আসক্তি২ পর্ব-১২

0
2774

#আসক্তি২
পর্বঃ১২
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সারাদিন নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষমতা ছিলো না শানের।শরীরের অবস্থা সামান্য একটু উন্নতি হয়েছে।
পাখি সামান্য হাতের কাজ গুলো সেড়ে রাতের রান্নাটা চুলায় বসায়।এক ফাঁকে উপরে গিয়ে শানের ঘরের দরজায় উকি দিতে বুঝতে পারে বুকের উপর ব্ল্যাঙ্কেট টা রেখে টিসুতে নাক মুছে নিচ্ছে বার বার।ভিতরে না ঢুকেই দরজার আড়াল থেকে শানকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে পাখি কেন জানে না আজ শানকে কিছুটা অন্যরকমই লাগছে তার কাছে।শরীরের সামান্য উন্নতি দেখে বেশ স্বস্তি পায় পাখি।চোখ আজ শানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে বেশ প্রশান্তি পাচ্ছে।কেমন যেন আজ শানের অসুস্থ্যতার কারণে একটু বেশিই বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।

আনমনেই মুচকি হেসে ওঠে পাখি।পরোক্ষনেই মুখে হাত দিয়ে ভাবে,”কি ব্যপার আমি হাসতেছি কেন?তার ব্যপারে হাসছি কেন? আজব তো!”
নজর এদিক সেদিক করে পাখি।নিজের কাছে নিজেই যেন ধরা পরে যায়।লজ্জামিশ্রিত চোখে অবনত মাথাটা সামান্য একটু তুলে শানের দিকে পূনরায় তাকাতেই শান দরজার দিকে তাকায়।
“কে, কে ওখান?”,ক্লান্তিমাখা অসুস্থ্য কন্ঠে বলে ওঠে শান।শরীর বিছানা ছাড়তে চাইছে না অথচ মন বলছে বাহিরে কে দেখতেই হবে।যেই ভাবা সেই কাজ। ধীরে ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে উঠার প্রস্তুতি নিতেই পাখি জিহ্ব কেটে ওঠে।বড় বড় চোখে আনমনে ভাবে,”দেখে ফেলল?কি হবে এবার?এতো লজ্জায় পড়ব ভাবি নি তো!”,
শান খুব কষ্টে বাম পা মেঝেতে নামাতেই পাখি দ্রুত দরজা থেকে সরে যায়।এরপর লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়িতে চলে আসে।আর সিঁড়ি থেকে একপ্রকার দৌড়ে রান্নাঘরে।

শান ধীরপায়ে এগিয়ে এসে দরজাটা পুরোটাই খুলে এপাশ ওপাশ চোখ বুলায়।ভ্রুকুচকে রিনরিনে কন্ঠে বলে,”স্পষ্ট মনে হলো কেউ দেখছে।তাহলে কোথায় গেলো?”
সাতপাঁচ ভেবে শান সিঁড়ির একদম কাছে চলে আসে।তবুও কাউকে কোথাও দেখতে পায় না।রান্নাঘর থেকে কড়াই খুন্তির আওয়াজে শানের বুঝতে অসুবিধা হয় না পাখি রান্নাঘরে।আনমনে ভাবতে থাকে,”ও তো কিচেনে তাহলে দরজায় কে ছিলো?”,
কুচকানো ভ্রুজোড়া সোজা করে শান আবার নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।দাঁড়িয়ে থাকা একেবারেই অসম্ভব বলে।

রাত ৯ টা বেজে ২৫ মিনিট।রান্না টা মোটামুটি শেষ করে পাখি সংকোচিত চিত্তে এগিয়ে যায় শানের ঘরের দিকে।ইনায়াহ্ থাকলে এতো বিব্রত লাগত না হয়ত।
দরজায় গিয়ে নক করে পাখি।ভিতর থেকে থমথমে কন্ঠে সাড়া আসে, “কাম ইন”
পাখি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে মাথা নিচু করে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,”খাবার রেডি”
পাখির এমন অদ্ভুত আচরনে শান অবাক হয়ে যায়।কারণ ইতোপূর্বে পাখি কখনোই শানের সামনে মাথা নিচু করে থাকে নি।যতোবার কথা হয়েছে ততোবারই পাখি চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে।এদিকে পাখি চাইলেও মাথা তুলে তাকাতে পারছে না।সে নিজেও বুঝতে পারছে না আজ এতো কিসের চক্ষুলজ্জা হচ্ছে!

“আমি কিছু খাবো না। ক্ষিদে নেই”,ফোনের স্ক্রীন স্ক্রল করতে করতেই বলে শান।পাখি লজ্জারাঙ্গা চোখে মাথাটা সামান্য তুলে শানের দিকে তাকায়।শান ফোন থেকে নজর সরিয়ে পাখির দিকে দেখতেই চট করে মাথাটা আগের মতো নিচু করে নেয় পাখি।এতে আরো বেশি বিরক্ত হয় শান।কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাখি বলে,”রাতের মেডিসিন নিতে হবে।মিস দেয়া যাবে না”
পাখির চিকিৎসকের মতো কথায় শান ভ্রু উচিয়ে ওর দিকে তাকায়।দূর্বল চিত্তে বলে,”মনে হচ্ছে ডাক্তার আমি না তুমিই!”
শানের কথায় কেমন অপমানিত বোধ হয় পাখির।একনজর তাকিয়ে বলে,”সেটা সন্দেহ তো আমারও।কারণ ডাক্তার হয়ে কিভাবে কেউ ঔষধে এতো হেলা করতে পারে!”
শান অবাক হয়ে যায় পাখির কথায়।কেমন গিন্নী গিন্নী ভাব!
মুচকি হেসে ওঠে শান।পাখি বুঝতে পেরেও সেদিকে খেয়াল করে না।তর্জনি আঙ্গুল উচিয়ে দরজা দেখিয়ে বলে,”তাড়াতাড়ি নিচে আসেন।খাবার ঠান্ডা হয়ে যায়।তারপর সেডিসিন নিয়ে তবেই এসে শুইবেন”
বলে দরজাটায় শব্দ করে হনহনিয়ে নিচে চলে যায় পাখি।

শান হাসিটাকে আরেকটু প্রশস্ত করে ধীরপায়ে বিছনা ছাড়ে।এরপর অসুস্থ্য শরীর নিয়ে নিচে নামে রাতের খাবারের জন্যে।

পাখি থমথমে মুখে প্লেটে ভাত বেড়ে শানের চেয়ারের দিকে ঠেলে দেয়।আর চারদিকে সুন্দর পরিপাটি করে কয়েকপদের খাবার রেখে রান্নাঘরে চলে যায়।শান পাখির কান্ড দেখে চলছে শুরুর থেকে।খারাপ লাগছে না তার;বেশ উপভোগ করছে সে।চেয়ার টেনে বসতে যাবে তখনি চোখ আটকে যায় টেবিলের উপর।হরেক রকমের খাবারের আইটেম করেছে পাখি।তবে সবগুলোই পুরোদমে দেশি খাবার।যাকে এক কথায় বাঙ্গালি খাবারও বলে।
লাল মরিচের আলু ভর্তা যেন লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খাবারের মালিকের দিকে।আরেক বাটিতে কাচা পেঁয়াজ দিয়ে টাকি মাছের ভর্তায় যেন জগতের সমস্ত লোভ ঢেলে দেয়া হয়েছে।এভাবে প্রত্যেকটা খাবার দেখে হেসে ফেলে শান।তবে বাহিরে সেটার রেশ আসে না।গালে লাল আভা বুঝা যাচ্ছে মাত্র।সবার শেষ চোখ গিয়ে আটকে যায় আরেকটা ছোট বাটিতে রাখা খাবারের উপর।বাটি হাতে নিয়ে শান বোঝার চেষ্টা করে এগুলো কি?কিছুক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর উপাদান গুলোর পরিচয় জানতে পারে সে।শুকনা মরিচ কাচা পেঁয়াজের মিক্স একটা ভর্তাটাইপ কিছু।এক আঙ্গুলে একটু মুখে দিয়ে শান চোখ বন্ধ করে ফেলে।এবার বুঝতে পারে এই ভর্তায় লেবুর রস আছে সাথে গুড় বা চিনি। বেশ মুখে লেগেছে খাবার টা।তড়িঘড়ি করে প্লেটে পুরোটা ঢেলে খাওয়া শুরু করে শান।দেখতে দেখতে তিন প্লেট ভাত মূহূর্তেই শেষ করে দেয়।তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে শান ভাবে,”এত্তোটা দিন এতো ভালো ভাবে খেলাম”
রান্নাঘরের দিকে চেয়ে গলাটা সামান্য উচিয়ে বলে, “থ্যাংক ইউ”
এরপর আবার সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে চলে যায় শান।

এদিকে খাওয়া শুরু থেকে শেষ অবধি পুরোটা সময় পাখি রান্নাঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে সবটা দেখে।নিজের মাঝে অজানা ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় পাখির।হাতে মরিচের ঝালটা তেমন আর জ্বলুনি লাগে না।ডান হাতটা উচিয়ে হেসে বলে,”তোর কাজ স্বার্থক”

🌸🌸

মধ্যরাতে পানির পিপাসায় ঘুম ভেঙ্গে যায় পাখির।ঘুমো ঘুমো চোখে সাইড টেবিল হাতরিয়ে ওয়াটার পট খোঁজে ।না পেয়ে বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে।এরপর জানালা ভেদ করে সড়কের ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলোয় ধীরপায়ে উঠে যায় সুইচ বোর্ডের কাছে।লাইট জ্বালিয়ে পট খুঁজতে কানে আসে কারো গোঙ্গানির চাপা শব্দ।পাখি বুঝতে পারে না কে এভাবে অসুস্থ্য মানুষের মতো গোঙ্গাচ্ছে।মূহূর্তে শানের কথা মনে পড়ে যায় পাখির।
“উনিই কি তবে গোঙ্গাচ্ছেন? জ্বর কি বেশি হলো তবে?”,ভাবতেই অজানা আশঙ্কা গ্রাস করে ফেলে পাখির তনু মন।বোতল রেখে দ্রুত দরজা খুলে শানের ঘরের উদ্দেশ্যে ছুটে চলে পাখি।দরজায় দু তিন বার নক করেও সাড়া মেলে না।কিন্তু ভেতর থেকে শানের গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে।ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায় পাখির।এরপর জোড়ে এক ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায়।”তারমানে দরজা খোলাই ছিলো!”
ভেবে ভিতরে ঢুকে যায় পাখি।

শানের মাথা থেকে পা অবধি ব্ল্যাঙ্কেট জড়ানো।তা দেখে পাখি দুটো শুকনো ঢোক গিলে কাপা কাপা হাতে ব্ল্যাঙ্কেটটা সরিয়ে দেয়।শানের মুখটা উন্মুক্ত হতেই চমকে যায় পাখি।জ্বরের কারণে মুখের শ্রী’ই যেন পাল্টে গেছে।মুখের প্রতিটা লোমকূপ স্পষ্ট হয়ে জানান দিচ্ছে কতোটা অসুস্থ্য শান।

পাখি দ্রুত থার্মোমিটার এনে মুখের কাছে ধরতেই চোখ মেলে তাকায় শান।চোখ দেখে আঁৎকে ওঠে পাখি।এরপর ইশারা করে মুখ খুলে থার্মোমিটার জিহ্বার নিচে দিতে।শান বাধ্য ছেলের মতো পাখির কথা অনুযায়ী মুখটা হা করে থার্মোমিটার মুখে নেয়।কিছুক্ষন পর পাখি চিন্তিত মুখে থার্মোমিটার বের করে দেখে ১০৪ ডিগ্রী জ্বরে শানের পুরো শরীর পুড়ে যাচ্ছে।উঠে দাঁড়াতেই জ্বরের ঘোরে পাখির হাত চেপে ধরে শান।বন্ধ চোখে হাতটা চেপে রেখেই শান বলে,”প্লিজ যেও না।”
“আপনি দু মিনিট শুয়ে থাকুন আমি আসছি”,বলেই পাখি শানের হাতের উপর আরেক হাত রেখে আশ্বস্ত করে।

এরপর দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বালতিতে করে এক বালতি পানি নিয়ে আসে। এরপর পানির পর পানি ঢালতে থাকে শানের মাথায়।কিছুক্ষন পর পর মাথায় জল পট্টি দেয়া তো আছেই।

“সারা শরীর টা মুছতে পারলে অনেকটা বেটার ফিল করতেন।এই যে শুনছেন!”,পাখি চোখেমুখে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলে।খুবই ধীরগতিতে শান চোখের পাতা খুলে পাখির দিকে একনজর তাকিয়ে পূনরায় চোখ বন্ধ করে ফেলে।পাখি মুখে বিরক্তির শব্দ করে উঠে চলে যায়।এরপর ঠান্ডা পানিতে তোয়ালে চুবিয়ে পানিটা নিঙড়িয়ে নেয়।এরপর কিভাবে গা টা মুছে দেবে ভাবতে থাকে পাখি।ভীষণ লজ্জা আর অঅস্বস্তিতে পরে যায় সে।এদিকে শানের অবস্থা খারাপ। এক পর্যায়ে তোয়ালে টা সংকোচে কাপাকাপা হাতে শানের গলার উপর রাখে।তোয়ালে রাখতেই একপলক তাকায় শান।আবার নিভে যায় চোখের পাতা।পাখি এবার অন্যদিকে তাকিয়ে গলা ঘাড় মুছিয়ে দেয়।

ঘন্টাখানিক পর পাখি বুঝতে পারে শানের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।পাখি এবার চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে আস্তে করে ডাকে, “শুনছেন, ঘুমিয়ে গেছেন!”
ঘুম জড়ানো কন্ঠে শান জবাব দেয়,”হুহহহ”
পাখি এবার নিশ্চিত হয় শান ঘুমিয়ে গেছে।

🌸🌸
শানের সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার।গরমের তাপে তাড়াতাড়ি ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে ধরফরিয়ে ওঠে শান।হাতের বাম পাশে রাখা ফোনটা হাতরিয়ে বুঝতে পারে ঘড়িতে সকাল ১০ টা বাজে।এতোক্ষন ঘুমালো সে ভাবতেও পারছে না।পুরো ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে দ্রুত উঠতেই পুরো শরীর সুস্থ লাগে তার।আড়মোড়া ভাঙ্গতেই খেয়াল হয় পাশে খাটের উপর একহাত রেখে তারউপর মাথা রেখে নিচু হয়ে মেঝেতে বসে কেউ ঘুমিয়ে আছে। চমকে ওঠে শান।পরোক্ষনে কাল রাতের কথা মনে পড়ে যায়।অবাকের চরম সীমা অতিক্রম করে শানের মন।অবাক হয়ে ভাবতে থাকে,”তারমানে সারারাত সে এভাবে বসে ছিলো!”

“পাখি,এই পাখি,হ্যালো পাখি”,শান পরপর কতোগুলো ডাক দেয়।তবুও সাড়া মেলে না পাখির।এবার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবে কিভাবে ডাকলে পাখি উঠবে।উপয়ান্তর না পেয়ে পাখির কাঁধে ডান হাত রেখে সামান্য ঝাঁকাতেই দড়বড় করে ওঠে পাখি।

“কে কে?”,হরবরিয়ে বলে ওঠে পাখি।
শান্তস্বরে শান জবাব দেয়,”আরে আমি”
“আপনি!জ্বর কমেছে?কখন উঠলেন আপনি?আমি মাত্রই তো ঘুমাইলাম!আপনি কখন উঠলেন?”,আতঙ্কিত কন্ঠে বলে পাখি।শান ফোনটা হাতে নিতে নিতে বলে,”এতো প্রশ্ন করলে উত্তর দিবো কোনটার?”
আবার স্বগতোক্তি করে বলে,”জ্বর কমে গেছে,আমি একটু আগেই উঠলাম।আর পুরোপুরি সুস্থ এখন।কিন্তু,কিন্তু তুমি এভাবে কেন?ঘুমাওনি সারা রাত?এখানেই ছিলা?”,শেষের কথাটা বেশ জিজ্ঞাসিত কন্ঠে বলে শান।

“আমি! মানে!আসলে!ঘুমিয়েছি।না না ঘুমাই নি।না মানে ঘুমিয়েছি কিন্তু…..”
“কি সব বলছো? আগে ভাবো কি বলবে।”,পাখির কথাকে থামিয়ে বলে শান।
“কিছু না”,বলেই দ্রুত শানের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।আর শান পাখির গমনের দিকে চেয়ে ভাবতে থাকে,”সবটাই কেমন লাগছে!আমি কি ওর খুব কাছাকাছি চলে আসছি!না না এটা আদৌ পসিবল না।আই’ম শান।যার লাইফে কোন নারীর স্থান নেই।

চলবে…..