#আসমানী
#পর্ব_১৬
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
পুরো রুমের আলো নিভিয়ে বসে আছে নাহিদ।তার রুম টা যেমন আসমানী বিহীন শূন্য লাগছে,তার মনটাও তেমনই শূন্য লাগছে।সে ভেবে পেল না আসমানীকে কি জবাব দিবে।সে হয়তো ভেবেই বসে আছে নুসাইবা কে কিডন্যাপ সেই করিয়েছিল।কিন্তু আদতে তো তা সত্য নয়।সে তার বোন কে কেন কিডন্যাপ করাবে।সে তো এইসব কাজে জড়িত না।তাই এই ব্যাপারে আসমানীকে কিছু একটা বুঝালেই সে বুঝবে।তবে সে যে কাজটা করেছে,সেটাও তো সবার পক্ষে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা সহজ না।কাজ টা সহজে গ্রহণ করার মতোও না।তবে,আসমানী কে কিভাবে বুঝাবে সে?সে কোনো অন্যায় করছে না।যেটা করছে,সেটা মানুষের ভালোর জন্যই করছে।সে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে আসমানীকে একেবারে শুরু থেকে সবই বলে দিবে সে।আর কোনো কিছুই গোপন করবে না।কিন্তু সেটা করতেও একেক সময় মন সায় দিচ্ছে না তার।তার দলের কেউই আজ পর্যন্ত এই কাজ করেনি।আর সে লিডার হয়ে কিভাবে করবে?
আজ তার বহু পরিচিত বিছানা টা কেন যেন বড় মনে হচ্ছে।কিন্তু বিছানাটা অতো বড় না।নাবিলের সাথে শোয়া নিয়ে ঝামেলা হতো তার।কিন্তু আসমানী তো আদুরে বেড়াল।গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে বুকের কাছে।বিয়ের পর আজই প্রথম আসমানী তার কাছে নেই।নাহিদ বিছানার এপাশ ওপাশ করেও কোনোভাবে ঘুমুতে পারছে না।একবার ভাবছে আসমানীকে কল দিবে।সে জানে তাতে কোনো লাভ হবে না।কারণ আসমানীর ফোন বন্ধ।সে বাসায় আসার পর মা বারবার বলেছে আসমানীকে কল দিয়ে ওর খবর নিতে।ঐ বাড়িতে তো তার আপন কেউই নেই।আবার উল্টাপাল্টা কিছু না বললে হয় ওকে।নাহিদ জানে আসমানী তার থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই সেখানে গিয়েছে।সে কল দিলেই বা সে ধরবে কেন?
নাহিদ জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকায়।তার ঘর থেকে চাঁদ দেখা যায় না।আসমানীর খুব ইচ্ছে তার সাথে এক কাপ কফিতে চুমুক দিতে দিতে চাঁদ দেখবে।তাদের নতুন ঘরটা প্রায় প্রস্তুত। দিন দশেকের মধ্যেই হয়তো তারা নতুন ঘরে চলে যাবে।সেখান থেকে খুব ভালোভাবেই চাঁদ দেখা যাবে।কিন্তু সব সত্য জানার পর কি আসমানী থাকবে তার কাছে?একসাথে হাত ধরে কি চাঁদ দেখার স্বপ্ন কি স্বপ্নই থেকে যাবে?
★★★
আসমানীর বিছানার পাশে বসে আছে ওর কাকী।কিছুক্ষণ পরপরই চোখ মুছছে ভদ্রমহিলা।নিজেদের মন্দ ভাগ্যের জন্য ভীষণ রাগ হচ্ছে তার।কি এমন পাপ করেছিল তারা যে তাদের সাথেই এইসব হচ্ছে?বাপ মা মরা মেয়েটাও যে ধুকে ধুকে মরছে।একে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে পরকালে তার ভাইয়ের সমতুল্য দেবর আর ছোট বোনের সমতুল্য জা কে কি জবাব দিবে তারা?তারা ছাড়া এই মেয়েটার আর কে আছে এই দুনিয়াতে?
“মা,তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।রাত জেগো না বেশি।”
দরজার দিকে তাকিয়ে আসমানীর কাকী দেখে তার মেজো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।সে উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,”ওর জ্ঞান ফিরবে কখন বাবা?ওর কি হয়েছিল? অজ্ঞান হয়েছিল কিভাবে?”
আয়ুশ মায়ের কথার কোনো জবাব দেয় না।কি বলবে সে?সে যদি বলে আসমানী আবার পাগলামি শুরু করেছে আগের মতো,তাহলে কি কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে?সে শুধু বলে,”অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।আর এখন ওকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে।ও এখন ঘুমুচ্ছে।চিন্তা করো না,কালকে সকালেই উঠে যাবে।”
আসমানীর কাকী কিছু না বলেই আসমানীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।আয়ুশ আবার বলে,”তুমি যাও মা,শুয়ে পড়ো গিয়ে।”
আসমানীর কাকী আসমানীর দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,”তোর খুব কষ্ট হয় তাই না বাবা?আসমানীকে তুইও বড্ড ভালোবাসিস,তাইনা?আমিও কত স্বপ্ন দেখতাম ওকে তোর জন্য বউ করে নিয়ে আসবো।তোকে এই স্বপ্ন তো আমিই ছোট বেলা থেকে দেখিয়েছি।এইজন্যই তো তুই ওকে ভালোবেসেছিস।ওকে ভাবতে ভাবতেই ভালোবেসেছিস।এখন ওকে হারিয়ে তোর বড্ড কষ্ট হয়,তাইনা বাবা?”
উত্তরের অপেক্ষা করে না ভদ্রমহিলা।চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় রুম থেকে।আয়ুশের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।নাহ,সে কাঁদে না।পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই।তারা থাকবে হাসিমুখে।কেন কাঁদবে সে?যারা কাঁদে,তারা হয় কাপুরষ।
সে ধীরে ধীরে আসমানীর পাশে গিয়ে বসে।ঘুমন্ত আসমানীকে দেখতে কি মায়াবী লাগছে।সবকিছু ঠিক থাকলে আজ আসমানী তার বউ হতো।তার অর্ধাঙ্গিনী হতো।তার কাছে হাজারো বায়না করতো।তার ছোট্ট ঘরের কোনায় কোনায় তার স্পর্শ থাকতো।কিন্তু হায়!ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর নিয়তি।ছোট্ট বেলা থেকে যে আসমানীকে সে পাওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখে আসছিল,সেই আসমানী এখন অন্য কারো ঘরের রানী।অন্য কেউ তাকে রোজ নিয়ম করে ভালোবাসে।আসমানী তার জন্য খুব যত্ন করে রান্না করে থালা সাজায়।সে ফিরে আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকে।নিজেকে যতোটা পারে পরিপাটি করে রাখে তার জন্য।রোজ রাতে বুঝি তার জন্য সাজে?তার কাছে বুঝি হাজারও বায়না করে?তার সমস্ত ভালোবাসা বুঝি তাকে উজার করে দেয়?
কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।সে তো তার হওয়ার ছিল।আল্লাহ তাকে যদি দিবেই না,তবে কেন মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল তাকে?
আয়ুশ জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়।চাঁদের আলো সরাসরি তাদের গায়ে এসে পড়ে।আসমানী চাঁদ ভীষণ ভালোবাসে।মাঝে মাঝে সে বেলকনিতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়তো।কেউ কিছু বললে বলতো,”আমি হচ্ছি আসমানী।আমার বাড়ি তো ঐ আসমানে।চাঁদ তো আসমানেই থাকে।তাহলে আমি চাঁদকে ভালো না বাসলে কে ভালোবাসবে?ইশশ!আমি যদি আসমানের চাঁদের সাথে মিশে যেতে পারতাম?”
আয়ুশের পুরোনো কথা মনে পড়ে বেশ হাসি পায়।হুট করেই তার ভীষণ অবাধ্য হতে ইচ্ছে করে।নিষিদ্ধ কাজ টা করার জন্য তার নিজের ভিতরের আরেকটা সত্ত্বা যেন তাকে ভীষণ ভাবে টানছে।সে বারবার নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু একসময় হার মেনে যায়।সে নিজেকে আসমানীর খুব কাছে নিয়ে যায়।
ঘুমন্ত আসমানীর নিশ্বাসের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে।তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে।সে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আসমানীর ঠোঁটের দিকে।এই নিষিদ্ধ কাজ টা করতে তার মন সায় দিলেও তার মস্তিষ্ক নিষেধ করছে।কিন্তু পাত্তা দেয় না সে সেদিকে।সে তার চোখদুটো বন্ধ করে নেয়।কিন্তু চু*মু খাওয়ার আগ মুহুর্তে তার মনে পড়ে চাঁদের গায়েও কলঙ্ক আছে।সে চায় না তার আসমানীর চরিত্রে কোনো কলঙ্কের দাগ লাগুক।সে চায় না তার আসমানী চাঁদের সাথে মিশে যাক।
এইবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না আয়ুশ।সে এইবার কাঁদতে থাকে নিঃশব্দে।সে উঠে যায় আসমানীর পাশ থেকে।রুমের লাইট টা বন্ধ করে দিয়ে যায় সে।থাক আজকে আসমানী চাঁদের আলোর সাথে মিশে।শুধু চাঁদের সাথে না মিশলেই হলো।এর বেশি সে আর কিছুই চায় না।
★★★
“আমার সাথে কি কথা বলা যায় না আসমানী?আমি সারাদিনে কত মেসেজ পাঠিয়েছি,কত কল দিয়েছি তুমি একবারের জন্যও ধরোনি।তুমি বাসায় এসেছো সেটা আমাকে নাবিলকে কল করে জানতে হয়েছে।ও আসমানী,কিছু তো বলো।”
আসমানী তবুও কিছুই বলে না।চুপচাপ রান্না করতে থাকে।
নাহিদ আবার অধৈর্য হয়ে বলে,”কথা না বললে কিভাবে বুঝবো তুমি কেন রেগে আছো?আমি কি এমন করেছি বলোতো?আমার সাথে কথা কেন বলছো না?”
আসমানী শান্ত অথচ দৃঢ় ভাবে বলে,”তুমি মানো বা নাই মানো,আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী।আপনার প্রত্যেকটা বিষয়ের উপর আমার অধিকার আছে।আমার জানার পূর্ন অধিকার আছে যে আপনি বাইরে আমাদের লুকিয়ে কি এমন কাজ করেন।আপনি আপনার কাজের ফিরিস্তি দিতে পারলেই আমি আপনার সাথে কথা বলবো।”
নাহিদ যেন হঠাৎই মিইয়ে যায়।যত আগ্রহ নিয়ে রান্নাঘরে এসেছিল,ঠিক ততোটাই শান্ত ভাবে চলে যায়।টেবিলে থাকা পানির জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পানি খায়।নিজেকে শক্ত করে সে।আজ যেভাবেই হোক,সব টা জানাবেই সে আসমানীকে।তাতে যদি নিয়ম ভঙ্গ হয়,তাহলে তাই হোক।
★★★
“আপনার মনে হয় না,আপনি ভুল করছেন?অন্যায় করছেন?” চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন করে আসমানী।
নাহিদ বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,”মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল করছি।কিন্তু অন্যায় যে করছি,এইটা কখনোই মনে হয় না।আমি জানি আমি কোনো অন্যায় করছি না।”
“আপনার কি মনে হয় যে আপনি কোনো সাওয়াব পাচ্ছেন?তারা যেমন অন্যের টাকা এক উপায়ে নিজেদের করে নেয়,তেমনি ভাবে আপনিও নেন।তাহলে তাদের আর আপনাদের মধ্যে পার্থক্য কি?”
“আসমানী,ঐ হারাম টাকার একটা পয়সাও আমরা নিজেদের কাছে রাখি না।নিজেদের কাজে ব্যবহারও করি না।সব এতিমখানা,বৃদ্ধাশ্রম আর পথে থাকা মানুষদের বিলিয়ে দিই।”
“তাতে কি হয়?অন্যের হক তো আপনারা নষ্ট করেন।”
“আমরা মোটেও অন্যের হক নষ্ট করি না।আমরা মানুষের টাকা মানুষের মাঝেই বিলিয়ে দিই।”
আসমানী বেশ জোরেই প্রশ্ন করে,”তাই বলে আপনি ডাকাতি করবেন?অন্যের উপার্জিত অর্থ আপনারা কেড়ে নিবেন?”
নাহিদ এইবার বেশ রেগে গিয়েই বলে,”নিজের বিবেক দিয়ে ভাবো আসমানী।ওরা অন্যের হক মেরে খায়।নিজেদের জন্য সম্পদের বিশাল পাহাড় গড়ে তুলে।আমরা ওদের থেকে যা নিই,তার থেকেও অনেক বেশি ওদের আছে।”
আসমানী এইবার বেশ রেগে গিয়েই বলে,”নিয়ম সবার জন্যই তো সমান তাইনা?সবার জন্যই সমান?তাহলে নিজের বড় চাচা যে অবৈধ উপায়ে এত কিছু করলো,তার বেলায়?কই তাকে তো কিছুই করছেন না?নাকি আপনিও তারই মতো?নিজেদের বেলায় ষোলো আনা আর বাকিদের বেলায় কিছুই না?”
চলবে….