ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-৩৩+৩৪

0
21

#ইচ্ছেঘুড়ি (৩৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

পুরো ঘরজুড়ে নিরবতা বিরাজ করছে৷ সবাই নিশ্চুপ। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। আমি এক কোনে মগে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শান্তর বাবা বলে,“এখন কেউ চা খাবে না। যাও ওটা ফ্লাক্সে রেখে দাও।”

তার কথা শুনে আমি যেই না পিছু ঘুরে চলে যেতে নিবো সেই মূহুর্তে শান্তর মা বলে,“না। এখনই খাবো। তুমি নিয়ে আসো। দেখি বৌমা কেমন চা বানাতে পারে, তুমিও সেটা দেখে নাও।”
শান্তর বাবা এই কথা শুনে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে বলে,“চা বানানো এমন কী?
এটা সবাই পারে। তাই প্লীজ আবার এটা বলে বসো না যে চা খেয়ে তোমার ছেলের বউকে যাচাই করে নিতে। যে সে কতটা যোগ্য।”

বাবার কথা শুনে শান্ত তার দিকে তাকাতে শান্তর বাবা বলে,“তাকিয়ে লাভ নেই। এখন এটা বলো না তোমার বউকে ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য বিয়ে করেছো, কাজবাজ করাবে না। তাই সেটা দেখে আমি তার যোগ্যতা যাতে বিচার না করি।”

“না। সেটা কেন বলবো?
ঘরের বউদের তো একটু কাজবাজ করতেই হয়। নাহলে শ্বশুড়, শাশুড়ীর মন পাওয়া যায় না। সেটা তো অবশ্যই করবে। তবে হ্যাঁ ছোট মানুষ সব নাই পারতে পারে। মা নাহয় সংসারটা সামলানো শিখিয়ে দিবে। আর তুমি নাহয় পাহারা দিবে তোমার বৌমা ঠিকঠাক শিখছে কি-না। অতঃপর না পারলে বকে দিও। শেখানোর পর না পারলে বকা অবশ্যই শোনা উচিত। কিন্তু না শিখিয়ে বকাটা আবার যৌক্তিক নয়।”
শান্তর কথা শুনে তার বাবা কিছু না বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর আমার হাত থেকে চায়ের মগ কেড়ে নিয়ে তাতে চুমুক বসায়। এটা দেখে শান্ত বলে,“সাবধানে। গরম, ছ্যাকা লেগে যাবে।”

“লাগলে লাগুক।
তাতে তোমার কি?”
এটা বলে শান্তর বাবা চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এটা দেখে শান্ত ইশারায় তার মাকে দিতে বললো। আমি তাই করলাম। শান্তর মাকে চা দিয়ে, এরপর শান্তকে দিলাম। এটা শান্তর ভাড়া বাসা। তাই এখানে কোন কাপ নাই। শান্ত বরাবর চা বানিয়ে মগেই খায়। এজন্য তাদেরও মগে দিতে হলো। তবে এটা নিয়ে শান্তর বাবা, মা কিছুই বললো না। এটা বেশ ভালোই লাগলো। সবাই চা খাচ্ছিলো আর আমি তাদের মাঝে অসহয় মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আসলে আমার কি করা উচিত সেটাই বুঝতে পারছি না। এটা লক্ষ্য করে শান্তর মা বললো,“তুমি চা খাও না?”

“আমাদের সাথে খেতে তোমার বৌমার মানে লাগছে। তাই খাচ্ছে না।”
শান্তর বাবা ব্যঙ্গ করে কথাটি বলে। যদিও এই কথাটি আমাকে কষ্ট দিতে বলেনি বরং শান্তর জন্য বলেছে। সে এসব বলে শান্তকে বোঝাতে চায় তার পছন্দ ঠিক না। এটা বুঝতে পেরে শান্ত বাকা হেসে বলে,“ও চা খায়। কিন্তু ঘরে আর মগ নেই। একা মানুষ কতগুলো কিনবো বলো? তাই চা নিচ্ছে না?”

“তুমি কিন্তু বড্ড বেশি বকছো।
মেয়েটাকে সবে কাছ দেখে দেখলে। এখনো তো চেনা জানা হলো না। তার আগেই সে কেমন সেটা বিচার করে ফেলছো? এটা ঠিক না? এক সময় তো তুমিই বলতে আমি যাতে শাশুড়ী হিসাবে এসব কাজ না করি। এসব ভালো নয়। আর এখন তুমি….।”
শান্তর মাকে থামিয়ে দিয়ে তার বাবা বলে,“থামো তো। তা এটা যখন জানেই তোমার ছেলে যে ঘরে মগ নেই তাহলে নিজে বেহায়ার মতো আমাদের সঙ্গে চা খাচ্ছে কেন? একটু আগে না স্ত্রী নিয়ে এত ভাষন দিলো? তো এটা জানে না, মেয়েটার পরে একা একা চা খেতে ভালো লাগবে না। তার সঙ্গ দিতে সে পরে নাহয় খেতো।”

“ওহ আচ্ছা। এটা আগে বলবে তো।
আমি তো নতুন বিয়ে করেছি। সব তো জানি না। তোমার তো অভিজ্ঞতা রয়েছে সেটা নাহয় আমাকে শিখিয়ে দিও।”

”শান্ত আমি তোমার বাবা। সীমার মধ্যে থেকে কথা বলো। লাজ শরমের মাথা খেয়ে কিছু বলো না।”
শান্তর বাবার মৃদু ধমকে শান্ত বোকা হয়ে যায়। সে বোকার মতো তাকিয়ে বলে,“যাক বাবা। আমি কী বললাম?”

“কিছু না। এখন তোমার সঙ্গে অহেতুক কথা বলার সময় নেই।”
শান্তর বাবা এই কথা বলে উঠে দাঁড়ায়। সে পা বাড়াতে নিয়ে থেমে গিয়ে বলে,“শান্ত তুমি কোন ঘরে থাকো?”

শান্ত হাত দিয়ে সেই ঘর দেখিয়ে দিতে শান্তর বাবা সেদিকে পা বাড়ায়। এটা দেখে শান্ত বলে,“বাবা তুমি ঘরে যাচ্ছো যে?”

“নিশ্চয় এতটা পথ জার্নি করে আসার পর এখন সারারাত তোমার সঙ্গে বসার ঘরে কাটাবো না। তাই ঘরে যাচ্ছি। বিশ্রাম নিবো।”
শান্ত তার বাবার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায়। সে সেটায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে,“তুমিও ঘুমাতে চলে আসো। তোমার মা আর বউকে তাদের মতো ছেড়ে দাও। তারা পরিচিত হয়ে নিক। আর হ্যাঁ এই বিয়ে আমি মানি না। তাই নাটক করবে না। আগে আমাদের এলাকায় যাবা, সেখানে আমি সবাইকে দাওয়াত দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করবো। তারপর এই বিয়েটা আমি মানবো। তাছাড়া নয়।”
এটা বলে শান্তর বাবা কোন কথা না বলে ঘরে চলে যায়। শান্ত তার বাবার কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। অতঃপর মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলে,“আমি তোমার আর বাবার উপর সব চাপিয়ে দিচ্ছি মা? তোমরা কি খুব বেশি অখুশি?”

“এটা এখন শুনে কী করবি? বিয়ে তো করেই ফেলেছিস। এখন আমাদের কোন উপায় আছে এই বিয়ে অস্বীকার করার? নেই তো। তাহলে এখন খুশি অখুশি নিয়ে ভেবে কী হবে?”
শান্তর মায়ের কন্ঠে কিছুটা অভিমান ছিলো। এটা বুঝতে পেরে শান্ত তার মাকে জড়িয়ে ধরে। নরম গলায় বলে,“স্যরি মা। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার এই সিদ্ধান্ত তোমাদের একদিন সঠিক মনে হবে।”

“আচ্ছা হয়েছে। এবার যা। তোর বাবা হয়তো তোর সঙ্গে কথা বলতে চায় তাই একটু ঘুরিয়ে তোকে ঘরে যেতে বললো।”

“সে নাহয় যাচ্ছি। কিন্তু তোমরা খাবার খাবে না? বাবা তো বললো সে এখন ঘুমাবে।”

“সেসব পরে দেখা যাবে।
তুই এটা বল এই বাড়িতে দুটো বিছানা আছে তো?”
শান্ত নাসূচক মাথা নাড়াতে মা কিছু একটা ভেবে বলে,“এটাই স্বাভাবিক। যাই হোক তুই যা আমরা বাকিটা ব্যবস্থা করছি।”

শান্ত মায়ের কথা শুনে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তবে যাবার আগে আমাকে চোখের ইশারায় বুঝায়,“ভয় পেও না। কিছু হবে না।”

শান্তর এই ব্যবহার আমাকে বরাবরের মতোই মুগ্ধ করেছে। শান্ত চাইলে পারতো আমাকে কিছু না বলে চলে যেতে। তবে সে জানে আমি সে ছাড়া এখানে বাকি সবার সঙ্গে অস্বস্তি হচ্ছে। তাই সে তার দৃষ্টির সাহায্য আমাকে বোঝালো, আমি যাতে অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে। এখানে সে আছে। আমি শান্তর যাবার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলাম। সেই মূহুর্তে শান্তর মা বলে,“তুমি আজ রাত শান্তর সঙ্গে থাকতে চাও?”

শান্তর মায়ের কথাটি শুনে আমি হচচকিয়ে গেলাম। আমি বুঝতে না পেরে বললাম,“মানে?”

“শান্তর সঙ্গে থাকতে চাও?
আমি ব্যবস্থা করে দিবো?”
শান্তর মায়ের কথা শুনে আমি নাসূচক মাথা নাড়াই। অতঃপর বলি,“আমরা তো বন্ধু। হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আমার মনে হয় এসব না করলেও হবে। আংকেল যা বললো সেটা করাই ভালো। এমনিতে আমরা আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি৷ এখন আংকেল যেহেতু চায় আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান করার পর বিয়েটা মানতে সেহেতু তখন সব হলেই হবে।”
আমি কিছুটা দ্বিধা নিয়ে কথাগুলো বললাম। আমি ঠিকভাবে আমার কথা বোঝাতে পারছিলাম না। তবে শান্তর মা সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে বলে,“আংকেল কি?”

“হ্যাঁ!”
আমি বুঝতে না পেরে বোকার মতো তার দিকে তাকাতে শান্তর মা বলে,“এত সংকোচ কেন করছো? চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছো? যাই হোক এত ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। তাছাড়া এখন আমরা তোমার শ্বশুড়, শাশুড়ী। তাই আংকেল আন্টি না বলে অবশ্যই বাবা, মা বলবে। বাবা, মা হিসাবে যতটা সম্মান পেতে পারি সেটা অবশ্যই দিবে। কিন্তু সম্মান আর ভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। আশা করি সেটা তুমি জানো।”
একটু থেমে শান্তর মা আমার হাতটি ধরে বলে,“দেখো আমরা মানছি তুমি আমাদের পছন্দ নও। আমরা আমাদের শান্তর জন্য যেমন মেয়ে ভাবছিলাম তুমি মোটেও তেমন নও। তাই আমাদের তোমাকে মেনে নিতে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু তাই বলে এটা নয় যে ততদিন তুমি আমাদের ভয় পেয়ে চলবে। বা আমাদের সাথে কথা বলবে সংকোচবোধ করবে। যেহেতু তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে সেহেতু আমাদের মেনে নিতেই হবে। তাই আমাদের উচিত আমাদের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা। আমার কথা বুঝেছো?”
শান্তর মায়ের কথায় আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,“হ্যাঁ মা।”

____

জয় সকালে উঠে সবার সামনে তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা বলতে তার মা রেগে গেল। সে রাগান্বিত গলায় বলে,“বাহ্। ভালোই বউ পাগল হয়েছিস তো? তুই বউয়ের কথায় আলাদা বাসা নিলি, সব ঠিক করলি। এখন যখন সেই বাসায় উঠবি তখন আমাদের জানালি? মানে যে বাবা, মা তোকে জন্ম দিলো তাদের এক বিন্দু দাম নেই তোর কাছে?”

“এভাবে হঠাৎ করে তুমি এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে? কার বুদ্ধিতে বউয়ের?”
জয়ের বাবা তার মায়ের সঙ্গে তাল দিয়ে কথাটি বলে। জয় খুব নরম গলায় বলে,“আমার পক্ষে একই বাড়িতে দেখে দুটো দায়িত্ব পালণ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেখো তোমাদের তো কাজলকে নিয়ে অনেক সমস্যা। তাই আমি ওকে তোমাদের থেকে দূরে করে দিচ্ছি। যাতে তোমাদের এই সমস্যা আর না হয়।”

“সমস্যা? কিসের সমস্যা?
আমাদের তো সমস্যা নেই। সমস্যা তো তোর বউয়ের? তোর বউয়ের আমাদের নিয়ে যত রাজ্যের সমস্যা। তাই তো তোকে কানপোড়া দিয়ে এখন নিয়ে যাচ্ছে।”
এটা বলে জয়ের মা কাজলের দিকে এগিয়ে যায়। তাকে গালি দিয়ে বলে,“তুই আমার কোল খালি করছিস না, দেখে নিস একদিন তোর কোল খালি হবে। মায়ের সন্তান কেড়ে নিয়ে কখনো কেউ ভালো হতে পারে না।”

জয়ের বাবা, মা একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে। এসব শুনে জয় কাজলকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে। সে তাদের থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা কোন কথা শুনছে না। জয়ের বাবা, মা কিছুতেই তাকে আলাদা হতে দিতে চায় না। তবে জয় তাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে,“আমি চলে যাচ্ছি না তো। আমি তো সবসময় তোমাদের কাছে আসবো। তোমাদের যা যা প্রয়োজন সব আমায় বলবে আমি নিয়ে আসবো। আমি তোমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি না। তোমরা ভুল ভাবছো।”

“না। তুই এখন এটা বলছিস। কিন্তু আলাদা হয়ে গেলে ঐ কালনাগিনী ঠিক তোকে বশে নিয়ে আমাদের স্মৃতি তোর মাথা থেকে ভুলিয়ে দিবে। ঐ কালনাগিনীকে আমরা ভালোই চিনি। ও তো এমন হবেই। ওর মা বাপই তো এমন।”
জয়ের মা এই কথা বলে কাজলের বাবা, মা তুলে গালি দেয়। এটা শুনে জয় কিছুটা রাগ নিয়েই বলে,“তোমরা থামবে। তোমাদের এসব কথাবার্তার জন্যই আমি আজ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নয়তো আমিও তো তোমাদের একসাথে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা তো সেই সুযোগ দিলে না। এখনও না জেনেশুনে কাজলকে বকা দিচ্ছো।”

জয়ের মা এই কথা শুনে জয়কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে কান্না করে বলে,“আমি কিছু জানি না। তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না। আমি এটা কিছুতেই মানতে পারবো না। তুই চলে গেলে আমি শেষ হয়ে যাবো। তুই কোথাও যাবি না।”
জয় নিজের মায়ের এমন কান্না দেখে ভেঙে পড়ে। কাজল জয়ের মুখের অবস্থা দেখেই সবটা বুঝে যায়। তার মনে হলো, জয় বোধহয় এবার এই অবস্থা দেখে নিজের সিদ্ধান্ত বদলাবে। তবে সেটা করে না জয়। সে নিজেকে সামলে তার মাকে বলে,“আমি রোজ তোমার কাছে আসবো মা। এই তো একটুখানি পথ। যত সমস্যাই হোক আমি ঠিক তোমার কাছে রোজ আসবো। তুমি প্লীজ কান্না করো না। তুমি এভাবে কান্না করলে আমারও তো কষ্ট হয়। প্লীজ মা কান্না করো না।”
তবুও জয়ের মা থামে না। সে কান্না করেই যাচ্ছে। শত হোক নিজের সন্তান। অথচ এই মায়ই যদি নিজের সন্তানের বউ ভেবে তার কিছু ভুল শুধরে তার বৌমাকে আপন করে নিতো তাহলে কিন্তু সংসারে এত সমস্যা থাকে না।

___

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে শান্ত আমার সঙ্গে দেখা করতে রান্নাঘরে চলে এলো। আমি তখন চা বানাচ্ছিলাম। শান্তর মাও এদিকে আসছিলো। তবে শান্ত রান্নাঘরে আসছে দেখে না আর আসে না। সে চলে যায়। শান্ত আমার কাছে এসে মিষ্টি করে বলে,“শুভ সকাল।”

“শুভ সকাল। ঘুম কেমন হলো?”
আমার এই প্রশ্নে শান্ত মজার সুরেই বলে,“বিয়ের পর বউ ছাড়া রাত। এটা ভালো যায়?”

এটা শুনে আমি মৃদু হাসলাম। কোন কথা বললাম না।শান্ত আমার হাসি দেখে বলে,“তুমি রাগ করোনি তো?”

“কেন রাগ করবো?”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে,“এই যে বিয়ের পর স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারলে না।”

“শান্ত ভালো হচ্ছে না। এখন আমি মজা করার মুডে নেই।”

“ওহ আচ্ছা। তবে নাহয় পরে করে নিবো। যাই হোক অবাক হচ্ছো না আমি যে অনুমতি ছাড়া আপনি থেকে সোজা তুমিতে চলে আসছি?”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে আমি কিঞ্চিৎ ভেবে বললাম,“রাতে অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম আপনি আপনার বাবা, মায়ের সামনে এসব নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাননি। তাই তুমিতে চলে গেলেন।”

“বাহ্। ভালো বুঝদার আছো।
তা তুমি কবে আমাকে তুমি বলবে?”

“না। এটা থাক। আমি আপনি বলে অভ্যস্ত।”
এটা শুনে শান্ত মজা করে বলে,“ছিহ কী লজ্জা?
আমি ছোট হয়ে তুমি বলছি আর তুমি বড় হয়ে তুমি বলতে পারছো না? এটা শুনলে তো লোক ছি ছি করবে।”

“লোকের কথায় আমি কান দেই না। কারণ আমি ইমতিয়াজ শান্তর বউ। আমার স্বামী লোককে পাত্তা দেয় না তো আমি দিবো কেন?”
আমি কিছুটা ভাব দেখিয়ে কথাটা বললাম। এটা শুনে শান্ত শব্দ করে হেসে দেয়। আমিও তার সঙ্গে তাল মেলালাম। অতঃপর হাসি থামিয়ে শান্ত বলে,“আচ্ছা এসব ছাড়ো।
বাবা দেরি করতে চায় না৷ তাই তুমি আজই অফিসে গিয়ে ছুটির ব্যবস্থা করো। খুব দ্রুত আমরা আমাদের বাড়ি যাচ্ছি এবং সেখানে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ সম্পন্ন হবে।”
এটা শুনে আমি কিছুটা চমকে গেলাম। সেই চেনা শহর, চেনা এলাকা। সেখানে আবার পা রাখবো। আমার বিষয়টি বুঝতে পেরে শান্ত প্রসঙ্গ বদলে বলে,“তো বলো কাল রাতে আমার মায়ের সঙ্গে কেমন গল্প করলে?”

“তেমন কোন গল্পই তো হলো না।
বিছানা রেডি করলাম তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।”
এটা শুনে শান্ত কিছুটা বিরক্ত হয়। সে বিরক্তি নিয়ে বলে,“বোকা নাকি তুমি? গোটা একটা রাত পেলে নিজের শাশুড়ীকে পটানোর সেটা না করে ঘুমিয়েছো? আরে ধুর। আমি তাহলে বিয়ে করে বউ ছাড়া রাত কেন পার করলাম? আমি ভেবেছি আমি এদিকে বাবার রাগ ভাঙাবো আর তুমি অন্যদিকে মায়ের। সেটা না করে তুমি ঘুমিয়েছো?”

“হ্যাঁ। না মানে। মা খুব ক্লান্ত ছিলো।
স্যরি। আমার তার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে গল্প করা উচিত ছিলো, তাই না?”
আমার কথায় শান্ত মাথা নাড়ায়। এটা দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শান্ত আমার মন খারাপ দেখে বলে,“ছাড়ো এসব। তবে হ্যাঁ একটা কথা মাথায় রাখবা, বিয়েটা যতই একা করি না কেন? বাবা, মায়ের মন জয় করতে হবে। সারাজীবন তো আর তুমি তাদের অপছন্দের বউ হয়ে থাকতে পারো না, তাই না? এভাবে সংসার হয় না। তুমি যতই আমার হাত ধরে সংসারে পা রাখো না কেন?এটার সঙ্গে শুধু আমি নই আমার বাবা-মায়ও জড়িয়ে আছে। এখানে তোমাকে আমার চেয়ে বেশি আমার বাবা, মায়ের পছন্দের হয়ে উঠতে হবে।”

“মানে?”
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করায় শান্ত খুব সুন্দরভাবে বলে,“আমি তো তোমারই। তোমার সবকিছু আমার অপছন্দের হলেও আমি সেটাকে পছন্দের বানিয়ে নিতে পারবো। কিংবা তোমার ভুলগুলো শুধরে নিতে পারবো। কিন্তু বাবা, মা সেটা করবে না। যতই হোক তুমি কিন্তু বৌমা। তারা শুধু ভুলগুলো খুঁজে বের করবে। কিন্তু সেই ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সমাধান দিবে না। এটাই সংসার জীবন। তাই তোমাকে আমার পছন্দের হওয়ার চেয়ে বাবা, মায়ের পছন্দের হয়ে উঠতে হবে। তাছাড়া তুমি আমার পছন্দের হয়ে উঠতে চাইবে বা কেন? তুমি আমার পছন্দ বলেই তো বিয়ে করলাম। তাই না?”

আমি মাথা নাড়াই। আমার মুখে ফুটে উঠেছে মিষ্টি এক হাসি। এ হাসি মুগ্ধতার। আমার মুখের এই হাসি দেখে শান্তও খুশিমনে বলে,“সংসার বড় জটিল পুষ্প।তুমি এবং তোমার ভাবনা তার কাছে খুবই নগন্য। তাই তোমাকে ধৈর্য ধরে সংসার সামলাতে হবে। আর হ্যাঁ এখানে ভুল যে কারো দ্বারা হতে পারে। আমি যেমন তোমার ভুল শুধরে দিবো তেমন তোমাকেও আমার ভুল শুধরে দিতে হবে।”


চলবে,

#ইচ্ছেঘুড়ি (৩৪)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

শান্তর পরিবার খুব দ্রুত বিয়ের আয়োজন সেড়ে ফেলতে চায়। সেজন্য আমাকে আজকের মধ্যে অফিস থেকে ছুটির ব্যবস্থা করতে বলেছে। শান্তর বাবা, মায়ের ইচ্ছা আজ যদি ছুটিটা পাশ হয়ে যায় তবে আমাদের নিয়ে তারা আজই তাদের বাড়ি চলে যাবে। যদিও ছুটি ম্যানেজ করা খুব কঠিন ছিলো। তবে সবসময় মন দিয়ে কাজ করায় কিছু সিনিয়রের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলাম৷ তাদের বিয়ের বিষয়টি জানাতে তারা ম্যানেজ করে দিলো।

আমার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ে করে ফেলেছি সেটা বলিনি। বিয়ে হবে এটা বলায় সবাই এটাই জেনেছে। এই কথা শুনে রায়ান কিছুটা হতাশ হয় বোধহয়। অথচ তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে পরিবারের পছন্দে। তাও আমার বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না। রায়ানের মুখের অবস্থা দেখে সেটা স্পষ্ট বুঝলাম। মানুষ বড় অদ্ভুত৷ কারো সুখে খুশি হয় না। দুঃখে আনন্দ পায়। রায়ান নিজ থেকে এগিয়ে এসে আমাকে বলে,“কাকে বিয়ে করছো? ঐ শান্ত নামের ছেলেটাকে?”

“হ্যাঁ।”
আমার মুখে এই কথা শুনে রায়ান উপহাস করে বলে,“মানলো তার পরিবার? তবে তোমার যা স্বভাব যেভাবে ছোট একটা ছেলের দিকে নজর দিয়েছো৷ তাতে মনে হয় তার পরিবার তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে।”

“আমাদের বয়সের পার্থক্য কিন্তু বেশি নয়। মাত্র এক বছর। তবুও শান্ত আমার ছোট সেটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু জীবনটা তো আমাদের। আমরা যখন দুজন বিয়ে করে ভালো থাকতে চাচ্ছি তখন আপনাদের উচিত নয় আমাদের ভালো থাকতে দেওয়া? তাছাড়া আপনার পরিবার রয়েছে। কিছুক্ষণ পূর্বে বিয়ে করলেন। নতুন বিয়ে। এই সময়ে স্ত্রীকে সময় দিবেন। সেটা না করে অন্যের পিছনে লেগে আছেন। এটা আপনার বয়স এবং চরিত্রের সঙ্গে যায় না।”
এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে কথাগুলো বললাম। আমার কথাগুলো রায়ানের পছন্দ হলো না বোধহয়। সেটা বুঝতে পেরেও আমি সেটা নিয়ে না ভেবে বরং রায়ানকে পাশ কাটিয়ে বের হই।


আমি বাড়ি ফিরে শান্তকে দশদিনের ছুটি পেয়েছি সেটা জানাতে সে খুশি হয়ে যায়। শান্তর বাবা, মা দুপুরের খাবার খেয়ে বের হওয়ার কথা ভাবছে। ইতিমধ্যে বাড়িতে শান্তর চাচার পরিবার চলে আসে। তাদের শান্তর বাবাই ডেকে পাঠিয়েছে। তাদেরকেও সাথে নিয়ে যাবে। যদিও শান্তর চাচা কাজের জন্য যেতে পারবে না। এসব কথা সবাই আলোচনা করছিলো। অন্যদিকে শান্তর মা এবং চাচী রান্নাঘরে খাবার তৈরি করছিলো। আমি সেদিকে গেলাম। রান্নাঘরে আসতে থমকে দাঁড়ালাম। শান্তর চাচী মাকে বলছে,“আমাদের শান্ত তো কোন দিক দিয়ে খারাপ নয়। তবে তার জন্য এমন এক মেয়েকে কেন পছন্দ করলে ভাবী?”

শান্তর মা কথাটি শুনে চুপ হয়ে যায়। সে কোন কথা বলে না। এদিকে এই কথা শুনে আমিও কিছুটা কষ্ট পেলাম। সত্যি তো এটাই। এই কথা শুধু যে শান্তর চাচীর তা নয়। বিয়েতে আসা আত্মীয় স্বজন সবারই থাকবে। তাছাড়া যেখানে বিয়ে হয়েছে, সেখানের সবাই আমাকে চেনে। এসব ভেবে আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেই সময়ে মায়ের নজর আমার দিকে পড়ে। সে আমাকে দেখে হাসার চেষ্টা করে বলে,“তুমি কখন আসলে?”

“এই তো মাত্র।”
আমিও হাসার চেষ্টা করে বললাম। মা এবং চাচীর সঙ্গে কাজে হাত লাগাচ্ছিলাম। কাজের ফাকে তাদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলছিলাম।

____
জয় তার বাবা, মায়ের কথা না শুনে তাদের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। এসব দেখে জয়ের মা খুব কান্না করে। ইতিমধ্যে খবর জয়ের বোনের কাছেও চলে গিয়েছে। সে এসেই জয়ের উপর চিৎকার করতে শুরু করে। সে বলে,“কী রে বিয়ে করে বউ পাগল হয়ে গেলি। দুদিনেই বউয়ের কথা নাচতে শুরু করেছিস? বউ এত পাগল করেছে? এখন বাপ মা কিছু না?”

“আমার কাছে আমার বাবা, মায়ের গুরুত্ব রয়েছে বলেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
জয়ের এই কথা শুনে তার বোন রাগ দেখিয়ে বলে,“ঢংয়ের কথা বলিস না। বাপ মায়ের কথা ভাবছিস, তাই তো তাদের ছেড়ে বউকে নিয়ে রঙ তামাশা করতে যাচ্ছিস।
এটা তো তোর কাজ হতে পারে না। তোর বউয়ের কাজ। নিশ্চয় তোর বউ কালো জাদু করেছে। তোর উপর জাদুটোনা হয়েছে।”

“আমারও তাই মনে হয়। জাদু না করলে আমার ভালো ছেলেটা এমন করবে কেন? আমার ছেলেটা আর আমার নেই?”
জয়ের মা কান্না করে বলে। এটা শুনে জয়ের বোন কাজলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,“এই কালনাগিনী কিভাবে আমার ভাইকে বশ করলি? তুই কিভাবে পারছিস, একটা সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটাতে? নিজের বাবা, মায়ের থেকে তো ভালো শিক্ষায় পেয়েছিস। স্বার্থপর বেয়াদব মেয়ে।”

“হ্যাঁ আমি খারাপ। আর আপনারা দুধে ধোঁয়া তুলসিপাতা। জয় তো কানা। চোখে দেখে না। তাই বউয়ের কথা নাচছে।”
কাজলের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। সে না পেরে মুখ খুলে। এটা শুনে জয়ের বোন বলে,“দেখলি কতবড় বেয়াদব তোর বউ? তোর সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বাজে কথা বলছে? তুই শুনছিস না?”

”ও কিভাবে শুনবে? ও তো আর আমাদের নেই। এই মেয়েটা জাদু করে পুরোপুরি ওকে নিজের বশে নিয়ে নিয়েছে।”
জয়ের মা কথাটি বলে। তার সঙ্গে তার বাবাও তাল মেলায়। বাবা, মা বোনের কথা শুনে অবশেষে জয় মুখ খুলে। সে নিতে না পেরে বলে,“চুপ করো তোমরা। আজ আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা কাজলের জন্য নয়। বরং তোমাদের জন্য নিতে বাধ্য হয়েছি। আর আপু তুই যে এত বড় বড় কথা বলছিস। তুই যদি মন দিয়ে নিজের সংসার করতি। ভাইয়ের সংসারে ঝামেলা করতে না আসতি তাহলে এসব হতোই না।”

“তুই কী বললি?
আমি তোর সংসারে ঝামেলা করছি?”
জয়ের বোন হতবাক হয়ে কথাটি বলে। এটা শুনে জয় বলে,“হ্যাঁ। তুই তো ঠিকই নিজের শ্বশুড় শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে গেলি। যতদূর জানি তোর স্বামীকে তো তার বাবা, মাকে দেখতেও দিস না। টাকা দিলে তো আরও ঝামেলা বাঁধাস। যেখানে তুই নিজের ভালো থাকার জন্য আলাদা হতে পারছিস সেখানে আমি হচ্ছি ওমনি আমার বউ আমাকে জাদু করছে? বাহ্।নিজের বেলায় ষোলো আনা। তাও তো তোর খুশি হওয়া উচিত এটা ভেবে যে আমার বউ আমাকে আমার বাবা, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে বাঁধা দিবে না। আমি রোজ আসবে। তাদের সব খরচও দেবো। যেটা তুই তোর স্বামীকে করতে দিচ্ছিস না। নিজে না শ্বশুড় শাশুড়ীর সাথে মিলে থাকতে পারলি। আর না নিজের সংসারটা ঠিকভাবে করছিস। মাসের অর্ধেক দিন এখানে এসে উঠে থাকিস। আর আমার বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করিস। কাজলকে এক মূহুর্তের জন্য শান্তি দিস না। মায়ের কান ভাঙাস বসে বসে। বলতে গেলে আজ আমি আলাদা হচ্ছি সেটার সবচেয়ে বড় কারণ তুই।”
জয়ের কথা শুনে তার বোন পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। জয় এসব কথা তাকে বলতে পারে সেটা সে কল্পনাও করেনি। জয় এবার তার মাকে বলে,“আর মা। আমার জানা মতে কাজল তোমাকে মা বানাতে চেয়েছিলো। তোমার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। আমি সব দেখেও সবসময় চুপ থেকেছি। কারণ আমি তোমাদের ভালোবাসি। তোমাদের সম্মান করি। যেটাকে তোমরা আমার দূর্বলতা ভেবে আমার বউকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছো। তার সঙ্গে দিনের পর দিন ঝগড়া করেছো। তাও আমি চুপ ছিলাম। শুধুমাত্র তোমরা আমার বাবা, মা। আমার পরিবর্তন তাই। তোমাদের ঝামেলা না নিতে পেরে বউয়ের গায়ে হাত অব্দি তুলেছি। কিন্তু তাও তোমরা আমার ভালোবাসার দাম দিয়ে। এক মূহুর্তের জন্য আমার বউকে আপন করতে পারোনি। যেহেতু একসাথে থাকতে পারছো না। তাই আমি আলাদা হচ্ছি। তোমরা যেমন আমার দায়িত্ব তেমন আমার বউও। তাই আমি এবার দুটোই দায়িত্বই পালণ করার চেষ্টা করছি। দয়া করে আমাকে এই চেষ্টাটা করতে দাও। বাঁধা দিও না।”
জয় শেষের কথাটি হাতজোড় করে বলে। অতঃপর কাজলের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়। কাজল জয়ের কথা শুনে প্রথমবার খুব মুগ্ধ হলো। জয় যে নিজের সিদ্ধান্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তার পরিবারকে মুখের উপর কিছু কথা বলেছে। এটাই কাজলের জন্য অনেককিছু। ঘরের বাহিরে বের হতে কাজল জয়কে জড়িয়ে ধরে। লোক লজ্জায় ভয়কে দূরে ঠেলে সে জয়কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,“আমি তোমাদের আলাদা করতে চাইনি। বিশ্বাস করো চাইনি। তবে আমি খুব খুশি। তোমার জন্য খুব খুশি।”
জয় এসব শুনে জবাব দেয় না। সে মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই সঙ্গে মনেমনে বলে,“আমার জন্য তুমি অনেক কেঁদেছো কাজল। আমি আর তোমাকে কাঁদতে দিবো না। আমি চেষ্টা করবো তোমাকে ভালো রাখার।”

____
শহরের বুকে রাত নেমে এসেছে। আমাদের বাস এসে তার গন্তব্যে থামলো। বহুদিন পর নিজের সেই চেনা শহরে এসে আমি কিছুটা থমকে গেলাম। বাস থেকে নামার সাহস করতে পারছিলাম না। শান্তর পরিবারের সবাই নেমে গেছে। বাস থেকে নেমে শান্তর মা আমার দিকে তাকিয়ে বলে,“নামছো না কেন?”

আমি জবাব না দিয়ে মৃদু হাসলাম। একদিন এই শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। নিজের খুশির জন্য বাঁচতে। আজ আবার সেই শহরে এসেছি।চেনা সেই শহর, পরিচিত সেই এলাকা, রোজকার সঙ্গী সেই গলি। সবকিছু আবার দেখবো এটায় যেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে তেমন চেনা মানুষগুলো আমাকে দেখার পর কেমন ব্যবহার করবে সেসব ভেবে ভয়ও হচ্ছে। তাই সাহস করে পা বাড়াতে পাচ্ছিলাম না। সেই সময়ে শান্ত এসে আমার ডান হাতটি শক্ত করে ধরে। শান্তর স্পর্শ পেয়ে আমি কিছুটা কেঁপে উঠলাম। অতঃপর শান্ত চোখে তার দিকে তাকাই। সে মিষ্টি হেসে চোখ দিয়ে ইশারা করে পা বাড়ানোর জন্য। শান্তর ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে আমি এবার সাহস করে পা বাড়াই। বাস থেকে নামার পরও শান্ত আমার হাতটি শক্ত করে ধরে রেখেছে। সে হাত ছাড়েনি। কিন্তু এটায় আমার বেশ সংকোচ হচ্ছিলো। সবাই ছিলো। তাই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। সেই মূহুর্তে শান্ত পাশে দাঁড়িয়ে বিরবির করে বলে,“স্বামী হাত ধরেছে তাতে এত সংকোচ হওয়ার কী আছে? নিজের শহরে এসে ওমনি চল্লিশ বছরের ভাব দেখানো শুরু করে দিয়েছো?”

“সবাই কী ভাবছে?”
আমি আস্তে করে কথাটি বললাম। এটা শুনে শান্ত বলে,“এটা ভাবতে বারণ করেছি না। এত লোকের কথা ভেবে কী হবে?”

“তো কার কথা ভাববো?”

”আমাদের কথা। আমার কথা, আমাদের বাচ্চার কথা।”

“হ্যাঁ?”
শান্তর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে কিছুটা শব্দ করেই বললাম। এটা শুনে সবাই আমাদের দিকে তাকালো। তবে কেউ কিছু বললো না। শান্তর বাবা শান্তর আমার হাত ধরে রাখা দেখে তার মাকে বলে,“শান্তর মা আমাকে ধরে রাখো। তোমার ছেলের দায়িত্বজ্ঞান দেখে কখন জানি হার্ট অ্যাটাক করে বসি।”

“তুমি শান্তর মতো করে কথা বলা শুরু করে দিয়েছো?”
শান্তর মায়ের মুখে এমন কথা শুনে তার বাবা কিছুটা রাগ করেই বলে,“আমি ওর মতো করছি না। ও আমার ছেলে। ও বাবার মতো হয়েছে।”

“কি!”
শান্তর মা অবাক হওয়ার ভাব ধরে কথাটি বলতে শান্তর বাবা বলে,“বাবা হিসাবে আমি কঠোর। কিন্তু মনে করে দেখো স্বামী হিসাবে আমি কিন্তু শান্তর মতোই ছিলাম। ও এই গুনটা আমার থেকেই পেয়েছে। যদিও বা জীবনে ভুল মেয়েকে বেছে নিয়েছে। পোড়া কপাল আমাদের।”
শেষ কথাগুলো কিছুটা মন খারাপ করেই বলে শান্তর বাবা। শান্তর মা ইশারায় এখানে এসব কথা বলতে বারণ করে। অতঃপর কথা বাদ দিয়ে শান্তর বাবা বাসায় যাওয়ার জন্য একটি অটো ঠিক করে। সেই সময়ে হঠাৎ শান্তর চাচী বলে উঠে,“ভাবী শান্তর বউও আমাদের সঙ্গে থাকবে। বিয়ের অনুষ্ঠান অব্দি না মেয়েরা তার বাবার বাড়ি থাকে। আর এই মেয়ে শ্বশুড়বাড়ি থাকবে।”

শান্তর চাচী কথাটি যথেষ্ট জোরে বলেছে। যেটা আশেপাশে থাকা কয়েকজন শুনেছে। তারা আমাদের দিকে তাকাতে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এটা দেখে শান্ত হাসি মুখে বলে,“বিয়ে তো হয়েই গেছে। তুমি যেটা বললে সেটা বিয়ের আগের নিয়ম। এখন যেহেতু ও আমার বউ তাই আমার সঙ্গেই থাকবে। এখানে খারাপের কিছু নেই। বরং তুমি একটু বেশিই ভাবছো।”

“এসব কথা বাদ দাও। সবাই গাড়িতে ওঠো।”
শান্তর বাবা এই কথা বলতে সবাই গাড়িতে উঠতে শুরু করে। আমি উঠতে নিবো সেই সময়ে শান্ত মৃদু রাগ দেখিয়ে বলে,“তোমাকে বলেছি না কারো কথায় মন খারাপ করবে না। তুমি এসব কথা এত কানে নাও কেন? তোমার এত ভাবতে মন চাইলে আমাদের কথা ভাবো। আমাদের কথা ভাবলে তোমার মন সবসময় খুশি খুশি থাকবে।”

এটা বলে শান্ত আমার হাতটি ধরে আমাকে গাড়িতে উঠতে বাঁধা দেয়। অতঃপর তার বাবাকে বলে,“তোমরা যাও। আমার একটু পরে আসছি।”

“কিন্তু?”
শান্তর মা কিছুটা আমতা আমতা করলেও শান্তর বাবা রাজি হয়ে যায়। সে তাদের পরে আসতে বলে। শান্তর বাবা জানে শান্ত কেমন? তাই এখন রাস্তার মাঝে কোনরকম বাক বিতণ্ডে জড়ানোর কোন মানে হয় না। তাছাড়া এটা আজ নতুন নয়।শান্ত আমার সঙ্গে অনেক ঘুরেছে। তার উপর এখন তো বউ। তাই তিনি রাজি হয়ে যান। গাড়ি ছেড়ে চলে যায়। শান্ত এটা দেখে একটা রিকশা ডাক দেয়। আমি এসব দেখে বললাম,“আবার আলাদা রিকশায় ওঠার কী প্রয়োজন? আমরা তো একসাথে বাড়ি যেতে পারতাম?”

“না পারতাম না।
আমার বউ মানুষের কথাই খুবই কান দেয়। তাকে মানুষের কথা কানে না নেওয়া শেখাতে হবে। তাছাড়া তার মনটাও খুব খারাপ। সেটাও ভালো করতে হবে। তাই একসাথে বাড়ি যেতে পারতাম না।”
শান্ত এই কথা বলে মিষ্টি করে হাসে। আমি আর কথা বাড়াই না। শান্তর সঙ্গে রিকশায় উঠে পড়ি। শান্তর কাধে ব্যাগ দেখে আমি বললাম,“ঘুরতে যাবেন যখন ঠিক করেছেন তখন এটা সঙ্গে নেওয়ার কী দরকার ছিলো? এটা তো বাবা, মায়ের কাছে দিয়ে দিলে পারতেন।”

“না এটা দেওয়া যেতো না।”

“কেন?”
আমি কৌতূহল হয়ে জিজ্ঞেস করে শান্ত খুব খুশিমনে বলে,“এটার মাঝে তোমার জন্য বিশেষ একটি উপহার রয়েছে। এখন আবার এটা দেখতে চেও না। এটা আমাদের যেদিন বাসর হবে সেদিন দিবো।”

“মানে? এখন দেখার আগ্রহ জাগিয়ে দেখাবেন না? এটা কেমন হলো?”

“বেশ ভালো। অপেক্ষা করুন।
অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”

“আচ্ছা। এটা আবার কি নাটক?”

“নাটক কোথায়। এটা একটা বিশেষ উপহার। আমি আপনাকে স্পেশাল মূহুর্তে দিবো।”

“আমি সেটার কথা বলছি না।
আপনি আমাকে আবার আপনি করে কেন বলছেন?”
শান্ত আমার কথা বুঝতে পেরে খুবই ভাব নিয়ে বলে,“পাশে চল্লিশ বছরের কাকিমা নিয়ে বসে আছি তো তাই তুমি আসছে না। তাছাড়া আপনি সারাদিন আপনি আপনি করবেন আর তুমি তুমি করবো কেমন দেখায় না?”
এটা শুনে আমি বিরক্ত হয়ে শান্তর দিকে তাকাতে শান্ত হেসে দেয়। হঠাৎ এই মূহুর্তে রিকশা থেমে যায়। শান্ত অবাক হয়ে বলে,“কী হলো মামা?”

“দাঁড়ান দেখছি।”
রিকশাচালক নেমে দেখে। সমস্যা বুঝতে পারছে না। তার রিকশা নষ্ট হয়ে গেছে বুঝতে পেরে বলে,”পোড়া কপাল। বেরসিক বউয়ের জ্বালায় বাঁচি না। এখন দেখছি রিকশাও দুই নাম্বারি করছে।”

“শান্ত ভালো হচ্ছে না।
আপনার এসব ফালতু মজায় আমি কিন্তু মজা পাচ্ছি না।”

“সত্যি পাচ্ছেন না?
রাগ হচ্ছে?”
শান্ত এটা জিজ্ঞেস করতে আমি সম্মতি নন।রসিক। তো দেখান নিজের রসিকতা।”

“কি!”
আমি অবাক হতে শান্ত আমাকে চোখ মেরে বলে,“বেসরিক বউ শুনেই তো রাগ করলেন। এর অর্থ কি?”
আমি শান্তর কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে মৃদু রাগ করে বলি,“আপনি আর একটা রিকশা ডাকুন যান।”

“হ্যাঁ তা তো ডাকছি।
তা সেটা ডাকলে বুঝি রসিক হবেন। মানে রোমান্টিক। হুডি তোলা রিকশায় রোমান্টিক বউ। কিছু হবে নাকি?”
শান্তর মজা শুনে আমি লজ্জা পেলাম। তবে সেটা বুঝতে না দিয়ে বললাম,“জে না। আমি চল্লিশ বছরের কাকিমা আছি এটাই ঠিক আছি।শুনে রাখুন আপনাকে এই চল্লিশ বছরের কাকী মায়ের সঙ্গেই থাকতে হবে। সারাজীবন থাকতে হবে।”

“হ্যাঁ পোড়া কপাল। শেষমেশ কপালে জুটলো…।”
শান্ত কথাটি শেষ করার আগে আমি তার বুকে আলতো করে ঘুষি দিলাম। তারপর বললাম,“ভালো হচ্ছে না শান্ত।”

”মন ভালো হয়েছে?”
শান্তর এই কথাটি শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। সত্যি তাই। শান্তর সঙ্গে কয়েক মূহুর্ত থাকতে আমার মন ভালো গেল। এসব দেখে আমি নরম গলায় বললাম,“আপনি সারাজীবন এমন থাকবেন তো শান্ত?”


চলবে,