#আসমানী
#পর্ব_১২
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
ধুলোপড়া ঘরটায় প্রায় মিনিট দশেকের মতো বসে আছে আসমানী।আজ প্রায় বছর খানেক হলো সে এই বাসায় আসেনি।কত স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আনাচে কানাচে।আসমানী অশ্রুভরা চোখে সেইসব দেখছে।ফ্লোর থেকে উঠে ধীর পায়ে সোফাটার দিকে এগিয়ে যায় সে।সিঙ্গেল সোফার হাতলে হাত বুলায় সে । সবাই যখন একসাথে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বসতো,তখন বাবা এই সোফায় বসতো।বাকি দুইটার একটায় সে আর তার বোন।আরেকটায় তার ভাই আর মা।কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না এটার জন্য।কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে সবাই নিজের নিজের যায়গায় বসে যেতো।অন্য সময় হলে সেটা আলাদা কথা।ছোট ভাই আর বোনের মাঝে প্রায়ই ঝগড়া বেঁধে যেত এই সিঙ্গেল সোফা নিয়ে।দুজনেই বাবার জায়গায় বসতে চাইতো।আগে সে আর তার ভাই এই সোফা নিয়ে মারামারি পর্যন্তও করতো।কিন্তু একটু বুঝ হওয়ার পর আর করেনি।
আসমানী ধীর পায়ে বাবা-মায়ের রুমে ঢুকলো।সবকিছু আগের মতোই আছে।কোনো জিনিস নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়েনি।সরবে কিভাব?সবই যে জড় বস্তু।ঘরের মানুষ দুজন তো না ফেরার দেশে চলে গেছে।যেখান থেকে চাইলেও আর ফিরে আসা যাবে না।আসমানী খাটের উপর গিয়ে বসলো।এই খাট অনেক দিনের পুরোনো।এই খাটেই নাকি বাবা-মায়ের বাসর হয়েছিল।এই খাটে শুয়েই মা তাকে কত গল্প শুনাতো।বাবা বুকের উপর নিয়ে আসমানীকে ঘুম পাড়াতো।তার প্রথম শিক্ষার হাতেখড়ি এই খাটে বসেই।বাবা বসে বসে অফিসের কাজ করতো।আর আসমানী খাতায় আঁকিবুঁকি করতো।তারপর যখন ভাইয়ের জন্ম হলো,তখন আসমানীকে পাশের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল।আসমানী ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করতো।বাবা-মাকে ছাড়া সে কিভাবে ঘুমাবে সেই চিন্তায়।বাবা অবশ্য মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে আর পাশের ঘরে পাঠায়নি।কষ্ট হলেও এই ছোট খাটেই চারজনে শুয়েছে।
কিন্তু কয়েকদিন যেতেই ছোট ভাইয়ের কান্নায় অতিষ্ঠ হয়ে নিজের কাঁথা আর বালিশ নিয়ে নিজেই পাশের ঘরে ঘুমোতে গিয়েছিল।তাকে দেখতে নাকি এতো কিউট লাগছিল মা তাই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে রেখেছিল।ছবিটা আজও আছে।বড় হওয়ার পর আসমানী নিজের এইরকম ছবি দেখে ভীষণ কেঁদেছিল।ইচ্ছে পোষণ করেছিল ছিড়ে ফেলার।কিন্তু মা অনেক চালাকি করেই ছবিটা লুকিয়ে ফেলেছিল।
এরপর আসমানী ভাইয়ের ঘরে ঢুকে।আসমানীর বুকটা ধ্বক করে উঠে।এতো গোছানো?কোনোকালে কি ছিলো এমন?ওর ঘর তো এতো গোছানো কখনোই থাকতো না।আসমানী আর ওর বোন বলতো এটা নাকি এই বাসার গোয়ালঘর।এই বাসায় নাকি একটা গৃহপালিত গরু থাকে।আসমানীর মা রোজ গুছিয়ে দিত।মাঝেমধ্যে আসমানী গুছিয়ে দিতে দিতে বলতো,”এই বাসাটাকে গরুটা একেবারেই গোয়ালঘর বানিয়ে দিয়েছে।বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না?দুষ্টু গরুর চাইতে শূন্য গোয়াল ভালো।সেইটাই প্রয়োগ করা উচিত।”
আসমানীর চোখ পানিতে ভরে উঠে।তার বলা কথাই কি আল্লাহ তবে শুনে নিয়েছেন?আল্লাহ কি তার কথা রেখেছেন?সে তো মন থেকে এইসব কোনো কিছুই চায়নি।
আসমানী এবার নিজের ঘরের দিকে যায়।যেখানে সে আর তার ছোট্ট বোনটা থাকতো।চারদিকে এতো গোছানো জিনিস আর নীরবতা সহ্য করতে পারে না আসমানী।তার বুক ফেটে কান্না আসতে চায়।কিন্তু চোখের পানি যে শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই। কার জন্য আর কাঁদবে সে?সে কাঁদলে কি তারা জীবনে ফিরে আসবে?
আসমানী নিজেদের পুরো ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে।তার ছোট বেলা কেটেছে এইখানে।কৈশোর কেটেছে এইখানে।সে তার ভাই-বোনদের সাথে হুটোপুটি করেছে।কত অভিযোগ, অভিমান আর আবদারের ঝুড়ি খুলে বসেছে।আসমানী এবার নিজেদের স্টোর রুমের দিকে যায়।সেখানে কতশত পরিত্যক্ত জিনিস ফেলে রেখেছে।আসমানী সেখানে গিয়ে রীতিমতো কাশতে থাকে।কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে সামনে এগিয়ে যেতেই প্রথমেই নজরে পড়ে একটা দুতলা খাট।এখানে উপরে সে আর তার ভাই নিচে থাকতো।ছোট্ট ভাইটা একটু বড় হওয়ার পর সেও উপরে ঘুমাতে চাইতো।আসমানীও ছাড়বার পাত্রী ছিল না।সেও নিজের জায়গা ছাড়েনি।তাই বাবা বাধ্য হয়ে এই খাটটাই স্টোর রুমে ফেলে তাদের জন্য আলাদা ঘর খুলে দিয়েছিল।
স্টোর রুম জুড়েই তাদের ছোট বেলাকার জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।বাবার পুরোনো রকিং চেয়ার,মায়ের পুরোনো আলমারি, তাদের খেলনা,একটা ভাঙ্গা আয়না। আসমানীর মনে হতে লাগলো এই ফেলে দেওয়া জিনিসগুলো যেন কত আপন তার।
সে স্টোর রুম থেকে বের হয়ে আসে।এইটা তার নিজের বাড়ি।কতদিন সে বাড়িছাড়া সে হিসেব নেই। হঠাৎ ওয়ালের দিকে নজর পড়তেই সেখানে তাদের ফ্যামিলি ফটো দেখে সে এইবার আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারে না।হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।সে আবার নিজের চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে,”আমি চোখ খুলবো,আর দেখবো সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছে।সবাই বাড়িতেই আছে।”
হঠাৎ পিছনে থেকে খুট করে দরজা খোলার শব্দ হলো।আসমানী এক বুক আশা নিয়ে পিছনে ঘুরে দেখে সেখানে তার বড় চাচা দাঁড়িয়ে আছে। সে এবার কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি ওদের কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না চাচ্চু।কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।আমি বাবাকে কথা দিয়েছি আমার মা আর ভাই-বোনদের মৃত্যু যাদের জন্য হয়েছে,তাদের কাউকে আমি ছাড়বো না।কাউকে ছাড়বো না।একজন একজন কে ধরে খু*ন করবো আমি।কিন্তু আমি কিছুই পারলাম না।আমি কাউকেই পেলাম না।তোমাদেরকেও ছাড়তে বাধ্য হলাম।সবার সামনে তোমাদেরকে ছোট করলাম।আমি পারলাম না চাচ্চু।আমি কিছুই পারলাম না।”
★★★
সবাই খাবারের টেবিলে বসে চুপচাপ খাচ্ছে।পুরো ঘরে যেন পিনপতন নীরবতা।আসমানীর চোখ ফোলা।কিছুক্ষণ আগেই কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে সে।নীরবতা ভেঙে আসমানীর চাচী বলে, “এইভাবে আর কতদিন আসমানী?এইভাবে কি জীবন চলবে?আমাদের থেকে এইভাবে দূরে থাকার কোনো মানে হয়?”
আসমানী কিছু না বলে চুপচাপ খেতে থাকে।সে একবার মাথা উচু করে তার চাচা-চাচী আর ভাইদের দেখে নেয়।কিন্তু কোনো জবাব দেয় না।
জবাব না পেয়ে আবার চাচী বলে,”কথা কানে যাচ্ছে না তোর?কিছু জিজ্ঞেস করছি তো আমি।”
আসমানী তবুও কিছু বলে না।আসমানীর চাচী এবার ধৈর্য হারিয়ে বলে,”আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোকে।শুনতে পাচ্ছিস না?আর কতদিন এইভাবে জীবন চলবে?তুই ঐবাড়িতে বেঁচে আছিস না মরে গেছিস তাও জানতে পারবো না আমরা।”
এবার সে তার মেজো ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,”ও না হয় নতুন।তুই কিছু করতে পারিস না?আড়াই বছর হয়ে গেছে তোর পরিবারের লোকদের সাথে এতো বড় অন্যায় হয়েছে। অথচ কিছুই করতে পারছিস না।কি করছিস তোরা?”
আসমানীর চাচা বলে,”আহ,কি শুরু করলে?খেতে তো দাও ওকে।এইভাবে বকবক করা বন্ধ করো।কতদিন পর এসেছে মেয়েটা।”
আসমানীর চাচী আর কিছু না বলে বসে থাকে।সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।শুধু সেই একা থাকে।আগে পাশের ফ্ল্যাটে দেবর তার পরিবার নিয়ে থাকতো।ছোট বেলায় বিয়ে হয়ে এসে দেবরকে কতটুকু পেয়েছিল সে?বাড়িতে ফেলে আসা ভাইয়ের কষ্ট তো দেবরকে দেখে ঘুচতো।তারপর দেবরের পছন্দ মতো বউ নিয়ে এলো।এমনভাবে থাকতো যেন দুটো বোন।অথচ বয়সে দুজনের মাঝে বিস্তর ফারাক ছিল।মাঝখানে একটা দমকা হাওয়া এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেলো।তার সুখের সংসারটা তছনছ করে দিয়ে গেলো।এখন সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত।তার স্বামী ভাই হারানোর শোকে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়।আর সে?সে তো এই ফ্ল্যাটে বন্দি থাকে।ফ্ল্যাটের বাইরে বের হতেও ভালো লাগে না তার।বের হলেই সামনে আসমানীদের ফ্ল্যাট।সেখানে তো হাহাকার ছাড়া আর কিছুই নেই।
★★★
বহুদিন পর নিজের ঘরে শুয়েছিল আসমানী।কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে এসে কিভাবে ঘুমিয়ে গেছে সে জানে না।হঠাৎ দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার।সামনে তাকিয়ে দেখে তার চাচার মেজো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।তার নাম আয়ান।আসমানী উঠে তার দিকে তাকিয়ে বলে,”কিছু বলবে ভাইয়া?”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ান বেশ কঠোরভাবে বলে,”তুই আমায় ঠকালি আসমানী।বড্ড বাজে ভাবে ঠকালি।”
★★★
নাবিল আজ বেশ খুশি।চুলে জেল মেখে আজ সে কলেজে এসেছে।জেল অবশ্য তার নিজের না।বড় ভাইয়ের থেকে নিয়েছে।বড় ভাইকে অবশ্য বলে নেয়নি।এইটা চুরি করে নেওয়া নাকি স্বাভাবিকভাবে নেওয়া সে বুঝতে পারেনা।এই মুহুর্তে সেটা সে বুঝতে চায় ও না।কিন্তু ভুল একটা সে করে ফেলেছে।নাতাশার ঘরে থেকে আয়না আনতে যাওয়ার সময় নাতাশা আর আসমানী ভাবী দেখে নিয়েছে যে সে জেল মেখেছে চুলে।নাতাশা কেমন সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ছিল।আর আসমানী ভাবী কেমন যেন মুখ টিপে টিপে হাসছিল।সে যে কিভাবে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে,সেটা সেই জানে।কলেজের কাছাকাছি আসতেই নাবিলের মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠে।তার বয়সী অনেক ছেলেই বাইক নিয়ে কলেজে আসে।তার কোনো বাইক নেই।সে কলেজে আসে সাইকেল নিয়ে।তাও সাইকেল টা তার নয়।তার বড় ভাইয়ের।অনেক দিনের পুরোনো সাইকেল।নাবিলের নিজের কাছে নিজেকে কেমন ছোট ছোট মনে হয়।হঠাৎ সে লক্ষ্য করে নাক বোঁচা মেয়েটাও কলেজের গেটের সামনে এসে পড়েছে।সেওরিকশা থেকে নামছে।নাবিলের মনে হলো এই ভাঙ্গাচোরা সাইকেল টা দেখলে মেয়েটা কি ভাববে?চারপাশে এতো বাইকওয়ালা ছেলেদের ভীরে সে কি তার দিকে তাকিয়েও দেখবে?
কিন্তু নাবিলের সব আশংকায় পানি ঢেলে দিশা নামক নাক বোঁচা মেয়েটা তাকে দেখেই মুচকি হেসে বলে,”কেমন আছো নাবিল?”
নাবিল আমতা আমতা করে বলে,”হ্যাঁ, ভালো।”
এরপরই সে চলে যায় কলেজের ভিতরে।আর নাবিল বাইরে ভ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।হঠাৎ তার মনে হয় সে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে।মেয়েটাকে কি একবার বলা উচিত ছিল না,”কেমন আছো বুঁচি?না মানে দিশা?”
চলবে…..