আসক্তি২ পর্ব-১৪

0
2763

#আসক্তি২
পর্বঃ১৪
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

হাতের কব্জিসন্ধি চেপে ধরে শান।টেনে এনে সামনে দাঁড় করায়।মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরে সেও।
“হাউ ডেয়ার ইউ?”,রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁতে দাঁত চিপে বলে শান।অসহায় মুখ করে পাখি ছলছলে চোখে শানের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি তাকায়।তার চোখে চোখ রেখে শান দ্বিতীয় দফা চিল্লিয়ে বলে,”হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি?”
অন্তরাত্মা সমেত কেঁপে ওঠে পাখি।আরেকবার শানের দিকে তাকায়।পাখির চোখের ভাষা পড়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না সে কতোটা অন্ধকারে পরে আছে।কারণ সে জানেই না শান কেন তার সাথে পূর্বের ন্যায় বাজে ব্যবহার করছে।

কাপাকাপা গলায় পাখি মিনমিন করে বলে,”ককি হহয়েছে আপপনার?”
“সেটাও কি এখন তোমাকেই বলতে হবে,হুমম?”,একটু এগিয়ে বলে শান।চোখের মনি এদিক সেদিক ঘুরিয়ে পাখি বলে,”সেরকম টা নয়, আসলে যাওয়ার সময় তো…..”
“এটা আমার জীবন।আমি কখন কি মুডে থাকব সেটা আমি ডিসাইড করব নট ইউ, ওকে?”,হাতের কব্জিটা আরো জোড়ে চিপে ধরে বলে শান।ব্যথায় কুঁকড়ে আহ্ শব্দ করে পাখি হাতের দিকে তাকায়।ব্যথার চোটে দুফোটা চোখের জল পরে যায় শানের হাতের উপর।

পাখির পুরো শরীর কাপছে।হিম ঠান্ডা হয়ে গেছে গোটা দেহ।হাতের উপর দুফোটা জল গড়াতেই চট করে হাত ছেড়ে দেয় শান।নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রনের সর্বচ্চ চেষ্টা করছে সে।কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। পাখির থেকে দুহাত সরে গিয়ে প্যান্টের দুই পকেটে হাত রেখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।তৎক্ষণাৎ রিনির বলা কথা গুলো আর সন্ধ্যায় ঐ মুরুব্বীদের কথা গুলো যেন মগজে গিজগিজ করছে শানের।চোখ বন্ধ করলেই বারোংবার সে সব ঘটনাস্থল মনে পড়ছে তার।

হাতের কব্জিটা আরেকটা হাতে ডলতে ডলতে পাখি চোখের পানি ছেড়ে দেয়।আনমনে ভাবতে থাকে,”আগে তো বড় মা, বড় বাবা কতো অত্যাচার করত, কই এতো কষ্ট তো হতো না?আজ সামান্য কব্জি চেপে ধরাতে এতো কেন কষ্ট হচ্ছে আমার”
হাতটা উঠিয়ে দেখে লাল লাল রক্তের ছিটা গুলো মূহূর্তেই দানা বেঁধে গেছে।

শান তড়িৎগতিতে পিছনে ফিরে পাখির সামনে এসে দাঁড়ায়।তর্জনী আঙ্গুল উচিয়ে বলে,”তোমার জন্যে আমার লাইফে কোন রকম প্রবলেম আমি চাই না।আমার চরিত্রের উপর আঙ্গুল উঠানোর সাহস এই অত্র এলাকা কিংবা মেডিকেল কোত্থাও কারোর নেই।অথচ আজ তোমার জন্য…….”
আধাকথায় থেমে শান চোখ মুখ কুচকে বলে,”আউট..গেট আউট ফ্রম মাই হাউজ”
পাখি অবাক চোখে শানের দিকে তাকায়।শান একবার সে চোখে তাকাতেই জগতের সমস্ত অসহায়ত্ব খুঁজে পায়।নজর সরিয়ে শান বলে,” বাড়ি থেকে চলে যাও”
অনুভূতিহীন শান্ত চাহনীতে পাখি বলে,”আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই।এ শহর আমার অচেনা।শহরের মানুষগুলো বড্ডো বেশিই অচেনা”
শেষের কথাটা শানের কানে আসতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।যেন কথাটা কানে নয় বুকের বাঁ পাশের ঠিক যেখানে হার্ট বসানো সেখানেই পেরেক ঠুকে দিলো।মূহূর্তের মাঝে রাগটা যেন অভিমানে পরিনত হলো।মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করলো,”আমি বাস্তবতার শিকলে বাঁধা।নতুন করে কোন নারী মায়ায় আটাকাতে পারব না”
কিন্তু সেসব আর বলা হলো না।মনের কথা রাগে পরিনত করে শান জবাব দিলো,”কোথায় যাবে, কি করবে সেটা তোমার ব্যপার।শুধু এটুকু জানি আমার বাড়ি ছাড়ো রাইট নাউ”
পাখি স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে শানের ব্যবহার গুলো পরোখ করে চলছে।স্বাভাবিকভাবে শানের দিকে চেয়ে বলে,”আপনি বড্ডো বেশিই রং পাল্টাতে পারেন ডাক্তার সাহবে।গিরগিটিও এতো তাড়াতাড়ি রং পাল্টায় না”

পাখির বলা প্রতিটা কথাই আজ একটু বেশিই ঝাঁঝালো লাগছে।ভুল তো কিছু বলছে না।তবুও শানের বুকে বিঁধছে কথাগুলো।
“আমি কোনভাবেই কারোর উপর এতোটা দূর্বল হতে পারি না।নো, ইম্পসিবল!”,ভেবেই শান পাখির হাতটা পূনরায় ধরে ফেলে।এরপর সদর দরজা খুলে ঝটকা মেরে দরজার বাহিরে রাখে পাখিকে।বজ্রকন্ঠে বলে,”চলে যাও”
এরকম কিছু হবে পাখি স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি।মূহূর্তেই মনের মাঝে একরাশ ঘৃনা জন্মে যায়।
“ভালোবাসা! এসব কি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ?”,বিড়বিড় করে ভাবতেই চোখের সামনে শানের বাড়ির দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়।দরজার শব্দে চমকে ওঠে পাখি।চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুগুলোর শেষাংশ দুহাতের উল্টোপিঠে মুছে চারদিকে তাকায়।পুরো আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেঁয়ে আছে।মূহূর্তের মাঝেই বৃষ্টি নামবে হয়ত।এই সময় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে পাখি বুঝে উঠতে পারে না।এ শহর যে তার অচেনা।

“যেখানেই যাই, এখানে তো আর নয়’ই”,ভাবতে ভাবতে গেইটের কাছে চলে আসে পাখি।দারোয়ান সালাম গেইটের কাছে নেই।হয়ত দোকানে গেছে চা টা খেতে।ধীরপায়ে বাহিরে বেরিয়ে এসে রাস্তার একপাশে দাঁড়ায় পাখি।এ রাস্তাুয় বড় যান না চললেও প্রাইভেট কার চলে।সাথে পায়ে হেঁটে চলা মানুষের আনাগোনা থাকেই।।আবাসিক এলাকা বলে কথা।
সবাই এ পাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছে আর পাখির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।আকাশের অন্ধকারটা আরেকটু গাঢ় হতেই দমকা হাওয়া শুরু হয়ে যায়।সে হাওয়ার বেগ গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।শঙ্কা, চারিদিকে বিপদের শঙ্কা মনে হয় পাখির কাছে।কি করবে বুঝতে পারে না।

“ম্যাডাম, আপনি? এই সময় বাহিরে কেন?”,কারো ডাকে চমকে ফেরে পাখি।ততোক্ষনে একটু একটু বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।পাখি তাকিয়ে বুঝতে পারে ব্যক্তি টা রাফি।
পাখির জড়সড় অবস্থা দেখে রাফি পূনরায় বলে,”ম্যাডাম কি ব্যপার এই সময়ে এখানে কেন?একটু পরেই বৃষ্টি নামবে ম্যাডাম বাসায় চলুন”
রাফির কথায় পাখি অবাক হয়ে বলে,”আমার কোন বাড়ি নাই রাফি”
পাখির শুকনো কথায় রাফির বুঝতে অসুবিধা হয় না শানের সাথে পাখির কিছু হয়েছে।রাফি আমতা আমতা করে বলে,”তাহলে কোথায় যাবেন ম্যাডাম?”
“আমার একটা হেল্প করবে?”
“হ্যা ম্যাডাম বলুন”
“আমায় ইনায়াহ্’র প্রিন্সিপালের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে?আমি তো চিনি না এই শহর”,শেষের কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পাখি।
রাফি হরবরিয়ে জবাব দেয়,”আচ্ছা ম্যাডাম আপনি দাঁড়ান আমি রিকশা নিয়ে আসি”

অল্প কিছুক্ষন পর রাফি একটা রিকশা নিয়ে পাখির সামনে দাঁড়ায়।এরপর দুজনে উঠে বসে রাখিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।পুরো রাস্তায় পাখি একটা কথাও বলে নি।পুরোটা সময় রাস্তার প্রতিটা মানুষকে খেয়াল করেছে,গাছপালাকে দেখেছে,আর দেখেছে প্রানহীন ঐ প্রতিটা ইট পাথরের দালানকে।রাফির মনে অনেক প্রশ্ন কিন্তু বলার সাহস হচ্ছে না;পাখির অবস্থা দেখে।তাই চুপচাপ বসে থাকে।তবে পাখির প্রতি কেমন যেন আলাদা মায়া কাজ করে রাফির।বড় বোনের মতো মনে হয় তার।

একটা সময় রিকশা এসে থামে রাখিদের বিল্ডিং এর সামনে।পাখি মাথা উচিয়ে দেখে দশ তলার বিলাসবহুল বিল্ডিং এটা।রাখি ওর মাকে নিয়ে পাঁচ তলার ফ্লাটটায় থাকে।রাফি বলে, “আপনি যেতে পারবেন না?নাকি আমি দিয়ে আসব?”
স্মিত হেসে পাখি জবাব দেয়,”এতোটা করলে আমার জন্যে এটুকুও করো।ফ্ল্যাট পর্যন্ত দিয়ে আসো”
রাফি মুচকি হেসে বলে,”আচ্ছা”

কলিংবেল টিপে অপেক্ষা করে রাফি।পরপর দুবার বেল দেয়ার পর কেউ এসে দরজা খোলে।

“পাখি!তুই!এসময়!”,দরজা খুলে পাখিকে দেখে অবাক হয়ে যায় রাখি।রাখির কথার জবাবে সামান্য হেসে রাফিকে বলে,”এবার এসো।অনেক ধন্যবাদ রাফি।”
“কি যে বলেন ম্যাডাম”
“আপু বলো ম্যাডাম বলো না”,থমথমে স্বরে জবাব দেয় পাখি।চোখের কোণে জল চিকচিক করছে তার।
পাখি স্বগতোক্তি করে বলে,”একটা অনুরোধ”
“হ্যা ম্যা..না না আপু। হ্যা আপু বলেন!”
চোখেমুখে কাঠিন্যভাব এনে পাখি বলে,”কেউ যেন না জানে আমি এখানে আছি”
রাফি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।পাখি একবার রাখির দিকে চেয়ে বলে,”ভিতরে যাবো না?”
“আরে অবশ্যই।আয় আয়, ভিজে গেছিস তো একদম”

রাফিকে বিদায় জানিয়ে ভিতরে ঢোকে পাখি। এরপর একে একে সমস্ত ঘটনা রাখিকে বলে।কান্না করতে করতে হেচকি উঠে যায় পাখির।রাখি ওকে জড়িয়ে শ্বান্তনা দেবার চেষ্টা করে।অনুতপ্তচিত্তে বলে,”আমারই ভুল হয়েছে রে পাখি।আমি ভেবেছি ডাক্তার সাহেব তোকে ভালোবাসে।তাই ওভাবে….”
“না রে তোর কোন দোষ নাই।সব দোষ আমার এই কপালের”,ওড়নার আঁচলে চোখ মুছে বলে পাখি।
“আচ্ছা বাদ দে।তোর কোত্থাও যেতে হবে না।শালা থ্যাংকলেস পার্সন।ও জানে না আকাশ কতোটা খারাপ করেছে। এ অবস্থায় কি করে কেউ বাড়িত থেকে একজনকে তাড়িয়ে দেয়।ফালতু লোক কোথাকার”,রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে রাখি।
এরপর পাখির চোখের পানি মুছিয়ে বলে,”আ’ম শিওর ও তোকে ভালোবাসে।হয়ত নিজের ইগোর কাছে পরাজিত হতে চাচ্ছে না।দেখবি ও তোকে নিতে আসবে।আর সেদিন তুই না গিয়ে বুঝিয়ে দিবি কষ্ট কাকে বলে!”,

“আমার ওসব কিচ্ছু চাই না আর। রাতটা এখানে থেকে সকালে সিলেট চলে যাবো।আমার কাছে টাকা নেই আর শহরটাও অচেনা।স্কুলে জয়েন করার এখনো এক মাস হয় নি তবুও রিকোয়েস্ট করব আমায় বেতন থেকে কিছু টাকা দিতে। আমি বাড়ি চলে যাব”,গড়গড় করে কথাগুলো বলে থেমে যায় পাখি।
রাখি ঝনঝনে গলায় বলে,”যেন ডাক্তারই সব;আমরা কিছুই না?এ শহরে আমি আছি পাখি।ডোন্ট ওয়ারি!”
ঠোঁটের হাসিটা সামান্য এলিয়ে পাখি বলে,”বিষাক্ত লাগছে এই নগরী”
“তো সিলেটে গিয়ে কী বেঁচে থাকতে পারবি?”,তেড়ছাভাবে বলে রাখি।
পাখি হেয়ালিমাখা উত্তর দেয়,”শান্তিতে মরতে তো পারব!”

চলবে……