আশার_হাত_বাড়ায় পর্ব-৮+৯

0
215

#আশার_হাত_বাড়ায় |৮|
#ইশরাত_জাহান
🦋
একা বাড়িতে একা থাকাটা তাও একটা মেয়ের জন্য কতটা কঠিন তা শ্রেয়া বুঝতে পারছে।ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে চারপাশে।টিনের চালে ঝিরঝির শব্দ হচ্ছে বৃষ্টির জন্য।ঠান্ডা হয়ে গেছে ঘর।টিনের ঘরগুলো একটু বৃষ্টি হলেই ঠান্ডা হয়ে যায়।জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে শ্রেয়া।বিদ্যুৎ চমকালে চোখ বন্ধ করে নেয়।কিছুটা ভয় কাজ করছে মনের ভিতর।কিন্তু ভয়টাকে জয় করছে সে বাধ্য হয়ে।একা থাকা ছাড়া উপায় নেই তার।এটাই যে এখন তার নিয়তি।

ল্যাপটপে কাজ সেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয় ফারাজ।ঠিক তখনই খটখট শব্দ হয় দরজা থেকে।দরজা খুলে ফারাজ দেখতে পেলো মিমিকে।প্রশ্ন করে,”তুমি ঘুমাওনি?”

ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে মিমি বলে,”একা ঘুমোতে ভয় করছে পাপা।বিদ্যুৎ চমকায় তো।”

“আজকে এখানে ঘুমাবে?”

মিমির সোজা উত্তর,”হ্যাঁ।”

ফারাজ দেখলো বাইরের আবহাওয়া।তারপর মিমিকে বলে,”আচ্ছা ঘুমাও।”

মিমি শুয়ে পড়ে বিছানায়।মিমির গায়ে কাঁথা দিয়ে দেয় ফারাজ।তারপর সে যেয়ে শুয়ে পড়ে সোফায়।মিমি ছোট করে বলে,”গুড নাইট পাপা।”

“সুইট ড্রিম প্রিন্সেস।”

বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে।কিন্তু শীতল আবহাওয়া রয়ে গেছে।পাতলা চাদরটা গায়ে মুড়িয়ে জানালা দিয়ে চাঁদ দেখছে শ্রেয়া।তারা নেই ওই আকাশে।শুধু মাত্র একটা চাঁদ আছে।তাও মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে।আস্তে আস্তে আবহাওয়াটা কেমন মনঃক্ষুন্ন পরিবেশ করে দিচ্ছে।কিছু হারানোর কষ্ট জাগিয়ে দিচ্ছে শ্রেয়াকে।কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলো শ্রেয়া।পানি গড়িয়ে পড়ছে এখন তার চোখ থেকে।নিজেকে নিজে বলে ওঠে,”কেনো আমাকে ভালোবাসতে পারলো না?কেনো আমাকে তার পছন্দের নারী করে তুলতে পারলো না?যখন তার পছন্দের নারী হয়ে উঠতে পারবো না জানে তাহলে কেনো করলো আমাকে বিয়ে?কেনো এভাবে ঠকে যেতে হলো আমাকে?”

শ্রেয়ার কথাগুলো ঘুরেফিরে শ্রেয়ার কানেই ভাসতে থাকে।কেউ নেই তার কথা শোনার জন্য।একটি মেয়ে কখনও তার সংসার ভাঙতে চাইবে না।বিয়ের পর টানা দেড় বছর এক ছাদের নিচে ছিলো তার স্বামীর সাথে।স্বামী মন দিতে না পারলেও সে তো স্বামী হিসেবে তাকে মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছে।স্বামী শব্দটার মান রাখতেই তো কতকিছু সহ্য করলো।কিন্তু সেই স্বামী তার ভালোবাসার তার বউ হওয়ার মূল্য দিলো না।জীবনে প্রথম পুরুষ বৈধ হয়ে এসেছিলো রনি।রনি মানুষটি খারাপ হলেও শ্রেয়ার কাছে সেই ছিলো মহান।আর এখন সেই হয়ে গেছে ঘৃণার পাত্র।

*******
রাতের বেলা ফেইসবুকে গল্প পোস্ট করছে রিমলি।সৃষ্টি বেগম ঘুমিয়ে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখালেখির কাজ করে সে।এখনও তাই করছে।এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর এই তিনমাস সে গল্প জগতে পা দিয়েছে। রিমলির প্রথম লেখাতেই সে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। এখনও তাই করছে।গল্পের সুন্দর সুন্দর কমেন্টগুলা দেখে মিটিমিটি হাসছে।পাশে সৃষ্টি বেগম ঘুমিয়ে আছে।তাই মন খুলে কিছু করতে পারছে না।রিমলির কমেন্ট পড়ার ভিতর খেয়াল করলো তার কাছে একটি ম্যাসেজ এসেছে।উপরে নোটিফিকেশন দেখা যাচ্ছে।ম্যাসেজটি ওপেন করতেই দেখতে পেলো একটি ছেলের অ্যাকাউন্ট থেকে ম্যাসেজ।ওখানে লেখা,”লেখিকা হিসেবে আপনি পারফেক্ট।অনেক সুন্দর শব্দচয়ন আপনি প্রয়োগ করতে পারেন মিস বা মিসেস লেখিকা।”

উৎসাহ পেয়ে রিমলি চলে গেলো আইডির ভিতরে।ফেসবুক থেকে দেখতে থাকলো তার প্রোফাইল।আইডি নাম ‘শিহাব হাসান’।আরো কিছু জানতে আইডির নিচে স্ক্রল করতেই দেখতে পেলো পুলিশ অফিসার।জব স্ট্যাটাস দেখেই রিমলি ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে। জোরে হাসার উপায় নেই।সৃষ্টি বেগম আছেন যে।রিমলির খুব হাসি পাচ্ছে।একজন পুলিশ অফিসার তাকে মিস বা মিসেস বানিয়ে দিলো।তারপর আপনি বলে সম্মধোন করছে।যেখানে রিমলি তার থেকে বয়সে ছোট।ম্যাসেজের কোনো রিপ্লাই না দিয়েই ডাটা অফ করে ঘুমিয়ে গেলো রিমলি।

******
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরের কাজ করছে রুবিনা রুহি আর রুমা।রনি অনেক জায়গায় সিভি জমা দিয়ে রেখেছে।এত তাড়াতাড়ি তার রেসপন্স পাবে না।তাই আরো কোম্পানিতে চেষ্টা করছে সে।হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো।পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো রুমাকে।তাই রুমাকে বলে,”যা দেখতো কে এসেছে?”

রুমা গিয়ে দরজা খুলতেই অবাক হয়ে দাড়িয়ে থাকে।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই তিনজন পুলিশ।তাদের ভিতর একজন শিহাব।রুমাকে জিজ্ঞাসা করে,”মিস্টার রনি আছে?”

রুমা চুপ থাকে।রনি কিছু দেখতে পাচ্ছে না তাই রুমাকে প্রশ্ন করে,”কে এসেছে রুমা?”

রনির জোরে কথা বলার শব্দে শিহাব এবার ভিতরে আসে। রুমা ওখান থেকে দৌড়ে রান্নাঘরে এসে বলে,”মা মা পুলিশ এসেছে।ভাইয়াকে খুঁজছে।”

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে রুবিনা মাথায় কাপড় দিতে দিতে বেড় হলো।পুলিশ এসে রনির সামনে দাড়ালো।রনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,”এত সকালে আপনারা আমার বাসায়?”

পকেটে হাত গুজে শিহাব বলে,”আমাদের কাজের জন্য কি সকাল বিকাল লেখা থাকে মিস্টার রনি?ক্রিমিনাল ধরতে আমাদের কারো বাসায় আসার ইনভেটিশন নেওয়া লাগে না।বিনা ইনভেটিশনে খালি পুলিশ আসে লোকেদের বাসায়।”

“তো কেনো এসেছেন?”

“হয়তো আমার কথা ভালোভাবে শোনেননি।আমি বলেছি ক্রিমিনাল ধরতে আসার কথা।”
বলেই রনির সামনে হ্যান্ডকাপ ধরে শিহাব।রনি প্রশ্ন করে,”আমার অপরাধ?”

শিহাব বলে ওঠে,”আপাতত একটাই বলি এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার।বাকিটা পরে জানতে পারবেন।এখন চলুন আপনাকে আপ্যায়ন করতে হবে।”
বলেই রনির হাতে হ্যান্ডকাপ বেধে দেয় শিহাব।রনি নিজেকে বাঁচাতে বলে,”আপনাদের কাছে এফ আই আর আছে?”

“পুলিশ কি আমরা হুজুকে হয়েছি?সব ট্রেনিং পেয়েই না পুলিশ হতে পারি।এটুকু সেন্স আমাদেরও আছে যে কাউকে অ্যারেস্ট করতে হলে স্ট্রং এভিডেন্স বা এফ আই আর থাকা লাগে।সব ব্যাবস্থা আছে।বাকি কথা পুলিশ স্টেশনে হবে,চলুন।”

বলেই নিয়ে যেতে থাকে রনিকে।বাধা হয়ে দাড়ায় রুবিনা।বলে,”আমার ছেলে কি করেছে?ও তো কারো কোনো ক্ষতি করেনি।কেনো নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?”

শিহাব এবার রুবিনার দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনার ছেলে কি করেছে না করেছে ওটা আদালতে প্রকাশ পাবে।এখন আপনাদের হাতে সময় আছে উকিল দেখুন।আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে দিন।”

বলেই নিয়ে চলে যায় রনিকে। দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকে রুবিনা।কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না।আশেপাশে থেকে লোকজন দেখছে।পুলিশের গাড়ি আসতেই সবার উকি দেওয়া শুরু।বাড়িওয়ালা নেমে এসেছেন মাত্র।শিহাবের কাছে এসে প্রশ্ন করেন,”কি হয়েছে?ছেলেটার অপরাধ কি?”

রনিকে ধাক্কা দিয়ে অন্য পুলিশের কাছে পাঠালো শিহাব।তারপর বারিওয়ালাদের বলে,”ওনার নামে মামলা এসেছে।এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ারের জন্য ওনাকে আমরা অ্যারেস্ট করতে বাধ্য।”

বলেই চলে যায় শিহাব।বারিওয়ালা এবার রুবিনার কাছে এসে বলে,”আপনারা কি শুরু করেছেন বলুন তো?কাল বউমা গেলো আজ পুলিশ আসলো।এসব ক্রিমিনালদের আমার বাসায় জায়গা দিবো না।এক তারিখ আসলেই চলে যাবেন আপনারা।”

বলেই চলে গেলো তারা।আশপাশ থেকে লোকে ভিন্ন মন্তব্য দিয়ে যাচ্ছে।রুবিনা তার মেয়েদের দিকে তাকালো।রুহি আর রুমা আতঙ্কে আছে এগুলো দেখে।রুবিনা ভিতরে এসে বসলো।কল করলো তার আত্মীয়দের।সাহায্য চাইতে হবে এখন তাকে।

******
কম্পিউটার দোকান থেকে সিভি আর পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে বেড় হলো শ্রেয়া।রাস্তায় দাড়িয়ে আছে রিক্সা খোঁজার জন্য।ঠিক সেই সময় সেখানে হাজির হয় রনিদের এক প্রতিবেশী।শ্রেয়ার পাশে এসে জিজ্ঞাসা করে,”আরে শ্রেয়া তুমি এখানে?”

মহিলাটিকে দেখ শ্রেয়া বলে,”কাজে এসেছিলাম।”

“চাকরি পেয়েছো?”

“হ্যাঁ।”

“তা ভালোই করেছো।তোমার স্বামীকে তো আজ পুলিশে নিয়ে গেছে।”

স্তব্ধ হলো শ্রেয়া।প্রশ্ন করলো,”কেনো?”

“অতকিছু কিভাবে জানবো!যতটুকু শুনলাম পরকীয়ার জন্য।তবে আমরা তো ভেবেছিলাম তুমি করেছো।”

রাস্তার দিকে তাকিয়ে শ্রেয়া বলে,”না আণ্টি।আমি এসব কিছু জানি না।আমি তো শুধু ডিভোর্স এর জন্য চেষ্টা করেছি।”

“ওহ,আচ্ছা তাহলে যাও কাজে।”
বলেই বিদায় নিলো মহিলাটি।শ্রেয়া আকাশের দিকে তাকালো।নিজেকে নিজে বলে,”এই পৃথিবীতে জোর যার মুল্লুক তার।আমার জোর নেই মুল্লুকও নেই।কিন্তু প্রকৃতির বিচার ঠিকই হয়ে গেলো।না জানি যার জীবন আমার মতো নষ্ট করেছে তার আজ কি অবস্থা!”

বলেই জোরে নিঃশ্বাস নিলো শ্রেয়া।ঠিক তখনই একটি রিক্সা এসে বলে,”কই যাবেন আপা?”

শ্রেয়া জায়গার নাম বলতেই লোকটি রাজি হলো।ভাড়া ঠিক করে রিক্সায় উঠলো শ্রেয়া।কিছুটা শান্তি লাগছে তার মনে।কেউ তার হয়ে অন্যায়ের বিচার করছে।হয়তো এই শাস্তির কারণ ভিন্ন কিন্তু শাস্তি তো পাবে রনি।

অফিসে এসে নিজের কাগজপত্র জমা দিলো শ্রেয়া।তারপর এসে বসলো নিজের কেবিনে।ল্যাপটপে খুঁটিনাটি দেখতে থাকে।শ্রেয়ার কাজের মাঝেই ফারাজ এসেছে।সবাই ফারাজকে দেখে দাড়িয়ে বলে,”গুড মর্নিং স্যার।”
ফারাজ ওদের হাত দেখিয়ে বসতে বলে নিজের কেবিনের দিকে চলে যায়।শ্রেয়ার কেবিন ক্রস করতে যাবে ওমনি শ্রেয়া ফারাজের সামনে এসে বলে,”গুড মর্নিং স্যার।”

ফারাজ শ্রেয়াকে উত্তরে বলে,”গুড মর্নিং মিসেস শ্রেয়া।”
বলেই চলে যায় নিজের কেবিনে।কেবিনে ঢুকেই ল্যাপটপে কাজ করতে থাকে ফারাজ।শ্রেয়া এসে বসে তার চেয়ারে।কিছুক্ষণ কাজ করতেই শ্রেয়ার কেবিনে আসে লিজা।শ্রেয়া একটু ঘাবড়ে যায়।লিজা হালকা হেসে বলে,”আসতে পারি?”

শ্রেয়া কনফিউশনের সাথে বলে,”হ্যাঁ,আসো।”

লিজা দুই কাপ কফি নিয়ে এসেছে।এক কাপ শ্রেয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”নেও ভালো লাগবে তোমার।অনেকক্ষণ তো ফাইল চেক করলে।”

লিজার থেকে কফি নিয়ে শ্রেয়া বলে,”থ্যাংক ইউ।”

লিজা বলে ওঠে,”এক্সুয়ালি কালকে তোমার সাথে অনেক বাজে ব্যাবহার করা হয়েছে।এর জন্য আই এম সরি।ওটা অনেক এক্সপেন্সিভ ছিলো আর রিচ ফ্যামিলি থেকে ব্রাইডাল ড্রেসটি হায়ার করা হয়েছে।এই জন্য ঘাবড়ে যাই আমি। অনেস্টলি বলতে কোম্পানির লসের কথা মাথায় আসে তখন।”

লিজার ভালো ব্যাবহার দেখে শ্রেয়া নিজেও খুশি হয়।বলে,”ব্যাপার না।ওটা পরিস্থিতির চাপে হয়ে যায়।ভুল আমারই বেশি ছিলো।এবার থেকে বুঝে শুনে চলবো।”

লিজা তার হাত বাড়িয়ে বলে,”তাহলে আজ থেকে আমরা ফ্রেন্ড?”

শ্রেয়া হেসে দেয়।লিজার সাথে হাত মিলিয়ে বলে,”ওকে ফ্রেন্ড।”

নিজের কেবিন থেকে দেখলো ফারাজ।একটু চিন্তামুক্ত হলো সে।এনিকে বলেছিলো লিজার সাথে কথা বলে বুঝিয়ে দিতে। ফারাজকে সবাই ভয় পায়।তাই যতটুকু দরকার এনি সবার সাথে ফ্রেন্ডলি কথা বলে সলভড করে।এই যে লিজা আর ইভাকেও বুঝিয়ে বলল।ইভা এখন ব্যাস্ত তাই লিজা নিজের মতো সময় দেখে এসেছে।

চলবে…?

#আশার_হাত_বাড়ায় |৯|
#ইশরাত_জাহান

খাটে পা দুলিয়ে বসে আছে অর্পা।স্টোভে রান্না করছে শ্রেয়া।এই ছোট বাড়িতে অটো গ্যাসের ব্যাবস্থা নেই।এখন নতুন গ্যাস কিনে টাকা নষ্ট করতেও চায় না শ্রেয়া।তাই তো স্টোভে কোনমতে চালিয়ে যাচ্ছে।অর্পা বলেছিলো,”আয় আমিও তোকে একটু সাহায্য করি।”

কিন্তু শ্রেয়া তাকে বসে থাকতে বলেছে।অফিস থেকে এসে অর্পাকে কল করে ডেকেছে।কালকে রনিকে কোর্টে ওঠানো হবে।এত তাড়াতাড়ি কাজগুলো হওয়াতে একটু অবাক শ্রেয়া।শুনেছে পাওয়ারফুল কেউ এই কেস করেছে।সাথে আবার শ্রেয়ার ডিভোর্স এর ব্যাপারটা জড়িত হয়েছে।শ্রেয়াকে সেখানে থাকতে হবে।এক কথায় বলা যায়,এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে কাল।কথাগুলো শ্রেয়াকে জানিয়েছে মিসেস তানহা।এইগুলো অর্পাকে বলে দেয় শ্রেয়া।সব শুনে অর্পা বলে,”তুই কি যাবি কাল?”

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে শ্রেয়া বলে,”আমি দেখতে চাই ওর শাস্তি।এমন সুযোগ কয়জন পায়?অন্যায়ের বিচারটা যেভাবে তাড়াহুড়া করে পেয়ে গেলাম এটা তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি হয়ে গেলো।বলতে গেলে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।”

“আমার মনে হয় তোর না যাওয়াটা ভালো হবে।”

কিছুটা অবাকের সাথে তাকালো শ্রেয়া।অর্পা এমন কথা কেনো বলছে!শ্রেয়ার তাকানো দেখে অর্পা বলে ওঠে,”তুই তো ডিভোর্সটাই দিতে চেয়েছিলি।রনির নামে কোনো কেস করিস নি।আর এই ঝামেলায় তোকে জড়াতে মন চাচ্ছে না।আমার তো মনে হয় এমনিতেই তোর ডিভোর্স ভালোভাবে হয়ে যাবে।”

স্টোভ বন্ধ করে পাশে রাখলো শ্রেয়া।নাকে কেরোসিনের হালকা গন্ধ আসছে।অর্পা এটা আরামের সাথে শুকতে থাকে।শ্রেয়া দেখে হেসে দেয়।বলে,”ছোটবেলা থেকে তোর এসব ভালো লাগে।বড়লোক বাড়ির বউ হয়েও পরিবর্তন হয়নি।”

মুখ ভেংচি দিয়ে অর্পা বলে,”বিয়ের পর মেয়েদের নাম পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু মন ন।আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি এগুলো।কিভাবে ভুলি বল?”

“হুম,আচ্ছা শোন।আমি ইচ্ছা করেই রনিকে ফেস করতে চাই।দেখতে চাই ও কেমন করে আমার সামনে ওর এই পতনের দিন।যে অত্যাচার করেছে আমাকে তারপরও আমি ওকে ছার দিয়েছি।কিন্তু প্রকৃতি ওকে ছার দেয়নি।আমি নিজের চোখে দেখতে চাই ওর কর্মের ফল।সুযোগ একবার এসেছে।পায়ে ঠেলে ফেলে দিতে চাই না।”

অর্পা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে শ্রেয়ার কথা।কিছু একটা ভেবে বলে,”চল আমার সাথে।”

ভ্রু কুঁচকে শ্রেয়া বলে,”কোথায়?”

“পার্লারে।”

অর্পার মাথায় আলতো চাটি মেরে শ্রেয়া বলে,”রাত হয়ে গেছে দেখেছিস।তোর এখন নিজের বাসায় যেতে হবে।আর ওসব পার্লারে এখন যাবো কেনো?”

“আরে রাত অতটাও বেশি না।ঢাকা শহরে এটা কিছুই না।তুই তো ঘরকুনো।তুই এখন বাইরে বেড় হয়েছিস আস্তে আস্তে জানতে পারবি সব।আমাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। সেফলি যাওয়া আসা করতে পারবো।”

“কিন্তু পার্লারে কেনো যাবো?”

“কাল তুই রনির সামনে সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে যাবি।”

“পাগল হয়েছিস!ওটা আদালত কোনো বিয়ে বাড়ি না যে সেজে গুঁজে যাবো।”

শ্রেয়ার এক হাত ধরে অর্পা বলে,”নিজের সুখটা কাকে বেশি দেখাতে হয় জানিস?যে তোর সুখ দেখতে চায় না। কাল যখন রনি ও তার পরিবার তোকে সুখে থাকতে দেখবে তখন তাদের করা অন্যায়গুলো উপলব্ধি করতে পারবে।তোকে বলেছিলো না যে তোর রূপ চলাফেরা থেকে ওই মেয়েটা অনেক ভালো।মেয়েটাকে তো দেখলাম কেমন রং ঢং করে চলেছিলো রেস্টুরেন্টে।তুইও কাল তেমন যাবি।দেখাবি যে চাকচিক্য রূপ ধারণ করলেই ওমন সুন্দরী হওয়া যায়।ঘরে বসে হাড়ি পাতিল নিয়ে বসে থাকলে তার সৌন্দর্য্য এমনিতেই ঝলসে যায়।এই কয়দিনে তুই ওদের থেকে দূরে থেকে সুখে শান্তিতে আছিস এটা ওদের দেখাবি। তোর জীবন থেমে থাকেনি এটা দেখিয়ে দিবি তুই।”

বলেই শ্রেয়ার হাত ধরে টানতে থাকে অর্পা।বাধ্য হয়ে অর্পার টানাটানিতে পার্লারে গেলো শ্রেয়া।তবে অর্পার কথাগুলো শুনে তার ইচ্ছা করছে রনি ও ওই পরিবারকে এসব দেখিয়ে দিতে।

******
কড়াইতে শুকনো ঝাল ভাজতে থাকে রিমলি।মাত্রই একটা ডিম ভেজেছে।ডিম ভাজা আর আলু ভর্তা দিয়ে গরম ভাত খাবে।সৃষ্টি বেগম শ্রেয়ার কথা ভেবে চলেছেন।শ্রেয়ার সাথে কথা বলতে না পেরে তার চিন্তা বেড়ে গেছে।রিমলি এটা দেখে একটু কষ্ট পেলেও আবার খুশি হয়।যেভাবে ভীত ভীত হয়ে চলতো এতদিন এখন মেয়ের জন্য চিন্তা করুক।খাবারগুলো তৈরি করে রিমলি বসলো সৃষ্টি বেগমের কাছে।বলে,”খাবার রেডি মা।আসো খেতে হবে তো।”

সৃষ্টি বেগম ভাবুক দৃষ্টিতে বলে,”আমি খাবো না তুই খা।”

“এভাবে না খেয়ে থাকলে কি আপুকে পেয়ে যাবে?একটু কিছু খেয়ে তারপর না হয় আবার কল দিবো।”

“কাল ঢাকায় যাবো।”

বিষম খেলো রিমলি।একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে,”টিকিট কাটা লাগবে তো মা।”

“সে আমি কেটেছি।পাশের বাড়ির খালেদকে দিয়ে।”

মাথায় হাত পড়লো রিমলির।কালকে রনিকে আদালতে নেওয়া হবে আর কালকে সৃষ্টি বেগম ঢাকা যেতে চাচ্ছেন।না পেরে রিমলি প্রশ্ন করে,”তুমি আপুকে কোথায় খুঁজে পাবে?”

“রনির মায়ের কল এসেছিলো।সে বললো রনিকে নাকি পুলিশ নিয়ে গেছে।কাল কোর্টে নেওয়া হবে রনিকে।একটু সাহায্যের দরকার।আমি এখন এত টাকা কই পাবো?এমনি ধার দেনা পরিশোধ করেছি কষ্ট করে।একটু ভালোভাবে বলেছি কিন্তু তার কি ব্যাবহার!আমার বিশ্বাস শ্রেয়া ওখানে আসবে। তাই আমরা সকাল সকাল এখান থেকে বেড় হবো।ট্রেনে ছয় ঘণ্টা লাগবে যেতে।একবার সামনে পাই ধরে বেঁধে যশোরে নিয়ে আসবো।”

“যদি না আসে?”

“আসবে না মানে!যুবতী মেয়ে ওখানে কি করবে?আমার কাছে আসলে তাও কোনমতে থাকতে পারবে।”

এবার রিমলি বলে ওঠে,”এগুলো তখন মনে ছিলো না যখন আমি বারবার বলতাম আপুর সাথে অন্যায় হচ্ছে?”

সৃষ্টি বেগম এবার ঘুরে তাকালো রিমলির দিকে।বলে,”সংসার করতে গেলে টুকটাক ঝামেলা হয়।আমিও যে তোর বাপের হাতে মাইর খাই নাই এমন না।স্বামীরা বাইরে থেকে কাজ কাম করে এসে ক্লান্ত থাকে।ওদেরকে তো সেভাবে দেখাশোনা করতে হয়।তোর বোনের নামেও তো নালিশ আসতো।কোনোদিন রনির জামা পুড়িয়ে দেয় তো কোনোদিন খাবারে ঝাল লবণ বেশি।এভাবে করতে থাকলে তো ঝামেলা বাড়বে।”

“কি সেই পুরনো চিন্তাধারা নিয়ে আছো মা।দুনিয়া বদলে গেছে।মেয়েরা এখন এতটা সহ্য করে থাকে না।”

“এই জন্যই তো ঘরে ঘরে আজ তালাক বাড়ছে।আগে আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম কখন স্বামীর মন পাবো।কিভাবে চললে ভুল হবে না।স্বামী যতই কটু কথা বলুক না কেনো বউ হয়ে মুখ খোলা যাবে না।আর এখন তোরা কি করিস?কিছু হইলেই তর্ক জুড়ে দিস।”

রিমলি বুঝলো এখন তর্ক করা বেকার।মাথা গরম আছে সৃষ্টি বেগমের।কাল ঢাকায় যাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না সৃষ্টি বেগমকে।রিমলি উঠে এবার মরিচ ভর্তা করতে থাকে।আলু গুলো মেশাতে মেশাতে বলে,”সে কাল ঢাকায় যাবে যখন এখন আসো কিছু খেয়ে নেও।এভাবে না খেয়ে থাকলে কাল ঢাকার ট্রেনে না উঠে হসপিটালে যাওয়ার ব্যাবস্থা তুমি করে দিবে।”

সৃষ্টি বেগম চোখ গরম করে তাকালেন। রিমলি একটু বেশি চালাক।লোকের মুখে অনেকবার শুনতে হয় ছোট মেয়েরা চতুর হয় বেশি।রিমলি তেমন হয়েছে।শ্রেয়া এমন না।শ্রেয়াকে যা বলতো তাই করতো।এখন আবার শ্রেয়া তার ফোনটাই ধরছে না।মা হয়ে সৃষ্টি বেগমের চিন্তা বেড়ে গেছে।

*****
অসহায় হয়ে সোফায় বসে আছে রুবিনা।এমন কেউ নেই যে তাদের সাহায্য করতে পারবে।রুহি ও রুমা কান্না করে একাকার হয়েগেছে।এখন শুধু উপায় ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ফিরে যাওয়া।কাল রনির কেসের ফয়সালা দেওয়া হতে পারে।যে কেস করেছে তার পরিবারের লোকই আবার উকিল।একেকজনের একেক দাপট আছে।যেগুলো শুনে কেউ এগিয়ে আসতে চায় না।উকিল নিতে চেয়েছিলো কিন্তু টাকা নেই কাছে।রনির ব্যাংক একাউন্ট লক করা।আত্মীয়রা মিলে লাখ লাখ টাকা দিতে পারবে না।আজকাল উকিল হায়ার করা মুখের কথা না।কোনমতে রাতের খাবারটা খেয়েছে তিনজনে।

*****
পার্লারে বসে আয়নায় নিজের মুখ দেখে নিজেই অবাক শ্রেয়া।এই মাত্র তার ফ্রেশিয়াল করা শেষ হলো।মুখটা অনেক উজ্জ্বল হয়েছে।চোখের নিচের কালো দাগ এখন নেই।অর্পা এসে পাশে দাড়ালো।শ্রেয়াকে দেখে বলে,”কি নিজেকে চেনা যায়?”

লজ্জা পেলো শ্রেয়া।হেসে দেয় অর্পা।দুজনে মিলে বাইরে ঘুরছে এখন।বেশি কথা চলছে কালকে কিভাবে কি করবে এগুলো নিয়ে।কথার মাঝেই শ্রেয়ার ফোনে ম্যাসেজ আসে।চেক করে দেখে রিমলি লিখেছে,”কাল আমরা আসবো।তুমি নাকি কোর্টে যাবে।রনির মা কল দিয়ে আম্মুর কাছে সাহায্য চায়।যদিও আম্মু সাহায্য করার অবস্থায় নেই কিন্তু এটা শিওর হলো যে তুমি কোর্টে থাকবে কাল।তাই সুযোগ বুঝে কাল ঢাকায় যাওয়া আমাদের।ঘাবড়ে যাবে না একদম।আমি আছি তোমার পাশে।নিজেকে শক্তি রেখো আপু।”

ম্যাসেজটি পড়ে শ্রেয়া একটু দীর্ঘশ্বাস নিলো।অর্পা জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”

“কাল মা আসবে বোনকে নিয়ে।চিন্তা বেড়ে গেলো কি যে হবে।”

অর্পা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,”যা হবে ভালো হবে।আণ্টি নিজের চোখে দেখবে তার আদরের জামাইয়ের করা পাপ।”

রাস্তার দিকে চোখ রেখে শ্রেয়া বলে,”জানিস দোস্ত!মা আমাকে একদিন বলেছিলো,আমার যদি সুযোগ থাকতো তোকে নিয়ে বিদেশ ঘুরতাম উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতাম।বিয়ে দিতাম না।আমার মায়েরও ইচ্ছা আমাকে ভালো কোনো পজিশনে রাখা কিন্তু মা আমার পুরোনো রীতি নীতিতে আটকে আছে।কারণ আমাদের অবস্থাও যে এরকম।মা তো মাঝে মাঝে এটাও বলে যে রিমলি না থাকলে আমরা মা মেয়ে মোটা কাপড়ে মোটা ভাতে কোনো রকমে থাকতাম।কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রিমলির দিকটাও আমাদের দেখতে হবে।লোকে মুখে অনেক কথা বলে। কেউ বলবে তুমি সংসার ছাড়বা বোন দেখার কি আছে?কিন্তু লোকে দুটো সাহায্য করে বলবে না যে এবার তোমার একটা রাস্তা হয়েছে তুমি তোমার মা বোনদেরকে নিয়ে শান্তিতে থাকবে।এই যে এখন আমি সুযোগ পেয়েছি তাই আমি চেষ্টা করছি।আগে সুযোগ ছিলো না মুখ বুজে থাকতাম।এগুলো যে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে এটা লোকে বোঝে না।আমার বোনটাও তো কম না।এতক্ষণে হয়তো দশ কথা শুনিয়ে দিয়েছে মাকে।আমি যেমন হয়েছি মায়ের মতো ভীতু বোন হয়েছে বাবার মতো সাহসী।”

কথাগুলো বলতে বলতে শ্রেয়ার চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে।মায়ের জন্য কষ্ট হয় শ্রেয়ার।মা যে তাকে বাধ্য হয়ে সংসার করতে বলে এটা শ্রেয়া বোঝে।মা যদি এতই খারাপ হতো তাহলে সংসারে সুখী হওয়ার জন্য একেক সিজনে একেক জিনিস পাঠাতো না।বিয়ের সময় গহনা ফার্নিচার দিতো না।কোনো রকমে বিয়ে দিয়েই শেষ করতে পারতো।রনির মা ও রনির সুন্দর ব্যাবহার দেখে শ্রেয়ার বিয়ে দেয় সৃষ্টি বেগম।বিয়ের পর আসল রূপ বেড় হয় তাদের।গ্রামের ভিতরে বসবাস হওয়ার কারণে লোকলজ্জায় ভয় পায় সবাই।এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করবে না কিন্তু শেয়াল কুকুরের হামলা দিনে রাতে পড়বে।আজকাল মেয়েরা যেমন স্বাধীনতা খোঁজে তেমন মেয়েদের নিরাপত্তার অভাবটা অনেক।দিনদিন মেয়েদের নিয়ে বাজে খবর বেশি আসে।এগুলো দেখে তো আরো ঘাবড়ে যায় সৃষ্টি বেগম।শ্রেয়াকে কোলে পিঠে করে রাখতে পারলেও রিমলিকে সামলে রাখতে পারে না।ও খুব উড়ন্ত।

শ্রেয়ার চোখের পানি মুছে অর্পা বলে,”আমি জানি আণ্টি এতটা খারাপ না।আণ্টি সিচুয়েশন বুঝে এমনটা হয়েছে।আংকেল থাকলে আণ্টি এমনটা করত না।কিন্তু কি আর করার!দেখা যাবে কাল কি হয়।এখন তো একটু হাসিখুশি কাটা।”

বলেই দুজনে আবার আনন্দ করতে থাকে।শ্রেয়াকে বাসায় পৌছে দিয়েই অর্পা চলে আসে নিজের বাসায়।হল রুমে বসে আছে জিনিয়া।অর্পাকে দেখে রাগ দেখিয়ে উঠে যায়।অর্পার একটু কষ্ট হলেও অভ্যস্ত হয়েছে তার।বাচ্চা দিতে না পারার জন্য অর্পাকে ওর শাশুড়ি সহ্য করতে পারে না।মিমি এসে জড়িয়ে ধরে অর্পাকে।মিমিকে পেয়ে দুঃখ ভুলে যায় অর্পা।দুজনে মিলে খেলাধুলা করতে থাকে এখন।

চলবে…?