#ইচ্ছেঘুড়ি (২৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
জয় কাজলের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরতে কাজল নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে যায়। জয় কিছুটা বিরক্ত হয়। কাজল জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,“যে ভালোবাসা বেডরুম অব্দি সীমাবদ্ধ সেই ভালোবাসা প্রকাশ করার প্রয়োজনটা কী?”
কাজলের মুখে এই কথা শুনে জয় কিছুটা হচচকিয়ে যায়। অতঃপর নিজেকে সামলে বলে,“তো তুমি কী চাও আমি আমার পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া করি? আলাদা হয়ে যাই? তাছাড়া তুমি তো চুপ থাকো না। তাদের সব কথার জবাব দাও। এখানে আমার চুপ থাকাটা তোমার অপছন্দ কেন হচ্ছে?”
“তুমি স্বামীর দায়িত্ব কর্তৃব্য সম্পর্কেই জানো না। শুধু খেতে দিলে, কাপড় দিলেই সব দায়িত্ব পালণ হয়ে যায় না। তুমি কখনো আমাকে বুঝতেই পারবে না জয়।”
এটা বলে কাজল বিরক্ত হয়ে বিছানার অন্যপাশে বসে। জয় এসে তার হাতের উপর হাত রাখে। কাজল কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে মনমরা কন্ঠে বলে,“বিয়ের আগে আমি স্বপ্ন দেখতাম। আমার স্বামী আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসবে। সে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। আমার সঙ্গে গল্প করবে। পরিবার এবং আমাকে সমান গুরুত্ব দিবে। স্বামীর ভরসায় আমি সংসারটাকে আমার ভাবতে পারবো। কিন্তু আমি সেগুলো কিছুই পাইনি। তুমি আমাকে ভালোবাসো। হ্যাঁ শুধু ভালোই বাসো। কিন্তু সেটা সকলের সামনে প্রকাশ করতে পারো না। তাতে তোমার মানে লাগে। আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠলে তোমার বাবা, মা, বোন কী ভাববে সেটা নিয়ে পড়ে যাও? রাতের বেলা খাবার টেবিলে তুমি তৃপ্তি করে খেয়ে উঠে যাও। একবার এটা জিজ্ঞেসও করো না আমি খেয়েছি কি-না। কারণ সামনে তোমার বাবা, মা বসা। তাদের সামনে জিজ্ঞেস করলে তারা তোমাকে বউ পাগলা ভাববে। এটা তোমার মানে লাগবে। আমার পছন্দে শপিং করতে চাইলে তুমি আমাকে নিতে চাও না। তাহলে তোমার পরিবার বাকা চোখে দেখবে। দিনশেষে যখন তোমার মা আমার সব কাজে দোষ বের করে তোমার কানে নেয়। তখন তুমি চুপচাপ শোনো। একটা সামান্য বাক্য ব্যয় করতে পারো না যে ও আস্তে আস্তে সব শিখে নিবে। মা ওকে একটু মানিয়ে গুছিয়ে নাও। কিন্তু রাতের বেলা আমাকে প্রেম দেখাতে দেখাতে ঠিকই বলতে পারো মা তো বুড়ো মানুষ তার কথায় কষ্ট পেও না। মানিয়ে নাও। সংসারে শুধু আমার একার দ্বায় মেনে এবং মানিয়ে নেওয়ার?”
কাজলের এসব কথা শুনে জয় চুপ করে যায়। তার কাছে বলার মতো কোন ভাষা নেই। তবুও শান্ত গলায় বলে,“সব মেয়েরা তো এভাবেই মানিয়ে নেয়।”
“হ্যাঁ মানিয়ে নেয় কারণ তাদের স্বামীরা তোমার মতো। যাদের স্বামীরা বউয়ের ভুলকে ভুল এবং ঠিককে ঠিক সেই সাথে তার সঙ্গে হওয়া ভুলকে ভুল বলতে পারে তাদের বউদের মানিয়ে নিতে হয় না। এমনিতেই তাদের সংসার সুখের হয়ে ওঠে। আর আমি তেমন স্বামী চেয়েছিলাম।”
কাজলের এসব কথা শুনে জয় ক্ষমা চায়। এটা দেখে কাজল আরও বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে শান্ত গলায় বলে,“আমি একা সবার সঙ্গে মানাতে পারবো না জয়। একটা মানুষ কত পারে? ওপর পক্ষের থেকেও কিছুটা আগ বাড়িয়ে আসতে হয়। তাহলে না পারা যায়। কিন্তু এই সংসারে আমিই শুধু মানিয়ে নিচ্ছি। তাদের ভালো চাচ্ছি, তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়তে চাচ্ছি। কিন্তু তারা কেউ চাচ্ছে না। এখানেই সমস্যা। আর এখানেই আমাকে প্রতিবাদ করতে হয়। তাই আমি বেয়াদব বউ। তাদের জন্য বেয়া দব বউ ঠিক আছে। ভালো বউরা এসে শুধু শুধু নরক যন্ত্রণা ভোগ করতো। আর তোমার এখানেও সমস্যা। শুধু কানের কাছে একই কথা, তুমি একটু চুপচাপ থাকো। সবার কথা শোনো। কিন্তু কেন জয়? তুমি যদি তোমার পরিবারকে একই কথা না বলতে পারো তবে আমাকে একাকে কেন বলছো? আমার এসব কথা আদৌ তুমি বুঝছো কি-না আমি জানি না জয়। তবে এভাবে চলতে পারে না। আমি পারবো না এসব মেনে নিয়ে মহান ভালো বাংলা সিনেমার জনম দরদী শাবানা টাইপ বউ হতে পারবো না। এটা সম্ভব নয়।”
কাজলের এসব কথা শুনে জয় তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর বলে,“আমি জানি ভুলটা আমারই। কিন্তু আমি কী করবো বলো? বাবা, মাকে কিছু বললে তারা ভাবে পর হয়ে গেছি তাদের। তাদের দূর ছাই করছি। তাই তো না পেরে তোমাকে বলি। তুমি আমার স্ত্রী। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। আমার সবচেয়ে ভরসার জায়গা। তুমি যদি আমার পরিস্থিতি না বুঝো তবে কে বুঝবে? সেই ভরসা তো তোমাকে সবসময় মানিয়ে চলতে বলি।”
জয়ের এই কথা শুনে কাজল একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে কোন জবাব দেয় না। জয় শান্ত গলায় বলে,“আমি তোমার সব কথা বুঝি কাজল। আমি চাই তুমি এই সংসারে ভালো থাকো। তোমার প্রাপ্যটা তুমি পাও। কিন্তু আমি দিতে পারছি না।আমি সন্তানের দায়িত্ব পালণ করতে গিয়ে স্বামী হওয়ার দায়িত্ব পালণ করতে পারছি না। দুইটা ব্যালেন্স করে চলতে পারছি না। এই অবস্থায় আমি কী করবো তুমিই বলো? তুমি বলো আমার কী করা উচিত?”
“ব্যালেন্স করতে না পারলে বিয়ে কেন করছিলে? বিয়ে করার আগে ভাবা উচিত ছিলো।”
কাজলের এই কথায় জয় জবাব দেয় না। সে কাজলের কপালে চুমু দিয়ে বুঝিয়ে দেয় সে কাজলকে খুব ভালোবাসে। হয়তো সে ভালো স্বামী হতে পারেনি। কিন্তু সে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে কাজলকে। কাজলও জয়ের এই ভালোবাসায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই সেও পারবে না জয়কে ছাড়তে। কিন্তু সংসারের এই কলহ যে তাকে পাগল করে দিচ্ছে। একটি সংসারে যে শুধুমাত্র স্বামীর ভালোবাসা দিয়ে একজন মেয়ে টিকে থাকতে পারে না। এই কথাটি জয়কে সে বোঝাতে পারলেও জয় কিছু করতে পারছে না। কাজলও বুঝে জয়ের পরিস্থিতি। কিন্তু সে তো এমনটা চায় না। এক পর্যায়ে জয় আস্তে করে বলে,“আমি চেষ্টা করবো নিজেকে পরিবর্তন করার এবং দুই দিক ব্যালেন্স করে চলার।”
____
রায়ান এবং আমি বাড়ির উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। রিকশায় রায়ান নরম গলায় বলে,“আমার পরিবার আমার পছন্দকে সম্মান জানাবে। এটা আমার বিশ্বাস। তো পরিবার রাজি হলে আপনি রাজি হবেন তো?”
রায়ানের এই কথায় আমি কয়েক মূহুর্ত চুপ থাকি। অতঃপর বলি,“বিয়ে সারাজীবনের ব্যাপার। হুট করে সব ঠিক করা যায় না। আপনি মানুষ হিসাবে চমৎকার। আমার পছন্দের। কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসাবে আমি যোগ্য কি-না সেটা আমাকে ভাবতে হবে।”
আমার এই কথাটি বোধহয় রায়ানের পছন্দ হলো না। সে মলিন মুখে আমার দিকে তাকায়। আমি ম্লান হেসে বলি,“আপনিও এটা যাচাই করে নিন আপনার পছন্দটা জীবনসঙ্গী নির্বাচন করার যোগ্য কি-না। হতে পারে আপনিও আমাকে শুধু মানুষ হিসাবে পছন্দ করেছেন। এই পছন্দের সঙ্গে জীবনসঙ্গী হিসাবে পছন্দ করার মিল নেই।”
“আপনি কিন্তু বোকার মতো কথা বলছেন।”
রায়ানের মুখে এই কথা শুনে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। বুঝতে না পেরে বললাম,“এখানে বোকার মতো কোন কথাটা হলো?”
“পছন্দ তো পছন্দই। এখানে এত পার্থক্য খুঁজে লাভ আছে। তাছাড়া আমরা পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ তো চোখের দেখায় হই। সেখানে এত চেনা জানা হয় না। যেটা বিয়ের পর ধীরে ধীরে হয়। সেই হিসাবে আমরা দুজন একে-অপরকে যথেষ্ট চিনি।”
রায়ানের এই কথায় আমার শান্তর একটি কথা মনে পড়লো। শান্তর কথাগুলো খুব গভীরভাবে ভাবতে আমি বললাম,“পারিবারিক বিয়ে খারাপ হয়। এই দেশে প্রায়ই মানুষের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। শুধু কয়েক বার দেখা সাক্ষাৎ করার পর। সবাই তো আর অসুখী নয়। প্রায় মানুষ সুখী। কিন্তু….।”
“কিন্তু?”
রায়ানের প্রশ্ন শুনে কোন ভাবনা ছাড়া আমি বললাম,“আমি একা মানুষ। আমার জন্য চেনা জানাটা খুবই জরুরি। আমার তো পরিবার নেই। বাবা, মা নেই যারা দায়িত্ব নিয়ে ভালো ছেলে খুঁজে বিয়ে দিবে। আর না আমি বিয়ের পর চাইলেই পারবো সাংসারিক ঝামেলা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে৷ সেজন্য আমার কয়েক বারের দেখা, একটু জানা শোনায় বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। আমাকে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওপর পাশের মানুষটা সত্যি আমার ভালোবাসার মানুষ হওয়ার যোগ্য কি-না এটা আমাকে যাচাই করে নিতে হবে।”
“তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি ভালোবাসার মতো মানুষ নই? আপনার যোগ্য নই আমি?”
রায়ানের এই কথার জবাব দেওয়ার আগেই সে আবার বললো,“আমি ম্যাচিউর। প্রতিষ্ঠিত। দেখতে ততটাও খারাপ নই। আমার পরিবারের একটি ভালো সুনাম রয়েছে। আমার মতো ছেলে যেকোন সুনামধন্য মেয়ের যোগ্য। সেখানে আপনার মনে হয় আমি আপনার অযোগ্য?”
“সবার ভাবনা এক নয়। যোগ্যতা সবাই একভাবে বিচার করে না।”
আমি এই কথা বলতে রিকশা এসে আমার বাড়ির সামনে থামলো। আমি নেমে পড়ি। ম্লান হেসে রায়ানকে বিদায় জানাই। রায়ান বলে,“আপনি রাজি নন?”
”আমি ভেবে জানাচ্ছি।”
আমি এই কথাটি বলতে রায়ান কিছুটা মলিন মুখেই রিকশা নিয়ে চলে যায়। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমি তার কথাগুলো ভাবি। সেই মূহুর্তে আমার শান্তর কথা মনে পড়ে। এই একই কথা যদি আমি শান্তকে বলতাম তাহলে সে কখনোই বলতো না আমি এই করছি, সেই করছি। আমি যে কারো যোগ্য। বরং শান্ত খুবই সুন্দরভাবে বলতো,“আমি যে কাউকে পছন্দ করতেই পারি। কিন্তু তাই বলে যে অপরপক্ষের মানুষ আমাকে পছন্দ করবে সেটা ভাবাটা বোকামো। আমি নিজেকে যোগ্য তৈরি করে নিয়েছি এর মানে এটা নয় যে ওপর পাশের মানুষটি যোগ্যতা বলতে আমার কাছে যা রয়েছে সেটাই চায়। তার চাওয়ার মাঝে আমার গুনটা নাও থাকতে পারে।”
এসব ভাবনা মাথায় আসতে আমি মনেমনে বললাম,“রায়ান আপনি হয়তো আর দশটা মানুষের মতোই ভাবছেন। আপনি আপনার দিক দিয়ে সঠিক। কিন্তু আমি আমার জীবনে এমন একজন মানুষ পেয়েছি সে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো ভাবে না। তার ভাবনার গভীরতায় আমি হারিয়ে গিয়েছে। সেজন্য আমিও এখন সাধারণ মানুষের মতো ভাবতে পারছি না। আপনার এই প্রস্তাবে হয়তো আমার বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আমি হলাম না। কারণ এখন শুধু আমি অন্যের নয় নিজের কথাও ভাবি। আমার জীবনে যে আসবে সে তো আমার পুরোপুরি পছন্দের হতে হবে। ভাগ্যিস শান্ত কথা শুনে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানাবো বলেছিলাম নয়তো আমি বুঝতেই পারতাম না আপনার চিন্তা খুবই সাধারণ। অন্যসব মানুষের মতো। আর আমার মনে হয় একটা সময় আপনি নিজেই অন্যদের মতো ভেবে আমাকে খুব নগন্য মনে করতে পারেন। কারণ সারা দুনিয়ার কাছে আমি নগন্য। অনাথ এক সাধারণ মেয়ে। যার কাছে আমি এমন তার বাড়িতে আমি কী রাজরানী হতে পারবো? যদি রাজরানী না হতে পারি তবে কেন বিয়ে করবো? একাই তো দিব্যি আছি।”
’
’
চলবে,
#ইচ্ছেঘুড়ি (২৪)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
আমি রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম সেই মূহুর্তে রায়ান ফোন দিলো। আমি ফোনটি ধরে শান্ত গলায় বললাম,“রায়ান আমি এই মূহুর্তে বিয়ে করবো না। আমি কিছুটা সময় নিতে চাই। আমি জানি আপনার পরিবার এতটা সময় দিবে না। সেজন্য আপনি অন্য পাত্রী খুঁজে নেন।”
“চিরকুমারী থাকার ইচ্ছে বুঝি?
বয়স তো কম হলো। উনত্রিশ হয়ে গিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে এখনো বিয়ে করতে চাচ্ছেন না? আদৌ বিয়ে করার ইচ্ছে আছে?”
রায়ানের কথা শুনে আমি মুচকি হেসে বললাম,“বয়স তো অনেকটা পেরিয়ে গেছে। তাই আর কিছুটা পার হলে ক্ষতি হবে না। বয়সের দোষ দিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।”
“আপনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে রিজেক্ট করছেন?”
রায়ানের এই কথায় আমি জবাব দিলাম না। সত্যি বলতে তেমনটাই। আমার জবাব না পেয়ে রায়ান বলে,“আপনি অনেক বুদ্ধিমতী পুষ্প।”
“হঠাৎ এই কথা?”
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম। রায়ান কিছুটা উপহাস নিয়েই বলে,“আপনার পরিচয় জানার পর কখনো ভদ্র কোন পরিবার আপনাকে বউ হিসাবে গ্রহণ করবে না। আপনি এটা খুব ভালোভাবে জানেন। আপনি বুঝতে পেরেছেন আমার পরিবার রাজি হবে না। তাই খুব কৌশলে নিজেই রিজেক্ট করছেন এমন একটা ভাব করলেন। আপনার এই বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতে হয়।”
রায়ানের মুখে এই কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে এমনটা ভাবনা ছিলো না আমার। আমি কিছু মূহুর্তের জন্য থ মেরে গেলাম। জবাব দিতে পারলাম না। আমার জবাব না পেয়ে রায়ান বলে,“ধরা পড়ে গেলেন। আপনি যতটা বোকা ভাবছেন আমি ততটা বোকা নই। যথেষ্ট বুদ্ধি নিয়ে ঘুরি।”
“হ্যাঁ বুঝলাম।
সমাজের নিম্ন মানসিকতার মানুষের মতো চিন্তা ধারা নিয়ে ঘুরেন। সত্যি বলতে আমার জীবনে এই ধরনের মানুষের প্রয়োজন নেই। আর আমি জানি এরা আমাকেও পছন্দ করবে না। তাই আমি তাকেই খুঁজছি তার মানসিকতা সুন্দর এবং যে আমাকে পছন্দ করবে। এক কথায় সাধারণ নয় আমি অসাধারণ মানুষ খুঁজছি।”
এই কথা বলে রায়ানকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ফোন কেটে দিলাম। সেই সঙ্গে নাম্বারটি ব্লক করে দিলাম। মনেমনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,“মানুষের উপর দেখে ভেতর অনুভব করা যায় না। ধন্যবাদ রায়ান। আপনার জন্য এটা আমি ভালোভাবে অনুভব করলাম যে আমার আসলেই সময় নেওয়া উচিত। আমি এখনো সঠিক মানুষ নির্ধারণ করার যোগ্য হইনি। সেই যোগ্যতা অর্জন করা উচিত।”
এসব ভেবে শান্তকে ফোন দিলাম। শান্ত ফোনটি ধরতে আমি নরম গলায় বললাম,“ধন্যবাদ শান্ত।”
“হঠাৎ!”
শান্ত অবাক হয়ে কথাটি জিজ্ঞেস করতে আমি ম্লান হেসে বললাম,“কাল আমরা দেখা করি। তারপর বলি?”
শান্ত রাজি হয়ে গেল। আমি ফোন রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ছবির ফ্রেমটি নিলাম। ছবিটি গভীরভাবে লক্ষ্য করতে আমার কল্পনায় শান্তর মুখটি ভেসে উঠলো। হঠাৎ মন বলে উঠলো,“সেদিন ইচ্ছেঘুড়ির কাছে তুই এমন একজন মানুষ চেয়েছিলি যে তোকে সবসময় হাসাবে।”
এই কথাটি মস্তিষ্কে নাড়া দিতে আমার মনে পড়ে যায়, সত্যি তাই। সেদিনের পর আমার মুখে সবসময় হাসি ফুটেছে। যে হাসির কারণ ছিলো শান্ত। শান্ত আমার জীবনে এসে আমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করে দিয়েছে। যার হাত ধরে আমি বাঁচতে শিখিয়েছি। অস্পষ্টভাবে আমি বলে উঠলাম,“সবসময় হাসির কারণ ভালোবাসার মানুষ হবে এমন তো কথা নেই। বন্ধুও তো হতে পারে।”
★
বিকালে অফিস থেকে দ্রুত বের হয়ে রিকশায় উঠে বসলাম। মাঝপথে শান্ত রিকশায় উঠলো। আমি শান্তকে দেখে হাসি মুখে বললাম,“কেমন আছেন?”
“হ্যাঁ ভালো। আপনি?”
শান্ত কিছুটা মনমরা কন্ঠে জবাব দিলো। এটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি বিষ্ময় নিয়ে তার দিকে তাকাতে সে বলে,“কী হয়েছে?”
“আপনার কী হয়েছে?”
আমার প্রশ্ন শুনে শান্ত হাসার চেষ্টা করে বলে,“আমার কী হবে? আমি তো ঠিক আছি।”
“না আপনাকে দেখে তো ঠিক মনে হচ্ছে না। শরীর খারাপ?”
এটা বলে শান্তর কপালে হাত দিতে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। আমি কপালে হাত রেখেই বললাম,“কই জ্বর তো নেই।”
“আমার কিছু হয়নি। আপনার কেন মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে?”
শান্তর কথা শুনে আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম,“কারণ আপনার মধ্যে সেই প্রাণোচ্ছল শান্তকে দেখা যাচ্ছে না।”
এটা শুনে শান্ত কিছুটা মনমরা কন্ঠে বলে,“ছাড়ুন তো। আপনি বেশি ভাবছেন। আমি ঠিক আছি।”
“মন খারাপ?”
আমার এই কথা শুনে শান্ত আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। অতঃপর প্রসঙ্গ বদলাতে বলে,“বিয়ের আলাপ কতদূর?”
“কার বিয়ে?”
আমার প্রশ্ন শুনে শান্ত কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,“আপনার ছাড়া আর কার।”
“ওহ আমার বিয়ে। বিয়ের আলাপ করবো তো কিন্তু পাত্র কোথায়? সেটা তো পাচ্ছি না।”
আমার এই কথা শুনে শান্ত হতভম্ব হয়ে যায়। সে বিষ্ময় নিয়ে বলে,“কেন রায়ান?”
শান্ত কথাটি বলে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি শান্ত গলায় বললাম,“তার মাঝে আমার পছন্দের সব গুন নেই।”
আমার কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে শান্ত খুশি হয়ে আমার দিকে তাকায়। যেই ছেলেটার মুখে একটু আগে হাসি ছিলো না তার মুখজুড়ে হাসি ফুটে উঠলো। সে হাসিমুখে বলে,“রিজেক্ট করে দিয়েছেন?”
আমি মাথা নাড়াই। যার অর্থ হ্যাঁ। এটা বুঝতে পেরে শান্ত বলে,“আমি জানতাম ঐ শালা নিজেকে যত ভালো দেখায় তত ভালো না। নিশ্চিত কোন গন্ডগোল রয়েছে।”
এটা শুনে আমি হেসে দিলাম। হাসি মুখে বললাম,“সে ঠিকি আছে। আপনার সঙ্গে আমি বরং সমাজের মানুষের মতো ভাবা বাদ দিয়েছি।”
“তো কোন ভাবনাটা সঠিক বলে আপনার মনে হয়?”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে আমি বিনা সংকোচে বলি,“অবশ্যই আপনার ভাবনা।”
শান্ত আমার এই কথা শুনে আর জবাব দেয় না। সে মুচকি হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই মূহুর্তে তার ফোন বেজে উঠে। শান্ত ফোন বের করে দেখে পলাশ ফোন দিয়েছে। সে ফোনটি ধরতে ওপাশ থেকে পলাশ বলে,“তুই বলে দিয়েছিস তো তুই আর ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবি না। বিয়ের পর ওর স্বামী এসব ভালো চোখে দেখবে না। তাছাড়া তুইও তো বিয়ে করবি। সব মিলিয়ে তুই এখন বন্ধুত্বটা শেষ করতে চাস।”
“চোপ শালা।”
এটা বলে শান্ত ফোনটা কেটে দেয়। শান্তর মন খারাপ দেখে পলাশ সেই গতকাল থেকে তাকে একই কথা বলে যাচ্ছে। যদিও শান্তও ভেবেছিলো পুষ্প আজ বিয়ের ঠিক হওয়ার কথা বললে সে একই কাজ করতো। কিন্তু যখন সেটা হচ্ছে না তখন শুধু শুধু কেন এসব করবে?
শান্তর বিরক্তি নিয়ে ফোন কেটে দেওয়া দেখে আমি অবাক হয়ে বললাম,“কে? কী বলছিলো যে আপনি এভাবে ফোন রেখে দিলেন?”
”পলাশ। তেমন কিছু বলছিলো না।”
এটা বলে শান্ত ম্লান হাসে। আমি শান্তর হাসি মুখের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই বিষয়টি লক্ষ্য করে শান্ত মনেমনে বলে,“পুষ্প আমার মতো বুঝি আমাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছে। যেভাবে আমি তাকে লক্ষ্য করে ফেসে গিয়েছি। সত্যি এমন হচ্ছে তো। নাহলে সে এভাবে তাকিয়ে থাকবে কেন?”
শান্ত হঠাৎ আমার ডান হাতের উপর তার বাম হাতটি রাখে। আমি কিছুটা চমকে যাই। তবে কিছু বলি না। শান্ত এটা দেখে হাতটি শক্ত করে ধরে বলে,“পুষ্প আপনার কেমন ছেলে পছন্দ? ভদ্র, সভ্য, দায়িত্ববান? এরা বুঝি স্বামী হিসাবে বেশি পার্ফেক্ট হয়?”
শান্তর কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। আমি না চাইতেও থমকে যাই। শান্তর এই প্রশ্নগুলো অন্যরকম লাগছে। আমি জবাব দিচ্ছি না দেখে শান্ত বলে,“এসে গেছি।”
আমি হচচকিয়ে যাই। শান্ত হাসি মুখে বলে,“পার্ক এসে গেছে।”
আমি এটা লক্ষ্য করে ম্লান হাসি। আমরা দুজন রিকশা থেকে নেমে পড়ি। দুজনে পার্কের ভেতরে গিয়ে একটি বেঞ্চের উপর বসি। শান্ত আমাকে বসিয়ে রেখে উঠে যায়। কিছু সময় পর চলে আসে। তার হাতে দুটি হাওয়াই মিঠাই। আমি এটা দেখে ম্লান হাসলাম। অতঃপর বলি,“আপনার সবসময় বাচ্চাদের জিনিসই পছন্দ হয়?”
“এটার উপরে লেখা আছে বুঝি শুধু বাচ্চারা খাবে?”
শান্ত এই কথা বলে হাওয়াই মিঠাই ভালোভাবে দেখছিলো। দেখে বলে,“কই কোথাও তো লেখা নেই? খুঁজে পাচ্ছি না কেন?”
শান্তর এসব কান্ড দেখে আমি শব্দ করে হেসে দিলাম। শান্তর কাছ থেকে একটি নিয়ে বললাম,“সবসময় বাচ্চামো।”
“আমি বড়দের মতো আচরণ করলে আপনি খুশি হবেন?”
শান্তর প্রশ্ন শুনে আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালাম। শান্ত আমার দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি জবাব দিচ্ছি না দেখে শান্ত বলে,“আপনি চান বা না চান আমি বদলাচ্ছি না। আমি আমার মতো ঠিক আছি।”
“হ্যাঁ।”
আমি এই কথাটি বলতে শান্ত খুব সুন্দরভাবে হেসে মাথা নাড়ায়। অতঃপর বলে,“নিজের সত্তাকে হারিয়ে অভিনেতা হয়ে বাঁচতে চাই না। তাতে নাই বা দেখলাম তার চোখে আমার জন্য মুগ্ধতা। তার হৃদয়ে আমার জন্য ব্যাকুলতা।”
“বাহ্ চমৎকার। তা কার চোখে মুগ্ধতা দেখতে চান?”
আমার এই কথার জবাব না দিয়ে শান্ত আমাকে বললো,“থাক। কিছু কথা নিজের কাছেই জমা থাক।”
“প্রেমে পড়েছেন?”
আমার এই প্রশ্ন শুনে শান্ত আমার চোখে চোখ রেখে বলে,“হয়তো পড়েছি।”
“বেশ তো। নাম কী মেয়েটার? কবে হলো এসব? আমাকে তো জানালেন না?”
আমি একটু থেমে আবার বললাম,“ওহ আমাকে কেন জানাবেন? আমি তো আপনার কাছে কাকি মা। এসব শুনলে যদি বলি ভালো ছেলেরা প্রেম করে না। সেই ভয়ে জানাননি তাই না?”
“কিছুটা সত্যি।”
শান্তর এই কথা শুনে আমি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে বললাম,“সে আপনি আমাকে যা ভাবেন। তবে সত্যি বলতে আমি কিন্তু বাঁধা দিবো না। আমি তো বন্ধু। বন্ধুরা প্রেমে উৎসাহ দেয় এটা আমি জানি।”
এটা শুনে শান্ত শব্দ করে হেসে দেয়। অতঃপর বলে,“কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আপনি তার নাম শুনলে অবশ্যই কাকি মা রূপ ধারণ করবেন।”
“আপনার এটা কেন মনে হলো? আমি তো অনেক বদলে গেছি, তাও আপনার এটা মনে হয়?”
আমার এই কথায় শান্ত বিনা সংকোচে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ হ্যাঁ। অতঃপর বলে,“বয়স বলতে একটি কথা রয়েছে।”
”তারমানে বলতে চাইছেন আমি আমার বয়সে যা ভাববো সেটা আপনার সঙ্গে মিলবে না? হ্যাঁ মানছি একটা সময় আমি বয়সের চেয়ে বেশি একটু ভাবতাম। তাই বলে এখনো ভাববো এমন তো নয়। মানুষ প্রেম করতেই পারে। আমি বাঁধা কেন দিবো?”
আমার এসব কথা শুনে শান্ত হাসে। তার হাসি দেখে আমার রাগ উঠে গেল। এটা বুঝতে পেরে শান্ত বলে,“আমার কথার ভাবার্থ যেদিন বুঝবেন সেদিন অবশ্যই আমাকে আপনার জবাব জানাবেন।”
“মানে!”
আমি শান্তর কথা বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকালাম। শান্ত জবাব না দিয়ে আমার হাত ধরে বলে,“চলেন আজ আপনার আর একটি ইচ্ছে পূরণ করি?”
“কোন ইচ্ছা?”
শান্ত জবাব না দিয়ে আমাকে নিয়ে যায়। আমি তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করি। বারবার জিজ্ঞেস করি,“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“ভরসা করতে পারেন। ঠকবেন না।”
এটা বলে শান্ত সামনে এগিয়ে যায়। আমিও শান্তর সঙ্গে এগিয়ে আসি। অতঃপর…..
’
’
চলবে,