#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৪৪]
বিষন্নতার শ্রাবণ শতাব্দী পাড়ি দিয়ে গেছে
বছর ফুরায়নি তবু, ক্ষত শুকায়নি কভু
যা ছিলো আমার বিস্বাদ ঢেকে দেওয়া মেঘ
তাও নিয়ে গিয়েছিলে সেই কবে চুপ করে
এক কোটি বছর দেখা হয়না তোমায় দুচোখ ভরে।
শ্রাবণের দিন গুলো অদ্ভুত সৌন্দর্যময়। অম্বরে জমে থাকা কালো মেঘ কাটিয়ে ভারি বর্ষণ ঘোলাটে অম্বর স্বচ্ছ করে তুলে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোটার সঙ্গে যেমন ধুয়ে মুছে যায় অন্তরের যতো গ্লানি। ঠিক তেমনি শতাব্দীকাল ধরে শ্রাবণের মেঘ গুলোর সঙ্গে পারি দিচ্ছে বিষণ্ণতা। বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষত ফুরায় নি। কাছের মানুষটাকে প্রাণ ভরে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা মিটে নি। বুকের বাম পাশটা সর্বদা অপ্রকাশিত দুঃখে জর্জরিত। দীবাকে কাছ থেকে পাবার তীব্র অভিলাষ মন থেকে কাটেনি। কিন্তু কাছে চাওয়া যে মানা। দুজনের মধ্যিখানে রয়েছে অসংখ্য বাধা। দীবা আজ তার না। অন্য কারোর জীবনসঙ্গিনী। বিষয়টা কি আদৌ মেনে নিয়ে সহ্য করার মতো? কিন্তু রাজ তো অন্যান্য ছেলেদের মতো ভেঙ্গে পরেনি। সে যথেষ্ট জ্ঞানী। চুপচাপ সবটা মেনে নিয়ে দীবাকে তার ভালোবাসার কাছে ভালো থাকতে দিয়েছে। এটাকে ত্যাগ বলে না। এটাকে বলে ভালোবাসা। যারা ভালোবাসার মানুষটাকে ভালো রাখার জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে পারে, তারাই প্রকৃত পক্ষে ভালোবাসতে জানে।
বেখেয়ালি ভাবে হাঁটছে রাজ। মাথায় সর্বদা দীবার চিন্তা নিয়ে ঘুরাঘুরি করে। অন্যত্র মন নেই তার। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ির কাছাকাছি আসলো। মোট তিনটা সিঁড়িতে নামার পরেই দীবার সঙ্গে আকস্মিক ভাবে ধা:ক্কা লাগলো তার। হঠাৎ-ই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না দীবা। ধা:ক্কা লাগায় সিঁড়ি থেকে পরে যেতে নিলেই রাজ দীবার এক হাতের কব্জি ধরে ফেললো। ভয়ে চোখমুখ খিঁচে ফেললো দীবা। বাড়ির নিচ তলায় বিশালাকৃতির বসার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো সবাই। কথোপকথনের এক পর্যায়ে দীবা ও রিমির মাঝে ঝগড়া বেধে যায়। দীবাকে প্রকাণ্ড রকম ভাবে রাগিয়ে দিয়ে এক ভু দৌড় লাগালো রিমি। দীবা কিসের ছাড়ার মেয়ে? সেও রিমিকে ধরার জন্য পিছু নিলো। বসার ঘর ঘুরেও যখন নিজেকে বাঁচাতে পারছে না তখন রিমি বসার ঘর ছেড়ে দুতলায় দৌড় দিলো। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিজে সেইভ ভাবে উপরে উঠলেও রাজকে একদম খেয়াল করে নি দীবা। যার ধরন সিঁড়ির উপরে দৌড়ে উঠার সময় ধা:ক্কা লাগে। ভয়ে চোখ বন্ধ করার পরেও যখন টের পেলো কিছুই হয় নি তখন দীবা আস্তে আস্তে চোখ খোলে সামনে তাকালে রাজকে দেখতে পেল। রাজের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো সে ঝুলে আছে। রাজ তার হাত ছেড়ে দিলেই ধপাস করে সিঁড়িতে পরে যাবে। ভয়ার্ত হলো দীবা। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল, ‘প্লিজ স্যার হাত ছাড়বেন না। প্লিজ, প্লিজ।’
‘ছাড়ছি না।’
দীবাকে ভয় পেতে দেখে আশ্বাস দিলো রাজ। তারপর খুব সাবধানতার সঙ্গে দীবার হাত ধরে সোজা করে দাঁড় করালো। প্রাণপ্রিয় জানটা বাঁচতেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো দীবা। বুকে এক হাত রেখে লম্বা করে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। অপরাধীর মতো তাকিয়ে বোকা বোকা টাইপ হাসি দিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করলো, ‘সরি স্যার। আসলে রিমিকে ধরার চেষ্টা করছিলাম। রিমি তো দৌড়ে উপরে চলে গেছে কিন্তু রিমির পিছনে আপনাকে আমি একদম খেয়াল করি নি। আই’ম সরি।’
ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিলো রাজ, ‘ব্যাপার না। তোমরা কি সারাদিনই ঝগড়া করো নাকি? যখনই দেখি তখনই কোনো না কোনো ব্যাপারে ঝগড়া করছো।’
দীবা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘ওই অল্পসল্প।’
শব্দ তুলে হাসলো রাজ। তার এই হাসিতে ভীষণ রকমের লজ্জা পেলো দীবা। অপ্রস্তুত হয়ে কোনো রকমে রাজের পাশ কাটিয়ে উপরে চলে গেলো। তার এমন হকচিকিত চেহারা দেখে আবারো হাসলো রাজ। ঠোঁটে হাসি রেখেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো।
_____________________
সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবে ধরনী করলো অন্ধকার। দুপুরে ভারি বর্ষণের পর পরিবেশ একদম নিস্তব্ধ। বাহির থেকে ভেজা মাটির ভ্যাঁপসা গন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে ছুঁই ছুঁই। ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কর্কষ ধ্বনি পরিবেশ বাকরুদ্ধ। আকাশটা ঘন কালো মেঘেদের কারণে অন্ধকার। অন্যান্য দিনের মতো সাদা কালো মেঘেদের আনাগোনা নেই। পরিবেশ একদম নিবিড়। বারান্দার একদম শেষার্ধে দাঁড়িয়ে এক মনে সামনের ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে নুরা। নিষ্প্রভ তার চোখের চাহনি। এই কয়দিনে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে চোখের নিচে হালকা কালি পরে গেছে। অন্যান্য দিনের মতো হাস্যউজ্জ্বল এই নুরা আজ নেই। চাঞ্চল্যকর মন ধুলাবালিতে মিশে নিস্তেজ হয়ে গেছে। কারণ নুরার মন ভেঙ্গেছে। এক পাক্ষিক ভালোবাসার মতো বিরাট বড় অপরাধ সে করেছে। কে বলে ভালোবাসা মানে সুখ? নুরার কাছে মনে হচ্ছে ভালোবাসা মানেই দুঃখ। মানুষটাকে হারানোর বেদনা হৃদয়ে সর্বদা বিরাজ করে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো অনেক রাত। সময় প্রায় নয়টা ছুঁই ছুঁই। এই বাড়িতে আটটাকেই মধ্যরাত হিসেবে গণ্য করে বাড়ির কর্মচারীগন। সেই অনুযায়ী রাত আটটার মধ্যেই রাতের খাবার শেষ করে যার যার ঘরে অবস্থান করতে হয়। দীবা ও রিমি আনন্দে ব্যস্ত। কিন্তু এই আনন্দে মন বসাতে পারছে না নুরা।।তাই রাইমার কাছে যাবে বলে দুজনের চোখে ফাঁকি দিয়ে বেড়িয়ে এসেছে। কিন্তু সে আদৌতে রাইমার কাছে যায়নি। একা একা বারান্দায় সময় কাটালো এতোক্ষণ। তাই এখন ঘরে যাবার জন্য পিছু ফিরতেই আবরারকে দেখতে পেলো। আবরারের রাগি চেহারা দেখে বিস্মিত হলো নুরা। আরব ভাই রেগে আছে কেন? চোখ ফিরিয়ে বাড়ির নিচে তাকাতেই রাজকে দেখতে পেলো সে। খেয়াল করলো আবরার রাজের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে আতঙ্কিত হলো নুরার মন। নিজেও অস্থির পায়ের কদম ফেলে আবরারকে ধরার জন্য পিছু ছুটলো।
রাজ এক পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলো। মনে জমে থাকা হাজারো অভিযোগ তুলছিলো। দীবাকে না পাবার যন্ত্রনা গুলো ভুলতে চাইছিলো। তখুনি আবরার আসলো তার কাছে। এসেই রাজের বাহুতে ধা’ক্কা দিলো একটা। হতভম্ব রাজ আকস্মিক ঘটনার মানে বুঝলো না। ধা’ক্কার তাল সামলাতে না পেরে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। আবরারের রাগি চেহারা দেখে প্রশ্ন করলো, ‘এইসবের মানে কি?’
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবরারের। রাগে মাথা গরম হয়ে গেলো তার। কপালের রগ ফোলে নীল বর্ণ ধারণ করলো।রাজের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আবারো রাজের বাহুতে ধা’ক্কা দিয়ে বললো, ‘দীবার কাছাকাছি যেতে বারণ করেছিলাম তোকে। তুই আবারো দীবার..!”
আবরারের কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই রাজ কিছুটা রাগী গলায় কাটকাট ভাবে বলে উঠলো, ‘দীবার কাছাকাছি কোথায়?”
আবরার প্রথমের মতো ক্রোধান্তিত চোখেমুখে রাজের বাহুতে তৃতীয় বারের মতো ধা:ক্কা দিয়ে বললো, ‘সন্ধ্যায় দীবার হাত ধরলি কেন? সাবধান করার পরেও বারবার দীবার কাছে যাচ্ছিস কেন তুই?’
আবরারের ব্যবহার আজ সীমা অতিক্রম করেছে। এতোদিন দূর থেকে থ্রে’ট দেওয়া পর্যন্তও ঠিক ছিল, কিন্তু আজ গায়ে হাত তুলার ব্যাপার টা রাজ নিতে পারলো না। রাগে শরির মৃদু কেঁপে উঠলো।। চোয়াল শক্ত করে আবরারের কলার ধরে গর্জন করে উঠলো, ‘ব্রাস্টার চোখে কি কালি পরে ছিলো? দীবাকে না ধরলে নিচে পরে যেতো।’
আবরার নিজেও রাজের কলাপ চেপে ধরলো। দুজনের মাঝে মা’রা’মা’রি লাগার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো নুরা। মর্মান্তিক অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ নুরা। দৌড়ে এসে দুইজনকে থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কেউ তার কথা গুরুত্ব দিচ্ছে না। দুইজন দুজনের কলার চেপে ধরে একে অপরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। এই বুঝি একে অপরকে আঘাত করবে। নুরা ভয়ে অস্থির হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আরব ভাই ছাড়ো প্লিজ। থামো তোমরা। ছাড়ো! আরব ভাই?’
ছাড়লো না আবরার। উলটো রাজের কলার আরো শক্ত করে চেপে ধরে হুংকার দিয়ে উঠলো, ‘তোকে আমি জাস্ট সহ্য করতে পারি না। বারবার সতর্ক করার পরেও তুই দীবার পাশেই ঘুরছিস। ইচ্ছে করছে তোকে মে’রে…!!
‘বাড়াবাড়ি করার একটা লিমিট থাকে। আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিবি না। হাত ছাড়!’
‘ছাড়বো না। কি করবি তুই?’
‘আবরার ভালো হচ্ছে না কিন্তু। হাত সরা বলছি!’
নুরা হতবাক। কি করবে কিছুই বুঝে আসছে না। এই মুহূর্তে দুজনকে থামাতে হবে। নাহলে এখানে বড় কোনো ঝামেলা বেধে যাবে। তার মনে হচ্ছে এই ঝামেলা টা রাইমার বিয়েতে বাধা হতে পারে। তাই নিজেও অস্থির হয়ে দুজনকে থামাতে চাইলো। আবরারকে ছাড়তে না দেখে রাজকে বললো হাত ছাড়তে, ‘স্যার প্লিজ আপনি ছেড়ে দেন। আরব ভাই? প্লিজ ঝামেলা করো না। ছেড়ে দাও ভাই প্লিজ।’
নুরার কথা রাখতে রাজ নিজেই কলার ছেড়ে দিলো। কিন্তু আবরার ছাড়লো না। তাই চোয়াল শক্ত করে আবরারের দিকে তাকালো রাজ। নুরা রাজের কলার থেকে আবরারের হাত ছাড়িয়ে আবরারকে দূরে সরিয়ে নিলো। আবরার রাজের দিকে আবারো এগুতে চাইলে নুরা তাকে বাধা দিলো। আবরার রাজের দিকে আঙ্গুল তুলে নুরা কে বলে উঠলো, ‘টেল হিম টু স্ট্যায় আওয়ে ফ্রম মাই গার্ল।’
রাজের মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো। আবরারের দিকে এগুতে চাইলে নুরা দুজনের মাঝামাঝি দাঁড়ালো। সামাল দিতে না পেরে নিজেই রাগ দেখিয়ে বলল, ‘কি শুরু করেছো তোমরা? উপরের সবাই টের পেলে কি হবে ভেবেছো? খবরদার কেউ কারোর দিকে আগাবে না। চুপচাপ যে যার রুমে যাও। এখুনি যাও বলছি।’
রাগান্বিত আবরার রাজের দিকে এক আঙ্গুল তুলে কড়া গলায় বলল, ‘সাবধানে থাকবি বলে দিলাম।’
কথাটা বলেই উপরে যেতে লাগলো আবরার। তার এমন কথা শুনে রাজ এগিয়ে যেতে নিলে নুরা রাজের বাহু ধরে আটকে ফেললো। রাজ রেগে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠল, ‘তোকে ভয় পাই নাকি আমি? দেখা কি করবি তুই।’
ভয়ার্ত নুরা দৃষ্টি ঘুরিয়ে উপরে তাকালো। কেউ টের পায় নি ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। তারপর রাজের বাহু ধরে জোর করে বাড়ির পিছনের লনের দিকে নিয়ে গেলো। লনের কাছে আসতেই রাজ নুরার হাত ঝাড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো। রাগের বশে পাশের একটা টবে লা:থি দিলো। তারপর রাগে কাটকাট ভাবে বলে উঠলো, ‘তোমার ভাই নিজেকে কি ভাবে? যখন খুশি যেভাবে খুশি এসেই থ্রে’ট দিবে? তোমার ভাইয়ের কপাল ভালো আমি এখনো কিছু করি নি। নাহলে এতোদিন হাসপাতালে থাকতে ভাইকে নিয়ে।’
নুরা রাজকে শান্ত করার জন্য বলল, ‘স্যার প্লিজ আস্তে কথা বলুন। কেউ শুনতে পাবে।’
‘তোমার ভাইয়ের কি কমনসেন্স বলতে নেই? দীবা দুতলার সিঁড়ি থেকে পরে যাচ্ছিলো। তখন আমি না ধরলে নিচে পরে গিয়ে সাংঘাতিক একটা ব্যাথা পেতো।’
কথাটা বলেই অশ্রাব্য ভাষায় একটা গালি দিলো রাজ। ভাইয়ের বিরুদ্ধে এমন একটা গালি শুনে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো নুরা। অন্য সময় হলে এই ছোট একটা গালি দেবার অপরাধে জেলের ভাত খাওয়াতো। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই নিশ্চুপ রইলো। রাজ নিজের রাগ সংযত রাখতে লনের মাঝে লম্বা একটা কাঠের ব্যঞ্চের মধ্যে বসলো। হাঁটুতে দুই হাতের কুনই’য়ের ভর দিয়ে ঝুকে এসে মেঝের দিকে তাকালো। পা দুটো নাচাতে লাগলো রাগ কমাতে। নিশ্চুপ নুরা। চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে রাজকে পর্যবেক্ষণ করছে।
” Some say it’s painful to wait for someone. Some say it’s painful to forget someone. But the worst pain comes when you don’t know whether to wait or forget. ”
দুটানার মাঝে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগলো রাজের। নিজেকে ছন্নছাড়া পথিকের মতো লাগছে। যার কোনো চেনা নিদিষ্ট গন্তব্য নেই। কোথায় যাবে সে? পরবর্তিতে কি করবে? কিভাবে দীবাকে ছাড়া নিজের বেখাপ্পা জীবনটাকে গুছাবে? যাকে এতো গুলো বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবেসেছে আজ তাকে ছাড়া সে কিভাবে নিজেকে কল্পনা করবে? এখানে তার দোষটা কোথায়? ভাবতে পারলো না আর। মাথা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো। চোখের শিরা গুলো লাল হয়ে এলো। দুই হাতে মাথার চুল গুলো খামচে ধরলো রাজ। কাঁপা কাঁপা কষ্টকর কণ্ঠে বললো, ‘আই মেডলি লাভ হার। ট্রাস্ট মি নুরা। এতো গুলো বছর শুধুমাত্র দীবার জন্য অপেক্ষা করেছি। দীবাকে আড়ালে ভালোবেসেছি। তাকে প্রোটেক্ট করেছি। আমার সাথেই কেন এমন হলো? আমাকে কেন ভালোবাসলো না দীবা? তোমার ভাই এর কারণ। আবরার চট্টগ্রাম না আসলেই দীবা আমার থাকতো। আই স্যোয়ার নুরা তোমার ভাইকে মে/রে ফেলতে ইচ্ছে করছে আমার।’
‘এখানে আরব ভাইয়ার কোনো দোষ নেই। ভাই আর দীবা, দুইজনই নির্দোষ। ভুলটা সম্পূর্ণ আপনার ছিলো স্যার।’
নুরার শান্তশিষ্ট কণ্ঠস্বর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো রাজ। চটপট মাথা তুলে অবাক চোখে নুরার দিকে তাকালো। নুরা একদম নির্বিকার। রাজকে এভাবে তাকাতে দেখে বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে শব্দ করে নিশ্বাস ফেললো। নিষ্প্রভ কন্ঠে স্বাভাবিক ভাবে শুধাল, ‘আপনি যে দীবাকে ভালোবাসেন তা জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল আপনার। আপনার ব্যক্তিত্ব, পারসোনালিটি, কথাবার্তা অসাধারণ। একটা মেয়েকে প্রেমে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আপনি যদি আগেই জানিয়ে দিতেন তাহলে দীবা আপনার প্রেমে পরতে বাধ্য হতো। কিন্তু আপনি তা করেন নি। এই কাজটাই আপনার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল স্যার।’
নুরার কথা গুলো কর্ণপাত হতেই রাজ যেন তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। হাজার টা শব্দগুচ্ছ তার গলায় দলা পাকিয়ে এলো। প্রত্যুত্তর করার মতো কোনো বাক্য পেলো না। নুরার কথা গুলো নিঃশব্দে শুনতে লাগলো।
‘দীবা এখনো জানে না আপনি তাকে ভালোবাসেন। তাহলে আপনিই বলুন দীবা কেন আপনাকে ভালোবাসবে যেখানে দীবা আজ অব্দি আপনার সঙ্গে পারসোনালি কোনো কথা-ই বলে নি।’
প্রতিক্রিয়াহীন রাজ। ছোট একটা ভুলের কারণে কি সে দীবাকে হারিয়ে ফেললো? নুরার কথানুযায়ী সত্যি কি দীবা তার প্রেমে পরতো? নিজের বোকামোটা ধরতে পেরে চোখ বন্ধ করে সামনের দিকে ঝুকে পূর্ণরায় চুল গুলো খামচে ধরলো রাজ। নুরা থামলো না। নিজের মতো বলতেই লাগলো,
‘আর এখানে আরব ভাইয়ারও কোনো দোষ আমি দেখছি না। চট্টগ্রাম আসার পর হুট করেই অচেনা একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলো। দীবাকে এর আগে কখনো ভাই দেখেনি। মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে তাই ঢাকা ফিরে গেছে। তারপর যখন তিনমাস পর আবারো আসলো তখন দুজনের মধ্যে ভাব হলো। একে অপরকে ভালোবাসতে শুরু করলো।’
এইটুকু বলে থামলো নুরা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজের দিকে তাকালো। রাজকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে রাজের পাশে বসলো। কিছু বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতেই রাজ মৃদু গলায় শান্ত ভাবে বললো, ‘তোমার এইদিকটা আমার ভীষণ পছন্দের। একদম প্রশংসাযোগ্য নুরা। খুব সহজেই মনের কথাগুলো গুছিয়ে বলে দিতে পারো।’
আলতোভাবে একটা স্মিতি হাসি দিলো নুরা। মলিন মুখশ্রীর এই হাসিটা বড্ড মায়াবী আর অসহায় লাগলো। রাজের দৃষ্টি সামনের ছোট ছোট অর্কিড গুলোর দিকে।
‘কোনো মানুষই নিখুঁত হয় না। চলতি পথে কোনো না কোনো ভুল সে করেই। আমিও করলাম। প্রথমত দীবাকে ভালোবাসার মতো মারাত্মক একটা ভুল। দ্বিতীয়ত ভালোবেসেও তাকে জানাই নি। এই দুটো ভুলই আজ আমাকে একদম বিষিয়ে তুলেছে। গুছানো জীবনটা একদম ছন্নছাড়া লাগছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আমার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে নুরা। শান্তি পাবার মতো কোনো জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় গেলে একটু শান্তি পাবো বলতে পারবে?’
শেষের কথাটা নুরার দিকে তাকিয়ে আকুলিত হয়ে বললো রাজ। প্রশ্নের উত্তরের আশায় নুরার দিকে অধীর আগ্রহভরে তাকিয়ে রইলো। তার এই আশাতীত ব্যাকুল ব্যথিত চেহারার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো নুরা। ঠোঁট নাড়িয়ে জবাব দিলো, ‘বাস্তবতা মেনে নিতে শিখুন। তাহলে শান্তি আপনাআপনি আসবে।’
নুরার উত্তরটা সম্পূর্ণ ভাবে অগ্রাহ্য করে তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে উঠলো রাজ। হাসির শব্দ চারপাশ কাঁপালেও এই হাসিতে প্রাণোচ্ছলের ছোঁয়া পেলো না নুরা। অসহায় মুখে তাকালো রাজের দিকে।
হাসতে হাসতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো রাজ। শব্দ করে একটা নিশ্বাস নিয়ে উষ্ঠধয় জিভ দিয়ে ভিজালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে করুণ কন্ঠে বলে উঠলো, ‘বাস্তবতা মানুষকে বাঁচতে শিখায় ঠিকই, কিন্তু সেই বেঁচে থাকায় কখনো সুখ দিতে পারে না। আমি নাহয় দূর থেকে দীবার সুখটাকেই নিজের সুখ হিসেবে আঁকড়ে ধরে বাঁচবো।’
নুরা আশ্চর্যান্বিত বললো, ‘দূর থেকে মানে?’
‘দীবাকে যতো কাছ থেকে দেখবো ততোই কষ্ট পাবো। এখন তো দীবা আমাদের আত্মীয়। দেশে থাকলে কোনো না কোনো ভাবে দেখা নিশ্চয় হবে। তাকে হারানোর বেদনা আবারো জাগ্রত হবে। এই কষ্ট গুলো আমি সহ্য করতে পারবো না।’
শুকনো ঢোক গিললো রাজ। কথাগুলো বলতে পারছে না সে। বারবার দলা পাকিয়ে আসছে তার। তবুও বহু কষ্ট বুকে লুকিয়ে ভাব প্রকাশ করছে। নুরার দিকে ফিরে বসলো রাজ। ব্যথিত চোখেমুখে তাকিয়ে আবারো বলে উঠলো, ‘আমিও রক্তমাংস দিয়ে গড়া একটা মানুষ। কোনো রোবট না। আমারো কষ্ট হয় নুরা। ভীষণ কষ্ট হয়। আমার সবচেয়ে দুর্বলতম একটা মানুষ দীবা। তাকে দেখে আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারি না। দীবাকে হারানোর পর থেকে নিজেকে পাগল পাগল লাগে। দীবার সামনে থেকে নিজেকে কখনো স্বাভাবিক রাখতে পারবো না আমি। দেশে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
বুকটা ধক করে উঠলো নুরার। অতিরিক্ত মানসিক যন্ত্রনায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতর টা ক্রমশ ভার হয়ে আসছে। দীবাকে ভুলে থাকার জন্য রাজ দেশ ছাড়বে? তাহলে কি রাজকে সে আর দেখতে পারবে না? ভাবতেই ধারালো চাকুর আঘাত বুকে লাগলো। অতিরিক্ত উত্তেজনায় হৃদযন্ত্রটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো।
লম্বা একটা দম নিলো রাজ। নিজেকে বহু কষ্টে স্বাভাবিক রেখে আবারো বললো, ‘আমার পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি। আব্বু ইউএস যেতে বলেছিলো। কিন্তু আমি তখন যাই নি দীবার জন্য। এখন ভাবছি ওখানে গিয়ে পিএইসডি করবো।’
‘তারপর কি দেশে ফিরবেন?’
‘দেশে ফিরে আসার চিন্তা কখনো করবো না। ওখানেই সিটিজেনশিপ নিয়ে থেকে যাবো।’
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো রাজ। নুরা বিহ্বল হয়ে জানতে চাইলো, ‘যা বলছেন ভেবে বলছেন তো?’
চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই থেমে গেলো রাজ। পিছু ফিরে নুরার দিকে তাকালো। নির্বাক কন্ঠের উত্তর, ‘ভেবেই বলছি।’
উঠে দাঁড়ালো নুরা। রাজের চোখে চোখ রেখে বিনা সংকোচে বললো, ‘আর যারা আপনাকে ভালোবাসে? তাদের জন্য কি বলবেন?’
‘আব্বু আগেই আমাকে যেতে বলেছিল। এখন আমি যেতে চাইলে কেউ না করবে না। তাদের ছাড়া আমাকে আর কেউ ভালোবাসে না যে তার কথা আমাকে ভাবতে হবে।’
‘হয়তো.. হয়তো এমন কেউ আছে যে আপনার মতোই আপনাকে লুকিয়ে ভালোবাসে। আপনি চলে যাওয়াতে যার ভীষণ কষ্ট হবে।’
‘এমন কেউ নেই।’
‘যদি থেকে থাকে তাহলে কি তাকে ফিরিয়ে দিবেন?’
মনে মনে রাজ বিস্মিত হলেও বাহ্যিক ভাবে প্রকাশ করলো না। নুরার প্রশ্নটা তার অদ্ভুত লাগলো। কেউ একজন তাকে লুকিয়ে ভালোবাসে? এটা কি আদৌতে সম্ভব? প্রত্যুত্তর করলো না রাজ। নুরার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে চুপচাপ চলে গেলো।
নুরা একদম নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গায়। চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি ঝরতে লাগলো। ঠোঁট ভেঙ্গে আসলো তার। নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি পেলো না। হাঁটু ভেঙ্গে নিচে বসে পরলো। তখুনি আকাশ কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকালো। বড় বড় বৃষ্টির ফোটা ধরনীর বুকে হামলে পরলো। নুরাকে সঙ্গ দিলো শ্রাবণের বর্ষণ। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অপরাধে নিঃশব্দে কান্না করার কারণে আকাশের বুকে জমে থাকা কালো অভিমানি মেঘ গুলো নিজেদের বিলিয়ে দিলো। টুপটাপ বৃষ্টির ফোটা হয়ে ঝড়ে নুরাকে শান্ত্বনা দিতে লাগলো। শব্দহীন বর্ষণের ফোটা গুলো বলতে লাগলো,
‘এ প্রেম থেমে যায়, রেখে যায় যা কিছু
আমরা ছুটছি অনন্তকাল তার পিছু,
চোখের কার্নিশ হয়ে যায় স্রোতস্বিনী নদী
ছেড়ে যাওয়া মানুষেরা তা জানতো যদি।
কতকাল বৃষ্টি হয়ে মেঘ ঝড়ে পরে
তাদেরও থেমে যেতে হয় দিন শেষে
পৃথিবীর কোনো আঁধার বেয়ে
নক্ষত্র ধরা দেবে তোমায় কাছে এসে।
চলমান..