ইচ্ছেঘুড়ি পর্ব-৪৩

0
19

#ইচ্ছেঘুড়ি (৪৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বেশ কিছুদিন কেটে যায়। অতঃপর আমার বদলি কনফার্ম হয়। যদিও এজন্য অনেকটাই কষ্ট করতে হয়েছে। তবে এবার আমি বাবা, মায়ের সঙ্গে থাকতে পারবো এটা ভেবেই খুশি। শান্তও যাবে। সেখানেই সে নতুন শোরুম দিবে। তাই বলে এখানের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে না। এটাও চলবে। পলাশ এবং রবির সঙ্গে আরও চারজন ইতিমধ্যে কাজে নিয়েছে। দোকানের সংখ্যা বেড়েছেও। দুইটা দোকান। এগুলো তারাই দেখবে। পলাশের সঙ্গে শান্তর বন্ধুত্বটা একটু বেশি গাঢ় হয়েছে। তাই তাকে সব দায়িত্ব দিয়েছে শান্ত৷ সে তো মাঝে মাঝে এখানে আসবেই। তবে বাকি সময়টা পলাশকেই সবটা দেখতে হবে।

আমি অবশ্য এই বিষয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিলাম। যতই বন্ধু হোক সে তো বাহিরের। তাকে এত বিশ্বাস করা যায়। এই বিষয়ে শান্তর সঙ্গে কথা হলে সে বলে,“আমি মানুষ চিনি।”

“হ্যাঁ জানি।
তবে আমি চিনি না। আমার এত সহজে কাউকে ভরসাও হয় না।”
আমার কথা শুনে শান্ত হাসি মুখে আমার চোখে চোখ রাখে। অতঃপর বলে,“স্বার্থপর এই দুনিয়ায় মানুষকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা উচিত নয়। তবে আমি করছি। পলাশ খুব ভালো ছেলে। আমার বিশ্বাস সে আমার ব্যবসায় যেটা করলে ভালো হবে সেটাই করবে। তবুও যদি সে আমাকে ঠকায় তাহলে তাতেও ক্ষতি নেই। কেউ আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে এর মানে এটা নয় ওখানে শুধু আমি পরাজিতই হয়েছি। না। বরং ঐ পরাজয়ের মাঝেও জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক বড় শিক্ষা রয়েছে। বুঝলা?”

আমি মাথা নাড়ালাম। শান্তর সব কথাই বুঝি। তবে আমার এবং শান্তর ভাবনা এক নয়। জীবনকে আমরা একভাবে দেখি না। তাই আমার একটু সন্দেহ লাগছে। সত্যি বলতে আমি তো শান্তর মতো সহজ করে জীবনকে দেখি না। এটা বুঝতে পেরে শান্ত আমার মাথার চুলে বেনী করতে করতে বলে,“আমি তো আছি। আমি তোমাকে জীবনটাকে সহজভাবে চিনিয়ে দিবো।”

___

অবশেষে আমরা আমাদের বাড়িতে পা রাখলাম। হ্যাঁ আমাদের বাড়ি। এটা এখন শুধু শান্তর বাড়ি নয়। আমারও বাড়ি। এই বাড়িকে আমার বাড়ি ভাবতে আমাকে সাহায্য করেছে বাবা, মা, শান্ত সবাই। তারা আমাকে আপন করে নিয়েছে বলেই আমি সবটা এত সহজে আপন করতে পেরেছি। নিজের করতে পেরেছি। এখানে আমি অনেক ভাগ্যবতী। একটা সময় নিজেকে সবচেয়ে দূর্ভাগা মনে হতো। আজ নিজেকেই সবচেয়ে ভাগ্যবতী মনে হয়। একটি মেয়ের জীবনে আর কি চায়। মেয়েরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংসারের স্বপ্ন দেখানো হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিটি মেয়েই একটি সুস্থ, সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখে। বিয়ের পর তার একটি ঘর হবে। যেই ঘরটা তার খুব আপন হবে। সেই ঘরের প্রতিটি মানুষ তার হৃদয়ের খুব কাছের হবে। এটাই তো চায় প্রতিটি মেয়ে। কিন্তু সবাই পায় না। এজন্যই তো সবাই বলে সংসার খুব কঠিন জিনিস। এখানে শ্বশুড়, শাশুড়ী বাবা-মা হতে চায় না আবার যারা বাবা, মা হতে চায় তাদের বৌমা তাদের বানাতে চায় না। দুই পক্ষের এই অমিলে সংসারটা হয়ে ওঠে একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। সবার কাছে আতংকের এই সংসার জীবন। সেখানে আমি সত্যি খুব ভাগ্যবতী। নিজের এই সুখকে নিজেরই মাঝে মাঝে হিংসা হয়। মন বলে,“ইশ আমার না নজর লেগে যায়।”
হ্যাঁ নজর লাগার ভয়টাও বেশ আছে। এসব ভয়ের কথা শান্তকে বললে সে আমার ভয় কাটানোর চেষ্টা করে না। উল্টো বলে,“কিছু ভয় থাকুক। একটু ভয় না থাকলে সংসার করে মজা নেই।”

বাড়ি ফিরতে বাবা, মা অস্থির হয়ে যায়। আমাদের পেয়ে তারা খুব খুশি হয়েছে। তাদের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। মা আমাদের পেয়ে খুশি হবে সেটা বুঝতেই পারছিলাম না। তবে বাবার খুশি মুখ দেখে কিছুটা আশ্চর্য হলাম। এই মানুষটি আমাকে আপন করলেও মুখের ভাবভঙ্গি দিয়ে সহজে সেটা বুঝতে দেয় না। তবে এবার তার মুখের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। এটা আমায় অনেকবেশি খুশি করলো। মা বসার ঘরে বসে আমার সঙ্গে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। এটা দেখে বাবা বলে,“মেয়েটা মাত্র আসলো। তাকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও। সেটা না করে এখনই কী সারাজীবনের সব কথা সেড়ে নিবে?”

”ওহ হ্যাঁ। আমিও না।
যাও মা। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
মায়ের কথা শুনে আমি মাথা নাড়ালাম। শান্ত এসব কান্ড দেখে হাসে। সে ঘরে চলে যায়। আমিও তার পিছনে পিছনে যাই। আমরা ঘরে আসতে আসতে শুনলাম মা বলছে,“দেখছো কত ভালো বৌমা পেয়েছো তুমি। যেখানে আজকালকার বউরা স্বামী নিয়ে আলাদা হতে চায় সেখানে সে একসাথে থাকার জন্য বদলি নিয়ে চলে আসলো।”

“হ্যাঁ। কারণ ওর শাশুড়ী যে তুমি।
তুমি ভালো তাই তোমার কপালে ভালো বৌমা জুটেছে। তাছাড়া আমি জানতাম, আমাদের ছেলের বউ খারাপ হলেও তোমার ছোঁয়ায় ভালো হয়ে যেতো। তোমার মতো মানুষের সঙ্গে দূরত্ব রাখাই যায় না।”
বাবার কথা শুনে মা খুশি হয়। তবে সে বলে,“একপাক্ষিক কিছু হয় না গো। যতই নিজের বউয়ের গুনগান গাও। বৌমা ভালো নাহলে এসব সম্ভব ছিলো না।”
বাবা মাথা নাড়ায়। সে মুখে কোন জবাব দেয় না।

___

আমি এসেছি শুনে পাড়ার অনেকে দেখতে এসেছে। তারা মায়ের সঙ্গে গল্প করছিলো আমি সবার জন্য চা বানাতে রান্নাঘরে চলে গেলাম। সেই সময়ে এক কাকীমা বলে,“ভাবী তোমার বউ কী বেড়াতে এলো? নাকি সবসময়ের জন্য থাকবে?”

“একেবারে চলে এসেছে।
এখন থেকে এখানেই থাকবে।”
মা খুব গর্বের সঙ্গে কথাটি বলেন। তার এই গর্বিত মুখের অর্থ, সে খুব ভালো ছেলের বউ পেয়েছে। যেটা তাকে আজ গর্বিত করছে। এটা শুনে এক কাকীমা বলে,“প্রথম প্রথম ওমন সবাই বলে। দেখো কয়দিন থেকে চলে যায় কি-না।”

“না। ও এখানেই থাকবে। সেজন্য তো বহু কষ্ট করে বদলি নিয়েছে। আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য। পুষ্প খুব ভালো মেয়ে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চায়।”
মায়ের এই কথার সঙ্গে অন্য একজন সম্মতি জানায়। সে বলে,“হ্যাঁ। মেয়েটা খুব ভালোই। একই পাড়ায় তো রয়েছি এতকাল। কখনো মেয়েটাকে কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। তার মাঝে কোন খারাপ কিছুই দেখিনি। দেখতে শুনতেও ভালো। হঠাৎ শুনলাম বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তার মা ফেরত পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকেই যত খারাপ কিছু শুনি। মেয়ের সমস্যা আছে, এই সেই। আমার তো মনে হয় ওর মা ইচ্ছা করে এসব ছড়িয়েছে। যতদূর জানি ও তো তাদের আসল মেয়ে। পালিত মেয়ে।”

“হ্যাঁ। হবে হয়তো। নয়তো মেয়েটার মাঝে এত সমস্যা থাকলে সেটা এতকাল ধরা পড়েনি। হুট করে পড়লো। তার মা বলেছে, আর সবাই ছড়িয়েছে। নয়তো মেয়েটাকে দেখে আমারও কখনো মনে হয়নি এরমাঝে কোন সমস্যা আছে।”
অন্য একজন তার কথায় সম্মতি জানায়। এসবের মাঝে আমি চা নিয়ে হাজির হই। তারা আমার হাত দিয়ে হাসিমুখে চা নেয়। মা আমাকে বলে,“পাশে বসো পুষ্প।”

মায়ের কথায় আমি তার পাশে বসলাম। সবাই খুব গল্প করলো। এক পর্যায়ে একজন বলে,“শান্ত স্বামী হিসাবে কেমন? আগে তো দেখতাম খুব আড্ডা দেয়, এখন তো শুনছি রাতে ঘর থেকে বেরই হয় না। তোমার ছোঁয়া পেয়ে অবশেষে ভালো হয়েছে।”

“ও আগে থেকেই ভালো ছিলো। ওর আড্ডা দেওয়ার বয়সে আড্ডা দিয়েছে। এটা কখনোই খারাপ দিক হতে পারে না। তাছাড়া বাকি যে ওকে মারা মারি করতে দেখতেন সেখানেও কিন্তু আপনারা ভুল ধারণা করেছেন। আপনারা শুধু তাকে মা রতে দেখে তার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা পোষণ করে নিয়েছেন। কিন্তু যদি তার সেই মারা মারির কারণটা জানতেন বা সেখানের পুরো ঘটনা শুনতে তাহলে হয়তো এটা হতো না। কিন্তু আপনারা সেটা করেন না। আপনারা মানুষকে উপর থেকে দেখেই সব নিজেদের মতো সাজিয়ে নেন। এখানেই ভুল।”
আমার কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। সবার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরে আমি হেসে আবার বলি,“শান্ত আপাদমস্তক পুরোটাই একজন ভালো মানুষ। আপনারা তার ভেতরে থাকা ভালো মানুষটিকে কখনো দেখতে চাননি তাই দেখেননি। তবে আমি দেখেছি। আমি খুব ভাগ্যবতী যে তাকে জীবনে পেয়েছি। হ্যাঁ তার সঙ্গে আমার বয়সের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এটা নিয়ে আমিও আপনাদের মতো ভাবতাম। কিন্তু সে এত ভালো মানুষ। যে তাকে হারিয়ে আমি আফসোস করতে চাইনি। সেজন্য তার মধ্যে থাকা ভালো মানুষটিকে পাওয়ার জন্য বয়স এবং সমাজ দুটোকেই একটু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি। তাছাড়া আমিই প্রথম নই যার সঙ্গে তার স্বামীর বয়সের পার্থক্য রয়েছে। হ্যাঁ হয়তো আমারটা পুরো এলাকার সবাই জানে তাই এত কথা হয়। তবে আমি প্রথম নই।”

শান্তর সম্পর্কে আমার ধারণা এবং আমার কথা শুনে মা খুব মুগ্ধ হয়। তার মুগ্ধতার দৃষ্টি আমার নজর এড়িয়ে যায় না। প্রতিবেশীরা আর কথা বাড়ায় না। তারা প্রসঙ্গ বদলে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। আমরাও সেটা নিয়ে কথা বলি।

____

জয় বাড়ি ফিরতে কাজল তার সামনে এসে বলে,“সারপ্রাইজ।”
জয় কিছু বুঝতে পারে না। সে ঘরটা ভালোভাবে দেখতে থাকে। কোথাও তো কোন বিশেষ সাজ নেই। জয় কিছু বুঝতে না পেরে কাজলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাজল খুশিমনে জয়কে জড়িয়ে ধরে। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,“সারপ্রাইজ আসছে।”

“কী?”
জয় বোকার মতো আবার প্রশ্ন করে। কাজল খুব মিষ্টি করে বলে,“আমাদের ঘরের নতুন সদস্য। এবং খুবই স্পেশাল সদস্য।”
এটা শুনে জয় বুঝতে পারে। সে খুশি হয়ে যায়। তারা দুজন বাচ্চার জন্য ট্রাই করছিলো বেশ কিছুদিন ধরে। অতঃপর সেই সময়ে এসে গেল। জয় খুশিতে কাজলের কপালে চুমু দেয়। সে আনন্দের সঙ্গে বলে,“সত্যি?”

কাজল মাথা নাড়ায়। যার অর্থ হ্যাঁ। জয় খুশিতে কাজলকে বলে,“তাহলে আজ বাহির থেকে খাবার অর্ডার করি? অবশ্যই তোমার পছন্দের।”
কাজল মাথা নাড়ায়। যদিও কিছুদিন যাবত খাবার খেতে পারছে না। তবুও সে রাজি হয়। যেহেতু জয় শখ করেছে এটা। এটাই তো সংসার। এখানে স্ত্রী স্বামীর শখের কথা ভাববে, স্বামী স্ত্রীর। তাহলে না সংসার পরিপূর্ণ হবে। হোক না একটা দিন কিছু টাকা অপচয়। এত হিসাবি হলে জীবন চলে না। এখানে জয় এতটাই খুশি হয় যে সে নিজের খুশি তার প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। অর্থাৎ তার বাবা, মাকে ফোন দিয়ে বলে। সে ভেবেছিলো তারাও খুব খুশি হবে। জয় তার মাকে খুব আশা নিয়ে বলছিলো,“মা তুমি দাদী হতে যাচ্ছো।”

তবে তার মা খুশি হলো না। তার কথা শুনে জয় পুরো হকচকিয়ে যায়। সে একদম প্রস্তুত ছিলো না এসব শোনার জন্য। জয়ের মা বলে,“ও পোয়াতি তোর বউ। আমিও দোয়া করি একটা ছেলে হোক সেও তোদের লাথি মেরে বউ নিয়ে চলে যাক। তাহলে না তোর বউ আমার জ্বালা বুঝবে। আমার ছেলে কেড়ে নিয়েছে, ওর ছেলেও অন্যকেউ কেড়ে নিবে।”

“মা।”
জয় কিছুটা চিৎকার করে কথাটি বলে। সে মাত্র তার সন্তানের আগমনের কথা শুনেছে। সেখানে এই কথা শুনেই তার মায়ের এমন কথা বলাটা সে মেনে নিতে পারছে না। জয় কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,“মা এমন কিছু বলো না যাতে আমি তোমাকে মা হিসাবে নূন্যতম সম্মান করতে ভুলে যাই। আর হ্যাঁ তুমি যার সম্পর্কে কথা বলছো সে আমার সন্তান। আমার অস্তিত্ব। তার জন্মের আগেই অভিশাপ দিয়ে দিচ্ছো। ছিহ মা। আমি এমনটা আশা করিনি। আমি তোমাদের সময় দেই না, ভালোবাসি না তা তো নয়। তাও কাজলের উপর রাগ পুষে রেগেছো। এতটাই রাগ যে আমার বাচ্চার আসার কথা শুনে তুমি বিন্দুমাত্র খুশি হতে পারলে না।”
এটা বলে জয় তার মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেয়৷ কাজল এতক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবই শুনেছে। সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসে জয়ের পাশে বসে। জয়কে সান্ত্বনা দিতে তাকে জড়িয়ে ধরে। জয় বিষয়টা বুঝতে পারে। তবে সে খুব ঠান্ডা গলায় বলে,“তোমার এই জার্নিতে আমি ছাড়া কেউ তোমার পাশে থাকবে না। সেটা তো তুমি বুঝতেই পারছো। তাই একটু সাবধানে থাকবে। আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো তোমাদের যত্ন নেওয়ার।”

“এই সময়টায় তুমি আমাদের পাশে থাকলেই হবে। আমাদের আর কিছু চাই না।”
এটা বলে কাজল জয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। জয়ও তাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়। সে খুব খুশি৷ তার এই খুশিটা সে কারো জন্য দুঃখে বদলে দিবে না। তবুও মনের কোথাও কষ্টটা রয়ে গেছে। তার মা খুশি হলো না।

____

শান্ত আর আমার ঝগড়া হলো। খুব সামান্য বিষয় নিয়ে আমাদের এই ঝগড়া। এখন শান্ত আমার সঙ্গে কথা বলছে না। সে আমার উপর অভিমান করে রয়েছে। আমাদের বিয়ের পর এমন টুকটাক ঝগড়া বেশ ক’বার হয়েছে। তবে প্রতিবার আমিই অভিমান করে থাকতাম। শান্ত খুব সুন্দরভাবে আমার মান ভাঙাতো। আমি সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। কিন্তু এবার সে আমার রাগকে পাত্তা না দিয়ে উল্টো নিজে রাগ করে বসে আছে। শান্ত এত সামান্য বিষয়ে রাগ করেছে, আমার সঙ্গে কথা বলছে না। এটা আমি মানতে পারছি না। তাই মনমরা হয়ে বসে ছিলাম। বাবা আমার মন খারাপটা লক্ষ্য করেছে। তাই তো মাকে বললো,“শান্ত আর ওর মধ্যে মনে হয় ঝামেলা হয়েছে। গিয়ে শোনো কী হয়েছে?”

“এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে আমার হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। স্বামী, স্ত্রীর মাঝে যতই হোক আমরা তৃতীয়পক্ষ।”
মায়ের কথা শুনে বাবা হাসে। অতঃপর বলে,“হ্যাঁ তোমার কথা ঠিক। স্বামী, স্ত্রীর মাঝে প্রবেশ করা উচিত নয়। কিন্তু তোমার বৌমা যে বোকা। আমার তো মনে হয় শান্তর বিষয়টা না বুঝেই মন খারাপ করে আছে। শান্ত কী চায় সেটা হয়তো বুঝতে পারছে না। তুমি গিয়ে কথা বলে দেখো। তোমাকে ওদের মাঝে প্রবেশ করতে হবে না। তুমি শুধু ওদের সমস্যাটা বুঝে, ওদের কার কী চাওয়া বা কী করা উচিত সেটা বলে দিবে। বাকিটা ওরা করে নিবে। সবসময় যে আমরা ওদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে থাকবো এমনটা তো নয়। মাঝে মাঝে কিছু সমস্যা আমাদের তো প্রয়োজন ওদের। তাই না?”
বাবার কথায় মা মাথা নাড়ায়। সত্যি তাই। অতঃপর সে আমার কাছে আসে। আমার পাশে বসে শান্ত গলায় বলে,“মন খারাপ?”

আমি জবাব না দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি। না চাইতেও মাকে জড়িয়ে কান্না করে দেই। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”কী হয়েছে? আমার বলো। তবে যদি আমাকে জানানোর মতো না হয় তবে বলো না। কিন্তু হ্যাঁ যদি জানানোর মতো হয় তাহলে অবশ্যই বলো।”

আমার মনে হলো কাউকে বললে মনটা হালকা হবে। তাই মাকে পুরো বিষয়টা বললাম। আমি কান্নারত অবস্থায় বললাম,“শান্ত আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছে। আমি বুঝতে পারছি না আমি কী করবো?”

“শান্ত রেগে নেই।”
মায়ের কথা শুনে আমি বোকা হয়ে গেলাম। কিছু বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকাতে মা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,“এই সামান্য বিষয়ে রাগ করার মতো ছেলে শান্ত নয়।”

“কিন্তু…।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে মা বলে,“আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”
মায়ের কথায় বুঝলাম আমাকে চুপ থাকতে হবে। আমি তাই থাকলাম। মা বলতে শুরু করলো,“শান্ত রেগে নেই। তবে ও তোমাকে রেগে আছি এমনটা বোঝাচ্ছে। কারণ ও চায় তুমি ওর রাগ ভাঙাও। এটাই সম্পর্ক। শান্ত সবসময় তোমার মান ভাঙালে তুমি তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।তারপর তুমি এমন একটা ধারণা মাথায় পুষে রাখবে যে একমাত্র তোমারই রাগ করার অধিকার আছে। আর শান্তর শুধুমাত্র তোমার রাগ ভাঙানো কাজ। এতে করে একটা সময় পর শান্ত হাঁপিয়ে যাবে। সে তোমার মান ভাঙাতে গিয়ে বিরক্ত হবে। তখন আর মান ভাঙাবে না। তখন তুমিও বিরক্ত হবে শান্ত বদলে গেছে বলে। আস্তে আস্তে সম্পর্ক খারাপ হবে। তাই শান্ত তোমাকে বোঝাচ্ছে ওরও রাগ হতে পারে। স্ত্রী হিসাবে তোমারও দায়িত্ব ওর রাগ ভাঙানো। তোমার কাজে শান্ত এবং শান্তর কাজে তুমি রাগ করতেই পারো। দুজনারই উচিত নিজেদের ভুল বুঝে নিজেদের শুধরে নেওয়া। সেই সঙ্গে রাগ করলে রাগ ভাঙানো। শান্ত তোমাকে এটাই বোঝাতে চাইছে। কিন্তু তুমি বুঝতে না পেরে কান্না করছো। হয়তো মন খারাপ করেই বসে থাকতে। যদি তুমি এমনটা করো তাহলে শান্ত এবার সত্যি রেগে যাবে। এবার ওর রাগ করাটা কিন্তু ঠিক। তুমি ওকে বুঝতে পারছো না। এমনটা তো ও চায় না। তাই আশা করি এবার তোমার কী করতে হবে সেটা তুমি বুঝেছো।”
মায়ের কথা শুনে আমি তার দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। মা একটু থেমে আবার বলে,“আবার এটা বলো না, শান্ত তো রেগে নেই। তাহলে আমি এবার খুশি থাকি। এমনটা একদম নয়। আমি যে তোমায় কিছু বলেছি তুমি এটা মাথায় রাখবে না। বরং তোমায় মাথায় এটা রাখবে শান্ত রেগে আছে। তোমাকে তার রাগ ভাঙাতে হবে। এজন্য চার দেওয়ালের মাঝে বসে তুমি কী করবে সেটা তোমার কাজ। আমার নয়। আর হ্যাঁ আমি যে তোমায় এসব বলেছি বা তুমি আমার সঙ্গে এসব শেয়ার করেছো এটা শান্তকে বলো না। পরবর্তীতে আমার সঙ্গে কিছু শেয়ারও করবে না। এটায় কোন স্বামীরই পছন্দ হবে না। তুমি এভাবে নয় বরং এভাবে ভাবো শান্ত যদি তোমার কোন কাজে কষ্ট পায় এবং সে তোমার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার বিষয়টা অন্য কাউকে বলে তাহলে এটা তোমার জন্য কতটা সম্মানের? হোক না সেটা ওর বাবা, বা মা। তোমার আপনজন। তাও কিন্তু এটা অসম্মানের। কোন স্ত্রী বা স্বামীই চায় না তাদের মাঝের কথাগুলো অন্যরা জানুক। তাই আশা করবো পরবর্তীতে তোমাকে এই ধরনের সমস্যায় কাউকে বলতে হবে না। তুমি নিজ থেকেই সমাধান খুঁজে পাবে। তবে হ্যাঁ যদি সমাধান খুঁজে না পাও তবে চুপিচুপি আমাকে বলো। আমি এটা চুপিচুপি রাখবো।”
মায়ের শেষ কথা শুনে আমি হেসে দিলাম। আমি তাকে খুশিমনে জড়িয়ে ধরে বললাম,“ধন্যবাদ মা। তুমি আমায় খুব সহজ করে বোঝালে। আমি আসলেই বোকা। অন্যরা হয়তো ভাববে আমি ন্যাকামি করছি। কিন্তু সত্যি বলতে আমি সত্যি এসব বুঝতে পারিনি। এত মাথামোটা আমি।”

“তুমি মাথামোটা নও পুষ্প।
তুমি ছোট থেকে যেভাবে বড় হয়েছো সেখানে দাঁড়িয়ে তোমার বয়স হলেও এতটা বুঝদার হওনি। তোমাকে হতে দেওয়া হয়নি। তাই তুমি সবটা এত সহজে বুঝতে পারছো না। এটা হয়। প্রত্যেক মানুষের চিন্তা-ধারা আলাদা। ব্যক্তি হিসাবে একেক জনের একেক রকম বড় হওয়া। এখানে দোষের নেই।”
মায়ের কথা শুনে আমার এত ভালো লাগলো যে বলার মতো নয়। এমন শাশুড়ী ক’জন বা পায়। এজন্যই সবাই বলে রূপবতীর থেকে ভাগ্যবতী হওয়া জরুরি। আমি সেটা হয়েছি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,“এবার মন খারাপ দূর করে ভাবো কিভাবে আমার ছেলের রাগ ভাঙাবে। তবে হ্যাঁ তোমাদের মাঝে বড় কোন ধরনের সমস্যা হলে অবশ্যই আমাদের জানাবে। আর সেই সঙ্গে শান্ত যদি কখনো ভুল করেও তোমার গায়ে হাত তোলার মতো গুরুতর অপরাধ করে সেটাও জানাবে। আমি জানি এটা শান্ত করবে না। তবুও করে থাকলে অবশ্যই জানাবে। এই ভুলের কিন্তু ক্ষমা হয় না। মজা বা রাগ যেভাবেই হোক না কেন এটা করা যাবে না। আশা করি এমন বোকা তুমি নও যে ভালোবাসো বলে এই অন্যায় মেনে নিবে। যদিও এটা হওয়ার চান্স নেই। তবুও বলা যায় না।”
এটা শুনে আমি মাকে সেদিনের কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম। শান্ত আমাকে বোঝানোর জন্য সেদিন গায়ে হাত তুলেছিলো। তবে মায়ের পরবর্তী কথা শুনে মনে হলো এটা জানলেও বাবা খুব তুলকালাম করবেন। বাবা এই বিষয়টা কখনো মেনে নিবেন না। তিনি এটা একদমই পছন্দ করেন না। সে যেমনই হোক, এই কাজটা তার চরম অপছন্দের। এটা যারা করে তাদের তিনি সহ্য করতে পারেন না। এই একটা কারণে সে তার বাবাকে কখনো ভালোবাসেনি। কারণ তার বাবা মজার ছলে হোক কিংবা রাগের মাথায় সবসময় তার মায়ের গায়ে হাত তুলতো। এতে তার মায়ের কেমন লাগছে সেটা দেখতে চাইতো না। যার জন্য এটা তার খুব অপছন্দ। আমি বুঝতে পারলাম ঐ বিষয়টা শান্ত যে কারণেই করুক বাবা খুব কষ্ট পাবে। তার শিক্ষার অপমান হিসাবে দেখবেন। তাই আমি থেমে গেলাম। থাক কিছু কথা না বলাই থাকুক।


চলবে,