#আষাঢ়ের_দোলনচাঁপা
#পর্বঃ১৮+১৯
#Jhorna_Islam
পর্ব_১৮
আর দুই দিন পরে আষাঢ়ের ফ্লাইট। সবকিছু গোছগাছ করা শেষ আরো আগেই। আজকে আষাঢ় ঠিক করেছে সারাটাদিন দোলনের সঙ্গে কাটাবে দোলনকে সময় দিবে।কালকে একটু দরকারি কাজ আছে তাই কাল দেখা করার সুযোগ খুব কম। তাই আজকে দোলনের সাথে সময় কাটাবে।আষাঢ় ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শিস বাজাতে বাজাতে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। এরমধ্যে দরজায় নক করে কেউ। আষাঢ় না তাকিয়েই ঢুকার পার্মিশন দেয়।
“কামিং।”
আষাঢ় আয়নার দিকে তাকিয়ে ব্রু কোচকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,,, “হোয়াট?”
কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও বলে,,,,কিছু বলার থাকলে বল। নয়তো নিজের রুমে গিয়ে ওড়না আঙ্গুলে পেঁচা, এখান থেকে বিদায় হো। তোর মতো আজাইরা টাইম নাই আমার কাছে। অনেক কাজ আছে আমার।
মেঘ এবার ওড়না থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়। আমতা আমতা করে বলে,,ইয়ে মানে আষাঢ়,,,,
“সাথে ভাই বল। ইদানীং দেখছি ভুলে বসেছিস আমি সম্পর্কে তোর কি হই আর তোর চেয়ে বড়।”
আষাঢ়ের কথায় মেঘের মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। মেঘ মোটেও এখন চায় না আষাঢ় কে ভাই বলতে। তবুও উপায় নেই মেঘের উদ্দেশ্য সফল করতে হলে ভাই বলতেই হবে।
“আষাঢ় ভা-ভাইয়া তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?”
আষাঢ় কোনো উত্তর দেয় না।
মেঘ আবার বলে,, “কোথায় যাচ্ছো তুমি আষাঢ় ভাইয়া?”
“মঙ্গল গ্রহে যাবি?”
“তুমি আমার সাথে এরকম করে কেনো কথা বলো?
” সেটা তোর মন কে ভালো করে জিজ্ঞেস কর।”
মেঘ আষাঢ়ের কথায় থতমত খেয়ে যায়। তাহলে কি আষাঢ় সব জেনে গেছে? জানারতো কথা না। ”
“কিছু বলার থাকলে তারাতাড়ি বলে বিদায় হো। আমার কাজ আছে আমি বের হবো।”
মেঘ নিজের ভাবনা থেকে বের হয়ে এসে বলে,,,
আসলে বলছিলাম কি, তুমি তো চলেই যাবে। তাই বলছিলাম কি আজকে আমায় একটু বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবে প্লিজ?
আষাঢ় ব্রু কোচকে মেঘের দিকেই তাকিয়ে আছে ।
মেঘ আবারও অনুনয় করে বলে,,, প্লিজজজজ আষাঢ় ভাইয়া। আমিতো এই শহরের কিছুই তেমন চিনিনা।আর আমার তেমন বন্ধু বান্ধব ও হয়নি যে তাদের সাথে ঘুরবো। যাদের সাথে একটু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তারা বাইরে তেমন বেরও হয় না যে তাদের সাথে যাবো। বাড়িতে বসে থাকতে কতক্ষন ভালো লাগে বলো? নিয়ে চলো না তোমার সাথে আমাকে।
“আজ সম্ভব না। আগে বললে হয়তো বা তোকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবে দেখতাম। কিন্তু আজ তোর ভাবিকে নিয়ে বের হচ্ছি। সো আজ তোকে নিতে পারবো না। ”
ভাবি কথাটা শুনে মেঘের ভিতরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। মেঘ আগেই বুঝতে পেরেছে আষাঢ় দোলনের নিয়ে বের হবে। এজন্য ইচ্ছে করেই চাইছে আষাঢ়ের সাথে যেতে।
“ওয়াও ভাবির সাথে মিট করতে যাচ্ছো? তাহলে তো আমাকে নিতেই হবে। আমি ভাবির সাথে দেখা করবো। প্লিজ আষাঢ় ভাইয়া প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো।”
আষাঢ় চুপচাপ কিছু একটা ভাবছে। মেঘ আষাঢ়ের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে ধারণা করছে আষাঢ় তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু মেঘ কে অবাক করে দিয়ে আষাঢ় বলে,,,”পসিবল না।আমার আর চাঁপাফুলের মাঝখানে তোর কাবাব মে হাড্ডি হয়ে কোনো লাভ নেই। এর থেকে ভালো আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি উনি তোকে ঘুরিয়ে আনবে তুই যেখানে যেতে চাস। শুধু শুধু আমাদের সাথে গিয়ে বোরিং হবি। এরপর আষাঢ় নিজের বাইকের চাবিটা হাতে নিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
মেঘ আষাঢ়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে। আষাঢ় চোখের আড়াল হওয়ার সাথে সাথে মেঘ আষাঢ়ের রুমের ফুলদানিটা হাতে নেয় ছুঁড়ে মারার জন্য।
“কুল মেঘ কুল! এরকম রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। তোর এই রাগে তোর ও লাভ নেই কারোরই কোনো লাভ নেই। রাগ না দেখিয়ে কাজে করে দেখা। তোর কাছে আরো সময় আছে। কাজে লাগা মেঘ নিজের মনের আগুন অন্যের মনে ছড়িয়ে দে।” কথাগুলো মেঘ নিজে নিজেকে বলে।
********
আষাঢ় দোলনদের বাড়ির সামনের রাস্তায় বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দোলনের জন্য অপেক্ষা করছে। আষাঢ় মনে মনে সেই দিনটার কথা ভাবছে যেইদিন দোলন এখানে পরে গিয়েছিল। আষাঢ় পানি দেওয়ার পরে মুখ ধুয়েছিল। কাঁদা মাটি দিয়ে একাকার অবস্থা ছিলো মেয়েটার। এখানেই আষাঢ় তার মন হারিয়েছিলো। আষাঢ় সেইদিনের কথা ভাবতে ভাবতে মুচকি হাসতে থাকে।
আষাঢ়ের ভাবনার ব্যাঘাত ঘটে আষাঢ়ের সামনে কারো তুড়ি মারার শব্দে।
আষাঢ় সামনের জনকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায়। ভুল দেখছে ভেবে নিজের চোখ বন্ধ করে আবারও তাকায়। নাহ্ ভুল দেখছে না যা দেখছে সব সত্যি। তার সামনে শাড়ি পরিহিত মেয়েটা আসলেই তার চাঁপাফুল।
“ঝটকা খেলে মি.আষাঢ় এহমাদ? ” ব্রু উঁচিয়ে বলে দোলন।
“ইয়েস! তাও আবার যেই সেই ঝটকা না। আটশো আশি ভোল্টের ঝটকা খেয়েছি চাঁপাফুল। আমাকে বুঝি প্লেন করে এইভাবে খু/ন করতে এসেছো?
যদি হয় তাহলে বলবো তুমি একশো পার্সেন্ট সফল হয়েছো।আমি আসলেই খু/ন হয়ে গেছি।
আষাঢ়ের কথায় দোলন খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।
আষাঢ় মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখে।
ইশশশ আজ আমি হার্ট অ্যাটাক করে এখানেই নিজের জীবন বিসর্জন দিবো। এমন করে কেন আমার হৃদয়কে বারবার আঘাত করছো? এমনিতেই তোমার শাড়ি পরা রূপ দেখে পুরো দুনিয়া ভুলে গেছি। তারমধ্য তুমি আবার এই হাসি দিয়ে পাগল করছো। তুমি কি চাইছো বলোতো মেয়ে?
“যা চেয়েছিলাম তা পেয়ে গেছি।আপাতত আর কিছু চাইছি না জনাব। ”
“তুমি এটা খুব অন্যায় করেছো।”
“কিসের অন্যায়?”
“এই যে শাড়ি পরে আসবে আগে থেকে আমাকে বলোনি। তাহলে আমিও পান্জাবি পরে আসতাম। ”
“বললে কি এরকম সারপ্রাইজ হতে আষাঢ় মাস? ” বলেই দোলন আষাঢ়ের নাকে টান দেয়।
তা অবশ্য ঠিক বলেছো।আমি কল্পনাতেও ভাবিনি তুমি শাড়ি পরবে। এখন যে আমার আবারও ঐদিনের মতো একটা ভুল করতে মন চাইছে।
“খবরদার আষাঢ় এইবার তোমাকে আমি গণধোলাই খাওয়াবো বলে দিলাম। ”
“তাই নাকি?”
“হুু।”
আষাঢ় কিছু না বলে বাইকে উঠে বসে। দোলনকে চোখের ইশারায় বসতে বলে। দোলন গিয়ে আষাঢ়ের পিছনে উঠে বসে। আষাঢ় বাইক স্টার্ট দেয়।
“আমি কিন্তু বেশি সময় থাকতে পারবো না আষাঢ় মাস। খালামনিকে দুই ঘন্টার কথা বলে এসেছি। ”
“আজ এসব কোনো কথা শুনবো না। আজ এই দিনটা শুধু তোমার আর আমার। আজ সারাদিন আমরা ঘুরবো ফিরবো, অনেক অনেক গল্প করবো আড্ডা দিবো।”
“কিন্তু? ”
“কোনো কিন্তু নয়। একটা কথা বলো চাঁপাফুল। ”
“কি কথা? ”
“বাইকে এরকম ভাবে বসে আছো মনে হচ্ছে অচেনা কেউ। মানুষ দেখলে ভাববে তুমি আমাকে ভাড়া করেছো গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। অধিকার থাকা সত্যেও এতো কেনো দূরত্ব? ”
দোলন কিছু বলে না চুপ থাকে।
বাইক চালিয়ে আষাঢ় কোথায় যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। আজ তাদের নির্দিষ্ট৷ কোনো গন্তব্য নেই।
কোলাহলপূর্ণ জায়গা ছেড়ে যখন নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে বাইক চলে দোলন তখন সন্তপর্ণে আষাঢ়ের কাছাকাছি এগিয়ে এসে দুই হাত দিয়ে আষাঢ় কে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা রাখে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আষাঢ় খেই হারিয়ে ফেলেছিল হুট করে এরকম কিছু হওয়ায়। অনেক কষ্টে বাইক নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজেকে সামলে নেয়। দোলন এইভাবে জড়িয়ে ধরবে আষাঢ় কল্পনা ও করতে পারেনি।
আষাঢ় দোলন দুইজন বাঁধন ছাড়া পাখির মতো সারাটাদিন এদিক ওদিক ঘুরে ফিরেছে। ফুচকা, ঝালমুড়ি, চটপটি, আইসক্রিম সব খেয়েছে।
নদীর পাড়ে বসে আষাঢ়ের কাঁধে মাথা রেখে দোলন কিছু সময় কেঁদে ও নিয়েছে। আগামীকাল চেয়েছিলো আবারও দেখা করতে কিন্তু আষাঢ়ের কাজ থাকায় তা সম্ভব না। তাই দোলনের ইচ্ছে আষাঢ় যেনো বিমানে উঠার আগে একবারের জন্য দেখা করে যায়।অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও যেনো করে। আষাঢ় চেয়েছিল দোলন যেনো এয়ারপোর্টে যায় আষাঢ়ের সাথে কিন্তু দোলন মানা করে দেয়। আষাঢ়ের বাবা মায়ের সামনে যেতে দোলনের কেমন সংকোচ হচ্ছে।
অগত্যা কি করার আষাঢ় কথা দেয় পরশুদিন দোলনের সাথে দেখা করে তারপর বিমানে উঠবে।
*********
আজকে আষাঢ়ের ফ্লাইট সকাল এগারোটায়।তাই আষাঢ় ঘড়িতে আর ফোনে দুটোতেই সাড়ে আটটার এলার্ম দিয়ে রেখেছে। বেশি রাত না জেগে ঘুমিয়ে ও গিয়েছিলো যেন সকালে তারাতাড়ি উঠতে পারে।
সকালে আষাঢ়ের ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। আষাঢ় চোখ পিটপিট করে খুলে মায়ের দিকে তাকায়।
“আষাঢ় উঠছিস না কেনো? কয়টা বাজে দেখেছিস? ফ্লাইট মিস করবি বাবা।”
আষাঢ় মায়ের কথায় দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে অলরেডি দশটা বাজে। এটা দেখে আষাঢ়ের মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। এটা কি করে সম্ভব? এতো ঘুম ঘুমিয়েছে আজ সে? এলার্মের শব্দেও সজাগ পেলো না? এলার্মের কথা মাথায় আসতেই ফোন আর ঘড়িটা হাতে নেয়। ফোন বন্ধ আর ঘড়িতে কোনো এলার্ম দেওয়া নেই। আষাঢ়ের মাথা কাজ করছে না। অন্য দিকে মিসেস রিমি তাড়া দিচ্ছেন আষাঢ় কে তারাতাড়ি তৈরি হওয়ার জন্য নয়তো সত্যি সত্যিই মিস করবে ফ্লাইট। আষাঢ় আর কিছু ভাবতে পারলো না তারাতাড়ি তৈরি হতে চলে গেলো।
মিসেস রিমি আষাঢ়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ব্রু কোঁচকায়। তিনি সকাল আটটায়ই আসছিলেন আষাঢ় কে ডাকতে কিন্তু মেঘ বাঁধা দিয়ে বলে যেতে হবে না সে দেখে এসেছে আষাঢ় ঘুম থেকে উঠেছে। এমনকি তৈরি হয়ে ও নিয়েছে। আষাঢ় নাকি বারণ করেছে তাকে এখন কেউ ডিস্টার্ব করতে। মেঘের কথা বিশ্বাস করে মিসেস রিমি আর আষাঢ়ের রুমে আসেন নি। এটা বুঝতে পারছেন না তিনি মেঘ এটা নিয়ে মিথ্যা কথা কেনো বলেছে।মেঘ কি চায় না যে আষাঢ় বাইরে যাক? এখন কিছু বলবেন না আষাঢ় আগে ভালো মতো যাক তারপর খোলাখুলি আলোচনা করবেন। মেয়েটা বারাবাড়ি করছে। এবার বুঝতে পারছেন বেশি পশ্রয় দিয়ে ফেলেছেন তিনি।
আষাঢ় এয়ারপোর্টে যাত্রা শুরু করেছে। গাড়িতে বসে দোলনকে কল মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা কোনো রেসপন্স করছে না। আষাঢ় আশা ছেড়ে দেয়। যাওয়ার আগে মাকে হাত ধরে বলে যায় দোলনের খেয়াল রাখতে। আর দোলনকে বুঝিয়ে বলতে।
আষাঢ় একরাশ মন খারাপ নিয়ে দেশ ছাড়ে।বুঝতে ও পারে না স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে পিছনে রেখে যাওয়া সাজিয়ে রাখা সব ঝড়ে তছনছ হয়ে যাবে।
#চলবে?,,,,,,
পর্ব_১৯
#আষাঢ়ের_দোলনচাঁপা
#পর্বঃ১৯
#Jhorna_Islam
ঐদিনের পর থেকে আমি দোলনের সাথে অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি আন্টি। প্রথম কয়দিন আমার মেসেজ শুধু সিন করে রাখতো কল দিলেও রিসিভ করতো কথা না বললেও।অন্তত আমার কথা শুনতো।বাইরের দেশে গিয়ে আমার অবস্থা প্রথমে নাজেহাল। একেইতো সবকিছু নতুন পরিবেশের সাথে একটা খাপখাওয়ানোর ব্যাপার আছে। আমি যাওয়ার দুই দিন পরে এরমধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে যায়। তুমিতো জানো আন্টি ডাক্তারি পড়ায় কতোটা সময় শ্রম দিতে হয়। পুরুদমে ক্লাস শুরু হওয়ার পরে নিজের খাওয়া গোসলের সময়টাও ঠিকঠাক পেতাম না। সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এইদিকে দোলন কথা বলে না দেখে এক পর্যায়ে খুব রাগ হয় আমার। মেন্টালি ডিপ্রেসড হয়ে আমি আরো সময় বইয়ের ভিতর মুখ গুঁজে পরে থাকতাম। রাগে দোলনকে ফোন দেওয়া বন্ধ করে দিলাম। ওরই কি শুধু রাগ আছে, আমার নেই? সব খবর মায়ের কাছ থেকে নিতাম।ততোদিনে নাকি মায়ের সাথে খুব ভালো একটা বন্ডিং হয়ে গেছে দোলনের। দুইজন নাকি ফ্রেন্ড হয়ে গেছে। মায়ের কাছে দোলনের গল্প শুনতাম। প্রতিদিন নাকি মায়ের সাথে কথা হতো। সপ্তাহে একদিন দেখা হতো। সব খবর তো মায়ের কাছেই পেতাম তাই ঠিক করে নেই একবারে দেশে ফিরে তারপর রাগ ভাঙাবো দোলনের। আমার সাথে কথা না বলায় আমার ও রাগ হয় এজন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। আমি জানি এটা আমার ভুল তবুও ঐ সময় এটাই সঠিক মনে হয়েছিল।
একদিন খুব করে ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলো এক পলক দেখার ইচ্ছে হলো।আবার কল দিলাম মেসেজ দিলাম কিন্তু এইবার আর না কল রিসিভ হলো আর না মেসেজ সিন হলো কারণ দোলন আমাকে ব্লক দিয়ে দিয়েছে। কি অন্যায় আমার জানা ছিলো না। পাগল হয়ে মায়ের কাছে ফোন লাগালাম মা বলল মাকেও নাকি ব্লক করে দিয়েছে। অন্য ফোন দিয়ে হাজার বার ট্রাই করলাম কোনো লাভ হলো না। তোমার ফোনে ও ট্রাই করলাম তোমার ফোন শুধু একটা কথাই বলে বন্ধ।
তখন রাত দুইটা বাজে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার মতো অবস্থা পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।ঐ রাত দুইটা বাজে মাকে তোমাদের বাড়িতে পাঠালাম। মা তোমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখে তোমাদের বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। আশেপাশে লোকজন কে বললাম জিজ্ঞেস করতে। মা বলল এতো রাতে কাকে জিজ্ঞেস করবে? বললাম জানিনা তবুও যে করে হোক দোলনের খবর নাও দরকার পরলে আশেপাশের বাড়িতে গিয়ে নক দিয়ে আমাকে জানাও। নয়তো আমি শেষ হয়ে যাবো। মা তাই করলো তোমাদের পাশের বাড়ি থেকে নাকি জানতে পারলো তোমরা কোথাও চলে গেছো এই বাড়ি থেকে। আর নাকি বলে গেছো কেউ খুঁজলে যেনো বলে,, তোমরা নিজের ইচ্ছেতে যাচ্ছো আর অতীতে যার সাথেই যা কিছু ছিলো সব ভুল। অতীত কে পিছু ছাড়ার জন্য নাকি তোমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছো। কথাগুলো শুনে আমি বুঝতে পারলাম আমাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলা।
আমি অসুস্থ হতে থাকলাম। এমন পর্যায়ে গেলাম টানা পনেরো দিন আমাকে হাসপাতালের বিছানায় পরে থাকতে হয়।দেখার মতো কেউ ছিলো না। আমার রুমমেট ছিলো ইন্ডিয়ার একজন ও আমার দেখাশোনা করেছে যতোটুকু পেরেছে। এইদিকে আমার অবস্থা দেখে বাবা মা ফোন দিয়ে কান্না। মা শুধু একটা কথাই বলতো ফোন দিয়ে দেশে ফিরে আয় দোলনকে আমরা সবাই মিলে বের করবো।তোর বাবা খুঁজ চালাচ্ছে পেয়ে যাবে টেনশন নিস না। তুই নিজের যত্ন নে বাবা।
আমার মাথায় ও জেদ চেপে গেলো সুস্থ হওয়ার পর আবার মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। যেই উদ্দেশ্যে গিয়েছি তা সফল করে তারপরই বাংলাদেশ ফিরবো তার আগে না। দোলনের সাথে তখনই সব বোঝাপড়া করবো। আমার সাথে এমন করে পালিয়ে আর কোথায় যাবে? আমি ঠিক খুঁজে বের করবো তাকে।
দোলনের খালামনি আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ সহকারে সব কথা শুনছেন। এতক্ষন আষাঢ় বলেছে তিনি একটা টু শব্দ ও করেন নি।
আষাঢ়ের কথা বলা শেষ হলে জোরে একটা নিঃশ্বাস নেয়। হাঁপিয়ে গেছে সে কথা বলতে বলতে। চোখের কোণে কখন পানি জমা হয়েছে বলতে পারবে না। বার কয়েক চোখ পিটপিট করে চোখের পানি সরানোর চেষ্টা চালায়। টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক নিশ্বাসে পুরোটা শেষ করে।
তোমার ফ্লাইট যেদিন ছিলো সেদিন দোলন সকাল সকাল বের হয়ে যায়। ভুল করে ফোন বাড়িতে রেখেই চলে যায়। এজন্য হয়তো তুমি ফোন দিয়ে ও পাওনি। অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর মলিন মুখে বাড়িতে ফিরে। কাঁদো কাঁদো মুখে আমাকে বলে,,তুমি শেষ বারের মতো দেখা না করেই চলে গেছো।
আমি তখন বলি হয়তো সময় পাওনি।
তারপর দুলিও ফোন চেক করে দেখে সত্যিই তুমি সময় পাওনি। সব জেনেও অবুঝ মেয়েটার খুব অভিমান হয় তোমার কোনো কিছুরই রিপ্লাই দেয় না। আমিও আর জোর করি না কারণ আমি জানি মেয়েটা বেশি সময় তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবে না, অভিমান ঠিক কেটে যাবে।
তোমার এবোর্ডে যাবার কয়দিন পর দোলন কারো সাথে দেখা করতে যায়। আমি জানিনা কার সাথে আমাকে শুধু বলে গেছে একজন স্পেশাল মানুষের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। সে তোমার খুব কাছের ভালোবাসার একজন মানুষ। যাওয়ার আগে যেমন খুশি ছিলো তেমনই লজ্জা পাচ্ছিল মেয়েটা।
দেখা করতে যাওয়ার আগে যেমন মুখটা পূর্ণিমা রাতের আকাশের মতো জ্বলজ্বল করছিল। ফিরে আসার সময় তার উল্টো মুখটা কেমন অমবস্যা রাতের আঁধারে ছেয়ে গিয়েছিল। কেমন পাগলের মতো আচরণ করছিল।তুমি নাকি তাকে ঠকিয়েছো। তুমি সব শেষ করে দিয়েছো। কেমন পাগলামি করতে লাগলো মেয়েটা দিন দিন পাগলামি বাড়তে লাগলো। দুলির এক কথা এখান থেকে চলে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। তাকে যদি বাঁচাতে চাই তাহলে যেনো অন্য কোথাও যাই যেখানে তোমার অস্তিত্ব থাকবে না।
শেষে উপায় না পেয়ে আমরা অন্য জায়গায় শিফ্ট হই।দুলি নিজেই তোমার সাথে সব যোগাযোগের ব্যবস্থা বন্ধ করে।
দীর্ঘ তিনটা বছর নিজের মনের সাথে নীরবে যুদ্ধ করে মেয়ে টা। কাউকে বলতে বা বুঝতে দেয়নি। কিন্তু আমিতো মা আমি ঠিক বুঝতে পারতাম মেয়েটার কষ্ট। কিন্তু কিছু করতে পারতাম না,কসম দিয়ে রেখেছে নিজে থেকে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো না কোনো কিছু তোমাকে জানাতে বা তোমার থেকে জানতেও পারবো না। মেয়ে টা আমার চোখের সামনে ধুঁকে ধুঁকে নিজের জীবন পাড় করেছে আমার কিছু করার ছিলো না।
দুই বছর আগে আমার ঔষধ আনতে বের হয় দুলি।কিন্তু নিয়তি মেয়েটার সাথে বুঝি সব খারাপ ই আছে একটা কার এসে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় আমার দুলিকে। সেই যে চোখ বন্ধ করে পরে আছে আমার দুলি আর চোখ খুলল না এখন পর্যন্ত।কথাগুলো বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পরে।
আষাঢ় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে আছে চোখ দিয়ে এখন পানি বের হলে চলবে না। অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে তাকে সমাধান করতে হবে। দোলনের সাথে মিথ্যাচার ও অন্যায়কারীদের শাস্তি দিতে হবে। তার চাঁপাফুলকে আগের মতো সুস্থ করে তুলতে হবে। এখন ভেঙে পরলে চলবে না। বি স্ট্রং আষাঢ়! বি স্ট্রং বলেই আষাঢ় উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে থাকে।
“আষাঢ়? ” পিছন থেকে ডাক দেয় দোলনের খালামনি।
আষাঢ় পিছনে না ফিরে দাঁড়িয়ে যায়।
“আমার মনে হয় ঐদিন তোমার ফোন আর এলার্মের ঘটনার রহস্য খুঁজে বের করলে আর আমার দুলি কার সাথে দেখা করেছিলো, কি কথা হয়েছিলো সেটা বের করলেই সকল কিছু সমাধান হবে। ”
আষাঢ় কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে বের হয়ে যায় সেখান থেকে।
রেস্টুরেন্টে বসে দোলনের খালামনি একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আষাঢ়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
#চলবে?,,,,,