#আসক্তি২
পর্বঃ৪৭(বোনাস)
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
“তুই সব জায়গায় খুঁজেছিস তো রাফি!”, হতাশ কন্ঠে প্রশ্ন ছোড়ে শর্মিলা।
রাফির এক কথায় জবাব,” হ্যা বড় মা”
বিয়ে বাড়িতে হুলুস্থুল কান্ড ঘটে যাবে যদি জানাজানি হয় ডক্টরের বউ লাপাত্তা।শর্মিলার পুরো শরীর দরদর করে ঘামতে থাকে।পাখির নম্বরে পর পর কতো গুলো কল করে। ভাঙ্গা চূর্ণবিচূর্ণ ফোনে কখনোই কল ঢুকবে না;স্বাভাবিক।অজানা আতঙ্কে শ্বাস ভারী হয়ে আসে শর্মিলার।একে একে খান সাহেব,শানের কাকা,কাকি,আব্দুল্লাহ্, রাহেলা,সবার কানে কথাটা চলে যায়।লোক চোক্ষুর আড়ালে অনেক খোঁজাখুঁজি চলছে।কিছুক্ষন আগেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়।এখন খাওয়াদাওয়ার পালা।এই সময়ে এমন কিছু জানাজানি হলে মানসম্মানের রফাদফা হবে।
এককান দুইকান করতেই কথাটা পৌঁছে রাখি-রনির কানে।বেশ স্তম্ভিত হয় রনি। পাখির কথা ভাবতেই বুকের ভিতর কষ্টে মোচড় দিয়ে ওঠে রাখির।একদিক আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন চলছে, আর অন্যদিকে গড়ে উঠছে চাপা দূঃচিন্তার বিশাল প্রাচীর।
_____________________
“এই মেয়েটাকে দেখেছেন কোথাও,?”
ফোন এগিয়ে পাখির ছবি দেখিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের দারোয়ানকে জিজ্ঞেসা করে রনি।
দারোয়ান বেশ কিছুক্ষন পাখির অপ্রস্তুত ছবিটার দিকে চেয়ে বলে,”এই ম্যাডাম কি আজ জাম রঙ্গের শাড়ি পড়েছিলো?”
রনি চিন্তায় পরে যায়।কারণ আজ একবারও পাখির সাথে তার সাক্ষাৎ হয় নি।
পাশ থেকে রাফি হড়বড়িয়ে বলে,”হ্যা হ্যা,জাম রঙ্গের মতো একটা শাড়ি পড়ছিলো ভাবি”
রনি ভ্রু কুচকে রাফিকে বলে,”তুই শিওর!”
“হ্যা ভাইয়া, আমি দেখেছি; নিজের চোখে”
“ওকে এবার বলুন, ইনাকে কখন দেখেছেন?”দারোয়ানের দিকে ফিরে উৎকন্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করে রনি।
” স্যার বিকেলের একদম শেষের দিকে।তখন কেবল সন্ধ্যা হবে হবে।তখন দেখছি খুব চিন্তিত চোখেমুখে গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়েছিলো।পরে একটা গাড়ি করে এইইই পাশে চলে গেছে ”
হাত দিয়ে রাস্তার বাম দিকে ইশারা করে বুঝিয়ে দেয় দারোয়ান ছেলেটা।
বিয়ের বরই যখন হন্তদন্ত হয়ে এদিকে ওদিক ছোটাছুটি করে তখন সবার নজর নিশ্চই তার উপরই পরবে।রনির বেলায়ও তার ব্যতিক্রম নয়।সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু এখন রনি।রোশনি বাহিরে এসে আলো ঝলমলে মাঠটায় দাঁড়িয়ে একবার সবার দিকে তাকায় তারপর গেইটের কাছে দাঁড়ানো নিজের ছেলের কাছে চলে যায়।
“এই কাজটা কি বাড়ির অন্য কেউ করতে পারত না রনি?সবাই তোমার দিকে কেমন করে দেখছে, দেখো!বাড়িতে আরো তো লোক আছে নাকি”, চাপাস্বরে কপোট রাগ দেখিয়ে রনির কাছ ঘেঁষে কথাটা বলে রোশনি।
” লাইক সিরিয়াসলি মম!ডু ইউ হ্যাভ এ্যানি আইডয়া, হু ইজ পাখি?”,ভ্রকুটি করে রোশনির দিকে ফিরে অবাক হয়ে বলে রনি।
মুখের কথা মুখেই মিলিয়ে যায় রোশনির।
রনি শ্বান্তস্বরে বলে,”লিসেন মা।পাখি হচ্ছে সেই মেয়ে যাকে আমার ভাই ভালোবাসে। যার মাঝে আমার প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের আত্মা লুকিয়ে আছে।মা আমরা কেউ জানি না পাখি কোথায় আছে!”
হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইয়ার মিটিং ইতোমধ্যে শেষ হওয়ার পথে।কি জবাব দেবে তোমরা?ও আসলে?…পাখির কিছু হলে ভাইয়াকে বাঁচানো সম্ভব নয় মা।তুমি জানো না, আমি জানি।ভাইয়ার কাছে পাখি কি জিনিস…সামন থেকে সরো মা।আই ডোন্ট কেয়ার মা, কে আমার সম্পর্কে কি বললো!”
“রাফি, গাড়ি বের কর”, বলেই রাফিকে তাড়া দেয় দ্রুত গাড়ি বের করতে।
রোশনি ছেলের দিকে একবার তো মেহমানদের কুনজরের দিকে একবার তাকাচ্ছে।
🌸🌸
” কি করব খান সাহেব?বউ মা কোথায় গেলো?মানলাম শরীর খারাপ তাই বলে ফোনটা সুইচ অফ রাখবে, বলেন তো!মেয়েটা ঠিক আছে তো!আমার বাবুকে আমি কি জবাব দেবো।মিটিং এ যাওয়ার আগে পই পই করে বলে গেছে ‘মা তোমার বউ মা’র শরীর খারাপ।ওকে দেখে রেখো’
আর আমি এইটুকু কাজই পারলাম না করতে”,প্রলাপ বকতে বকতে হাতে কপাল ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বসে পরে শর্মিলা।
রাহেলা একমনে শুধু আল্লাহ্’কে ডেকে চলেছে।রানু রাহেলাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।দূঃচিন্তার ছাপ শানের কাকার চোখে মুখে।আব্দুল্লাহ’র চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি।হাজার হোক মেয়েটার প্রতি আলাদা একটা টান পরে গেছে গত মাস গুলো থেকে।
খান সাহেব শর্মিলাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয় না।দূঃচিন্তা যে তার হচ্ছে না এমনটা নয়।তবে তিনি প্রকাশ করছেন না।
“মুন সাইন কোথায় দিদা?”, বলতে বলতেই ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলে ইনায়াহ্। শর্মিলার কোলে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে ফেলে মেয়েটা।খুব কষ্টে ইনায়াহ্’কে চুপ করিয়ে মিছে সান্ত্বনা দেয় শর্মিলা।কারণ যে করেই হোক তীরে এসে তরী ডোবানো যাবে না।মেহনমানদের কানে কিছুতেই খবর টা পোঁছানো যাবে না।
🌸🌸
” বড় মা”,কম্পিত জড়িয়ে আসা কন্ঠে রাফির ডাকে পিছনে ফেরে শর্মিলা।
“কি রে, কি হলো?আমার বউ মা কোথায়?”,হন্তদন্ত হয়ে প্রশ্ন করে শর্মিলা।
রনি ধপ করে পিছনে রাখা চেয়ারটায় বসে পরে।দুইহাতে মুখ চেপে ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকে।
” কিছু বলছিস না কেন? বাড়িতে গেছে?রেস্ট নিচ্ছে তাই না?বললি না ফোনটা বন্ধ কেন?”,পরপর কতোগুলো প্রশ্ন করে শর্মিলা।
“ভাবি বাড়িতে নেই বড় মা।”, বলতে বলতে কেঁপে ওঠে রাফির স্বর।
” নেই মানে কি?ঘরে খুজেছিস?”
“ভাবির সাইড ব্যাগটা সিঁড়ির কাছ পরে ছিলো।ফোনটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে সিঁড়ির নিচে পরেছিলো।আর…… ”
গা শিউরে ওঠে শর্মিলার।’আর’বলা কথাটা শোনার জন্যে কান যেন অধীর আগ্রহী কিন্তু মন? মন কেন জানে না বলছে কথাটা না শোনাই ভালো।নিজেকে কোনমতে নিয়ন্ত্রণে এনে বুকে সাহস সঞ্চার করে প্রশ্ন করে,”আর?”
“ভাবির শাড়িটাও সিঁড়ির একদম নিচে পরেছিলো”, চারদিকে তাকিয়ে মিনমিন করে কথাটা বলে মাথা নিচু করে নেয় রাফি।
শর্মিলা মানতে পারে না রাফির কথা।নিজের শরীরের ভারটা খুব ভারী লাগছে তার কাছে।নিজেকে কোথাও ছেড়ে দিতে ইচ্ছ করছে যেন।টাল টা সামলাতে না পেরে দুই কদম পিছিয়ে যায় শর্মিলা।খান সাহেব কাঁধে হাত রেখে চেয়ারে বসায়।রাহেলা দৌঁড়ে এসে একগ্লাস পানি এগিয়ে দেয়।রোশনি শর্মিলার কাছাকাছি এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” এমন করো না ভাবি।সবকিছু ভালো হবে।মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু হতেই পারে না।”
শান্ত স্থীর চাহনীতে রোশনির দিকে তাকায় শর্মিলা।
“আরো একটা কথা বড় মা “, মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে রাফি।
প্রশ্নাতুর চোখে তাকায় শর্মিলা।রাফি সেদিকে দেখে বলে,” ভাবির ঘরের অনেক ড্রয়ারের জিনিস পাতি এলোমেলো ছিলো”
__________
“কি ব্যপার মা, তোমরা সবাই এখানে?মেহমানদের দেখাশুনা করছে কে?”
ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে প্রশ্ন করে শান।প্রতিটা উৎসুক চোখ ঘুরে তাকায় শানের দিকে।সবার মুখেই ভয়ের প্রবল বলিরেখা স্পষ্ট যেন।রাফি সামনে থেকে সরে যায়।
“কি ব্যপার তোমরা এতো কি নিয়ে চিন্তা করছো? আম্মা?কি হয়েছে আম্মা?”, বলতে বলতে শর্মিলার দিকে এগিয়ে আসে শান।
নিজের দিকে আগত শানের প্রতিটা পদধ্বনি যেন শর্মিলার বুকে একেকটা করে তীর ছুড়ে মারছিলো।
” উফ একগ্লাস ঠান্ডা পানি আনতো রানু”,রানুকে উদ্দেশ্য করে বলতেই শান আবার বলে, “তুই থাক। ওয়েটারকে ডাকছি”
বলেই ওয়েটারকে ইশারা করে শান।ঠান্ডা কিছুর অর্ডার করে।
সবাই শানের উৎফুল্লুতা দেখে ভিতরে ভিতরে গুমসে মরছে যেন।
“মিটিং টা সুন্দর হয়েছে আম্মা।গ্রেট প্রোজেক্ট সাকসেস আমার “, বলতেই সাফল্যের খুশি ফুটে ওঠে শানের চোখে মুখে।
শর্মিলা জোড়পূর্বক হাসি ঠোঁটে এলিয়ে বলে,” তোর ককলিগরা কি এসেছে বাবু?”
“হ্যা মা, ওদের খেতে বসিয়ে আমি এখানে চলে আসলাম”
“কিরে নতুন বর তোর বউ কই?”
বলতে বলতেই নিজের শার্টের কলারটা টেনে শান নাক কুচকে ফেলে।
“ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ হবে এসে এখানে ফ্রেশ হবো তাই পাখিকে…… বাই দ্য ওয়ে পাখি কই?”
চারদিকে তাকিয়ে সন্দিহান চোখে সকলের উদ্দেশ্য প্রশ্ন করে শান।
সবাই যেন এই সময়টারই অপেক্ষা করছিলো মনে মনে।
“আম্মা পাখি কই?ওর শরীর কি খুব অসুস্থ হয়েছে?”, বলতে বলতে সবার দিকে আবার তাকায়।সবাই একে অন্যের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।
শান বিরক্ত হয়ে বলে,” আরে তোমাদের মুখ চাওয়াচাওয়ি পরে করো আগে বলো পাখি কোথায়?তোমাদের এই ন্যাকামি গুলো বড্ডো বিরক্ত লাগে আমার”
শর্মিলা কিছু বলতে উদ্যত হতেই শান রাফির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোকে বলেছিলাম পাখির শরীর খারাপ হলে ওকে ওর ঘরটায় নিয়ে যেতে।ওখানেই আছে তাই না?আচ্ছা আমি দেখছি”
বলে অপরদিকে পা বাড়াতেই ইনায়াহ্ এসে পা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। ঠোঁট টিপে কান্না নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করে;কিন্তু পারে না।শান ভ্রুকুচকে ইনায়াহ্’কে কোলে তুলে নেয়।ইনায়াহ্ আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না।শানের গলায় মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে ফেলে।
“এই মাম্মাম কি হয়েছে তোমার? এই দেখো, এদিকে দেখো না মা?সান সাইনকে বলো কি হয়েছে?”, বলতে বলতে ইনায়াহ্’কে পাশের একটা চেয়ারে বসায়।ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে চোখের পানি মুছে ইনায়াহ্ বলে,”মুন সাইনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সান সাইন।আমার মুন সাইনকে এনে দাও তুমি”
বলতে বলতে আবারও কেঁদে ফেলে ইনায়াহ্।
শানের পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় মূহূর্তেই।বুকের ভিতর হাহাকার শুরু হয়ে যায় খানিক পরেই।ইনায়াহ্’র দুই গালে হাত রেখে বলে,”আচ্ছা আগে বলো, তোমার ফোন কোথায়?”
ইনায়াহ্ ভ্রু কুচকে বলে,”আমার ফোন তো বাড়িতে সান সাইন।কেন?”
“কিছুক্ষন আগে আআমায় ফোফোন দাওনি তুমি?”, কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে শান।
” নাতো। আমরা তো সেই দুপুরে চলে এসেছি এখানে।আর ফোন তো আমার ঘরেই”,ঠোঁট উল্টে বলে ইনায়াহ্।
মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ফেলে শর্মিলা।
শান উঠে দাঁড়ায় ইনায়াহ্’র থেকে।বিপদ যে ঘটেছে তা ভেবেই পুরো শরীর কাঁপছে শানের।শুকনো ঠোঁটটা জিহ্বার আলোতো ছোঁয়ায় ভিজিয়ে কপালটা স্লাইড করতে থাকে।ফট করে ফোনটা হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করে শান।প্রথম আননোন নম্বর থেকে কল আসে সন্ধ্যে ৭.০০ টায়।পরে ইনায়াহ্’র নম্বর থেকে কল আসে রাত ৭.৩০ টার দিকে।মিটিং শেষ হয় ৮.৩০ এ। আর এখন বাজে ৯.১৫.
২.১৫ মিনিট সময়ের হিসেব মিলাতেই শানের মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে।
“শানবাবা”, বলে এগিয়ে এসে পিছন থেকে ধরে নেয় আব্দুল্লাহ্।চোখ পিটপিট করে শান পিছনে ফিরে আব্দুল্লাহ্’কে হাত ইশারা করে বোঝায়,” আমি ঠিক আছি”
পুরো দুনিয়া আঁধারে ছেঁয়ে যায় যেন।চোখ বন্ধ করতেই হাস্যোজ্জ্বল পাখির মুখটা ভেসে ওঠে মানসপটে।
“ভাইয়া, যতোদূর বুঝতে পেরেছি বাড়ি থেকে কিছু একটা হয়েছে”,শানের দিকে এগিয়ে এসে কথাটা বলে রনি।
“পাখি কি তোমাদের সাথে এসেছিলো আম্মা?”, কন্ঠের স্বর একদম খাঁদে ফেলে শ্বান্ত ভঙ্গিত শর্মিলাকে প্রশ্ন করে শান।
মাথা উপর নিচ করে শর্মিলা হ্যা সূচক জবাব দেয়।
” তাহলে বাড়ি গেলো কেন?”,স্বাভাবিকভাবেই আবারও প্রশ্ন করে শান
শানের প্রশ্নের জবাবে কেউ কিছু বলতে পারে না।কারণ আদৌ কেউ জানেও না পাখি বাড়ি কেন গিয়েছিলো।
“বলতে পারলে নাতো আম্মা?কারণ তোমরা ওর খেয়ালই রাখো নি।বিয়ে নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়েছিলে যে ওকে একটু দেখে রাখার কথাই তোমাদের কারোর মাথায় ছিলো না।আম্মা তোমারে তো বলে গেলাম ও অসুস্থ আম্মা।তাও একটু খেয়াল রাখলে না আম্মা”, অসহায় চোখে করূনস্বরে প্রশ্ন করে শান।
শর্মিলা কিছুই বলতে পারে না।
বাড়িতে পৌঁছানোর পর দেখা সমস্ত কথাগুলো রনি এগিয়ে এসে শানকে জানায়।সেসব শুনে চোখ মুখের রং পাল্টে যায় শানের।নজর যেন আজ চঞ্চল।দ্রুত গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই রাফি বলে,” ভাইয়া আমি যাই”
শান থমকে গিয়ে পিছনে ফিরে কটাক্ষের স্বরে বলে,”সবাই অনেক বড় উপকার করেছো আমার।আর কিছু করতে হবে না ভাই।তোমরা বিয়ে এনজয় করো।বাকিটা আমি একা করতে পারব”
আর এক মূহূর্ত না দাঁড়িয়ে শান চলে যায় বাড়ির উদ্দেশ্যে।
__________
এতোটুকু রাস্তা অথচ গাড়ি যেন চলছেই না শানের। আশপাশের গাড়ি দেখে মনে হয় সবার গাড়ি দ্রুত ছুটছে শুধু তার টা ব্যতিত। গাড়ির স্পিড আরো বেশি করে বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে একধ্যানে ছুটে চলে।পাখির বিপদের কথা ভাবতেই পারছে না শান।নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে তার।রাগে ক্ষোভে চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে অজান্তেই।
গাড়িটা গেইটের ভিতর ঢুকাতে ঢুকাতে দারোয়ানের দিকে তাকাতেই ভ্রুকুচকে শান ভাবতে থাকে,”কোন বিপদ যদি বাড়িতেই ঘটবে তাহলে দারোয়ান আমায় ফোন করলো না কেন।ঐ আননোন নম্বর টা কি দারোয়ানের? ”
ভাবতেই গাড়িতে ব্রেক কষে শান।হাত ইশারা করে দারোয়ানকে কাছে ডাকে।গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে গা ভিজে যাওয়ায় ছাতা সমেত গাড়ির গ্লাসের দিকে এগিয়ে আসে সালাম।
জড়িয়ে আসা কন্ঠে শান বলে,”সালাম ভাই বাড়িতে কি কেউ এসেছিলো?”
“নাতো ভাইজান।কেউ তো আহে নাই। ক্যান?”
“না কিছু না, তুমি যাও ”
কথা শেষ করে শান পূনরায় গাড়ি চালিয়ে সদর দরজার একদম সামনে চলে আসে।দ্রুত পা নেমে দেয় গাড়ির নিচে।পা চালিয়ে সদর দরজা অবধি গেলেও ভিতরে ঢোকার সাহস টা কুলাতে পারে না শান।
কেমন যেন নিজেকে নিথর মনে হতে থাকে।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই সিগারেটের উদ্ভট গন্ধে চোখ মুখ কুচকে নেয় শান।চোখ খুলেই সোফার উপর রাখা জাম রঙ্গের শাড়িটা নজরে পরে তার।যেটার কথাই রনি বলছিলো।পা যেন চলছেই না। টলমলে পায়ে এগিয়ে শাড়িটা হাতে তুলে নেয়।সেন্টার টেবিলে রাখা পাখির ফোনের ভাঙ্গা অংশ গুলো হাতে ছুঁয়ে দিতেই গা কেঁপে ওঠে শানের।পাশে রাখা পাখির সাইড ব্যাগটায় নজর পরে শানের।বেশ উুচু হয়ে আছে সেটা।হাতে নিয়ে ব্যগের চেইন খুলে দেখে নিজের একটা পাঞ্জাবির সেট।কলিজা কেঁপে ওঠে শানের।বুঝতে বাকি থাকে না বাড়ি কেন ফিরেছিলো পাখি।
চোখ মুখ বন্ধ করে নিজের আবেগানুভূতি গুলো সংবরনের চেষ্টা করে।এরপর দৌঁড়ে উঠে নিজের ঘরে যেতেই চোখে পরে সিঁড়ির নিচে পরে থাকা তালা চাবিটার দিকে।এবার শান নিশ্চিত হয় পাখির বাড়িতে ফেরার কারণ বুঝতে পেরে।দ্রুত চলে যায় ঘরে।বিছানার এক কোণে পাখির পরিহিত ব্লাউজ পেটিকোট টা কুচকানো অবস্থায় দেখতে পায় সে।বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। বিছানায় ধপ করে বসে দুহাতে মুখ চেপে ঘন ঘন শ্বাস নেয় শান।হাতদুটো পিছনে ঠেকিয়ে কাবার্ডের দিকে নজর ফেলে দেখে কাপড় চোপড় সব এলোমেলো।সবগুলো ড্রয়ার খোলা।জিনিসপাতি ছড়ানো ছিটানো।ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে চার্জিং এ একটা ফোন।ভ্রু কুচকে সেদিকে উঠে যায় শান।ফোনটা নেড়েচেড়ে দেখে তারই অব্যহৃত পুরোনো ফোনটা।
অবাক হয়ে ফোনটা খোলে শান।ডায়ালে নিজের নম্বর দেখে কুঞ্চিত ভ্রোজোড়া মূহূর্তেই সোজা হয়ে যায়।শান বুঝতে পারে আননোন নম্বর টা তারই অব্যবহৃত সিমের।
বেশ ভাবনায় পরে যায় শান।ঘরে পুরোনো ফোন চার্জিং এ, পাখির শাড়ি একখানে, ব্লাউজ পেটিকোট অন্যখানে,কাবার্ড অগোছালো।
কোনকিছুই ঠাওর করতে পারছে না সে।মাথায় যন্ত্রনা করছে সবকিছু।কপালের উপরের রগগুলো দপদপ করে উঠছে থেকে থেকে।
শান ঘরের ওয়াশরুম বেলকোনি সবখানে খুঁজে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসতেই নজর পরে ইনায়াহ্’র ঘরের ভিতরে।বিছানার চাদর টা কুঁচকানো;অগোছালো। খাটের এক কোনার দিকে মেঝেতে পরে রয়েছে পাখির গায়ের ওড়না।শান দ্রুত এগিয়ে সেটা হাতে উঠিয়ে নেয়।হাজারও ভয় গ্রাস করে মূহূর্তেই।ঘরের চারিদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে ক্ষীনস্বরে ডেকে ওঠে,”,পাখি,পাখি”
কোন সাড়া নেই।পিছনে ফিরে বাহিরে চলে আসে।
চোখ ফেটে জল গড়াতে চাইছে শানের।পায়ের গতিবেগ শূন্যের কাছাকাছি।তবুও মনের জোড়ে সবকয়টা ঘর খুঁজে দেখে শান।কোথাও পায় না পাখিকে।ব্যর্থ হয়ে রিক্ত হাতে ড্রয়িং রুমে ফিরে আসে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে পাগলের মতো আচরন করতে থাকে।এরপর জোড়ে চিৎকার করে বলে,”পাখি”
শব্দটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে শানের কাছেই।কান্নায় ভেঙ্গে পরে শান।কিছুক্ষন পর দুহাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে সামনে তাকাতেই চোখ পরে ডায়নিং টেবিলের কাছে মেঝেতে লাল চিকচিক করা রক্তের ফোটা গুলোর দিকে।লাইটের আলোর প্রতিফলনে সেসব আরো চিকচিক করছে যেন।শান দৌঁড়ে ছুটে যায় সেদিকে।রক্ত গুলোর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পরে সে।বাঁ হাতের আঙ্গুলে তুলে চোখের সামনে নিয়ে আসে।বেশ ঠান্ডা সেগুলো।
সামনে তাকাতেই আরো কয়েক ফোটা রক্ত দেখতে পায় শান।নিজেকে আর নিজের মাঝে খুঁজে পায় না সে।ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে । খুব ধীর পায়ে এগিয়ে যেতেই দেখে রান্নাঘরের মেঝেতে রক্তের ছড়াছড়ি।যেন রক্তের বন্যা বয়ে গেছে একটু আগে।নিজেকে অসাড় লাগে শানের।পাখির কথা ভেবেই দম বন্ধ হয়ে আসে যেন।রক্তের ক্ষীন প্রবাহের আগমনের উৎস খুঁজতেই রান্নাঘরের আরো ভিতরে যায় শান।বাঁ হাতে চোখ মুখ মুছে কিচেন ডেস্কের নিচে চোখ পরে যায়।ফোটা ফোটা রক্ত সেখান থেকেই গড়িয়ে পরছে।
শান এবার ছোট বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।তার সাহস হয় না ডেস্ক টা খোলার।এই মূহূর্তে নিজেকে বড্ডো অসহায় লাগে যেন।সত্যিই সাহস জোগানোর জন্যে কাউকে লাগত এখন।কান্না থামিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ডেস্কের ছিটকিনিটা খুলতেই গড়িয়ে পরে স্বর্ণের চিকোন চারটা চুড়ি সমেত পাখির বাঁ হাতটা।খুব ভালোবেসে গড়িয়ে দিয়েছিলো শান।
এবার আর বুঝতে বাকি থাকেনা তার জন্যে কি অপেক্ষা করছে।কোথা থেকে যেন এক আকাশ পরিমান সাহস এসে জমা হয় শানের মনে।রক্ত মাখানো মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ডেস্কের ভিতর তাকাতেই পাখির রক্তে এবড়োখেবড়ো মুখটা চোখে পরে শানের।চিৎকার করে ওঠে ।কাল বিলম্ব না করে খুব সাবধানে বের করে আনে পাখিকে।
কোলে তুলতেই বুঝতে পারে রক্তের ধারার প্রধান উৎস।ভিতর টা যেন দুমড়েমুচড়ে যায় মূহূর্তেই। সেদিক থেকে নজর সরিয়ে পাখির রক্তাক্ত দেহটা কোলে তুলে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসে শান।রক্তটা এখনো অনেক গরম দেখে শানের বোঝার বাকি থাকে না কিছুক্ষন পূর্বেই দূর্ঘটনা ঘটে গেছে।
কালো চুলের গোছটা রক্তে লাল হয়ে গেছে একদম।টুপ টুপ করে আগা দিয়ে রক্ত পড়ছে।বুকের কাছের জামার সাদা রং রক্তে লাল রঙ্গে পরিনত হয়েছে।কোমড় থেকে পায়ের পাতা পুরোটাই লাল রক্তে রঙ্গিন আজ। পাখিকে বুকের মাঝে চেপে ধরে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে শান।
লম্বায় দুটো শ্বাস টেনে একটা হেঁচকি তুলে পিটপিটিয়ে খোলে পাখি।চোখের পাতা দুটো খুলতেও কষ্ট হচ্ছে যেন নিদারুন।পুরো পাতা রক্তে জবজবে হয়ে গেছে।শান চকিতে নিচে তাকিয়ে দ্রুত হাত দিয়ে মুছে দেয় সদ্য জমাট বাঁধতে শুরু করা রক্তের ফোটাগুলো।
“পাখি, এই পাখি।জানপাখি আমার… এইতো আমি জান। চোখ খোলো জান”, কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে চলে শান।
আহত চোখ দুটো খুলে শানের দিকে তাকায় পাখি।শানের চোখের নোনাজল এসে গালে পড়তেই চোখ বুজে নেয় সে।শান অনবরত কেঁদেই চলেছে।
পরোক্ষনে চোখ খুলে খতো বিক্ষত ডান হাত টা জোড় করে উচিয়ে শানের গাল স্পর্শ করার চেষ্টা করে পাখি।রক্তে জড়ানো চোখ টেনে টেনে খুলে অস্পষ্ট স্বরে বলে,” বড্ডো দেরি করে এলে”
হাতটা ধপ করে পরে যায় নিচে।পরপর দুটো হেচকি তুলে চোখ বন্ধ করে নেয় পাখি।পাশেই কোথাও বিকট শব্দে বাজ পরার আওয়াজ হয়।মূহূর্তেই থেমে যায় বৃষ্টির গতি।
যেন সে তার কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পাদন করে ধরনী থেকে বিদায় নিলো।
চলবে…..