ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-৪৩

0
1153

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৪৩( স্পেশাল পর্ব)
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

ভোর হলো প্রায় অনেকক্ষণ। ঐশী জুভানের বাহুডোরে বেঘোরে ঘুমে মগ্ন। আর একটু পর ঐশীর জ্ঞান ফিরবে। কিন্তু জুভানের মনে ঘুরছে অন্য চিন্তা।সে চায়না ঐশী ঘুম থেকে উঠে জেগে ওকে দেখুক।আর আজ যা করেছে তার জন্যে ত একটু হলেও শাস্তি প্রাপ্য ওর। তাই জুভান খুব সাবধানে ঐশীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ঐশী পিটপিট করে চোখ খুলে। বেশ কিছুক্ষণ লাগলো ওর সম্ভিত ফিরে পেতে। আড়মোড়া ভাঙ্গতেই লক্ষ্য করলো,ঘাড়টা এখনও অসম্ভব ব্যাথা করছে। কিন্তু ঠোঁটের জ্বালা আগের থেকে অনেক কম। ঐশী অঙ্গুল্ড ইয়ে ঠোঁট ছুলে ঠোঁটের মধ্যে নরম কিছুর অস্থিত্ব পায়। মলম মনে হয়। ঐশী এবার হাত নাড়াতেই হাতে টান খায়। ” আহ্” বলে মৃদ চিৎকার করে ঐশী হাতের দিকে তাকায়। হাতে সেলাইন পুষ করা। ঐশী এসব দেখে ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

— ” আবারও বন্দী। ধুর! ”

প্রায় আধা ঘন্টা এমন সং সেজে বসে থাকার পর একটা মেয়ে সার্ভেন্ট রুমে ঢুকলো। দরজা খোলার আওয়াজ শুনে ঐশী ভাবলো হয়তো জুভান এসেছে। কিন্তু ঐশীকে ভুল প্রমাণিত করে মেয়র সার্ভেন্ট বাটিতে সুপ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। ঐশী আবারও এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জুভান যে তাকে নিজ থেকে দেখা দিচ্ছে না সেটা খুব ভালোই আন্দাজ করতে পারছে ও।

— ” ম্যাম, সুপটা খেয়ে নিন প্লিজ। ”

ঐশী সুপের দিকে একনজর তাকালো। তারপরই মুখ ঘুরিয়ে বললো,

— ” এখন খাওয়ার ইচ্ছে নেই। ”

সার্ভেন্ট পড়লো মহাফ্যাসাদে। ঐশীকে আকুতি মিনতি করেই লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে বললো,

–” ম্যাম, আপনি খাননি জানলে স্যার অনেক রেগে যাবেন। আর স্যারের রাগ যা ভয়ংকর। প্লিজ ম্যাম খেয়ে নিন। ”

ঐশী এবার মুখ ঘুরে তাকালো মেয়েটার দিকে। সোজাসাপ্টা বললো,

— ” তাহলে তোমার স্যারকেই এসে খাওয়াতে বলো। ”
— ” ম্যাম, স্যার এই রুমে আসতে চাচ্ছেন না। ”
— ” তো আমিও এখন খেতে চাচ্ছি না। ”

মেয়েটার মুখে এবার নিদারুণ অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো। আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেছে। এবার তো আর কোনো উপায় নেই। সার্ভেন্ট শেষ পর্যন্ত সুপ টেবিলের উপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

একটু পর হনহন কর জুভান রুমে প্রবেশ করে। চোখে মুখে আগুনের ফুলকি ঝরছে। প্রথমে খুশি হলেও এখন ঐশী জুভানের রাগ দেখে খানিক ভয় পায়। না জানি এখন ওর কি হাল করে এই বদটা। জুভান রুমে এসেই কোনো ভনিতা না করে সুপার বাটি হাতে নেয়। এক চামচ সুপ ঐশীর দিকে এগিয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বলে,

— ” খাও। ”
ঐশী খায় না। বরং ঠোঁট মুখের ভিতরে নিয়ে যায়। জুভান এবার রাগে ঐশীর গাল ধরে জোর করে হা করিয়ে সুপ খাইয়ে দেয়। ঐশী না চাইতেও সুপ গিলে ফেলে। গালে হাত ঘষে করুন গলায় বললো,

— ” আপনি আমায় ব্যাথা দিচ্ছেন। ”

জুভান হা না কিছুই বললো না। আরো এক চামচ সুপ ঐশীর মুখের সামনে ধরলো। ঐশী এবার রাগ দেখিয়ে বললো,

— ‘ কি হয়েছে আপনার? আমার সাথে কথা বলছেন না কেনো? ”

জুভান এবার ঐশীর চোখে চোখ রাখলো। কঠোর কণ্ঠে বললো,

— ” ইচ্ছে করছে না তাই। আর কিছু? ”

জুভানের কথা শুনে ঐশীর চোখ ভিজে এলো। কান্নাভেজা গলায় বললো,

— ” এমন করে বলছেন কেনো? ”

— ” কেমন করে বলছি? ”
জুভানের ত্যাড়া উত্তর শুনে ঐশী দমে এলো না। বললো,

— ” আপনি খুব ভালো করে জানেন আমি কিসের কথা বলছি। ”

জুভান উত্তর দিলো না। ঐশীর মুখের দিকে আরও এক চামচ্ সুপ এগিয়ে দিলে ঐশী এবার এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসে। হাত ঝটকা দিয়ে জুভানের হাত থেকে চামচ্ নিচে ফেলে দেয়। জুভান এতে হতবাক হলে ঐশীর মুখের তাকিয়ে নিভে যায়। ঐশীর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ভেজা গলায় বললো ও,

— “থামুন এবার। আমি আপনার এই রূপ সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ বন্ধ করুন এসব। আমি আর নিতে পারছি না। ”

জুভান ঐশীর অবস্থা দেখে চোখ বুজে নিঃশ্বাস নিলো। তারপর রেগে ঐশীর দু বাহু খামচে ধরলো। হড়হড় করে বললো,

— ” আমার সামান্য একটু অবহেলা তুমি পাঁচ মিনিটের জন্যে সহ্য করতে পারো নি। কিন্তু এই তুমি? দিনের পর দিন আমায় অবহেলা করে এসেছো।তখন? তখন আমার মধ্যে কি গেছে তার কি কোনো খেয়াল ছিলো তোমার? উত্তর দাও। ”

ঐশী ভেজা চোখে জুভানের দিকে তাকালো। বললো,

— ” আমি আপনাকে অবহেলা করেছি কখন? ”

— ” করেছো তুমি। একবার না বরং হাজারবার। তুমি একবারও তোমার প্রতিশোধের কথা আমায় জানিয়েছো? না জানাও নি। কারণ তুমি কখনোই আমায় আপন ভাবতে পারো নি। আমাদের মনের মিল হয়েছে ঠিকই কিন্তু তুমি সবসময় আমাকে আপন ভাবো নি। ভাবলে একা একা এত বড় রিস্ক নিতে পারতে না। ”

— ” আমি ভয় পাচ্ছিলাম জুভান। আমি চাইনি তুমি এসবের জন্য আমাকে ছেড়ে দাও। ”

ঐশীর চোখের জল কোনো বাঁধ মানছে না। জুভান অবাক হয়ে বললো,

— ” ভয়! আমকে নিয়ে? ”

— ” হ্যাঁ জুভান। ভয়! আমি তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যে ছাড়তে পারবো না। ”

জুভান এবার ঐশীকে ছেড়ে দিলো। রাগ এবার তার হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। জুভান এবার শীতল গলায় বললো,

— ” আজ একটুর জন্যে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হারাতে বসেছিলাম, ঐশী। তোমার জন্যে আমার জীবন আবার আঁধারে ঢেঁকে যাচ্ছিলো। আর আমার জীবনে তোমার থেকে মূল্যবান আর কিছুই নেই, ঐশী। আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেত! ”

জুভান ভাবতেই ভয়ে কেপে উঠলো। ঐশী অবাক হয়ে জুভানের দিকে তাকিয়ে আছে। জুভান এবার কপাল চুলকালো। তারপর ঐশীর দিকে আঙুল উচিয়ে বললো,

— ” এর জন্যে আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করবো না ,ঐশী। ”

জুভান চলে যেতে নিলে ঐশী জুভানের ডান হাত ধরে ফেলে। জুভান সামনে তাকিয়েই চোখ বুজে। ঐশী করুন গলায় বললো,

— ” আই অ্যাম সরি। আর হবে না এরকম। ”

জুভান এক ঝটকা দিয়ে ঐশীর থেকে হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। ঐশী সেখানেই হাঁটু গেড়ে বসে কান্না করতে থাকে। তার জীবনটা এরকম না হলেও পারতো!
____________________
ঐশী আজ এক অবিশ্বাস্য কাজ করার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জুভানের রাগ ভাঙ্গানোর এর থেকে ভালো উপায় আর তার মাথায় আসেনি। ঐশী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সাদা জর্জেট শাড়ি। যা শরীরে জড়ানোর ফলে পেট, নাভি প্রায় সব দৃশ্যমান। চুলগুলো পিঠ অব্দি ছড়ানো। চোখে মোটা করে কাজল, ঠোঁটে একটা নুড লিপস্টিক। মুখে হালকা ব্লাশঅন। ঐশী আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কোনো কমতি তো নেই?

অনেক রাত হয়েছে। ঐশী ঘুমিয়েছে কিনা জানতে জুভান খুব সাবধানে রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই থমকে যায়। ঐশী জুভানের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জুভান ঐশীকে আগাগোড়া নিরক্ষ্ন করতেই তার গলা শুকিয়ে আসে। প্রচন্ড তৃষ্ণায় খা খা করতে থাকে তার বুক। জুভান এক প্রেম ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ঐশী ধীর পায়ে এগিয়ে আসে জুভানের দিকে। আলতো করে জুভানের গলা জড়িয়ে ধরতেই জুভান সম্বিত ফিরে পায়। চটজলদি ঐশীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়।
সঙ্গেসঙ্গে ঐশী জুভানকে জড়িয়ে ধরে। জুভান থমকে যায়। ঐশী জুভানের বুকে নাক ঘষে কান্নাভেজা গলায় বললো,

— ” ঐশী সরি। একবার দুবার, হাজারবার সরি বলছে তার জেদী বরটাকে। আর কক্ষণো সে এমন করবে না। ”

ঐশী জুভানের বুক থেকে মুখ তুলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলে,

— ” এই ঐশী আর কখনো নিজেকে তার জেদী বর থেকে আলাদা করবে না। কথা দিচ্ছি সে। ”

জুভান ঐশীর এমন করে কথা বলা দেখে না চাইতেও হেসে ফেললো। ঐশী এমন একটা মেয়ে, যার উপর সে কখনোই রেগে থাকতে পারে না। মনে হয়না জীবনেও পারবে। জুভান ঐশীর কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে নিজের সাথে মেশালো। নিজের চোখ বন্ধ করে কপালে খুব সময় নিয়ে অধর ছুঁইয়ে দেয়। ঐশী আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। জুভান কপাল থেকে মুখ তুলে ঐশীর ঠোঁটের দিকে তাকায়। ঘোরমাখা গলায় বললো,

–” আজকে কাছে আসাটা কি কিস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ? নাকি এর থেকেও বেশি কিছু? ”

ঐশী এত এত লজ্জা পায়। লজ্জায় চলে যেতে নিলে জুভান হুট করে ঐশীকে পাজকোলা করে কোলে তুলে নেয়। ঐশী ভয় পেয়ে জুভানের গলা জড়িয়ে ধরে। জুভান টিপ্পনী কেটে বলে,

–” আজকে পালাতে দিচ্ছি না, সুন্দরী। ”

ঐশী লজ্জায় জুভানের বুকে মুখ লুকায়।

জুভান ঐশীকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ঐশীর চোখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা লজ্জায় একেবারে নেতিয়ে যাচ্ছে। জুভান ঐশীর কপপালে চুমু দিয়ে ঐশীর দিকে তাকায়। হঠাৎ তার কি একটা মনে পড়ায় বললো,

— ” তুমি অসুস্থ ঐশী। আমাদের এগুনো কি ঠিক হবে? ”

ঐশী আঁতকে উঠে। জুভান কি তবে থেমে যাবে। ঐশী জুভানের কলার ধরে ওকে নিজের দিকে ঝুঁকে আনে। জুভানের চোখে চোখ রেখে বলে,

— ” আপনিই আমার সকল রোগের সুস্থতা, জুভান। ”

জুভান মুচকি হেসে ঐশীর শাড়ির আঁচল সরিয়ে ওর গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। জুভানের একেকটা স্পর্শ ঐশীর মনে শিহরণ জাগিয়ে তুলে। এক বিরামহীন সুখের সাগরে সাঁতার কাটতেই ঐশীর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ইশ! কি জুভান ওকে কি সুখটাই না দিচ্ছে। ও তো সুখের কারনে মরে যাচ্ছে! ঠিক তখন জুভান ঐশীর বয়স কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

— ” আজ আমার ভালোবাসার তোমার মৃত্যু নিশ্চিত,ঐশী।”.

ঐশী চোখ বুজে মুচকি হাসে। জুভান যখন ফিসফিসিয়ে কথা বলে ঐশী তখন এই ঘোরে চলে যায়। জুভান ওকে এত ভালবাসে কেনো? কি সৌভাগ্য ওর!

#চলবে