ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-১১+১২

0
21

#ইচ্ছেঘুড়ি (১১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বেশ কিছুদিন কেটে যায়। আমার সময়টা বেশ ভালো কাটছে৷ জীবনে চলার পথে শান্তর মতো একজন বন্ধু পেয়ে আমি সত্যি খুব খুশি। শান্তর সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তাতে তাকে একরোখা, জেদী এবং ছেলে মানুষ মনে হতো। এখন তার সঙ্গে মিশে বুঝতে পারছি, সে কতটা বিচক্ষণ মানুষ। তার প্রতিটি কথা আমাকে মুগ্ধ করে। আমার জীবনকে নতুনভাবে চিনতে শিখিয়েছে আমায়। জীবনে প্রথমবারের মতো তাই একটি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। আমি আমার এই মাসের বেতনের টাকার থেকে কিছু টাকা নিজের জন্য রেখে দিলাম। শান্তর ধার শোধ করতে হবে, সেই সঙ্গে ছুটির দিনে বাসায় বসে না থেকে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা হৃদয়ে পোষণ করেছি। যদিও এই কয়েকদিন বন্ধের দিনে শান্তর সঙ্গে এলাকার কাছাকাছি খুব ঘুরেছি। তার সঙ্গে অনেক বাচ্চামোও করেছি। প্রথমদিকে এগুলো বাচ্চামো মনে হলেও পরবর্তীতে খুবই চমৎকার লেগেছে। তবে এবার আমি সেই প্রথম দিনের মতো সারাদিন ঘোরার কথা ভেবেই বেশ অনেকটা টাকা নিজের কাছে রাখলাম।

কিছু টাকা হাতে রেখে বাকি টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতে সে টাকাগুলো গুনে আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,“এত কম টাকা কেন? তুই তো অফিস বন্ধ দিসনি তাহলে এত কম টাকা দিলো কেন?”

“এই মাসে এই টাকাই পেয়েছি। বাকি টাকা অফিস কেটে রেখেছে।”
আমার কথা শুনে মা অনেকটা অবাক হয়ে যায়। জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি শান্ত গলায় বললাম,“অফিসে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেই সমস্যার সমাধানের জন্য সবার থেকে কিছু টাকা কেটে রেখেছে। যেটা আমাদের পরে দিবে বলে জানিয়েছে।তবে মনে হয় না পরে এটা পাবো।”

”কি!”
মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। মাকে বিশ্বাস করানোর জন্য আমি শান্তভাবে বলি,“এটাই সত্যি।”
মাকে আমার কথা বিশ্বাস করাতে আমি শান্তকে ফোন দেই। তার নাম্বারটা আমি আগেই বস হিসাবে সেইভ করে নিয়েছিলাম। তাকে ফোন দিয়ে আমি শান্তভাবে খুব ছোট করে বুঝিয়ে দেই এই মূহূর্তে সে আমার অফিসের বস। আমার কথায় সে পুরোটা বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করে নেয়। তাই মা এসবের সত্যতা জানতে চাইলে সে এসব সত্যি বলে। মা ফোন রেখে বলে,“অফিসের সমস্যা অফিস কর্তৃপক্ষ সমাধান করবে। এখানে কর্মচারীদের বেতন কেন কাটবে? এটা তো অন্যায়। এই নিয়ে তোরা প্রশ্ন তুলিসনি?”
এভাবে মা অনেকগুলো প্রশ্ন করে। আমি খুবই শান্তভাবে সবগুলো প্রশ্নের জবাব দেই। অবশ্যই সব মিথ্যা। মাকে বিশ্বাস করানো কঠিন ছিলো তবুও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাগুলো বহু কষ্টে বিশ্বাস করাই। অবশেষে মা মেনে নেয়। অতঃপর বলে,“পরের মাসে পুরো টাকা যেন হাতে পাই।”
একটু থেমে পরক্ষণে বলে,“কাজলের জন্য পাত্র খুঁজছি। বিয়ে ঠিক হলো প্রচুর খরচ। বুঝতেই তো পারছিস। তাই এভাবে বলছি। আবার বলিস না মা ভালোবাসে না। আজকাল তো এটা বলতে শিখেছিস।”
মায়ের মুখে এই কথা শুনে জবাব না দিয়ে আমি চুপ করে থাকি।

___
শান্তর বাবা তার মায়ের উপর প্রচন্ড রেগে যায়। সে রাগান্বিত গলায় বলে,“তোমার ছেলে বললো আর তুমি মেনে নিলে তোমার ছেলে এই কাজটি করবে। তাই তুমি টাকা দেওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলে। আদৌ এসব সম্ভব? তোমার ছেলে আদৌ এসব বোঝার মতো মানুষ। পাড়ার মোড়ে আড্ডা দেওয়া ছাড়া তোমার ছেলে আর কিছু পারে। তুমি কোন ভরসায় তাকে এত টাকা দেওয়ার কথা বলছো আমাকে।”

“ও পারবে। একটু ভরসা রাখো ওর উপর।”
শান্তর মায়ের এই কথা শুনে তার বাবা আরও রেগে যায়। সে কঠিন গলায় বলে,“দেখো আমি স্পষ্ট ভাষা জানিয়ে দিচ্ছি কোনভাবেই তুমি কোন টাকা তুলবে না। এতদিনের কষ্টে জমানো টাকা এভাবে নষ্ট করার কথা ভাববেও না। তোমার ছেলের দ্বারা এসব হবে না। এত ধৈর্য তোমার ছেলের নেই।”
শান্তর মা যতই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে বুঝতে চায় না৷ এক পর্যায়ে ঘরের ভেতর থেকে শান্ত বের হয়ে আসে। সে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলে,“তোমরা যদি চাও আমি এভাবে পাড়ার মোড়ে বসে বখাটেপনা না করি তবে আমার কথা মেনে নাও। আর যদি না মানো তবে আমি সারাজীবন এমনই থাকবো। কখনো বদলাবো না। তখন তোমাদের জমানো টাকা তোমাদের ম রার পর আড্ডাবাজি দিয়েই শেষ করবো। এখন সিদ্ধান্ত তোমাদের হাতে। ভেবে দেখো কী করবো।”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে তার বাবা হতভম্ব হয়ে যায়। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,“হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিলে কেন?”

“আমার সব বন্ধুরা চাকরি নিয়ে নিয়েছে। কেউ বা বিদেশ চলে গিয়েছে। সেজন্য একা হয়ে পড়েছি। পাড়ার মোড়ে দোকানে বসে আগে যে মজা পেতাম এখন তা পাই না। এখন তো তোমার মতো মধ্য বয়সী বুড়োগুলো বসে কার মেয়ের বিয়ে হলো, কার মেয়ের বিয়ে ছাড়া বাচ্চা হলো সেসব আলোচনা নিয়ে বসে থাকে। এসব শুনতে কার বা ভালো লাগে? তাই ভাবলাম কিছু একটা করি। নতুন শহরে গিয়ে বন্ধু বানাই। সেই বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজিও হবে, কাজও হবে।”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে শান্তর বাবা বেশ গম্ভীর গলায় বলে,“বুঝলাম। এই পাড়ায় আমার বদনাম করে হচ্ছে না। এখন অন্য পাড়ায় যাবে। তাই তো?”

“না গো। এখানে বসে তোমার বকবক শুনতে চাই না বলেই তো অন্যত্র যেতে চাচ্ছি। তাই ওখানে গিয়ে অহেতুক নিজের ঝামেলা বাড়াতে কেন বলবো যে তুমি আমার বাবা? আর আমি যদি তোমার কথা কাউকে নাই বলি তবে তোমার বদনাম কিভাবে হবে?”
শান্তর হাসিমুখে বলা কথাগুলো শুনে তার বাবা রেগেমেগে তার দিকে তেড়ে আসলে তার মা থামিয়ে দেয়। শান্ত এটা দেখে হাসতে হাসতে বলে,“এই বয়সে তোমার এত রক্ত গরম ভালো লক্ষণ নয়। নিশ্চয় শরীরে এত এত রোগ বাঁধিয়ে রেখেছো। যাও গিয়ে ডাক্তার দেখাও। অবশ্যই তার আগে আমার টাকাটা দিয়ে যেও। পরে দেখা যাবে আমাকে বকে বকে এমন রোগ বাঁধিয়েছো যে সব টাকা সেখানেই চলে যাচ্ছে। তাই আগেই আমার টাকাটা দিয়ে যেও।”

”আচ্ছা তোর কথা মেনে নিলাম। মনে কর আমার বড়সড় রোগ হয়েছে, আমার চিকিৎসা না হলে আমি মা রা যাবো, সেখানে টাকা লাগবে। এখন তুই যে টাকাটা চাচ্ছিস সেটাও লাগবে। সেক্ষেত্রে তুই ঐ টাকা নিয়ে কী করবি?”
বাবা অনেকটা বিরক্তি এবং রাগ নিয়ে কথাটা বলে। বাবার এমন অদ্ভুত কথা শুনে শান্ত মজা নিয়ে বলে,“অবশ্যই আমার টাকা নিয়ে কোন নিরাপদ স্থানে যাবো। যতক্ষণ না তুমি পটল তুলছো ততক্ষণে আর আসছি না। নয়তো আমার টাকার শোকে আমাকে পটল তুলতে হবে। না বাবা। এই রিস্ক নেওয়া যাবে না।”

”শান্ত?”
বাবা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে কথাটি বলে। শান্ত হাসতে হাসতে ঘর থেকে বাহির হয়ে যায়। এটা দেখে তার বাবা মাকে বলে,“শুনেছো তোমার ছেলের কথা। কতবড় বেয়াদব ও। বাবার মৃ ত্যু কামনা করে।”

”ও নাহয় বেয়াদব কিন্তু তুমি তো পাগল। পাগল নাহলে শান্ত কী একটা কথা বললো সেটা ধরে নিজের শরীরে মরনব্যধি বানিয়ে ফেললে। বাহ্।”
মায়ের এই কথা শুনে বাবার হুঁশ ফেরে। সে মনেমনে ভাবে ঠিকই তো। শান্তর ফালতু কথা শুনে সেও তো ভুলবাল বকলো। এটা বুঝতে পেরে সে নিজের উপর বিরক্ত হয়ে বলে,“তোমার আধ দামড়া ছেলেটা আমার পাগল করে দিচ্ছে।”
__
আমি শান্তর দিকে টাকা এগিয়ে দিতে শান্ত হেসে বলে,“এগুলো লাগবে না।”

“কেন?”
আমার এই কথার জবাবে শান্ত হাসে। অতঃপর বলে,“যেদিন মিথ্যা নয় সত্যি বলে টাকা নিয়ে আসবেন সেদিন টাকা নিবো। নয়তো না। ততদিন অব্দি ঋনী হয়ে থাকুন।”
শান্তর এই কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। মন খারাপ করে বললাম,“তাহলে হয়তো ধার শোধ হবে না।”

”হবে। নিশ্চয়ই হবে।”
এটা বলে শান্ত হাসিমুখে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,“এগুলো দিয়ে নিজের যেটা খেতে ইচ্ছা করে সেটা খান। যেটা কিনতে ইচ্ছা করে কিনুন। আর বাকিটা রেখে দিন, শুক্রবার আপনাকে নিয়ে নতুন এক জায়গায় ঘুরতে যাবো। এবার সব টাকা আপনাকেই দিতে হবে।”
আমি শান্তর কথায় রাজি হয়ে গেলাম। শান্ত ম্লান হেসে বলে,“আমি না থাকলে আমাকে মিস করবেন?”

“আপনি সবসময় এই কথাটা কেন বলেন? কোথায় যাবেন আপনি?”
আমার এই প্রশ্নের জবাবে শান্ত খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে,“আমার চাচার কাছে। সে অন্য শহরে থাকে। আমি সেখানে গিয়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কারণ আমি যে শান্তকে চিনি তার দ্বারা কাজবাজ হবে না। এটাই মনে হয়েছিলো আমার। এটা বুঝতে পেরে শান্ত হেসে বলে,“আমার সব বন্ধুরা ব্যস্ত হয়ে গেছে। তাই আমাকেও হতে হবে। আমি অন্যের অধিনে চাকরি করতে পারবো না এটা আমি বুঝে গেছি। তাই ব্যবসার কথা ভাবলাম। তবে হ্যাঁ এটাও জানি ব্যবসাও অনেক ধৈর্যের।যেটাও আমার নেই। কিন্তু আমি সমাধান বের করে ফেলেছি।”
আমি সমাধান বুঝতে না পেরে শান্তর দিকে তাকিয়ে থাকি। শান্ত আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলে,“সমাধান হলো আমি যেটা পারি সেটাই করবো। আপনার আমাকে যা মনে হয়ে যে আমি বাচ্চামো করে বেড়াই। তো আমি সেই বাচ্চামো করেই আমার ব্যবসা ধার করাবো। আমি কাপড়ের দোকান দিতে যাচ্ছি। তো সবার সঙ্গে আমি সেভাবেই কথা বলবো এখন যেভাবে বলছি। আমি সেটাই করবো মন যেটা চায়। মন যেভাবে চায় সেভাবে কাপড় বিক্রি করবো। যেহেতু দোকানটা আমার নিজের হবে সেহেতু আমি যেভাবে চাইবো সেটাই করতেই পারবো। পরবর্তী এই ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে একটা শোরুম নিয়ে নিবো। কিন্তু যদি না দাঁড়ায় তবে বাদ দিয়ে দিবো।”

“আপনার সব কথার সাথে সহমত হলেও এটায় পারলাম না। একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। সেই সাথে লাভ লস থাকবেই। কিন্তু আপনি যা বলছেন তাতে আপনার মন যখন বলবে এই কাজটা বোরিং লাগছে তখনই আপনি এটা বাদ দিবেন। মানে বাবা-মায়ের যে এত টাকা নষ্ট করছেন সেটা নিয়ে আপনার কোন চিন্তাই হচ্ছে না বা হবে না। এই ভাবনার সঙ্গে সম্মতি জানাতে পারলাম না। স্যরি।”
আমার এই কথা শুনে শান্ত বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,“আপনাকে পরিবর্তন করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। যাই হোক আমি যেভাবে পারি সেভাবে কাজ করবো। যদি না পারি বা আমার লস নিয়ে আপনার এত চিন্তা থাকে তবে আপনি নাহয় আমাকে সাহায্য করতে চলে আসবেন। বিনা পয়সা আমার দোকানে কাজ দিয়ে যাবেন। যে পরিশ্রম, ধৈর্যটা আমি দেখাচ্ছি না সেটা আপনি দেখিয়ে আমার ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে দিবেন।”
এই মূহুর্তে দাঁড়িয়েও শান্ত মজা নিচ্ছে বুঝতে পেরে আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। আমার বিরক্তি বুঝতে পেরে শান্ত হেসে বলে,“মজা লাগলো না?”
আমি নাসূচক মাথা নাড়াতে শান্ত বলে,“আপনার কাকি মা টাইপ জ্ঞানও আমার মজা লাগে না।”
এই ছেলেকে বোঝানো আমার দ্বারা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে আমি মাথায় হাত দিলাম। এটা দেখে শান্ত শব্দ করে হেসে দেয়। সেই হাসির সঙ্গে এমন ভাবভঙ্গি করে সামনে এসে যে না চাইতে আমিও হেসে দেই।

আমাদের দুজনের এইসব কর্মকান্ড দেখে দুজন মহিলা একে-অপরকে বলে,“এদের আজকাল বড্ড একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে না?”

“হ্যাঁ। কিন্তু মেয়েটার তো ওসব আগ্রহ নাই। মানে ছেলেদের থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। তবে এরা তো বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছি বেশ গল্প করে। বিষয়টি কিছুটা গড়মিলে লাগে না তোর?”
অন্যজন মাথা নাড়ায়৷ তারা এভাবে আমাদের নিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে। তাদের কথা বুঝতে না পারলেও তাদের আড়চোখে তাকানো দেখে আমি বুঝলাম আমাদের নিয়ে কথা বলছে। এটা বুঝতে পেরে আমি হাসি থামিয়ে ফেললাম৷ তাদের দুজনের তাকানো দেখে কিছুটা সংকোচ বোধ হলো আমার। এটা দেখে শান্ত বললো,“এতদিনেও আমি আপনাকে এদের এড়িয়ে যাওয়া শেখাতে পারলাম না।”
এটা বলে শান্ত এবার মাথা হাত দেয়। সেভাবেই যেভাবে একটু আগে আমি দিয়েছি। এটা দেখে আমি আবার হেসে দিলাম। শান্তও হাসি দিলো।


চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#ইচ্ছেঘুড়ি (১২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

ধীরে ধীরে আমার দিনগুলো রঙীন হয়ে উঠছে। সময় বেশ সুন্দরভাবে কেটে যাচ্ছে। ছুটির দিনে শান্তকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম ঘুরতে। প্রথমে অবশ্য মা এসব নিয়ে প্রশ্ন করছিলো। তাকে মিথ্যা বলে কাটিয়ে নেই। ইদানীং মাকে প্রচুর মিথ্যা কথা বলছি। নিজের এই পরিবর্তন নিয়ে আমার খুব ভয় হতো। এভাবে মিথ্যা বলা ঠিক হচ্ছে না। সেই সঙ্গে সত্যিটা জানলে বাবা-মায়ের আচরণ কেমন হবে সেটা ভেবেও ভয় পেতাম। যদিও এই ভয়টা বেশিক্ষণ থাকতো না। শান্ত এই ভয় কাটাতে খুব সুন্দরভাবে বলে,“নিজের জন্য ভাবাটা ভুল নয়। যদি সত্যি বলে সেটা নাহয় তবে মিথ্যা দিয়েই নাহয় হলো। এখানে ভুলের কী আছে? ভুল তো এতদিন করতেন নিজের জীবন অন্যের কথামতো চালিয়ে।”
শান্তর কথায় আমি আমার ভয় কাটিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করতে শিখেছি। জীবনে চলার পথে প্রতিটি মানুষের এমন এক বন্ধুর প্রয়োজন। যে তাকে বাঁচতে শেখাবে। কিন্তু সবাই তো এমন ভাগ্যবান হয় না। তাই সবার জীবনে শান্তর মতো বন্ধু আসে না। আমি মুগ্ধ নয়নে শান্তকে দেখে এসব কল্পনা করছিলাম। শান্তর ডাকে কল্পনা থেকে বের হয়ে আসি। অতঃপর বলি,“আজ আমরা কোথায় যাবো?”

“বিনা দাওয়াতে বিয়ে খেতে যাবো।”
শান্তর এই কথায় আমি হচচকিয়ে গেলাম। কিছুটা সংকোচ নিয়ে বললাম,“এটা তো ঠিক নয়।”

“এত ঠিক ভুল ভাবলে চলবে?
জীবনে এরকম কিছু পাগলামোর দরকার রয়েছে। পরবর্তী সময়ে এসব ভেবে হাসতে তো পারবো।”

“কিন্তু?”
শান্ত যতই বোঝাক আমার কিছুটা ভয় করছিলো। সেই সঙ্গে আমাদের বয়সের সঙ্গে এসব পাগলামো একদমই যায় না। এসব কথা শুনে শান্ত হাসতে হাসতে বলে,“আপনার বয়সের সঙ্গে বাবা, মায়ের কথায় ওঠা বসাও যায় না। নিজেকে নিয়ে মিথ্যা রটে যাচ্ছে সমাজে সেটা চুপ করে হজম করাও যায় না। আপনার বয়সের অন্যকোন মেয়ের সঙ্গে এমন হলে এতদিনে সবাইকে বুঝিয়ে দিতো মজা। কিন্তু আপনি? ঝামেলা হবে এই ভয়ে সবার কথা হজম করে ঘরে গিয়ে কান্না করেন। এটাও আপনার বয়সের সাথে যায় না। একদমই যায় না।”

আমি এসব কথা শুনে চুপ করে যাই। এসব কথায় আসলে জবাব দিবো কী ভেবে পাই না। শান্ত এসব বুঝতে পেরে বলে,“চলেন। দাওয়াত দেওয়া বিয়ে তো অনেক খেলেন এবার দাওয়াত ছাড়া একবার খেয়ে দেখুন।”
এটা বলে শান্ত আমার হাত ধরে একটি রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশায় উঠে অব্দি শান্ত আমার হাতটি ধরে ছিলো। আমি তার ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শান্ত সেটা দেখেও দেখলো না। অতঃপর একটি বিয়ে বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামে। শান্ত আমাকে নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়লো। পুরো বিয়ে বাড়িতে সবাই অপরিচিত। এত অপরিচিত মানুষের ভিড়ে ভীষণ ভয় কাজ করছিলো। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি কেউ এসে বলে,“তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।”

আমি এই ভয় নিয়ে থাকলেও শান্তর মাঝে তেমন কিছু ছিলো না। বরং সে নিজ উদ্যেগে সবার সঙ্গে ভাব জমাচ্ছিলো। শান্ত প্রাণোচ্ছল মানুষ হওয়ায় খুব সহজেই সবার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলো। আমি শুধু তাকিয়ে তার কান্ডই দেখে যাচ্ছিলাম। তবে আমার চোখেমুখে ভয় ছিলো। এটা দেখে শান্ত কানের কাছে এসে বিরবির করে বলে,“এভাবে চোরের মতো করলে লোকে আপনাকে চোর ভেবে গনধোলাই দিবে। এজন্যই বলে চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ো ধরা। চুরি করছেন করেন। কিন্তু মুখের ভাবভঙ্গিতে এসব ধরা পড়া যাবে না। নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসুন। মনেমনে বলুন, আমি চোর নই।”
এই সময়ে দাঁড়িয়ে শান্তর এসব মজা আমার খুবই বিরক্ত লাগছিলো। শান্ত সেটা বুঝতে পেরে ভেঙচি দিয়ে বিয়ে বাড়ি উপভোগ করতে বরের কাছে চলে গেলো। সেখানে গিয়ে খুবই ভাব নিয়ে কথা বললো। বরপক্ষ তার হাবভাব দেখে মনে করলো কনেপক্ষের অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন অতিথি।

বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষণ ভেতরে ভয় লাগলেও এখন মাত্র কী কান্ড করে আসলাম এটা ভাবতেই অন্যরকম লাগছে। বেশ ভালো লাগছে। খুব একটা খারাপ অনুভূতি ছিলো না। এটা ভেবে খুশিমনে হাঁটছিলাম। আমি শান্তর থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়। সেই মূহুর্তে একটি ছেলে ঝড়ের বেগে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে চলে যায়। কিছুটা যেতে মুখ ঘুরিয়ে বলে,“স্যরি মিস।”
এই বিষয়টি লক্ষ্য করে শান্ত ছেলেটিকে একটি গালি দিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। শান্ত যে আমার সঙ্গে সেটা ছেলেটি বুঝতে পারে নাই। শান্তর গালি শুনে সেটা বুঝতে পেরে দৌঁড় দেয়। শান্ত ছেলেটার পিছু নিতে নিলে আমি তাকে ধরে ফেলি। তার হাত ধরে বলি,“এসব বাদ দিন প্লীজ।”

এটা দেখে শান্ত বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকায়। অতঃপর বলে,“ছাড়ুন হাত।”
শান্ত কিছুটা উচ্চশব্দে কথাটি বলতে আমি হাত ছেড়ে দিলাম। ইতিমধ্যে ছেলেটি অনেক দূরে চলে যায়। শান্ত এটা লক্ষ্য করে রাগী কন্ঠে বলে,“এভাবে চুপ থাকতে থাকতে এদের মাথা আপনারাই বিগড়ে দিয়েছেন। এরা এখন ইভটিজিংকে কিছু মনেই করে না। করবে কেন? আপনাদের শরীরের সঙ্গে বিভিন্ন অজুহাতে স্পর্শ করে যদি মাফ পাওয়া যায়। তাহলে এটাকে অন্যায় বা ভুল মনে হবে কেন? এটা তো দুধভাত।”
শান্ত এখানে আরও অনেক কথা বলে। সেগুলো শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। তবে মনেমনে ভাবি, সত্যি কি এত সহজ। এত সহজে মেয়েরা এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতে পারে। রোজ রাস্তাঘাটে বিভিন্নভাবে মেয়েরা হেনস্তার শিকার হয়। কিন্তু চাইলেই প্রতিবাদ করা যায়? যায় না। বরং যে মেয়ে প্রতিবাদ করে সেই হয়ে যায় খারাপ। দিনশেষে তার মান সম্মানটাই যায়। আমি শান্তর কথার জবাবে এসব বললে শান্ত বলে,“ভালো হয়ে লাভ কী? যদি খারাপ হয়ে সমাজে কিছু পরিবর্তন করা যায়। যদি ভালো হতে অন্যায়কে অন্যায় বলতে না পারা যায় তবে খারাপ হওয়াই ভালো।”
এসব বলে শান্ত হাঁটা ধরে। আমিও তার পিছনে হাঁটতে থাকি। কিছুটা পথ যেতে রিকশার দেখা মেলে। আমরা দুজন রিকশায় উঠে পড়ি।

____
কাজল পাড়ার মোড়ের দোকানে আসতে একজন প্রতিবেশী বলে,“কী রে কাজল তোর বিয়ের কোন খবর আছে? একবার তো ভাঙলো বিয়ে।”
অন্য একজন খুবই সুন্দরভাবে ঢং করে বলে,“কর সুন্দর মেয়ে! তার কপালেই বিয়ে ভাঙা লেখা ছিলো। এখন তো মনে হয় ভালো পাত্র আর পাওয়াও যাবে না। তার উপর তোর বোন যে রঙঢঙ করছে। তাতে মনে হয় না তোর বিয়েটা আদৌ হবে।”
কাজল কথার জবাব না দিয়ে তাদের দিকে শান্ত চোখে তাকায়। তারা বলেই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে বলে,“তোর বোনকে তো আজকাল বখাটের সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখা যায়। যদিও জানি ওসব সক্ষমতা ওর নেই। তবে বখাটে ছেলেদের সঙ্গে কী করে বুঝি না।
ওর জন্যই তোর জীবনটা খারাপ হচ্ছে। তোর জন্য বড় আফসোস হয়।”

“হ্যাঁ খুব আফসোস হয়। সেই আফসোসের জন্য তো সারা পাড়া এসব বলে বেড়াচ্ছো। রসিয়ে কষিয়ে আমার বিয়েটা কিভাবে ঠিক হয়ে ভাঙলো সেসব বলে যাচ্ছো? আমার আপার আদৌ কোন সমস্যা রয়েছে কি-না সেটা না জেনেই পুরো এলাকায় রটিয়ে দিয়েছো। এখন এই খবর রটিয়ে দেওয়ায়, পাড়ার বখাটের সঙ্গে আমার আপার গভীর সম্পর্ক রয়েছে সেটা রটাতে পারছো না বলে খুব আফসোস হচ্ছে। সেজন্য আমাকে নিয়ে পড়েছো তাই না কাকী মা?”
কাজল কিছুটা ব্যঙ্গ করে কথাগুলো বলে। তার কথা শুনে দুজনেই চুপ হয়ে যায়। কাজল হাসিমুখে প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলে,“খুব আফসোস হচ্ছে আমার আপাকে ওর সঙ্গে কুকর্ম করতে দেখছো এটা রটাতে পারছো না। সেটা নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে তাই না?”

“এসব কী বলছিস বেয়াদবের মতো?
আমরা তো তোর ভালোর জন্যই বলছিলাম।”
তাদের এই কথা শুনে কাজল কঠিন গলায় বলে,“তোমরা যে মানুষের কত ভালো চাও সেটা আমি খুব ভালোভাবেই জানি। আর রইলো আমার বিয়ের কথা। সেটা নিয়ে আফসোস না করে যখন পাত্রপক্ষ আসবে তখন মুখটা একটু বন্ধ রাখলেই পারো। তাহলে আর আফসোস করতে হয় না।”
কাজলের মুখের কথা শুনে দুজনেই মনেমনে বলে,“এই মেয়ের তো মুখের চোপা কম না। একদম মায়ের মতো হয়েছে। কিন্তু বড়টা ওমন নয়। তাই তো কথা বলে মজা পাওয়া যেতো।”
তাদের মনের কথা কাজল উপলব্ধি করে পেরে বলে,“হাতের পাঁচ আঙুল তো সমান হয় না। তাছাড়া তোমাদের রঙতামাশা বহুত দেখেছি। আমার আপার পিছনে এতদিন লাগতে সে তো নরম মনের তাই কথার তীরে তীরে তাকে পিষে মে রেছো। এখন যেই দেখছো মজা পাওয়া যাচ্ছে না। সব টপিক শেষ। তখন এসেছো আমাকে পিষতে। তবে হ্যাঁ সাবধান। আমি আপার মতো নই যে তোমরা পিষতে আসবা আর পিষে যাবো। আপার জায়গায় আমি থাকলে এতদিনে এই পাড়ায় হুলস্থুল বেঁধে যেতো। তোমাদের কপাল ভালো। এটা ভেবে ভালো থাকো। অন্যের নামে পরনিন্দা পরচর্চা না করে একটু পরকালের কথাও ভাবো। নয়তো নিজেদের কথা ভাবো। তোমাদেরও কেচ্ছা কম শোনা যায় না। পাড়ায় কান পাতলে অনেককিছু শোনা যায়।”
এটা শুনে দুজনেই কেটে পড়ে। এই মেয়ের সঙ্গে যে কথায় পারা যাবে না সেটা বুঝতে পেরে আগেই চলে গিয়েছে। কাজল তাদের চলে যাওয়া দেখে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে থাকে। বিরক্তি নিয়ে বলে,“সারাদিন অন্যের কানে বিষ ঢালা ছাড়া কোন কাজ নেই।”

”একটু শুনবেন….।”
কারো ডাকে কাজল পিছন ঘুরে তাকায়। সামনে একজন সুদর্শন পুরুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়। এই এলাকায় একে আগে কখনো দেখেনি। সেই মূহুর্তে ছেলেটি বলে,“আপনি যদি রেগে না যান একটা কথা বলবো?”

“হ্যাঁ বলেন?
আপনার সঙ্গে আমার কিসের লেনা দেনা যে আমি রাগ করবো?”
কাজলের মুখে এই কথা শুনে ছেলেটি আমতা আমতা করে বলে,“না মানে। একটু আগে আপনি যেই রাগ নিয়ে তাদের কথা শোনালেন তাই একটু…।”
কাজল ছেলেটিকে থামিয়ে দিয়ে বলে,“ফালতু না বকে আসল কথা বলুন। কী বলতে চাচ্ছেন?”
ছেলেটি একটি ঠিকানার কথা বলে নরম গলায় বলে,“যদি দেখিয়ে দিতেন এই বাড়িটা কোথায় তাহলে ভালো হতো।”

”এখানে নতুন?”
ছেলেটা মাথা নাড়ায়। অতঃপর বলে,“আসলে তিনি আমার বাবার বন্ধু। বাবার সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ নেই। বাবা তার কন্টাক্ট নাম্বার জানে না। তবে তার বাড়ির ঠিকানা জানতো। তাই আমাকে পাঠালো। আসলে আমার বাবা খুব অসুস্থ, তার এখন নিজের বন্ধুর কথা খুব মনে পড়ছে। সেজন্যই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে আসছি। আপনি ঠিকানাটা চিনেন?”

“হ্যাঁ চিনি।”
এটা বলে কাজল একটু এগিয়ে এসে তাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিলো। এখান থেকে কোথায় যেতে হবে। এটা দেখে ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বলে,“ধন্যবাদ।”
কাজল কোন জবাব না দিয়ে চলে আসে। ছেলেটি একবার কাজলের বলে দেওয়া রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। পরক্ষণে কি মনে হতে পা ঘুরিয়ে সে কাজলের পিছু নেয় এবং কাজলের বাড়িটা দেখে নেয়।
___
অনেকটা সময় কেটে যায়। দেখতে দেখতে শান্তর চলে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে। তার বাবা তাকে ব্যবসার জন্য টাকা দিতে রাজি হয়েছে। আগামীকাল সে তার চাচার কাছে চলে যাবে। যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে ছাদে এলো শান্ত। আমাকে ফোন দিয়ে আগেই বলে দিয়েছিলো। তাই আমি ছাদে আগে থেকেই বসে ছিলাম। শান্ত রাত পেরিয়ে গেলেই চলে যাবে এটা ভেবে কিছুটা খারাপ লাগছিলো। শান্ত আমার মন খারাপ দেখে ম্লান হেসে বলে,“বন্ধু হিসাবে আমি খুব চমৎকার তাই না?”
আমি মাথা নাড়াতে শান্ত খুশি মনে বলে,“আমি জানি। আপনি না বললেও।”

“আচ্ছা আপনি এই শহরে ব্যবসাটা শুরু করতে পারতেন না?”
আমার এই কথায় শান্ত একটু সময় চুপ থাকে। অতঃপর বলে,“আমার চাচার এই ব্যবসা। সে এসব সম্পর্কে ভালো বুঝবে। তাই তার কাছে যাচ্ছি। দ্বিতীয়ত এই এলাকায় আমার এত বদনাম যে আমি এখানে দোকান দিলে দেখা যাবে আমার দোকানে কাস্টমার আসার আগে সবাই আমার নামে গিয়ে বদনাম করে আসবে। এতবড় ঝুঁকি নেওয়া ঠিক বলেন? তার উপর কেউ তো বিশ্বাসই করতে চাইছে না যে আমি এই ব্যবসা দাঁড় করাতে পারবো। আমার বাবা তো এখন থেকেই টাকার শোকে কান্না করতে শুরু করেছে।”
এটা শুনে আমি মৃদু হাসলাম। শান্তও হাসি দিলো। পরক্ষণে শান্ত হয়ে বললো,“আজ আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই। আশা করি এই কথাগুলো আপনার জীবনে কাজে লাগবে। সেই সাথে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার কী করা উচিত? এতদিন নাহয় আমি ছিলাম তাই আপনি সাহস করে মিথ্যা বলে হোক বা কিছু একটা করে হলেও অনেকটা পরিবর্তন এনেছেন জীবনে। তবে আমি জানি, আমি চলে যাওয়ার পর আপনি আবার একইরকম জীবন কাটাবেন। তাই আমি আপনাকে আজ আমার জীবন সম্পর্কে কিছু জানাতে চাই। আশা করি আপনার এসব কথা কাজে লাগবে।”
আমি অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকাই। শান্তর জীবন সম্পর্কে তো আমি জানিই। আর কি জানার আছে। আমার মনের কথা বুঝতে পেরে শান্ত বলে,“আরও জানার আছে। আমি যদি খুব একটা ভুল না হই তবে আপনি হয়তো জীবনে দুই একবার নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছেন। এসব পথে পা না বাড়ালেও ভেবেছেন নিশ্চয়।”
একটু থেমে শান্ত বলে,“একটা সময় আমারও মনে হতো জীবনটা শেষ করে দেই। আমার মৃ ত্যুই আমার মুক্তির পথ। আমার মনে হয় এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষ আছে যারা জীবনে হতাশ হয়ে এসব কথা ভাবেনি।অনেকে তো নিজেকে সামলাতে না পেরে আত্ম হত্যা করেও নেয়। কিন্তু বাস্তবতা কী জানেন? আত্ম হত্যা করে কেউ কখনো মুক্ত হতে পারে না। বরং সে নিজেকে ঠকিয়ে নিজের জীবনকে এক ভয়ানক জায়গা পাঠিয়ে দেয়। অথচ সে যাদের জন্য এসব করেছে বা করছে তারা কিন্তু পৃথিবীতে ভালোই থাকে। হয়তো দুই চারদিন তার জন্য শোক পালণ করে। তারপর ঠিকই ভুলে যায়। তাদের জীবন তাদের মতো করে এগিয়ে যায়। যেই জীবনে সেই মানুষটি একজন মৃ ত ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়। যার অস্তিত্ব তার জীবনে বিলীন হয়ে গেছে।”
আমি শান্তর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যাই। আমি লক্ষ্য করলাম শান্তর মুখে সেই হাসিটি নেই যেটা সবসময় থাকে। সিরিয়াস কথা বলার সময়ও যার ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হতো না আজ তার ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। শান্তকে দেখে এই মূহুর্তে খুবই সিরিয়াস মনে হচ্ছে। আমি শান্তর এমন রূপ দেখে বিষ্মিত হয়ে যাই।


চলবে,
(ভুলক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)