#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ৮
-“তুলি, তুই নাঈমের সাথে ওর শ্বশুরবাড়ি যা। ইতির মা বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে আয়।” মেয়েকে বলেন নাজমা বেগম।
-“তোমার মাথা খারাপ হইছে মা? আমি যাব? আমি? কিভাবে ভাবতে পারলে, যে আমার ভাইকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে আমি তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইবো? কক্ষনই না। এইসব উল্টাপাল্টা আবদার আমার কাছে করবা না মা।” উত্তর দেয় তুলি।
-“দেখ তুলি, আমিও চাইনা আমার মেয়ে কারো কাছে ছোট হোক। কিন্তু ইতি তোর ভাইকে তাবিজ করছে। সে বলছে তুই গিয়ে ক্ষমা না চাইলে সে ইতিকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠবে। সেটা তুই চাস? এখন তাও ভাইকে চোখের সামনে পাচ্ছিস কিন্তু যদি পুরোপুরি ডাইনিটার সাথে আলাদা বাসায় গিয়ে উঠে তাহলে জীবনে ভাইয়ের মুখ দেখতে পারবি? পারবি না। ভাইও হারাবি। তারচেয়ে তুই চুপচাপ গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আয়, ইতিকে নিয়ে আসুক বাসায়। চিন্তা করিস না, বাসায় খালি আসতে দে। নাঈম তো আর সারাদিন ওকে পাহারা দিবেনা। আমার মেয়েকে যতটা মানসিক কষ্ট দিচ্ছে তার কয়েকগুণ কষ্ট পেতে হবে ওকে। ইতি? ওর জীবনের সুখের ইতি যদি আমি না করছি তাহলে আমি তোর মা নই। এবারের মতো গিয়ে মাফ চেয়ে আয় মা।” মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন নাজমা বেগম।
-“আচ্ছা ঠিকাছে। কিন্তু তুমি যদি এর শোধ না তুল মা তাহলে দেখিও আমি কি করি।” রাগ করে বলে তুলি।
-“আচ্ছা তুই রেডি হ। আমি নাঈমকে গিয়ে বলি। মায়ের উপর ভরসা রাখ।” মেয়েকে এই কথা বলে ছেলের রুমের দিকে যান নাজমা বেগম।
-“নাঈম, বাবা উঠ। আমি তুলিকে বুঝাইছি। ও নিজের ভুল বুঝতে পারছে। তুই ওকে নিয়ে যা, আমার বউমাকে নিয়ে আয় বাবা। বাড়ির বউ দূরে থাকলে ভালো লাগেনা। নিয়ে আয় যা।” ছেলেকে ঘুম থেকে ডাকতে ডাকতে বলেন নাজমা বেগম। মায়ের কথা শুনে খুশি হয়ে উঠে ওয়াশরুমে যায় নাঈম। হাতমুখ ধুয়ে এসে নাশতা করে নেয়।
তুলি ওর রুম থেকে বের হয়ে এসে বলে -“ভাইয়া চল, ভাবিকে নিয়ে আসি। আমি সরিরে ভাইয়া। ভাবির প্রতি তোর ভালোবাসা বুঝতে পারিনি।” বোনের মুখে এই কথা শুনে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয় নাঈম।
-“আমি জানতাম আমার বোন ভুল বুঝতে পারবে। আমি অনেক খুশি হইছি রে সোনা। চল যাই। এইজন্যই তো তোকে এতো ভালোবাসি।” মা বোনের ষড়যন্ত্র ঘুনাক্ষরেও টের পায়না নাঈম।
কলিং বেল চাপ দিতেই দরজা খুলে দেয় ইতি। দেখেই ঘুরে ভিতরের দিকে যেতে লাগতেই তুলি পিছন থেকে ডাক দেয় -“ভাবি, আমাকে ক্ষমা করে দেয়া যায়না? আমিতো তোমার ছোটবোনের মতোই। না বুঝে ভুল করে ফেলেছি, ক্ষমা করে দাও প্লিজ।”
-“আমি ক্ষমা করার কে? তুমি গায়ের জোরে আমার বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছ। আমার মাকেও ধাক্কা দিয়েছ, তাদের পা ধরে ক্ষমা চাও। তারা যদি ক্ষমা করেন, করবেন।” বলে সরে দাঁড়ায় ইতি।
পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার কথা শুনে রাগ উঠে যায় তুলির শুধু ভাই সামনে তাই চুপ করে থাকে আর মনে মনে বলে “চল খালি আমাদের বাসায়। পা ধরা কাকে বলে শেখাবো।”
কথার আওয়াজ শুনে ইতির মা বাবা দেখতে আসেন কে এলো। তুলিকে দেখেই দুজনের মুখ কালো হয়ে যায়। দুজনের মনে একই প্রশ্ন “এই বেয়াদব এখানে কেন?”
উনাদের দেখে নাঈম সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে তুলিকে ঠেলে দেয় ক্ষমা চাইতে। ভাই আছে সেজন্য তুলি চুপচাপ ইতির বাবার পায়ের কাছে বসতেই উনি তুলিকে হাত ধরে তুলে দিয়ে বলেন -“থাক মা, পা ধরার দরকার নাই। ক্ষমা করে দিয়েছি তোমাকে। তুমিও তো আমার মেয়ের মতোই। তবে মা, একটা কথা বলি, রাগটা একটু কমাও। রাগ ধ্বং/সের কারণ। মেয়ে কি ছেলে কারোই মাত্রাছাড়া রাগ থাকা উচিৎ না। মানুষ যখন রেগে যায় তখন সে হয়ে যায় শয়-তানে-র গোলাম। এইজন্য রাগ উঠলে বারবার আউজুবিল্লাহ পড়তে হয়।”
উত্তরে তুলি -“জ্বি আংকেল জ্বি আংকেল” বললেও মনে মনে বলে “আসছে মহাজ্ঞানী মহাজন।”
নাঈম এবার ওর শ্বশুর কে বলে -“আমি তাহলে ইতিকে নিয়ে গেলাম। আজ অফিস ছুটি নিয়েছি।”
-“বাবা, মেয়ে স্বামীর ঘরে যাবে বাবামায়ের জন্য এর চেয়ে খুশির আর কিছু নাই। কিন্তু বাবা তুমি আজ আমার কাছে ওয়াদা কর আমার মেয়ের যেন আর কোন কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবা। একটাই মেয়ে আমার, বড় আদরের। কোনদিন একটা ফুলের টোকাও দেইনি। যে মেয়ে আমার ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা বলে সবসময়ই ঘরে খাবার মজুদ রাখি সেই মেয়ে আমার দিনের পর দিন ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করে না খেয়ে থাকছে। ইশ, কি কষ্টটাই না পাইছে আমার মেয়েটা।” বলেন ইতির বাবা।
লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখে উত্তর দেয় নাঈম -“আজ আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ইতির সব ব্যাপারে আমি নিজেই খেয়াল রাখব ইনশাআল্লাহ।”
বাবামায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ইতি নাঈমের সাথে রওনা দেয়। বাসায় পৌঁছে দেখে ওর ঘরের সবকিছু এলোমেলো। বুঝতে বাকি থাকেনা কার কাজ। অশান্তি এড়াতে চুপ করে থাকে ইতি। নাঈম সবাইকে ড্রইংরুমে ডাকে। সবাই এলে ও তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে -“মা, কাল থেকে আমি বাসায় না ফেরা পর্যন্ত ইতি তোমার আমানত হিসেবে থাকবে। খেয়াল রাখবা তুলি যেন অযথা ওর পিছনে না লাগে।”
ছেলের কথায় রেগে গেলেও মুখে কিছু বলেন না নাজমা বেগম। আয় করা ছেলেকে চটালে বিপদ। হাতছাড়া হয়ে যাবে, তারচেয়ে আস্তে ধীরে মাথা খাটাতে হবে। এতো বয়সের অভিজ্ঞতায় এটাই জেনেছেন রাগ করে কিছু হয়না, যা করার করতে হয় ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিনতে। মেয়ের অবুঝের মতো রাগ করার পরিণতি তো চোখের সামনেই। মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলেন -“তুই কিছু চিন্তা করিস না বাবা। আমিতো আছি। আমার দুই মেয়ে সেটা তো এক মাস থেকেই জানি।”
নাঈমের কথা শেষ হলে ইতি কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। যেহেতু স্কুলে যাওয়া হল না সেহেতু দুপুরের রান্না করা যাক। নাঈমও বাসায় আছে। কিচেন থেকে ঘুরে এসে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে -“কি রান্না করব দুপুরের জন্য?”
উত্তর দেয় নাঈম -“আজ দুপুরে কিছুই রান্না করতে হবে না। যেহেতু আজ আমরা সবাই ফ্রি আছি, চল সবাই মিলে একটা ডে ট্যুর দিয়ে আসি। সারিয়াকান্দি যাই চল। নদীর ওপারের চরে কাশফুল ফুটেছে। চল রেডি হও সবাই।”
নাজমা বেগম বলে উঠেন -“সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া, শুধু শুধু একগাদা টাকা খরচ। কি দরকার বাবা? একটা দিন সময় পাইছিস বাসায় রেস্ট নে।”
-“না মা, মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া শরীর মন সবটার জন্যই ভালো। আজ আমি ইতি দুজনেই ছুটি নিয়েছি। কাল থেকে তো আবারও শুরু হবে আমাদের দৌড়। তুলি যা রেডি হ। ইতি রেডি হও।” নাঈম বলে।
নাঈমের বাবা ইলিয়াস রহমান বরাবরই চুপচাপ মানুষ। ডাকাবুকো স্ত্রীর চাপে উনার মতামত দেয়ার ক্ষমতা অনেক আগেই হারিয়েছেন। এখন আয় করতে পারেন না, ছেলের উপর বসে বসে খান, এই কারণে আরো চুপচাপ হয়ে গেছেন। যে যা বলে সেটাই মেনে নেন। অন্যায় দেখলেও প্রতিবাদের সাহস পান না। তার উপর স্ত্রী কথায় কথায় বুঝিয়ে দেন উনি এই সংসারের বোঝা। ছেলের সাথে উনার সখ্যতা কম, মেয়ে তো তাকে মানেই না। ইতিই বিয়ের পর থেকে যতক্ষণ বাসায় থাকতো উনাকে বারবার চা বানিয়ে দিত, কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করত। কাল ইতি না ফেরায় উনি খুব মুষড়ে পরেছিলেন। সারারাত ছটফট করেছিলেন তার স্ত্রী আর কন্যার জন্য ছেলের জীবনটাও নষ্ট হচ্ছে ভেবে। শেষরাতের দিকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ছেলের আর ইতির সুখের জন্য দুয়া করেন। আজ ইতিকে ফিরতে দেখে খুশি হয়ে যান উনি। ছেলের আহ্বানে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রেডি হতে উঠতে নিতেই স্ত্রী হাঁকিয়ে উঠেন -“তুমি কই যাও?”
-“নাঈম সবাইকে রেডি হতে বলল না?” সবিস্ময়ে বললেন ইলিয়াস সাহেব।
-“তুমি গিয়ে কি করবা? সবাই গেলে বাসা পাহারা দিবে কে? তোমার যেতে হবে না।” ঝাঁঝিয়ে উঠেন নাজমা বেগম।
ইতি ওর রুমে যেতে যেতে কথাটা শুনে এগিয়ে আসে, শ্বশুরের হাত ধরে বলে -“চলেন বাবা আমরা বাপ বেটি আজ ম্যাচিং ড্রেস পরব। আপনার পাঞ্জাবি বের করে দেই।”
ইলিয়াস সাহেব একবার স্ত্রীর দিকে একবার বৌমার দিকে তাকাতে থাকেন। নাজমা বেগমের ক্রমাগত তাঁকে ধমকের উপর রাখা, অবজ্ঞা করা উনার আত্নবিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছে। ইতি জানে এখন নাঈমের সামনে ওর শাশুড়ী যতই রাগ করুক চিল্লাইতে পারবেনা বা এই টপিকে ইতি কথা শুনেনা এই ধরনের অভিযোগও করতে পারবেনা। শ্বশুড়ের হাত ধরে দৃঢ় পায়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় ইতি। পিছনে তাকালে দেখতে পেত নাজমা বেগমের দৃষ্টি থেকে জ্বলন্ত আগুন পড়ছে। কিন্তু ইতি এই বাড়িতে পা দেয়ার সময় নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে আর সে পিছনে ফিরে তাকাবেনা। এখানে তার নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে।
পারবে কি ইতি? দেখা যাক কি হয় সামনের পর্বে।
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ