আষাঢ়ের দোলনচাঁপা পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
32

#আষাঢ়ের_দোলনচাঁপা
#পর্বঃ(শেষ পর্ব)
#Jhorna_Islam

এহমাদ বাড়িতে আজ আবার একটা বো’ম ব্লাস্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। সকলের দৃষ্টি এখন একজন মানুষের উপর নিবদ্ধ। মানুষ যেটা কল্পনা ও করে না সেটাই তার সাথে ঘটে।কিছু কিছু মানুষ কি সুন্দর ভালো মানুষির মুখোশ পরে থাকে। এহমাদ বাড়ির লোকজন বা দোলনের বাড়ির লোকজন কেউ ই ভাবেনি এমন কিছু।
আষাঢ়ের দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ করে রেখেছে এখন তার চোখ তুলে তাকাতেও কেমন লজ্জা লাগছে। কেমন সংকোচ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আষাঢ় জীবনে ও কল্পনা করেনি।আষাঢ় যাকে নিজের আইডল ভাবতো সে এমন কাজ করেছে। যার জন্য আষাঢ় সব করতে পারতো সে কিনা লোক চক্ষুর আড়ালে এতো নোংরা খেলা খেলল?
আষাঢ় বার কয়েক চোখ টিপে নিজের চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করে ধরা গলায় ডাক দেয়,,, ব-বাবা?

আষাঢ়ের বাবা আষাঢ়ের ডাকে তাকায়।

এবার বাবার দিকে তাকিয়ে আষাঢ় নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি ঝড়তে থাকে। নিজের শার্টের হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় কিন্তু চোখ যে আজ বাঁধন হারা হয়েছে সেকি কোনো কিছুতে আটকাবে? নাকি কোনো কিছুর বারণ শুনবে। সে অঝোর ধারায় শ্রাবণ বর্ষণ করতে ব্যস্ত।

কেন করলে বাবা এমন? কি করে করলে?
হোয়াই বাবা হোয়াই?? বলেই আষাঢ় নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে চিল্লিয়ে উঠে। পুরো এহমাদ বাড়ি যেনো আষাঢ়ের চিল্লানিতে কেঁপে ওঠে। চার দেয়ালে বারবার সেই কন্ঠ প্রতিদ্ধনিত হতে থাকে। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে আষাঢ়ের এমন ধ্বনি যেনো সকলের কান ধরিয়ে দিচ্ছে।

মি. শ্রাবণের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

“কি হলো কথা বলছো না কেন?”

“কি বলবো?”

“তুমি জানোনা কি বলবে? তোমার সেই মহান কাজের কথা আমার মুখ থেকে আবার শুনতে চাও? তোমার হয়তো শুনতে ভালো লাগে কিন্তু আমার তো বলতে লজ্জা লাগছে সাথে ঘেন্না ও হচ্ছে। ”

আষাঢ়!! (মিসেস রিমি)

তুমি কেন ডাকছো আবার মা? তোমার ও কি এরকম আনাদের ধামাকাদার কিছু দেখানো বা শক দেওয়া বাকি আছে? থাকলে দেখিয়ে দিতে পারো আর অবাক হবো না।

তুই শান্ত হো আগে।

তোমার স্বামী আমার শান্তি কেঁড়ে নিয়েছে। কি করে উনি এসব করতে পারলো? কি করে পারলো করতে? একটা বার আমার কথা কি উনার মাথায় আসেনি? উনিকি জানেন না আমি দোলনকে কতোটা ভালোবাসি? আমার কথা একটা বার ভাবলো না হাহ্ কি করে ভাববে উনিতো আমাকে ভালোইবাসেন নি।যদি ভালোবাসতো তাহলে আমার দোলনের জন্য করা পাগলামির পরও এরকম একটা ভয়ংকর কাজ করাতে পারতো না।
মা তুমি তো জানো আমি উনাকে কতোটা ভালোবাসতাম।ইনফেক্ট তোমার থেকে বেশি ভালোবাসতাম। উনি কি করে পারলো আমার দোলনকে অপমান করে টাকার লোভ দেখিয়ে আমার জীবন থেকে সড়ানোর হুমকি দিতে। এটাতো তাও ছোট্ট বিষয় তুমি কি জানো তোমার স্বামী কি করেছে? নিজের গাড়ি দিয়ে দোলনকে এক্সিডেন্ট করিয়েছেন উনি।

ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে থাকা সকলে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।সকলের মাথায় যেনো বা’জ পরেছে। আষাঢ় নিজের চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মেঝেতে বসে পরে।
দোলন এতক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো কিন্তু আষাঢ় কে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পরতে দেখে নিজেকে আর আঁটকে রাখতে পারে না। দোলন এগিয়ে এসে আষাঢ়ের কাঁধে হাত রাখে।আষাঢ় জানে এটা তার চাঁপাফুল তবুও সে আজ তাকালো না কোন মুখে তাকাবে সে?মেয়েটা তার জীবনে আসার পর থেকে শুধু অপমান কষ্ট এসব সহ্য করে চলেছে।

শ্রাবণ ভাই? তুমি বহু বছর আগের খুব এখনও পুষে রেখেছো মনে? মিসেস খেয়া শ্রাবণকে উদ্দেশ্য করে বলে।
সকলে মনে হয় অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। মিসেস খেয়ার কথায় সকলের দৃষ্টি এখন উনার দিকে।
মি শ্রাবণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

কি হলো শ্রাবণ ভাই?

কিছু স্মৃতি, অতীত, অপমান চাইলেও কোনোদিন ভুলা যায় না খেয়া।(মি..শ্রাবণ)

এবার মিসেস রিমি চিল্লিয়ে বলে,, তোমরা কি কেউ আমাকে খুলে বলবে সব? এসব অর্ধেক কথা আমার ভালো লাগছে না।

মিসেস খেয়া এবার নিজেই মুখ খুলে সব বলতে থাকে,,,
বহু বছর আগের কথা আমার বাবার বাড়ির সাথেই ছিলো শ্রাবণ ভাইদের বাড়ি। আমি দোলনের মা কেয়া আর শ্রাবণ ভাই ছিলাম প্রাণ প্রিয় বন্ধু। সারাদিন আমরা একসাথে থাকতাম।খাওয়া ঘুরাঘুরি খেলাধুলা সব এক সাথে ছিলো।তবে আমার থেকে শ্রাবণ ভাই আর কেয়ার আরো গাঢ়ো বন্ধুত্ব ছিলো।

কিন্তু হুট করে কেয়া আর শ্রাবণ ভাইয়ের মধ্যে কিছু একটা ঘটনা ঘটে তবে আমি জানতাম না কিছু। অবশ্য পরে সব জেনেছি।
শ্রাবণ ভাই নাকি কেয়াকে আগে থেকেই ভালোবাসতো।সেটাই জানায় কেয়াকে তবে কেয়া শ্রাবণ ভাইকে না অন্য আরেকজন কে ভালোবাসতো।শ্রাবণ ভাই নাকি কেয়ার ভালোবাসার মানুষ কে যা নয় তাই বলে অপমান করে। কেয়া সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে শ্রাবণ ভাই কে চ’ড় মেরে দেয় নিজেও অনেক কথা শোনায়।এসব নিয়ে তাদের মধ্যে অতিরিক্ত দ্বন্দ্ব চলে যার জন্য শ্রাবণ ভাই একটু বেশিই এগ্রেসিভ হয়ে যায়। এসব বাড়ির লোক ও সামলাতে পারছিলো না এর জন্য শেষে কোনো উপায় না পেয়ে শ্রাবণ ভাইয়ের বাবা শহরে চলে আসে।

আচ্ছা শ্রাবণ ভাই তুমি কি সেই দ্বন্দ্বের জেড় ধরে আমার দুলি কে গাড়ি চাপা দিয়েছিলে?

তোর বোনের ভালোবাসার মানুষের চেহারা পেয়েছে মেয়েটা।অনেক চেয়েও নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলাম এমনকি টাকা দিয়ে এই শহর থেকে আমার ছেলের জীবন থেকে ও সড়াতে চেয়েছিলাম কিন্তু শুনেনি।একদিন খুব রেগে ছিলাম আর মেয়েটা আমার গাড়ির সামনে চলে আসে চেষ্টা করলে হয়তো এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচাতে পারতাম কিন্তু কেন জানি ইচ্ছে করে নি।বারবার চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল এই আমাকে কেয়া এই মেয়েটার বাবার জন্য ছেড়ে গিয়েছে।

তুমি কি কেয়ার প্রেমিককে দেখেছিলে?(মিসেস খেয়া)

না।

তাহলে কি করে বুঝলে দোলন বাবার মতো হয়েছে?

মায়ের মতো যখন হয়নি তাহলে তো বাবার মতোই হয়েছে।

কিন্তু আমার কেয়া যাকে ভালোবাসতো তাকে তো জীবনে আপন করে পায়নি।

মানে?

তোমরা চলে আসার পরে বাড়িতে কেয়াকে নিয়ে তুমুল কান্ড ঘটে।বাবা কেয়ার ভালোবাসাকেও মেনে নেয়নি। কেয়াকে জোর করে অন্য জায়গায় মানে
দোলনের বাবার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়।

মি.শ্রাবণ অবাক হয়ে বলে,,,, তুই এসব কি বলছিস খেয়া?

আমি যা বলছি সব ঠিক বলছি।

মি শ্রাবণ এবার মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পরে।

সবকিছু শুনে আষাঢ় উঠে দাঁড়ায় কাউকে কিছু না বলে উপরে উঠতে থাকে। আষাঢ় কে উপরে উঠতে দেখে মিসেস রিমি, দোলন জানতে চায় কোথায় যাচ্ছে কিন্তু কোনো উত্তর পায় না। আষাঢ় সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগায়। আষাঢ়ের পিছন পিছন দোলন ও যায় কিন্তু রুমে ঢুকতে পারে না। দোলন দরজায় দাঁড়িয়ে আষাঢ় কে ডাকতে থাকে কিন্তু কোনো সাড়া পায় না। আষাঢ় কে এমন করে দরজা বন্ধ করতে দেখে সকলেই উদ্বিগ্ন হয়ে পরে।
মিনিট দশেক পরে আষাঢ় রুমের দরজা খুলে বের হয় সাথে একটা বড় লাগেজ তারপর এক হাতে লাগেজ আর এক হাতে দোলনের হাত ধরে নিচে নেমে আসে।

মিসেস রিমি দৌড়ে এগিয়ে এসে বলে কোথায় যাচ্ছিস বাবা?
মি.শ্রাবণ ও বসা থেকে উঠে বলে কোথায় যাচ্ছো তুমি আষাঢ়?

আপাতত কোথায় যাচ্ছি জানিনা মা তবে এই বাড়িতে এক ছাদের নিচে একজন খু’নীর সাথে আমি আর কিছুতেই থাকতে পারবো না।

পাগল হয়ে গেছো তুমি আষাঢ়? (মি.শ্রাবণ)

মি.এহমাদ আপনার সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধছে।

মি.শ্রাবণ এগিয়ে এসে বলে,, আমার ভুল হয়ে গেছে আষাঢ়।
আষাঢ় কোনো উত্তর দেয় না দোলনের হাত ধরে নিয়ে মিসেস খেয়ার সামনে দাঁড়ায়।
মিসেস খেয়ার হাতে দোলনের হাত দিয়ে বলে আন্টি আপনার ভাগ্নিকে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম। আমি তার যোগ্য না পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন আন্টি।আষাঢ় কথাগুলো বলেই নিজের শার্টের হাতায় চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়ায় যাওয়ার জন্য।
মিসেস রিমি সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছিস তুই?

আমাকে আর আটকিও না মা আমি এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত ও থাকবো না।

তোমার বাড়ি তুমি কেন থাকবে না আষাঢ়? (মি.শ্রাবণ)

আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এখানে থাকো আমি চলে যাচ্ছি বাড়ি ছেড়ে।

আপনার এসব সমস্ত নাটক অসহ্য লাগছে আমার।

আমি ভুল করেছি আষাঢ় আমি সব স্বীকার করছি।রাগের মাথায় আমি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি।
দোলন তুমি আমাকে মাফ করে দাও মা বলেই মি.শ্রাবন এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু আষাঢ়ের চিল্লানোর শব্দে আর এগোয় না।

আষাঢ় বাড়ি থেকে বের হতে নিলে তার হাত টেনে ধরে দোলন।
“আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছো আষাঢ় মাস?”

“চাঁপাফুল আমাকে যেতে দাও।আমি তোমার লাইফে আসার পর থেকে একটার পর একটা ক্ষতি হয়েই চলেছে। ”

এসব আজগুবি কথা বলোনাতো আষাঢ়।

তুমি আমার সাথে যাবে?

হুু।

থাকতে পারবে আমি যেখানে রাখবো?

তোমার কি মনে হয়?

ঠিক আছে তাহলে চলো। বলেই দুইজন এহমাদ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
মিসেস খেয়া ও চলে যায়। বাকি থাকে মিসেস রিমি যে নিজের স্বামীর দিকে ঘেন্নার দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে যায় মনে মনে ঠিক করে নেয় উনিও বাবার বাড়ি চলে যাবে। নিঃসঙ্গ একাকি পরে থাকে পুরো বাড়িতে মি.শ্রাবণ এহমাদ।

****
আষাঢ় যখন দরজার পর্দা সরিয়ে মাকে দেখতে পায় তখন বেশ অবাক হয়ে যায়। পরে জানতে পারে মা একটা জরুরি কাজে তাকে ডাকছে। আষাঢ় দোলনের দিকে তাকিয়ে মায়ের সাথে চলে যায়।
সেই সুযোগে আষাঢ়ের বাবা রুমে ঢুকে দোলনকে আবার আষাঢ়ের জীবন থেকে চলে যেতে বলে। আরো নানান ধরনের কথা বলতে থাকে যেসব আষাঢ় শুনে ফেলে।সব শুনে আষাঢ় সকলকে ডেকে আনে।

********
পরিশিষ্ট ঃ
পুরো বাড়িতে একাকী জীবন পাড় করে অসুস্থ হয়ে পরে এহমাদ সাহেব। নিজের চলার শক্তি ও বাক শক্তি ও হারিয়ে ফেলে। এমন করুণ পরিস্থিতি কেউই চায়নি। দোলন ও উনাকে মাফ করে দিয়েছে।
পরবর্তীতে আষাঢ় দোলনও আষাঢ়ের মা এহমাদ বাড়িতে ফিরে আসে।
আষাঢ় মাস ও তার চাঁপাফুল একসাথে তাদের জীবন অতিবাহিত করতে থাকে।

আসসালামু আলাইকুম। জানি গল্পটা শেষের দিকে এসে হযবরল লেগে গেছে তার জন্য দুঃখিত। আপনাদের আর অপেক্ষা করাতে চাইনি তাই এখানেই ইতি টানলাম।ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। পুরো গল্পটা কেমন লেগেছে জানাবেন। সকলে ভালো থাকবেন আর আমার জন্য ও দোয়া করবেন। আপনাদের জন্য নতুন কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা করবো ভবিষ্যতে।

#সমাপ্ত।