ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-৩৯+৪০

0
21

#ইচ্ছেঘুড়ি (৩৯)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

কয়েকদিন কেটে যায়। আগামীকাল আমরা চলে যাবো। আমার ছুটি শেষ হয়ে যাবে। সেজন্য না চাইতেও যেতে হবে। এই কয়েকদিনে মায়ের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে।ধীরে ধীরে মা আমাকে আপন করে নিচ্ছে। যদিও এজন্য আমাকেও অনেককিছু করতে হয়েছে। এই যেমন সন্ধ্যাবেলা মা না চাইতেও তার ঘরে গিয়ে তার কোলে মাথা রেখে গল্প করা, তার ফ্রী সময়ে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া। তার পছন্দের খাবার তৈরি করে দেওয়া। এসব টুকটাক কাজ করে তার মন জয় করে নিয়েছি। মাও এতদিন পর গল্প করার, মনের কথা বলার মতো একজন মানুষ পেয়ে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন আমাদের শাশুড়ী, বৌমার সম্পর্ক খুবই সুন্দর। তবে আমার একার জন্য কিছু হয়নি। সেদিন মা বললো না, আমি দুই পা এগিয়ে আসলে সে এক পা এগিয়ে আসবে। তেমনটাই হয়েছে৷ আমি নিজ থেকে তার কাছে গিয়েছি, সে আমাকে দূরে না ঠেলে দিয়ে আপন করে নিয়েছে। সে দূরে ঠেলে দিলে হয়তো সুসম্পর্ক গড়ে উঠতো না।

মা যে আমাকে খুব আপন করে নিয়েছে সেটা তার সেদিনের কথায় বুঝতে পারলাম। একদিন যে মা চাচীর কথা শুনে চুপ থাকতো। দ্বিধায় ভুগতো। সেই মানুষটি এখন চাচী ফোন দিয়ে আমার নামে নিন্দা করলে প্রতিবাদ করে। এই তো গতকাল রাতে চাচী ফোন দিয়েছিলো। সে টুকটাক কথা শেষে বলে,“তোমার ছেলের বউ কেমন?”

”ভালো। খুব ভালো।”
মায়ের কথা শুনে চাচী বোধহয় খুশি হননি। সে বলে,“হ্যাঁ এভাবেই বউকে লাই দাও। একদিন তোমার মাথায় উঠে নাচবে। তা…।”
চাচী আরও কিছু বলতে চাইলেও মা বলতে দেয়নি। সে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,“আমার বউ। আমি মাথায় তুলি। তাতে ক্ষতি কিসের? সে তুমি তোমার বৌমাকে নাহয় লাই দিও না। তোমার জীবনে এসব কাজে লাগাও। আমি বরং একটু লাই দেই। আমার একটু লাই দেওয়ায় যদি আমার ছেলে, আমার বৌমা খুশি হয় তাহলে সেটাই হোক না। আমি তো মা। মায়েদের তো বেশি চাওয়া নেই। সন্তানরা ভালো থাকুক এটাই তো আমরা চাই। সেখানে সন্তান যা করলে ভালো থাকবে সেটা না করে, সে মাথায় উঠে পরে নাচতে পারে এই কথা ভেবে এখন তাকে কষ্ট দিলে কী ভালো হবে? তারা খুশিতে থাকতে পারবে? তাই তাদের খুশির জন্য একটু নাহয় লাই দিলাম।”

“হ্যাঁ এখন এটাই বলবা। যেদিন ঐ মেয়ের জন্য তোমার ছেলে তোমাদের দূর ছাই করবে তখন বুঝবে।”

“এটা কখনো হবে না ভাবী। আমার ছেলে আমাদের দূরছাই করলেও বৌমা করবে না। ও খুব ভালো মেয়ে। আমি যতটা চিনেছি ও সবার সঙ্গে খুশি থাকতে চায়। ভালো থাকতে চায়। মিলেমিশে আনন্দে থাকতে চায়। আমার ছেলের পছন্দ কিন্তু খারাপ নয়।”
মায়ের এই কথা শুনে চাচী কিছুটা ব্যঙ্গ করেই বলে,”এই ক’দিনের পরিচয়ে এত প্রশংসা? দু’দিনের পরিচয়ে মানুষ চেনা যায় নাকি?”

“যায়। যাকে চেনা যায় তাকে একদিনেই চেনা যায়। মানুষের মনটা পড়তে বেশি সময় লাগে না।”
মায়ের এসব কথায় বিরক্ত হয়ে চাচী ফোন রেখে দেয়। এদিকে মায়ের কথা শুনে আমি খুব খুশি হই। তার কথায় আমি বুঝতে পারি সে আমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছে।

মা মেনে নিলেও বাবা হয়তো এখনো মানতে পারেনি। তার ভাবভঙ্গি কিছুই বোঝা যায় না। যদিও মা বাবার মন জয় করতে আমাকে দিয়ে ইচ্ছে করে বাবার পছন্দের খাবার রান্না করায়। সন্ধ্যাবেলা বাবা বাসায় ফিরলে আমাকে চা নিয়ে তার কাছে পাঠায়। আমি যখন সন্ধ্যাবেলা বাবার কাছে চা নিয়ে যাই তখন বাবা আমাকে দেখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আমি কথা বলতে চাইলেও সে বলে না। তবুও আমি কথা বলি। বাবা চায়ে চুমুক দিলে আমি শান্ত গলায় বলি,“বাবা চা কেমন?”

বাবা চায়ে চুমুক দেওয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকায়। কোন কথা বলে না। এসব একদিন দেখে শান্ত হাসতে হাসতে বলে,“বাবার বয়স হয়ে গেছে তো, তাই কম কথা বলছে। কম কথা বলা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই না বাবা?”

“বাহ্। আজকাল দেখছি সন্ধ্যাবেলাও তোমায় বাড়ি পাওয়া যায়। আগে তো তোমাকে রাত দুইটার আগে বাড়িতে দেখা যেতো না।”
বাবার এই কথা শান্ত কানে না নিয়ে বলে,“তারমানে তুমি মেনে নিলে তোমার বয়স হয়ে গেছে?”

“ফাও কথা না বলে ঘরে যাও। সঙ্গে তোমার বউকেও নিয়ে যাও। গিয়ে ভালোভাবে বোঝাও এই বয়সে এত চিনি দিয়ে চা খাইয়ে আমাকে মা রতে চায় কি-না।”
বাবার কথা শুনে আমি এবং শান্ত দুজনেই অবাক হলাম। শান্ত আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলে,“কতটা চিনি দিয়েছো?”

আমি জবাব দিতে পারি না। শান্ত তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,“তো সেটা ভালোভাবে বললেই পারতে। সবসময় চুপ থাকো কেন?”

“চুপ থাকি আমার কপালের কথা ভেবে।
রাস্তায় বের হতে পারি না এলাকার মানুষের কথায়। আর ঘরে শান্তি পাই না তোর বউয়ের এই চিনির গোডাউন ভরা চা খেয়ে। কত মানুষকে বোঝাবো যে বউ ভালো আছে। ভালো হয়েছে। ছেলে ভালো আছে। ধুর। জীবনটা শেষ করে দিলি।”
এটা বলে বাবা বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শান্ত বাবার কথা বুঝতে পেরে বলে,“এলাকায় বের হতে না পারলে কানে তুলো গুঁজে বের হবা। তাহলে তো কারো কথা শুনতে হতো না।”

“আমার এত খারাপ দিন আসেনি। তোর থেকে পরামর্শ নিবো। লোকে আমার বাড়ির বউকে বাজে কথা বলবে আর আমি কানে তুলো গুঁজে না শুনে চলে যাবো। কেন রে? আমার বৌমা কি খারাপ যে তার নামে বাজে কথা বললে চুপচাপ শুনতে হবে?”
বাবার কথা শুনে শান্ত নরম গলায় বলে,“ওহ তোমার বৌমা খুব ভালো বুঝি?”

শান্তর কথা শুনে বাবা চুপ হয়ে যায়। কথা না বলে আমার দিকে তাকায়। তারপর মলিন গলায় বলে,“লোকের সামনে ভালো বলা উচিত তাই বলছি। এসব নিয়ে আবার ভেবো না আমি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি। যতই আশেপাশে ঘুরঘুর করো, সেধে গল্প করো আমি তোমাকে আমার ছেলের বউ হিসাবে মানি না।”

এটা বলে বাবা বসার ঘর থেকে তার শোবার ঘরে যায়। শান্তকে কিছু বলার সুযোগ দেয় না। বাবার এমন কথাবার্তায় আমি বুঝতে পারি না, সে আমাকে পছন্দ করে নাকি অপছন্দ। যদিও শান্ত বলে,“বাবা পছন্দ করে তোমায়। কিন্তু মানতে চাচ্ছে না।”
__

এভাবেই এই ক’টা দিন কেটে যায়। আগামীকাল চলে যাবো। এটা ভেবে খারাপ লাগছে। বাবা, মাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে। আমি তাদের এই সময়ের মাঝে খুব আপন করে নিয়েছি। তাদের ছায়ায় আমি সারাজীবন বাবা, মায়ের যে অভাব বোধ করেছি সেটা দূর হয়েছে। তাই চলে যেতে খারাপ লাগবে। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বদলি করে আবার এই শহরে চলে আসবো। সেই সঙ্গে শান্তও তো শোরুম দিবে। সেটা এই শহরেই দিবে। অতঃপর আমরা সবাই একসঙ্গে থাকবো।

কাল চলে যাবো তাই আজ একবার কাজলের বাড়ি যাবো। সেদিনের পর কাজলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। কাজল চায় আমি এবং শান্ত একবার যাতে তার বাড়িতে যাই। সেজন্য আজ যাবো। আমি তৈরি হওয়ার জন্য মায়ের কাছে গেলাম। মা ঘরে কাজ করছিলো। আমি গিয়ে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরি। মা এটা দেখে হেসে বলে,“দেখো মেয়ের কান্ড।”

“মা আমাকে আজ তুমি সাজিয়ে দিবে?
তোমার মনের মতো করে সাজিয়ে দিবে?”
মা আমার কথা শুনে খুশি হয়। সে রাজি হয়। অতঃপর আমি মায়ের কাছে শাড়ীটা দিতে সে আমাকে খুব সুন্দরভাবে শাড়ী পড়িয়ে দেয়। তার মতো করে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলে,“আমার সাজানো তোমার ভালো লাগবে?”

“খুব লাগবে।”
আমার কথা শুনে মা খুব খুশি হয়। পরক্ষণে মনটা খারাপ করে বলে,“কাল তো চলেই যাবে। এখন এত মা মা করে মায়া বাড়াচ্ছো কেন?”

মায়ের মুখে এই কথা শুনে আমি তার হাত ধরে মিষ্টি করে বললাম,“তুমি চিন্তা করো না। খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো।”

“আচ্ছা দেখা যাবে।
আজ তাড়াতাড়ি ফিরো। তোমরা চলে যাবে সেজন্য আমি আজ ছুটি নিলাম। একসঙ্গে থাকবো। কিন্তু তা হলো কই। এখন যাচ্ছো বোন বাড়ি। যাই হোক যাচ্ছো যাও। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। ঠিক আছে?”
আমি মায়ের কথায় সম্মতি জানালাম। মা আমার চুলগুলো সুন্দরভাবে খোঁপা বেধে দিয়ে শাড়ীর আঁচলটা মাথায় তুলে দিলো। অতঃপর বললো,”এবার মুখে যা যা দেওয়ার তুমি দাও।
এসব আমি খুব একটা বুঝি না।”

“আচ্ছা।”
আমি এই কথা বলে চোখে হালকা কাজল দিয়ে নিলাম। আর ঠোঁটে শাড়ীর সঙ্গে মিলিয়ে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক দিলাম। অতঃপর মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,“আমাকে সুন্দর লাগছে তো?”

“হ্যাঁ। খুব সুন্দর লাগছে।”
এটা বলে মা আমার গালে হাত দেয়। এই সময়ে শান্ত এই ঘরে চলে আসে। সে তৈরি হয়ে এসে বলে,“হলো তোমার?”

“হ্যাঁ।”
অতঃপর মাকে বিদায় জানিয়ে আমি এবং শান্ত বের হলাম।
__

গলি দিয়ে দুজন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিলাম। সেই মূহুর্তে একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হয়। সে আমাদের দেখে বলে,“বাহ্। ছোট বরের সঙ্গে তো তোকে ভালোই মানাচ্ছে পুষ্প। এই পাড়ার মেয়ে তুই। তোকে সেই ছোট থেকে দেখছি। কোন ছেলে পছন্দ না বলে শেষে ছোট একটা ছেলের সঙ্গে একই পাড়ায় বিয়ে করে ফেললি।”

সে কথাটি হাসতে হাসতে বললেও আমাকে যে অপমান করার উদ্দেশ্য বলেছে সেটা আমি বুঝতে পারলাম। শান্তও এটা বুঝতে পেরে হাসি মুখে বলে,“কাকি মা আপনার বয়সে বড় বরের সঙ্গে বোধহয় আপনাকে মানাচ্ছে না খুব একটা। তাই এখন ছোট বর খুঁজছেন বুঝি? না মানে কাকি মা আমার সঙ্গে পুষ্পকে মানালেও আপনাকে মানাবে না। তাই প্লীজ অন্তত ছোট বর খুঁজতে গিয়ে আমার মতো বাচ্চাদের দিকে নজর দিয়েন না।”

”তুমি এসব কী বাজে কথা বলছো?
আমি সেটা বলতে চেয়েছি নাকি। আমার বরের সঙ্গে আমাকে ভালোই মানায়।”
সে কিছুটা আমতা আমতা করে কথাটি বলে। এটা শুনে শান্ত হেসে বলে,“হ্যাঁ বেশ মানায়। দেখেছি তো ঐ পাড়ার মোড়ের দোকানে বসে টাক মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সিগারেট টানে। আর আপনার সঙ্গে তাকে কতটা মানায়, আপনি তার মাথার টাকের জন্য দৈনিক কতবেলা মধুচন্দ্রিমা করেন সেসবই বলে।”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে কাকিমা চুপ হয়ে যায়। শান্ত হাসি মুখে কিছুটা কঠিন করে বলে,“লোক সমাজে নিজের স্ত্রীকে অপমান করা বয়সে বড় স্বামীর চেয়ে লোক সমাজে নিজের স্ত্রীকে সম্মান দেওয়া ছোট স্বামীই বেশি উত্তম। এটা পুষ্প বুঝতে পেরেছে। তাই তো তার আমার সঙ্গে দিন কাটাতে কোন দ্বিধা হচ্ছে। যত দ্বিধা সব আপনাদের মাঝে। দ্বিধা নয় হিংসে। নিজেরা জীবনে অসুখী তাই অন্যদের সুখ সহ্য হচ্ছে না।”
এটা বলে শান্ত আমার হাত ধরে পা বাড়ায়। কাকিমা পিছন থেকে বলে,“নতুন নতুন তো তাই মধুচন্দ্রিমা লাগছে। যাক না কয়েক বছর…।”

“হ্যাঁ দেখবেন।
সারাজীবন আপনারা দেখে যাতে লুচির মতো ফুলতে পারেন সেই ব্যবস্থা করবো। আশা করি আপনাদের আমাদের একসঙ্গে দেখে ভালোই লাগবে।”
এটা বলে শান্ত আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বেগে হাঁটতে থাকে। বড় রাস্তায় উঠে শান্ত রিকশা খুঁজছিলাম। সেই সময়ে আমি শান্তর হাত ধরে বললাম,“কথাটা তো ভুল নয়। নতুন নতুন সবই সুন্দর লাগে। পরে না পরিবর্তন হয়। তুমি সবসময় আমাকে এভাবে ভালোবাসবে তো?”

আমার কথা শুনে শান্ত হাসে। আমার ধরে রাখা হাতের দিকে ইশারা করে বলে,“তুমি এভাবে রেখে দিলে সারাজীবন থেকে যাবো। আমার ভালোবাসা এমনই থাকবে যদি তুমি পুষ্প সারাজীবন এমনই থাকো। মানুষের মন হয়তো বদলায়, তবে সেই বদল ঘটার আগে ছোট ছোট কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। সেগুলো দেখে তৎক্ষনাৎ সামলে নিও। তাহলে সারাজীবন আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসবো। এভাবেই ভালোবাসবো।”

এটা বলে শান্ত একটি রিকশা দেখতে পেয়ে ডাক দেয়। আমরা দুজন রিকশায় উঠে পড়লাম। পাশাপাশি দুজন বসে আছি। রিকশা চলছে ধীর গতিতে। সেই মূহুর্তে মনে হলো আমি যদি শান্তর কাধে মাথা রেখে এই সময়টা উপভোগ করতাম। তাহলে বেশ হতো। কিন্তু লোকজন কী বলবে সেটা ভেবে সংকোচ হচ্ছিলো। শান্ত বোধহয় মন পড়তে জানে। তাই সেই সময়ে আস্তে করে বলে,“তোমার মন যা চায় সেটা করতে পারো। আমি পর নই। তোমারই তো স্বামী।”

আমি শান্তর কথা শুনে তার চোখে চোখ রাখি। অতঃপর বলি,“কিছু লজ্জা থাকা ভালো। লোকের কথা কান না দিলেও তাদের কথা মাঝে মাঝে ভাবা উচিত। তুমি আমার স্বামী। আমার ব্যক্তিগত মানুষ। তাই ভালোবাসাটা ব্যক্তিগত থাকুক। জনসম্মুখে নাই বা সেটা প্রকাশ পেলো। তাই কিছু ইচ্ছা অপূর্ণই থাক। সব ইচ্ছে পূরণ হতে নেই। তাহলে জীবনের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যাবে।”
আমার কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে শান্ত মাথা নাড়ায়। অতঃপর বলে,“হাতটা তো ধরে রাখতে পারো। এতটুকু লোকদের দেখালে ক্ষতি নেই তো।”

শান্তর কথা শুনে হেসে আমি তার হাতটি ধরলাম। শান্তও খুশি হলো। আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের সঙ্গে মনে হচ্ছে রাস্তা এগিয়ে আসছে। এসব বাচ্চামোময় কথা ভাবছিলাম। আর শান্ত সে আমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো। তার তাকানো উপলব্ধি করতে পেরে বললাম,“এত মুগ্ধ হও না। পরে একইরকম মুগ্ধতা খুঁজে না পেলে তোমাকে ভালোবেসে রেখে দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে আমার জন্য।”

“তখন নাহয় নতুন করে তোমাতে মুগ্ধ হবো।”
শান্তর এই কথা শুনে আমি তার দিকে তাকালাম। তার চোখে চোখ রাখলাম। তার চোখের গভীরতায় নিজের জন্য ভালোবাসার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। সেই মূহুর্তে তার ফোন বেজে উঠলো। জয় ফোন করেছে। হয়তো আমার বের হয়েছি কি-না জানতে। শান্ত ফোনটা ধরে কথা বললো। আর আমি চোখ ঘুরিয়ে আবার রাস্তার দিকে তাকালাম। সেই সময় অব্দি শান্তর হাতটি ধরেই ছিলাম। আমার বেশ ভালো লাগছিলো। তবে ভালো লাগার সঙ্গে মনের মধ্যে ভয়ও করছিলো। মাঝে মাঝে মনে হয়,“এত সুখ আমার কপালে সইবে তো।”


চলবে,

#ইচ্ছেঘুড়ি (৪০)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বেশ অনেকটা সময় হলো আমরা কাজলের বাড়ি পৌঁছালাম। ভেতরে ঘরে জয় এবং শান্ত গল্প করছে। আর আমি এবং কাজল রান্নাঘরে। আমি কাজলের হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছিলাম। আর দুই বোনে টুকটাক কথা বলছিলাম। কথা বলার ফাঁকে আমি বদলি হয়ে আসবো শুনে কাজল বললো,“আপা এটা না করাই ভালো হবে মনে হয়। তোমার এবং ভাইয়ার আলাদা থাকাই উচিত।”

“কেন? তোর এমন মনে হয় কেন?”
আমি বুঝতে না পেরে এটা জিজ্ঞাস করলাম। কাজল মনমরা হয়ে বলে,দূরে থাকলে সম্পর্ক সুন্দর থাকে। তাছাড়া তোমার শ্বশুড়বাড়ির সবাই ভালো তুমি তো বললে। এরা সারাজীবন ভালো থাকবে যদি তুমি দূরে থাকো। কিন্তু কাছে থাকলে কেন জানি না সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়ে যায়।”
কাজলের কথা বুঝতে পেরে আমি নরম গলায় বললাম,“তোর শ্বশুড়বাড়ি আর আমার শ্বশুড়বাড়ি এক নয় কাজল। আমি জানি, তুই অনেক চেষ্টা করেছিলি তাদের সাথে মিলেমিশে থাকার। কিন্তু পারিসনি। কারণ তারা চায়নি তোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে। তুই যে তাদের সঙ্গে ভালোভাবে থাকতে চাস এটাই তারা বুঝতে চায়নি। বলা যায় তাদের কাছে তুই বোঝা এবং ঘরের কাজ করার মেশিন ছিলি। কিন্তু শান্তর বাবা, মা এমন নয়। তাই তোর ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি তাদের সঙ্গে একসাথে খুব ভালো থাকবো।”

“কিন্তু।”
কাজলের মনের ভয় বুঝতে পেরে আমি হাসি দিলাম। এই মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমি দূরে গিয়ে এর সঙ্গে কোন যোগাযোগ করিনি তাও এই মেয়েটা আমার উপর রাগ ধরে না রেখে বরং আমার ভালো নিয়ে চিন্তা করছে। এসব ভেবে আমি বললাম,“স্যরি কাজল। তোর খারাপ সময়ে আমি তোর পাশে থাকতে পারিনি। আমি বুঝতে পারছি, তুই সংসারে জীবনে খুব খারাপ সময় পার করেছিস। ঐ সময়ে কারো একজনার কাছে মনের কথা বলার মানুষের প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমি সেই সময়ে তোর সঙ্গ দেইনি। স্যরি কাজল।”

”আরে বাদ দাও তো।
এই একই বিষয় নিয়ে কতবার ক্ষমা চাইবে?”
কাজল এটা বলে হাসার চেষ্টা করলো। সে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। আমি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম,“তুই এখন ভালো আছিস তো? জয় তোর খেয়াল রাখে তো?”

“হ্যাঁ। খুব ভালো খেয়াল রেখেছি। ও খুব ভালোবাসে আমায়। ওর পরিবারকেও খুব ভালোবাসে। কিন্তু দুইটা দিক ম্যানেজ করতে পারেনি। তবে এখন চেষ্টা করছে।”
কাজল কথা প্রসঙ্গ তার এবং জয়ের বিষয়ে তাদের ভালোবাসার সম্পর্কে বলতে শুরু করেছে। আমি সেসব মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকি। তবে বিয়ের এতদিন হয়ে যাওয়ার পরও ওরা কোথায় ঘুরতে যায়নি শুনে কিছুটা অবাক হলাম। এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে কাজল বলে,“অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। ছুটির দিনে মন আর সায় দেয় না। তাই দুজনে একসঙ্গে বাড়িতেই গল্প করে কাটাই। এটাও কিন্তু খারাপ নয়।”

“হ্যাঁ। তবে সময় করে অফিস থেকে ক’টা দিন ছুটি নিয়ে ঘুরে আসিস। তাহলে মন ভালো থাকবে। তুই তো বললি জয়েরও পারিবারিক বিষয় নিয়ে মনটা খারাপ। দুজনে মিলে ঘুরে আসিস। তাহলে ফ্রেশ লাগবে।”
আমার কথা শুনে কাজল মাথা নাড়ায়। যার অর্থ সে জয়কে বলবে।

দুপুরের খাবার শেষে চারজনে গল্প করতে বসে পড়লাম। এসবের মাঝে মা ফোন দিলো। আমি ফোনটা ধরতে মা বলে,“আর কত সময় লাগবে? বাসায় ফিরবা কখন?”

“এই তো মা। এখন বের হবো।”
এটা বলে আমি মায়ের সঙ্গে আরও কয়েকটা কথা বলে ফোন রাখলাম। অতঃপর বললাম,“শান্ত আমাদের এবার বের হতে হবে।”

“তোমরা এখনই যাবে আপা? আর কিছুক্ষণ থাকো প্লীজ?”
কাজলের কথা শুনে আমি তৎক্ষনাৎ বললাম,“না রে। মা আমার জন্য আজ ছুটি নিয়েছে। কিন্তু তাও সারাদিন একা থাকতে হলো। এখন বাসায় না ফিরলে সে কষ্ট পাবে। কাল তো চলে যাবে। সেজন্য এমনি তার মন খারাপ। এখন না গেলে নয়।”

“বাহ্। আপনাদের শাশুড়ী বৌমার সম্পর্ক তো খুব সুন্দর।”
জয় কথাটি বলে উঠলো। এটা শুনে কাজলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। জয়ের মায়ের সঙ্গে তো তার সম্পর্ক বেশি ভালো নয়। তাই কাজলের মুখটা মলিন হলো। এটা শান্তর চোখে পড়তে সে হাসতে হাসতে বলে,“হ্যাঁ। তবে এত ভালো কিন্তু আমার মা ওকে বাসতো না। ও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মাকে ভালোবাসা দেখিয়েছে অতঃপর মা ওর ভালোবাসা বুঝে ওর দিকে এগিয়ে আসে। নিজেও ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু যদি পুষ্প একা তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতো আর সে শুধু দূরেই ঠেলে দিতো তাহলে এই সম্পর্ক এত সুন্দর হতো না। উল্টো তখন আমার স্ত্রীর কথা ভেবে আমাকে বাড়িটা ছাড়তে হতো। অথবা বাবা, মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন তর্কে জড়াতে হতো।”
একটু থেমে শান্ত বলে,“আসলে কী বলুন তো জয়। যেকোন সম্পর্ক সুন্দর করতে দুইদিক দিয়েই এগিয়ে আসতে হয়। একদিক দিয়ে কখনো সম্ভব নয়। একজন সারাজীবন গুরুত্ব দিয়েই যাবে দিয়েই যাবে, ভালোবাসা চেয়েই যাবে চেয়েই যাবে। অপরজন তাকে শুধু অবহেলা দিবে, অপমান করবে তাহলে চলে না। তখন যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এত এত ত্যাগ স্বীকার করে তার মনটা বিষিয়ে যায়। তাই একপাক্ষিক কোন সম্পর্ক ঠিক হয় না।
এদিক দিয়ে আমার মা এবং বউ দুজনেই খুব ভালো মানুষ। তাই তাদের সম্পর্ক এত সুন্দর হয়ে উঠেছে।”

শান্তর কথার ভাবার্থ বুঝতে বাকি রইলো না জয়ের। সে কাজলের দিকে তাকায়। কাজলও তার দিকে তাকায়। শান্ত এই সুযোগে বলে,“আমরা তো এখন বের হবো। আপনারা ঘরে বসে থেকে কী করবেন? সন্ধ্যা হতে তো অনেক বাকি। চলুন আপনারাও আমাদের সঙ্গে। আমরা বাড়ি যাই, আপনারা আশেপাশে নাহয় দুজন ঘুরে সময় কাটালেন। এখানে বসে বোরিং হওয়ার থেকে এটা করা ভালো।”

“হ্যাঁ করাই যায়। কিন্তু…।”
কাজল থেমে যায়। সে প্রথমে খুশি হয়েছিলো প্রস্তাব পেয়ে। তবে জয় যেতে আগ্রহী হবে কি-না ভেবে থেমে যায়। কাজলের মনের কথা বুঝতে পেরে জয় রাজি হয়ে যায়। অতঃপর তারা তৈরি হতে চলে যায়। আমরা চলে আসলাম বাড়ি। আর কাজল এবং জয় ঘুরতে বের হলো কাছাকাছি পার্কে।

___

সন্ধ্যা থেকে মায়ের সঙ্গে গল্প করছিলাম। মা প্রায়ই কথায় বলছে,“কাল তোমরা চলে যাবে। ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাবে। একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।”
এসব কথা ভেবে মায়ের মনটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি তার মন ভালো করার চেষ্টা করছি। নানা ধরনের কথা বলে৷ কিন্তু তার মন খারাপ দূর হয় না। এই অবস্থা দেখে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,“আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো মা। তুমি তো আমার মায়ের মতো। তোমার কাছে ফিরবো না তো কার কাছে ফিরবো। তুমি জানো তোমায় পেয়ে আমি মায়ের অভাব ভুলেছি।”

”তাই?
আমিও তো তোমাকে পেয়ে মেয়ের অভাব ভুলেছি। তুমি জানো তোমার বাবারও কিন্তু মেয়ের অনেক শখ ছিলো।”

”আচ্ছা তাই?”

“হ্যাঁ। আচ্ছা শোনো আজ তোমাকে একটা গোপন কথা বলি। এসব আবার বাবার সঙ্গে ভাব হলে তাকে বলো না যেন। সে কিন্তু আমাকে বকবে।”

“আচ্ছা বলবো না বলো।”
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করলাম। মনে হলো যেন ইন্টারেস্টিং গল্প। মা হাসি মুখে বলে,“তোমার বাবা মেয়ে খুব পছন্দ করে। তার ইচ্ছে ছিলো আমাদের একটা মেয়ের। কিন্তু হলো না। শান্ত যখন গর্ভে তখন তোমার বাবা অনেক স্বপ্ন দেখেছিলো মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের সঙ্গে কি কি করবে। মেয়ের বিয়ে দিলে তাকে ছাড়া থাকবে কিভাবে এসব ভেবেও কষ্ট পেতো। তা যদি দেখতে।”

“সত্যি। বাবা এসব করতো?”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। মা মাথা নাড়িয়ে বলে,“হ্যাঁ। কিন্তু তার আশা পূরণ হলো না। তাই বলে এটা নয় যে ছেলে হওয়ায় অখুশি হয়েছে। ছেলে মেয়ে তো আমাদের হাতে নেই। তাই এসব নিয়ে দুঃখ করে লাভ নাই। এটা ভেবে তোমার বাবা মানিয়ে নিলো। তবে তার দুঃখ বেশিদিন ছিলো না। তার ভাইয়ের মেয়ে হলো। সেটাই তার কাছে অনেক আনন্দের খবর ছিলো। ভাইয়ের মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতে। চেয়েছিলো কাছে রাখতে। একসঙ্গে সবাই মিলে থাকতে। কিন্তু ভাবী রাজি হলো না। তার ইচ্ছা তার বাবার বাড়ির ওখানে গিয়ে ব্যবসা করবে তার স্বামী। সেই সময়ে তোমার বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলো। সে মেয়েটার জন্য তার ভাইকে অনুরোধ করেছিলো এখানে থাকতে। এখানে ব্যবসা করতে। যত টাকা লাগে সে দিবে। যেভাবে হোক ম্যানেজ করবে। কিন্তু থাকেনি। মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল। সেদিন সে খুব কষ্ট পেয়েছিলো। এরপর অবশ্য ছুটি পেলেই ভাইয়ের বাসায় যেতো। মেয়েটাকে দেখতে। কিন্তু সেটাও ভাবী ভালো চোখে দেখতো না। এত ঘন ঘন আসা পছন্দ করতো না। সেটা তোমার বাবা বুঝতে পেরে মায়া কাটানোর চেষ্টা করেছে। সে যাওয়া কমিয়ে দিলো। এটা করতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু তাও করলো।”
মায়ের প্রথম দিকের কথা যতটা না খুশি হয়ে শুনছিলাম শেষের দিকের কথা শুনে খুব কষ্ট পেলাম। বাবা এমন কষ্ট পেয়েছে। এটা ভাবতেই আমার কাছে কেমন লাগছে। মা আমার মুখের অবস্থা দেখে হাসি মুখে বলে,“তো এসব কথা তোমায় কেন বললাম?”

“কেন?”
আমি মায়ের কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করি। মা হাসি মুখে বলে,“যাতে তুমি বুঝতে পারো তোমার বাবা তোমার উপর রেগে নেই। সে প্রকাশ না করলেও তোমাকে খুব পছন্দ করছে। তার মেয়ের শখটা তো পূরণ হয়েছে। কিন্তু সে ধরা দিতে চাচ্ছে না। কেন বলো তো?”

“কেন?”

“ধরা দিলে তুমি যদি তার দূর্বলতা বুঝতে পেরে তাকে কষ্ট দাও। তাছাড়া শান্ত ছেলে হলেও তার সঙ্গে একটু অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলে তার। এখন যদি ধরা দেয় তাহলে তো শান্তর পছন্দ ভালো এটা মেনে নিতে হবে। এখানে তো হেরে যাবে শান্তর কাছে৷ তাই ধরা দিচ্ছে না।”
মায়ের এই কথা শুনে আমার মুখটা বিষ্ময়ে হা হয়ে গেল। আনমনে বললাম,“বাবার থেকেই তবে এসব ছেলে মানুষি গুন পেয়েছে শান্ত।”

“হ্যাঁ। তবে যেটা পায়নি সেটা হলো অন্যদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করার গুন। তোমার বাবা এবং আমি এই কাজটা খুব করতাম। আগে করতাম। কলিগদের সন্তানদের সাফল্য, আশেপাশে মানুষের কথা আমাদের খুব প্রভাবিত করতো। যেটা করতে গিয়ে আমরা আমাদের শান্তর ছেলেবেলাটা নষ্ট করেছি। আমরা কখনো বুঝতেও পারিনি আমরা কতবড় ভুল করেছি। কারণ কেউ কখনো ভুলটা ধরিয়ে দেয়নি তো। আমরা ভুল তখন বুঝতে পেরেছি যখন শান্ত বদলে গেল। সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শুরু করলো। নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করলো। তার কথা তার ব্যবহার সবকিছুতে আমরা বুঝেছি আমরা কত ভুল করেছি। নিজের সন্তানকে সেরা দেখতে গিয়ে আমরা অনেক বড় ভুল করেছি।”
মা এই কথাগুলো বলে থামে। আমার বিষ্মিত মুখ দেখে হেসে বলে,“এটা ভাবছো তো শান্ত তো বলছে ওর বাবা ওকে সারাদিন বকে। সে অন্যের কথা শুনে ওকে এখনো বকতে থাকে। তাহলে সে কিভাবে ভুল বুঝলো? আরে বুঝেছে। ঐ যে বললাম তোমার বাবা শান্তর কাছে হারতে চায় না। তাই বুঝতে দেয় না। নিজের ভুল বুঝতে পারলে তো হেরে যাবে। বাবা, ছেলে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে একইরকম।”
মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি দেখলাম শান্ত দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে এতক্ষণ আমাদের কথা শুনেছে। এটা বুঝতে পেরে আমি বললাম,“লুকিয়ে আমাদের কথা শুনছিলে? এটা কিন্তু ভালো স্বভাব নয়।”

“তো? পুরুষ মানুষের একটু আকটু খারাপ স্বভাব থাকা ভালো। নয়তো নারীরা বুঝতে চায় না। তাদের জন্য কত পরিবর্তন হয় পুরুষরা।”
এটা বলে ভাব নিয়ে এসে মায়ের পাশে বসে। অতঃপর বলে,“বাবা এতবার আমার কাছে হেরে গিয়েছে অথচ বুঝতে দেয়নি। এটা ঠিক হলো মা। তুমিও আমার থেকে এসব লোকালে। ঠিক করলে না মা। কোথায় আমি আশা ছিলাম আমার বাবা আমার কাছে ক্ষমা চায়। ভুল বুঝতে পেরে কান্নাকাটি করবে। কিন্তু শালার সে তো খুব বুদ্ধিমান। কি সুন্দর বুদ্ধি নিয়ে চলছে!”

শান্ত মজা করে এসব বলছে বুঝতে পেরে মা তার মাথায় আলতো করে মে রে বলে,“বাবাকে নিয়ে মজা হচ্ছে।”

“আরে মজা কই করছি।
তুমিই ভেবে দেখো, সে কি সুন্দর আমাকে বকাবকি করে যেতো ঘন্টার পর ঘন্টা। আমি বাসায় ঢুকেছি না জানি তার অটো মেশিন চালু হয়ে যেতো। ভুল যে নিজের সেটা বুঝেও এমনটা করতো। কত চালাক রে।”
শান্তর এসব কথা শুনে মা এবং আমি দুজনেই হেসে দেই। মা হাসতে হাসতে বলে,“হ্যাঁ বল। তোর বাবা আসার সময় হয়ে গেছে। এসে শুনলে বুঝবি।”

“কী বুঝবো হ্যাঁ?
আমি কী ভয় পাই নাকি।”
শান্ত ভাব নিয়ে কথাটা বলে। আমি হাসতে হাসতে বললাম,“তুমি পারোও।”

____

বাবা, মাকে বিদায় জানিয়ে বেশ কিছুদিন হলো এই শহরে এসেছি। ছুটি শেষে অফিস জয়েন করেই প্রথমে আমি বদলির এপ্লিকেশন দিলাম। তবে সেটায় বিশেষ কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এজন্য অনেকটা সময় ব্যয় করতে হবে। ধৈর্যের সঙ্গে দৌঁড়ঝাপ করতে হবে। তার মাঝে তো রয়েছে রায়ান। যে আমার ভালো দেখতে পারে না। তাই সে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি এসব বুঝতে পেরে চুপ রইলাম৷ কিছু বললে ঝামেলা বাড়বে। তাই নিজের মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু মনে হয় না কাজ হবে।

এসব ভাবনায় মগ্ন ছিলাম সেই মূহুর্তে শান্ত এসে তার মাথাটা আমার কোলের উপর রাখে। দুই হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,“এত কী ভাবছো?”

“ঐ অফিসের বিষয়।
মনে হয় না বদলি হতে পারবো।”
আমার কথা শুনে শান্ত ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বলে,“তো কী হয়েছে?
আমার আমাদের শহরে গিয়ে ব্যবসা দাঁড় করাতে মেলা সময় লাগবে। তাই এত তাড়া নাই। এসব নিয়ে ভেবো না। ঐ সময়ের মাঝে হয়ে যাবে।”

“যদি না হয়?
যাও হওয়ার চান্স ছিলো কিন্তু রায়ানের জন্য হয়তো হবে না। মানুষটা যে কেন আমার ভালো থাকা দেখতে পারছে না।”
আমি বিরক্তি নিয়ে এই কথা বলতে শান্ত বলে,“শালার বউ মনে হয় শান্তি দেয় না। তাই তোমার সুখ সহ্য হচ্ছে না। আমি তো আর তোমাকে জ্বালাই না।”

“ওহ আচ্ছা। তাহলে এখন কী করছো?”
আমার কথা শুনে শান্ত কোন গুরুত্ব দিলো না৷ সে আগের মতো হাত দিয়ে আমাকে সুরসুরি দিতে থাকে। আমি বিরক্ত হয়ে শান্তর দিকে তাকাতে সে মাথাটা তুলে বোকা বোকা হেসে তাকায়। আমি এটা দেখে না চাইতেও হেসে দিলাম। তারপর বলি,“এভাবে জ্বালাচ্ছো কেন?
আমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবছি দেখছো না?”

“এজন্যই জ্বালাচ্ছি। কারণ কাল কী হবে বা হবে না এটা নিয়ে ভেবে তুমি একটু বেশিই নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো। এটাই আমার পছন্দ হচ্ছে না। আমাদের নতুন বিয়ে হলো। কোথায় আমরা আনন্দ করবো। তা না করে তুমি এসব কী ভাবছো বলো তো?”
এটা বলে শান্ত আবার মাথাটা গুজে নিলো। আমি তার মাথার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,“আচ্ছা ভাবলাম না।
আমি সমাধান বের করে ফেলেছি।”

“তাই? কী সমাধান?”

“বদলি নাহলে চাকরিটা ছেড়ে দিবো।”
আমার এই কথা শুনে শান্ত চমকে উঠে বসে। সে কিছুটা রাগ নিয়েই বলে,“কী বললে?”

“চাকরি ছেড়ে দিবো।
আমার চাকরি করার প্রয়োজন কি। তুমি তো আছোই। তুমি, বাবা, মা তোমরাই আমার কাছে সব। তোমাদের সঙ্গে আমি আনন্দে থাকতে পারবো এটাই তো আমার জন্য অনেককিছু।”

“আচ্ছা।
ধরো তুমি চাকরি ছেড়ে দিলে। এখন আমিও তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি।”
শান্তর কথা শুনে আমি হচচকিয়ে গেলাম। বিষ্ময় নিয়ে বললাম,“মানে?”

“এত ভয় পাচ্ছো কেন?
আমি ভাবতে বলেছি। পুষ্প আমি জানি তুমি আামকে আমার পরিবারকে খুব ভালোবাসো। কিন্তু তারমানে এটা নয় যে আমি বা আমার পরিবার সারাজীবন তোমার ভালোবাসার বিনিময়ে একইরকম ভালোবাসা দিবো। জীবনে খারাপ সময় যেকোন মূহুর্তে আসতে পারে। আমি তোমায় ভালোবাসি। কাল পরিবর্তন হবো কি-না জানি না। হতে তো চাই না। কিন্তু ধরো পরিবর্তন হলাম। তোমায় আর ভালোবাসলাম না। তখন তোমায় ছেড়ে দিলে তুমি কোথায় যাবে? তোমার কাছে তো চাকরি থাকবে না। হাতে টাকা থাকবে না। এমনটা হবে না। কারণ আমি তোমায় ছাড়বো না। এটা তুমিও বিশ্বাস করো। তাই এটা নাহয় বাদ দিলাম। কিন্তু একবার ভাবো। যদি আমার কিছু হয়ে যায়। তখন কিন্তু আমার পরিবার তোমায় চিনবে না। সন্তান যেখানে নেই সেখানে বাবা, মা তার স্মৃতিস্বরূপ তোমায় কেন রেখে দিবে? তারা যতই তোমায় ভালোবাসুক কিন্তু পরের মেয়েকে সারাজীবন কিন্তু বয়ে নিয়ে যাবে না। তখন যদি তোমায় তারা ঘরছাড়া করে দেয় সেই সময়ে তুমি কী করবে? তাই তোমার কাছে যে চাকরিটা আছে সেটা করো। বেতনের টাকাটা নিজের জন্য জমিয়ে রাখো। যাতে ভবিষ্যতে তোমায় কারো কাছে মাথানত করতে না হয়। আর এসব কথা নাহয় বাদ দিলাম।
তুমি এসবের কথা চিন্তা করেই বা কেন চাকরি করবে। হ্যাঁ তাই তো। কিন্তু চাকরিটা করবে। কারণ একজন নারীর আত্মনির্ভরশীল হওয়া জরুরি। এই চাকরিটা তোমাকে এই সমাজে একটা পরিচয় দিচ্ছে, তোমার যোগ্যতা সমাজকে দেখাচ্ছে। এই সমাজ চাইলেই পারবে না এটা বলতে যে তোর কী আছে? স্বামীর পয়সায় ফুটানি মারিস। এসব বলতে পারবে না। কারণ তারা জানে তুমি চাকরিজীবী। এটা তোমার আত্মসম্মানের সঙ্গেও জড়িত।”
একটু থেমে শান্ত আবার বলে,“তারমানে আমি এটা বলছি না যারা গৃহিনী তাদের সম্মান নেই। তারা ভালো নেই। হ্যাঁ আছে। কিন্তু তাই বলে তাদের উদাহরণ টেনে তোমাকেও যে তাদের মতো হতে হবে এমন তো নয়। তাছাড়া এটা সেই যুগ নয় যেখানে নারীরা কাজ করতে পারবে না। বা করলে তারা খারাপ হয়ে যাবে। মানুষ বাকা চোখে দেখবে। বরং এটা ভালো। খুবই ভালো। ভালো খারাপ সব জায়গায় আছে। যেমন চাকরিজীবি খারাপ হতে পারে তেমন গৃহিণী। তাই এটাকে খারাপ চোখে দেখার কিছু নেই। বা ছোট করার কোন বিষয় নয়। বরং আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়া বেশি জরুরি। তুমি আশেপাশে তাকাও তাহলেই বুঝতে পারবে। ঘরে ঘরে কত মেয়েকে শুনতে হয়, কামাই করে খাওয়া। খাও তো আমার ছেলের কামাই। আবার মুখে এত কথা কেন? কত স্বামী তার স্ত্রীকে অবজ্ঞা করে বলছে, সহ্য নাহলে চলে যাও। তাও তো মুরোদ নেই। বাপের বাড়ি তো কিছু নেই৷ অনেক জায়গায় অনেক স্ত্রীর নূন্যতম শখ পূরণ হয় না। সে যদি সামান্য একটি গোলাপ নিজের খুশির জন্য কিনতে চায় তাহলে তাকে শুনতে হয়, টাকা গাছে হয়। এমন ভাবে অপচয় করতে চাও। টাকা তো ইনকাম করো না বুঝবে কি। এই বয়সে এত রঙ কিসের? এই দিনে দাঁড়িয়ে সব মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি। আর সেখানে তুমি স্বাবলম্বী হয়ে সেটা ত্যাগ করতে চাইছো। এটা খুব জঘন্য সিদ্ধান্ত।”


চলবে,