আসক্তি২ পর্ব-২৩

0
2672

#আসক্তি২
পর্বঃ২৩
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

মায়ের মতো অনেকেই হয়ত জীবনে থাকে, তবে মা কিন্তু একজনই হয়।তার তুলনা তিনি নিজেই।মাকে ছাড়া জীবন যে কতোটা কষ্টের তা কেবল মা হারা সন্তানরাই বুঝতে পারে।

আজ পাখির খুব করে মায়ের কথা মনে পড়ছে।মাকে হারিয়েছে অনেক বছর হলো।তবুও যেন মা’র স্মৃতিগুলো আজও জ্বলজ্বল করছে।জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ নিচে চেয়ে আছে পাখি।তাকিয়ে দেখছে জীবনের চলমান গতি।কোথাও কোনকিছু থেমে নেই। সকাল থেকেই মায়ের জন্য মনটা খুব খারাপ করেছে তার।
কোনকিছুই ভালো লাগছে না ।ইনায়াহ্’কে স্কুলের জন্যে রেডি করে দেয়।
ইনায়াহ্ প্রশ্ন ছোড়ে,”তুমি রেডি হবা না মুন সাইন?”
শুকনো হেসে পাখি বলে,”না বেবি,আজ তুমি রাফি চাচ্চুর সাথে যাও। কাল থেকে আমি যাব।”

ইনায়াহ ঠোঁট উল্টাতেই পাখি হরবরিয়ে বলে ওঠে,”এই না না, একদম কান্না কাটি চলবে না। আমার রিকোয়েস্ট এটা। তুমি কি মুন সাইনের রিকোয়েস্ট রাখবা না? বলো বেবি?”
শেষের কথাটা একটু করূন স্বরে বলে পাখি।
খিলখিলিয়ে উঠে ইনায়াহ্ বলে,”ওকে বাবা ওকে, আর কেঁদো না।আমি যাচ্ছি তো ”
এরপর বুকে জড়িয়ে একবার আদোর করে দেয় পাখি।

নাস্তার টেবিলে বসে শান ফোনে কিছু একটা দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে।পাখি ইনায়াহ্’কে সাথে নিয়ে নামতে নামতে শানের দিকে তাকায়।একবার সেদিকে চেয়ে শান আবার ফোনের দিকে তাকায়।পরোক্ষনে বুঝতে পারে পাখি নরমাল ড্রেসে রয়েছে।আবার তাকাতেই পাখির চোখে চোখ পড়ে।মুখটা খুব শুকনো দেখায় পাখির।আবার নরমাল ড্রেস তারমানে স্কুলেও যাবে না।ছোট ছোট চোখ করে বোঝার চেষ্টা করে শান।

পাখি শানের দিক থেকে অনুভূতিহীন চাহনীতে নজর সরিয়ে নেয়।শানের একটা চেয়ার পরের চেয়ারটা বের করে ইনায়াহ্’কে বসায়।প্লেট রেডি করে খাবার নেয়। এর মাঝে অন্যান্য দিনের মতো একটি বারও শানের দিকে তাকায় না পাখি।ব্যপার টা কেমন যেন হজম হচ্ছে না শানের।তবুও চুপচাপ নাস্তা সেরে নেয়।
রাহেলা এসে পাখির শুকনো মুখের দিকে চেয়ে বলে,”তুমি খাবে না মা?আর রেডি হও নি যে, আজ স্কুলে যাবে না?”
পাখি ঠোঁট সামান্য প্রসস্ত করে শান্ত স্বরে বলে,”আমার ক্ষিদে নেই চাচি।”
“আর আজ স্কুলেও যাব না”,ইনায়াহ’র মুখে খাবার টা তুলে দিতে দিতে বলে পাখি।
পাখির হাবভাব আজ শানের বড্ডো ব্যতিক্রমী লাগছে।সন্দিহান চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবে,”ব্যপার কি? আজ এতো শান্ত?স্কুলেও যাবে না, সকালেও খাবে না?একটি বার তাকালোও না!হাউ ইজ দিজ পসিবল ম্যান”
“আরেকটা পরোঠা দিবো বাবা”,পরোঠার প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে জানতে চায় রাহেলা বেগম।ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে শান জবাব দেয়,”না চাচি, আর খাবো না”
উঠে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়ায় শান।পাখির দিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে যেন দৈনিক দিনের মতো ওর দিকে একটু তাকায়।কিন্তু শানকে অবাক করে দিয়ে পাখি একটি বারও শানের দিকে তাকায় না।অগত্যা শান গলায় দুইবার “উহুম,উহুম”শব্দ করে
পাখিকে উদ্দেশ্য করে রাহেলাকে জোড়ে বলে,”আমি আসছি চাচি ”
তবুও পাখি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ইনায়াহ্’কে খাওয়ায়।এবার খানিকটা নয় পুরো অবাক হয় শান।সিঁড়িতে পা রেখে আবার পাখির দিকে তাকায় শান;ব্যর্থ হয় সে।চলে যায় নিজেরর ঘরের উদ্দেশ্যে।

🌸🌸
“ইনায়াহ্ স্কুলে গেছে, দেখিস একটু।আর আমি আজ যেতে পারছি না ”
“কেন কি হয়েছে বল?”
“আরে না তেমন কিছুই না। আজ যাচ্ছি না সেটাই জানানোর জন্যে ফোন করেছিলাম”

বলেই কল কেটে দেয় পাখি।রাখি বেশ বুঝতে পারছে পাখির মন খারাপ।তারও ব্যপারটা খুব খারাপ লাগছে।কিছুক্ষন পর ইনায়াহ্ স্কুলে চলে আসলে রাখি গিয়ে জানতে চায় পাখির খবর।
“তোমার মুন সাইনের কি হয়েছে বাবু?”
ইনায়াহ্ মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে জবাব দেয়,”জানি না।শুধু বলেছে আজ স্কুলে আসবে না।”
ভাবনায় পরে যায় রাখি।
“কি এমন কারণ যে ওর মন এতো খারাপ আজ!”

শান আজ কারণে অকারণে ফোন করছে বেশি।পাখির পার্সোনাল নম্বরে ফোন করাটা কেমন যেন ইগোতে লাগে।তাই ল্যান্ডফোনে ফোন করে।আর প্রত্যেকবারই রাহেলা ধরে।
“হ্যালো কে?”
“চাচি আমি”
ফোন কানে নিয়ে রাহেলা বলে,”হ্যা বাবা বলো”
বিব্রতবোধ করে শান বলে,”ইনায়াহ্ ফেরে নি এখনো?কি করছে ও?”
“এ নিয়ে তিনবার ফোন করলে, আর একই কথা বলছো?তোমার কি হয়েছে বাবা?”,হরবরিয়ে বলে রাহেলা
“না ঠিকাছে সব, রাখছি চাচি”,বলেই ফোন কল কেটে দেয় শান।

🌸🌸
বিকেল বেলা সোফায় বসে ডোরিমন দেখছে ইনায়াহ্।রাহেলা বেগমও বসে আছে পাশেই।দরজায় কারো ডাকে দুজনেই সেদিকে তাকায়।রাখি এসেছে।
“পাখি আছে?কোথায় ও?”
সহাস্যে রাহেলা বেগম তাকে ভিতরে এনে বসতে দিয়ে বলে,”হ্যা মা পাখি তো আছে। মনে হয় ঘুমাচ্ছে।দাঁড়াও আমি ডেকে আনি”
রাহেলা চলে যায় পাখিকে ডাকতে।এদিকে রাখি ইনায়াহ্’র সাথে কথা বলে।

কিছুক্ষন পরে পাখি ঘুমু ঘুমু চোখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।মুচকি হেসে রাখির সাথে কথা বলে।
“এই সময় হঠাৎ?”
রাখি ভ্রু নাচিয়ে জবাব দেয়,”হুহহ হুহহ,আসলাম।একটা সারপ্রাইজ আছে”
অবাক হয়ে পাখি প্রশ্ন করে, “সারপ্রাইজ!আমার জন্যে! কি সেটা?”
“আছে ম্যাম আছে।আজ আপনার মন খারাপ আমি বুঝেছি।তাই মন ভালো করে দেবো”
পাখি সন্দিহান চোখে পাশ কাটিয়ে সোফায় বসতে বসতে বলে,”কোন মন টন খারাপ না।এমনিই আজ ভালো লাগছে না কিছুই”
পাখিকে টানতে টানতে রাখি বলে,”চল তোর রুমে চল ”
“তোর ব্যাগে এগুলো কি?এতো উচু কেন ব্যাগ? “,জিজ্ঞাসু হয়ে প্রশ্ন করে পাখি।
রাখি মুচকি হেসে বলে,”উপরে চল। গেলেই বুঝতে পারবি”
পাখি ওকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়।ইনায়াহ্ও ওদের পিছু পিছু চলে যায়।আর রাহেলা রাতের খাবারের আয়োজনে রান্নাঘরে চলে যায়।

ব্যাগ থেকে একে একে রাখি খাবারের জিনিস গুলো বের করে।পাখি অবাক হয়ে বলে,”এসব কেন?”
“পার্টি হবে ম্যাম পার্টি”,ঠোঁটে ডেভিল হাসি রেখে বলে রাখি।ইনায়াহ্’র চোখেমুখে খুশি ঝলমলিয়ে ওঠে।দুহাতে তালি দিয়ে ওঠে,”ওয়াও আমরা পার্টি করব আজ!”,
“ইনায়াহ্ তুমি একটু বাহিরে যাও বেবি।দেখো তো দিদা কি করছে”,ইনায়াহ্’কে আদর করে বাহিরে যেতে বলে রাখি।এরপর লম্বা একটা বোতল বের করে পাখিকে বলে,”তাড়াতাড়ি এটা অন্য কোথাও রাখ”
চোখ ছানাবড়া পাখির। বোতল দেখে বোঝার বাকি নেই এটা কি হতে পারে!শুকনো ঢোক গিলে বলে,”এসব কি রে?তোর মাথা ঠিকাছে?ডাক্তার সাহেব জানলে ঠিক রাখবে না আমায়।তুই এসব নিয়ে যা। আমি পারব না এসব রাখতে”,
হন্তদন্ত হয়ে যায় পাখি।কলিজা শুকিয়ে আসছে তার।
রাখব বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলে,”তোর দ্বারা কিচ্ছু সম্ভব না।তোর ডাক্তার সাহেব জানতেও পারবে না।আর এটা একটু খেলেই দুনিয়া ভুলে যাবি।টেষ্ট করে দেখ”
পাখি অবাক চোখে বলে,”কক্ষনোই না।আমি এসব কোন দিনও খাই নি।এসব ভালো জিনিস না রাখি”
“রাখ তোর ভালো মন্দ।দেখি “,বলেই বিছানার মাথার কাছে ফাঁকা যায়গায় বোতল টা রেখে দেয় রাখি।

🌸🌸
একে একে রাখি বাকি খাবারের জিনিস গুলো প্লেটে সার্ভ করে নেয়।এরপর রাহেলা বেগমকেও টেনে এনে একসাথে সবাই পার্টি করে।একটু পর রাখি ফোনে ফুল ভলিউমে গান ছাড়ে।ইনায়াহ্ গানের তালে তালে নেচে ওঠে।সবাই হাতে তালি দিয়ে হেসে দেয়।

এক পর্যায়ে রাহেলা বলে,”আমি যাই রান্নাঘরে;রাতে খেতে হবে না!তোমরা বরং মজা করো”
রাহেলা চলে যাবার পর রাখি অন্য গান ছাড়ে ফোনে।ঘর থেকে হাসতে হাসতে বের হয় রাহেলা।সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেক আগে।সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাড়িতে প্রবেশরত শানকে দেখতে পায় রাহেলা।দুটো ব্যাগ হাতে দ্রুত বাড়িতে ঢোকে শান।হাতের ব্যাগ দুটো রাহেলার হাতে দিয়ে বলে,”ফ্রিজে রাখো চাচি। আইসক্রিম আর চকোলেটস আছে।গলে যাবে”

আজ যে পাখির মন খারাপ ছিলো তা বোঝার অপেক্ষা রাখে না।তাই অনেক ভেবে কতোগুলো আইসক্রিম আর চকোলেটস নিয়ে আসে শান।রাহেলা হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,”আচ্ছা রেখে দিচ্ছি আমি।তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও”

সিঁড়িতে পা রাখতে শানের কানে ভেসে আসে
Lagawelu jab lipistic , hilela aara distric
Tu, lagaweli jab lipistic , hilela aara distric
Zilla top lalelu
Kamariya
kare lapa lap, Lollipop lagelu

শান চোখ মুখ কুচকে অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, “বাড়িতে এরকম একটা গান কে বাজাচ্ছে!”
দ্রুত পা চালিয়ে উপরে চলে যেতেই ইনায়াহ্’র ঘরের কাছে থেমে যায়।কারণ গান টা এ ঘর থেকেই আসছে।ভেড়ানো দরজাটা সামান্য ঠেলে চোখ কপালে উঠে যায় শানের।
গানটার সাথে তিনজনের উরাধুরা নাচ বাড়িময় কাঁপিয়ে তুলছে যেন।অবাক হয়ে যায় শান।সে যে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের নাচ দেখছে সেদিকে কোন খেয়ালই নেই কারোরই।কিছুক্ষন ওভাবে দাঁড়ানোর পর শান চুপচাপ বুকের কাছে দুইহাত গুঁজে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।সরু চোখে তাকিয়ে আছে পাখির দিকে।নাচ দেখে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে শানের।আনমনে ভাবে,”কেমন প্রাণবন্ত তুমি।এটাই মানায় তোমার সাথে”

শানের ভাবনার মাঝেই শানের দিকে চোখ পড়ে রাখির।সন্তর্পনে মিউজিক টা অফ করে দেয়। আড় চোখে পাখির দিকে তাকিয়ে ইশারায় নাচ থামাতে বলে।পাখিও ওর চোখ অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই শানকে দেখতে পায়।লজ্জায় পর পর কতোগুলো পলক ফেলে পাখি।
“ইনায়াহ্ চলো আআমরা নিচচে যযাই”,জড়ানো গলায় বলে রাখি। এরপর পা টিপে টিপে ইনায়াহ্’র হাত ধরে শান’কে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
“আআমিও…..যাবো..”,পাখির কথা টা বলার আগেই ওরা চলে যায়।

শান ধীরপায়ে ভিতরে ঢোকে।পাখি বার বার শানের দিকে তাকাচ্ছে আর ওড়নার আঁচলে মুচরাচ্ছে।
শান একদম পাখির সামনে এসে দাঁড়ায়;কিন্তু কোন কথা বলে না।পাখি মাথা তুলে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,”ঐ রাখিই গান টা…… ”
শান ঘরের চারদিক দেখে বুঝতে পারে একটু আগে এ ঘরে সুনামি হয়েছে।পাখির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মুখ কুচকে বলে, “এতো লো স্টান্ডার্ডের গান চালাচ্ছিলে!আর কি বিশ্রী নাচ!”
পাখি এবার মাথা তুলে মুখ বাঁকিয়ে বলে,”অনেক জনপ্রিয় গান এটা….”
“জনপ্রিয় মাই ফুট”,কটাক্ষ করে বলে শান।
পাখি ওড়নার আঁচল ছেড়ে আঙ্গুল উচিয়ে বলে,”তাও ভালো আপনার মতো ক্ষ্যাতমার্কা না।রসকষহীন চুপসে যাওয়া বেলুন”
“কি বললে?”
“কোন কথা দ্বিতীয়বার বলি না আমি”,ভাব নিয়ে বলে পাখি মুখ ফিরিয়ে নেয়।
শান ওর দিকে চেয়ে বলে,”যেমন মানুষ, তেমন গান। হ্যাহহ।অবশ্য এসব ছাড়া আর কি গান পছন্দ হতে পারে!”
বলেই শান উল্টোপথে চলে যেতেই পাখি চেতে গিয়ে প্রশ্ন করে,”কি বললেন আপনি?আমি লো স্টান্ডার্ড!নিজে কি? নিজে তো হিটলারের বাপ ”
“হোয়াটেভার “,উল্টো মুখেই বলে শান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

শানের এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটা জ্বালা ধরিয়ে দেয় পাখির গায়ে।কটাক্ষ করে বলা কথাগুলোও রাগ উঠাচ্ছে পাখির।মনে পড়ে রাখির বলা কথাটা,”এটা খেলে দুনিয়া ভুলে যাবি”
যেই ভাবা সেই কাজ।বিছানার ওপাশে রাখা বোতলটা বের করে মুখটা খুলে নেয় পাখি।রাগে মুখের সামনে ধরলেও মুখের ভিতরে ঢালার সাহস হয় না। কেমন যেন উটকো একটা গন্ধ।সাহস যুগিয়ে নাক চেপে ধরে একটু খেতেই মুখটা কেমন ঝলসে যায় যেন।গলা দিয়ে নামছে যেন জানান দিয়ে নামছে।আরেকবার সাহস করে আরেকটু খায়।এবার আগের মতো খারাপ লাগছে না, বেটার লাগছে।এরপর বোতলে মুখ লাগিয়ে কয়েক মূহূর্তের ব্যবধানে পুরো বোতল ফাঁকা করে পাখি।লম্বা একটা ঢেঁকুর তোলে।

এর মাঝে রাখি চলে আসে ইনায়াহ্ সহ। পাখি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রাখির দিকে।
“ডাক্তার সাহেব খুব বকেছে কি?”,প্রশ্ন করে রাখি।মৃদু হেসে পাখি জবাব দেয়,”আরে না।বকবে কেন?আমি পাখি।আমায় বকে কেউই পার পায় না বুঝলি?”
পাখির কন্ঠে একটা কম্পন অনুভব করে রাখি।সেটা অগ্রাহ্য করে বলে,”আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম রে”
স্বগতোক্তি করে বলে,”নিচে বসে থাকতে থাকতে ইনায়াহ্’র ঘুম পাচ্ছিলো। আর আমাকেও বাড়ি পৌঁছাতে হবে।মা ফোন করেছিলো।তাই তোর সাথে দেখা করতে এলাম”
নেশাক্ত চোখে পাখি বলে,”রাত টা থেকে যা”
“না রে, মা একায়।মা হার্টের পেশেন্ট।ভয় করে খুব”,অপারগতা দেখিয়ে বলে রাখি।
“তাহলে খেয়ে তবেই যা”,হেসে হেসে বলে পাখি।
পাখির আচরন কেমন যেন অগোছালো মনে হয় রাখির।ঘড়ি দেখে নিতেই চমকে ওঠে রাখি।
“নয় টা বেজে গেছে! আমায় এবার যেতে হবে”বলে বেরিয়ে পরে রাখি।

ফিরে এসে বলে,”বাই দ্য ওয়ে তুই ঠিক আছিস তো?”
“একদম।ঝাক্কাস”,বলে পাখি আশ্বস্ত করে রাখিকে।
রাখি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসে নিচে।এদিকে ইনায়াহ্ ঘুমের ঘোরে যেপাশে পেরেছে সে পাশেই ঘুমিয়ে পরেছে।পাখি এগিয়ে গিয়ে ওকে ঠিক করে শোয়ায় আর হেসে ওঠে।খানিক পরে মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে থাকে।সবকিছু কেমন যেন ফুরফুরে লাগছে তার কাছে।চুলের খোপাটা খুলে দেয় আবার বেঁধে নেয়।আবার খুলে আবার বাঁধে।এভাবে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকে দরজায় ঠেস দিয়ে।

🌸🌸
রাতে খাওয়ার পর শান উপরে উঠে আসে নিজের ঘরের দিকে।পাখির ওমন অগোছালো ভাব দেখে ভ্রু কুচকে যায় তার।পরোক্ষনে কুঞ্চিত ভ্রুজোড়া সোজা করে নিজের ঘরে হাঁটা দেয় শান।পাখি ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি বজায় রেখে শানের পিছু পিছু চলে।পিছনে কারোর আগমন বুঝতে পেরে শান ঘরের মেঝেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়।ঘুরে তাকিয়ে ভ্রু উচিয়ে বলে,”তুমি! এখানে কেন?”
পাখি কোন জবাব না দিয়ে হাসি হাসি মুখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শানের দিকে।

“আবার কি শুরু করলে?এবার এটা বলো না যে বউ বলে তুমি এ ঘরে ঘুমাবে?”,সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে শান।পাখি ধীরপায়ে পিছনে ঘুরতেই শান হাফ ছাড়ে।শান ধরে নেয় পাখি চলে গেছে।বিছানার দিকে এগোতেই দরজা লক করার শব্দে চমকে যায়। পিছনে তাকিয়ে দেখে পাখি দরজাটা লক করে দুহাত পিছনে দরজায় ঠেস মেরে এলোমেলো চুলে দাঁড়িয়ে আছে।
“কি করছো এসব?পাগল হয়ে গেছো?দরজা আটকালে কেন?”,দাঁতে দাঁত পিষে বলে শান।
পাখি এলোমেলো পায়ে দুচোখ কচলে শানের দিকে আগাতে আগাতে বলে,”আপনি এমন কেন ?কেন এমন করেন আমার সাথে?আমি তো আপনাকে অনেক ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব।”
পাখির গলার জড়ানো, কম্পিত স্বরে শান অবাক হয়ে যায়।টলমল করা শরীর দেখে শান নিশ্চিত হয় পাখি উল্টা পাল্টা কিছু গিলেছে।

অবাক হয়ে ভাবতে থাকে,”কি করে সম্ভব সেটা?কিভাবে খাবে সে এসব?”
ইতোমধ্যে পাখি শানের বুকের কাছে চলে আসে।মাথাটা বুকে ঠেকিয়ে ন্যাকামির স্বরে বলে,”আমায় একটু ভালোবাসলে কি হয়?আমি তো…..”
বলতেই শান পাখির দুই গালে হাত রেখে মুখটা উচু করে ধরে।
“ছিহহহ আপনি কতো খারাপ। এখন সুযোগ নিচ্ছেন না?দেবো না আমি”,কটকটে গলায় বলে পাখি দুই পা সরে আসে।পরতে গেলে ধরে ফেলে শান।পূনরায় নিজের কাছে এনে মুখটা তুলে ধরে এবার পাখি আর কিছু বলতে পারে না।চোখ দুটো যেন ক্লান্ত হয়ে আসে।শান মুখটা আরেকটু কাছে এনে গন্ধ শুঁকে চোখ মুখ কুচকে অপর পাশে তাকায়।ঘুমু ঘুমু পাখির দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,”এসব কি পাখি?এসব কি খেয়েছো তুমি?”

“ঐ রাখি টা এনেছিলো।আমাদের দুজনের খাওয়ার জন্যে।আর আমি সবটা একাই খেয়েছি হেহেহে”,পাগলের মতো হাসতে থাকে পাখি।

মাথা চেপে ধরে আবার বলে,”আমি খাইতে চাই নি।ও বলেছিলো’এটা খেলে নাকি দুনিয়া ভুলে যাওয়া যায়’কিন্তু আপনার অপমান গুলো আমি ভুলতে চাই।তাই সবটা খেয়ে নিয়েছি।”
শান মলিন মুখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।খোলা চুলে, এলোমেলো চাহনীতে পাখিকে অন্যরকম লাগছে আজ।দূরন্ত অনুভূতি গুলো ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। হার্টের গতি বেগতিক বুঝে পাখিকে দরজার দিকে ঘুরিয়ে বলে,”ঘঘরে যাও।ঘুমাও। কাকাল সকালে এ নিয়ে ককথা হচ্ছে”
“না, আমি এখানে ঘুমাব।বিয়ের পর তো বর বউ একসাথে ঘুমায়”,ঠোঁট কাটা হয়ে একরোখা জবাব দেয় পাখি।একটু নড়তেই পরে যায় মেঝেতে।শান হকচকিয়ে নিচু হয়ে বসে হাত ধরে টেনে তোলে পাখিকে।
“এ কোন মুশকিলে পরে গেলাম।পুরো নেশা তো মাথায় চড়ে বসেছে এর।রাখি”,ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে শানের।পাখির মলিন মুখটার দিকে চেয়ে থাকে শান।

মাথা তুলে পাখি বলে,”আজ সারাদিন মায়ের কথা বড্ডো মনে পড়ছিলো।আমার এ জগৎে আপন বলতে কেউই নাই।যে করেই হোক বিয়েটা তো হলো, সেই বর নামোক আপনি টাও আমার আপন না।খালি দূর দূর করেন।আমার কষ্টটা আমি কাউকেই বলতে পারি না।কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।আপনার জীবনে কোন মেয়ে কি করেছে আমি জানি না।আমি কিচ্ছু করব না, প্রমিজ”,গড়গড় করে কথা গুলো বলতে বলতেই চোখের কোণ বেয়ে জল ছেড়ে দেয় পাখি।শান আলতো হাতে সে জল মুছে দেয়।অভিমানে পাখি হাত সরিয়ে বলে,”লাগবে না।”
মুচকি হেসে শান এগিয়ে পাখির কপালে একটা গাঢ় চুমু দিয়ে নেয়।

কপালটা ঘষতে ঘষতে পাখি বলে,”চাই না আমার ”
“এখন যাও ঘুমাও।পরে কথা বলব আমরা “,পাখির গালে হাত রেখে বলে শান।
পাখি ঝনঝনে গলায় বলে, “না আমি এখন থেকে এখানেই ঘুমাব”
“কেমন করে বোঝাই ;ভুল হয়ে যাবে।একে তো না চাইতেও বিয়ে হয়ে গেছে। সে হিসেবে তোমায় কাছে নেয়ার পূর্ণ রাইট আমার আছে, তার উপর তোমায় ভালোবাসি;সে দূর্বলতাও রয়েছে।নিজেকে বোঝানোটা দায় হয়ে পরবে পাখি “,আনমনে ভেবে শান বলে, “আমার ঘরে ভুত আছে পাখি।আর ইনায়াহ্ও ও ঘরে একা।ভয় পাবে তো”
পাখি ভাবুকের মতো কিছু একটা ভেবে বলে, “না আমি এখানেই ঘুমাব, ব্যাস”
ভীষণ গ্যারাকলে পরে যায় শান।কোন উপায় না পেয়ে বলে,”যাও বিছানায় গিয়ে ঘুমাও”

পাখি মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, আপনি কোলে করে নিয়ে যান”
“হোয়াট?পাগল হয়েছ?পারব না আমি। ”
“তাহলে আমিও উঠছি না”
মুখে বিরক্তির ছাপ এনে শান অগত্যা ওকে কোলে তুলে নেয়।বিছানায় শোয়াতেই টি-শার্টের কলার চেপে ধরে পাখি।ও চোখে সম্মোহনের আকুতি বুঝতে পেরে শান দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়।পাখি রেগে গিয়ে আরেকটু টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে।এবার শানকে অবাক করে দিয়ে শানের অধরে জোড়পূর্বক নিজের অধর জোড়া মিলিয়ে নেয়।

চলবে……..