ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-৩৭+৩৮

0
25

#ইচ্ছেঘুড়ি (৩৭)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

ভোরের মিষ্টি আলো চোখে পড়তে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ মেলে তাকিয়ে পাশে শান্তকে দেখে মুচকি হাসি দিলাম। ঘুমন্ত শান্তর মুখটা বেশ ভালো লাগছে। একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। কি নিষ্পাপ মুখশ্রী! এটা ভাবতে মন বলে উঠলো,“যারে যার ভালো লাগে। তার সবই ভালো লাগবে।”
মনের কথাটা বুঝতে পেরে আবারও হেসে দিলাম৷ হাসি মুখে ধরে রেখে শান্তর কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে দিলাম। অতঃপর শান্তর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে গেলাম। গোসল করে ফ্রেশ হতে হতে শান্ত উঠে গেল। শান্ত উঠে এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,“এই তুমি এত ভালো শাড়ী পড়তে পারো কেন?”

“মানে?”
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করতে শান্ত আমার ঘাড়ে মুখ রেখে বলে,“তুমি বড্ড আনরোমান্টিক। শাড়ী পড়তে পারলেই পড়তে হবে। একদিন নাহয় এলোমেলোভাবে পড়ে আসতে।”

“মানে? আমি শাড়ী পড়তে না পারলে তুমি খুশি হতে?”

”হ্যাঁ। তাহলে আমি তোমাকে শাড়ী পড়ানোর সুযোগ পেতাম৷”
শান্ত এটা বলে একটু থেমে আবার বললো,“ভাবো তো। সিনেমার মতো আমি তোমাকে শাড়ী পড়িয়ে দিতাম। কত রোমান্টিক হতো বিষয়টা। কত সুন্দর হতো। তাই না?”

“শাড়ী পড়াতে পারো?”
আমি এই কথা বলতেই শান্তর মুখের হাসি চলে যায়। সে বিরক্ত হয়ে বলে,“এই সময়ে এই কথাটা জিজ্ঞেস করা লাগে তোমার। ইশ আমি কত সুন্দর রোমান্টিক একটা দৃশ্য ভাবছিলাম।কোথায় সঙ্গ দিয়ে তুমিও দৃশ্যটা কল্পনা করবে। তা না করে কী বোরিং একটা প্রশ্ন করলে? শাড়ী পড়াতে পারো?”

“বুঝে গেছি।”
আমি এই কথা বলে শান্ত আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,“কী বুঝেছো?”

“তোমার দৌঁড়। মানে তুমি যে এত সুন্দর রোমান্টিক দৃশ্য কল্পনা করছো। ওটা কল্পনা অব্দিই আছে। বাস্তবে শাড়ী পড়াতে গিয়ে হিমশিম খাবে। তাই না?”
আমার কথা শুনে শান্ত কিছুটা সময় চুপ থাকে। অতঃপর কিছু একটা ভেবে বলে,“শাড়ী পড়াতে পারি না বলেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারছো।”

“মানে?”
আমি বুঝতে না পেরে শান্তর দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকাই। এটা বুঝতে পেরে শান্ত হাসি মুখে ফুটিয়ে বলে,“শাড়ী পড়াতে পারলে তো তোমার মনে ভয় থাকতো না যে কোন মেয়েকে পড়িয়ে অভ্যস্ত। তোমার সতীন থাকার সম্ভাবনা থাকতো। এখন যেহেতু পারি না সেহেতু এই সম্ভাবনা নেই।”
শান্তর কথা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে তাকাই। এরপর বলি,“তোমার সঙ্গে এখন এসব কথা বলার সময় নেই। আসছি আমি।”
এটা বলে আমি শান্তকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি।

___

আমি ঘর থেকে বের হয়ে শান্তর মাকে রান্নাঘরে দেখে তার কাছে আসলাম। আমি আসতে সে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বলে,“ঘুম ভাঙলো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। অতঃপর মুখে বললাম,“আমি আপনাকে সাহায্য করি মা।”

”না। তুমি ঘরে যাও।
আরাম করো।”
মায়ের কথা শুনে হাসি মুখে বললাম,“এতদিন তো করলাম আরাম। এবার নাহয় অতিথি থেকে একটু বাড়ির বউ হই।”
আমার কথা শুনে মা আমার দিকে তাকায়। আমি নরম গলায় বললাম,“প্লীজ মা।”
শান্তর মা মুখে কোন কথা বললো না। সে ইশারায় কাজ দেখিয়ে দিলো। আমি তার হাতে হাতে কাজ করতে শুরু করলাম। কাজ করার ফাঁকে নিজ থেকেই বললাম,“মা আপনি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেন, তাই না?”

”হ্যাঁ। এটা আমার অভ্যাস।
তাই বলে তোমাকে রোজ সকালে উঠতে হবে না। আমি সেইসব শাশুড়ীদের মতো নই যে বউ একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে তাহলে রেগে যাবো। এতটা খারাপ নই।”
মায়ের কথা শুনে আমি হাসি মুখে জবাব দিলাম,“তবুও তাড়াতাড়ি ওঠা উচিত। মা এত সকালে উঠে সব কাজ সাড়বে আর আমি শুয়ে থাকবো। এটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া দুজনে মিলে গল্প করতে করতে কাজ করলে, কাজটা করতে আনন্দ পাওয়া যাবে।”
মা আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকায়। আমাদের কথার মাঝে শান্তর মামী এবং চাচী চলে আসে। চাচী আমাকে রান্নাঘরে দেখে একটু বাকা করেই বলে,“বাহ্। তোমার বৌমা তো বেশ ভালো। সকাল সকাল চলে এসেছে তোমাকে কাজে সাহায্য করতে। করবেই তো। থাকবেই বা কতদিন, কিছুদিনের ব্যাপার তো। এই কয়টা দিন কাজে সাহায্য করে যদি একটু ভালো বৌমার তকমা পাওয়া যায় তবে ক্ষতি কিসের? ভালো তো?”
একটু থেমে আবার বলে,“বয়স যে বাতাসে বাড়েনি সেটা কিন্তু তোমার বৌমা দেখিয়ে দিলো। বুদ্ধিও আছে।”

“এই যুগের মেয়ে হয়ে এতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না দিলে তো টিকে থাকা যাবে না। তাই না আপা?”
মামী কথাটি বলে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমাকে মিষ্টি করে বললো,“তুমি এসব ঘাবড়ে যেও না। আসলে শান্তর চাচী আবার বুদ্ধিহীন মেয়ে তার ছেলের জন্য খুঁজছে তো। তাই তোমাকে ঠিক হজম হচ্ছে না।”
এটা বলে শান্তর মামী নিজে থেকে হাসে। তার কথা শুনে মা বলে,“ভাবী ছাড়ো তো।”
এরপর চাচীর দিকে তাকিয়ে বলে,“ভাবী আপনি বসার ঘরে বসুন। আমি চা নাস্তা নিয়ে আসছি।”

“হ্যাঁ। যা করার জলদি করো।
আমাদের আবার এখন ফিরতে হবে।”
এটা বলে মুখ বেকিয়ে চাচী চলে গেলেন। মাও চা নাস্তা নিয়ে তার পিছনে গেল। এতক্ষণ এটাই আমি রেডি করছিলাম। মা এবং চাচী চলে যেতে মামী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,“সংসার বড় কঠিন জিনিস।তাই সব কথা গায়ে লাগাবে না। একটা কথা মাথায় রেখো তুমি সবার পছন্দের মানুষ হবে না। তাই বাকা কথা একটু বাকা ভাবেই নিও।”
মামীর কথা আমার বেশ লাগলো। আমি মাথা নাড়ালাম। মামী হাসি মুখেই বলে,“তুমি কিন্তু দেখতে বেশ মিষ্টি। আমাদের শান্তর পছন্দ আছে।”
মামীর সঙ্গে বসে টুকটাক কথা বললাম। মানুষটা বেশ ভালো। এত ভালো বলেই বোধহয় মামার ফুল গাছ নিয়ে করা বাচ্চামো খুব সুন্দরভাবে সামলে নেয়। এজন্য পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার পরও কখনো তাদের ঝগড়া করতে দেখিনি। এসব ভেবে আমি বললাম,“আপনিও খুব মিষ্টি মামী।”
আমার কথা শুনে মামী মুচকি হাসলো।

____

শান্তর মামা, মামী চলে গেল। এখন চাচার পরিবারও চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। যাবার সময় বিদায় নিতে গিয়ে চাচী মাকে বললো,“ভাবী তোমার বৌমাকে ডাক্তার দেখানোর লাগলে এখনই দেখিয়ে নিও।”

“কেন?
এই সময়ে ডাক্তার কেন?”
মা বুঝতে না পেরে চাচীকে প্রশ্ন করে। চাচী খুব নরম গলায় বলে,“আমাকে খারাপভাবে নিও না। আমি তোমাদের ভালোই চাই। শোনো মেয়ের বয়স আটাশ উনত্রিশ বছর। এই বয়সের মেয়েদের বিয়ের পর বাচ্চা হতে অনেক সমস্যা হয়। তাই নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাইলে আগেই ভালো ডাক্তারের কাছে যাও৷ যদিও জানি না কাজ হবে কি-না।”

“এখনই এত নেগেটিভ ভাবছেন কেন ভাবী?
এমন কিছু হবে না। এত খারাপ না ভাবি আমরা।”
মা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলার চেষ্টা করে। এটা শুনে চাচী বলে,“আরে রাখো তো ভালো মানুষি।
আমি খুব ভালোভাবে জানি তুমি শান্তর পাশে এমন মেয়েকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছো না। তাও মেনে নিয়েছো। ঐ অব্দিই থাকো না। তাকে এত ছাড় দিতে যেও না। বলে দিচ্ছি। পস্তাবে খুব। তাছাড়া তোমারও তো বাচ্চা হবে কি-না এটা নিয়ে সন্দেহ আছে। বলো আছে না?
তাহলে এখন ডাক্তারের কথা ভাবলে দোষ কোথায়?”
এভাবে চাচী মাকে নানাভাবে বোঝায়। সব শুনে মা কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায়। তার মনেও সন্দেহ জাগে। তবুও সে হাসার চেষ্টা করে বলে,“না গো ভাবী। এমন কিছুই হবে না। আপনি এত ভাববেন না। মেয়েটা পছন্দ নয় বললে খারাপ হবে। ওতটাও তো খারাপ নয়।”

“হ্যাঁ ওরকম সবাইকেই দেখে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। যাই হোক ভালো পরামর্শ দিলাম, নিলা না। পরে পস্তাবে। এই মেয়েকে একটু বেশি লাই দিচ্ছো। কী হবে ডাক্তারের কথা বললে? একটু কষ্ট পাবে এই তো? এটা নিয়ে এত ভাবছো কেন? এই ভাবনাটাই বেশি। এত ভেবে তাদের লাই দিচ্ছো বলেই একদিন ঐ মেয়ে তোমাদের মাথায় উঠে নাচবে। দেখে নিও। সেদিন কেঁদে কুল পাবে না।”
এসব কথা বলে চাচী বিদায় নিয়ে চলে যায়। তবে তার কথাগুলো মা ফেলে দিতে পারে না। শাশুড়ী মন তো। তার উপর বৌমা পছন্দ হয়নি। সেজন্য একেবারে ফেলে দিতে পারে না। আমি তাদের কিছুটা কাছেই ছিলাম। তাই না চাইতেও সব কথা শুনে নিয়েছি। যদিও চাচী আমাকে দেখেছিলো। তবুও থামেনি। আমার তো মনে হয় এসব কথা আমাকে শোনানোর জন্যই আরও বেশি করে বলেছে। চাচী বিদায় নিয়ে চলে যেতে মা আমার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকালো। আমি তার দৃষ্টি দেখে মাথানত করে নিলাম।

বাবা অফিসে চলে যায়। আর শান্ত চাচাদের পরিবারকে এগিয়ে দিয়ে আসতে যায়। ঘরে এখন আমি এবং মা শুধু। এই সময়ে মা আমাকে তার ঘরে ডাকে। আমি তার ঘরে যেতে তিনি বলেন,“পাশে বসো।”
আমি মায়ের পাশে বিছানায় বসি। শান্তর মা আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে,“কোন ঔষধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমরা বরং এখনই বাচ্চার জন্য ট্রাই করো।”

আমি এই কথা শুনে মায়ের দিকে তাকালাম। সে এই কথা কেন বললো সেটা আমি জানি। তাই মিষ্টি হেসে বললাম,“এরপরও যদি বাচ্চা না হয়?”

আমার মুখে এই কথা শুনে মা কিছুটা রেগে বললো,“বাজে কথা বলো না।
বাচ্চা হবে না কেন? তোমার কী সমস্যা আছে? এটা জানো নাকি?”
মায়ের রাগ দেখে আমি তার হাতে হাত রাখলাম। আমি হাত রাখতে সে কিছুটা চমকে উঠলো। আমি শান্ত গলায় বললাম,“মা এভাবে রেগে যাবেন না প্লীজ। বাচ্চা তো আমার হাতে নেই। এটা তো আমি চাইলেই গর্ভে ধারণ করতে পারবো না। তাই না?
আমি সেটাই বলতে চেয়েছি। ধরেন আমার বাচ্চা হলো না। তাহলে বুঝি আপনাকে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবেন?”
আমার শেষ কথাটি শুনে শান্তর মা কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলে,“শান্তকে তো পাগল বানিয়ে ফেলেছো। চাইলেই তো তোমাকে বের করতে পারবো না। তবে হ্যাঁ আমার শান্তর সন্তান নাহলে আমি কিছুতেই তোমাকে মেনে নিতে পারবো না। কখনো না।”

“আচ্ছা।”
এটা বলে আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ি। এটায় মা হতভম্ব হয়। আমি হাসি মুখে বলি,“জানেন মা। আমার না নিজের মা নেই। আমি জানিও না আমার বাবা, মা কে? কারা আমায় জন্ম দিয়েছে? তবে হ্যাঁ বাবা, মা হিসাবে দুজনকে পেয়েছিলাম। কিন্তু তারা কখনো আমাকে বাবা, মায়ের যে একটা স্নেহ হয় সেটা দেয়নি। আমি তাদের সঙ্গে কখনো সন্তানের মতো জোর খাটাতে পারিনি। তবে আজ আপনার কোলে মাথা রাখিয়ে একটু জোর খাটাতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে। আর শান্ত বলে যা মন চায় তাই করা উচিত। যদি আমার সেই মনে চাওয়া কারো ক্ষতি না করে। তাই করে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না যেন।”
আমি এই কথা বলে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরি। মা কিছু বলে না। সে আসলে খুব অবাক হয়েছে। তাই বিষ্ময়ে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। আমি এটা বুঝতে পেরে নরম গলায় বললাম,“মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন।”
আমার মুখ দিয়ে কথাটি বের হতেই শান্তর মা আলতো করে মাথায় হাত রাখে। আমি খুশি হই। খুশিমনে বলি,“এভাবে কেউ কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দেইনি মা। আপনি দিলেন। আপনি তো আমায় ঋনি করে দিলেন।”

মা কোন জবাব দেয় না। সে শুধু আমার কথা শুনে। আমিও বলতে শুরু করি,“মা এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই।ছিলো না। এখন আপনারা আছেন। আপনারাই আমার সব। আমি জানি আপনারা আমাকে পছন্দ করেন না। তবে শান্তকে খুব ভালোবাসেন। তাই মেনে নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে আপনারা খুব ভালো। তাই তো মেনে না নিয়েও সকলের সামনে আমার সম্মানের জন্য লড়াই করেছেন। এটা অনেক বড় কিছু আমার জন্য। আপনারা ভালো বলেই শান্ত এত ভালো। তবুও কোথাও গিয়ে আমি আপনাদের কাছের কেউ হতে পারছি না। আমি চেয়েও আপনাদের কাছের হতে পারছি না। আমি জানি এটা এত সহজ নয়। অপছন্দের কাউকে আপন করা সহজ নয়৷ তাই এটা করতে আমাকে অনেক সময় দিতে হবে। আমি সেই সময়টা দিতেও চাই। তবে আজ যেহেতু আপনি বাচ্চা নিয়ে কথা বললেন। বিশেষ করে অন্যের কথায় বাচ্চা নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। তাই আজ আপনাকে আমি কিছু কথা বলতে চাই। এটা জরুরি। আমি আশা রাখছি আপনি আমার কথা মন দিয়ে শুনবেন। প্লীজ মা শুনুন।”
এটা বলে আমি থেমে যাই। মা আমার মাথায় ভালো করে হাত বুলিয়ে দেয়। অতঃপর বলেন,“বলো? আমি শুনতে চাই।
যদি কিছু কথা শুনলে সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব কিছুটা হলেও কমবে, তাহলে সেটা শোনা উচিত। হ্যাঁ আমি তোমার বয়স, তোমার পরিচয় সবকিছু নিয়ে দ্বিধায় আছি। আমি চেয়েও তোমাকে আমার শান্তর পাশে মানতে পারছি না। আর যখনই মানতে চাই তখনই মনে হয় এই সম্পর্কের ভবিষ্যত ভালো হবে না। আমার ঘরে যদি নাতি নাতনি না আসে? হতে পারে তুমি এটা শান্তর চাচীকে বলতে শুনেছো? তবে তার এই কথাগুলো কিন্তু কোথাও গিয়ে আমার মনের কথাই। আমার মনের ভয়ের কথা। তাই আমি তোমার কথা শুনতে চাই। যদি তোমার কথা শুনে আমার মনের ভয় কাটে। সংশয় দূর হয়। আমাদের শাশুড়ী বৌমার সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়। তবে অবশ্যই আমি মনোযোগ দিয়ে তোমার কথা শুনবো।”


চলবে,

#ইচ্ছেঘুড়ি (৩৮)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

“আমি আমার বাবা, মায়ের দত্তক নেওয়া মেয়ে। শুধু এই একটি কারণে তারা আমাকে কখনো ভালোবাসতে পারেনি। আমাকে দত্তক নেওয়ার পর হঠাৎ তাদের বাচ্চা হয়ে গেল। তাই নিজের মেয়ে এবং পালিত মেয়ের মাঝে পার্থক্য তারা অনুভব করতে শুরু করলো। অতঃপর আমার সারাজীবনটা অনাদার, অবহেলায় কাটলো। আমি কখনো বাবা, মায়ের ভালোবাসা কেমন হয় সেটা অনুভব করতে পারিনি। অতঃপর যখন স্বপ্ন দেখলাম বিয়ে, একটা সুন্দর সংসারের। জীবনে কিছু চাইনি। শুধু চেয়েছিলাম এমন একজন মানুষ, যার হাত ধরে আমি নতুন এক পরিচয় পাবো। একটা সুন্দর সংসার হবে আমার। যেই সংসারে পা দিলে আমার সব দুঃখ ঘুচবে। সেই সময়ে আমার বাবা, মা আমার চাকরির লোভে পড়ে গেল। বিয়ে হলে খরচ করতে হবে সেই ভয় জন্মালো। নাম পরিচয় হীন এক মেয়েকে বড় করেছে এটাই অনেক। এত খরচ কেন করবে? কিন্তু বারবার যে সম্মোন্ধ আসছিলো। তাই না পেরে আমার মা সবাইকে বলে দিলো, আমি বিয়ে করতে চাই না। বিয়ের প্রতি আমার আগ্রহ নেই। আমার কোন চাহিদা নেই। এক নিমিষেই এই কথাটা সবার মাঝে ছড়িয়ে গেল। আমার দুঃখ ঘোঁচার স্বপ্নটা ভেঙে গেল।”

একটু থেমে শান্ত গলায় আবার বললাম,“একটা সময় আমি আমাকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ইচ্ছে করতো ম রে যাই। তবে ম রার জন্যও অনেক সাহসের প্রয়োজন ছিলো। যেটা আমার ছিলো না। নির্দিষ্ট এক গন্ডির মাঝে আমার জীবনটা আটকে গেল। বলা যায়, নির্দিষ্ট এক সময়ের মাঝে। জীবনের সব চাওয়া পাওয়া নিয়ে ভাবতে যখন ভুলে গেছিলাম তখনই শান্ত আমার জীবনে আসে। এক টুকরো ভরসা হয়ে। যার ছোঁয়ায় আমি নতুন করে বাঁচতে শিখেছি। নির্দিষ্ট এক সময়রেখায় আটকে যাওয়া পুষ্পের জীবনের ছকভাঙার সূচনা হয় শান্তর হাত ধরে। যার মাধ্যমে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। নতুনভাবে সব শুরু করেছি। শান্ত জীবনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার আমার দুঃখ ঘোঁচার স্বপ্নটা দেখতে শুরু করি। স্বামী, সন্তান, শ্বশুড়, শাশুড়ী সবার সঙ্গে মিলে একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।
আমি যে বাবা, মায়ের ভালোবাসা কখনো অনুভব করতে পারিনি সেটা অনুভব করার স্বপ্ন দেখি। আমার শ্বশুড়, শাশুড়ী যাদের মাঝে আমি আমার সেই বাবা, মায়ের ছাঁয়া পেতে চাই। বিশ্বাস করুণ মা, আমার এতটুকুই চাওয়া। আমি কখনো চাইনি আমার জন্য কোন বাবা, মায়ের সঙ্গে তার সন্তানের দূরত্ব তৈরি হোক। এখনো চাই না। শান্ত আপনাদের সন্তান। তার সঙ্গে আপনাদের সুন্দর সম্পর্ক থাকুক সেটাই আমি চাই। তাই দয়া করে অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে এটা ভাববেন না আমি আপনাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে এসেছি। না মা। এটা আমি করতে আসিনি। কখনো করবো না। আমি এক পোড়া কপালি। দুঃখী মানুষ। আমি জানি কষ্টের অনুভূতি কেমন হয়। তাই আমার দ্বারা কারো জীবনে কষ্ট, যন্ত্রণা অনুভব হোক সেটা কখনোই চাইবো না। এইটুকু বিশ্বাস আমার উপর রাখুন মা।”
এতক্ষণ অব্দি আমার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন মা। সে কোন কথা বললেন না। আমি একটু থেমে আবার বললাম,“এবার যদি বলি সন্তানের কথা। হ্যাঁ মা আমিও জানি আজকাল প্রায়ই মেয়েদেরই দেখা যাচ্ছে বাচ্চা হচ্ছে না। হরমোনাল অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে বয়স বেশি হলেও হয়তো সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এসব কিছুর উর্ধ্বে এটাই সত্যি যে আল্লাহ না চাইলে কখনোই সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। আবার সে চাইলে কখনোই বলা যায় না যে সন্তান হবে না। তাই যেটা আমাদের হাতে নেই সেটা ভেবে এখন কষ্ট পাওয়াটা উচিত। বলুন না মা?
ধরে নিলাম আমার বাচ্চা হবে না। এজন্য আপনি আমাকে কখনো মেনে নিবেন না মা? আল্লাহ যদি আমার কোলে সন্তান না দেয় তাহলে কী আমি অপবিত্র হয়ে যাবো? এতটাই খারাপ হয়ে যাবো যে আমাকে ভালোবাসা যায় না? তাছাড়া মা আমি ভেবে নিয়েছি, আমার যদি সন্তান না হয় তবে আমি একজন সন্তান দত্তক নিবো। অবশ্যই সেই সন্তান আমার মতো পুষ্প হয়ে বড় হবে না। তাকে আমি এমনভাবে বড় করবো যাতে আমার বাবা, মা তার বেড়ে ওঠা দেখে লজ্জায় পড়ে যায়। তাদের মাঝে এখন যে অনুশোচনার রেশ মাত্র নেই তখন তাদের চোখে মুখে সেই অনুশোচনা ফুটে উঠুক।”

“তারমানে তোমার মনে আশংকা রয়েছে তুমি মা নাও হতে পারো?”
মায়ের মুখে এই কথা শুনে আমি তাকে ছেড়ে উঠে বসলাম। নরম গলায় বললাম,“মা আমি হবো। সেটা গর্ভের সন্তান হোক কিংবা গর্ভের নয়। তবে আমি মা হবো। খুব ভালো মা হবো। আর আমি জানি শান্তও খুব ভালো বাবা হবে। ও আপনাদের সন্তান তো। আপনাদের মতোই ভালো হবে।”

“বুঝলাম।
শান্তর উপর অনেক বিশ্বাস তোমার। সেই সঙ্গে আমি যে দ্বিধায় ভুগছি সেটা তোমার মাঝেও রয়েছে। আর তুমি চাও তোমাকে আমি এভাবেই মেনে নেই। ভালোবাসি। তাই তো?”
মায়ের কথা শুনে আমি চুপ হয়ে রইলাম। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ বুঝে মা বললো,“ভালোবাসা এভাবে হয় নাকি? ভালোবাসা এত সহজ নয়। আমাকে ওপর পাশের মানুষটি ভালোবাসবে কি-না এটা আমার উপরই নির্ভর করে। হ্যাঁ নির্ভর করে। আমি যদি ওপর পাশের মানুষের সঙ্গে একটি সম্পর্কে জুড়ে যাই তবে সেই মানুষটির ভালোবাসা অর্জন করার চেষ্টাটাও আমাকেই করতে হবে।”
আমি কিছু বলতে নিলে মা আমাকে থামিয়ে দেয়। সে খুব নরম গলায় বলে,“এতক্ষণ আমি মনোযোগ দিয়ে তোমার কথা শুনেছি না। এবার তুমি শোনো।”
আমি থেমে গেলাম। মাথা নাড়িয়ে মাকে বলার জন্য বললাম। মা বললো,“সম্পর্কে আমি তোমার শাশুড়ী। তোমার দ্বিতীয় মা। বলতে গেলে প্রথম মা। কারণ তুমি তোমার জন্মদাত্রী মাকে দেখোনি। যাকে দেখেছো সে আর যাই হোক মা নয়। যে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে মেয়েকে অপমান করতে দুবার ভাবে না সে আর যাই হোক মা নয়। এটা আমি বুঝি। তো যা বলছিলাম, আমি তোমার মা। সন্তান হিসাবে তোমার উচিত নয় এই মায়ের মন জয় করার। আমার স্থানে দাঁড়িয়ে দেখো। শুধু আমার নয়, শান্তর বাবার এবং আমার উভয়ের। আমাদের পক্ষে কিন্তু একমাত্র ছেলের বউ হিসাবে তোমাকে মেনে নেওয়া কষ্টকর। সেই হিসাবে দাঁড়িয়ে বিয়ের দু’দিন যেতে না যেতে ভালোবাসা দাবি করাটা ভুল পুষ্প। আর ভালোবাসা চেয়ে নিতে হয় না। সেটা অর্জন করতে হয়। তুমি আমাকে যেসব কথা শোনালে তাতে মনে হলো তুমি আমার ভালোবাসা চাচ্ছো। চেয়ে নিতে চাইছো। এটা কী কেউ চাইলেই দেওয়া যায়? যায় না। এটা অর্জন করতে হয়। ঠিক এভাবে যেভাবে তুমি অধিকার খাটিয়ে আমার কোলে মাথা রাখলে। এভাবেই নিজের কাজ দ্বারা ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়।”
এতটা বলে মা থেমে যায়। অতঃপর একটু থেমে আবার বলে,“হ্যাঁ আমি জানি। একপাক্ষিক দুনিয়াতে কিছু হয় না। বউ শাশুড়ীর সম্পর্ক সমাজ ভালো চোখে নেয় না। তাদের কাছে এই সম্পর্ক মানেই একটা যুদ্ধ। দুজনের ভেতর অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক বৌমারা অনেক চেষ্টা করে এই প্রতিদ্বন্দ্বীতা বাদ দিয়ে শাশুড়ীর মন পেতে। কিন্তু শাশুড়ী এক চিমটি এগিয়ে আসে না। অথবা শাশুড়ী বৌমার প্রিয় হতে চায়। কিন্তু বৌমা এক চিমটি তার হৃদয়ে শাশুড়ীকে জায়গা দিতে এগিয়ে আসে না। এরপর একপাক্ষিক বারবার এগিয়ে গিয়েও কোন লাভ না হওয়ায় পিছিয়ে যেতে হয়। তখন সম্পর্ক যুদ্ধে বদলে যায়। এসব আমি বুঝি। তাই আমি আমার পক্ষ থেকে এটা বলতে পারি তুমি দুই পা এগিয়ে আসলে আমি এক এগিয়ে আসবো। অবশ্যই আসবো।”

মায়ের কথা মুগ্ধ হয়ে আমি শুনলাম। তার কথা শুনে এবার বুঝলাম শান্ত এত ভালো মুগ্ধ করা কথা কিভাবে বলে? তার বাবা, মায়ের চিন্তা-ধারা এত সুন্দর বলেই তার চিন্তা-ধারা এত সুন্দর। এটা ভেবে আমি খুশি হলাম। তখন মা বলে,“আশা করি আমি তোমার মনের মধ্যে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। তবে আমার কথাগুলো তোমার কাছে কঠিন মনে হতে পারে। যদি এমন মনে হয় তাহলে শান্তকে বলো। আমার ছেলে এসব কঠিন কথা তোমাকে সহজভাবে বুঝিয়ে দিবে। আমার ছেলে এই কাজটা খুব ভালো পারে।”
আমি মায়ের কথায় মাথা নাড়ালাম। সেই সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিলাম তার কথা বুঝেছি। মা তার কথা দিয়ে আমাকে বোঝাতে চেয়েছে, আশেপাশের মানুষ তার কানে যতই বিঁষ ঢালুক। আমি যদি তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এগিয়ে আসি তবে সেও আমার সঙ্গ দিবে। আমি ঠিক থাকলে সেও ঠিক থাকবে। এসব বুঝতে পেরে আমি মাকে জড়িয়ে ধরি। অতঃপর বলি,“মা তুমি খুব ভালো। তোমাকে শাশুড়ী থেকে আমার মা বানাতে আমার বেশি সময় লাগবে না।”
আমার মুখে তুমি শুনে মা কিছুটা হচচকিয়ে গেল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“আপনি থেকে তুমি হয়ে গেলাম?”

”তুমি তো আমার মা।
তুমি তো আমার পর নও৷ তাহলে তোমাকে কেন আপনি করে বলবো? তুমি বললে আপন আপন লাগে। একদম আপন।”
এটা বলে শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমার কান্ড দেখে মুচকি হাসে। অতঃপর বলে,“এমনই থেকো। ভালো বউ হওয়ার অভিনয় করো না। যা করার মন থেকে করো। মন না চাইলে শুধুমাত্র শান্ত খুশি হবে এসব ভেবে যদি আমাদের মন জয় করতে চাও তাহলে পস্তাবে। তাহলে সংসার গড়ার আগেই ভেঙে যাবে।”

”আচ্ছা। তুমি আমার চোখে তাকিয়ে দেখো।
আমার চোখে যদি অভিনয় থাকে, এগুলো মিথ্যে থাকে তাহলে নাহয় আমার সংসার ভেঙে দিও। তুমি পিছিয়ে যেও। তবে সত্যি মনে হলে কিন্তু এগিয়ে আসতে হবে।”
আমি কথাটি বলে মুখে খুব সুন্দর এক হাসি ফোটালাম। এটা দেখে মাও হাসলো। সে বিছানা থেকে উঠে বলে,“এখানে বসে গল্প করলে হবে না। অনেক কাজ আছে। আমি গেলাম। তবে হ্যাঁ যা বললাম মাথায় রেখো। ঔষধ খাওয়া লাগবে না। এখনই বাচ্চার জন্য চেষ্টা করো।”
মায়ের মুখে এই কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাকে এতক্ষণ কী বোঝালাম? মা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে,“চেষ্টা করতে বলেছি। বাচ্চা নাহলে মানবো না সেটা বলিনি। আর না তোমার বাচ্চার শখ পূরণ করতে বাঁধা দিবো সেটা বলেছি।”
মা কথাটি বলে চলে যায়। তার কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠে। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে মা আমার মুখে হাসি দেখে ম্লান হাসে। তার স্মৃতিতে অতীতের কিছু কথা ভেসে উঠে। তার বিয়ের দুই বছর কেটে গেলেও বাচ্চা হচ্ছিলো না। মাত্র দুই বছরেই সবাই অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। বউ চাকরি করে, তাই অভিশাপ লাগছে। সেজন্য বাচ্চা হয় না। নয়তো বয়স পেরিয়ে গেছে। এসব কথা দুই বছরে তাকে কম শুনতে হয়নি। সেই সময়ে শান্তর বাবা তার পাশে না থাকলে হয়তো সে কিছু একটা করে বসতো। তখন শান্তর বাবাই বলতো, কয়েকটা বছর যাক। দুই বছরে কী বোঝা যায়? অতঃপর পরবর্তী বছরেই তাদের মুখে হাসি ফুটে। শান্ত গর্ভে চলে আসে। সন্তান জন্ম দিলেও আশেপাশের মানুষের সেসব কথা এখনো কানে বাজে। সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে শান্তর মা মনেমনে ভাবে,“আমার তো তাও বিয়ের বছর শেষ হলে সবাই এসব বলতে শুরু করতো। তাও তারা সব স্বল্প শিক্ষিত ছিলো। সেখানে দাঁড়িয়ে বিয়ে হতে না হতে পুষ্পকে এসব কথা শুনতে হচ্ছে। আর আমিও শিক্ষিত মানুষ হয়ে ভাবীর কথা শুনে তাকে বাচ্চা নিয়ে এসব বলছি। এসবে তার মনের উপর কেমন প্রভাব পড়ছে এটা ভাবলাম না। এটা ঠিক হলো না। যদিও মেয়েটার মুখে হাসি ফুটেছে কিন্তু পরবর্তীতে এসব কথা যখন মনে পড়বে তখনই তো কষ্ট হবে। ইশ কেন যে এমন করলাম? মেয়েটা ভালো না খারাপ সেটা যাচাই না করেই শুধু মাত্র ছেলের সঙ্গে যায় না তাই অপছন্দ করছি। এটা কী ঠিক? কখনোই ঠিক না। সারাজীবন তো পুষ্পের সঙ্গেই থাকতে হবে৷ ও শান্তর বউ। তাহলে কেন তার ভালো খারাপ না দেখে তাকে অপছন্দ করবো? পছন্দ করার কারণ না থাকলে না অপছন্দ করবো৷ সেটা তো আগে যাচাই করতে হবে। ঠিক হচ্ছে না এসব।”

____

কাজল এবং জয়ের জীবন ভালোই যাচ্ছে। তবে জয়ের মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। তার বাবা, মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে সারাজীবন থাকতে চেয়েছিলো। এসব কাজল বুঝে। কিন্তু তার কিছু করার আছে? সে তো চেষ্টা করেছিলো। কাছে থেকে তাদের মন পায়নি। এখন দূরে আছে একটু মানসিক শান্তি পাচ্ছে। তবে জয়ের মন খারাপ দেখলে কাজলের কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। এসবের মাঝে তার মা ফোন দিয়ে পুষ্পের বদনাম করতে শুরু করে। তার জন্য তাদের স্বামী, স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হয়েছে৷ এসব শুনে কাজল বিরক্ত হয়ে বলে,“কোন মাটি দিয়ে গড়া তোমরা? নূন্যতম লজ্জা নাই? মেয়েটাকে তো জীবনে শান্তি দিলে না। এখন তার ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছে সেটাও সহ্য হচ্ছে না। হিংসায় জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছো। কেন মা? আপার বিয়েতে তো তোমাদের কোন খরচ হয় নাই, তাহলে এত দুঃখ কিসের তোমাদের?”

এসব শুনে মা কিছু বলতে নেয় তবে কাজল সেটা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,“আর কখনো ফোন করবে না। তোমাদের মতো খারাপ বাবা, মায়ের সন্তান হয়ে জন্ম নিয়েছি বলেই আজ আমার স্বামীর মন খারাপ করে থাকতে হয়। আমার কপালে তোমাদের মতোই জঘন্য শ্বশুড়, শাশুড়ী জুটেছে৷ ভাগ্যিস আমার কোন ভাই নাই। থাকলে তোমার মতো বজ্জাত শাশুড়ীর পাল্লায় পড়ে ভাইয়ের বউকে ম রতে হতো।”

“তুই এসব বলতে পারছিস?”
মা অবাক হয়ে কথাটি বলে। কাজল সেটা শুনে বলে,“হ্যাঁ পারছি। আমার তো মনে হয় আমার সঙ্গে যা খারাপ হয়েছে সব তোমাদের কর্মফল। আমি তো জীবনে কোন পাপ করিনি তাও কেন আমার কপালে এমন শ্বশুড়বাড়ি জুটলো। যাদের সঙ্গে আমি একসাথে কাটাতে পারিনি। এটা তোমাদের পাপের ফলেই হয়েছে। তোমরা ভালো হলে আমার কপালেও আপার মতো ভালো শ্বশুড়, শাশুড়ী জুটতো। কত ভালো তারা। দেখলে?
আপার কাছে শুনলাম, তারা এই বিয়ে বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। শুধুমাত্র তাদের সন্তানের জেদের জন্য। অথচ তাদের আচরণে এটা একবারও প্রকাশ পাইনি। কত সুন্দর করে বৌমার সম্মানের কথা বললো। প্রথমদিন দেখেই বুঝেছি এরা খুব ভালো মানুষ। আর আপাও খুব ভালো। তাই এদের ভাব হয়ে যাবে খুব সহজে।”
একটু থেমে কাজল আবার বলে,“তোমরা ভালো হলে এমনটা আমার সঙ্গেও হতো। তাহলে আজ আলাদা থাকায় জয়কে এত মন খারাপ করতে হতো না। তোমরা ভালো নও বলেই বোধহয় এটা হয়েছে।”

“বাজে কথা কেন বলছিস? এমন ভাবে বলছিস জানো ঐ মেয়েটা খুব ভালো আছে আর তুই কষ্টে আছিস? তুই তো জামাইয়ের সঙ্গে ভালোই আছিস। তাহলে এসব আক্ষেপ করছিস কেন?”
মায়ের কথা শুনে কাজল ফোন কেটে দেয়। এই মহিলা বুঝে না কাজলের দুঃখ কোথায়। হ্যাঁ এখন আলাদা হয়ে সে ভালো আছে। কিন্তু সে এমনটা চায়নি। সে চেয়েছিলো একসঙ্গে থাকতে। আলাদা থাকলেও অন্তত তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকবে। এখানে তার শাশুড়ী তো তার নাম অব্দি শুনতে পারে না। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা তো দূর। হ্যাঁ ভালো আছে। শুধু স্বামীর সঙ্গে।


চলবে,