#আষাঢ়িয়া_প্রেম 💓
লেখনিতে #মিমি_মুসকান
#পর্ব_৮
ঘরের মধ্যে এতো মানুষজন দেখে ফারজানা রীতিমতো চমকে গেছে। এতো আত্মীয় স্বজন! সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে তাদের মধ্যে এতো মিল দেখে। এদিকে ফারজানার কাজিনগুলো সব পুচকে। তার বাচ্চা মামাতো বোন একটু সুযোগ পেলেই কান্না কাটি করে। আর খালাতো ভাই টা সবে মেঝেতে হাতড়াতে পারে। কেউই তার সবসময়ী নয়। সকলেই তার চেয়ে ছোট। এদের সাথে মনের কথা বলা যায় না। আর বাপের সাইডের কাজিন গুলো অতিরিক্ত মাত্রায় বড়। এরা সংসার নিয়েই সর্বকাল ব্যস্ত। তাই এবার ফাহাদ সাহেবের কাজিনদের দেখে ঈ*র্ষা হচ্ছে তার।
ফাহাদের বাড়িটা ভীষণ বড়। ভেতরে বসার ঘরে সকলে মিলে বসেছে কথাবার্তা বলতে। ফারজানা হবু শাশুড়ি আর ভাবীর সাথে দেখা করতে না করতেই কাজিনরা সব ধরে বেঁধে তাকে নিয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকের ঘরটাতে। এতোক্ষণ সকলে মিলে এখানেই আড্ডা দিচ্ছিল। ফারজানাকে সকলে ঘিরে রাখল চারদিক থেকে। একেক দিক থেকে একেকজনের প্রশ্ন। সুফিয়ান চট করে তার পা ধরে সালাম করে বলল,
“আসসালামুয়ালাইকুম ভাবী, আমি আপনার সবচেয়ে ছোট দেওর।”
আচমকা কাণ্ডে ফারজানা ভ*য় পেয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে বলল, ওয়ালাইকুমুস সালাম।
নাদিরা সুফিয়ানের মাথায় চাটি মেরে বলল, “তুই কি গাধা। এভাবে ভ*য় পাইয়ে দিলি ভাবীকে।”
হুমাইরা ফারজানার পাশে বসে বলল, “ব্যাপার কি বলো তো ভাবী, এখন থেকে দুজন সেম রঙের জামা পড়েছো? উহুম উহুম!”
ফারজানা লজ্জা পেয়ে বলল, “না না। ওরকম কিছু না।”
সুমাইয়া বলল, “সত্যিই কি না!”
ফারজানা ইতস্তত করছে। এরই মধ্যে ঘরে পা রাখল ফাহাদ। ঢুকেই সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “কি হচ্ছে কি? তোরা কি শুরু করলি?”
“ওই দেখো দেখো জোড়া শালিক এসে পড়েছে।”
মুখ টিপে হেসে উঠল সকলে। বিচ্ছু একেকটা। ফাহাদ মুখাবয়বে কঠোর*তার ছাপ। নাহলে এরা আর ফারজানাকে শান্তি দিবে না। এরই মধ্যে চা নিয়ে হাজির হলো একজন। ফাহাদ ফারজানার সোফার কাছে এগিয়ে এলো। ফারজানা মাথায় ঘোমটা টেনে মাথা উপুড় করতেই ফাহাদের নজর কাড়ল। টানা টানা দুটো চোখে গাঢ় কাজল টানা যে। এই চোখাচোখির রেশ বেশিক্ষণ রইল না। ছোকড়া গুলো সকলে মিলে ওহোহহহহ করে চেঁচিয়ে উঠল। ফারজানা দ্রুত মাথা নামিয়ে দেখল। একঝাঁক হাসির শব্দ।
ফাহাদ চায়ের কাপ হাতে তুলে বলল, “নাও চা নাও।”
ফারজানা যেই কি হাত বাড়িয়ে ধরতে যাবে ওমনি সবাই আবার চেঁচিয়ে উঠলো। ফারজানা ভ*য় পেয়ে চা টাই ফেলে দিতে যাচ্ছিল। ফাহাদ ধরে ফেলল তৎক্ষণাৎ। গরম চা বোধহয় একটু পড়ল তার হাতে। সকলের উদ্দেশ্যে ফাহাদ চেঁচিয়ে উঠে বলল, “আহ চুপ করবি তোরা? এখনি গ*রম চা পড়ে যেত। আমার বউকে একটু শান্তিতে চা খেতে দিবি না?”
সকলে মুখ টিপে হেসে উঠল। ফাহাদ ফের সেধে বলল, নাও।”
ফারজানা চোখ মুখ শক্ত করে চায়ের কাপ হাতে নিল। শুধু শুধু ওদেরকে বকছে। আসল জন তো এখানে। তিনিই তো ওস্তাদ মনে হচ্ছে।
চায়ের কাপ অর্ধেক শেষ হয়েছে কি না এরই মধ্যে ভাবী ডাক পাড়লেন। ফারজানা চলে গেল ভাবীর সাথে সাথে। তার পেছন পেছন ফাহাদ উঁকি দিতেই পেছন থেকে ভাইগুলো একে ঝাপ্টে ধরল নেই। শান্তি নেই একটু।
আড়াল থেকে অনেকক্ষণ ধরেই দেখছে ফাহাদ। ঘরের উত্তর দিকে করিডোরে আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ফাহাদ। ফারজানা ওই দক্ষিণ দিকের দরজার কাছে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ভাবীর সাথে। আরো দুজন আছে সাথে। আড়াল থেকে তাদের মুখ তো আর দেখা যায় না। ফাহাদ দাঁড়িয়ে আছে দুই হাত আড়াল করে। ফারজানার নজর পড়েছে তার দিকে। তখন থেকেই ইশারা দিচ্ছে। কিন্তু ম্যাডাম আসলে তো। আসবেই বা কি করে? ভাবী এখান থেকে তাকে ছাড়তেই চাইছে না।
ফাহাদ বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এবার অস্থির হয়ে উঠল। ভাগ্যিস তার সবচেয়ে ছোট কাজিন সুভার দেখা পেয়ে গেল। ফাহাদ তাকে কাছে ডেকে বলল, “যা তো একবার,তোর ভাবী কে ডেকে নিয়ে আয়।”
“কি বলে আনব?”
“যা পারিস। আমার কথা একদম বলবি না।”
“আনলে তুমি আমায় একটা আইসক্রিম দিবে তো।”
“একটা না দুটো দিব। তুই দৌড়ে যা।”
সুভা হচ্ছে টুকুর টুকুর কথা বলার মানুষ। ছোট হলে কি হবে? কথা শিখেছে ভালো। ঠিক কি করে যেন ফারজানাকে ডেকে নিয়ে এলো। শুধুই নিয়ে আসেনি। তাকে রেখেই ছুটে পালিয়েছে। এদিকে ফারজানা বুঝল না সে কোথায় আছে? এখানে কেন? ফাহাদ সাহেব কে দেখেছিলো তখন এখন তো আর দেখছে না। কিন্তু কিন্তু করে এদিক ওদিক তাকাতেই কারো হিচকে টানে রুমের মধ্যে চলে এলো সে। হতভম্ব হয়ে তাকাল সামনে। স্বয়ং ফাহাদ সাহেব দাঁড়িয়ে তার সামনে। ইশ দেখো? হাসছে কেমন? দুই হাত আড়ালে নিয়ে হাসছে মিটি মিটি!
“খুঁজছিলেন আমায়?”
“কই না তো? ওমন টেনে নিয়ে এলেন কেন? কেউ দেখে ফেললে?”
“এখানে কেউ নেই। সবাই বসার ঘরে। হবু বউকে দেখবে বলে অপেক্ষা করছে।”
“ইশ, তাহলে তো আমার সেখানে যাওয়া উচিত। এখানে কি করছি?”
ঘর থেকে বেরুনোর প্রস্তুতি। থেমে গেল গম্ভীর মসৃণ এক পুরুষালি কণ্ঠস্বরে,
“শুনুন?”
“আবার কি?”
পেছন ফিরে কথাটুকু বলতে গিয়ে যেই দেখল ফাহাদ সামনে এগিয়ে আসছে ওমনি দেওয়ালের সাথে মিশে দাঁড়াল। ভ*য় পেয়ে ছোট হয়ে গেল মুখটা। ফাহাদ মুচকি হেসে পেছনের হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে বলল, “এগুলো পরে যান।”
ফারজানা চমকালো, অভিভূত হলো। বিস্মিত হয়ে শুধাল, “এগুলো?”
“আমার বাগানের ফুল। আজ সকলেই তুলেছে। আজ তো হবে না, আরেকদিন আপনাকে আমার বাগান ঘুরিয়ে দেখাব কিংবা এবার থেকে রোজই।”
ফারজানা হেসে ফুলের মালা দুটো নিয়ে হাতা পরে নিল বালা’র মতো। ইশ কি সুন্দর আটকে আছে হাত দুটোয়।
“এতো আশা করা কি ভালো? ভবিষ্যতে কি হবে আপনি আমি কখনোই আগে থেকে বলতে পারি না!”
“আমার বিশ্বাস আছে যে।”
“কার প্রতি?”
ফাহাদ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আপনার প্রতি!”
ফারজানা এক ঝলক হাতের দিকে তাকাল। সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ডাক পড়ল ভাবীর। অপেক্ষা না করে ছুটে পালাল। কে জানে দেখে ফেললে কি ভাবত!
উপস্থিত সকলের সামনে ফারজানাকে বসানো হয়েছে। তার পাশেই ফাহাদ। দাদি দুজনকে একসাথে দেখে নজর তুলছেন। মাশা আল্লাহ মাশা আল্লাহ কি সুন্দর লাগছে দুজনকে। ফারজানা লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে বার বার। দেখছে হাতে পড়ানো ফুলের মালার দিকে। পিছনেই দাঁড়ানো ছিল সুমাইয়া আর হুমাইরা। সুমাইয়া বলে উঠলো,
“বাহ ভাবী, তোমার হাতের ফুলগুলো তো কি সুন্দর?”
বড়রা কানে না নিলেও বাকিরা এদিকে চট করে তাকাল। সুমাইয়া ফের বলল, “আগে তো দেখেনি।”
হুমাইরা ফিসফিসিয়ে বলল, “দেখবি কি করে? একজন তো সকাল বেলা ঘুম থেকে গাছের ফুল ছিঁড়ে সুঁইসুতা নিয়ে বসে এগুলো বানিয়েছে। জানিস না, সুঁইতে সুতা ঢোকানোর জন্য ভাবীর পিছন কতোক্ষণ ছুটেছে।”
“সত্যি নাকি? কই আমি তো দেখলাম না?”
“১০ টা পর্যন্ত ঘুমালে কেউই দেখবে না। এসব ভোরবেলার কাণ্ড।”
কথাগুলো কেবল ফারজানার কানে গেলো তাই না,ফাহাদ ও শুনল। শুনতে পেয়ে এদিক তাকাল ভ্রু কুঁচকে।হুমাইরা মুখে হাত দিল। এদিক তাকাল ফারজানার দিকে। নোয়ানো মাথায় মৃদু হাসির রেখা দেখতে পেলো সে। ফারজানা ফুলগুলোকে সযত্নে আগলে নিল। এগুলো এই মূহুর্তে তার কাছে অমূল্য হয়ে উঠেছে।
ফারজানা আর ফাহাদের বিয়ে নিয়ে কারো আপত্তি ছিলো না। ফাহাদের বাবার বড় ব্যবসা আছে। বড় ছেলে দেখছে এসব আপাতত। কিন্তু তবুও ফাহাদ নিজের আলাদা ব্যবসা খুলেছে। ছোটখাটো ব্যবসা,সবেই শুরু করেছে। নিজের কিছু একটা করবে বলে। মোজাম্মেল সাহেবের এই ব্যাপারটা ভালো লাগল। এছাড়াও ছেলে অন্যান্য গুণে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুরশিদা বেগম তো শুরু থেকেই হ্যাঁ বলে আছেন। তারা বিয়ের তারিখ ঠিক করল। আসছে জানুয়ারিতে। মানে আরো ৪ মাস বাদে। এতো অপেক্ষা যেন ফাহাদের কাছে ভালো লাগল না। সময়টা অনেক বেশি লম্বা। ফাহাদের কাঁচুমাচু মুখটা দেখেই ফারজানা মুখের কথা পড়ে নিল। একটু ফিসফিস হাসির শব্দ ও যেন পেলো ফাহাদ। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দেখল সবাই তাদের ঘিরে ধরেছে। বাগদান হবে এখন। এসব ব্যবস্থা তো আগে বলা ছিলো না কিন্তু ও বাড়ি থেকে তারা তৈরি হয়েই এসেছিলো। ছেলেকে আংটি পড়াবে বলে। এদিকে ফাহাদেরাও যে তৈরি ফারজানা তা আদলে তা বুঝতে পারেনি।
স্বর্ণের সরু ডিজাইনের আংটিটা তার অনামিকা আঙ্গুলে চকচক করছে। সবটাই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। ফাহাদ সাহেবের বিশ্বাসের উপর এখন তার হিং*সে হচ্ছে। কিভাবে লোকটা যা চাইছে তাই যেন পেয়ে নিচ্ছে। কিভাবে হয় এমন?
বিয়ের কথাবার্তা পাকা হবার পরপরই খেতে বসলে সকলে। প্রথমেই মুরব্বি আর পুরুষ সকলে খেয়ে নিল। তাদের মধ্যে কাজিনরাও ছিল। থেকে গেল কেবল ফারজানা আর বাড়ির বউরা। তার মা আর শাশুড়ি। পুরুষরা খাওয়া দাওয়া করে নিচে বেরিয়েছে চা পান খেতে এই ফাঁকে তারা বসেছেন খেতে। দাদি সবার আগে খাওয়া দাওয়া সেরে এখন ঘুমোতেও চলে গেছেন। ফারজানা বসেছে বড় সোফার একদম শেষ মাথায়। তার পাশে বসেছে খালাতো ছোট বোনটা। বাকিরা বসেছে ওই বড় ডাইনিং টেবিলে। পুরো ডাইনিং টেবিল আসলে ভরে গেছে। তাই একা সে এখানেই বসেছে।
ফারজানার একটু অবাক লাগছিলো। সে একা কেন বসে। তার পাশে ভাবী চাইলেও তো বসতে পারত। একা বসতে ভালো লাগছে না। তখনি চট করে সুমাইয়া, হুমাইরা, নুপুর, ঝুমুর, সুভা সকলে এসে বসল তার আশেপাশে। ফারজানা জিজ্ঞেস করতেই তারা বলল, না ভাবী তোমার সাথে খাবো। তাই অপেক্ষা করছিলাম।”
হুমাইয়া ফিসফিসিয়ে বলল, “আরো একজন কিন্তু আছে?” ফারজানা বুঝতে পারল না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই এই রহস্য উন্মোচন করল সে। ফাহাদ কোত্থেকে এসে হাজির হতেই ভাবী বলে উঠলো, “ফাহাদ তুই ও বসে পড়। তোরও তো এখনো খাওয়া হয়নি।”
মুরশিদা বেগম অবাক হয়ে বললেন, “মানে? ও এখনো খায়নি?”
ব্যাপারটা বোধহয় কেবল ফারজানা আর তৃণলতা বেগমই ধরতে পেরেছেন। ছেলের আক্কেল দেখে কি বেক্কল বনে যাচ্ছেন। কি রকম ছেলেরে বাবা। মানুষজন বুঝতে পারলে কিসব বলবে? তবুও ছেলেকে বাঁচানোর জন্যই বললেন, “না, ও তো ওখানে সব দেখাশোনা করছিলো। খাবার বেড়ে দিচ্ছিল তাই বোধহয় খেতে পারেনি।”
তৃণলতা বেগম কথাটা বলে চোখ রাঙি*য়ে তাকালেন। বোনগুলো সব একসাথে হেসে উঠল। তারা আবার রসিকতা করে ফারজানার পাশের জায়গাটা ছেড়ে দিল। বলল, এই সর সর ভাইয়া বসবে ভাবীর পাশে!”
ফারজানা লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারল না। এই লোকটার সবকিছুতে বেশি বেশি। অথচ খেতে গিয়ে রঙ্গ কম হলো না। একের পর একজন এসে হাজির। নাজিম এসে বলল, “ভাবী রোস্টটা আমি নিই।”
ফারজানা কিছু বলার আগেই রোস্ট গায়েব। শুভ এসে ডিম নিয়ে চলে গেলো। আরেকজন এসে মাছ ভাজা নিয়ে চলে গেল। আরেকজন কিছু বলার আগেই ফাহাদ ধম*কে তাকে প্লেট দিয়ে বলল, “বের হ এদিক থেকে!”
নাদিম ধমক খেয়ে প্লেট হাতে নিয়েই ছুটে পালাল। হুমাইরা আর সুমাইয়া হেসে উঠে বলল, “তোমার দেবরদের জ্বা*লায় তুমি পাগল হয়ে যাবে ভাবী।”
ফারজানা মিটিমিটি হাসল। ফাহাদ আবারো তার প্লেট নিয়ে খাবার দিচ্ছে। ফারজানা মুখ ফুটে বলল, আর না।”
“এই মুরগির আধার খাবেন আপনি?”
“ওতোটুকুই ঠিক আছে।”
“না, আমার প্লেটের অর্ধেক ও এর চেয়ে বেশি।”
ফারজানা মুখ লাল করে প্লেট হাতে নিয়ে বলল,“বেশি বেশি করছেন। কে বলেছে ইচ্ছে করে এসব করতে? সবাই দেখছে আমাদের।”
“কি করলাম আবার?”
“এই যে আমার সাথে খেতে বসেছেন!”
“দোষের কিছু কি? কয়দিন পর তো..
ফারজানা একপিস শসা মুখে দিয়ে বলল, “কয়দিন সবুর তো করতে পারতেন।”
কথাটা শুনে ফাহাদ এমন করে তাকাল যেন সে ক*ষ্ট পেয়েছে। ফারজানার ও মনে হলো সে বেশি বেশি বলে ফেলেছে। হয়তো আরেকটু কম বললেও হতো।
বিকেলের ঘটনা। ছাদে সকলে একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার আসর জমেছে ফারজানার কারণে। সেই তো আসল মানুষ। এরই মধ্যে সুফিয়ান গিটার হাতে সুর তুলেছে। সুমাইয়া আর হুমাইরা সেই তালে নাচছে। ওরা কাজিনরা মিলেই আসর জমিয়ে তুলেছে। ফারজানা এক কোণায় দাঁড়িয়ে। নিচ থেকে তার উড়না টান খেলো। দেখল সুভা দাঁড়িয়ে। সে হাত উঁচু করে ছাদের দরজার দিকে তাক করল। আড়াল থেকে ফাহাদ সাহেবের পাঞ্জাবি দেখেই সে নিশ্চিত হয়ে গেল।
“ডাকছিলেন আমায়?”
“ভুলেই তো গেছেন আমায়।”
ফারজানা মুখটা নামিয়ে বলল, “ওরা সবাই এখানে ছিল আমি ভাবলাম আপনিও এখানে থাকবেন।”
ফাহাদ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। তাকে অনুসরণ করছে ফারজানাও। ফাহাদ হাঁটতে হাঁটতে বলল, “একটু পরেই তো চলে যাবেন।”
“হুম একটু বাদেই যাব।”
“কেমন লাগল আমাদের বাড়ি?”
“ভালো।”
“বাড়ির মানুষগুলোকে?”
“সকলে খুব মিষ্টি!”
“আর আমাকে?”
পেছনে মুখ ফিরিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল ফাহাদ। ফারজানা চোখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বলল, “মোটামুটি!”
“মোটামুটি?”
“জি।”
ফাহাদ ঠোঁট চেপে মাথা দুলিয়ে বলল, আচ্ছা!”
ফারজান মুখ টিপে হেসে তাকে অনুসরণ করল। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ি বেরিয়ে তারা একটি কক্ষের সামনে এসে দাঁড়াল। ফাহাদ হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার ঘর, মানে আমাদের!”
ফারজানা ঘরের মধ্যে পা রাখল। ঢুকতেই বেলি ফুলের ঘ্রাণ তাকে মুগ্ধ করল। বেলকনির দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে বাতাস ঢুকছে ঘরের মধ্যে। ঘরটিকে একনজরে দেখল সে। ফাহাদ শুধাল, “পছন্দ হয়েছে? বলে দিন কিছু বদলানোর হলে?”
“কেন? বদলাতে কেন হবে? নিজের পছন্দের প্রতি আস্থা নেই আপনার?”
ফাহাদ উপর থেকে নিচ অবধি ফারজানাকে দেখে মৃদু হেসে জবাব দিল, “আলবাদ আছে!”
অতঃপর হাত বাড়িয়ে একটা নেকলেস ধরল ফারজানার সামনে। বলল, “আংটি কেনার সময় পছন্দ হয়ে গেল। আপনার জন্য!”
ফারজান উল্টো হয়ে দাঁড়াল। সামনের আয়নার প্রতিবিম্বে দেখা যাচ্ছে দুজনকে। পিছনের চুলগুলো সামনে সরিয়ে বলল, “ খুব বেশি ভালোবেসে ফেলছেন না আমায় ফাহাদ সাহেব?”
ফাহাদ এগিয়ে এসে নেকলেসটা তার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল, “অ*ন্যায় করছি কি?”
“ভালোবাসা ন্যায় অন্যা*য়ের কি বুঝে?”
“তাহলে জিজ্ঞেস করছেন যে? ভালোবাসা জিনিসটা আমার কাছে খুব দামী। জীবনে আজ অবধি ভালোবেসে যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। আগলে রেখেছি সারাজীবন সেরকম আপনিও থাকবেন মহারানী!”
বলেই হাত বাড়াল। ফারজানা তার হাতের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। ফাহাদ শুধালো, “ধরবেন না?”
“সময় হোক।”
“এই অপেক্ষা যে বড় নিদা*রুণ আর যন্ত্রনা*দায়ক! এতোক্ষণ অপেক্ষা করাবেন।”
“যখন অধিকার পাবেন তখন ধরবেন।”
“এখনো অধিকারের কথা বলছেন?”
“হুম। অধিকার থাকলে অনুমতি নিতে হয় না ফাহাদ সাহেব।”
বলেই সে দরজার দিকে আগাল। ফাহাদ দুই হাত পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “তাহলে কথা দিচ্ছি আজ রাতেই অধিকারবোধ থেকে আপনার হাত দুটো আমি নিজের করে নিব। সাথে আপনাকেও!”
“পাগলামি কথাবার্তা!”
“আপনার এই পাগল প্রেমিককে তুচ্ছ ভাববেন না দয়া করে।”
জবাবে ফারজানা তার মিষ্টি হাসি দেখিয়ে দরজা থেকে বিদায় নিল। ফাহাদ সাহেব সত্যিই একটা পাগল। যা মুখে আসে তাই বলে!
কিন্তু ফারজানার কোনো ধারণা ছিলো না ফাহাদ সাহেবের পাগলামি সম্বন্ধে। সন্ধ্যে বেলা তাদের ফিরার কথা ছিলো। সে তখন ভাবীর ঘরে বসা। হঠাৎ ভাবী ছুটে ঘরে ঢুকলেন। উনার হাতে হালকা গোলাপি রঙের একখান শাড়ি। ফারজানার হাতে শাড়িটা দিয়ে বলল, “কেমন ফারজানা?”
“খুব সুন্দর ভাবী!”
“মা এনেছেন তোমার জন্য। দেখো? আমিও একটা নিয়েছি আমারটা আকাশী রঙের। সেদিন শপিং করতে গেলাম তখন আমি পছন্দ করলাম মা তোমার জন্য ও একটা নিলেন।”
ফারজানা হাত বুলিয়ে শাড়ি দেখে বলল, “বাহ চমৎকার। সত্যিই দারুণ ভাবী।”
“তাহলে পরে ফেলো।”
“এখনি?”
“হুম একটু পরেই তোমার কাবিন হবে। ওরা আসছে। এখনি এটা পরে তৈরি হয়ে যাও।”
“মানে ভাবী?”
“মানে বিরাট কিছু? আমার দেবর পা*গল হয়ে গেছে বুঝলে তো। কি জাদু করলে ভাই? আজ তোমাকে নিজের না করে সে ছাড়ছে না।”
রহস্য টেনে হাসি দিয়ে ভাবী উঠে দাঁড়াল। ফারজানা তখনো কিছু বুঝতে পারল না। এরই মধ্যে ঘরের ভেতর মা, মামী আর দুই খালা এসে হাজির হলেন। তারা কিসব বললেন তার কিছুই ফারজানা বুঝল না। কেবল বুঝল আজ তাদের বিয়েটা হবেই। কেউ আলাদা করতে পারবে না তাদের। এই বিয়ে যেন হবারই ছিল। ভাগ্যের লিখন।
ফাহাদের কাজিনরা মিলে তাকে সাজিয়ে দিল। সময় বেশি ছিলো না। খুব কম সময়ের মধ্যেই বিয়ের কাজ শেষ হলো। ফারজানার সাজ সামান্য। গয়না গাটি বলতে কেবল কানে স্বর্ণের একজোড়া ঝুমকো। দাদি দিয়েছেন উপহার স্বরূপ। হাতে সেই ফুলের বালা। গলায় উনার দেওয়া সেই লকেট। শাশুড়ি মায়ের মন না ভরায় তার বিয়ের স্বর্ণের টিকলি এনে পরিয়ে দিলেন মাথায়। ব্যস এতেই। এতেই তার বিয়ে হয়ে গেল ফাহাদের সাথে। দুজন পাশাপাশি বসে যখন কবুল বলছিলো তখন যেন ফারজানার পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে গেছিল। তোতলাতে লাগল সে। শরীর ঝিম মেরে গেল। কাবিন নামায় সই করতে গিয়ে দেখল হাত কাঁপছে। লিখতে পারছে না। কান্না পাচ্ছে। কেন? কিভাবে হলো এসব? এই লোকটা কি ম্যাজিশিয়ান? জাদু জানে?
কেউ হাতটা ধরল শক্ত করে। অধিকারবোধ থেকে। এই প্রথম, স্বেচ্ছায়, কোনো ছলচাতুরি ছাড়া তারা স্পর্শ করল একে অপরকে। ফারজানা মুখ ফিরিয়ে পাশে চাইল। লোকটিকে দেখল। সে আশ্বস্ত করল। শান্ত মলিন মুখে কি যে দেখল ফারজানা। কিৎকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল। এই লোকটা কে? কতোদিন আগে পরিচয় হলো তাদের? কতো দিনের সম্পর্ক আর চেনা জানা? এখনি সারাজীবনের জন্য লিখিয়ে নিচ্ছে নিজের করে? এসব কি? নিয়তি! সত্যিই কি তাই! তাদের নিয়তি কি তবে এটাই!
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তারা দু’জন। কেবল তারা দু’জন। এই পৃথিবীর সবকিছু উৎসর্গ যেন পেয়েছে একে অপরকে। ফাহাদ এবারও হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ফারজানা হাত বাড়িয়ে দিল। তার বুক কাঁপছে দুরুদুরু। দুটো হাত আগলে ধরে ফাহাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সদ্য হওয়া অর্ধাঙ্গিনীর মুখপানে চেয়ে দেখল। লালচে চোখ ফোলা মুখটা। হাপাচ্ছে এখনো। ফাহাদ নরম সুরে বলল, “কাঁদছেন কেন? আপনি তো তাদের সাথেই ফিরে যাবেন।”
ফারজানা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “আপনি খুব খারাপ। এমন পাগলামী করে কেউ।”
ফাহাদ হাসল। তার হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বলল, “আজ থেকে আমার সবকিছু আপনার জন্য। মেরি জান, মেরি জান। আপনি আমার জান!”
অতঃপর তার হাতটা ধরল বুকের বা পাশে। ফুলগুলো শুকিয়ে ঝরে পড়ল এতোক্ষণে। ফারজানা কেঁদে উঠল আবারো। ফাহাদ বলল, “শুনতে পাচ্ছেন কিছু? উপলব্ধি করছেন কি? কতোটা ভালোবাসি আপনাকে!”
বুকে টেনে নিল এবার। ফারজানা তার বুকের মধ্যে মিশে রইল। অস্পষ্ট স্বরে বলল, “আপনিই আবার সব। আজ থেকে সবকিছু লিখে দিলাম আপনার দলিলে!”
কথাগুলো জড়ানো ছিল। কিন্তু ফাহাদ শুনল। স্পষ্টই শুনল। হাসল মিটিমিটি। চেয়ে দেখল আকাশের একটি মাত্র চাঁদকে। তখনি আকাশে উড়ল আ*তশবাজি। বিচ্ছু গুলো বিয়ের খুশিতে এখন আতশ*বাজি জ্বালা*চ্ছে!
~ সমাপ্ত