#ইচ্ছেঘুড়ি (৬)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
“আপনাকে এত প্রশ্নের উত্তর দিবো কেন?
আপনি তো আমার বন্ধু নন।”
শান্তর এই কথায় আমি কিছুটা থমকে যায়। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকি। এটা দেখে শান্ত মুচকি হাসি দিয়ে বলে,“তবে এসব কথা বলাই যায়। তেমন পার্সোনাল কিছুই নয়।”
“থাক বলতে হবে না।”
আমি কিছুটা অভিমান নিয়েই কথাটি বললাম। এটা দেখে শান্ত বলে,“সবার উপর অভিমান করতে নেই। এতে মানুষ সস্তা ভাবে। আর হ্যাঁ নিজেকে কারো সামনে সস্তা করা একদম উচিত নয়। এতে সবাই একটু বেশিই মাথার উপরে উঠে নাচে।”
“আপনার ফালতু কথা শোনার সময় নেই আমার। আমি গেলাম।”
আমি যাবার জন্য পা বাড়াতে শান্ত বলে,“আরে নিচে আপনার বোনের পাকা কথা চলছে। সেখানে আপনার কোন প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে বরং আপনি আমার ফালতু কথাই নাহয় শুনুন।”
“নিচে যে আমার বোনের পাকা কথা হচ্ছে, এটা আপনি কিভাবে জানলেন?”
“বোকা বোকা কথা বলছেন কেন?
আরে একই পাড়ায় থাকি আমরা। এসব জানবো স্বাভাবিক নয় কি?”
আমি মাথা নাড়ালাম। আসলেই বোকার মতো প্রশ্ন করা হলো। মূহুর্তে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এলাকার সবাই আমাদের নিয়েই গসিপ করছে৷ বিশেষ করে আমাকে নিয়ে এটা ভাবতেই আমার মনটা খারাপ হলো। এটা দেখে শান্ত বলে,“আমি অনার্স কমপ্লিট করে আর পড়ালেখা করিনি। তারপর এই বখাটে জীবনটাকেই বেছে নিলাম। যদিও এর মাঝে দুবার চাকরি করেছি। তবে দুটোই বেশিদিন টেকেনি। প্রথম চাকরিটা আমার কারণেই চলে গেছে, বসের নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়টায় বস নিজের লোক ঢুকানোর জন্য আমাকে বের করে দিলো।”
শান্ত এসব কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি মন খারাপ ভুলে গিয়ে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,“আপনি বসের মাথা ফাটালেন কেন?”
“আর বলবেন না। সারাদিন প্রচুর খাটাতো। এত কর্মময় জীবন আমার কোনকালেই পছন্দ ছিলো না। তাই জীবনটা বোরিং হয়ে গিয়েছিলো। তার মাঝে এই বস উঠতে বসতে কথা শোনাতো। চুপচাপ কত সহ্য করা যায়। তাও কয়েক মাস সহ্য করেছিলাম। কিন্তু একদিন শালায় সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাই দিলাম নাক বরাবর..
শান্ত প্রথমে স্বাভাবিক কন্ঠে কথাগুলো বললেও শেষ কথাগুলো রাগ নিয়ে বলছিলো। এটা দেখে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,“কিভাবে সীমা ছাড়ালো?”
“আমার বাবা মা নিয়ে গালি দিচ্ছিলো। আবে শালা তোর চাকরি করি, তার মানে কী তোকে আমাকে গালি দেওয়া লাইসেন্স দিয়েছি। তুই বস শালা বসের মতো থাকবি। তাও আমাকে গালি দিচ্ছে নাহয় মেনে নিলাম। বাবা, মা তুললি কেন?”
“তারপর?”
আমার এই প্রশ্ন শান্ত খুব মজা নিয়ে বলে,“তারপর আর কি। মাদার*** মুখ সামলে কথা বল, এটা বলে নাক বরাবর এক ঘুষি দিলাম। ব্যস তাতেই সব শান্ত।”
শান্তর মুখে গালি শুনে আমি কিছুটা হচচকিয়ে গেলাম। এটা বুঝতে পেরে শান্ত বলে,“এত ভালো সাজার ঢং করবেন না প্লীজ। এত ভালো মানুষে আমার এলার্জি আছে।”
“আচ্ছা। এলার্জি যখন আছে তখন দূরে যান। আপনাকে আমার সঙ্গে কথা বলতে কে বলেছে?”
“আবে শালা, আপনিই তো প্রশ্ন করলেন। তাই তো জবাব দিলাম।”
শান্তর এই কথা শুনে আমি চোখ বড় করে তাকালাম। অতঃপর বললাম,“আপনি আমাকে শালা বললেন?”
“হ্যাঁ। ও স্যরি। আপনি তো শালা শালী হবেন।”
”শান্ত?”
আমি কিছুটা রাগ নিয়ে বলতে শান্ত ভাব নিয়ে মুখ ভেঙচি দিলো। আমি পুরো থ হয়ে গেলাম। এত বড় আধ দামড়া ছেলের এসব বাচ্চামো দেখলে যে কারোরই রাগ উঠবে। কিন্তু ভদ্রতার জন্য আমি রাগটা প্রকাশ করতে পারলাম না। সেই সময়ে শান্ত বলে,“রাগ উঠলে রাগটা ঝাড়ুন। নিজেকে আর কত ঠকাবেন। রাগটা ঝেরে ফেলুন। দেখবেন খুব শান্তি লাগবে।”
আমি এই কথা শুনে কোন কথা বলতে পারলাম না। শান্ত নামক অশান্ত ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছেলেটি ততটা খারাপ না। কিছু কিছু কথা বলে যেগুলো ভালো লাগার মতোই। আমি নিজেকে সামলে বললাম,“মাত্র দুইবার চাকরি করলেন। আর কখনো চাকরির চেষ্টা করেননি?”
“না। ধুর। এত বিন্দাস জীবন কাটাচ্ছি। এখানে আবার ঐ চাকরি নামক মহামারীতে কে ঢোকে। আমি তো বরং চাকরির জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখন খুব খুশি আছি। চাকরি নিয়েই জীবনে ভুল করেছি। যেই কয় মাস চাকরি করেছি সেই কয় মাস নিজেকে ঠকিয়েছি। বসদের কথায় উঠতাম বসতাম। নিজের মনের কথা না শুনে মনকে ঠকিয়েছি। তাই এখন আর ওসব চাকরির প্যারা নিয়ে নিজেকে ঠকাতে চাই না। আমি খুব প্রাণোচ্ছল মানুষ। আমার কাছে নিজের মনের কথা শুনে সারাদিন আনন্দ কাটানোটাই জীবন। এখানে অন্যের জন্য নিজের আনন্দ বিসর্জন দেওয়া বোকামি। এই বোকামি আমি করতে চাই না।”
“এমন চিন্তা আপনার বয়সের সঙ্গে যায়? আপনি বিয়ে করবেন না? কেউ আপনার মতো বেকার মানুষের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিবে? তাছাড়া আপনার বাবা, মা এখন নাহয় দুজনে চাকরি করে সংসার চলে যাচ্ছে। তারা যেহেতু সরকারি জব করে তাই ধরে নিলাম আপনার জন্য অনেকটা টাকা জমা রেখে যেতে পারবে। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে কতদিন চলবে? বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায় জানেন তো? তারপর কী করবেন আপনি?”
আমার এই কথা শুনে শান্ত অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকায়। অতঃপর বলে,“একদম পাক্কা কাকি মা।”
“মানে?”
আমি কিছুটা বিরক্তির চোখে তাকিয়ে। শান্ত এটা দেখে বলে,“বিরক্ত হয়ে লাভ নেই। কাকি মা টাইপ আচরণ যতবার করবেন ততবার আমি আপনাকে কাকি মা বলে সম্মোধন করবো।”
“আচ্ছা। আপনার যা খুশি ভাবেন বলেন। কিন্তু আপনি যেমনভাবে জীবন কাটাতে চাচ্ছেন তেমনভাবে বাস্তবে সত্যি কাটানো সম্ভব নয়। এভাবে জীবন চলতে পারে। মানুষের জীবনকে পরিচালনা করতে হলে একটি লক্ষ্যের প্রয়োজন। সেই লক্ষ্য ধরে এগিয়ে যেতে হয়।”
“আমার লক্ষ্য আছে। প্রথম কথা হলো আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। এমনিতে আমি জানি আমার মতো ভবঘুরের সঙ্গে কেউ মেয়ে বিয়ে দিবে না। তবে আমার ইচ্ছেও নেই। কিন্তু বাবা, মায়ের একটি চাওয়া পাওয়া আছে। সেসব ভেবে যদি কখনো নিজের পছন্দমতো মেয়ে পেয়ে যাই তবে বিয়ের কথা ভাববো। আর সেই সময়ে ক্যারিয়ার নিয়েও ভাববো। কিছু একটা করে নিবো।”
“বাহ্। কি চমৎকার পরিকল্পনা।”
আমি কিছুটা ব্যঙ্গ করেই বললাম। শান্ত বুঝতে পেরে বলে,“জ্বী। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা ভেবে এখন জীবনটা তছনছ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমি আপনার মতো মহান এবং কাকি মা টাইপ জ্ঞান নিয়ে চলি না। ভবিষ্যতে যখন হবে তখন দেখা যাবে।”
”আস্ত পাগল।”
আমি বিরক্তি নিয়ে কথাটি বলে ছাদের একপাশে গিয়ে বসি। শান্ত তার স্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর আমাকে বলে,“আমিও একসময় কিছু একটা হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি উপলব্ধি করতে পারলাম ঐ স্বপ্নটা আমার সত্যি হবে না। তখন মন খারাপ হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে আমি বুঝলাম যা জীবনে পাবো না, কেউ আমার সঙ্গে খারাপ করেছে, আমি কাউকে ভালোবাসি সে আমাকে ভালোবাসে না, আমার বাবা-মা আমার মনটা বুঝতে পারছে না তারা শুধু তাদের দিকটা আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, এতসব বিষয় নিয়ে মন খারাপ করা বা কষ্ট পেয়ে বসে থাকা মানে সময় নষ্ট করা। নিজেকে ঠকিয়ে নিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করা। আমি সেটা এখন আর করি না। আমি সেই সময়টা মন খারাপ করে কাটানোর চেয়ে বরং তখন যে পরিস্থিতিতেই থাকি না কেন সেটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করি। এই যেমন আপনার সঙ্গে আমার যায় না, আপনি কাকি মা টাইপ তাও আমি এতটা সময় আপনার সঙ্গে ছিলাম। সেই সময়টা আমি কোন না কোনভাবে ইনজয় করেছি। কিন্তু আপনি করেননি। এটাই আমার এবং আপনার পার্থক্য। এই যেমন আপনি এই সময়টাকে উপভোগ না করে এখনো মন খারাপ করছে নিজের সঙ্গে যা খারাপ হয়েছে তা নিয়ে।”
আমি শান্তর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। শান্ত হাসি মুখে নিয়ে মজার ছলে বলে,“কাকি মা এবার তো নিজের বয়সের দিকে তাকান। মাত্র আটাশ বছর বয়স এতও আহামরি নয় যে নিজেকে কিশোরী ভাবা না গেলেও মহিলা ভাবা যায়। সো নিজের মন যা চায় সেটাই করুন। মনকে খুশি করুন।”
”আমি খুশিতে থাকি বা না থাকি তাতে আপনার কী আসে যায়?”
আমার প্রশ্নটি অহেতুক। তাও কেন জানি না করে ফেললাম। এটার জবাবে শান্ত মজা নিয়ে বলে,“আপনি খুশিতে থাকলে আমার জীবন থেকে একটা পাড়ার কাকি মা ধুর হবে। কেউ একজন তো আমার কাজের মধ্যে খারাপটা না খুঁজে ভালোটা খুঁজবে। কিন্তু খুশি না থাকলে তো সেই কাকি মা রূপ ধারণ করে সবসময় গুন্ডাকে ভোলাভালা নাদান বাচ্চা ভেবে আমার থাপ্পড়টাকে গুন্ডামি ভেবে বসে থাকবেন।”
“আপনি?”
আমি কিছুটা রেগে কথাটি বললে শান্ত লাফ দিয়ে তার মামার ছাদে চলে গেল। অতঃপর বলে,“স্যরি কাকি মা। আপনার ভাষণ শোনার ইচ্ছা নাই। বিদায় নিলাম। তাছাড়া আমার খাটাশ মামাটাও বাড়ি চলে আসার সময় হয়েছে। এসে আমাকে দেখলে আবার জ্ঞান দেওয়া শুরু করবে।”
এটা বলে শান্ত স্থান ত্যাগ করলো। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দুই সেকেন্ড ভাবলাম এখানে মাত্র কী হলো। অতঃপর শান্তর ছেলে মানুষিময় কথাগুলো মনে করে হাসতে শুরু করলাম। পরক্ষণে ভাবলাম,“ও আমার সঙ্গে কাটানো সময়টা উপভোগ কিভাবে করলো? আমার কথাগুলোকে অন্যভাবে নিজের বাচ্চামো স্বভাবের মতো করে ভেবে নিয়ে উপভোগ করার কথা বুঝিয়েছে?” এটা মাথায় আসতে আমি গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলাম।
___
আমি ছাদ থেকে বাসার ভেতর আসতে পাত্রপক্ষের একজন দেখে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি কে মা?”
আমি জবাব দেওয়ার পূর্বেই মা আমার হয়ে বললো,“ও আমার বোনের মেয়ে। কাজলের পাকা কথা হচ্ছে বলে চলে আসলো।”
আমি এই কথাটি শুনে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মা আমাকে বিরবির করে বললো,“চুপ করে যা মা। কিছু বলিস না। ঘরে অবিবাহিত বড় বোন আছে শুনলে তারা ভাববে আমাদের পরিবারে কোন খারাপ রেকর্ড আছে। তখন কাজলের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দেবে। আমি সেটা চাই না।”
এই কথায় আমি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললাম,“পাড়ায় যা রটিয়েছো তাতে তোমার মনে হয় এরা কিছু জানতে পারবে না? তোমার প্রতিবেশীরা ভালো নাকি? উল্টো মিথ্যা বলে বিপদে পড়লে মা। নিজের বিপদ নিজে ডাকলে। মিথ্যা ভালো কিছু বয়ে আনে না জীবনে।”
আমার সব কথা অগ্রাহ্য করলেও মা এই কথাটি নিয়ে কিছুটা ভাবলো। সে আফসোসো নিয়ে বিরবির করে বললো,“ঠিকই তো। পাড়ার কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তো তারা সত্যিটা বলে দিবে। আমি পুষ্পকে বোনের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়ে ঠিক করিনি। আমার কী করার, ভাবীরাই তো বললো। ঘরে অবিবাহিত বড় মেয়ে আছে জানলে তারা বিষয়টি দৃষ্টিকটু হিসাবে নিবে। বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই তো এমনটা করলাম। কিন্তু ঐ ভাবীরাই তো দুমুখো সাপ। ওরাই যদি আমার বিয়েতে ভাঙানি দেয়। আমি যে এই বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে ভাবলাম না।”
’
’
চলবে,