#আসক্তি
পর্বঃ৪৩
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
“এই যে ম্যাম, আপনার বাবার আর শান স্যারের ছবি।রাশেদ যখন আমার ছবিগুলো তুলেছিলো তখন পিছন টেবিলে তাঁদের ছবি গুলোও ওঠে তবে ব্লার হয়ে আসে আর কি।পরে যখন আমি ছবিগুলো দেখি তখন আর ক্রোপ করার ইচ্ছে হয় নি;রেখে দিয়েছিলাম”-ইকরা বলতেই বলতেই নিজের ফোনটা পাখির দিকে বাড়িয়ে দেয়।
পাখি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে ছবি গুলো একের পর এক সুইপ করে দেখতে থাকে।চোখের দুফোটা জল নিকাবের কাপড়েই লুকিয়ে যায়।বাঁ হাতে মুখটা চিপে কান্না সংবরণের বৃথা চেষ্টা করে।
(কিছুক্ষন আগে)
“পাখি একটু তাড়াতাড়ি করো না। আমার আজ ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ আছে তো।”-শান পাখিকে তাড়া দিয়ে নিজে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।পাখি কচ্ছোপের গতিতে বোরখা পরে নিকাব টা বেঁধে নেয়।শান বের হয়ে এসেও দেখে পাখি এখনো ড্রেসিং টেবিলের সামনে।শান যে ওর দিকে বিরক্তি নিয়ে চেয়ে আছে তা আয়না দিয়ে একবার দেখে আবার নিজের কাজে মন দেয়।কাজ শেষে আস্তে করে বলে,”হুমম রেডি”
শান নিজেকে রেডি করে নাস্তা শেষ করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়।শান পাখিকে নার্স ইকরার কাছে নিয়ে এসে বলে,”ইকরা ম্যামের একবার চেকাপ করিয়ে নিয়ে এসো। আমি কেবিনে আছি”
পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”কাজ শেষ হলে আমার কেবিনে চলে এসো কেমন!”
মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় পাখি।
“কেমন আছেন ম্যাম?”-জানতে চায় ইকরা।
“ভালো আছি ইকরা, তুমি কেমন আছো?”
“জ্বি ম্যাম অনেক ভালো আছি।আপনার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে আরো বেশি ভালো আছি”
পাখি অবাক হয়ে বলে,”কি করে জানলে?”
“সে কি ম্যাম, স্যার কিছু বলে নি আপনাকে?”-
পাখি আমতা আমতা করে জবাব দেয়, “না ততো,কি ব্যপারে!”
“স্যার না বরাবরই এমন একটু গুমোট স্বভাবের।আসলে হয়েছে কি সেদিন হঠাৎ করে স্যার অনেক গুলো মিষ্টি নিয়ে মেডিকেলে ঢুকলো।আমরা সবাই তো অবাক। স্যার একে একে সবাই কে মিষ্টি খাওয়ালো।পরে জানতে চাইলে বলেছিলো আপনি মা হতে চলেছেন।বিশ্বাস করবেন না ম্যাম স্যারের চোখে কি পরিমাণ খুশি দেখেছিলাম।আমি ভাবতেও পারি নি একজন ছেলে মানুষ বাচ্চার কথা শুনে এতো খুশি হতে পারে।”-ইকরা আর পাখি হসপিটালের করিডোরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ইকরা কথা গুলো বলে।পাখি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না শান এতো খুশি হয়েছিলো।
একটু ভাবনার ভঙ্গি করে ইকরা আবার বলে,”সেদিন মেবি স্যার আপনার বাড়ি থেকে এসেছিলো।যতোদূর স্যার বলেছিলো সেদিন আপনার বাবার দোয়া মাহফিল ছিলো’
বলতে বলতে ইকরার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে।ততোক্ষনে তারা পৌঁছে যায় তাদের গন্তব্যে।ইকরা সেই নার্স কে বুঝিয়ে বলে ম্যামের ভালো ভাবে চেকাপ করতে।চেকাপ শেষে তারা পূনারায় হাঁটা ধরে।
ইকরা বিমর্ষ চিত্তে আবার বলে,”সত্যিই বাবা হারানো যে কতোটা কষ্টের এটা যাদের বাবা নেই তারাই বলতে পারবে।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইকরা।পাখি শুধু নীরব শ্রোতার ন্যায় শুনে যায়।
পাখি অস্ফুট স্বরে বলে, “তোমার বাবা….”
“নেই ম্যাম, অনেক আগেই গত হয়েছেন”-মুখটা মলিন করে ইকরা জবাব দেয়।
ইকরা আবার বলতে শুরু করে,”তবে কি জানেন ম্যাম, শান স্যারের মতো কেউ একজন জীবনে থাকলে কোন কষ্টকেই আর কষ্ট মনে হয় না।উনি খুব ভালো মানুষ।আপনাকে খুব ভালোবাসেন ম্যাডাম”
“তাই?খুব ভালো মানুষ!”
ইকরা থমকে যায়।হাঁটা থামিয়ে বলে, “এভাবে বলছেন কেন ম্যাডাম?কোন সমস্যা?”
কথা শেষে ঠোঁটে হাসি প্রসস্ত করে ইকরা।
“আচ্ছা ইকরা, আমার জানা মতে তোমার স্যার নামকরা ডাক্তার তবে আমার বাবাকে কেন বাঁচাতে পারলো না ? কারন,কারন তিনি ইচ্ছে করেই আমার বাবাকে পৃথিবী থেকে সরিয়েছেন।”-দাঁতে দাঁত চিপে বলছিলো পাখি।
ইকরা যেন আকাশ থেকে পরার মতো অবস্থা।সে ভাবতেও পারছে না পাখি শানের ব্যপারে এরকম মনোভাব পোষন করে।অবাক হয়ে জিজ্ঞেসা করে, “ম্যাডাম আপনি কিসব বলছেন?”
ইকরার কথায় পাখি মুখ ঘুরিয়ে রাগে হাসফাস করতে থাকে।
“ম্যাম এদিকে আসুন”-বলে ইকরা পাখির হাত টেনে নিয়ে ছাদে চলে যায়।বসার মতো দুটো বেঞ্চ পাতা, সেখানে বসায়।
“আমি নিজেই অপারেশন রুমে ছিলাম ম্যাম। সাথে আরো দুজন নার্স আর দুজন জুনিয়র ডাক্তার ছিলেন।আমরা সবাই দেখেছি কিভাবে স্যার কষ্ট পাচ্ছিলেন।শেষ মূহূর্তে যখন আপনার বাবা চলে যান তখনো স্যার চেষ্টার কোনই ত্রুটি করে নি ম্যাম।আমরা কখনো কোন সার্জারিতে স্যারের ওমন স্তব্ধতা দেখিনি”-এরপর নার্স ইকরা অপারেশন রুমের সেদিনের সমস্ত অভিজ্ঞতা পাখিকে জানায়।
পাখির অস্থিরতা বেড়ে যায়।এক টানে নিকাবটা খুলে লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়া শুরু করে।চারিদিকে পাগলের মতো দেখতে থাকে।
“ইকরা, একটু পানি এনে দেবে”
“হ্যা ম্যাডাম এক্ষুনি নিয়ে আসছি।আপনি বসুন”-বলেই এক দৌড়ে নিচে আসে ইকরা।পানির বোতলটা হাতে নিয়ে আবার ছুটে যায় ছাদের দিকে।বোতলটা ছোঁ মেরে নিয়ে পাখি ঢকঢক করে পানি খায়।নিজেকে একটু ধাতস্ত করে কপালের, নাকের ডগার, ঠোঁটের উপরের ঘাম গুলো রুমালে মুছে নেয়।
“স্যারের জন্যে আপনার মনের বিরূপ ধারনা দেখে আমি সত্যিই হতাশ ম্যাডাম।ভাবতেও পারি নি স্যারের। মতো একজন মানুষ আজ তার মিসেসের কাছে অপরাধী।কিছু কথা বলি ম্যাডাম।যদিও আগেই বলা উচিত ছিলো আমার।সময়ের অভাবে আপনার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।
একদিন আমি আমার বয়ফ্রেন্ড রাশেদ সহ মেডিকেল মোড়ের জিহা রেস্টুরেন্টে যাই।আমরা আমাদের বিয়ের ব্যপারে কথা বলতেই সেদিন দেখা করি।কিছুক্ষন পর শান স্যার এসে আমাদের সামনের টেবিলটায় বসে।আমি বিপরীত মুখে বসে ছিলাম বলে স্যার আমায় চিনতে পারে নি।আর আমিও রাশেদ ছিলো বলে লজ্জায় স্যারের সাথে আর কথা বলিনি।
রাশেদ আমায় ইশারা করে স্যারকে দেখায়।আমি কাঁধটা হালকা বাঁকিয়ে দেখি একজন মেয়ে আমার পিছনের চেয়ারটায় বসা স্যারের মুখোমুখি।রাশেদ আমায় বলে,”তোমার স্যার।সাথে তার ওয়াইফ নাকি”
আমি স্পষ্টই জানিয়ে দিলাম এটা স্যারের ওয়াইফ নয়।স্যারের ওয়াইফ এভাবে কখনো আসবেন না।দ্বিধা আমার মনেও চলছিলো মেয়েটা কে?,কারণ আমার পিছনে বসায় মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছিলো না।”
এটুকু বলেই পাখির দিকে তাকালো ইকরা।পাখির অস্থিরতা কমে গেছে, শুষ্ক ঠোঁট দুটো জিহ্বায় ভিজিয়ে বলে, “বাকিটা আমি জানি ইকরা।বাদ দাও ”
ইকরা অবাক হয়ে যায়।অস্ফুট স্বরে বলে,”আপনি জানেন!”
“হুমম”
“কিন্তু ম্যাম স্যার যে আপনার বাবাকে মানা করলো যাতে আপনাকে কিছু না বলে”
“মানে?”
“আমি বলছি ম্যাম।”-বলেই ইকরা আবার বলতে শুরু করে।
“এরপর মেয়েটার ফোনে একটা কল আসে মেয়েটা উঠে যায়।তখন আমি আস্তে করে দেখে নিই মেয়েটাকে।মেয়েটা ছিলো ডাক্তার নীরা।আমিও চুপচাপ বোঝার চেষ্টা করেছিলাম ব্যপারটা কতোদূর!
নীরার সাথে স্যার কিছু দরকারি কথা বলছিলেন।আমি কান পেতে শুনে ফেলি সবটা।আমি আবার কান পাতলা স্বভাবের কিনা!।আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়।দুনিয়ার সব থেকে খারাপ মানুষ মনে হয় স্যারকে।আমি রাগে উঠে দাঁড়াতেই স্যারের সামনের টেবিল থেকে একজন ভদ্রলোক উঠে স্যারের কলার চিপে ধরে।রাশেদ আমার হাতটা টেবিলে চেপে ধরে ঐদিকে ইশারা করে।এরপর যা দেখলাম ম্যাডাম আমি সবটার জন্যে মোটেও তৈরী ছিলাম না।”
পাখি অবাক বিষ্ময়ে ইকরার একের পর এক সমস্ত কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো।
“ভদ্রলোক স্যারের কলার চিপে সজোড়ে থাপ্পোর বসিয়ে দেয়।দু গালে থাপ্পর এর বুক বরারবর একটা ঘুষি দিতেই আরেকজন ভদ্রলোক এসে তাকে আটকে দেয়।উনি স্যারকে মারছিলেন আর কিছু কথা বলছিলেন। তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় নি উনি স্যারের শ্বশুর আই মিন আপনার বাবা।ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তেড়ে আসা ভদ্রলোক বুক চেপে ঘন ঘন শ্বাস নেয়া শুরু করে।ডাক্তার নীরা তখন আবল তাবল অনেক কিছু বলে ঐ লোককে।ইতোমধ্যে চারদিকে ভীর পরে যায়।আমি রাশেদ সহ সবটাই দেখছিলাম পাশে দাঁড়িয়ে।লোক সমাগম বেশি হওয়ায় স্যার চারিদিকে তাকিয়েও আমায় বুঝতে পারে নি।
ভদ্রলোকের অবস্থা বেগতিক দেখে স্যার নিজের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে ওয়েটার কে দ্রুত পানি আনতে বলে।ওখানে উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টে চেয়ে ছিলো স্যারের দিকে।এরপর ডাক্তার নীরার ফোনে আরেকটা কল আসে।নীরা অন্যদিকে চলে যায়।তখন স্যার আপনার বাবাকে যা বললো তা শুনে নিজেই নিজের মাথা ফাটাতে মন চাইছিলো ঐ মূহুর্তে।
নীরা চলে আসার পর স্যার ডক্টর নীরাকে চলে যেতে বলে।আর পরে কথা বলবে বলে জানায়।এরপর আপনার বাবাকে চেয়ারে বসিয়ে স্যার আমার পিছনের চেয়ারটায় বসে।ততোক্ষনে লোক সমাগম কমে গেছে।
এরপর আপনার বাবাকে স্যার ফোনে রেকর্ড হওয়া একটু আগের ঘটনা গুলো শোনায় আর নীরার ব্যপারে সমস্ত কথা বলে।নীরার সব বাজে কাজের প্রমানের জন্যেই সেদিন স্যার নীরার সাথে দেখা করেছে সেটাও বলেছে। ডাক্তার নীরা আপনার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো তার প্রমানস্বরূপ রেকর্ড টা জরুরী ছিলো।
পুরো ঘটনা টা আমি পিছনে বসে নীরবে প্রত্যক্ষ করে গেছি ম্যাম।আর স্যারের মতো মানুষের জন্যে প্রান ভরে দোয়া করেছিলাম।আপনার বাবা অনেক খুশি হয়েছিলো সেদিন।বার বার ক্ষমা চাইছিলো স্যারের থেকে।স্যারের হাত ধরেও ক্ষমা চাইছিলো আর পাশে ঐ ভদ্রলোক সবটা দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন, ভাইজান আপনি সত্যি কপাল করে জামাই পেয়েছেন।মনে হয় আপনার চাচা ছিলো”
পাখি হতভম্বের ন্যায় বসে সামনে তাকিয়ে বলে,”ফুপা”
“হতে পারে ম্যাম।এরপর পরিবেশ পরিস্থিতি শান্ত হলে আমি আর রাশেদ নিজেদের ব্যপারে কথা বলি।উঠে আসার দিকে রাশেদকে বলি কয়টা ছবি উঠিয়ে দিতে।ও দেয়ও, পরে মেসে এসে দেখছিলাম আপনার বাবা আর শান স্যারের ছবিও এসেছে।”
“এই নিন ম্যাডাম”-বলে ফোনটা এগিয়ে দেয়
🌸🌸
পাখি অনূভুতিহীন চাহনীতে ইকরার দিকে চেয়ে দূর্বল কন্ঠে বলে,”আগে কেন এসব বলো নি ইকরা”
“আসলে সরি ম্যাম, আমার সুযোগ হয় নি এসব বলার।ভেবেছিলাম হয়ত সমস্যা সমাধান হয়েছে তাই…”-আমতা আমতা করে বলে ইকরা।
এই মূহূর্তে পাখির কি করা উচিত কিছুই বুঝতেছে না ।শরীরটা নেতিয়ে পরছে যেন।নিজের শরীরের ভার টা বড্ডো ভারি লাগছে।টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইকরাকে বলে, “নিচে চলো”
পাখির অবস্থা দেখে ইকরা ভয় পেয়ে যায়।পাখির দুবাহু ধরতে গেলেই পাখি বলে,”লাগবে না।চলো!”
“ম্যাম আপনাকে দূর্বল লাগছে খুব।পারবেন না একা যেতে”
পাখি শুকনো হেসে বলে,”তোমার স্যারের কেবিন পর্যন্ত যেতে যে সময় লাগবে সে সময়টুকুই যেন অন্তত আল্লাহ্ আমায় বাঁচিয়ে রাখে”
চলবে…..
#আসক্তি
পর্বঃ৪৪
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
টলটমলে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে পাখি।ছাদ থেকে শানের কেবিনের দূরত্ব যেন আজ যোজন যোজন।মনে হচ্ছে হাজার মাইল দূরে শানের কেবিন।দরজার সামনে আসতেই পাখির পা থেমে যায়।দরজাটা সম্পূর্ণ খোলাও না আবার বন্ধও না;হালকা ভেড়ানো।শানের বাঁ হাত টা সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে।শ্বাস যেন থেকে থেকে জানান দিচ্ছে।হার্ট জোড়ে জোড়ে বিট করা শুরু করেছে।অনুভুতিহীন চাহনীতে দরজার ফাঁক দিয়েই শানের উপস্থিতি অনুভব করছে পাখি।ইকরা চলে গেছে একটু আগে।কেমন যেন সংকোচ কাজ করছে পাখির মাঝে।
হুট করেই শানের কথায় ধ্যান ফেরে,”ভিতরে আসো।বাহিরে গরম না!”
চমকে পরপর দুবার চোখের পলক ফেলে পাখি।ধীর পায়ে দরজা টা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।কেবিনে কেউ নেই এখন।আশপাশে চোখ বুলিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে স্তম্ভের ন্যায়।নজর আজ শানেতে আবদ্ধ।
“কি হলো দাঁড়াই আছো কেন, বসো?-শান মাথা না তুলেই বলে।মোটা মোটা কিসব রিপোর্ট না কি যেন পড়ছে আর কলমের নিব দিয়ে একটু করে মার্ক করছে।পাখি একদৃষ্টে চেয়ে আছে শানের দিকে।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে শানকে।
অফ হোয়াইটের শার্টটা কনুইয়ের কাছে ফোল্ড করা,বুকের কাছের দুটো বোতাম খোলা।লোমগুলো যেন উকি দিচ্ছে শার্টের খোলা জানালা দিয়ে।চোখের চশমা টা বার বার এক হাতে তুলে তুলে দিচ্ছে।আর নাকটা কুচকাচ্ছে বার বার।স্ট্রেইট সিল্কি চুল গুলো ফ্যানের বাতাসে বার বার উড়ে আসছে কপালে।
আনমনে ভাবছে পাখি,”কোন দিকেই কোন খামতি নেই মানুষটার।না রূপের আর না গুনের।শুনেছি কোন মানুষই নাকি পারফেক্ট হয় না।কিন্তু ইনি তো পারফেক্ট। আমার কি আছে?কোনদিক থেকে পারফেক্ট আমি?তিনি আবারও প্রমান করলেন আমি তার যোগ্য মেয়ে নই।”
এসিটা বন্ধ কেন সেটাই বুঝতে পারছে না পাখি।শানকে দেখে মনে হলো ফ্যানের বাতাসেও ঘামছে তাই দ্রুত গিয়ে এসিটা অন করে দিলো।সামনে থেকে পাখির সরে যাওয়াতে শানের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো পাখিতে।পাখির কাজে মোটামুটি অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে ফেললো শান।পাখি মলিন চেহারায় আবারও সামনে এসে দাঁড়ালো।
শান এবার কলম টা রেখে উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।ভেড়ানো দরজাটা আরো একটু চাপে চৌকাঠের সাথে ঠেকিয়ে দিলো ;লক করল না।পাখি হাতের চেকাপের কাগজ টা দেখছে বার বার।শান হঠাৎ পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে পাখিকে।চমকে ওঠে পাখি।
“কি ব্যপারর,এতো ভয় পাচ্ছো মানে?কেবিনে আমি ছাড়া কে আছে?”-শান মুখটা পাখির কানের কাছে এনে বলে আর আস্তেধীরে নিকাবটা খুলে দেয়।
পাখি কিছু বলতে পারে না।ওর কি অনুভূতি হচ্ছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
শান এবার পাখির হাতদুটো স্লাইড করে হাত থেকে কাগজ টা নিয়ে নিলো।থুতনিটা কাঁধে রেখে কাগজ টা দেখতে ব্যস্ত শান।
“আমি ওয়াশরমে যাবো”-পাখির কথায় শান বিরক্ত হয়। বলে,”কোথায় একটু রোম্যান্স করব তাও হলো না”
সরে গিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,”যান ম্যাডাম”
পাখি কাগজ টা শানের হাতে দিয়েই পাশের রুমে চলে যায়।
কেবিনের পাশেই ছোট্ট ওয়াশরুম আছে।যেটা শানের একান্তই ব্যক্তিগত।পাখি আশ পাশ ভালো করে পরখ করে বোরখা নিকাব টা খুলে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।শুষ্ক ঠোঁট মুখ ভিজিয়ে সামনে রাখা আয়নাটার দিকে চেয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।
সিথিবিহীন খোপা করা একগোছা চুল,কালো চামড়া বিশিষ্ঠ একটা মুখঅবয়ব ,প্রসস্ত কপাল,ডাগর ডাগর দুটি চোখ।খুব সাধারন একটা গড়ন।
“কি আছে আমার মাঝে তার সহধর্মিণী হওয়ার?”-ভাবতেই নজর পড়ে গলার নিচে বুকের ঠিক উপরে বিউটিবোনের কাছে কালো লালচে দাগটা।হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় পাখি।ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি ফোটে পাখির।
“পাগল একটা”-মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে পাখি।সে নিজেও জানে না পরমূহূর্তে সে কী করবে!ভাবনা গুলো কখনো এলোমেলো হচ্ছে কখনো আবার ভোঁতা হয়ে এবড়োখেবড়ো হচ্ছে।
পরপর আরো কয়েকবার চোখে মুখে পানি দিয়ে ড্রেস পরে বের হয় পাখি।
“রেডি?”-শান বলে
পাখি ওয়াশরুমের দরজা লক করতে করতে বলে,”হুমম”
“চলো তোমায় বাড়ি দিয়ে আসি। আমায় আবার মেডিকেলে আসতে হবে”-হন্তদন্ত হয়ে বলে শান।
গাড়ির চাবি ফোন সবটা নিয়ে পাখিকে সাথে করে দ্রুত বের হয় কেবিন থেকে।ফোনে কারো কল আসায় রিসিভ করে কানে ধরে।পাশাপাশি হাঁটছে দুজন।পাখি শুধু চেয়ে দেখছে পাশের শানকে।গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই শান লক দরজাটা খুলে দিতে ভোলে না।এরপর বসে পরে নিজের সিটে।
ফোন কানে নিয়েই গাড়ি স্টার্ট করে।পাখি তবুও চেয়ে আছে শানের দিকে।শান ভ্রু নাচিয়ে ইশরা করে, কি?
পাখি তবুও চেয়ে থাকে।শান এবার এগিয়ে এসে পাখির সিট বেল্টটা বেঁধে দেয়।
🌸🌸
গাড়ি চলছে আপন গতিতে।শান আড়চোখে পাখিকে দেখেছে কয়েকবার।হঠাৎ করে গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে হেসে ফেলে শান।হাসিতে যেন মুক্তা ঝড়ছে।পাখি তবুও অপলকে চেয়ে আছে শানের দিকে।
“এভাবে দেখতে থাকলে গাড়ি চালাব কি করে আমি! বার বার তোমার দিকে নজর পড়ছে।কি সমস্যা বলোতো?চেকাপের পর থেকেই খুব চুপচাপ মনে হচ্ছে তোমাকে।এ্যানি প্রবলেম?”-হেসে হেসে বলে শান।
পাখি মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিয়ে আবারও চেয়ে থাকে শানের দিকে।
শান গাড়ি পূনরায় স্টর্ট দিতে দিতে বলে,”একজন খুনিকে আজ প্রথম দেখলে নাকি?খুনিকে এতো দেখতে নেই।এমনিই আসক্ত হয়ে গেছো পরে না জানি আবার…. ”
শানের কথাটা শেষ হতে না হতে পাখি ডান হাত টা গাড়ির স্টেয়ারিং এর উপর রাখা শানের বাম হাতের উপর রাখে।
“বাড়ি যাবো না ”
শান ভ্রু কুচকে বলে,”তাহলে!”
“ঐ পদ্ম বিলের ধারে!
শান মুচকি হেসে ওঠে পাখির আজ হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে।
“আমার হসপিটালে যেতে হবে তো!
“ছুটি নিয়ে নিন”
শান পাখির কথাটা আজ ফেলতে পারলো না।কারণ আজই প্রথম পাখি নিজে থেকে ছুটি নিতে বলছে।শানও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি অন্য রাস্তায় নিয়ে ছুটে চলে সেই পদ্ম বিলের কাছে।দুই ঘন্টার পথ পেড়িয়ে পোঁছে যায় গন্তব্যে।আজ পাখি নিজে নিজেই গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে গুটিগুটি পায়ে। এসে দাঁড়ায় একদম বিলের খুব কাছাকাছি। শানও তাকে অনুসরন করে চলে আসে।স্বচ্ছ পানিতে পুরো বিলের মাটিটা বোঝা গেলেও একটু দূরের পানিটার গভীরতা বোঝা যাচ্ছে না।পাখি বুঝতে পারে ওটা কোন গভীর পুকুর।নিজের অযোগ্যতা টা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।জুতোটা খুলে বিলের ধার ঘেঁষে এগিয়ে চলে সে পুকুরের দিকে।শান পাখির থেকে কয়েক মিটার দূরে।বুঝতে পারে না পাখি কি করতে চলেছে।
পিছন পিছন শানের আগমনের পদধ্বনি বুঝতে পেরে পাখি পুকুরের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়।খুব সাবধানে শানের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
“স্ট্যাচু”-চিল্লিয়ে বলে পাখি।
শান থমকে গিয়ে ভাবতে থাকে এখন, এই সময় এসব খেলা মানে।তবু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে পাখি কি করতে চলেছে!
“সার্জন সাহেব গ্রামের মেয়ে হলেও আমি না সাঁতার জানি না।”
একটু থেমে পাখি আবার বলে,”আমি ছোট বাচ্চা খুব ভালোবাসি।খুব ইচ্ছে ছিলো মা হবো।হলাম, তবে অনাগত সন্তানের।”
পাখি নিজের পেটের উপর হাত রেখে বলে,”আমি আমার পেটের এই অনাগত সন্তানকে খুউব খুউব ভালোবাসি সার্জন সাহেব।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।আমি চলে গেলে তাকেও চলে যেতে হবে।ওর পৃথিবীতে আগমন অবধি অপেক্ষা করা যে আমার কাছে কোন ভাবেই সম্ভব না। ওর আসার আরো পাঁচ ছয় মাস বাকি।এতোগুলো দিন আমি কী করে নিজের বিবেকের সাথে লড়াই করে বাঁচবো।”
শান বুঝতে পারে না কি হতে চলেছে।কি করতে চাইছে পাখি।এক পা আগাতেই পাখি জোড়ে চিল্লিয়ে বলে,”একদম না। একদম কাছে আসবেন না।আমার কথা শেষ হয় নি।আল্লাহ্ র কসম দিলাম কাছে আসবেন না।”
শান এবার বুঝতে পারে পাখি কি করতে চলেছে।চিন্তার ভাঁজ যেন কপালে স্পষ্ট শানের।
“ওটা তো অগভীর বিল একটা।মিনিমাম হাটু পরিমান পানি হবে”-ভেবেই হেসে ফেলে শান।
হাসি থামিয়ে বলে, “গাধী কোথাকার।এসবের মানে কি হ্যা?বলেছি না বাবু দুনিয়াতে আসলে তোমায় ছেড়ে দেবো;তখন আর খুনির সাথে থাকতে হবে না,তাহলে এসব কি?চলে আসো বলছি”
বলতে বলতেই শান আবার হেসে বলে,”ওখানে লাফ দিলে হাইয়েস্ট পায়ে একটু ব্যথা পাবা তাছাড়া আর কিছু না।চলে আসো ”
পাখি এবার ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি এলিয়ে বলে,”আমি কোনদিক থেকেই আপনার যোগ্য নই ডাক্তার সাহেব।আপনাকে অবিশ্বাস করে, ভুল বুঝে যে অন্যায় আমি করেছি তার শাস্তি কি আমার ও আমার অনাগত সন্তানের মৃত্যুর মাধ্যমে পূর্ন হবে না?আমাদের জীবন দিলেও কি তার ক্ষমা হবে না?আমায় মাফ করবেন সার্জন সাহেব।”
বলেই আর এক মূহূর্ত দেড়ি না করে পাখি চোখ মেলে চারপাশটা দেখে লাফ দেয় পুকুরে।পা গিয়ে ঠেকে মাটিতে।নিজের দিকে চেয়ে দেখে,
“তারমানে বুক অবধি পানি!”
ভাবতেই চোখ মুখ কুচকে ফেলে পাখি।
ঘটনার আকষ্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যায় শান।দিগ্বিদিক চিন্তা না এক দৌড়ে চলে আসে বিলের ধারে।পাখির দিকে ভালো করে না দেখেই, কালক্ষেপণ না করে লাফিয়ে পড়ে পানিতে।বলিষ্ঠ দেহে কোলে তুলে নেয় পাখিকে।ভয়ে আতঙ্কে শানের শরীরের প্রত্যেকটা লোম দাঁড়িয়ে যায়।তৎক্ষণাৎ লাফ দেয়ায় পাখির কোন ক্ষতিই হয় নি।বরং শরীরের অর্ধেকটা তখনো শুকনো।শান দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে পাড়ে এনে রাখে পাখিকে।দুজনেই চুপ। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কি থেকে কি হলো সেটাই শানের বোধগম্য হচ্ছে না।পা দুটো বিলের পানিতে ভিজিয়ে দুহাত মাটিতে গেড়ে মাথা নিচু করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে শান।
এদিকে নিজের ব্যর্থ কাজে নিজের কপাল চাপড়াচ্ছে পাখি।আনমনে ভাবে,”সার্জন সাহেব ঠিকই বলে গাধী আমি। মরতেও পারলাম না।একটু মাঝ বরাবর লাফটা দিলেই হতো!”
শান যে ফিরে ওর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তা বোধগম্য হতেই পরপর কতোগুলো শুকনো ঢোক গেলে পাখি
“মরতে না পারলে কি হইছে, এনার হাতে ঠিকই এবার আমার মৃত্যু লেখা আছে।”
ভাবতেই পরপর চোখের পলক ফেলে পাখি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে শানের।কিছুক্ষন আগে করা পাখির পাগলামির কথা ভেবে থাপ্পোরের জন্যে উদ্যত হয়ে হাতটা উঁচুতে উঠায় শান।পাখি ভয়ে একটু পিছিয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেলে।শান থেমে যায়।হাত টা নামিয়ে পাখির দুবাহু ধরে জোড়ে ঝাকিয়ে রাগি স্বরে বল,”কি করতে যাচ্ছিলে তুমি?”
শানের গলার স্বরে পদ্ম বিলে বসে থাকা সাদা বক গুলো ফরফর করে উড়ে গেলো আকাশে।কথাটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে বার বার চারিদিকে আওয়াজ করছে।
নিজেকে এবার আর কন্ট্রোল করতে পারে না পাখি।কেঁদে ফেলে মুখ চেপে।
“আমি আপনার যোগ্য না। আমি আপনার মতো মানুষের ভালোবাসার উপর আঙ্গুল তুলেছি;অবিশ্বাস করেছি। আমায় প্লিজ মরতে দিন”-বলতে বলতে করূনস্বরে কেঁদে ওঠে পাখি।
শান এতোক্ষনে বুঝতে পারে পাখির অস্বাভাবিক আচরনের কারণ কি!দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”কতোবার বলেছিলাম আমি নির্দোষ।ইভেন আমাদের তোমাদের প্রত্যেকটা মানুষ আমায় সাপোর্ট করেছে এক্সেপ্ট ইউ?হোয়াই পাখি?হোয়াই!”
পাখির কান্নার বেগ বেড়ে যায়।
শান আবার বলে,”কি বলেছিলাম মনে আছে?সত্যিটা জানতে পারলে, পারবে তো নিজেকে ক্ষমা……”
“আমি সত্যিই পারছি না নিজেকে ক্ষমা করতে। বিবেকের কাঠগড়ায় আমি অপরাধী হয়ে সারাজীবন বাঁচতে পারবো না সার্জন সাহেব।তাই তো,তাই তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি”
শান আরেকবার তেড়ে এসে বলে,”তাই বলে…..”
মাথা ভনভন করছে পাখির।চোখ ঘোলা হয়ে আসছে।
বন্ধ চোখের পাতা জোড়া খুলে একপলক শানের দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”আমি আপনার যোগ্য না।আমি বাঁচতে চাই না।আমি অবিশ্বাস করেছি, কষ্ট দিয়েছি……”
হারিয়ে যায় পাখির গলার স্বর।শান দ্বিতীয় বারের ভয়ে একেবারে চুপসে যায়।নাম ধরে কয়েকবার ডাকে, গা ঝাকিয়ে কয়েকবার ডেকেও কোন সাড়া না পেয়ে ভেজা শরীরে পাখিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে শোয়ায়।ফোন করে কাউকে কেবিন বুক করতে বলে।দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করে শান। পাখিকে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দেয় ভালোভাবে।
বিপদের সময় নাকি ফুরাতে চায় না।শানেরও তাই হয়।ড্রাইভ করছে আর বার বার সিটে বসে থাকা পাখিকে দেখছে।
হসপিটালে পোঁছাতে পোঁছাতে দুপুর হয়ে যায়।লাঞ্চ টাইম লোক সমাগম তেমন নেই।এই সুযোগে শান দ্রুত পাখিকে কোলে নিয়ে হসপিটালে ঢোকে।প্রাথমিক চিকিৎসার পর বুঝতে পারে ভিপি লো হয়ে গেছে আর অতিরিক্ত ভয়ের কারণে সেন্সলেস হয় পাখি।শরীর টা বেশ দূর্বল।তার কারণ খাবারে অনিহা।এরপর ইউএসজি রিপোর্ট দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শান।কারণ তাদের সন্তান এবং পাখি দুজনেই ঠিক আছে।
🌸🌸
কিছুক্ষন পর জ্ঞান ফেরে পাখির।চারিদিকে চেয়ে বুঝতে পারে নিজের ঘরে আছে সে।বিছানায় শুয়েই পরে থাকে আর দু চোখের কোণা বেয়ে অঝোড়ে জল ফেলে।কয়েক ঘন্টা আগে ঘটা কাহিনী গুলো নেয়াতই দূঃস্বপ্ন মনে হয় তার কাছে।
“কোন মুখে আমি শানের সামনে দাঁড়াব?কি যোগ্যতায় তার সাথে সংসার করব?”-আনমনে ভাবতেই হঠাৎ খেয়াল হয়,”আমি তো বেঁচে গেলাম আমার বেবি!
ওর কিছু হয় নি তো”-ভেবেই পেটে হাত রেখে কেঁদে ফেলে পাখি।কান্নার শব্দ ক্রমেই বেড়ে চলছে।
কান্নার আওয়াজে ওয়াশরম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয় শান।
“এই কি হইছে, পাখি”-বলতে বলতে সারা গায়ে সাবানের ফেনা সমেত এগিয়ে আসে শান।
পাখি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে,”আমার বাচ্চা কই?”
শান সরুচোখে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে থাকে।
“মানে?”
“আমি লাফ দিলাম,আপনি তুললেন।তারপর বকলেন।তারপর আমার কিচ্ছু মনে নাই।আমার বাচ্চা কই”-বলতে বলতে পাখি নিজের পেটে হাত বুলায় আর কাঁদে।
শানের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়।
“কেন,লাফ দেয়ার আগে খুব না বড় বড় কথা বললে?এখন কি হলো?শোন বাবা মায়ের কর্মফল সন্তানদের দিতে হয়।আজ তোমার গাধামির জন্যে আমার বাচ্চাকে তার খেসারত দিতে হলো”-চোখ মুখ থেকে সাবানের ফেনা সরাতে সরাতে বলে শান।
পাখি কোনকিছু চিন্তা না করে আবারও কেঁদে দেয়।
পাখির কান্নার ধরন টা শানের বুকে গিয়ে লাগে।এগিয়ে গিয়ে পাখিকে ধরে ঝুঁকে গিয়ে বলে,”কিচ্ছু হয় নি তোমার বেবির।আল্লাহ্ র রহমতে দুজনই সুস্থ আছো।তবে আজ যা করলে তার হিসেব কড়ায় গন্ডায় উসুল করবে এই শান।শাস্তি বেঁচে যাচ্ছো তুমি প্রেগন্যান্ট বলে।”
পাখি কান্নাজড়িত কন্ঠে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,”আমি মরেই যেতাম ওর কিছু হলে”
“ড্রামা কুইন একটা”-মুখ কুচকে বলতে বলতে শান ওয়াশরুমের দিকে যায়।
পাখি আস্তে করে পা টিপে টিপে এসে পা উচিয়ে শানের গলা জড়িয়ে ধরে।হঠাৎ এমন হওয়ায় শান ঘাবড়ে তাল সামলাতে না পেরে দু কদম এগিয়ে যায়।
“কি করছো, পরে যাবো তো!”
পাখি কিছু না বলে শানের ভেজা পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলে,”আমি আপনার জীবন থেকে সরে গেলেই ভালো হবে ডাক্তার বাবু”
শান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,”আমি তো তোমায় ছাড়ছি না সোনা।তোমার হাড় খাবো, হাডি খাবো তারপর চামড়া দিয়ে ঢুগঢুগি বাজাবো।তারপর ভেবে দেখবো আর কি কি করা যায় সে ঢুগঢুগি দিয়ে”
পাখি আচমকাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।শানের কানে অনেকদিন পর পুরোনো সেই হাসির ধ্বনি যেন হার্টের বিটকে কয়েগুন বাড়িয়ে দেয়।পাখির হাত দুটো মুঠো করে ধরে পাখিকে সামনে আনে।চুল গুলো ঠিক ঠাক করে বলে।
“আমি জানতাম এই দিনটা আসবে।যেদিন তুমি আমায় আবারও আগের মতো ভালোবাসবে। তবে ভাবিনি তুমি বোকার মতো সুইসাইড এটেম্পট করবে।জানো কতোটা ভয়টা পেয়ে গেছিলাম আমি?”-থমথমে মুখে বলে শান।
“সরি! আমি আর কোনদিন আপনাকে অবিশ্বাস করব না।তখন আসলে মাথা ঠিক ছিলো না।সামিহা ভাবি যা যা বলেছিলো আপনিও তাই তাই বলেছিলেন।আর নীরার সাথে দেখা করার কথাও তো সত্যি ছিলো।তাই আমি বোকার মতো…..
আমার অনেক বড় ভুল হয়েছে।আর কোনদিন এমন ভুল করব না প্রমিস”-কানে ধরে বলে পাখি।
একটু দম নিয়ে আবার বলে,”আসলে আজ যখন ইকরার কাছ থেকে সবটা জানলাম,বুঝতে পারি নি কি করব!শুধু মনে হয়েছে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে হয়ত এই অন্যায়ের ক্ষমা পাবো আমি।”
“ইকরা মানে?”-সন্দিহান চোখে বলে শান।
এরপর পাখি ইকরার বলা সমস্ত কথা শানকে বলে দেয়।
শান ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মনে মনে বলে,”যতো যাইই বলো আগে সুস্থ হও, বুঝাব শান কি!আর আজকের টা তো আরো বড় অন্যায় করে ফেললে।প্রেগন্যান্সির সময়ে তোমায় কোন কষ্টে রাখব না আমি”
“এই,শুনছেন!”-পাখির ডাকে ভাবনা ভাঙ্গে শানের।
শুকনো জবাব দেয়,”কি?”
“ভিজে গিয়েছি একদম। আপনি তাড়াতাড়ি গোসল সেড়ে নিন।আমিও ওয়াশরুমে যাবো”
শান ওকে কোলে করে নিয়ে বলে,”চলো আজ একসাথে গোসল করব”
চলবে…..