ইট পাটকেল পর্ব-২০+২১

0
1046

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২০

কামিনী চৌধুরী ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে নিউজপেপারে চোখ বুলাচ্ছে।তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কাল তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে বাসর ও সেরে ফেলেছে। আর কেউ এখনো ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসে নি।নূরের আজ কনসার্ট আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে। অসুস্থতার জন্য পোগ্রাম পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।আজ সারাদিন রিহার্সাল করবে। রাত আট টায় শুরু হবে কনসার্ট। আশমিন সেখানে চিফ গেস্ট। যদিও নূর সেটা জানে না।আশমিন নিজেই জানতে দেয়নি নুর কে। বর্ষসেরা শিক্ষার্থীদের সম্মাননা দেয়া হবে আজ। আশমিনের পোগ্রাম দুপুরে হলেও আশমিন রাতে একবার যাবে সেখানে।আশমিনের মতে,বউয়ের লেজ ধরে ঘোরা স্বামীদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পরে।আর সে কখনো নিজের দায়িত্বের অবহেলা করে না।

আশমিন সকাল সকাল জীমে গিয়েছে।ইদানীং সে নিজেকে নিয়ে চিন্তায় আছে। বউ তার দিকে খুব একটা নজর দিচ্ছে না। ব্যপার টা গুরুতর। এতো মেন্টাল স্ট্রেস নিতে পারছে না সে।কোথায় এসে হ্যান্ডসাম বরের সাথে চিপকে থাকবে তা না করে সারাক্ষণ লাঠিসোঁটা নিয়ে যুদ্ধ করার পায়তারা করে । সে ভালো বলে এখনো কিছু বলছে না। না হলে এতো দিনে দুই বাচ্চার মা করে ঘরে বসিয়ে রাখতো। রাগে গজগজ করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেলো আশমিন।

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে এক ভ্রু উচু করে ফেললো আশমিন। কামিনী চৌধুরী গুনগুন করতে ব্রেকফাস্ট করছে।আমজাদ চৌধুরী এখনো নিচে আসেনি। সানভি আর অমি ব্রেকফাস্ট করতে করতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আশমিন কে দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেলো। আশমিন ইশারায় বসতে বলে গম্ভীর গলায় বলল,

— আর কখনো খাবার ছেড়ে এভাবে দাঁড়াবে না।

দুজনেই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। মিনিট দুই পরে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে নূর এসে উপস্থিত হলো। ধপ করে চেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে দিলো টেবিলে।অজানা কারনে তার খুব ঘুম পাচ্ছে। রাগের বসে সে সত্যিই সেই গ্লাসের পানি খেয়ে ফেলেনি তো?উফফফ।মাথা ধরে বসে রইলো নূর। আশমিন নূরের দিকে নির্লিপ্ত চোখে চোখ রেখেই খাবার মুখে পুরছে।তীক্ষ্ণ চোখে নিজের দেওয়া চিহ্ন গুলোতে চোখ বুলিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল সে। আশমিনেএ পুর্ণ ধ্যান কামিনী চৌধুরীর দিকে। এতো শান্ত মানেই ঝড়ের পূর্বাভাস।

নূর টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরেছে।অমি নূরের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেও সানভি একটু পর পর লাজুক চোখে আশমিনের দিকে তাকাচ্ছে। আশমিনের খাওয়ার শেষ পর্যায়ে আমজাদ চৌধুরী আর মায়া আন্টি নিচে নেমে এলো। হালকা গোলাপি শাড়ি তে দারুণ লাগছে তাকে।মায়া আন্টির ভেজা চুল দেখে চোখ বড় বড় করে আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকালো আশমিন।আমজাদ চৌধুরী ও ভ্রু কুচকে তাকালো ছেলের দিকে।এভাবে তাকানোর কি আছে? মায়ার ভেজা চুলের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো কামিনী চৌধুরী। কটমট করে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। মায়া এসে আমজাদ চৌধুরীর বরাবর বসে পরলো। কামিনী চৌধুরী গটগট করে চলে গেলো সেখান থেকে। আশমিন আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

— বিয়ে করবে না করবে না করে গড়াগড়ি খেয়ে কান্নাকাটি করছিলে।যেই বিয়ে করিয়ে দিলাম অমনি মেইন কাজ সেরে ফেললে!

আমজাদ চৌধুরী চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন।ভাগ্য ভালো আর কেউ শোনে নি।আশমিনের দিকে তাকিয়ে কটমট করে বললো,

— বাবা হই তোমার। লাজলজ্জা সব খেয়ে বসে আছো? বেয়াদব ছেলে। বিয়েটা নকল, তাই এসব অবান্তর কথা বলা বন্ধ করো।

আশমিন অবাক হওয়ার ভান করে বললো,,

— তারমানে বিয়েটা আসল হলে সত্যিই বাসর সেরে ফেলতে! এই বয়সে এতো ডেস্পারেট হওয়া ভালো না। আর আমাকে বেয়াদব নির্লজ্জ যাই বলো না কেন আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আমি আমার বাবার মতো হয়েছি। আমি নির্লজ্জ মানে সেও নির্লজ্জ। আর বিয়ে টা আসল ছিল।

আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব হয়ে বসে ছেলের চলে যাওয়া দেখলো।তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে,বিয়ে টা আসল ছিল।

নূর চোখ বন্ধ করে বাবা ছেলের কথা শুনছিল।আশমিন কে এখন তার শুধু একজন অসহ্য ভয়ংকর মানুষ মনে হয়। চোখ খুলে আমজাদ চৌধুরীর দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নূর। শান্ত গলায় বললো,

— কিছু কথা ছিল আংকেল।

আমজাদ চৌধুরী ক্লান্ত চোখে তাকালো নূরের দিকে। নূর চোখ সরিয়ে নিলো। শান্ত গলায় বললো,

— আমি ডিভোর্স নিতে চাইছি।যেহেতু আমাদের বিয়ের কোন ডকুমেন্টস নেই সেহেতু মৌখিক তালাক দিলেই হবে।

আমজাদ চৌধুরী চমকে উঠলেন।ভয়ার্ত চোখে তাকালো নূরের দিকে। নূরের পিছনেই আশমিন দাঁড়িয়ে। শান্ত চেহারায় ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে আছে সে। সানভি অসহায় চোখে তাকালো আশমিনের দিকে।

আশমিন ঠান্ডা গলায় হুংকার দিয়ে বললো,

— সান,,,

সানভি পরিমরি পায়ে দৌড়ে গিয়ে একটি হকিস্টিক এনে দিলো আশমিনের হাতে।নূর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে।

মুহুর্তেই ডাইনিং টেবিলে চুর্নবিচুর্ন হয়ে গেলো। নূর চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে ভাঙ্গা কাচের দিকে। এটা তার মায়ের হাতে কেনা।মায়ের স্মৃতি এভাবে নষ্ট হতে দেখে রাগে কষ্টে মুখ লাল হয়ে গেলো নূরের।চোখ বন্ধ করে হাত মুঠ করে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলো। আশমিন হকিস্টিক টা সানভির হাতে দিয়ে নূরের সামনে এসে দাড়ালো। শক্ত হাতে নূরের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাতে দাত চেপে বললো,,

— আরেকবার এই কথা মুখ থেকে বের করলেও এই টেবিলের জায়গায় তুই থাকবি আর হকিস্টিকের জায়গায় আমি।কিভাবে ভাঙ্গবো তা সবার সামনে বলতে চাইছি না।

নূরের মুখ ছেড়ে দিয়ে শান্ত ভাবেই বেড়িয়ে গেলো আশমিন। ভাব দেখে মনে হচ্ছে এখানে কিছুই হয়নি।নূর হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো। আমজাদ চৌধুরী আর মায়া আন্টি চুপচাপ বসে আছে। আমজাদ চৌধুরী কে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে তার কাছে এলেন মায়া আন্টি। নরম গলায় বলল,

— চিন্তা করবেন না।রাগ উঠেছে তাই এমন করেছে।মাথা ঠান্ডা হলে ঠিক হয়ে যাবে।

এমনিতেই আমজাদ চৌধুরীর মাথা গরম ছিল।মায়ার কথা শুনে আগুনে ঘি ঢালার কাজ হলো। সে আগুন চোখে তাকালো মায়ার দিকে। শক্ত করে বাহু চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বললো,

— নাটক করছো?বউ সাজতে চাইছো? কান খুলে শুনে রাখো,এই বাড়িতে কয়েকদিনের মেহমান তুমি।নিজের সীমার মধ্যে থাকো।আমার কাছে ঘেসার চেষ্টা করবে না। আর সবাই কে ভেজা চুল দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছো?আমি খুব আদর করেছি তোমায়।ছিঃ, নোংরা মেয়েমানুষ। আমার পরিবার থেকে দূরে থাকো।সময় হলে আমি নিজে তোমাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলবো।

মায়া ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আমজাদ চৌধুরীর দিকে। হাতটা ব্যথায় নিল হয়ে গেছে।কাল তো সব ঠিকই ছিল।আজ হঠাৎ করে কি হলো?

মায়া ধরা গলায় বলল,

— আপনি এসব কি বলছেন? আমি তো শুধু আপনাকে শান্তনা দেয়ার জন্য বলছিলাম,,

আমজাদ চৌধুরী তেতে উঠলেন। কর্কশ গলায় বলল,

— আমি চেয়েছি তোমার কাছে সান্তনা? একদম আমার কাছে ঘেসার চেষ্টা করবে না। অসহ্য লাগে তোমাকে।

মায়ার বাহু ছেড়ে গটগট করে চলে গেলো আমজাদ চৌধুরী।মায়া অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে দেখলো তার চলে যাওয়া।

কামিনী চৌধুরী রুমে বসেই ক্রুর হাসলো। টাকার ব্যবস্থা করা হতে গেছে। কাল অথবা পরশু টাকা হাতে পাবে।তখন সে নিজের আসল চাল চালবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্তরে এসে নূরের মন খানিকটা ভালো হয়ে গেলো। অন্যান্য শিল্পিরা এখন পারফর্ম করছে।মন ভালো হলেও আশমিনের উপর রাগটা ষোল আনাই আছে। পার্কিং এ আশমিনের গাড়ি বহর দেখে বাকা হাসলো নূর।কালো মার্সেটিজ টা আশমিনের অসম্ভব প্রিয়। এটা ছাড়া সে কোথাও যায় না।গাড়ি তে একটা স্ক্রেচ পরলেও আশমিন মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ক্রুর হেসে নূর তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেলোlight

one day I’m gonna fly away
One day when heaven calls my name
I lay down I close my eyes at night
I can see morning light
One day I’m gonna fly away
One day I’ll see your eyes again
I lay down I close my eyes at night
I can see morning light

নূরের সাথে একজন মেল সিঙ্গার পারফর্ম করছে।আশমিন তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু দেখছে। নূর কে ঠিক একটা বার্বিডলের মতো লাগছে।বউ সুন্দরী হলে অনেক জ্বালা। সেখানে মন্ত্রী হয়েও কোন লাভ নেই।বউয়ের কাছে পাত্তা পাওয়া যায় না। পুতুলের মতো একটা বউ তার। সারাক্ষণ কোলে নিয়ে না ঘুরে এখানে বসে মুরগির মতো ঝিমাতে হচ্ছে!বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে গেলো আশমিনের।

কনসার্ট শেষ হলো রাত দুইটায়।আশমি ভার্সিটি চত্তরে দলের কিছু ছেলের সাথে কথা বলছে।নূরের গাড়ি এসে আশমিনের গাড়ির সামনে থামলো। আশমিন ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো।নূর হাতে হকিস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই বিরস মুখে অমি দাঁড়িয়ে। নূর দুই আঙ্গুল দিয়ে স্যালুট দেখিয়ে ধুম করে আশমিনের গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে ফেললো। ছেলেরা দৌড়ে যেতে চাইলে আশমিন ইশারায় থামিয়ে দিল।

— তোরা মিডিয়া সামলা।এদিকে যেন না আসে।

ছেলেগুলো মাথা নেড়ে চলে গেলো। নুর সব গুলো গ্লাস ভেঙ্গেই ক্ষান্ত হয় নি। পুরো গাড়ি অচল করেই ক্ষান্ত হয়েছে।আশমিন দুই হাত ভাজ করে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর ক্রুর হেসে আশমিনের কাছে এসে দাড়ালো। ময়লা ঝাড়ার মতো হাত ঝেড়ে ফিচলে গলায় বলল,

— হিসাব বরাবর মন্ত্রী সাহেব। উইস ইউ আ ভেরি নাইস জার্নি টুনাইট।

চলবে,,,

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২১

সকাল থেকেই কামিনী চৌধুরী কে খুব খুশি খুশি লাগছে।নূর তীক্ষ্ণ চোখে সবকিছু অবলোকন করেছে।মায়া বেগম নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছেন। বিয়ের পর থেকে কিচেন সে সামলায়।এখন আর সেফের রান্না না খেয়ে সবাই তার হাতের রান্না ই খায়।তবে কামিনী চৌধুরীর খাবার সেফ রান্না করে।

আশমিন আজ সপ্তাহ খানেক হলো কানাডা গিয়েছে।কিছু জরুরি কাজে আটকে যাওয়ায় আরো কয়েকদিন থাকতে হবে। নূরের সাথে এই কয়েকদিন কথা হয়নি তার। কামিনী চৌধুরী নূর কে চার’শ কোটি টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে কাল।সেই সাথে আর এস কোম্পানির থেকে শেয়ারের একটা পোশাক কারখানা তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।পৈতৃক সুত্রে সে এই কারখানা পেয়েছে।আর এস কোম্পানি তে তার আর কোন শেয়ার নেই।কামিনী চৌধুরী দাতে দাত চেপে মেনে নিয়েছে সব।কোথায় চার হাজার কোটি টাকার ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি আর কোথায় পঞ্চাশ কোটি টাকার সামান্য একটা কারখানা।

আজ ছুটির দিন। শুক্রবার কেউ অফিসে যায় না।আমজাদ চৌধুরী নিজের রুমে রেস্ট নিচ্ছে।মায়া বেগমের রুমেই সে থাকে।কয়েকবার কামিনী চৌধুরীর কাছে যেতে চাইলেও কামিনী চৌধুরী তাকে রুমে ঢুকতে দেয়নি। মায়া বেগমের সাথে তার সম্পর্ক আগের মতোই আছে। কেউ কারোর সাথে খুব একটা কথা বলে না। আশমিনের সাথেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আমজাদ চৌধুরীর। চার বছর বয়স থেকে আশমিন হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে।কামিনী চৌধুরী ছোট বেলা থেকেই আশমিনের প্রতি ছিল উদাসীন। জীবনের বিশ টা বছর সে হোস্টেলেই কাটিয়েছে।তবুও আমজাদ চৌধুরীর সাথে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। আজ এতো কাছে থেকেও তাদের মধ্যে হাজার মাইলের দূরত্ব।

ড্রয়িং রুমে বসে অফিসের কিছু কাজ করছিল নূর।অমি কিছু হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে তাকে।আজ আশমিনের দেশে আসার কথা। সেদিন ই একইরকম দেখতে আরেকটা গাড়ি নিয়ে এসেছে আশমিন।

কলিং বেলের শব্দে কামিনী চৌধুরী একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন।মেড গুলো হা করে তাকিয়ে আছে কামিনী চৌধুরীর দিকে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টা কে দেখে কামিনী চৌধুরীর মুখ চকচক করে উঠলো। তাকে জরিয়ে ধরে কুমিরের কান্না কাদতে লাগলো। নূর চোখ মুখ কুচকে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। অমি নিস্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো কামিন চৌধুরীর দিকে। কামিনী চৌধুরীর কান্নার আওয়াজ শুনে আমজাদ চৌধুরী ও বেরিয়ে এসেছে তার রুম থেকে। কামিনী চৌধুরী কে শান্ত করে বুক থেকে সরাতেই কেপে উঠলো অমি।অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।এ জেন তারই প্রতিচ্ছবি। নূর একবার দেখে আবার নিজের কাজে মন দিলো। সেদিকে চোরা চোখে তাকালো অমি।নুরের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে অবাক হলেও কিছু বললো না। আমজাদ চৌধুরী একবার নূরের তাকিয়ে আবার শক্ত চোখে কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকালো। মনে মনে করুণা হলো তার সহধর্মিণীর জন্য। পদে পদে হেরে নিজেকে উন্মাদ করে চলেছে।এর পরিনতি অত্যন্ত ভয়ংকর।

ছেলেটা কে নিয়ে ভিতরে আসলো কামিনী চৌধুরী। ছেলেটা দেখতে অমির মত হলেও অমি থেকে তার গায়ের রঙ অনেকটা উজ্জ্বল।

কামিনী চৌধুরী শয়তানি হেসে নূরের বরাবর এসে বসলো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— সবার মনে অনেক প্রশ্ন তা আমি জানি।তার আগে পরিচয় করিয়ে দেই,এ হচ্ছে আশিয়ান শিকদার।শিকদার আম্পায়ারের একমাত্র উত্তরাধিকারী।রাফসান শিকদারের ছেলে।

আশিয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অমির দিকে।দেখতে তার মতো ছেলেটা কে বুঝতে বাকি নেই তার।কাউকে কিছু না বলে সে অমি কে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। অমি অবাক হলেও কিছু বললো না। কামিনী চৌধুরী মুখ কুচকে সেদিকে তাকিয়ে আছে। নূর এবার আয়েশ করে বসলো।
অমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আশিয়ানের থেকে।চোখের পানি লুকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

প্রায় বিশজন গার্ডসহ বাড়িতে ঢুকলো আশমিন। সারি সারি লাগেজ গুলো রেখে গার্ড গুলো নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লো। আশমিন ক্লান্ত গা এলিয়ে দিলো সোফায়।নূরের কাধে মাথা রেখে ন্যাকা গলায় বলল,

— আই মিসড ইউ বউ। তোমাকে ছাড়া থাকতেই পারছলাম না জানো?তাই তারাতাড়ি চলে এলাম।

নূর ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো। না এই লোকের অসহ্য কারবার শেষ হবে আর না নূর ভালো বউদের মতো সংসার করতে পারবে। আশমিন কে কিছু না বলে আশিয়ানের দিকে তাকালো নূর। সে আপাতত কামিনী চৌধুরীর পাশে বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে নূর আর আশমিনের দিকে। নূর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

— আপনার পরিচয়?

কামিনী চৌধুরী কর্কশ গলায় বলল,

— এই মেয়ে,একটু আগে কি বললাম শুনতে পাওনি?

— নাহ।আমি সবার কথায় কান দেই না।রাস্তার কুকুর ও ঘেউঘেউ করে।তাই বলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তার কোন মানে নেই।আমি আপনার সাথে কথা বলছি না মিসেস চৌধুরী।পরের বার আমার কথায় বাম হাত ঢুকানোর চেষ্টা করবেন না। আই ডোন্ট লাইক ইট।

কামিনী চৌধুরী কটমট করে তাকালো নূরের দিকে। আশিয়ান ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলে নূরের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,

— আমি আশিয়ান শিকদার। রাফসান শিকদারের ছেলে।

আশমিন নূরের কাধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আশিয়ানের দিকে।

নূর শান্ত চোখে তাকালো। উঠে গিয়ে রাফসান শিকদারের কাউচে বসে পায়ের উপর পা তুলে গম্ভীর গলায় বলল,

— প্রুফ?

আশিয়ান নড়েচড়ে বসলো।জোর গলায় বলল,

— ডিএনএ টেস্ট করিয়ে দেখতে পারো। কানাডায় আমার আম্মুর সাথে সম্পর্ক ছিল তোমার বাবার। সেখানেই আমার জন্ম। আমজাদ চৌধুরীর আর মামনি সাক্ষী আছেন।চাইলে জিজ্ঞেস করতে পারো নূর।

নূর ক্রুর হাসলো। আশমিন শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূর মলিন চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। আশমিন চোখ সরিয়ে নিলো। এ তো একদিন হওয়ার ই ছিল। নূর আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল,

— আমার বাবার এক রাতেই বেড পার্টনার ছিল আপনার মা।তার জন্য তাকে এক কোটি টাকা পেমেন্ট করা হয়েছে। আর আপনার মা আমার বাবার সুযোগ নিয়েছিল। তার বেহায়াপনার ফল হচ্ছেন আপনি। যাকে বলে অবৈধ সন্তান। কোন অবৈধ সন্তান কি করে রাফসান শিকদারের উত্তরাধিকারী হতে পারে? নিজের অবস্থান বুঝতে শিখুন মি. আশিয়ান।লোকে শুনলে হাসবে যে।

আশিয়ান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। এই মেয়ে কে দুই আঙ্গুলে পিষে দেলা তার দুই মিনিটের ব্যপার। নিজের হিংস্রতা এই মুহুর্তে বাইরে আনতে চাইছেনা সে।কামিনী চৌধুরী বাকা হাসলো। সে জানতো নূর এমন কিছুই করবে।আশিয়ান কে হালকা ভাবে নেয়া তাদের মোটেই উচিত হচ্ছে না। ডুবাইয়ের নামকরা মাফিয়া সে। শিকদারের এই অর্থ সম্পদ তার হাতের ধুলোর মতো। কিন্তু সে শিকদার দের মৃ*ত্যু চায়।তার মায়ের মৃ*ত্যুর বদলা নেয়ার জন্যই তার এখানে আসা।চাইলে এই মুহুর্তে সবাই কে মেরে ফেলতে পারে সে। কিন্তু এতো সহজ মৃত্যু এদের দিবেনা আশিয়ান।ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর যন্ত্রণা দিবে এদের।তার কাছে মৃত্যু খুব সামান্য শাস্তি।

— সত্যি টা জানানোর ছিল তাই জানালাম। অনেক তো আয়েশ করলে।এবার নাহয় বাবার জারজ সন্তানের সাথে হালকা মোকাবেলা হয়ে যাক।

আশমিন শব্দ করে হেসে উঠলো। আশিয়ান আর কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ক্রুর হেসে বললো,

— কেন নয় মি.মাফিয়া।আপনার অপেক্ষায় আমার চোখের নিচে কালি পরে গেলো। এতো অপেক্ষা তো আমি আমার বউয়ের জন্য ও করিনি। এসেছেন, কয়েকদিন ঘুরুন ফিরুন। যা হওয়ার তা নাহয় পরে হবে। দেখা গেলো আর সুযোগ ই পেলেন না বাংলাদেশ দেখার।কয়েকদিন রেস্ট নিন।এখন আপনি আসতে পারেন।আমার খুব প্রেম পেয়েছে।এই মুহুর্তে বউ দরকার। আমি আবার প্রেম চেপে রাখতে পারি না। আসো তো বউ।

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নূর কে টেনে উপরে নিয়ে গেলো আশমিন। অমি কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। আশিয়ান আয়েসি ভঙ্গিতে বসে বাকা হাসলো। ইন্টারেস্টিং কিছু হবে এবার।

আশমিন নূর কে নিজের রুমে এনেই দরজা বন্ধ করে দিল।নূর শয়তানি হেসে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই নূর অগ্রাসী ভাবে আদর করতে লাগলো আশমিন কে। আশমিন থমকে গেলো। মাথার মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেলো।ঠোঁটে হালকা ব্যথার আবির্ভাব হতেই দুই লাফে দূরে সরে গেলো।

— তুমি এভাবে একজন গণ্যমান্য মন্ত্রীর ইজ্জত লুটে নিতে পারো না! আমার এতো বড় সর্বনাশ করো না নূর। আমি জনগণের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। এখনো বউয়ের সাথে বাসর টা ও করা হয়নি।

নূর কটমট চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। আশমিন দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। নূর একটা বালিশ ছুড়ে মারলো আশমিনের দিকে। রাগী গলায় বলল,,

— এমন করলে আর বাসর করাও হবে না। এতো নাটক করেন কিভাবে?অসহ্য মানুষ একটা।

চলবে,,,