#ইচ্ছেঘুড়ি
#অন্তিম পর্ব (প্রথম অংশ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
জয়ের বাবা, মা কাজলের সঙ্গে খুবই ভালো আচরণ করছিলো। তাদের আচরণে কাজল কিছুটা হতবাক হয়। সে তাদের ক্ষমা করছি বললেও মন থেকে ক্ষমা করেনি। শুধুমাত্র জয়ের খুশির জন্য তাদের কান্না দেখে এমনটা করেছে৷ এই মানুষগুলো তার সঙ্গে যে আচরণ করেছে তাতে কোনভাবে তাদের ক্ষমা করা যায়। চাইলেও পারবে না কাজল। কিন্তু তাদের ভালো আচরণে কাজল ভাবনায় পড়ে যায়। এরা হঠাৎ এত ভালো আচরণ কেন করছে? কাজল বুঝে উঠতে পারছে না। অতঃপর যখন তারা মিলেমিশে থাকার কথা বললো। এই সময়ে কাজলের যত্ন নিতে হবে, তাই একই বাড়িতে যাওয়া উচিত। এসব কথা শুনে কাজল বুঝলো তারা ছেলের চোখে ভালো হতে নাটক করছে৷ জয় তাদের আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছে। তাই জয়ের খুশির জন্য সব অভিনয় করছে। কাজল এসব দেখে ভয় পেয়ে যায়। জয় আবার একসঙ্গে থাকতে রাজি হয়ে গেলে তার হয়তো আর ভালো থাকা হবে না। এরা যতই ভালো ব্যবহার করুক। এরা যে ভবিষ্যতে এই বাচ্চা হারানো নিয়েও তাকেই কথা শোনাবে সেটা সে বুঝতে পেরেছে। তাকে সবার কাছে ছোট করবে। এসব ভেবে কাজল কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে জয় তার বাবা, মাকে বলে,“তোমরা আমার বাবা, মা। তোমরা আমার ভালো চাও। এই পৃথিবীতে প্রত্যেক সন্তানের কাছেই তার বাবা, মা সেরা। তোমরাও আমার কাছে সেরা। সেই সঙ্গে তোমরা এখন ভুল বুঝতে পেরেছো এটা শুনে আমি খুব খুশি হলাম। সত্যি বলতে আমার ভালো লাগছে। আমার বাবা, মা এতদিন পর হলেও বুঝেছে।কিন্তু। স্যরি মা। আমার আর তোমাদের সঙ্গে একসাথে থাকা হবে না। কেননা আমার মনে হয় আমরা এখন দূরে আছি বলেই তোমরা তোমাদের ভুল বুঝতে পেরেছো। কাছে গেলে হয়তো আবার সেই একই ভুল করবে। তাছাড়া আমার কষ্ট দেখে হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য তোমাদের উপলব্ধি হয়েছে তোমরা ভুল করেছো। এই উপলব্ধি একসঙ্গে থাকলে কেটে যাবে। আমি চাই না এমন হোক। কাজলের সঙ্গে তোমাদের আবার মন মালিন্য হোক। তাই আলাদা থাকাই ভালো।”
জয়ের কথায় তার বাবা, মা খুব কষ্ট পায়। তারা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,“আমরা কথা দিচ্ছি আমরা আর বৌমাকে জ্বালাবো না। কোন কথা শোনাবো না। প্লীজ বাবা, চল না এক হয়ে যাই।”
“স্যরি। এটা আর সম্ভব নয়।”
এটা বলে জয় ঘরে চলে যায়। মা কিছুটা রাগ নিয়ে কাজলের দিকে তাকায়। কিছু বলতে নিয়ে থেমে যায়। কারণ বাবা তার হাত ধরে ফেলেছে। এখন রাগ প্রকাশ করলে জয়ের চোখে আবার খারাপ হয়ে যাবে। তাই রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে নিলো তারা। কাজল তাদের ভাবভঙ্গিতে যা বোঝার বুঝে যায়। আসলে বাস্তবতা এমনই। এই ধরনের মানুষ কখনো শুধরায় না।
★
জয়ের বাবা, মা বাড়ি চলে যায়। জয় এবং কাজল এখন পুরো বাড়িতে একা। কাজল খুব মন খারাপ করে ছিলো। এটা দেখে জয় বলে,“আমরা একটা ভালো ডাক্তার দেখাবো। তার পরামর্শ নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আবার বাচ্চার জন্য ট্রাই করবো। প্লীজ আর মন খারাপ করে থেকো না।”
“জয় আমার প্রচুর ভয় হচ্ছে।
আমি আদৌ সন্তান জন্ম দিতে পারবো তো?”
কাজলের এই কথায় জয় ম্লান হেসে বলে,“সন্তান দেওয়ার মালিক যিনি তিনি যদি না দেন তাহলে কিছু করার আছে? তার পরিকল্পনা বোঝা দ্বায়। সন্তান না হওয়ার মাঝেও হয়তো আমাদের ভালো লুকিয়ে আছে। আর সন্তান নাহলে না হবে। সন্তান না হলে বুঝি বাবা, মা হওয়া যায় না। আমরা সন্তান দত্তক নিবো।”
“না।”
কাজল চিৎকার করে উঠে। এটা শুনে জয় কিছুটা হকচকিয়ে যায়। কাজল জয়ের হাত জড়িয়ে বলে,“না। আমি কিছুতেই সন্তান দত্তক নিবো না। আমি একটা সন্তানের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে পারবো না। আমি জানি সন্তান দত্তক নিলে আমি তাকে কিছুতেই ভালোভাবে মানুষ করতে পারবো না। কিছুতেই পারবো না। কারণ আমি এমন বাবা, মায়ের সন্তান যে তাদের রক্ত শরীরে নিয়ে আমি এমন ভালো কাজ কিছুতেই করতে পারবো না।”
জয় কাজলের বিষয়টা বুঝতে পারে। সে কাজলকে যথেষ্ট সান্ত্বনা দেয়। কাজল তার বাবা, মায়ের মতো নয়। একদমই নয়। তাই তার থেকে এমন কিছু হবে না। তবে জয় ভয় পাচ্ছে নিজেকে নিয়ে। তার একটা সন্তানের খুব শখ। এই সন্তান না পাওয়ার আক্ষেপে সে না বদলে যায়। তার ভালোবাসার কাজল না তার অপ্রিয় হয়ে উঠে। এই ভয়টা সে পাচ্ছে। এই মূহুর্তে এই ভয়টা দূর করতে হলে তাদের একান্তে ভালো সময় কাটানো জরুরি। এসব ভেবে জয় অফিস থেকে দু’দিনের ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাচ্চার পুরো বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তারা ঘুরে বেড়াবে। তাহলে হয়তো দুজনের জন্যই সবকিছু সহজ হবে। সুন্দর হবে। এসব ভেবে জয় কাজলকে বুকে জড়িয়ে নেয়। শক্ত করে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয়।
___
ধীরে ধীরে সময় কেটে যায়। কাজলের সঙ্গে আমার কথা হয়। সে এখন বেশ ভালো আছে। জয় তার খুব খেয়াল রেখেছে। সেজন্য খুব দ্রুত সবটা সামলে উঠতে পেরেছে। আমিও বেশ আছি। শান্ত আমার জীবনে আসার পর থেকে আমি আর খারাপ নেই। একদম নেই। এখন কাজল সুখে আছে জেনে আরও খুশি আছি। কাজল এমন একজন মানুষ যে আমাকে ঐ নরকের মাঝে থেকেও হিংসা না করে ভালোবেসে গেছে। বাবা, মায়ের ঘৃণায় বড় হওয়ায় আমিকে কখনো পর করে দেখেনি কাজল। তার ভালো থাকাটা আমার জন্য জরুরি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই মেয়েটার সঙ্গে আমি ইচ্ছাকৃত সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম তাও মেয়েটা সবসময় আমার ভালো চেয়েছে। কখনো রাগ করে খারাপ কিছু বলেনি। এমন একজনের ভালো না থাকাটা আমার জন্য কষ্টের। বসে বসে এসব ভাবছিলাম সেই মূহুর্তে শান্ত এসে পাশে বসে। আমি শান্তকে দেখে কিছুটা অভিমান করে মুখ ঘুরিয়ে নেই। আমি অভিমান করে আছি দেখে শান্ত হতবাক হয়ে বলে,“তুমি রেগে আছো?”
“না। আমি বেশ আছি। রাগবো কেন?”
আমি এই কথা বলে অভিমানী মুখ নিয়ে তার দিকে তাকাই। আসলে আজ আমার জন্মদিন। আমি আশা করেছিলাম শান্ত আমাকে উইশ করবে। কিন্তু করেনি। এসব দিন নিয়ে যদিও কোনকালে মাথাব্যথা ছিলো না আবার। তবে কথায় বলে না অতি আহ্লাদে আহ্লাদী। আমার অবস্থা হয়েছে তেমন। এদের থেকে এত ভালোবাসা পেয়েছি যে এখন এসব বিষয়েও অনেক আশা করে বসে থাকি। এসবে কোন ভুল নেই বলে আমি মনে করি। প্রিয় মানুষের কাছে এমন কিছু চাওয়া সবারই তো থাকে। এটা যদি হয় আবেগ তো আবেগ। আবেগের তো কোন বয়স নেই। একটু আবেগি হলাম নাহয়। এসব ভাবায় মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমার মন বিষন্ন দেখে শান্ত আমাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। নরম গলায় বলে,“আমি কিছু ভুল করেছি। তুমি আমার কাজে কষ্ট পেয়েছো?”
“আজকের দিনে আমি তোমার কাছে ছোট এক আশা করতে পারি না?”
আমার এই কথা শুনে শান্ত কিছুটা ভাবনায় পড়ে যায়। শান্ত আমার বলা ‘আজকের দিন’ কথাটি মাথায় নিয়ে নেয়। অতঃপর আজকের তারিখ মনে করে ভাবে আজ বিশেষ কী দিন? শান্তর এসব ভাবনার মাঝে আমি বলি,“তুমি আজকের দিনটা ভুলে গেলে?”
“না তো।”
এটা বলে শান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,“শুভ জন্মদিন।”
আমি বিষ্ময় নিয়ে শান্তর দিকে তাকাই। শান্ত হাসি মুখেই বলে,“আমি ভাবছিলাম রেস্টুরেন্টে গিয়ে তোমায় উইশ করবো। তাই করছিলাম না। তবে এখন যখন দেখলাম তোমার মন খারাপ তখন ভাবলাম এখনই করে ফেলি।”
“তারমানে তোমার মনে ছিলো?”
আমি খুশি হয়ে যাই। শান্ত আমার জন্য সারপ্রাইজ প্লান ভেবে রেখেছে। সে রেস্টুরেন্টে বুকিং দিয়ে রেখেছে। এটাই মনে হলো তার কথায়। তাই খুশি হয়ে যাই। শান্ত আমাকে ছেড়ে বলে,“হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
আমরা এখন বের হবো। আমি এটা বলতেই তোমার কাছে আসছিলাম।”
“সত্যি?”
আমি খুশি হয়ে শান্তকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরি। উৎফুল্ল গলায় বলি,“আমি জানতাম তুমি আমার সব বিশেষ দিনগুলো মনে রাখবে। আমার জন্য বিশেষ কিছু ভাববে।”
“তুমি খুশি হয়েছো?”
শান্ত প্রশ্নটি করতে আমি অনেক খুশি মনে হ্যাঁ বলি। আমার মুখে খুশি ফুটে ওঠা দেখে শান্তও খুশি হয়। অতঃপর দুজন তৈরি হয়ে চলে আসি রেস্টুরেন্টে। শান্তর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে শান্ত আমাকে একটু দাঁড় করিয়ে রেস্টুরেন্টের কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলতে গেল। তারপর আমার কাছে এসে আমাকে নিয়ে একটি টেবিলে বসলো। আমাকে বসিয়ে রেখে আবার তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেল। কিছু একটা বলে আবার আমার কাছে আসলো। শান্ত হাসি মুখে বলে,“ওদের আমি বলেছিলাম আমরা সন্ধ্যার মাঝে আসবো। কিন্তু ওরা ভাবছে আমরা রাতে আসবো। তাই কেকটা এখনো রেডি করেনি। একটু অপেক্ষা করতে হবে। যদিও আমার রাগ হয়েছিলো তবে ওরা অনেক ক্ষমা চাইলো তাই আমি নরম হয়ে গেলাম।”
“আচ্ছা।”
এটা বলে আমি ম্লান হাসলাম। শান্ত আমার দিকে গভীর নজরে তাকিয়ে রইলো। আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম,“তুমি আমার জন্মদিন ভুলে গিয়েছিলে তাই না? আমাকে খুশি করতে তখন বললে রেস্টুরেন্ট বুকিং করেছো, এখানে বসে আমরা গল্প করবো। কেক কাটবো এটা ভেবে রেখেছো। তাই না?”
আমার মুখে এই কথাটি শুনে শান্তর মুখটা মলিন হয়ে গেল। সে আমার ডান হাতটি ধরে বলে,“থাক না কিছু মিথ্যে সত্যি হয়ে। তুমি আমার আদুরে বউ তো। এত বুঝদার নাই বা হলে।”
শান্তর কথা শুনে আমি তার চোখে চোখ রাখলাম। শান্তর এতক্ষণের কান্ড দেখে আমি বুঝে গিয়েছিলাম সে আসলে মাত্র এখানে এসে সব ঠিক করলো। কেকের অর্ডারও মাত্রই দিয়েছে। তবে সেই সময়ে আজকের দিন কথাটি শুনেই শান্ত খুব সহজে সবটা বুঝে গিয়েছিলো। তাই তৎক্ষনাৎ উইশ করলো। আমি এসব বুঝে প্রশ্ন করতে শান্তর জবাব আমাকে চুপ করিয়ে দিলো। শান্ত মুখের মলিনতা দূর করে হাসি ফুটিয়ে বলে,“কিছু মিথ্যে সত্যি হয়ে থাকলে যদি প্রিয় মানুষের খুশি দেখা যায় তবে কিছু মিথ্যে সত্যি হয়ে থাকুক না পুষ্প। সবকিছু বুঝতে নেই। আমার সঙ্গে এখানে এসে তুমি খুশি হয়েছো তো?”
শান্তর প্রশ্নে আমি মাথা নাড়ালাম। অবশ্যই খুশি হয়েছি। শান্ত এটা শুনে বলে,“তাহলে খুশিটুকুই থাক। যেসব ভাবলে খুশিটা নষ্ট হবে সেসব না ভাবি। কিছু ভুল মিথ্যের চাদরে পড়ুক না ঢাকা। সংসারে এমন মিথ্যের চাদর না থাকলে খুশি থাকা যায় না।”
শান্তর কথার ভাবার্থ বুঝে আমি সত্যি খুশি হলাম। এই মানুষটা খুবই চমৎকার। এর কথা শুনে আপনি খুশি হতে বাধ্য। তবে শান্তর কথা শোনার পর আমার কিছুটা আফসোসই হচ্ছে। এত সহজে শান্তর মিথ্যেটা আমার ধরা উচিত হয়নি। একদমই উচিত হয়নি। তবে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে শান্ত আমাকে ভুলিয়ে দিলো, আমি তার মিথ্যে যে ধরেছিলাম। তার চমৎকার ব্যবহার, ছোট ছোট যত্ন সবকিছু মিলিয়ে সেদিন আমি অনেক সুন্দর সন্ধ্যা কাটালাম। শান্তর সঙ্গে সময় কাটালে আমার দিনটা এমনই যায়।
★
পরবর্তী দিন সকালে ঘুম ভাঙতে আমি আমার পায়ে নুপুর দেখতে পেলাম। নুপুর দেখে অবাক হয়ে গেলাম। শান্তকে ঘুম থেকে তুলে বললাম,“এটা কী?”
“আয় হায় এটা কী হলো? আমার বউ অন্ধ হয়ে গেল? এখন এই অন্ধ বউকে নিয়ে আমি কী করবো? আমি কিভাবে সংসার করবো? আমার তো সব শেষ।”
শান্তর মজা শুনে আমি বিরক্ত হলাম। বিরক্তি নিয়ে বললাম,“মজা করো না।”
“আমার এত সুন্দর ঘুম নষ্ট করে বলছো মজা করো না। এটা কেমন কথা?
দেখতেই তো পাচ্ছো ওটা কি। আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। এটা নুপুর। আমার প্রশ্ন হলো এই নুপুর কোথা থেকে এলো এবং কখন আমার পায়ে ঢুকলো।”
“নুপুর যেখান থেকে আসার সেখান থেকে এলো। যেভাবে পায়ে ঢোকার সেভাবে ঢুকলো।”
শান্তর এমন হেয়ালিপনায় আমি বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এটা দেখে শান্ত হেসে বলে,“তোমার জন্মদিনের উপহার এটা।”
এটা বলে শান্ত মিষ্টি এক হাসি দিয়ে বিছানা থেকে উঠে যায়। আমি পায়ে থাকা নুপুর জোড়া দেখতে থাকি। আবেগের বয়সে সিনেমা দেখে মাঝে মাঝে কল্পনা করতাম, আমার বিয়ে হবে। সংসার হবে। সেই সংসারে আমার স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসবে। আর একদিন আমি উপর হয়ে শুয়ে থাকবো। পা দুটো খাটের বাহিরে থাকবে। সেই সময়ে আমার স্বামী এসে আমার পায়ে নুপুর পড়িয়ে দিবে। আমি বিছানা থেকে উঠে পায়ে নুপুর দেখে অবাক হবো। সেই সঙ্গে হৃদয়ে থাকবে অন্যরকম অনুভূতি। আমার সেই পাগলামিময় স্বপ্নের কথা শান্তকে কখনো বলেছি কি-না মনে পড়ছে না। তবে এটা সত্যি হওয়ায় আমার মনটা খুশি হলো। হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতির জন্ম হলো। সব কেমন স্বপ্নের মতো।
আমি বিছানা থেকে মেঝেতে নেমে দাঁড়ায়। দুই পা বাড়িয়ে দেই পায়ের নুপুরের ঝনঝন শব্দ শুনি। আবার থেমে যাই। একদম ছোট বাচ্চাদের মতো কান্ড করে বসলাম। ছোটরা যেমন তার চাওয়া জিনিসটা পেয়ে যায় তখন যেমন খুশি হয় আমি তেমনই খুশি হলাম। তারা যেভাবে বারবার সেই জিনিসটা দেখে সেভাবেই দেখছি। আমি এসব করছিলাম সেই সময়ে শান্ত এসে আমার গালে চুমু দিয়ে বসে। আমি চোখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাতে সে তার বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলে,“পছন্দ হয়েছে?”
“খুব।”
আমার মুখে এই কথা শুনে শান্ত মজা করে বলে,“শুধু খুব। খুব বেশি নয়?”
“না।”
এটা বলে আমি শান্তর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,“খুব বেশি পছন্দ তো এটা। এটা ছাড়া কেউ খুব বেশি পছন্দ হবে না।”
শান্ত আমার কথা বুঝতে পেরে খুশি হয়ে আমার নাকের সাথে নাক ঘষে বলে,“এত পছন্দ আমায়?”
“হ্যাঁ।
তোমার চেয়েও বেশি তোমায় পছন্দ করি। তুমি আমাকে যতটা না পছন্দ করো তারচেয়ে বেশি।”
“হ্যাঁ।
তাই তো বাবা, মায়ের কথা শুনে মনের কথা গোপন করছিলা। আমার চেয়ে বেশি পছন্দ করো তাই।”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে আমার মুখটা মলিন হয়ে গেল। সত্যি সেদিন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শান্ত আমার মুখের মলিনতা দেখে বলে,“পুষ্প তোমার আমাকে আমার চেয়ে বেশি পছন্দ করতে হবে না। আমার মতো পছন্দ করো। যতটা করলে তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো স্বপ্নেও ভাববে না। মনের অজান্তেও এই কথাটি মাথায় আনবে না। শুধু ততটা ভালোবাসা আমায় দাও। আমি শান্ত সারাজীবন তোমারই থাকবো।”
শান্ত এই কথা শুনে আমি খুশি হই। আমার মুখের মলিনতা দূর হয়। আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি,“আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না শান্ত। তোমাকে ছাড়া আমি যে বাঁচতে পারবো না। শেষ হয়ে যাবো।”
“এতও অন্যের উপর নির্ভর করা উচিত নয়…।”
শান্তর কথা শুনে আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। তারপর বললাম,“তোমার যৌক্তিক ব্যখা শুনতে চাই না। তুমি শুনে রাখো শান্ত, তোমার মতো কেউ একজন জীবনে থাকলে সারাজীবন নির্ভরশীল হয়ে থাকা যায়।এই নির্ভরতায় পথ হারাবার ভয় নাই। একদমই নেই।”
এটা শুনে শান্ত জবাব দেয় না। সে শুধু হাসে। আমি তার হাসির মধ্য দিয়ে তার জবাব খুঁজে নেই। অবশ্যই সেটা ভালোবাসার জবাব।
____
ধীরে ধীরে সময় কেটে যায়। দিন কেটে সপ্তাহ নয়, সপ্তাহ শেষে মাস। মাস শেষে প্রায় বছর ঘনিয়ে আসছে। বিবাহিত জীবনের এই এক বছরে আমি আমাকে নতুনভাবে চিনেছি। সংসার যে শুধু দুঃখের হয় না তার বাস্তব উদাহরণ আমি। অবশ্য শান্তর পরিবারের মতো চমৎকার এক পরিবার পেয়েছি বলেই সুখের হয়েছে। তবে এরমানে এটা নয় যে ঝামেলা হয়নি। হ্যাঁ কিছু সমস্যা তো হয়েছেই। বাবা, মা খুব ভালো। তবে মাঝে মাঝে আমার কিছু কাজ মাকে কষ্ট দিয়েছে। মায়ের কিছু কাজ আমাকে কষ্ট দিয়েছে। দিনশেষে আমরা নিজেদের ভুল বুঝে সেই ভুল শুধরে নিয়েছি বলেই আমাদের মাঝে এত ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। শান্তর সঙ্গেও প্রায় সময় মান অভিমান হয়েছে। সেটা দূরও হয়ে গিয়েছে। একবার অবশ্যই খুব বেশি ঝগড়া হয়েছিলো আমাদের। সেবার আমাদের ঝামেলা মেটাতে বাবা, মায়ের প্রয়োজন পড়েছিলো। বাবা শান্তকে নিয়ে সেদিন পুরো রাত আলাদা সময় কাটিয়েছে। সেই সময়ে সে শান্তকে কী বলেছে জানি না, পরবর্তী দিন শান্ত আবার আমার সঙ্গে সব মিটিয়ে নিয়েছে। আমিও তাতে সাড়া দিয়েছে। কারণ শুধু শান্তকে নয়, মাও সেদিন সারারাত আমাকে বুঝিয়েছে। এভাবেই শান্তর সঙ্গে আমার ঝামেলা হলে বাবা, মা আমাদের বুঝিয়েছে। বাবা সঙ্গে শান্তর বা মায়ের সঙ্গে আমার সমস্যা হলে শান্ত সব মিটমাট করেছে। পুরো সংসার জুড়ে এক তর্কে সবাই মুখ ফুলিয়ে কখনো থাকিনি বলেই সংসারটা সুখের হয়েছে। এজন্য অবশ্যই সবাইকে সম্পর্ককে গুরুত্ব সহকারে নিতে হয়েছে। এভাবেই দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর হতে চললো। সামনে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। এটা নিয়ে অবশ্য শান্ত খুব আগ্রহী। যদিও সে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছে তবে আমি সেটা আগেই বুঝে গিয়েছি। কিন্তু এর মাঝেই ঘটে গেল চমৎকার এক কান্ড। শান্তর আগে তাকেই আমি সারপ্রাইজ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। বাবা, মা সেদিন ভাগ্যক্রমে মামাদের বাড়ি গিয়েছিলো। আমি সাথে যাইনি। তাই বাবা অবশ্য শান্তকে ফোন করে বিকালেই ডেকে নিতে বলেছিলো। তবে আমি নেইনি। খবরটি যখন আমি জানতে পেরেছি তখন মনে হলো এটার জন্য হলেও শান্তকে ডাকার প্রয়োজন নেই। সে তার সময়েই বাড়ি ফিরুক।
★
শান্ত ঘরে ঢুকতেই চোখ থমকে দাঁড়াল। দেয়ালের কোণে কোণে শাড়ী ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যেন রঙিন পর্দা; কারও রেশমি আঁচল জানালায় টাঙানো, হাওয়ায় দুলছে মৃদু পর্দার মতো। মেঝেতে বিছানো পুরোনো সুতির শাড়ী, যেন রঙিন গালিচা। টেবিলের উপর কাঁচের জারে ভরে রাখা কিছু শুকনো ফুল, পাশে একটা কাঁসার বাটি যাতে রাখা আছে প্রদীপ, চারপাশে সেই আলো মৃদু ঝিলিক দিচ্ছে।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পা। তার গায়ে নীল রঙের একটি স্নিগ্ধ জামদানি শাড়ী, আঁচল হালকা মেঝেতে ছুঁই ছুঁই করছে। খোলা চুল এলোমেলোভাবে কাঁধ ছুঁয়ে আছে, হাতে রূপালী চুড়ি হালকা শব্দ তুলছে।
শান্ত ঢোকার শব্দে সে ধীরে ধীরে মুখ ঘুরায়। চুলের ফাঁক দিয়ে চোখ উঁকি দেয়, ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। শান্ত তাকিয়ে থাকে অবাক দৃষ্টিতে, ঘর যেন মুহূর্তেই এক যাদুকরি আবেশে ভরে যায়। সাজানো ঘর, মৃদু আলো আর নীল জামদানিতে মোড়া পুষ্প। সব মিলিয়ে দৃশ্যটা তাকে একেবারে মুগ্ধ করে ফেলে। শান্ত ধীরে ধীরে পুষ্পের দিকে এগিয়ে আসে। অবাক গলায় বলে,“আমাদের বিবাহ বার্ষিকী তো এখনো এক মাস পর। তাহলে এসব আয়োজন কেন? আজ তো আমার জন্মদিনও নয়।”
এটা শুনে পুষ্প মুচকি হাসে। সে শান্তর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দেয়। শান্ত কিছুটা হকচকিয়ে যায়। পুষ্প ধীরে ধীরে তার কাছে আসে। আর বলতে থাকে,“এই অবস্থায় বাহিরে গেলে তুমি খুশি হতে না। তাই ঘরের সব জিনিসপত্র দিয়েই ঘরটা সাজিয়ে নিলাম। সুন্দর না?”
“হ্যাঁ সুন্দর।
কিন্তু আজ বিশেষ কি? আমার তো তেমন কিছু মনে পড়ছে না। আমি কিছু ভুল করলাম পুষ্প?”
“না তো।
তুমি তো জানোই না। তাহলে ভুল কিভাবে করলে?”
পুষ্পর কথা বুঝতে না পেরে শান্ত তার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে। পুষ্প এসে তার গলায় দু’হাত রেখে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,“তুমি খুশি? বাবা, মা বাসায় নেই। তাই ভাবলাম এই বিশেষ দিন কিছুটা বিশেষ করি।”
“বুঝিয়ে বলবে প্লীজ?”
শান্ত এখনো বুঝতে না পেরে অনুরোধ করে। পুষ্প লাজুক হাসি দিয়ে টেবিলের দিকে ইশারা করে। শান্ত সেদিকে তাকিয়ে প্রেগ্ন্যাসি কীট দেখে অবাক হয়। সে তৎক্ষনাৎ পুষ্পের চোখে চোখ রাখে। পুষ্প সম্মতি দিতে শান্তর মুখটা হা হয়ে যায়। কয়েক মূহুর্তের মাঝে নিজেকে সামলে শান্ত খুশিতে পুষ্পকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে,“সত্যি?”
’
’
চলবে,
#ইচ্ছেঘুড়ি
#অন্তিম পর্ব (শেষাংশ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
“সত্যি?”
শান্তর কথায় আমি আবার সম্মতি জানালাম। শান্ত খুশিতে আমাকে কোলে তুলে নিলো। খুশিমনে বলে,“ইশ এতবড় কান্ড আমি ঘটালাম।”
এমন সময় এমন কথা শান্তর দ্বারাই সম্ভব। আমি তার কথা শুনে শব্দ করে হেসে দিলাম। অতঃপর বললাম,“না। আকাশ থেকে টুপ করে পড়লো।”
আমার কথা শুনে শান্তও হাসলো। সে আমাকে বিছানায় বসিয়ে আমার পাশে বসে। আমার হাত জড়িয়ে রেখে বলে,“আজ আমি খুব খুশি। খুব খুব খুশি।”
“কিছু খুশি রেখে দাও।
সব এখন শেষ করলে হবে। বাচ্চাটাকে আসতে দাও। তারপর খুশি হও। ধীরে ধীরে বাবা হয়ে ওঠো।”
আমার কথা শুনে শান্ত মুচকি হেসে বলে,“ধীরে ধীরে বাবা হবো কি? আমি তো বাবা হয়ে গেছি। হ্যাঁ আমি এখন আমার সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছি না। তবে ঠিক পারবো। আমি তোমায় এবং আমার বাচ্চার এত যত্ন নিবো যে সে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই আমি তাকে অনুভব করতে পারবো। সেও আমাকে অনুভব করতে পারবো।”
আমি শান্তর চোখের দিকে তাকালাম৷ শান্ত হাসতে হাসতে বলে,“সবাই তো বাবু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বাচ্চার দায়িত্ব নিতে নিতে বাবা হয়ে ওঠে। আমি নাহয় এখন থেকেই হলাম। কারণ আমি ব্যতিক্রম পথে হাঁটতে পছন্দ করি।”
আমি শান্তর কথার কোন জবাব না দিয়ে তার কাঁধে মাথা রাখি। আস্তে করি,“আমি চাই আমাদের একটা মেয়ে বাবু হোক। তাহলে বাবা, মা খুব খুশি হবে।”
“সুস্থ সবল সন্তান হোক এই দোয়া করো।
কারো খুশির জন্য নির্দিষ্ট কাউকে চাওয়া ঠিক নয় পুষ্প। আমাদের বাচ্চা হবে এটাই বড় কথা। সেই বাচ্চাটা সুস্থ সবল হোক এটাই আমাদের চাওয়া হওয়া উচিত।”
শান্তর কথায় আমি সম্মতি জানালাম। অতঃপর দুজনে আমাদের প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে আজ অব্দি যা ঘটলো তার স্মৃতিচারণ করলাম। গল্প করলাম। ঘরের দেওয়ালের সঙ্গে সাজিয়ে রাখা আমাদের প্রথম দেখার সেই জলরঙে আঁকা ছবি, ইচ্ছেঘুড়ি আর কিছু ছবি। সবগুলো আলতো হাতে স্পর্শ করে শান্তকে বললাম,“আমাদের বাচ্চাকে একদিন এসব দেখিয়ে আমাদের সুন্দর মূহুর্তগুলোর স্মৃতিচারণ করবো। বেশ হবে, তাই না?”
শান্ত এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,“না বেশ হবে না।
শুধু বাচ্চাদের গল্প বললে হবে না। নাতি, নাতনিদেরও তো বলতে হবে। তখন বেশ হবে।”
এটা শুনে আমি মুচকি হাসলাম। জবাব দিলাম না। শান্ত আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,“শত বছর তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই পুষ্প। বার্ধক্য আমাকে কাবু করতে পারবে না যদি তুমি সঙ্গে থাকো।”
“আমাকেও কাবু করতে পারবে না।
পথ চলতে কোন লাঠির প্রয়োজন হবে না যদি তুমি সঙ্গে থাকো শান্ত। তোমার সঙ্গ পেলে পথ হারাবার ভয় আমার বার্ধক্য এসে হানা দিতে পারবে না। কিছুতেই না।”
এটা বলে আমি শান্তর হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। আমার মনে হলো সময়টা থমকে গেছে। এটা এমন এক বিশেষ সময় যেই সময়টা আমি বারবার যাতে জীবনে ফিরে আসে সেটাই চাই। বারংবার আমি আমার জীবনে এমন সুখের সময় চাই। শান্ত পাশে থাকলে হয়তো সুখের এই মূহুর্তগুলো বারবার ফিরে আসবে।
___
কাজল এবং জয় এখন একজন ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছে। ডাক্তারের মতে, এবার তারা বাচ্চার জন্য আমার ট্রাই করতে পারে। আশা করা যায় কোন সমস্যা হবে না। সেই সঙ্গে খুব শীঘ্রই কাজল আবার বাচ্চা গর্ভে ধারণ করতে পারবে। কাজল এবং জয়ের কোন সমস্যা নেই। তারা বাবা, মা হতে পারবে এটা শুনে দুজনেই খুব খুশি হয়। কাজলের আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। সে জয়ের হাত ধরে খুব আবেগ নিয়ে বলে,“জয় প্লীজ আমরা আজ থেকেই সব শুরু করি। আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণ করতে এবার একজনের প্রয়োজন। খুব প্রয়োজন।”
“আমিও তো চাই কাজল।
বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ যখন চাইবে তখন ঠিকই হবে।”
জয়ের কথা শুনে কাজল খুশি হয়। সে জয়কে জড়িয়ে ধরে। এই মানুষটির জন্যই কাজল এখনো ঠিক আছে। প্রথম বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর অনেকের অনেক কথা শুনেছে। তবে সেসব গায়ে মাখেনি। কারণ তার পাশে তার স্বামী ছিলো। একজন মেয়ের জন্য এটাই তো বড় পাওয়া। তার স্বামী যদি তার পাশে থাকে তাহলে সে যেকোন কিছুর মোকাবিলা করতে পারে। তাছাড়া স্বামীর সঙ্গ লোকের কটু কথা বন্ধ করতেও সাহায্য করে। এই দিক দিয়ে কাজলও বেশ ভাগ্যবতী। সংসার জীবনের প্রথমে হয়তো জয়ের ব্যবহারে সে কষ্ট পেতো। তবে আজ আর সেই কষ্ট নেই। তারা দুজন এসব ভাবছিলো সেই মূহুর্তে তার মা ফোন দেয়। কাজল ফোন ধরতে মা বলে,“শুনলাম তোর তো বাচ্চা হতে কোন সমস্যা নেই। এবার নিয়ে নে। শুনছিস তো পুষ্প মা হচ্ছে। এটা শুনে এলাকার লোকজন আমাকে কটু কথা বলছে। তুই সুখবরটা দে। তারপর আমিও তাদের মুখে ঝামা ঘষে দেই।”
মায়ের মুখে এই কথা শুনে কাজল ফোন কেটে দেয়। এরা শুধরানোর নয়। কাজলের বাবা, মা এবং জয়ের বাবা, মায়েরা যুগ যুগ ধরে একইরকম থাকে। হ্যাঁ তবে মাঝে হয়তো একটু গিরগিটির মতো রঙ বদলায়। ভালো মানুষ হওয়ার নাটক করে। কিন্তু এরা কখনোই তাদের ভুল বুঝতে পারে না। এরা ভুলগুলো সেই সময়ে উপলব্ধি করে যখন জীবনের অন্তিম মূহুর্তে তারা বিছানায় পড়ে গিয়ে তারা যাদের সবচেয়ে বেশি অবহেলা করেছে তাদের সঙ্গ পায়। তাদের সেবা পায়। সেই সময়ে তাদের সব ভুলের জন্য আফসোস হয়। কিন্তু বাস্তবে দাঁড়িয়ে সেই সময়ে আফসোস করে আদৌ কিছু করা সম্ভব। সম্ভব নয়। সারাজীবনের দুঃখ তার সেই সময়ে চাওয়া ক্ষমায় কখনো ঘুচে যায় না। কখনো নয়।
___
ধীরে ধীরে সময় কেটে যায়। আমার পেট উঁচু হতে শুরু করে। গর্ভাবস্থায় পুরো সময়টা জুড়ে শান্ত এবং বাবা, মা আমার বেশ যত্ন করেছে। শান্ত সেই সকালে আমাকে অফিসে দিয়ে আসতো, আবার অফিস শেষ হওয়ার আগেই আমার অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। যাতে আমি বের হয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে না পড়ি। এই সময়ে চিন্তা করা ভালো নয়। এসব করে শান্তর নিজের ব্যবসার কাজে মনোযোগ দেওয়া হয় না। এখানে শোরুমে যাও যেতো পলাশদের ওখানে এই ক’মাসে একবারও যায়নি। শান্তর এই যত্নগুলো আমার বেশ লাগে। যদিও এই সময়ে সব স্বামী এভাবে পাশে থাকতে পারে না। আসলে সবাই তো শান্তর মতো ব্যবসায়ী নয়। নিজের অধিনে কাজ করে না। যে যখন খুশি তখন সব ছেড়ে বাসায় পড়ে থাকতে পারে। অন্যের অধিনে চাকরি করলে শান্ত এত সময় আমাকে কখনো দিতে পারবো না।
গর্ভাবস্থার সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত হলো আমার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার পরও শান্ত বা বাবা, মা কেউ আমাকে তেমন কিছু শোনায়নি। তারা বুঝতে পেরেছিলো, বাচ্চা হওয়ার সময়ে যেসব পরিবর্তন হয় তারই ফল এটা। তবে একদিন অকারণে একটু বেশি রেগে গিয়েছিলাম। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে গেলে মা হাসিমুখে বলে,“তুমি চিন্তা করো না। তোমার এসব কর্মকান্ডের শাস্তি আমি পরে তোমায় দিবো।”
“পরে কেন?
এখনই দেন? এখনই আমাকে বকা শুনিয়ে দিন?”
আমি মাকে খুব কষ্ট দিয়ে কথা বলায় নিজ থেকেই শাস্তি পেতে চাচ্ছিলাম। মা আমার কথা শুনে আমার গালে হাত দিয়ে বলে,“এখন নয়। তাছাড়া তুমি তো আর ইচ্ছে করে ভুল করছো না। এমন পরিবর্তন সবার হয়। আর যদি এসব ধরে রেখে আমি তোমাকে কষ্ট দেই তাহলে তুমি সেসব কখনো ভুলতে পারবে না।”
একটু থেমে মা বলে,“মেয়েরা যখন গর্ভবতী হয় তখন যদি তাদের কেউ সামান্য পরিমান কষ্ট দেয় তাহলে এই কষ্টটা তার অন্তরে সারাজীবন থেকে যায়। আমি বুঝি এই যন্ত্রণা। গিয়ে দেখো কত মেয়ে মা হচ্ছে, কিছু খেতে পারে না। তাও শাশুড়ীরা বলে বেড়ায় এত এত খায়। কোনকিছু খাওয়ার শখ হলে বলে, আমরা মা হইনি। এত রঙ করতে হয়নি। এসব কথা বলে তারা হয়তো বুঝতেও পারে না যে তারা তাকে কত কষ্ট দিচ্ছে। দুনিয়ার সব কষ্ট একদিকে আর মা হওয়ার সময়ে পাওয়া এই কষ্টগুলো অন্যদিকে।”
এটা বলে মা ভাবনায় পড়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম মা হয়তো শান্তর জন্মের সময় এমন কিছু কষ্ট পেয়েছে। মা হয়তো এখন সেসব ভাবছে। আমি মায়ের কাছে সেই বিষয়ে প্রশ্ন করলাম না। থাক না কিছু কষ্ট নিজের হয়ে। এজন্য মাকে আমার খুব ভালো লাগে। যেখানে প্রায় মানুষ তাদের অতীতে পাওয়া কষ্টগুলো নিজেদের বৌমার উপর দিয়ে শোধ নিতে চায় সেখানে মা সেই কষ্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে বৌমাকে সেসব সুখ দিচ্ছেন যেসব দিলে সে ভালো থাকবে। প্রত্যেক মেয়েই বিয়ের পর এমন একজন মা চায়। আমি এটা ভেবে মাকে জড়িয়ে ধরি।
★
বাচ্চা প্রসবের দিন চলে আসে। আমরা ডাক্তারের দেওয়া তারিখের দুইদিন আগেই হাসপাতালে ভর্তি হই। এটা অবশ্য শান্ত করেছে। যখন থেকে শুনেছে আমাদের জমজ বাচ্চা হবে তখন থেকে সে আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। এতটাই চিন্তিত যে সব ছেড়ে আমার সঙ্গে বাড়ি বসে থাকতে শুরু করে। সারাদিন আমার মনটা আনন্দে থাকবে কিভাবে সেটা দেখছে? যত্নের পরিমান দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব দেখে অবশ্য বাবা বলছিলো,“হ্যাঁ কাজবাজ সব ছেড়ে দিয়ে বাসায় পড়ে থাকো। তোমার বাচ্চারা এসে না খেতে পেয়ে পথে নামুক।”
এসব শুনে শান্ত অবশ্য গুরুত্ব না দিয়ে মজা করে বলতো,“তুমি না বড়াই করতে তোমার যা আছে তা দিয়ে আমার তিন পুরুষ খেতে পারবে। তাহলে আবার আমার বাচ্চাদের পথে নামতে হবে কেন?”
শান্তর কথা শুনে বাবা নিজের কথায় নিজে ফেঁসে যায়। জবাব খুঁজে পায় না।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম। ওদের গর্ভে থাকা অবস্থায় বাড়িতে ঘটা মজার ঘটনা গুলো মনে করে নিজেকে খুশি রাখছিলাম। শান্ত অবশ্য আমার হাত ধরে সেখানেই বসে ছিলো। বাবা এজন্য এখানে লজ্জায় আসেনি। মা এসব বললে শান্ত কিছুটা ভাব নিয়ে বলে,“এখানে লজ্জার কী আছে? মনে হয় আমি পরের বউয়ের হাত ধরে আছি।”
শান্তর এসব ছেলে মানুষি দেখে আমি মনেমনে হাসি। আমারও যে তার কান্ডে লজ্জা লাগছে সেটা বললে শান্ত বলে,“লাগুক। একটা কথা বুকে হাত দিয়ে বলো তো, তুমি খুশি হচ্ছো না?”
আমি জবাব দেই না। এটা অবশ্য ঠিক। মনেমনে বেশ খুশিও হচ্ছি। দু’দিনে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানানো হলো, আমাদের সিজার করতে হবে। জমজ বাচ্চা নরমাল ডেলভারি হওয়ার সম্ভাবনা এমনিতে কম থাকে। সেখানে আমার কিছু জটিলতা রয়েছে। এটা শুনে শান্ত তৎক্ষনাৎ অপারেশন করার অনুমতি দিয়ে দিলো। সে কোন রিস্ক নিতে চায় না।
অতঃপর আমাকে অপারেশন করতে নিয়ে যাওয়া হলো। শান্ত ওটিতে ঢুকানোর আগ অব্দি আমার হাতটি শক্ত করে ধরে ছিলো। আমাকে ভরসা দিয়ে বলছিলো,“তুমি ভয় পেও না পুষ্প। আমি আছি। আমি সারাজীবন তোমার সঙ্গে থাকবো। যদি তাও ভয় পাও তবে আমাদের সবচেয়ে সুখের মূহুর্তগুলো ভেবো। দেখবে তোমার সব স্মৃতির পাতায় আমি আছি। শুধুই আমি। তাই ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমরা একসঙ্গে খুব ভালো থাকবো। আমাদের সমস্ত ইচ্ছে পূরণ হবে।”
শান্তর কথা শুনে আমি হাসার চেষ্টা করি। যদিও মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিলো। তবে সেই ভয় প্রকাশ না করে আমি হাসি। শান্তকে কোন কথা না বলে ওটিতে ঢুকি। তবে মনেমনে ঠিক বলছিলাম,“জীবন নিয়ে আমার আর কোন আফসোস নেই শান্ত। কোন আফসোস নেই।”
___
ভেতরে পুষ্পের অপারেশন হচ্ছে। বাহিরে শান্ত, বাবা, মা, মামা, মামী, কাজল, জয় সবাই অপেক্ষা করছে। ঘন্টা খানেকের মাঝে নার্স দু’টো ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে বাহিরে আসে। সে খুশিমনে বলে,“আপনাদের ছেলে, মেয়ে দুই বাবুই হয়েছে।”
এই কথা শুনে সবাই খুশি হয়। তবে শান্ত বাচ্চাদের দিকে নজর না দিয়ে পুষ্পর কথা ভাবছিলো। এই মূহুর্তে তার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিলো। নার্স বাচ্চাদের এগিয়ে দিলে বাবা, মা এগিয়ে আসে। মা বাচ্চাদের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে খুশি হয়। সে একবার বাবার দিকে তাকায়। বাবাও আবেগ নিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মা নার্সকে বলে,“মেয়ে বাবুটাকে ওর কাছে দিন।”
বাবা এটা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। নার্স বাচ্চাটিকে বাবার দিকে এগিয়ে দেয়। তবে বাবা ধরে না। সে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। মা চোখের ইশারায় বলে,“ধরো। তোমাকে এই মেয়ের থেকে কেউ কখনো দূরে করতে পারবে না।”
মায়ের ইশারায় বাবা ভরসা পায়। সে কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে দেয়। আলতো হাতে বাচ্চাটিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে সে চোখ বন্ধ করে দেয়৷ তার চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এটা খুশির নাকি বিরহের বলা যায় না। তবে তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই কথাগুলো যখন সে তার ভাইয়ের বাসায় তার মেয়েকে দেখতে ঘন ঘন যেতো। তখন তার ভাইয়ের বউ বিরক্ত নিয়ে বলতো,“ভাইয়া রোজ রোজ এখানে না এসে আপনি বরং সমস্ত কাজবাজ বাদ দিয়ে এখানেই থেকে যান। আমরা নাহয় আপনাকে পালবো। আপনার ভাই ভেবে নিবে সে এক পঙ্গু লোককে পালছে।”
তার এই কথায় বাবা পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। সে স্বপ্নেও ভাবেনি ভাবী এসব কথা বলবে। বাবা কিছুটা মলিন গলায় বলে,“বিশ্বাস করো এখানে আমার কোন চাওয়া পাওয়া নেই। শুধু ঝুমুকে একটু দেখতে আসি।”
“আসছে। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।
দুই টাকার খেলনা নিয়ে এসে আমার মেয়ের দিকে কুনজর দেন সেটা আমি ভালোই বুঝি।”
সেদিন এই অল্প কথায় চাচী থামেনি। বাবাকে কথার আঘাতে এতই জর্জরিত করেছে যে সে সেদিনের পর কোনদিন তাদের বাড়ি যায়নি। ধীরে ধীরে সম্পর্ক ঠিক হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সে কখনো সেই স্মৃতি ভুলতে পারেনি। সেদিনের পর ঝুমুর কথা ভেবে সে অনেক কান্না করেছে। সত্যি বলতে সে ঝুমুকে হৃদয় দিয়েই ভালোবেসেছিলো। একদম মেয়ের মতো করে। সেই কষ্ট ভুলতে তারা আবার বাচ্চার জন্য অনেক চেষ্টা করছিলো। কিন্তু হয়নি। মাও বাবার আবেগটা বুঝতে পেরে খুব কষ্ট পেতো। সে যদি একটা মেয়ের জন্ম দিতে পারতো। কিন্তু ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই। এসব কথা ভেবে বাবা শান্তর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেই চোখের পানি বিসর্জন দেয়। এটা বিরহ এবং সুখ মিলিয়ে ঝড়ে পড়ছে। একদিকে পুরনো স্মৃতি ভেবে যেমন কষ্ট হচ্ছে তেমন আনন্দও হচ্ছে। তার বুকে তার শান্তর মেয়ে। সে মনেমনে বলে,“আমার সোনা দাদু।
আমি তোমার এত ভালো খেয়াল রাখবো যে তুমি বড় হয়ে কখনো আমায় ভুলে যাবে না। আমাকে ছোটবেলায় যেভাবে ভালোবাসতে সেভাবেই ভালোবাসবে। আমি কথা দিচ্ছি। আমি তোমার খুব খেয়াল রাখবো।”
মা ছেলে বাবুটিকে কোলে নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারে তার স্বামীর আবেগ। তার খুশি। তবে মনেমনে বেশ ভয় হয়। অতিরিক্ত আদর দিতে গিয়ে যদি সে কোন ভুল করে। সেই ভুলগুলো যদি শান্ত বা পুষ্প সহ্য করতে না পারে। এই ভয়টা তার হৃদয়ে কাজ করে। এসব ভাবনার মাঝে অন্যরা বাচ্চাদের দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে বাবা এবং মা দুজনেই বাস্তবে ফিরে আসে। বাবা শান্তর মেয়েকে বুকে নিয়ে বলে,“তোমরা ছেলে বাবুকে কোলে নাও। আমি আগে আমার নাতনিকে প্রানভরে দেখি তারপর তোমাদের দিচ্ছি।”
এটা বলে নিজেই ছেলে বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে,“দাদুভাই তুমি রাগ করো না। আমি তোমাকেও আদর করবো। তবে আগে বোনকে আদর করি।”
তাদের এসব কথার মাঝে শান্ত নার্সকে বারবার পুষ্পের কথা জিজ্ঞেস করে। নার্স বলে,“আপনার স্ত্রী ঠিক আছে। সেলাই চলছে। সেটা শেষ হলে বাহিরে বের করা হবে।”
পুষ্প ঠিক আছে শুনে শান্ত খুব খুশি হয়। সে এবার তার বাচ্চাদের দিকে তাকায়। তার পরিবার বাচ্চাদের নিয়ে বেশ আবেগে আপ্লূত হচ্ছে দেখে সে খুব খুশি হয়। বিশেষ করে বাবার খুশি তাকে অনেক বেশি খুশি করে। এসব দেখে সে মনেমনে বলে,“যা হয় ভালোর জন্যই হয়। একসঙ্গে দুটো বাচ্চা হওয়ায় ভালো হয়েছে। কারো কোন আফসোস থাকবে না। তবে হ্যাঁ একটা হলে আমিও চাইতাম মেয়ে হোক। আমার বাবার মুখে এই খুশিটা দেখার জন্য হলেও চাইতাম মেয়ে হোক। মেয়ে নাহলে তো আমি বুঝতেই পারতাম না, আমার বাবা এত আবেগি।”
★
আমাকে বাহিরে বের করা হলে শান্ত আবার আমার হাতটি ধরে নেয়। শরীর দূর্বল, চোখ মেলে রাখতে পারছি না। তবুও শান্তর মুখটা দেখার জন্য চোখ মেলে রাখলাম। আমি বের হতে সবাই আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বললো। তবে সেখানে বাবাকে দেখতে পেলাম না। আমি শান্তকে ইশারায় এটা বোঝানোর চেষ্টা করি। শান্ত বলে,“বাবা মিষ্টি কিনতে গেছে। সে নাকি এখন সারা এলাকায় মিষ্টি বিলাবে আর তার বৌমাকে যারা যারা বাজে কথা বলছে তাদের এখন তার নাতি, নাতনির বর্ননা করে আসবে।”
এটা শুনে আমি মৃদু হাসলাম। শান্তও হাসলো অবশ্য। সে হাসতে হাসতে বলে,“আমিও তো ভাবি আমি এত পাগল কিভাবে হলাম। আমার বাবার থেকেই সব পাগলামি পেয়েছি। দেখলে কত পাগল সে? তবে হ্যাঁ সে কিন্তু তোমার ছেলেকে কম আদর করছে। সব আদর মেয়েকে করা হচ্ছে। বাবা আসলে এটা নিয়ে বকে দিও।”
আমি হাসলাম। তবে কোন কথা বললাম না। আমাকে আমার বাচ্চাদের দেখানো হলো। আমি পরম যত্নে আমার বাচ্চার গায়ে হাত বুলিয়ে দেই। সে এক চমৎকার অনুভূতি। তবে এটার চেয়েও গভীর অনুভূতি তখন জন্মেছিলো যখন বাচ্চার কান্নার শব্দ আমার কানে আসছিলো। অবশ করা থাকলেও আমি সবকিছু অনুভব করতে পারছিলাম। ঐ সময়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মা হওয়ার এই অনুভূতি সত্যি চমৎকার। ভীষণ চমৎকার।
___
আমি হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসতে এলাকায় প্রায় মানুষ আমাকে এবং বাচ্চাদের দেখতে এলো। তারা অবশ্য মুখে মুখে সবাই কম বেশি ক্ষমাও চাইলো। তাদের আমাকে নিয়ে থাকা ভুল ধারণা ভেঙে গেছে। তারা অবশ্য এসব বলার সঙ্গে আমার বাবা, মাকেও বকা দেয়। তবে তাদের বকা দেওয়া শুনেও আমি কিছু বলতে পারি না। আমার খারাপ লাগলেও আমি তাদের থামাই না। আমার মন বলে,“এসব লোকের কথা শুনে যদি বাবা, মা একটু শুধরে যায়।”
কিন্তু আদৌ সেটা সম্ভব। সম্ভব নয়।তবুও আজ আমি ভীষণ খুশি। আজ আমার নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। আজ আমার জীবনে সব রয়েছে। এদিকে বাচ্চার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ও এক কান্ড করে বসেছে। সে চাচীকে ফোন দিয়ে তার রাগ ঝাড়ে। সে সুন্দরভাবে বলে,“আমার বৌমার তো বেশ বয়স হয়ে গিয়েছিলো। বাচ্চা হবে না বলে তোমার খুব আফসোস হচ্ছিলো না ভাবী। এবার এসো আমার বাড়ি। দেখো যাও কত মিষ্টি দুটো বাচ্চার জন্ম দিয়েছে আমার বৌমা। একটা মিষ্টি মেয়েও হয়েছে। আমার স্বামী তো খুব খুশি। তার আর মেয়ের অভাব রইলো না। এই মেয়েকে দুই টাকা হোক বা দশ টাকা যে জিনিসই দিক কেউ বাজে মন্তব্য করবে না। ভাবী এসে দেখে যাইয়ো আমার নাতি, নাতনিদের। হ্যাঁ আবার তাদের অভিশাপ দিও না। তারা যাতে ভালো থাকে সেই দোয়া করো।”
মায়ের এই কান্ডের কথা শুনে আমার ভালো লাগলো না। এমন অহংকার করা উচিত হয়নি। তবে আমি বুঝি মায়ের অনুভূতি। সে কোন পরিস্থিতির কথা ভেবে চাচীকে এভাবে বলেছে।
___
আমার দিনগুলো বেশ ভালোই যাচ্ছিলো। ঘরের কোন কাজে কেউ হাত লাগাতে দিচ্ছিলো না। সবার এক কথা, আগে পুরোপুরি সুস্থ হবে তারপর কাজ। বাচ্চাদের সমস্ত দেখাশোনা বাবা, মায়ই করছে। সেই সঙ্গে তাদের জন্য একজন কাজের মেয়েও রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র তাদের দেখাশোনা করবে। যেহেতু আমরা সবাই চাকরি করি সেহেতু তাদের দেখাশোনা করতে একজন লাগে। আমার শাশুড়ী অবশ্য বলে দিয়েছে,“যতই কাজের মেয়ে রাখা হোক। তুমি মা। চাকরি করো, ব্যস্ততা সব বাদ দিয়ে তুমি ওদের সেই সময় দিবে যাতে ওদের কখনো মনে না হয় ওরা ওদের মাকে পায়নি। মায়ের কোন অভাব অনুভব করেছে। বাচ্চা জন্ম দেওয়া যত সহজ মা হওয়া কিন্তু তত সহজ নয়। মা একটি শব্দ নয়। এই শব্দের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে অনেক অনেক দায়িত্ব।”
আমি মায়ের কথায় সম্মতি জানাই। আমি অবশ্যই ভালো মা হবো। আমি ছোট থেকে যা পাইনি তা আমার সন্তানদের দিবো।
★
আমি বিছানায় বসে বই পড়ছিলাম। বাচ্চারা এখন তার দাদা, দাদির কাছে। তাদের বাবা, মা খুনসুটি করছিলো। আমি ঘরে বসে সেসব শুনে হাসছিলাম। সেই মূহুর্তে শান্ত ঘরে এলো। সে ঘরে এসেই আমাকে কোলে তুলে নিলো। আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,“এখন এসব পাগলামি তোমার সঙ্গে যায়?”
“কেন যায় না? অবশ্যই যায়।”
এটা বলে শান্ত আমার কপালে চুমু খায়। আমি তার গলা জড়িয়ে বলি,“এখন বাবা হয়ে গেছো না। এখন…।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত বলে,“থামো তো।
বাচ্চার মা হয়ে গেছো বলে মনের বয়স চল্লিশ বানিয়ে ফেলো না। বাচ্চারা বুড়ো হয়ে গেলেও আমাদের ভালোবাসা কমবে না। কারণ ভালোবাসার কোন বয়স হয় না বুঝলে চল্লিশের রমনী।”
“বেশ বুঝলাম।
আপনার ভালোবাসা সবসময় ষোলোর কিশোরের মতোই থাকবে। তাই তো?”
আমার কথা শুনে শান্ত মাথা নাড়ায়। যার অর্থ হ্যাঁ। শান্ত ঐ অবস্থায় আমাকে কোলে নিয়ে বাহিরে বের হয়। আমি তৎক্ষনাৎ বলে উঠলাম,“কী করছো? বাবা, মা দেখে ফেলবে?”
“তারা তাদের ঘরে।
দেখলেও সমস্যা নেই। তারা বুঝি প্রেম করেনি।”
এটা বলে শান্ত আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ির ছাদে চলে আসে।
খোলা আকাশের নিচে, নক্ষত্রভরা রাত্রি যেন আকাশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে স্বপ্নের মায়াজাল। তারার ভিড়ে এক টুকরো রূপালি দীপশিখার মতো নিস্তব্ধ চাঁদ দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত, প্রশান্ত, অথচ অদ্ভুত আকর্ষণে ভরা। সেই আলোর স্নিগ্ধতায় ছাদ যেন অন্য এক জগতে রূপ নিয়েছে।
আমি শান্তর কোলে নতশিরে বসে আছি, যেন সময় থমকে গেছে আমাদের দু’জনকে ঘিরে। চারদিকে নীরবতার সুর বাজছে, দূরের বাতাসে হালকা শিহরণ বয়ে যায়, আর চাঁদের আলো এসে নিঃশব্দে ছুঁয়ে যায় আমাদের অব্যক্ত ভালোবাসা। মনে হয়, রাত্রির এই আকাশ, চাঁদের এই জ্যোৎস্না আর আমাদের দু’জনের নীরব একাত্মতা। সব মিলেই এক অমলিন কবিতা হয়ে উঠেছে। এই সুন্দর মূহুর্তে দাঁড়িয়ে শান্ত আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,“ভালোবাসবো?”
“বাসো। আমি তো তোমার ভালোবাসার চাদরে সারাজীবন জড়িয়ে থাকতে চাই শান্ত।”
আমার কথা শুনে শান্ত মুচকি হেসে বলে,“আমিও তোমায় সারাজীবন ভালোবাসতে চাই। তুমি, আমি, আর আমরা মিলে এক সুখের নীড় সারাজীবন ইচ্ছেঘুড়ির সুঁতোয় বেঁধে রাখতে চাই। যেটা আমাদের নীড়৷ শুধুমাত্র আমাদের নীড়। ভালোবাসার নীড়।”
আমি শান্তর চোখে চোখ রাখলাম। তার গালে চুমু খেয়ে বললাম,“এই ভালোবাসার নীড়ের সবটুকু ভালোবাসা সইবার সহ্যশক্তি তিনি আমায় দিক।”
এটা বলে শান্তর গলা জড়িয়ে নিলাম। শান্ত খুশি হয়ে আমাকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিলো। সেই মূহুর্তে আমি বলে উঠলাম,“তোমার বাবুই সোনা আমাদের হয়তো খুঁজছে। চলো এবার যাই।”
শান্ত মাথা নাড়ায়। সে আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আমিও উঠে দাঁড়াই। আমি পা বাড়াতে নিলে শান্ত আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি মুচকি হাসি দিয়ে তার হাতে হাত রাখি। শান্ত আমার হাতটি ধরে বলে,“আমি, তুমি এবং আমরা ইচ্ছেঘুড়ির সুঁতোয় বাঁধা সুখের নীড়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে চলো না পা বাড়াই।”
আমি সম্মতি জানালাম। আমার সম্মতি পেয়ে শান্ত আমার হাত ধরে আমার সঙ্গে একসাথে এক পা বাড়িয়ে দেয়। এখান থেকে আমাদের জীবনের সুখের আরও একটি অধ্যায়ের সূচণা হয়। যেই অধ্যায়ে আমাদের বাবুই সোনা অর্থাৎ আমাদের বাচ্চারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমি শান্তর সঙ্গে এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে আসতে আমার চোখের ভাষায় আমাদের সেই দেখা হয়, কাছে আসার সমস্ত স্মৃতি ভেসে উঠে। আর কানে ভেসে উঠে শান্তর বলা সেই কথা,“ভালোবাসবো?”
সে এক অন্যরকম অনুভূতি। অন্যরকম প্রাপ্তির গল্প। এই প্রাপ্তির সঙ্গে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমি শান্তর হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলি। শুধু ঘরের দিকে নয়, এই এগিয়ে চলা সুদূর ভবিষ্যতে একসঙ্গে পাড়ি দেওয়ার এগিয়ে চলা। যেই ভবিষ্যতে শুধু থাকবে একরাশ মুগ্ধতা, একরাশ প্রাপ্তির গল্প। শান্ত এবং পুষ্পের প্রাপ্তির গল্প।
(সমাপ্ত)