#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৫৭] প্রথমাংশ
গালে এক হাত গুঁজে বসে আছে দীবা। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ধূসর রঙের আকাশটা দেখছে। শীতল বাতাসের শু-শু শব্দ চারপাশ আমোদিত। আকাশে থোকায়থোকায় মেঘ জমেছে। কিয়ৎক্ষণ পর বোধহয় ধরনি কাপিয়ে বর্ষণ হবে। বর্ষাকাল দীবার অনেক পছন্দের। আষাঢ় শ্রাবণমাসের মেঘের গর্জন, বর্ষণ, শীতল বাতাস সবই তার প্রিয়। কিন্তু অতিপ্রিয় মাস দুটো যেন চোখের পকলেই শেষ হয়ে গেছে। আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি শ্রাবণের বিদায় হতে। দীবা গালে হাত রেখেই আনমনে বলে উঠলো, ‘রিমি? তুইও তো রিলেশনে আছোস।’
পাশে বসেই কিছু একটা লিখছিলো রিমি। দীবার কথা শুনতেই খাতায় চালিত কলম থেমে গেলো। চমকে তাকালো দীবার দিকে। বিস্মিত হয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘না বোইন, ব্রেক’আপ কইরা লাইছি।’
এমতাবস্থায় হাসতে নিয়েও হাসলো না দীবা। হাসি আটকে বললো, ‘সিরিয়াসলি? ভয় পাইছোস?’
হতাশার নিশ্বাস ফেললো রিমি। কলম রেখে পিছনের হাই বেঞ্চে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজল। মলিন চেহারায় বলে উঠলো, ‘এই আরব ভাই যে কি শুরু করছে আল্লাহ ভালো জানে।’
দীবা এবার গালে দুই হাত রেখে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, ‘রাজ স্যারের সঙ্গে তোর ভাইয়ের মনে হয় পূর্বজন্মের শত্রুতা ছিলো। নাহলে রাজ স্যারকে দেখতে পারে না কেন?’
রিমি দীবার দিকে আড়ষ্টার সঙ্গে তাকালো। মনে মনে বলল ‘কারণটা তুই নিজেই দীবা’। কিন্তু উপরে চুপচাপ রইলো। ক্লাসে শিক্ষক আসায় দাঁড়িয়ে পরলো সবাই। মনোযোগ দিলো পড়ায়।
পুরো ক্লাসে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে দেখলো রাজ। বুক ভরা যেই আশা নিয়ে ক্লাসে এসেছিলো তা মুহূর্তেই হারিয়ে গেলো। নুরা কলেজ আসে আজ? কিন্তু কেন? প্রশ্নটা মাথায় আসার পর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর মিলে গেলো। তাহলে নুরার কথাটা সত্যি ছিল। আবরার তাকে বাড়ির বাহিরে যেতে নিষেধ করেছে! ভাবতেই রাগে মাথা নাড়া দিয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত পিষলো নিরবে। আবরারের সমস্যা কোথায়? কেন সব সময় তার পথে আসছে? দীবা তার স্ত্রী জানার পর তো সে সড়ে এসেছে। যদি রাজ নিজের ভালোবাসা ভুলতে পারে তাহলে তাহলে আবরার কেন তাকে মেনে নিতে পারছে না? ক্রোধান্বিত হয়ে একটা গম্ভীর নিশ্বাস ফেললো রাজ। চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে ক্লাস করাতে লাগলো।
কলেজ ছুটি হওয়ায় সকল শিক্ষার্থীর আনন্দের শেষ নেই। কিন্তু সেই আনন্দ উপভোগ করতে পারছে না রিমি ও দীবা। মলিন চোখেমুখে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসলো। কারোর মুখে খুশির ঝিলিক নেই। গেইটের বাহিরে এসে নিজেদের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলে রাজকে তাদের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তাদের দুজনকে দেখেই রাজ এগিয়ে এসে কিছুটা অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করে উঠলো, ‘নুরা আজ কলেজে আসে নি কেন? কিছু হয়েছে ওর?’
রিমি সঙ্গে সঙ্গে আশ্বাস দিয়ে প্রত্যুত্তর করলো, ‘নুরা একদম ঠিক আছে। আসলে আরব ভাই…’
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো রিমি। তাকে থামতে দেখে রাজ আবারো প্রশ্ন করলো, ‘কি থামলে কেন? আবরার কি করেছে?’
নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো রিমি। এমনিতেই দুজনের মাঝে সাপ নেউলের সম্পর্ক। তার উপর আবার আগুনের মধ্যে ঘি ঢালতে যাচ্ছিলো সে। নিজেকে মুহূর্তেই কয়েকটা অশ্রাব্য ভাষায় গা-লি দিলো। রাজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টেনে কোনো রকমে বোকাবোকা টাইপ হাসি দিলো।
রিমির উত্তর শুনার দরকার পরলো না রাজের। কারণটা তার জানা। শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দুজনের দিকে তাকিয়ে অনুনয় স্বরে বললো, ‘ছোট একটা হেল্প করতে পারবে তোমরা?’
দীবা জানতে চাইলো, ‘অবশ্যই চেষ্টা করবো। কি হেল্প লাগবে?’
রাজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘নুরার সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগ আছে? আমি ওর সাথে একটু দেখা করতে চাই।’
চোখ দুটো ছানাবড়া করে ফেললো রিমি। বিস্মিত হয়ে আলতোভাবে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ইম্পসিবল স্যার। আরব ভাই জানতে চাইলে মে-রে-ই ফেলবে। আপাতত দেখা করার চিন্তা বাদ দেন।’
রিমির হাত ধরে থামিয়ে দিলো দীবা। রাজের দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে। আমরা সুযোগ বুঝে আপনাকে জানাবো। একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
উল্লাসিত হলো রাজ। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠলো। হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা জানালো। দীবা আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলে রাজ একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। তাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমোদিত একটা হাসি দিলো সে। গতকাল রাতে নুরার কান্নামাখা কন্ঠ শুনার পর থেকেই মনটা অস্থির হয়ে ছিলো। যতোক্ষণ না নুরাকে দেখতে পারছে ততোক্ষণ তার মন শান্ত হবে না। কিছুতেই না।
___________________
চিন্তিত দীবা কোমড়ে এক হাত রেখে অপর হাতের নখ কামড়াতে কামড়াতে পায়চারি করছে রুমে। দুশ্চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। অস্থির হয়ে আছে মন। তখন তো বড়মুখে বলে এসেছে নুরার দেখা করিয়ে দিবে। কিন্তু এখন কিভাবে কি করবে সে? কোথায় দেখা করাবে? ভাবতেই মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো তার। দীর্ঘসময় পায়চারি করার পর দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘পা-ষা-ণ একটু তো সাহায্য করতে পারিস।’
বিছানায় বসে হুমায়ুন আহমেদের ‘তন্দ্রাবিলাসী’ বই পড়ছে রিমি। দীবার কথা শুনেও প্রতিক্রিয়া দেখালো না। পাতা উলটে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো, ‘করতে পারবো না বলেই তো স্যারকে কিছু বলিনি।’
দীবার কান্না করে দেবার মতো অবস্থা প্রায়। চরমরূপে হতাশ হয়ে বিছানায় ধপাস করে বসে পরলো। রিমির দিকে কাঁদুকাঁদু চেহারায় রিমির দিকে তাকাতেই রিমি বললো, ‘আরব ভাই যা ঢং শুরু করছে। নুরাকে কলেজেই যেতে দেয় নি তাহলে বাহিরে কোথায় এলাউ করবে?’
‘কিছু একটা তো বলতেই হবে। শপিংয়ের কথা বললে কেমন হয়?’
শেষের কথাটা কিছুটা উল্লাসিত হয়ে বললো দীবা। রিমি কিছুক্ষণ ভেবে সম্মতি জানালো। অতঃপর দুজন একত্রে বসে কিভাবে ব্যাপারটা ম্যানেজ করবে তা ঠিক করে নিলো।
_____________________
বুকে দুই হাত গুঁজে মুখ ফুলিয়ে গাড়িতে বসে আছে দীবা। রাগে তার শরির রিরি করছে। মেজাজ বিগড়ে আছে একদম। কটমট চোখে আবরারের দিকে আড় চোখে তাকালো একবার। এই লোকটার ব্যাবহার অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গেছে। শপিংয়ের জন্য বাড়ির সবাই যেতে বললেও মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আবরার। সে কিছুতেই নুরাকে দিবে না। হয় সে তাদের সঙ্গে যাবে নাহয় নুরাকে বাড়িতে রেখে রিমি দীবাকে যেতে হবে। অজ্ঞাত বাধ্য হয়েই আবরারের সঙ্গে যেতে রাজি হলো দুজন। চোখ ঘুরিয়ে পিছনের সিটে তাকালো। দেখলো রিমিও বিরক্তি নিয়ে বসে আছে। হতাশ হলো দীবা। উপায় খুঁজতে লাগলো আবারো।
পরিকল্পনা না থাকার পরেও কিছু কসমেটিকস কিনলো তারা। হাসফাস করছে রিমি ও দীবা। আবরার তাদের সঙ্গেই! কিভাবে আবরারের চোখের আড়াল হবে তারা? দ্বিতীয় তলায় একটা দোকানের দিকে চোখ যেতেই রিমির মাথায় চটজলদি একটা বুদ্ধি আসলো। দীবার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিশফিশ করে বললো। বিলম্ব করলো না দীবা। সঙ্গে সঙ্গে আবরারের বাহু জড়িয়ে ধরে দোকানটা দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘ওইযে দেখেন নিবিড় ফ্যাশনে কতো সুন্দর সুন্দর কাপল ড্রেস। আসেন আমাদের জন্য কাপল ড্রেস কিনি। তাড়াতাড়ি আসেন।’ [দোকানের নাম কাল্পনিক]
আবরার কিছু বলার আগেই রিমি নুরার হাত ধরে বললো, ‘আচ্ছা কাপল ড্রেস দেখ তাহলে। আমার একটা হিজাব লাগবে। আমি নুরা ওটা কিনতে যাই।’
দীবা আবরারকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। তার আগেই আবরারের বাহু ধরে টেনে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেলো।আবরারের মাথায় ক্যাপ আর মুখে মাক্স পড়ে থাকায় কেউ চিনতে পারলো না। হঠাৎ দীবার এমন ব্যবহারে কিছুটা বিস্মিত হলো আবরার। দীবা তার হাত ধরেই বিভিন্ন কালেকশন দেখতে দেখছে। শাড়ি হাতে নিয়ে গায়ে রেখে তাকে দেখাচ্ছে। মৃদু হাসলো আবরার। সব চিন্তা বাদ দিয়ে দীবার দিকে এক মনে তাকিয়ে রইলো। মুগ্ধকর নয়নে উপভোগ করতে লাগলো দীবার হাসিখুশি চেহারা।
.
নুরার হাত ধরে শপিংমলের তৃতীয় তলায় আসলো রিমি। তৃতীয় তলার পাশে বিশাল জায়গা জুড়ে রেস্টুরেন্ট আছে। হিজাব কেনার কথা বলে এখানে আসায় নুরার রাগ প্রথমের তুলনায় দ্বিগুণ হলো। শপিং করার জন্য আসতে চায় নি সে। জোরপূর্বক আনা হয়েছে তাকে। বিরক্তির শেষ পর্যায়ে গিয়ে রিমির হাত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলো, ‘এখানে আনলি কেন? যা কেনার তাড়াতাড়ি কিনে বাড়িতে আয়। ভাল্লাগতেছে না আমার।’
কথাটা বলে সামনে তাকাতেই থমকে গেলো নুরা। বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠলো। চোখ দুটো লাল হয়ে এলো মুহূর্তেই। নুরার থমকানো দেখে মুচকি হাসলো রিমি। নুরার কাধে হাত রেখে চোখের ইশারা দিয়ে বললো, ‘যা দেখা করে আয়!’
চলে গেলো রিমি। নুরা তার জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
রেলিং’য়ে হেলান দিয়ে পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিলো রাজ। পরনে তার সাদা শার্ট কালো প্যান্ট। নুরাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্মিতি হাসলো। এক হাত উঠিয়ে ইশারায় কাছে ডাকলো। সাড়া পেতেই ঠোঁট ভেঙ্গে গেলো নুরার। এক দৌড়ে এসে রাজকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। বিকেলের শেষ সময় হওয়ায় রেস্টুরেন্টে হাতে গুণা কয়েকজন মানুষ মাত্র। নুরাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে হতবাক হয়ে গেলো রাজ। নিজেও এক হাতে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে নুরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘হুশ কান্না করে না। মানুষ দেখছে। নুরা? কান্না থামাও।
তবুও থামলো না নুরা। কান্নার গতি আরো বাড়লো। তাকে থাকতে না দেখে রাজ বলে উঠলো, ‘আমি কি তোমার কান্না দেখতে এসেছি নুরা? কান্না থামাবে নাকি চলে যাবো?’
চলে যাবার কথাটা শুনেই আরো শক্ত করে রাজকে জড়িয়ে ধরলো নুরা। কান্না থামালো। রাজ নুরাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। নুরা গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে রাজের দিকে তাকালো। রাজ হাটু গেড়ে নুরার সামনে বসলো। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বললো, ‘এই দুইদিনের মধ্যে চেহারার কি হাল করেছো? শুকিয়ে গেছে মুখটা।’
নুরা অসহায় চোখে তাকালো রাজের দিকে। প্রত্যুত্তর করলো না। তাকে নিরব দেখে রাজ আবারো বললো, ‘এতো ভেঙ্গে পরছো কেন? এভাবে কান্নাকাটি করে শরির খারাপ করার মতো ইস্যু এখনো হয়নি।’
আড়ষ্টতার সঙ্গে তাকালো নুরা। ধুকধুক বুকে মলিন কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আরব ভাই কখনো মেনে নিবে না। আপনার উপর এখনো রেগে আছে। গতকাল বড় আব্বু (রোশান) সঙ্গেও এই নিয়ে কথা কা-টা-কা-টি হয়েছে তার। সাবিত ভাইয়াও চুপ ছিলো। আরু ভাই এখনো কিছু বলেনি। ওরা কেউ-ই মেনে নিবে না। বিশ্বাস করুন আপনাকে আমি সত্যি অনেক ভালোবাসি। আপনাকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না।’
শেষের কথাটা দুটো অস্থির হয়ে বললো। চোখ দুটো ছলছল করছে তার। রাজ কিছুক্ষণ নুরার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিরবতা কাটিয়ে নুরার দুই হাত ধরলো। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে নুরার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে উঠলো, ‘পালাবে আমার সাথে?’
চমকে উঠলো নুরা। রাজের থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে বিস্মিত চোখে তাকালো। রাজ আবারো জানতে চাইলো, ‘বলো পালাবে আমার সাথে? কেউ যেহেতু মেনে নিবে না তাহলে আর কোনো রাস্তা দেখছি না। চলো পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি।’
নুরা বিস্মিত হয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জবাব দিলো, ‘কখনোই না। এই সিদ্ধান্ত আমি কখনোই নিবো না। দরকার পরলে সারাজীবন অপেক্ষা করবো। বারবার সবাইকে মানানোর চেষ্টা করবো। তবুও পালিয়ে বিয়ে আমি করবো না।’
‘তাহলে এখুনি এতো আপসেট হয়ে পরছো কেন?’
রাজের পালটা প্রশ্ন শুনে স্থির হয়ে গেলো নুরা। বিব্রত হয়ে চোখ দুটো নামিয়ে অন্যত্র তাকালো। রাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চেয়ার টেনে বসলো। টেবিলে দুই হাত রেখে বললো, ‘আবরার আর আমার মাঝে ঝা-মে-লা আছে তাই ওর মেনে নিতে সময় লাগবে। ততোদিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে স্বাভাবিক। তোমাকে স্ট্রং থাকবে নুরা। তুমি আমাকে সাপোর্ট দিবে। আমি তোমার পরিবারের লোকদের সাথে আলাদাভাবে কথা বলবো। মানাবো বুঝাবো। একদিন না একদন ঠিকই মেনে নিবে।’
এইটুকু বলে থামলো রাজ। তখুনি সেখানে একজন যুবক উপস্থিত হলো। হাতে একটা মেনো কার্ড রাজের দিকে এগিয়ে খাবার অর্ডার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। রাজ শুধু এক কাপ কফি অর্ডার করেছে। ছেলেটা চলে যাবার পরেই রাজ আবারো বলতে লাগলো, ‘তোমাকে আমার ভালো লাগার একমাত্র কারণ হচ্ছে তোমার ম্যাচুরিটি। জানি তুমি ভেবেচিন্তে সব সিদ্ধান্ত নাও। তাহলে এখন কেন নিজের এই হাল করছো? সময় তো আর চলে যাচ্ছে না। আমাদের অস্থির না হয়ে ঠান্ডা মাথায় সবাইকে বুঝাতে হবে।’
মলিন আঁখি যুগল তুলে রাজের দিকে তাকালো নুরা। মন ভরে দেখে নিলো রাজকে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো রাজের কথার। এতোক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রাজ। দীবা কল দিয়ে নুরার কথা জানানোর পর থেকে তার মন অস্থির হয়ে উঠেছিলো। নুরাকে এক পলক দেখার জন্য হাহাকার করছিল বুক। এখন চোখের সামনে নুরাকে দেখতে পেয়ে শান্ত হলো মন। মৃদু হেসে নুরার দিকে তাকালো রাজ।
____________________
আরেকটু বেশি সময় থাকার জন্য কাপল ড্রেস পছন্দ হওয়ার পরেও ইচ্ছে করে কোনোটাই ভালো লাগছে না বলে চালিয়ে দিচ্ছে দীবা। এক পর্যায়ে আবরার মহা বিরক্ত হলো। তাই দোকানদারের সামনেই ধমক দিয়ে উঠলো। অতঃপর বাধ্য হয়ে পছন্দমতো একটা শাড়ি পাঞ্জাবির সেট নিয়ে নিলো। ভাগ্যবশত দোকান থেকে বের হবার পরেই রিমি নুরা সেখানে হাজির হয়েছে। তাদের দেখেই ভয়ার্ত মন শান্ত হলো দীবার। আবরারের হাত ছেড়ে নুরা ও রিমির কাছে এসে উল্লাসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘হিজাব কিনেছিস?’
প্রত্যুত্তরে নুরা মুচকি একটা হাসি দিলো। রিমি দাঁত কেলিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে চল এবার বাড়ি ফেরা যাক।’
কথাটা বলেই আবরারের দিকে তাকিয়ে দীবা হাঁটা শুরু করলো। সঙ্গে রিমি নুরাও। ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো আবরার। কিছুক্ষণ আগেও দীবা এক মুহূর্তের জন্যও তার হাত ছাড়ে নি। আর এখন আবরার তার সাথে আছে কি নেই সেই খেয়াল নেই। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলো আবরার। এখানে আসার আগ পর্যন্তও নুরার মন খারাপ ছিলো। আর এই অল্পসময়ের ভিতরেই তার মুখে হাসি? কিছুটা সন্দেহ লাগলো তার। তবুও চুপচাপ তাদের পিছনে হাঁটতে লাগলো।
শপিংমলের বাহিরে এসে গাড়িতে উঠে বসলো। দীবা সামনের সিটে আর নুরা রিমি পিছনের সিটে। তিনজনের মন একদম ফুরফুরে। বিশেষ করে দীবার। ভাব খানা এমন যেন ঈদের শপিং করেছে। আবরারের সন্দেহ আরো তীব্র হলো। কপাল কুঁচকে গাড়ির কাছে আসলো। পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেলো। চোখে তুলে উপরে তাকাতেই অবাক হলো সে। হতভম্ব হয়ে একবার তিনজনের দিকে তাকিয়ে আবারো শপিংমলের বিল্ডিং’য়ের তৃতীয় তলায় তাকালো। আজ শপিংয়ে আসার মূল উদ্দেশ্য তাহলে রাজ! নিরবে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
চলমান…
#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-৫৭] দ্বিতীয়াংশ
পশ্চিমাকাশে সূর্য ডুবি ডুবি অবস্থা। চারপাশে তার হলুদ লালচে আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। ঘোলাটে আকাশের সঙ্গে মৃদু শীতল বাতাস জানান দিচ্ছে রাতে ভারি বর্ষণ আসবে। পুরো রাস্তা দীবা আকাশটা দেখে কাটিয়েছে। শান্তি নিবাসের সামনে গাড়ি থামালো আবরার। গাড়ি থেমতেই দীবা দরজা খুললো বের হতে। তখুনি আবরার পিছু ফিরে রিমি নুরার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘তোরা যা। দীবার সাথে আমার কথা আছে।’
দীবা নামতে গিয়েও থেমে গেলো। রোমান্টিক ভেবে রিমি নুরা ঠোঁট টিপে হাসলো। আবরারের কথায় সম্মতি দিয়ে চুপচাপ শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে নেমে গেলো গাড়ি থেকে। ব্যাপারটা দীবা স্বাভাবিক ভাবে নিলো। কারণ এর আগেও আবরার তাকে নিয়ে এভাবে একা সময় কাটিয়েছে। এখনও বোধহয় তেমনই হবে। গত কয়েকদিন যাবত আবরারের সঙ্গে তার ঝামেলা চলছে। একা সময় কাটানোর মতো পরিস্থিতি কিংবা মন কোনোটাই ছিল না। এখন হয়তো সব স্বাভাবিক হবে। ভেবেই বুক ভরে নিশ্বাস নিলো দীবা। চোখ ঘুরিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। দেখলো আবরার চোয়াল শক্ত করে গাড়ির স্টোরিয়ারিং ধরে বসে আছে। তার এরূপ চেহারা দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো দীবা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। আবরারের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজেই বললো, ‘কিছু বলবেন আপনি? চুপচাপ বসে আছেন যে।’
ফিরে তাকালো না আবরার। সামনের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো, ‘আজকের সব কিছু তাহলে রাজের জন্য ছিলো?’
পিলে চমকে উঠলো দীবা। প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো আবরারের দিকে। ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো একটা। এতো সতর্ক থাকার পরেও জেনে গেলো লোকটা? ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না। লম্বা একটা দম নিয়ে মনে সাহস জুগিয়ে জবাব দিলো, ‘হুম!’
চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো আবরারের। দাঁতে দাঁত পিষলো নিরবে। নুরাকে তার চোখের আড়াল করতে কাপল ড্রেসের বাহানা ছিল। পুরোটা সময় দীবার নাটক ছিলো ভাবতেই রাগে মাথা নাড়া দিয়ে উঠছে তার। সে কিছু বলার আগেই দীবার বিড়বিড় করে বলা তাচ্ছিল্য কণ্ঠস্বর কানে আসলো, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়।’
কথাটা বলেই দীবা আবরারের দিকে ফিরলো। বিরক্তিকরভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে উঠলো, ‘আপনি কি এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। নুরা যাকে ভালোবাসে তার সাথেই থাকুক। সেখানে আপনি বাধা দেবার কে? আপনি কাউকে ভালোবাসেন না? আপনার ভালোবাসার মানুষটাকে যদি আপনার থেকে আলাদা করতে চায় কেউ কেমন লাগবে আপনার? কি করবেন তখন?’
এমনিতেই দীবার প্রতি রাগ ছিলো আবরার। তার উপর আবার তার ভালোবাসা নিয়ে কথা বলায় রাগে শরির কেঁপে উঠলো। গাড়ির স্টোরিয়ারিংয়ে ডান হাত দিয়ে জোরে একটা ঘু-ষি দিয়ে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠলো, ‘মে-রে ফেলবো। মে-রে একদম মাটিতে পুঁতে ফেলবো। কারোর সাহস নেই আমার থেকে আমার ভালোবাসা আলাদা করার।’
আকস্মিক ঘটনায় ভয়ে কেঁপে উঠলো দীবা। ভয়ার্ত চোখে তাকালো আবরারের। হাতে ব্যাথা পেয়েছে কিনা দেখার জন্য দ্রুত আবরারের হাত ধরলো। ডান হাতের উলটো পিঠে আঙ্গুল লাল হয়েছে। আঘাত পাওয়ায় দীবার রাগ বাড়লো! রাগি চেহারায় শাসনের ভঙ্গিতে ধমক দিলো দীবা, ‘এতো রাগ কেন আপনার? পেলেন তো ব্যাথা হাতে। একটু রাগ কমান। আপনার রাগের কারণে বাড়ির সবাই কষ্ট পেয়েছে।’
আবরার দীবার দিকে না তাকিয়েই ক্ষুব্ধ গলায় বললো, ‘আমি কাউকে কষ্ট দেইনি।’
‘অবশ্যই দিয়েছেন। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর এতো বছর একবারো ভেবেছেন বাড়ির সবাই আপনাকে ছাড়া কেমন আছে? মানলাম রোশান আঙ্কেল ভুল করেছে। তাই বলে তার জন্য আপনি অন্যদের কষ্ট দিবেন? আপনার মা, কাকি, ভাইবোন সবাই আপনাকে কত মিস করেছে জেনেন? আর রোশান আঙ্কেল? আপনি চলে যাওয়ার পর তিনি কতোটা কষ্ট পেয়েছে একবার চিন্তা করেছেন? আপনি এখনো উনাকে বাবা বলে ডাক দেননি। উনি বাবা হিসেবে এইটুকু অধিকার রাখে না আপনার উপর?’
দীর্ঘসময় ধরে এতো গুলো কথা বলে থামলো দীবা। আড় চোখে আবরারের দিকে তাকালো। কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবারো খোঁচা দিতে চাইলো, ‘একজন মানুষের উপর জোর করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে সেই মানুষটা কেমন ফিল করে সেটা আপনি ভালো জানেন। তবুও কেন সেই একই কাজ আপনি নুরার সঙ্গে করছেন? কেন নুরা আর রাজ…!’
এইটুকু বলে জিব কাটলো দীবা। বারবার কেন আবরারের সামনেই রাজের নাম টা নিতে হয়? বারবার কেন ভুলে সে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো। অতিরিক্ত বুঝাতে গেলে পরে হিতে বিপরীত হবে। বিব্রতভাব নিয়ে আবরারের দিকে তাকাতেই দেখলো আবরার রক্তিম চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিললো একবার। ইতস্তত ভাবে বললো, ‘সরি ভুলে নাম নিয়েছি।’
প্রত্যুত্তরে কিছু বলার বদলে দীবার দিকে এগিয়ে এলো আবরার। দীবার একপাশে হাত রেখে একদম কাছাকাছি আসলো। চোখে চোখ রেখে কাটকাট গলায় বললো, ‘যতো যাই হোক, রাজকে আমি কিছুতেই মেনে নিবো না।’
দীবা আর ধৈর্যধারণ করতে পারলো না। চোখে চোখ রেখেই বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘এমন কেন আপনি? নিজের জেদের কারণে নুরাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছেন। আর আপনি কি মনে করেন? আপনার মেনে নেওয়া না নেওয়ার জন্য নুরা অপেক্ষা করবে? কখনোই না! ওরা ঠিকই একদিন বিয়ে করবে। তখন আর আপনি কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু এখন নুরার সঙ্গে যেই ব্যবহার টা করছেন সেটা আজীবন নুরার মনে থাকবে।’
রাগি মুখখানা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো। দীবার থেকে সরে এসে সিটে হেলান দিয়ে বসলো আবরার। চোখ বন্ধ লম্বা একটা দম নিলো। শুকিয়ে যাওয়া উষ্ঠধয় ভিজিয়ে কণ্ঠস্বর নরম করে বললো, ‘এটা নুরার সব থেকে বড় ভুল সিদ্ধান্ত হবে। রাজ নুরাকে ভালোবাসে না।’
এইটুকু বলে থামলো আবরার। মহা বিরক্ত হয়ে দীবা ‘উফফ’ বলে উঠলো। গাড়ির দরজা বাহিরে বের হয়ে বললো, ‘আপনার এই এক কথায় বিরক্ত হয়ে গেছি আমি।’
গাড়ির দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলো দীবা। তপ্ত শ্বাস ফেলে আবরার সিটে হেলান দিলো। এক হাত থুতনি তে রেখে আকাশের দিকে তাকালো। আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে ধরনি। অন্ধকার হয়ে আসছে সামনে দিন গুলো। কিছুতেই মনকে মানাতে পারছে না। আর না পারছে পরিবারের কাউকে মানাতে। রাজ নুরাকে ভালোবাসে না। এটা আবরার শতভাগ নিশ্চিত। রাজ নুরাকে ইউজ করছে শুধুমাত্র দীবার কাছে আসার জন্য। ফটিকছড়িতে থাকাকালীন রাজের সেই কথাটা মনে পরলো আবরারের।
‘আমার ভালোবাসা কিভাবে আমার করতে হয় সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। মাঝখান থেকে কাঁটা হয়ে আসবেন না।’
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় মাথা ব্যাথা শুরু হলো আবরারের। বারবার রাজের বলা কথাটা মাথায় ঘুরছে তার। রাজ জানে দীবা তার স্ত্রী। তবুও কেন দীবাকে পাওয়ার জন্য নুরাকে ব্যবহার করছে? এতো নিচে কিভাবে নামতে পারলো সে? দুই হাতে চুল খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে গাড়ি ঘুরালো আবরার। মুহূর্তেই শান্তি নিবাস ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেলো। মনে মনে কিছু পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলো। রাজের সাথে আগে কথা বলতে হবে। ব্যাপার এখানেই মেটাতে হবে। নাহলে যতো দিন যাবে নুরা ততো কষ্ট পাবে।
___________________
ঘড়ির কাটা রাত নয়টার ঘরে। চারপাশ নিঝুম নিস্তব্ধ। কিন্তু কৃতিম লাইটের কারণে বাড়ি আলোকিত। ছাদের সিঁড়িতে গালে দুই হাত দিয়ে বসে আছে রিমি। তার সামনেই অভ্র বুকে দুই হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অভ্রের এমন চাহনীতে ইতস্তত করছে রিমি। অনেক চুপচাপ থেকে অবশেষে বিব্রতভাব নিয়ে বলেই ফেললো, ‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আশ্চর্য খেয়ে ফেলবে নাকি?’
সাথে সাথেই ধমকে উঠলো অভ্র, ‘সমস্যা কি তোমার? ইগনোর করছো কেন আমাকে?’
রিমি অসহায় হয়ে কাঁদু কাঁদু গলায় বললো, ‘এমন করতেছো কেন? এখানে বসিয়ে রেখে আমাকে ধমকাচ্ছো খালি।’
অভ্র আবারো তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো, ‘আগে আমার কথার উত্তর দাও। ব্লক দিয়েছো কেন?’
রিমি দাঁত বের করে বোকা বোকা টাইপ হাসি দিয়ে বললো, ‘দেখো নুরাকে নিয়ে অনেক ঝামেলা হচ্ছে বাড়িতে। পরে যদি আমার রিলেশনের কথা জানতে পারে তাহলে আবার ঝামেলা তৈরি হবে। আবরার ভাই মনে হয় না মেনে নিবে। আর আমি চাই না এই কারণে তোমার আর ভাইয়ের মাঝে কোনো ঝামেলা হোক।’
‘আমার আর নুরার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা রিমি। রাজের সঙ্গে স্যারের ঝামেলা আছে বলেই মেনে নিচ্ছে না। রাজ যদি না দীবাকে ভালোবাসতো তাহলে তো মেনে নিতো তাই না? আমার সাথে তোমার ভাইয়ের সম্পর্ক খুব ভালো। এখানে মেনে না নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।’
হতাশার নিশ্বাস ফেললো রিমি। ঠোঁট উল্টে চিন্তিত চেহারায় গালে আবারো দুই হাত রাখলো। আড়ষ্টতার সঙ্গে শুধাল, ‘জানি। কিন্তু আমার ভয় লাগছে। ভাই জানলে যদি আমাকে বকা দেয়?’
চোখ বন্ধ রাগ নিয়ন্ত্রণ কোড়লো অভ্র। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘পরে কি হবে না হবে সেই ভেবে এখন আমাকে ব্লক দিয়ে রাখবে?’
রিমি অভ্রের দিকে তাকালো একবার। মিনমিন করে বললো, ‘আচ্ছা সরি!’
কিছুটা শান্ত হলো অভ্র। এই মেয়ে তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে একদিন। কেন যে এর প্রেমে পড়তে গেলো আল্লাহ ভালো জানে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো অভ্র। রিমি প্রথমের মতো গালে হাত রেখে চিন্তিত গলায় বললো, ‘রাজ স্যার দীবাকেই কেন ভালোবাসলো? আগে পরে আর কেউ ছিলো না? আর ভালোই যখন বেসেছে তখন ব্যাপারটা আবরার ভাইয়েরও জানার কি দরকার ছিলো? যদি না রাজের বাচ্চা দীবাকে ভালোবাসতো। আর না আমার মহান বিরক্তিকর ভাইজান জানতে পারতো। মানে সব মিলিয়ে যাতা একটা অবস্থা ক্রিয়েট হইছে।’
এইটুকু বলে থামলো রিমি। প্রথমে কথা গুলো চিন্তিত স্বরে বললেও এখন কিছু রাগ মিশ্রিত কন্ঠে আবরারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে উঠলো, ‘আরে ভাই রাজ স্যার দীবাকে ভালোবাসতো! এখন তো আর বাসে না। তাহলে সমস্যা কোথায়?’
আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো রিমি। চোখ দুটো বড়বড় করে সামনে তাকিয়ে অস্ফুটভাবে বলে উঠলো, ‘তুই এখানে?’
ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো অভ্র। রিমির চোখের দৃষ্টি অনুসরণ পিছু ফিরে তাকালে দীবাকে দেখতে পেলো। দুজনকে আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে অভ্র চুপচাপ চলে গেলো। দীবা চোখ ছোট ছোট করে দুজনের দিকে এগিয়ে এসে সন্দেহ প্রবন দৃষ্টিতে বললো, ‘রাজ স্যার আমাকে পছন্দ করে? কবে থেকে? আর এটা তোর ভাই জানলো কিভাবে?’
রিমি ভয়ে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। আমতাআমতা করে কোনো মতে বললো, ‘দীবা শোন…!’
রিমির চেহারার এই রিয়েকশন দেখে মহা বিরক্ত হয়ে গেল দীবা। সাথে সাথেই কপাল কুঁচকে রাগ ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য এমন ভাব ধরতেছিস যেন আমি জানালে তোর ভাইকে ফেলে রাজের কাছে চলে যাবো। ফালতু!’
রিমি বড় করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে বললো, ‘আমি ভাবছিলাম তুই রেগে যাবি।’
দীবার মাথায় হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই অতি আগ্রহ নিয়ে রিমিকে সিঁড়িতে বসিয়ে সব জানতে চাইলো। রিমি আস্তে ধীরে এক এক করে তার জানা সব কিছুই জানালো। এতোদিন তার অগোচরে এতো কিছু হয়েছে অথচ সে কিছুই জানে না? ভাবতেই অবাক চূড়ান্ত পর্যাতে দীবা। মাথায় হাত দিয়ে নিজেও রিমির পাশে ধপাস করে বসলো। আফসোস নিয়ে বলে উঠলো, ‘হায় আল্লাহ কেন যে ওই দিন মেলাতে শাড়ি পরে গেছিলাম।’
রিমিও ঠোঁট উল্টে মলিন কন্ঠে বললো, ‘আরব ভাই ভাবতে রাজ স্যার তোর কাছে আসার জন্য নুরাকে ব্যবহার করছে। এছাড়া তোকে পছন্দ করে জানার পর থেকে এমনিতেও রাজকে সহ্য করতে পারে না। কিভাবে মানানো যাবে বল?’
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল দীবা। অতঃপর রিমিকে আশ্বাস দিয়ে বললো, ‘আমি মানিয়ে নিবো। এবার খেতে আয়। নুরাকে কত খুশি দেখ।’
‘হ্যাঁ, রাজ স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসার পর থেকেই তার মন ভালো হয়ে গেছে।।স্যার মনে হয় জাদু করেছে।’
‘চুপ স্যার স্যার করিস না। কেউ শুনতে পাবে।’
দুই বান্ধুবি ফিশফিশ করতে করতে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলো। এসেই যেন চোখ তাদের চড়কগাছে উঠে গেছে। রসগোল্লা সাইজের চোখ দিয়ে নুরার দিকে তাকিয়ে রইছে দুজন। অপরদিকে নুরা হাসিখুশি চেহারায় আয়েশা, নিশিতা ও রোহানার সঙ্গে টেবিলে খারার সার্ভ করছে। রিমি দীবা অবাক হয়ে চুপচাপ টেবিলে গিয়ে বসলো। আরিয়ান গালে হাত দিয়ে নুরার দিকে তাকিয়ে আছে। সাবিত বুকে হাত গুঁজে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা আবরারের নজর এড়ায়নি। সেও অবাক। তবে সেটা বাহিরে প্রকাশ করেনি। রাজের সাথে দেখা করার পরে নুরার আকস্মিক পরিবর্তন তাকে ভাবালো। নতুন এক চিন্তা মাথায় চাপালো। তবুও নিরব। প্রতিক্রিয়া না করে চুপচাপ খাওয়ায় মন দিলো।
দীবা ও রিমি আয়েশার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে কি হয়েছে জানতে চাইলো। নুরাকে এমন খুশি দেখে সবাই খুশি। তাই কেউ কিছু বলছে না। নুরা যেভাবে চাইছে করুক। কিন্তু তাদের দুইজনের অতিরিক্ত আগ্রহ দেখে আয়েশা চোখ পাকিয়ে তাকালো। চুপ হয়ে গেলো দুজন। খাওয়ায় মনোযোগ দিলো তারাও।’
______________________
রাত্রী প্রায় সাড়ে দশটা। রিমি নুরার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে দীবা নিজের রুমে গেলো না। ইচ্ছে করেই আবরারের রুমে আসলো। পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো রুম ফাঁকা। ওয়াশরুমের দরজাও খোলা। তাহলে বারান্দায় আছে লোকটা। নিঃশব্দে পায়ের কদম ফেলে বারান্দায় আসলো দীবা। সন্দেহ তার ঠিক হলো। আবরার বারান্দার লাইট অফ করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভিতরের লাইট ও ছাদের লাইট থেকে আসা আলোতেই আবরারের বলিষ্ঠ দেহ একদম স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। একা একা দাড়িতে এতো কি ভাবছে লোকটা? কপাল কুঁচকালো দীবা। চুপচাপ আবরারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আকাশটা সুন্দর না?’
আবরার প্রত্যুত্তর করে নি। দীবা মুচকি হাসলো। ঠোঁটে হাসি নিয়েই বললো, ‘নুরাকে দেখেছেন কত খুশি আজ? আজকের বিকেলের প্ল্যানটা একটা ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে।’
আবরার এবারো নিশ্চুপ। তবুও দীবা নিজের মতো করে কথা বলছে, ‘ভালোবাসতে সময়ের দরকার পরে না। কারোর হুট করেই ভালোবাসা হয়ে যায়। যেমন আপনি। আমাকে আপনি বাগানে দেখেছিলেন তাই না? তার বেহায়াদের মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন।’
মৃদু শব্দ তুলে হেসে ফেললো আবরার। দীবাও স্মিতি হেসে বললো, ‘কিন্তু আমার মনে আপনার জন্য ভালোবাসা হুট করে তৈরি হয়নি। আস্তে ধীরে আপনাকে ভালোবাসি। স্যার হয়তো আগে আমাকে পছন্দ করতো। কিন্তু যখন জানতে পেরেছে আমি বিবাহিত তখন দূরে চলে গেছে। এমনকি দেশও ছাড়তে চেয়েছিলেন শুধুমাত্র তার জন্য যেন আমাদের মাঝে ঝামেলা না হয়।’
আবরার শব্দ করে একটা নিশ্বাস ফেললো। দীবা না থেমে প্রথমের মতোই বলতে লাগলো, ‘স্যার সব কিছু ভুলে গিয়ে নুরাকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইছে। নুরাও স্যারকে ভালোবাসে। তাহলে কেন তাদের ভালোবাসা মেনে নিবেন না?’
চলমান…