#আয়নামতী
#পর্ব_৩৮
#পুষ্পিতা_প্রিমা
বাড়ির ভেতরে অনুরাগকে প্রবেশ করতে দেখা গেল। বসার ঘরে সবাই ছিল। আয়না ছিল না শুধু। শায়লা বেগম আদা দিয়ে গরম চা করে দিতে বলেছিল চামেলিকে। আয়না সেটি নিয়ে আসতেই অনুরাগের মুখোমুখি পড়লো। চোখাচোখি হলো। অনুরাগের নির্বিকার চাহনি। চলে গেল সে। আয়নার কপাল কুঞ্চিত হলো। প্রফেসর তার দিকে ওভাবে তাকালো কেন?
আয়না শায়লা বেগমকে চা দিয়ে ঘরের দিকে যেতেই অনুরাগকে আবার বসার ঘরে আসতে দেখলো। তাই চুপচাপ এককোণায় দাঁড়িয়ে রইলো। অনুরাগ পকেট থেকে একটি মুড়িয়ে থাকা সংবাদপত্রের খানিকটা অংশ বের করলো। টি টেবিলে রেখে দিল সেটি। তারপর শায়লা বেগমের পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো। শায়লা বেগম বলল
‘ এটা কিসের খবর দাদুভাই? আমি তো চোখে দেখিনা। পড়ে শোনাও।
‘ পারব না।
‘ রাগ কেন? আচ্ছা আমি নাতবউকে ডাকি।
আয়নাকে ডাকতেই পা টিপে টিপে এল আয়না। অনুরাগের চোখ নিচে নিবদ্ধ। কোনো দিক তাকালো না সে।
‘ পাশে এসে বসো নাতবৌ। এদিকে আসো আমার পাশে।
আয়না শায়লা বেগমের ডান পাশটায় গিয়ে বসলো। ছেঁড়া সংবাদপত্রের অংশটা হাতে নিতেই দেখলো একটা অংশে অনুরাগের ছবি, অন্য অংশে কুহেলীর অর্ধনগ্ন ছবি। হেডলাইনটা পড়েই চমকে অনুরাগের দিকে তাকালো আয়না। চক্ষুকোটরে অবিশ্বাস্য কৌতূহল। মেঝের দিকে এখনো চোখ নিবদ্ধ অনুরাগের। শায়লা বেগম বলল
‘ কি লিখা আছে নাতিবৌ? পড়ে শোনালে না কেন?
আয়না বলল
‘ আপনি চা টা খেয়ে নিন না। ঠান্ডা হয়ে গেছে বোধহয়।
শায়লা বেগম অনুরাগকে বলল
‘ তুমি পড়ে শোনাও। এখানে কুহেলীর ছবি কেন?
অনুরাগ ধপধপ্ হেঁটে চলে গেল। আয়না গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রান্নাঘরে চলে গেল। চামেলির বকবকানি ভেসে আসছে। আয়না তার বাকি কাজগুলোর দিকে হাত বাড়ালো। পেঁয়াজ, মরিচ আর ধনেপাতা কুঁচি করা দরকার। চামেলি মাছগুলো পানি দিয়ে ধুতে ধুতে বলল
‘বৌরাণির মন খারাপ ক্যা? কোনো চমচ্যা?
‘ নাহ।
আর কোনো কথা বাড়ালো না চামেলি। অন্যসময় আয়না নিজ থেকেই এটা ওটা বলে। এখন বলছে না। যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা। মরিচ আর ধনেপাতা কুঁচি করে সবুজ রঙের বাটিতে রাখলো । পেঁয়াজ কুঁচি করার সময় অসাবধানতায় আঙুলের মাথা কেটে গেল। চামেলি বলল
‘ বৌরাণি তোমার জামাই মানে ছোটচাহেবের জন্য মাছ ভাজা রান্না করতে বলছে। গলায় নাকি কি ইফিকচন,,
জমিলা ঝামটি মেরে বলল
‘ ইনফেকশন গাদী। বৌরাণি মাছ কম ঝাল করতে বলছে বড়মা। ঝোল ছাড়া। ছোট সাহেবের খেতে কষ্ট হবে।
আয়না দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচলে আঙুলটা চেপে ধরে চলে গেল। জমিলা বলল
‘ কি হয়ছে রে?
চামেলি চপিং বোর্ডে তাকালো। কাটারে রক্ত লেগে আছে। বলল
‘ বৌরাণির কি হাত কাটলো নাকি? ওমা রক্ত কেন?
জমিলা বলল
‘ শীগগির যাহ। বড় মাকে বল। নইলে পরে আমাদের সাথে খ্যাকখ্যাক করবে।
‘ আইচ্ছা যাইতাছি।
______________
দশটার দিকে পাহাড়তলীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল অনুরাগ । মুখটা থমথমে ছিল যতক্ষণ বাড়িতে ছিল। আনহিতা এটা ওটা বললেন মুখ দিয়ে কথা বের হলো না তার। খেতে বললে ও খেল না।
আয়নাকে কিছু বললে ও কিছু বলল না সে। সারাদিন বিষণ্ণতায় কাটলো আয়নার। কুহেলী ছাড়া পেয়ে এত জঘন্য কাজ করবে ভাবতে ও পারছেনা আয়না।
তখন রাত সাড়ে নয়টা। বিছানা তুলে ঝেড়ে ফেলল আয়না। বেডশীট বিছিয়ে দিল । পুরো ঘরের আনাচকানাচ ঝেড়ে ফেলল। ঝাড়ু দিয়ে ঝাড় দিতেই তিনটি ছেড়া ছবির টুকরো পেল সে। তারই ছবির অংশ। ছবিটা দুইবছর আগের সেই হাসি-হাসি মুখের ছবিটা। যেটা অনুরাগকে দেখানোর জন্য দিয়েছিল। এতদিন পর ছবিটা! তাও ছেঁড়া। অনুরাগ তার ছবিটা ছিঁড়ে ফেলেছিল? দপদপ করে জ্বলে উঠলো আয়না। আজ আসুক। এত সুন্দর সূক্ষ্ম অপমানে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে উঠলো আয়নার। সে এতটা তুচ্ছ! বলতে না বলতেই ঘন্টাখানেক পরে অনুরাগ বাড়ি ফিরলো। চেহারা শুষ্ক, রুক্ষ। আয়না ঘরে থম মেরে বসে রইলো। অনুরাগ রাতের খাবার খেতে বসে চামেলিকে ডেকে নিল। বলল
‘ ডেকে নিয়ে আসো। বাবা খেয়ে নিয়েছে। ও এখানে খেতে পারবে।
‘ খাবে না বলচে।
‘ কেন খাবে না? কে কি বলেছে?
‘ কেউ কিচ্ছু বলেনাই। আঙুল কাটছিল রান্নাঘরে। দুপুরে চামচ দিয়ে খাইছে। এখন নাকি খাবে না।
‘ আমি ডেকেছি বলো। যাও।
‘ যাইতাছি বাপু। চবচময় জ্বালায়।
চামেলি ডাকলো আয়নাকে। আয়না মুখের উপর বলল
‘ খাব না আমি। অত দরদ দেখাতে হবে না কারো। আপনি যান।
চামেলি চলে গেল গাল ফুলিয়ে। অনুরাগকে গিয়ে বলল
‘ দরদ না দেখাতে বলছে।
অনুরাগ আর কথা বাড়ালো না। আনহিতাকে বলল
‘ না খেলে না খাক। মা তুমি বসো।
‘ না। আরেকবার ডেকে দেখি না?
‘ দরকার নেই। এটা ওর বাপের বাড়ি নয়।
‘ অনু?
‘ ঠিক কথায় বলেছি।
আনহিতা কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেয়ে নিল। অন্য প্লেটে খাবার বেড়ে অনুরাগকে দিল। বলল
‘ মাঝরাতে খেয়ে নিতে বলো। তখন খিদে আসবে।
অনুরাগ বলল
‘ আমি পারব না। চামেলি আপাকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও।
আনহিতা ভারী অবাক হলেন ছেলের ব্যবহারে। আর না পেরে বললেন
‘ কি হয়েছে অনু? তোমার ব্যবহার ভালো ঠেকছে না আমার।
‘ তোমার বৌমার কাছ থেকে জেনে নিও। আমি কি বলব মা?
দাঁড়ালো না অনুরাগ। সোজা ঘরে গেল। ধাক্কা দিল দরজা৷ খুললো না। আয়না বিছানায় বসা ছিল। পড়ছিল বই নিয়ে। সামনে তার পরীক্ষা কলেজে। বাড়িতেই পড়া দরকার। কলেজে যাওয়া হয় না। অনুরাগের দরজা ধাক্কানো খুলতেই ইচ্ছা হলো না। খুললো না। বসেই থাকলো৷ খুলতে বললে খুলবে।
অনুরাগ প্রায় চার পাঁচ মিনিটের মতো দরজা ধাক্কা দিয়ে গেল৷ আয়না ও খুললো না। শেষমেশ গুরুগম্ভীর গলা ভেসে এল
‘ আমাকে কি আজকে বাইরে ঘুমাতে হবে?
বিছানা থেকে নামলো আয়না৷ ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুললো৷ কোনোদিক না দেখে আবার বিছানায় উঠে বসলো। অনুরাগ হেঁটে গিয়ে টেবিলের কাছটাই গেল দেখলো তিনটা টুকরো। তাও একটা ছবির। সাজিয়ে রাখা। মানে জোড়া দেওয়া। ছবিটা কোথা থেকে এতদিন পর। এত খুঁজে ও পেল না সে। আজ কোথা থেকে?
‘ এইটা এখানে কি করে?
বই থেকে মুখ সরালো আয়না। মুখ দিয়ে অনেককিছুই বের হলো তবে বলল না। শুধু বলল
‘ কুড়িয়ে পেয়েছি। উচ্ছিষ্ট নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি দরকার?
‘ উচ্ছিষ্টই যখন টেবিলে কেন রাখা হলো?
প্রচন্ডরকম আহত হলো আয়না। এক লাফে বিছানা থেকে নামলো। ছবির টুকরো গুলো কুঁচি কুঁচি করলো তারপর ফেলে দিল। অনুরাগ ভুরু কুঁচকে তাকালো। বলল
‘ সমস্যা কি?
রক্তচোখে তাকালো আয়না। বলল
‘ আমার ছবি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন তখন। আবার আমার প্রতি এত দরদ কোথা থেকে আসলো?
‘ আমি ছিড়িনি৷ না জেনে মিথ্যে অপবাদ দেবে না খবরদার। গলার আওয়াজ তো বেশ উঁচু। নিজে ভুল করো আবার শাসাও আমাকে। কি পেয়েছ তুমি?
কে যেন এগিয়ে আসছে তাদের ঘরের দিকে। অনুরাগ সোজা দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসলো। বলল
‘ কে ছিঁড়েছে তোমার ছবি? কে?
‘ আপনি। কে ছিঁড়বে আর? আলমিরার কোণায় ঝাড়ু দিতেই বেরিয়ে এল।
‘ আমি করিনি। কুহেলীর কাজ৷
আয়না চুপসে গেল। চোখ নামিয়ে নিল। চুপ করে থাকলো। অনুরাগ বলল
‘ চুপ কেন? কুহেলী তো বন্ধু হয় তোমার। তাই চুপসে গেলে? আর আমি তো শত্রু।
‘ কুহেলী কেন আমার ছবি ছিঁড়বে? আর কুহেলী যখন আপনার বউ তখন আমার ছবি এই ঘরে কি করছিল?
‘ জানিনা। কুহেলীর নাম ধরেছি বলে খারাপ লাগছে?
‘ আমি চাই না কথা বাড়ুক।
‘ এখন তো কিছুই চাইবে না তুমি। কুহেলী আমার শত্রু, কিন্তু তোমার বন্ধু। সে কি বলল তার ভক্তদের! অনুরাগ চৌধুরী তার উপর দুর্বল। তার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা। আবার তাকে ফিরাতে চাইছে নিজের কাছে। ভুলের ক্ষমা চেয়েছে। সে নিজে কোনো ভুল করেনি বরঞ্চ অনুরাগ চৌধুরী নিজের ভুল স্বীকার করে সমস্ত অভিযোগ তুলে নিয়েছে তার উপর থেকে। ছাড়াছাড়ির বছর না পেরোতেই যেই লোক দ্বিতীয় বিবাহ করে সেই লোকের কাছে ফেরার কথা ভাবতে ও পারেনা কুহেলী।
কি সুন্দর বিবৃতি দিল কুহেলী।
আমার সব মানসম্মান ধুুলোয় মিশে গেল। তারপর ও সে তোমার বন্ধু। আমি মুখ খুলিনি এখনো। এড়িয়ে গেছি, যাচ্ছি সাংবাদিকদের প্রশ্ন। কারণ কুহেলী সরকার আয়নামতীর বন্ধু হয়।
আয়না একটু করে তাকালো তার চোখের দিকে। আবার চোখ নামিয়ে দিল।
‘ আমাকে আর কতভাবে তুমি অপমান করবে আয়নামতী? আমি তোমাকে আমার শক্তি, অনুপ্রেরণা ভাবি। আর তুমি জেনেশুনে কলঙ্কিত করছ আমায়। শাস্তি কি এখন ও শেষ হয়নি? আর বাকি থাকলে দিয়ে দাও। কারণ আমি মনে করে ফেলছি হয়ত থাকতে থাকতে তুমি এই সম্পর্কটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছো। কিন্তু নাহ। তুমি ঠিক আগের মতোই আছ। যে আমার কষ্ট বুঝা তো দূরে থাক, কষ্ট দিতেই পছন্দ করে। আমার অপরাধ আমি তাকে জোর করে বিয়ে করেছি। আর কি কি শাস্তি বাকি রেখেছ আয়নামতী? বুকে ছুরি চালানো?
‘ আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।
হাতের বাহু খামচে ধরে তার সামনে আয়নাকে এনে দাঁড় করালো অনুরাগ। বলল
‘ দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রাক্তনের উপর কেন দুর্বলতা!
হাজার হাজার লোকের সামনে এই প্রশ্ন তোমাকে করা হলে তুমি কি বলতে আয়নামতী?
‘ লাগছে আমার।
চট করে ঠেলে দিল অনুরাগ। বলল
‘ আরেহ কাকে কি বুঝাই আমি? এই মেয়ে কে হয় আমার? ওই বিয়ে নামক শব্দটা ছাড়া তো কিছুই নেই তোমার আমার মাঝে। ভালোবাসা টালোবাসা তো বহুদূর, সামান্য মায়া ও হয় না তোমার? রাস্তার কুকুর বিড়ালেরা ও তো তোমার সহানুভূতি পায়। ওই রূপা ও তো পরের মেয়ে। তাকে আপন করতে তো কষ্ট হয়নি। আমিই কেন সবকিছু থেকে অতটা ব্যাতিক্রম? আমার অপমানগুলো তোমার অপমান হওয়া উচিত ছিল। আর আমার সুনামে তোমার গর্ব। এটাই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আয়নামতী। ভেবেছিলাম আমি এসব কথা তুলবই না তোমার সামনে। সব ভুলে থাকব। সয়ে যাব। তুমি নিজ থেকে এসে কথা বলবে আমার সাথে । তোমার ভুল ভাঙবে। আমার সেই ছোট্ট বিন্দুকণার মতো রাগগুলো তোমার কথায় চট করে সরে যাবে। তুমি রাগ ভাঙাবে। একটুখানি অনুতাপ নিয়ে তাকাবে।
কিন্তু তুমি ওই ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে যার কারণ ও কুহেলী, সেটার দায় চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছ আমার ঘাড়ে। দিয়েই যাচ্ছ যখনও তোমার সামনেই সত্যিটা। দেখে ও দেখো না তুমি। কারণ আমার ওই একটাই দোষ। আমি ভালোবাসি তোমায়। একটু বেশিই যত্নে রাখি তোমায়।
এতক্ষনে আয়নার গাল ভিজে উঠেছে। হাতের মুঠোয় শাড়ি। ডুকরে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর।
‘ কুহেলীর মাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। ফিরলে একবার দেখে এসো। আর কুহেলীকে বলে এসো তার নাম জপে জপে আমি ঘুমাতে যাই। তাকে ভেবে ভেবে দিনরাত পার হয় আমার। কুহেলীকে নয়, পারলে পুরো দুনিয়াটাকেই জানিয়ে দিও। পারলে সাথে এটা ও জানিয়ে দিও, কুহেলী নয় বরং তুমিই আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল।
চোখের কোণায় তীব্র বিতৃষ্ণা অনুরাগের।
আয়না চুপচাপ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো। আওয়াজ অনুরাগের কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল শুধু।
‘ আমি তোমাকে আঘাত করে কথা বলতে চাইনি। নিজের জায়গাটা বুঝে নিয়েছি। খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর আঙুলে মলম লাগাও। আমি বাইরে গেলাম।
‘ আপনার ঘরে আপনি থাকুন। আমি যাই।
চোখভর্তি, গালে লেপ্টে থাকা জল নিয়ে কথাটা বলল আয়না। সশব্দে হেসে ফেলল অনুরাগ।
‘ আমার ঘর, আমার বাড়ি, আমার রাজত্ব। কিন্তু ক্ষমতা তো তোমার হাতে।
চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অনুরাগ। আয়না বিছানায় বসে থাকলো। অনেক্ক্ষণ বসে বসে ইচ্ছেমত কাঁদলো। চামেলি খাবার এনে দিল। আয়নার চোখ ফোলা দেখে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো৷ কিন্তু করলো না। শায়লা বেগম এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল কোনো কথা ছাড়া । আনহিতা এসে মলমের কৌটো দিয়ে গেল। বলে গেল
‘ মনে করে লাগিয়ে দিও বৌমা । তুমি না পারলে অনুকে বলো। ও লাগিয়ে দেবে।
আয়না ভাত খেয়ে নিল । তারপর মলমের কৌটো নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তিন তলার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে অনেক কষ্ট করে ছাদে উঠলো। ছাদে বড় সাইজের বাল্ব লাগানো। বিশাল ছাদটাতে এত বড় বাল্বটা ও পোষাতে পারলো না। আবছা আবছা অন্ধকারে ছাদের আনাচকানাচে ছেয়ে আছে। তবে রাতের আকাশ ঝলমলে তাই আয়নার ভূতভয় বেশি জমতে পারলো না। ভয় আর ও কেটে গেল যখন দেখলো ছাদের কোণায় দাঁড়ানো একটি লম্বাটে সৌষ্ঠব দেহা অবয়ব। মাথা নিচু করে কি যেন করছে। একটিবার থমকালো আয়নামতী।
অনুরাগের হাতে সিগারেটের প্যাকেট। সিগারেট। সিগারেটের প্যাকেটে আগুন লাগিয়ে দিল। দাউদাউ করে সেটি জ্বলে গেল। তারপর ধরালো সিগারেটের মুখে। হঠাৎ পেছনে নরম পায়ের আওয়াজ, আর ফোঁপানির শব্দে সম্ভিৎ ফিরলো তার।
‘ আপনি সিগারেট খান প্রফেসর?
ফোঁসফোঁস করে কথাটা বলল আয়না।
গায়ে হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটাতে রঙ খুলে গেছে তার। কান্নায় চোখমুখ ফুলে টুইটুম্বুর। লম্বা বেণুনী কোমরে পড়ে আছে। লম্বা সিঁথিকাটা মাথায়। মাথায় কাপড় দেওয়া নেই।
অনুরাগ বলল,
‘ প্রফেসর মানুষ সিগারেট খায় না। খেলে ও বিরাট সমস্যা হবে এমন ও না।
‘ আমি জানিনা আপনি সিগারেট খান।
আলতো বাঁকা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখলো অনুরাগ। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
‘ এতরাতে এখানে কি? ঘরে যাও।
আয়না এগিয়ে এল। জ্বলন্ত সিগারেট কেড়ে নিল অনুরাগের কাছ থেকে। ফেলে দিল। পায়ের দু ফিতার জুতোর তলায় পিষে ফেলল সেটি। তারপর নাক টানতে টানতে বলল “গন্ধ”।
অনুরাগ অন্যদিকে তাকানো। আয়না নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মুখ নিয়ে গেল অনুরাগের মুখের কাছে। মুখোমুখি নাক টেনে গন্ধ শুঁকে বলল
‘ গন্ধরাজের গন্ধ , সিগারেট নয়।
মুখে হাসি আয়নার। মলমটা বাড়িয়ে দিল অনুরাগের দিকে। আঙুল ও বাড়িয়ে দিল। মলমটা নিল অনুরাগ। কৌটো খুলতে খুলতে অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিল,
‘ আগেই বলেছি সিগারেট খাই না আমি।
‘ তাহলে হাতে সিগারেট কেন?
‘ আমাকে দেখামাত্র তড়িঘড়ি করে চলে গেল বাবা। ফেলে গেল প্যাকেট।
‘ ওহহ।
আহহ একটু ধীরেধীরে লাগান। অনেকটা কেটেছে।
‘ মন কোথায় ছিল?
‘ সত্যি বলি?
চোখ তুলে তাকালো অনুরাগ।
‘ সত্য শুনতেই মজা। যদিও হয় বিষাক্ত।
‘ আপনার বকা খাওয়ার ভয়ে অন্যমনস্ক ছিলাম। বাঁচতে পারলাম কই?
‘ বকা? বকা কোথায় দিলাম? ওগুলো আমার ভুলের বিবরণ।
‘ আমি কি জানতাম নাকি কু,,
‘ থাক ওসব কথা। ভালো লাগছে না।
আয়না মলমের কৌটো নিয়ে ফেলল। দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো অনুরাগের বুক। চওড়া বুকটাতে নিজের জায়গা করে নিয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলে উঠলো
‘ আপনি আমায় ধরছেন না কেন? আশ্চর্য! কত বকেছেন আমায়। তারপর ও তো কাছে এসেছি। অভদ্র মানুষ। অনেক তো জ্ঞান দিলেন। আমি খারাপ সেটা জানি আমি। ভালো সাজতে যাই না। যাচ্ছি ও না।
অনুরাগ দুহাত বাড়িয়ে কোমল শরীরটা নিজের দুহাতের বাঁধনে নিল। মাথাটা বুকে চেপে বলল,
‘ আর কত রাগারাগি? মান অভিমান জমিয়ে রাখা আর দূরে থাকা। সবকিছুর হিসাব এবার চুকিয়ে ফেলা দরকার। একেবারে চলে যাও নয়ত, পরিপূর্ণ আমার আয়নামতী হয়ে যাও। তুমি কি বলো?
‘ আমাকে আজকাল আয়না নামে কেউ চেনেনা প্রফেসর। আপনি আমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। আপনার আর ও শাস্তি বাকি।
‘ শাস্তি হিসেবে তোমার হাতের নখগুলো এভাবে পিঠে বিঁধে থাক তাহলে।
‘ থাক। মলম তো আছে।
চলবে,,
#আয়নামতী
#পর্ব_৩৯
#পুষ্পিতা_প্রিমা
বাগানবাড়িতে ফুল তোলার কাজ চলছে। আয়না ও হাত লাগিয়েছে। সকাল সকাল রূপা এসে হাজির। কোলে সায়ান। আয়না বিস্মিত হলো। বলল
‘ ওকে নিয়ে এসেছিস কেউ জানে?
রূপা মিটমিট করে হাসলো। সায়ান আয়নাকে দেখে ঠোঁট টানলো। আয়না হেসে কোলে নিয়ে ফেলল তাকে। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলল
‘ কোলে নিলাম তো। আব্বার কি আমার জন্য মন পুড়ছে?
সায়ান চুপটি করে বুকের সাথে লেগে থাকলো। আয়না কপালে মাথায় চুমু দিতে দিতে রূপাকে বলল
‘ কি হলো বললি না যে? আম্মা তোকে বকবে না? তুই এতদূর ওকে নিয়ে হেঁটে এসেছিস? এভাবে আসা ঠিক হয়নি।
‘ তোমার বর এনে দিয়েছে।
‘ বর? প্রফেসর?
‘ হুমম।
‘ গাড়িতে করে এসেছিস?
‘ হুমম।
‘ উফ তাহলে তো ঠিক আছে। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। আম্মা কিছু বলেনি? ভাবি?
‘ ছোটসাহেবকে জেম্মা বলছে ‘ শোনো জামাই আমার ভাইরে তাড়াতাড়ি নিয়া আসবা। তার ফুপুর কোলে দিয়া আদর খাওয়ায় আবার পাঠাই দিবা। আমি আমার ভাইরে ছাড়া থাকিত পারিনা।
আয়না হেসে দিল। বলল
‘ তাই নাকি? আব্বা আদর খেতে এসেছে? এই আব্বা আদর তো খাইছেন আর কি কি খাবেন আপনি?
সায়ান উঃ উঃ শব্দ করলো। আয়না তাকে আর ও আদর করে দিল। বলল
‘ আব্বা কথা বলা কখন শিখবে?
রূপা বলল
‘ ও কথা বলা শিখলে তোমাকে আনামতী ডাকবে।
‘ চুপ। বেশি পেকে গেছিস? প্রফেসর কোনদিকে?
রাস্তার মোড়ে শার্টকোর্ট পড়া কতগুলো সাহেবের সাথে কথা বলছে দেখলাম। আয়না বলল, আচ্ছা আমি বাবুকে ঘরে নিয়ে যাই। একটু দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়ায়। তুই ও চল। সন্দেশ খাবি? তোর ছোটসাহেব এনেছে।
‘ কাল ভাই আনছে সন্দেশ। খেয়েছি। আবার খাব। এইখানে নিয়ে আসো। আমি ওখানে যাব না।
‘ আচ্ছা আমি যাই আর আসি। তুই এখানে থাক। তোর ফুল তুলতে হবে না।
রূপা মাথা দুলিয়ে বলল
‘ আচ্ছা।
সায়ানকে দেখে আনহিতা আর শায়লা বেগম অবাক হলো। বলল
‘ বাবুটা কোথা থেকে? আর কে এসেছে?
‘ রূপার সাথে এসেছে।
অনিমা দৌড়ে আসলো। আবার আয়নার সামনে এসে থেমে গিয়ে বলল
‘ আমাকে একটু দেওয়া যাবে। আমি আবার বাচ্চা মারিনা।
‘ আপনি বাচ্চা মারেন কখন বললাম?
সায়ান খিকখিক করে হেসে দিল। ঝাপ দিল অনিমার কোলে। যেন কতবছর ধরে চেনে। অনিমা হেসে বলল
‘ মা আমাকে বাবুটা কিভাবে চেনে জানো? ওই দাদার মেজবানে আসছিল না৷ তখন কোলে নিয়েছিলাম সেইথেকে। কি মিষ্টি? তুমি জানো সারাক্ষণ কোলে থাকবে কিন্তু কাঁদবেনা। খিদে পেলে মাকে খুঁজে। ওইদিন খিদে পেয়েছে বুঝলে। আমি তো বুঝতে পারিনি। ও ছোট হাতটা দিয়ে আমার বুকে আঁচড় কাটতে শুরু করলো। মুখ ঘষে ঘষে কান্না করতে লাগলো। শেষমেশ ওর মাকে যখন দিলাম তখন একদম শান্ত।
আনহিতা বলল
‘ বাচ্চাদের ভাষাটাই এমন৷
সায়ান আবার হাসলো। আনহিতা বলল
‘ বৌমা বাবুকে কিছু খাওয়ায়। ও মেহমান না?
অনিমা নিয়ে গেল। বলল
‘ আমি খাওয়ায়। আমি, আমি।
হেসে ফেলল আনহিতা। অনিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ ওর মেয়েটা ও বাবুর বয়সী হতো বেঁচে থাকলে।
শায়লা বেগম বললেন।
‘ আবার হবে হবে।
আনহিতা বলল
‘ ডাক্তার তো অমির পরেই বলেছে আর বাচ্চা হবে না। যাও হলো তা আল্লাহ নিয়ে গেল।
থাক ওসব কথা। ও শুনলে মন খারাপ হয়ে যাবে। আল্লাহ একটা দিল তো ছাতা । ওটা নিয়ে থাকুক।
আয়না ওদের কথা চুপচাপ শুনলো।
________________
আম্মার কোলে ছেড়ে দিয়ে আসবেন একদম। ওদের একা ছেড়ে দেবেন না। মনে থাকবে?
‘ থাকবে।
মাথা দুলিয়ে বলল অনুরাগ।
‘ বাগানের কাজ শেষ?
‘ নাহ, এখনো অনেক বাকি। আপনি আগে ওদের ছেড়ে দিয়ে আসুন।
‘ ঠিক আছে।
সায়ানকে নিয়ে হাঁটা ধরলো অনুরাগ। আয়না আবার দৌড়ে এল । শাড়ির সাথে লেগে হোঁচট খেতেই অনুরাগ এক হাত দিয়ে ধরলো। বলল
‘ আহা আস্তে।
‘ আরেকটু দিন আদর করে দিই।
সায়ানকে দিয়ে দিল অনুরাগ। আয়না সায়ানের সারাগালে চুমু খেল। বুকের সাথে কিছুক্ষণ চুপচাপ চেপে ধরে রেখে মাথায় চুমু খেল, তারপর বলল
‘ আবার আসিও আব্বা।
সায়ান হাসলো। আঙুল দেখিয়ে বলল
‘ আঃ।
আয়না বলল
‘ বাহ।
অনুরাগ বলল
‘ টা টা বলেন সায়ান সাহেব।
সায়ান ছোট্ট হাত নাড়িয়ে বলল,
‘ তাত তাত তা।
আয়নার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। কিছু বলতে ও পারলো না সে। কথা বুজে আসছে। ছোট্ট হাতটা ধরে হাতটাতে চুমু দিল সে। অনুরাগকে বলল
‘ আপনার জন্য আমাকে এখানে থাকতে হচ্ছে। নইলে আমি ওদের সাথে থাকতাম। আমার আব্বাটাকে সারাক্ষণ আদর করতে পারতাম।
‘ আহা বাচ্চার জন্য কাঁদতে হয়? আমাকে বলবে তো ভাই। যতই চাইবে ততই পাইবে।
‘ কোথা থেকে? আপনি কি আবার বাচ্চার ফ্যাক্টরি খুলেছেন নাকি?
অনুরাগ হেসে উঠলো সশব্দে। চারপাশ কাঁপিয়ে দেওয়া সেই হাসি। আয়নামতীর রাগ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেই হাসি। নাকের ডগায় রাগ এনে দেওয়ার মতো সেই হাসি। অনুরাগ যেতে যেতে হাসলো। আর আয়না ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। অনুরাগ কিছুদূর গিয়ে বলল
‘ নাগিনী!
____________
প্রায় সপ্তাহখানেক পরের কথা। সায়ানের আকীকা করা হয়েছে। তাই দাওয়াত পড়েছে মেয়ে আর ছেলের শ্বশুরবাড়ি। দুপুরের আয়োজন। নাতির আকীকার জন্য গরু দিতে চেয়েছিলেন নাওয়াজ শেখ। আয়ান বারণ করে দিয়েছিল। সে যতটুকু পারে ততটুকু করবে। কারো কিচ্ছু নেবে না। নাওয়াজ শেখ এতে ব্যাথিত হলেন। অনুরাগ একটা ছোট্ট পাঞ্জাবি, একটি হাঁটাহাঁটি করার জন্য গোল গাড়ি, আর এক গাদা ছোট শার্ট প্যান্ট দিল সায়ানকে। সাথে একটা ছোট্ট আংটি। রূপার আংটি। শায়লা বেগম বলেছিলেন মুসলমান ছেলেদের স্বর্ণ পরিধান হারাম। আয়শা বেগম বেশ ধার্মিক মানুষ। ওনি তা অপছন্দ করবেন। তাই রূপার আংটি দিল অনুরাগ।
আয়ানের উপর ক্ষেপে থাকলো নামিরা। তার বাবার কোনোকিছু কেন নিচ্ছে না আয়ান। কি দোষ করেছে তার বাবা? আয়ান তা টের ও পেল, নামিরা তার সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছে না। ফুলেফুলে থাকছে। আয়ান ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলো
‘ আমার উপর রেগে আছ মিরা?
‘ নাহ।
‘ উত্তরটা তো তাই বলে দিল৷
‘ রাগ করব কেন?
‘ গরু কেনার টাকা নিইনি বলে।
‘ তুমি পয়সাওয়ালা হয়েছ। এখন পরের টাকা নেবে কেন?
‘ মিরা?
নাক টানতে টানতে ফুঁপালো নামিরা। বলল
‘ তুমি আমাকে শাসাচ্ছ?
‘ নাহ মিরা। তোমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। তোমার বাবার ওসব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
‘ নাতি হয় সায়ান। আমার বাবার নাতি হয়।
‘ ওনি চাননি তুমি আর সায়ান আমার কাছে থাকো। সেজন্য ওনি আমি বেঁচে আছি এই খবরটা জেনে ও চুপ করে ছিল। আমাকে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছিল তোমার বিয়ে দিয়েছেন ওনি। আর একটা বাচ্চা ও হয়েছে।
আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো নামিরা।
‘ ও এই ব্যাপার ছিল তাহলে? আর তুমি তা বিশ্বাস করে ফেললে। এই তুমি আমাকে ভালোবাসো?
‘ মিরা আমি তখন অসুস্থ ছিলাম। শারিরীক মানসিক। আমি বিশ্বাস করিনি৷ সেদিনই ছুটে এসেছি তোমার কাছে, এসে দেখলাম সত্যিই বাচ্চা তোমার কোলে।
‘ হ্যা অন্যের বাচ্চা। তুমি মরে গেলে আর আমি আরেকজনকে বিয়ে করে বাচ্চা ও নিয়ে নিলাম। বাহ সাব্বাশ মিঃ আয়ান।
আয়ান দুহাত বাড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ফেলল নামিরাকে। বলল
‘ আমি দুঃখিত মিরা। আমি সত্যি ভালোবাসি তো। সত্যি। আমার উপর প্লিজ রেগে থেকো না। মিরা আমার উপর রেগে থাকতেই পারেনা। মিরা রেগে আছে?
কান্নার বাঁধ ভাঙলো মিরার। বাবা এতকিছু করেছে কেন বলোনি আমায়?
‘ খবরদার মিরা। ওনাকে কিচ্ছু বলবে না। ওনি এখন সবটা মেনে নিয়েছেন। ভুল বুঝতে পেরেছেন। বলবে না।
নামিরা কেঁদেই গেল। আয়ান শক্ত চুম্বন বসালো তার কপালে।
_____________
শীতের প্রকোপ বেড়েছে। কনকনে ঠান্ডা পড়ছে। বারান্দায় শাল গায়ে দাঁড়িয়ে রইলো আয়না। রাত প্রায় দেড়দুইটা। অনুরাগ চট্রগ্রামের মহাজন হাঁটের দিকে এক সম্মেলনে গিয়েছে। ফিরতে দেরী হবেও বলেছে। আনহিতার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল সন্ধ্যায়। ঔষধ পেটে পড়তেই ঘুমে ঢলে পড়লেন তিনি।
বারান্দা পায়চারী করলো আয়না। ঘুম এসেছে তার ও। চোখ লালচে হয়ে যাচ্ছে। হাত পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। ঘরে পা রাখতেই গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। কাঁপা-কাঁপা পায়ে নিচে চলে এল সে। দরজা খুলতেই অনুরাগকে দেখতে পেল। হেসে ফেলল সে। অনুরাগ হাসিটা ফিরিয়ে দিল নিজে হেসে। বলল
‘ অপেক্ষা? তা ও আয়নামতী?
‘ আয়নামতী ভালো তাই এতদিন টিকে আছে। নইলে তৃতীয় বিয়ের জন্য মাঠে নামা দরকার পড়তো মিঃ চৌধুরী।
‘ আয়নামতীর মতো বউ পাওয়া গেলে চোখবন্ধ করে, বিয়ে করে নেব ।
‘ আয়নাকে পাবেন কিন্তু আয়নামতী খুবি দুর্লভ এই জগতে। তাই আশা ছেড়ে দিন
বিয়ে পাগলা পুরুষ।
অনুরাগের হেলে পড়লো আয়নার দিকে। ফিসফিস করে বলল
‘ লোকে তো বউপাগলা ডাকে। এখন কি হবে?
‘ কি আর হবে? আপনার জন্মই হয়েছে অদ্ভুত অদ্ভুত উপাধি পাওয়ার জন্য।
‘ আর উপাধি দেওয়ার জন্য আয়নামতী।
হেসে উঠলো আয়না। বলল
‘ হাতের ব্যাগে কি?
‘ আমার ব্যাক্তিগত জিনিস?
‘ আমি ছাড়া আবার ব্যাক্তিগত কি?
রেগে বলল আয়না।
‘ তুমি আমার ব্যাক্তিগত মানুষ। তোমার জন্য যা আনব সেগুলো ও ব্যাক্তিগত৷
ঠোঁট পুনরায় হাসি চড়লো আয়নার।
আনহিতাকে দেখতে গেল অনুরাগ। ঘুমন্ত মায়ের কপালে চুমু আঁকলো সে। গায়ের উপর ভালোভাবে কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিল। পায়ের আঙুলগুলো টেনে দিতেই আয়না বলল
‘ কি করছেন?
‘ সকালে উঠে মা যখন দেখবে আঙুল আর ফুটছেনা তখন বুঝে যাবে আমি রাতে তাকে দেখতে এসেছি। এটা আমি ছোটবেলা থেকে করে আসছি। তখন রাত করে কোচিং থেকে ফিরলে এমনটা করতাম।
‘ নতুন কিছু আবিষ্কার করলাম আজ।
অনুরাগ হাসলো। মায়ের কপালে দ্বিতীয় চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল
‘ আমার মা আর সবার মা গুলো বেঁচে থাক হাজার বছর।
আয়না হেসে বলল
‘ আপনি তো খারাপ মানুষ। এসব কথা ভালো মানুষরাই বলে।
অনুরাগ বলল
‘ তুমি বিশুদ্ধ করে দাও তো দেখি তাহলে।
‘ আমি খারাপ কাজ করিনা।
হেসে উঠলো অনুরাগ। ঘর থেকে বের হয়ে দরজা বন্ধ করলো। যেতে যেতে বলল
‘ তাহলে আমি করি?
আয়না তার পেছনে। প্রশ্ন ছুঁড়লো।
‘ কি? খারাপ কাজ কি কম করেছেন নাকি? আর ও করতে মন চাইছে? খারাপ মানুষ!
অনুরাগ চট করে থেমে গেল। ফিরলো আয়নার দিকে। আয়না ও সাথে সাথে থেমে গিয়ে বলল
‘ কি হলো?
‘ কি কি খারাপ করেছি দেখি বলোতো।
‘ বলব?
‘ হুম।
‘ তাহলে শুনুন। প্রথমত বিয়ে ভেঙেছেন আমার। দ্বিতীয়ত আমার বাগান পুড়িয়েছেন। আমাকে জোর করে বিয়ে করেছেন। ইচ্ছে করে করে ছুঁয়েছেন। আমাকে পুরোপুরি বন্দী করে ফেলেছেন। সব খারাপ কাজ।
হাওয়ায় ভাসলো যেন আয়না।
‘ আশ্চর্য কোলে নিয়েছেন কেন? ধুরর কেউ দেখলে আমি শেষ। নামান। আল্লাহ আমি মরে যাব লজ্জায়। দেখবে তো ।
‘ জ্বীন-ভূত ছাড়া আর কিছু নেই এখানে আপাতত।
‘ জ্বীন-ভূত?
‘ হ্যা।
ভয়ার্ত চোখ আয়নার।
‘ ওসবে ভয় পাই না আমি। নামান বলছি।
‘ নামাবো না।
‘ তো?
‘ আরাম করে করে কোলে চড়ছো। আবার গলার জোর কত? আমাকে কেউ এভাবে চড়ালে মাথায় তুলে রাখতাম।
আয়না হেসে ফেলল। ভালো করে অনুরাগের গলা আঁকড়ে ধরে মিহি গলায় বলল
‘ তাই নাকি? মাথায় তুলে কিভাবে? শিখিয়ে দিন। আমি তুলে রাখব আপনায়।
‘ সিন্ধুকে তুলে রাখো। মাথায় তোলার দরকার নেই।
‘ সিন্ধুক? কি সিন্ধুক?
‘ হৃদয়সিন্ধুক।
মোলায়েম চাহনি আয়নার। হাসিমিশ্রিত চোখ।
‘ কোল থেকে কি নামাবেন না?
‘ কথা ঘুরাচ্ছ?
‘ জানলেই তো।
‘ তুমি জানো। জেনেই মারো।
‘ এবার তো নামান। আর কতক্ষণ? ধুরর।
‘ ঘুমানোর জায়গায়।
‘ নির্লজ্জ!
‘ শুধু বউয়ের কাছে।
হেসে ফেলল অনুরাগ। আয়নাকে নামিয়ে দিল বিছানায়। বলল
‘ চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি এক্ষুনি আসছি।
‘ আমি ঘুম।
‘ ঘুম ভাঙতে জানি।
_________
তিনটা কাঠগোলাপ কানের কাছে টের পেল আয়না। হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলল
‘ কোথা থেকে?
‘ অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি। তোমাকে এখন আর ও সুন্দর দেখাচ্ছে আয়নামতী।
‘ আমি লজ্জা পাচ্ছিনা কেন?
‘ কেন? পাওয়া তো উচিত।
‘ সেটাই কিন্তু পাচ্ছি না কেন?
‘ চোখ বন্ধ।
‘ কেন?
‘ আর ও একটা উপহার।
‘ করলাম।
অনুরাগ খুব সন্তর্পণে ব্যাক্তিগত কাজ সাড়লো গালে, চোখের পাতায়,ললাট,নাকের ডগায় আর চিবুকে। ধড়ফড়িয়ে উঠলো আয়না। বলল
‘ দরজার কাছে সাদা শাড়ি পড়া একটা বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। দেখুন না। সরুন।
অনুরাগ বলল,
‘ বুড়িটা নাতি নাতনির মুখ দেখাতে বলল।
চাপা হাসিতে মত্ত হল আয়না। অতঃপর একটা সময় এসে অনুরাগ তাকে ঘুমঘুম গলায় ডাকল
‘ আয়নামতী! বুড়িটা তো তোমার পাশে ঘুমাচ্ছে।
আয়না দুম করে মারলো অনুরাগের বুকে। বলল
‘ বেয়াদব লোক ঘুমের ভেতর ও মশকরা করে।
চলবে,,,,,
মাগোমা লুমান্টিক গল্প ও কেউ লিখে নাকি? 😒😒