় করলো অর্পা।এই ছেলের মুখে কোনো কথা আটকায় না।ফারাজ গলা খাকারি দিয়ে বলে,”অসভ্য কোথাকার।”

মিরাজ পাত্তা দিলো না।অর্পাকে নিয়ে বের হতে হতে বলে,”বেস্ট অফ লাক ব্রো।”

অহি মিমির হাত ধরে বের হবে তখন শ্রেয়া বলে,”ওকে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো?”

অহি আহাম্বকের মতো তাকিয়ে বলে,”তাহলে ওকে কি করব?”

“আমার কাছে থাকবে না মিমি?”

“আজকের রাতে?”

শ্রেয়া তাকালো ফারাজের দিকে।বিড়বিড় করে বলে,”ভালো যখন বাসেই না বাসর আর কি হবে?এর থেকে ভালো মিমি থাকুক আমার সাথে।

এবার একটু জোরেই বলে,”মিমির মা হয়ে এসেছি আমি।মিমি তো আমার সাথেই থাকবে।”

মিমি মুখে হাত দিয়ে ফোকলা দাঁতে হেসে বলে,”বাচ্চারা বড় হলে আলাদা থাকে জানো না?”

“তুমি তো এতটাও বড় না।”

“অভ্যাস করেছি আমি।পাপা আর আমি একসাথে ঘুমাই না।”

“আমার সাথে ঘুমাবে।”

“আজ না অন্যদিন।আজকে আর এসব নিয়ে কথা বাড়াতে হবে না।আসি আমরা।”(অহি)

“গুড নাইট মাম্মাম।”(মিমি)

মিমির মুখে মাম্মাম শুনে খুব খুশি হলো শ্রেয়া।ঠোঁট চওড়া করে হেসে গুড নাইট জানালো।ওরা যেতেই দরজা লাগিয়ে দিলো ফারাজ।শ্রেয়া এবার একটু নার্ভাস হয়ে পড়ল।বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে সোফায় যেতে নিলে ফারাজ বলে ওঠে,”আশেপাশে কি ক্যামেরা আছে?”

শ্রেয়া সাথে সাথে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো।মুচকি হাসলো ফারাজ।সে প্রশ্ন করেছে আর শ্রেয়া কি না ক্যামেরা খুঁজতে ব্যাস্ত।ভালোভাবে খোজার পর বলে,”কই ক্যামেরা?”

“আমি প্রশ্ন করেছিলাম।খুঁজতে বলিনি।”

“না,কোনো ক্যামেরা নেই?”

“আমি কি বাংলা সিনেমার হিরোদের নাদান মতো দেখতে?”

“না।”

“আপনি কি নিজেকে বাংলা সিনেমার ন্যাকা নায়িকা মনে করেন?”

“কেনো?”

“এই যে বাসরে বাংলা সিনেমার মতো করে বালিশ নিয়ে অন্য জায়গায় যাচ্ছেন।যেনো মনে হচ্ছে আমি আমার বিছানায় আপনাকে স্থান দিচ্ছি না।”

চোখ ছোট ছোট করে তাকালো শ্রেয়া।ফারাজ আবারও বলে,”বাংলা সিনেমার আপডেট ভার্সন আমি আমার লাইফে আনবো না বলেই তো এতটা গ্যাপে বিয়ে করেছি।এখন দেখছি সেই লাইফটাই ব্যাক করছে।”

শ্রেয়া বালিশ রেখে দিলো বিছানায়।কোনো কথা না বলে অন্যদিকে ফিরে বসে আছে।মুখ গোমড়া হয়ে আছে।বাসরেও অপমান।এই লোকের টেরা কথা খালি শ্রেয়ার সাথেই বলতে হয়।ফারাজ শ্রেয়াকে দেখে নিয়ে বলে,”বাসরে নাকি স্বামীকে আগে সালাম করতে হয়।দেনা পাওনা মিটিয়ে নিতে হয়।এগুলো কি আমরা করবো না?”

শ্রেয়া জিহ্বায় কামড় দিলো।পাশে থাকা ঘোমটা নিয়ে আবারও গেলো ফারাজের কাছে।পা ধরে সালাম করতে নিবে ফারাজ থামিয়ে দিয়ে বলে,”করতে হবে না সালাম।এমনিতেই হবে।তো বলুন কি চাই আপনার?”

“কিছু না।”

“বিয়ের প্রথম দিন বলে লজ্জা পেয়ে ঠিকই বলছেন কিছু চাই না।দুইদিন যেতে না যেতেই তো আমার হাতে বস্তা বস্তা জিনিসের লিস্ট ধরিয়ে দিবেন।”

শ্রেয়া কঠমঠ চোখে তাকালো ফারাজের দিকে।ফারাজ বলে,”মিথ্যা কিছুই বলিনি।আপনারা মেয়েরা প্রথমে লজ্জা পেয়েই ছেলেদের ইমপ্রেস করেন।এরপর যেই লজ্জা নিবারণ হয় ওমনি হাতে ধরিয়ে দেন বস্তা ভরা লিস্ট।নারী জাতি বোঝা বড় দায়।”

“এই নারী না থাকলে আপনি পৃথিবীতে আসতেন না।”

“পুরুষ না থাকলেও আমি পৃথিবীতে আসতে পারতাম না।আমাকে পয়দা করতে একটা নারী না পুরুষেরও অবদান আছে।”

“আপনি তো দেখছি আরেক লাগামহীন।”

“সত্যি কথা বলেছি বলে লাগামহীন!”

“আপনি থাকুন নারী পুরুষের অবদান নিয়ে আমি ঘুমাবো।”

“আটকে রেখেছি আমি?”

“ধুর!”

শ্রেয়া ঘুমাতে গেলে ফারাজ আলতো হেসে লাইট অফ করে দেয়।শ্রেয়া চোখ বন্ধ করে নেয়।ফারাজ শুতে শুতে বলে,”প্রথম রাত স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তাকে নিজের আয়ত্তে আনতে চাই না।তবে হ্যাঁ রাতে ঠ্যাং চলে গেলে বুঝে নিবেন গভীর ঘুমে ছিলাম তাই চলে গেছে।বয়স হয়েছে তো হাত পা কন্ট্রোলে থাকে না।আমি কিন্তু নিজ ইচ্ছায় আপনার কাছে আমার ইজ্জতের দফারফা করবো না।”

চোখ মেলে বড়বড় করলো শ্রেয়া।এই লোক আজ এমন করছে কেনো?মাথা কি গেলো নাকি ভাবছে।”আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে।এখন এসব ভাবতে থাকলে সারারাত জাগা হয়ে যাবে।সকালে আপনার উপর দিয়ে চাপ যাবে।কাল আপনার অর্ডার আছে তো।”

ফারাজের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে শ্রেয়া।ঘুমিয়ে যায় ধীরে ধীরে।

মিমি শুয়ে আছে আর মিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অহি।কিছু একটা ভেবে অহি বলে,”আচ্ছা নানু তোমার কি তোমার মম্মির কথা মনে পড়ে?”

মিমি তাকালো অহির দিকে।মিমি এটা বুঝে অহনা হলো অহির মা।অহির মনেও কষ্ট আছে।অহনাকে হারানোর কষ্ট অহি নিজেও পায়।মিমি বলে,”একটু একটু মনে পড়ে।”

“দেখা করবে তোমার মম্মির সাথে?”

ঘাবড়ে গেলো মিমি।খামচে ধরলো অহির হাত।ভীত কণ্ঠে বলে,”আমাকে তো মারবে।আমি দেখা করবো না।”

“না নানু।এখন আর মারবে না তোমাকে।তুমি কাছে গেলে তোমাকে অনেক ভালোবাসবে তোমার মম্মি।”

“তুমি জানো?”

“হ্যাঁ,তোমার মম্মি অনেক ভালো হয়েছে।এখন আর পঁচা কাজ করেনা।তোমাকে মিস করে।তোমার প্রিয় খাবার রান্না করতে চায়।তুমি যদি ভালোবেসে যাও তোমার মম্মি খুব খুশি হবে।”

ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো মিমি। বলে,”তাহলে আমি যাবো।মম্মির সাথে দেখা করবো।পাপাকে বলে কাল নিয়ে যেও।”

“তোমার পাপাকে বলতে হবে না নানু।তোমার পাপা কষ্ট পাবে।তুমি শুধু দেখা করেই চলে আসবে।”

“পাপাকে না বলে আমি কোথাও যাই না তো!”

“আমি নিয়ে যাবো আমার বান্ধবীর বাসায়।তাহলে যেতে দিবে।পাপাকে বলতে হবে না এই বিষয়ে কিছু।পাপাকে কষ্ট দেওয়ার দরকার নেই।তোমার মাম্মাম আর পাপা এখন হাসিখুশি আছে তোমাকে নিয়ে।এখন এগুলো বলে কষ্ট দিবে তুমি?”

“না।”

“তাহলে ওদের না জানিয়েই চলো।”

“আচ্ছা।”

মিমিকে কোলে জড়িয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো অহি।কাল মা মেয়ে একসাথে হবে।পুরোনো তিক্ত সম্পর্ক শেষ করে মধুর সম্পর্কে জড়াতে পারবে।

ভোরের আলো ফোটার আগেই কুরআন তিলাওয়াত শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়ল ফারাজ।পাশে তাকিয়ে দেখে শ্রেয়া কুরআন তিলাওয়াত করছে।ফারাজ খুশি হলো।শ্রেয়া পড়া শেষ করে জায়নামাজ ভাঁজ করে ফারাজের দিকে তাকালো।মুখ ভেংচি দিয়ে অন্যদিকে ফিরলো শ্রেয়া।ফারাজ আহম্বক হয়ে বলে,”আমি আবার কি করলাম?”

“সকালে এতবার ডাকা হলো উঠলেন না কেনো?নামাজের সময় তো শেষ হতে যাচ্ছে।”

“কখন ডাকলেন?”

“আমি ডাক দেইনি কিন্তু আপনাকে কল করেছি।”

“এহ!বউ পাশে থেকে কখনও এভাবে কল দেয়?আজ প্রথম দেখলাম।”

“সূর্য চারিদিকে আলো ছড়াবার আগে নামাজ পড়ে নিন।”

ফারাজ চলে গেলো ওযু করতে।শ্রেয়া নেমে আসলো নিচে।রান্নাঘরে ঢুকে একেকটা জিনিস দেখতে থাকে।কিছুই চেনে না এই জায়গার।অর্পা হামি দিতে দিতে আসে।বলে,”কি খুঁজছিস?”

“চা বানাবো।কোন হাড়িতে চা বানায় তাই তো জানি না।”

“আমি দিচ্ছি।এত সকালে না উঠলেও পারতিস।”

“নামাজ পড়তে উঠেছি।আচ্ছা বাসার সবাই কেমন চা খায়? মানে হালকা লিকার নাকি কড়া।”

“একেকজন একেক চা।শাশুরি গ্রিন টি,অতসী ব্ল্যাক কফি,তোর জামাই সুগার ফ্রী ট্যাবলেট দিয়ে চা,আমার জামাই বেশি করে চিনি আর দুধ দিয়ে চা,আমাদের শশুর আমি আর কাকিয়া আদার আর লেবু দিয়ে লাল চা।”

“বাব্বাহ।এতগুলো চা তুই বানাস!”

“আমি না।মেইড আছে।তবে বাবার আমার আর কাকিয়ার জন্য সবসময় নিজে বানাই।”

“উনি সুগার ফ্রী ট্যাবলেট দিয়ে চা খান।ট্যাবলেট কোথায়?”

অর্পা একেক করে সবকিছু দেখিয়ে দিলো।শ্রেয়া চা বানিয়ে ফ্লাক্সে রেখে দিলো।অর্পার দিকে তাকিয়ে বলে,”এটাতে বাবা কাকিয়া আর তোর চা আছে।তোর জামাইয়ের পছন্দের চা তুই বানিয়ে দিস।আমি গেলাম উপরে।”

ফারাজ আর নিজের জন্য চা নিয়ে উপরে গেলো শ্রেয়া।ফারাজ নামাজ শেষ করেছে মাত্র।শ্রেয়া টি টেবিলের উপর ফারাজের জন্য আনা চা রেখে ব্যালকনিতে যায় নিজের চা নিয়ে।ফারাজ চায়ের কাপ নিয়ে ব্যালকনিতে আসলো।শ্রেয়ার পাশে দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে চা উপভোগ করছে।শ্রেয়া আড়চোখে দেখছে ফারাজকে।ফারাজ সামনে তাকিয়ে আছে আর চায়ে চুমুক দিচ্ছে।এই মনোরম দৃশ্য আর আশেপাশের সকালের শীতল হাওয়া মন ছুঁয়ে নিচ্ছে শ্রেয়ার।শখের পুরুষের সাথে এভাবে সকালের চা উপভোগ করতে পেরে ভালো লাগছে শ্রেয়ার মনে।

শ্রেয়া আর ফারাজ দুজনেই রেডি হয়ে নিচে নামলো।শ্রেয়া আগে ওর পেস্ট্রি হাউজে যাবে।সাথে করে মিমিকেও নিতে চায়।কিন্তু অহি বলে,”আমি আজ আমার এক বান্ধবীর বাসায় যাব।মিমিকে নিয়ে যেতে চাই।আমার মিমিকে ওরা দেখতে চায়।”

ফারাজ সম্মতি দিলো।অহি একটু শান্তি পেলো মনে মনে।তিহান প্রশ্ন করে,”তোমার কোন বান্ধবীর কথা বলছো?”

“তুমি চিনবে বা।”(কিছুটা রুক্ষ কণ্ঠে)

জিনিয়া খোচা দিয়ে বলে,”তোমার বান্ধবীও আছে!পড়ালেখা তো করোনি।বান্ধবী পেলে কোথায়?”

“এই বাড়ির ভাত কপালে লেখা না থাকলে পড়ালেখা করার সুযোগ পেতাম।যতটুকু করেছি তারমধ্যে বান্ধবী জুটিয়েছিলাম।”

অহি যে তিহানকে ইঙ্গিত করে বলেছে এটা সবাই বুঝতে পারলো। তিহান চৌধুরী না চাইলে ফারহান চৌধুরী বেশ কয়েকবার অহিকে পড়াশোনা করার প্রস্তাব দেন কিন্তু অহি তখন স্বামী সংসার বুঝতো।স্বাভাবিকভাবে যে শিক্ষাটা অর্জন করা হয় সেই শিক্ষায় চলে মানবজাতি।অহির ক্ষেত্রেও তাই।পড়াশোনা না করে তূর্যকে বড় করলো।”

মিরাজ এসে টেবিলে বসতে বসতে বলে,”তূর্য আসবে কাল।”

সোফায় বসে নখে নেইলপলিশ দিচ্ছিলো অতসী।স্বামী আসবে শুনে খুশিতে লাফিয়ে বলে,”সত্যি!কিন্তু ও তো আমাকে কিছু বলেনি।”

“হয়তো সারপ্রাইজ দিতে চায়।”

“হাউ কিউট।”

মনে মনে হেঁসে দিলো ফারাজ।কাল সত্যি একটা সারপ্রাইজ আছে।তবে আনন্দের না বেদনার।

চলবে…?

#আশার_হাত_বাড়ায়|৩৯|(মিশ্র গল্প)
#লীলাউদ্যান (আংশিক অংশ)
#ইশরাত_জাহান
🦋
স্নিগ্ধ সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসার সামনের গাছগুলোতে পানি দিতে থাকে রিমলি।মিসেস জুঁই এলো সেখানে।রিমলির পাশে দাঁড়ালো।এই কয়েকদিনে ছেলের চলাফেরায় মিসেস জুঁই বুঝতে পেরেছেন তার ছেলে এই শ্যামবর্ণের কন্যাটির প্রেমে পড়েছে। রিমলিকে তারও ভালো লাগে।বিষয়টি যেহেতু ভালোবাসার তাই দেরি করতে চায় না মিসেস জুঁই।ছেলে মেয়ে এক অপরকে চাইলে এভাবে এক ছাদের নিচে আলাদা রাখলে বিপদ আরো বেশি বেড়ে যায়।তাই তিনি রিমলির ব্যাপারে জানতে চান।রিমলির মতামত থাকলে বিয়ে নিয়ে কথা বলবে সৃষ্টি বেগমের সাথে।রিমলির পাশে এসে বলেন,”টবগুলো শুকিয়ে গেছে।এখানে একটু বেশি পানি দেওয়া লাগবে।”

রিমলি টবে পানি দিতে থাকে।মিসেস জুঁই বলেন,”জানো আমার ফুল কেনো এত প্রিয়?”

মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে দিলো রিমলি।মিসেস জুঁই বলেন,”আমার বড়বোন জিনিয়া আর আমি জুঁই।আমার মা আমাদের মিল রেখে জ দিয়ে ফুলের নাম রাখে।নিজের নামের জন্যই আমার কাছে ফুল আরো বেশি প্রিয়।ছোটবেলা থেকে মনে হতো আমি নিজেই একটি ফুল।সেই সোনালী দিনগুলোর কথা এখন শুধু স্মৃতির পাতায় আটকে আছে।”

“আমাদের সবারই ছোটবেলায় আবারও ফিরে যেতে ইচ্ছা করে।তাই না আন্টি?”

“আমার তো খুব ইচ্ছা করে।বিশেষ করে দিনদিন চুল পাকতে শুরু করেছে যে।মনে হয় এইতো সেদিনই আমি স্কুল থেকে এসে মাকে জড়িয়েছিলাম।পুরোনো দিনে ফেরত গেলে বাবা মাকে হয়তো আবারও ফিরে পাবো।”

“আমিও।আমার বাবাকে আবার ফিরে পাবো। ওইদিনটা আসলে আমি ওইদিন বাবাকে আর বের হতে দিবো না।বাবা বের না হলে এক্সিডেন্ট হতো না।”

কথার মধ্যে কষ্টের ছাপ।মিসেস জুঁই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”যার যাওয়ার সময় হয় তাকে আটকে রাখলেও সে থাকবে না।”

রিমলির চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে।মিসেস জুঁই দেখছেন।গাড়ির শব্দে পিছনে তাকালো দুজনে।শ্রেয়া আর ফারাজ এসেছে। রিমলি দৌড়ে জড়িয়ে ধরলো বোনকে।সালাম দিলো ফারাজকে,”আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

ভিতরে গিয়ে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে শ্রেয়া দোকানে গেলো।মিসেস জুঁই ফারাজের পাশে এসে বলেন,”তোর সাথে একটু কথা ছিলো।”

“হ্যাঁ,বলো।”

“শিহাবকে নিয়ে।আমার মনে হয় শিহাব কাউকে ভালোবাসে।”

“কাকে?”

“তোর শালীকে।”

ফারাজ তাকালো মিসেস জুঁইয়ের দিকে।বলে,”তোমার কি মেয়েটাকে পছন্দ?”

“হ্যাঁ,তবে বয়স তুলনামূলক বেশ কম।”

“তোমাদের জেনারেশন তো এগুলো দেখতো না।স্টাডি করতে গেলে গ্র্যাজুয়েশন ছেলের বয়স বাড়বে আর মেয়েরা তো আঠারো এর পর যেকোনো সময় বিয়ে করতে পারবে।যদি তাদের সম্মতি থাকে।”

“এটাও ঠিক।”

“শিহাব রাজি থাকলে তোমার আপত্তি করার কিছু দেখছি না।তবে মা হিসেবে তোমার মতামত অবশ্যই আছে।”

“তুই শ্রেয়ার সাথে কথা বলে দেখ।”

“হুম।”

দোকানের কাজ সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে শ্রেয়া।কেক বানানো মাত্র শেষ হলো।আজ এখানে যারা আসবে তারা দুজন হলো নাবিহা আর মীর।এই দুই মাস হলো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়েছে।রোজ সকালে মর্নিং ওয়াকের সময় এখান দিয়ে যায়।নাবিহা কেক খেতে খুব ভালোবাসে।মীরের জন্য খায় না।নাবিহার বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর থেকে স্ট্রেসমার্ক আর মেদ বেড়েছে।যেটা মীরের চিন্তার কারণ।নাবিহাকে মেদ কমাতে এই একমাস ধরে অনেক দৌড়ের উপর রেখেছে। কাল হঠাৎ নাবিহা কেক খাওয়ার আবদার করেছিলো।মীর প্রমিস করেছে আজ তাকে ইচ্ছামত কেক খাওয়াবে।শ্রেয়া সব ঠিক করে বসতেই দোকানে উপস্থিত হলো মীর ও নাবিহা।মীর এসেই শুরু করে দিলো ফ্লাটিং করা।শ্রেয়ার সামনে এসে একটু ঝুঁকে বলে,”হেলো মিস বিউটিফুল লেডি।আপনার মতো দেখতে মিষ্টি এবং ভালো কেক দিবেন আমার হানিকে।”

শ্রেয়া হা হয়ে আছে।বউকে পাশে রেখে আরেকজনের বউকে এভাবে বলছে।নাবিহা মীরের মাথায় আলতো চাপড় মেরে বলে,”যেখানে সেখানে ফ্লাটিং!”

“মিস বিউটিফুল লেডি।মাই হানি ফিল জেলাস।প্লীজ ডু ইট ফার্স্ট।”

“ওটা মিস না মিসেস হবে মিস্টার মীর।”

পরিচিত কণ্ঠ পেয়ে পিছনে তাকালো মীর। ফারাজকে দেখে বলে,”হেয় ব্রো।”

বলেই হ্যান্ডশেক করে।মীর শ্রেয়ার দিক তাকিয়ে বলে,”তোমার মিস উফস মিসেস?”

“ইয়াহ।”

“ওহহো!এই জন্য তুমি আমার বিয়েতে আসতে পারোনি।”

“নো।তখন আমি দেশে ছিলাম না।তো মিসেস নাবিহা আমার ভাইটার সাথে এডজাস্ট হতে সমস্যা হচ্ছে না?”

নাবিহা মীরের পাশে এসে দাড়িয়ে বলে,”ও আছে বলেই আমি মুক্ত আকাশে পাখির মতো উড়তে পারি।ডানা মেলে সুখপাখিদের দেখতে পাই।ভালোবাসার নতুন আবির্ভাব উপলব্ধি করি।”

“বিয়ের আগে তো এমন ছিলি না ভাই।”

“হানি আমার ব্যাপারে সব জেনেই আমার সাথে লীলাউদ্যানে পারি জমিয়েছে।”

বলেই নাবিহার হাত ধরে নেয় পরম আবেশে।ফারাজ আলতো হাসে।শ্রেয়া খুব সুন্দর ডিজাইন করা কেক এনে বলে,”হ্যাপি সেকেন্ড মান্থ এনিভারসারি।”

নাবিহা মীরের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই জন্য তুমি আমাকে কাল কেক খেতে দেওনি?”

“ইয়েস।আমার হানির একটি দিন ছুটিতে দিবো।তো সেটা পারফেক্টলি কাটাতে হবে না!কেক কেনো আজ তুমি তোমার আনহেলদি খাবার যা খুশি খাও।কাল থেকে আবারও ফুল ডায়েট।আমাদের বেবী প্ল্যান করতে হবে তো।”

শ্রেয়া নাবিহার দিকে তাকাচ্ছে।কত যত্নে আছে মেয়েটি।জীবনের দুইটা বছর হেলায় পার করে আজ সুখের সাগরে পারি জমিয়েছে।ফারাজ এসে শ্রেয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,”হানি শব্দটা এভেইলেবল হলেও আমি এটার সাথে সম্পর্কিত নই।তাই আমি ওসব হানি জানু বলে ডাকতে পারব না।একটু বাঙালি নামে ডাকতে পারি কি?”

“যেমন?”

“শ্রেয়াময়ী।বাঙালি বাঙালি ভাব প্রকাশ পায়। চলবে?”

মীর শিস বাজিয়ে বলে,”চলবে না ব্রো দৌড়াবে।আসো আমাদের কেক কাটতে হবে।”

মীর আর নাবিহা বিয়ের দুই মাস পূর্ণ হওয়ার কেক কেটে একে অপরকে খাইয়ে দিলো। মীর শ্রেয়াকে বলে,”সাউন্ড বক্স আছে?”

“হ্যাঁ,আপনারা ড্যান্স করবেন নাকি এমনি শুনবেন?”

“আমি এখন আমার হানির সাথে কাপল ড্যান্স করবো আর আপনারাও করবেন।”

শ্রেয়া তাকালো ফারাজের দিকে।ফারাজ বলে,”বউয়ের সাথে ড্যান্স করতে আমার আপত্তি নেই।”

চোখ বড় বড় হয়ে এলো শ্রেয়ার।তারপরও খুশি হলো মনে মনে।সাউন্ড বক্সে সফট গান বাজানো হলো।মীর আর নাবিহা নাচতে থাকে অন্যদিকে ফারাজ আর শ্রেয়া।দোকানের মধ্যে ঢুকলো রিমলি।কোচিং শেষ করে মাত্র আসলো।টেস্ট পরীক্ষা সামনে।এখন কলেজে যায় না।দোকানে বসে বই নিয়ে পড়ে আর গল্প লিখে।সৃষ্টি বেগম এদিক ওদিক দেখে আর রিমলি টুকটাক সাহায্য করে।দুইজোড়া কাপলের ড্যান্স দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে ছবি তুলতে থাকে রিমলি।শিহাব এসে দাড়ালো রিমলির পাশে।রিমলি প্রশ্ন করে,”আজ কাজ নেই আপনার?”

“টানা একমাস একটা সিরিয়াস কেস দেখেছি।এখন কিছুদিন ছুটি।কিছুদিন বললে ভুল পরশু থেকেই জয়েন হবো।”

সামনে কাপলদের দেখে মনের আবেগেই শিহাব বলে,”তোমার কি কাউকে ভালো লাগে রিমলি?”

ভ্রুকুটি করে রিমলি উত্তর দেয়,”যেমন?”

“বিএফ।”

“এখনও তো ইন্টার কমপ্লিট করলাম না।এত অল্প বয়সে বিএফ রাখলে মানায়?”

“এর মানে কি অনার্সে উঠলে তুমি প্রেম করবে?”

“সবাই করে।আমি করলে সমস্যা কোথায়?”(শিহাবকে খেপাতে)

“কার সাথে প্রেম করবে শুনি?”

“যার সাথেই করি না কেনো।আপনাকে কেনো বলবো?”(মুচকি হেসে)

“তোমার প্রেম আমি করাচ্ছি।এতটুকু মেয়ে সে কি না প্রেম করতে চায়!”

“এই একদম বয়স নিয়ে খোচা দিবেন না।এই এতটুকু মেয়ে কত বুইড়া থেকে জোয়ান মানুষের বিয়ে দিয়ে বাচ্চা পয়দা করেছে জানেন?”

“কয়জনের?”

হাতের কর গুনলো রিমলি।বলে,”একেকটা গল্প অনুসারে প্রায় বিশটা লোকের বিয়ে দিয়েছি।”

কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না শিহাব।বলে,”মানে?”

“কিছুনা।”(কথা এড়াতে)

“ভুলে কি ভুলভাল বকি আমি।এরা তো জানে না আমি লেখিকা।ধুর!”(মনে মনে)

কাপল ড্যান্স শেষ হতেই মীর বলে,”এখন আমাদের যেতে হবে।আমার কাজ আছে।অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।আজ আসি ব্রো।”

ফারাজ জড়িয়ে ধরে মীরকে।শ্রেয়া এসে জড়িয়ে ধরে নাবিহাকে। একে অপরকে বিদায় দিলো তারা।নাবিহার হাত ধরে বাইরে এলো মীর।গাড়িতে উঠে ড্রাইভ করে কিছুটা দূরে যেতেই শ্রেয়া দেখলো দোকানের সামনে একটা রিক্সা এসেছে।রিক্সা থেকে নামছে জিন্নাত আর পূর্ব।জিন্নাত হাত ধরে টানতে টানতে আনছে পূর্বকে।নাবিহা আর পূর্বের সম্পর্কে অবগত শ্রেয়া।ওদের বিচ্ছেদের নিউজ দেখেছে সে।মনে মনে ভাবছে,”ভাগ্য তাদের আলাদা করলেও রেখেছে পাশাপাশি।দুই দেহ আলাদা হলেও আলাদা হতে পারেনি দুই মন।যেভাবেই হোক তাদের একসাথে দেখা না গেলেও দেখা যাবে তাদের সম্পর্কের গভীরতা।”

একদিকে নাবিহা তার স্বামীর সাথে চলে যাচ্ছে গাড়ি করে আরেকদিকে পূর্ব এলো আরেক মেয়ের জোরাজুরিতে।জিন্নাত এসেই শ্রেয়ার সামনে দাড়িয়ে বলে,”আমাকে স্ট্রবেরি কেক দিন।আর এই লোকটিকে তেতো চকলেট কেক।উমমম না।ওনাকে ভেনিলা একটু মিষ্টি বেশি সেই কেক দিন।”

রিমলি ওদের কাছে এসে বলে,”জিন্নাত আপু তুমি?”

শ্রেয়া বলে ওঠে,”তুই চিনিস?”

“হ্যাঁ,আমার কলেজেই পড়ে।আমার সিনিয়র কিন্তু খুব ফ্রেন্ডলি।আমিও স্ট্রবেরি কেক খাই।দাড়াও নিয়ে আসছি আমি।”

পূর্ব পাশের টেবিলে বসতে যাবে দেখলো একটি কেকের অর্ধেক অংশ কাটা কিন্তু কেকের উপরের নাম দেখা যাচ্ছে।সেকেন্ড মান্থ এনিভার্সারি মীর এন্ড নাবিহা।চোখ চিকচিক করে উঠলো পূর্বের।গলা শুকিয়ে এলো তার।আজ সে সম্পর্কের মূল্য বুঝলে সুখটা সেই পেতো।শ্রেয়া ভ্যানিলা কেক এনে পূর্বের টেবিলের উপর রেখে বলে,”সম্পর্ক ধরে রাখতে অধিক অর্থ নয় অধিক সময়ের প্রয়োজন।”

অতঃপর ফারাজের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভালোবাসার জন্য মন থাকা লাগে এটা যেমন ঠিক ভালোবাসা ধরে রাখার জন্য ভালোবাসার ব্যক্তিকে মন ভরে সময় দিতে হয়।সারাটা দিন না হোক একটু সুখ দুঃখ আদান প্রদানের জন্য স্বল্প সময়ই হোক।হারিয়ে গেলে আফসোস করলেও কেউ ফিরে আসবে না হারিয়ে যাওয়ার আগে ধরে রাখতে হবে।”

ফারাজ শ্রেয়ার কথাগুলো শুনে হেসে দিলো।মনে মনে বলে,”সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আমি আপনার মুখ থেকেই আগে শুনতে চাই শ্রেয়াময়ী।বেদনার বানী দিয়ে নয় মধুর মিশ্রণে যেদিন আপনি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করবেন সেদিন আমিও আপনাকে আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখাবো।”

রিমলি কেক এনে জিন্নাতের হাতে দিলো।সে নিজেও এক পিচ খেতে শুরু করলো।শিহাব দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে।মনে মনে বলে,”স্ট্রবেরি।তোমার এই স্ট্রবেরির প্রতি পাগলামির জন্যই নামটা তোমাকে দেওয়া হলো।”

চলবে…?