ইতির সংসার পর্ব-২৩+২৪

0
267

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২৩

ইতিকে যখন ডাক্তার সাহেব ডেকে নিয়ে যান তখন নাঈম ছিল আধো ঘুমে আধো জাগরণে। হঠাৎ পুরোপুরি সজাগ হয়ে দেখে ইতি পাশে নাই, সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামতে যায় ইতিকে খুঁজতে যাবে সেজন্য। তুলি এগিয়ে এসে ভাইকে ধরতে লাগে তখন দুই ভাই বোন স্যালাইনের তারে জড়াজড়ি করে পড়ে যায়। সাথে সাথে নাঈমের হাতের ক্যানুলা ছুটে যায়, ফিনকি দিয়ে র/ক্ত বের হতে শুরু করে। তুলি ভয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়।

ইতি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে ভাবে নাঈম ঘুমাচ্ছে এই সুযোগে গিয়ে ওর মেডিসিন গুলো আনা যাক। সামনে আগাইতে যাবে এইসময় তুলির চিৎকার শুনে দৌড়ে কেবিনে এসে দেখে ভাইবোন জড়াজড়ি করে নিচে পড়ে আছে আর নাঈমের হাত দিয়ে গলগল করে র/ক্ত পড়ছে। এক চিৎকার দিয়ে নার্সকে ডেকে ইতি সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়।

নার্স এসে আগে নাঈমের হাতের র/ক্তপাত বন্ধ করে ব্যান্ডেজ করে দিতে যায় কিন্তু নাঈমের চিৎকারে পারেনা। একেতো অনেকক্ষণ ইতিকে না দেখে অস্থির হয়ে গেছিল তার উপর চোখের সামনে ইতিকে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে দেখে নাঈমকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়। হইচই শুনে তাড়াতাড়ি করে মুরাদের মা ছুটে আসেন, উনি ইতির মা কে সাথে নিয়ে ক্যানটিনে গেছিলেন চা খেতে। দুজনে মিলে তাড়াতাড়ি করে ওদের সামলে নেন। ইতিকে তুলে এটেন্ডডেন্ট বেডে শুইয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে ইতির মা। নার্স নাঈমের ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে ইতির প্রেসার চেক করতে যায়। এরমধ্যে ইতির জ্ঞান ফিরে এলে নাঈমকে খুঁজতে থাকে। ইতির মা সরে বসলে দেখা পায় নাঈমের, পাশের বেডে শুয়ে তাকিয়ে আছে ইতির দিকে। মুরাদের মা ওকে চেপে ধরে আছে বেডের সাথে নইলে তখনই ছুটে যায় ইতির কাছে এমন অবস্থা।

সেই সময় নাজমা বেগম ও ইলিয়াস সাহেব কেবিনে আসেন। দুজনেই ভিতরের অবস্থা দেখে অবাক। নাঈম যখন পড়ে যায় তুলিকে নিয়ে তখন স্যালাইনের স্ট্যান্ড লেগে তুলি হাতে ব্যাথা পায়। এতো দুজনের অবস্থা দেখে চুপ ছিল কিন্তু মায়ের দেখা পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কথায় তখন জানা যায় ওর হাতেও আঘা/ত লেগেছে। আবার নার্সকে ডাকলে সে তৎক্ষনাৎ পেইন কিলার ক্রীম লাগিয়ে দিয়ে যায়।

ইতি একটু ধাতস্থ হয়ে উঠতে গেলে সবাই ওকে উঠতে মানা করে। কিন্তু ও সবাইকে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। নাঈমের সাথে ওর কথা আছে জানায়। তখন মুরাদের মা সবাইকে ঠেলে নিয়ে বের হয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে যায়।

ইতি আস্তে আস্তে নাঈমের বেডে এসে বসে, ওর হাত ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে -“তোমার জন্য একটা খবর আছে। কিন্তু তুমি যদি সুস্থ না হও তাহলে কেমনে বলি বল?”

-“ইতি, আমি যেকোনো খবর শুনার আগে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি তোমার গায়ে হাত তুলে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও প্লিজ। তুমি ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।” নাঈম আকুল হয়ে ইতির কাছে ক্ষমা চায়।

হঠাৎ করে ইতি কেঁদে দেয়, নাঈমের কপালে চু/মু দিয়ে বলে -“এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম কিন্তু এরপর আর কখনো আমরা তোমাকে ক্ষমা করব না। কঠিন শা/স্তি দেব।”

-“হ্যাঁ তোমার আব্বু আম্মুর কাছেও ক্ষমা চাইব। উনারাও কষ্ট পেয়েছেন আমার আচরণে।” নাঈম বলে।

এবার নাঈমের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয় ইতি, নাঈমের নাক টেনে দিয়ে বলে -“আম্মু আব্বুর কাছে ক্ষমা তো চাইতেই হবে কারণ তুমি তাদের সন্তানকে কষ্ট দিয়েছ। তবে তুমিও খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারবে সন্তান কষ্ট পেলে বাপমায়ের কোথায় গিয়ে লাগে।” বলে নাঈমের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।

-“আমি আসলে বুঝতেছিনা তুমি কিসের কথা বলছ? আমি কিভাবে বুঝব? মানে? তুমি বলতে চাচ্ছ আমি মানে আমরা মানে আমাদের ঘরে নতুন কেউ আসতেছে? কি বল? কবে হল এই সুখবর?” অস্থির হয়ে যায় নাঈম।

ইতি আস্তে আস্তে বলে -“যখন তুমি আমাকে মারলে তখন আমি তোমাকে এই কথাই বলতে চাচ্ছিলাম। আম্মুর বাসায় যাওয়ার সময় বলতাম। কিন্তু তুমি তো তার আগেই…..”

ইতির মুখ চেপে ধরে নাঈম। -“আমি কত বড় অমা/নুষ যে যার ভিতরে আমার সন্তান বেড়ে উঠছে আমি তার গায়েই হাত তুলেছি। আল্লাহ ক্ষমা করে দিও আমাকে। ইতি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি আর কক্ষনও তোমার সাথে এভাবে রাগ করবনা। প্রমিজ।”

-“হ্যাঁ, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি, যদিও করা উচিৎ না। তবে হ্যাঁ ক্ষমা করলেও আমার গায়ে হাত তুলে যে অপরাধ তুমি করেছ তার শা/স্তি তোমাকে পেতেই হবে। অপেক্ষা কর পেয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমি দেবনা, তোমার সন্তান দিবে বড় হয়ে।” ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে ইতি।

বাবা হবার আনন্দে মশগুল নাঈমের চোখেই পড়েনা কথাগুলো বলার সময় ইতির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ দরজায় নকের শব্দে দুজনেই তাকায় দরজার দিকে। নার্স দাঁড়িয়ে আছে নাঈমের রিপোর্ট হাতে নিয়ে। ইতিকে সেগুলো দিয়ে বলে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করতে।

নাঈমকে বুঝিয়ে রেখে ইতি রিপোর্টগুলো নিয়ে যায় ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট দেখে হাসিমুখে বলেন -“একদম সুস্থ আপনার স্বামী। তার কোন শারীরিক সমস্যা নাই। কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকায় এমনটা হয়েছে। আমিও সেটাই ভাবছিলাম। উনি যদি সুস্থবোধ করেন তাহলে উনাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন কাল সকালে। তবে আমি সাজেস্ট করব ওকে নিয়ে যাওয়ার আগে যদি সম্ভব হয় আপনার শ্বশুর শাশুড়ি সহ আপনাদের নিয়ে বসতে। কিছু কথা বলা প্রয়োজন।” রিপোর্ট দেখে ডাক্তার সাহেব বলেন।

-“অবশ্যই ডাক্তার সাহেব। কখন বসতে চান বলুন। আমি সবাইকে জানিয়ে দেব।” বলে ইতি।

-“আমি ১১টার মধ্যে চলে আসি। তাহলে ১১টায়ই হোক। আর কেউ আসুক আর না আসুক আপনার শাশুড়ী আর ননদ যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকে।” বলেন ডাক্তার সাহেব।

অনেক কষ্টে নাজমা বেগমকে রাজি করিয়ে সবাই মিলে একসাথে এসেছে ডাক্তারের চেম্বারে। নাঈমকে বাসায় নিয়ে যাবে জন্য সবাই খুশি, আরো খুশি ওর খারাপ কিছু হয়নি জন্য, তার চেয়েও বেশি খুশি নাঈমের ঘরে নতুন মেহমান আসছে জন্য। শাশুড়িকে ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার রাজি করানোর জন্য শেষে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে হয় ইতিকে।

ইতি, নাঈম, নাজমা বেগম, ইলিয়াস সাহেব, তুলি, ওর শাশুড়ি ও ইতির বাবা-মা এলে ডাক্তার সাহেব বলতে শুরু করেন -“নাঈমের রিপোর্ট দেখলাম। আলহামদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত ভালো। ও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল স্ট্রেস ও প্যানিক এটাকে। আমি সবার সাথে কথা বলে যা বুঝলাম তাতে নাঈমের মা আর তুলি নাঈমকে খুব মানসিক চাপে রাখে। জানিনা উনাদের কি উদ্দেশ্য তবে এমন চাপ অব্যাহত থাকলে সেইদিন দূরে না যেদিন নাঈম স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে থাকবে অথবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এসাই/লামে থাকবে। কোনটা আপনারা চান নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। দেখুন কথাগুলো আমার হয়তো বলা মানায়না কিন্তু আমি চাই আমার রোগীরা যেন অসুস্থ হয়ে আবারও আমার কাছে ফিরে না আসুক। নাঈমের অসুস্থতার উৎস শুধুমাত্র মানসিক টানাপোড়েন। শারীরিক ভাবে সে সম্পুর্ন ফিট একজন ছেলে। এই বয়সী ছেলেদের যেমন হয়। দেখুন মিসেস ইলিয়াস স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে জান্নাতে। বাকি সমস্ত সম্পর্ক এসেছে বিবি হাওয়া ও হযরত আদম (আ:) দুনিয়ায় আসার পর। যে সম্পর্কটাকে আল্লাহপাক জান্নাতে সৃষ্টি করেছেন সেই সম্পর্কটাকে আমরা বরাবর তাচ্ছিল্য করে যাই। কেন? স্বামী যদি স্ত্রীর ভালোমন্দ দেখে তাহলে সে ভাড়ুয়া বা ভেড়া আবার স্ত্রী যদি স্বামীকে বেশি কেয়ার করে তাহলে সেটা হয় পজেসিভনেস। কেন এমন হবে? আমি আপনাকে শুধু বলছিনা, ম্যাক্সিমাম রোগী আসে বিয়ের পরের মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে। একটা সুস্থসবল ছেলে বিয়ের পরে স্ত্রীকে নিজের মতো করে পেতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা না বিয়ের পর থেকেই একটা ছেলেকে দেখতে হয় কখন মা গাল ফুলালো আর কখন স্ত্রী।

এমন তো না যে আপনাদের দুজনের কেউ নাঈমকে কম ভালোবাসে। মিসেস ইলিয়াস যদি ছেলেকে জন্ম দেন তাহলে মিসেস নাঈম জন্ম দিয়েছেন একজন স্বামীকে। মিসেস ইলিয়াসের ভালোবাসা দেয়ার তিনজন মানুষ, মিস্টার ইলিয়াস আর দুই ছেলেমেয়ে কিন্তু মিসেস নাঈমের তো শুধুই নাঈম তাইনা? তাহলে কেন আপনি ওদের হিংসা করেন বা একসাথে দেখলে রেগে যান বলবেন কি মিসেস ইলিয়াস? পরের বাড়ির একটা মেয়ে আমার ছেলেকে ভালোবাসার জন্য নিজের সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে এটা দেখলেই তো মেয়েটাকে মাথায় তুলে রাখতে ইচ্ছে করে। আমার দুই মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলে বিয়ে দিয়েছি। এখন আমার তিন মেয়ে আলহামদুলিল্লাহ। যা কিনি বা যাই করি ৩ মেয়ের জন্য সমান। বৌমা এখন মায়ের বাড়িই যেতে চায়না। আর আমার স্ত্রী তো বৌমাকে এমন ভাবে রাখে যেন মাথায় রাখলে উকুনে খাবে আর মাটিতে রাখলে পিঁপড়ে খাবে। বৌমার মুখ ভার দেখলে এখনো ছেলেকে ধরে পি/টায় আমার স্ত্রী। আমি আর ছেলে কামাই করি, সে আর তিন কন্যা মিলে মনের সুখে উড়ায়। কখনো ভুলেও বৌমার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলেনা আমার স্ত্রী, ওর যুক্তি আমারও মেয়ে আছে, আমি পরের মেয়েকে আনন্দে রাখলে আল্লাহ আমার মেয়েদের আনন্দে রাখবেন। একটা পরের মেয়েকে ঘরে এনে এভাবেই আপন করে রাখতে হয়।” বলেন ডাক্তার সাহেব।

-“হইছে থামেন, অতো লেকচার দেয়া লাগবে না। এখানে কেন ডাকছেন সেটাই বলেন।” স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বাঁধা দেন নাজমা বেগম।

ডাক্তার সাহেব শান্তকন্ঠে বলেন -“তাহলে শুনুন কেন ডাকছি।”

জানতে চান কেন ডেকেছেন?
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২৪

সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ডাক্তার সাহেব বলেন -“আমার মতে মিসেস ইলিয়াস আর তুলির কাউন্সেলিং প্রয়োজন। রিলেশনশিপ কাউন্সিলর অথবা ফ্যামিলি কাউন্সিলরের কাছে কিছুদিন অন্তত কাউন্সেলিং করতে হবে। তাহলে উনারা বুঝবেন উনাদের এসব আচরণ কতটা যুক্তিযুক্ত। একজন ডাক্তার হিসেবে আমার এটাই মনে হয়। এবার আসি নাঈমের ব্যাপারে। সে সম্পুর্ণ সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ। তার যা সমস্যা ছিল সেটা তার মা ও বোনের ক্রমাগত মানসিক চাপে হয়েছে। নাঈমের সুস্থ থাকার জন্যই উনাদের কাউন্সেলিং করা জরুরি। এবার আসি একটা সুখবরে। মূলত এটা বলার জন্যই সবাইকে একত্রিত করা। আশাকরি এই সুখবরে নাঈম পুরোই সুস্থ হয়ে যাবে কোন মেডিসিন ছাড়াই। কি বল ইতি তাইনা?” বলে ইতির দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন -“এখন কিন্তু ইতির আরো বেশি যত্নের প্রয়োজন নাঈম। তোমাকেও আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ তুমি এখন শুধু কারো সন্তান নও, সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছ।”

একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠেন ইতির বাবা-মা, মুরাদের মা ও ইলিয়াস সাহেব। উঠে গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। -“বাবারে আমার। কত্তযে খুশি হইছি বুঝাতে পারবোনা। তোকে বিয়ে দেয়ার পর থেকে স্বপ্ন দেখতেছিলাম আমি দাদা হইছি। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। মা ইতি, তুমি আমার মায়ের আরেক রূপ। আজ এই বুড়ো ছেলেকে তুমি যে খুশি দিয়েছ আমি মন থেকে দুয়া করি তোমার সন্তানেরা যেন তোমাকে সবসময়ই মাথায় করে রাখে।” বলতে বলতে আবেগে কেঁদে উঠেন তিনি।

ইতির বাবা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন -“এইতো সেদিন তোকে কাপড়ে পেঁচিয়ে এনে আমার কোলে দিল আর আজ তুই আমাকে নানা হবার খবর দিলি মা। আল্লাহ তোকে ও তোর সন্তানকে নেক হায়াত দিক। সবধরনের বালামুসিবত থেকে দূরে রাখুক। আমিন।”

সবাই একসাথে বলে উঠে আমিন। ইতির এই সুখবরে সবাই খুশি শুধু তুলি আর ওর মায়ের মুখে হাসি নাই। ইতি সেটা খেয়াল করে কিন্তু কিছু বলেনা। এরা দুজন খুশি হবে সেটা সে আশাও করেনি। কেমন মানুষ এরা? অনেককেই দেখেছে ভাবি ননদে দা কুমড়ো সম্পর্ক কিন্তু ফুপি হিসেবে বেস্ট, দাদী হবার খুশিতে অনেকে ছেলের বউয়ের সাথে ভালো ব্যবহারও করে। অথচ এরা জানি কেমন।

নাঈম আর ইতিকে নিয়ে সবাই বাসায় ফিরে আসে। মুরাদের মা খাদিজা বেগম উনার বাসা থেকে খাবার রান্না করিয়ে এনেছেন দুপুরের জন্য। তাই আর তুলির বাবা-মাকে উনি যেতে দেন না। দুপুরে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করে উঠলে উনি ইতি আর নাঈমকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে তুলিকে বাসন মাজাসহ খাওয়ার পরে যা যা করতে হয় সব সেরে উনাদের জন্য চা বানাতে বলে দুই বেয়াইকে ড্রইংরুম ছেড়ে দিয়ে দুই বেয়ান নিয়ে নাজমা বেগমের রুমে গিয়ে বসেন। খাদিজা বেগমের উপস্থিতিতে নাজমা বেগম না পারছেন ইতির মাকে তাচ্ছিল্য করতে না পারছেন ইতিকে খাটাতে।

এদিকে নাঈম ঘরে ঢুকেই ইতিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে -“আমার সত্যিই এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা আমি বাবা হব। আমার একান্ত আপন আরেকজন দুনিয়ায় আসবে। বল তুমি আমার কাছে কি চাও? এই মুহুর্তে যেটাই চাইবে আমি তোমাকে দেব কথা দিলাম। তুমি শুধু বল কি চাও ইতুমনি।”

নাঈমের বুকে মুখ লুকিয়ে ইতি বলে -“আমি শুধু চাই তোমাকে সবসময়ই খুশি রাখতে, ভালো রাখতে। তুমি ভালো থাকলে, তুমি বেঁচে থাকলে আমার সব পাওয়া হবে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবনা সত্যি।” বলে হুহু করে কেঁদে উঠে ইতি।

নাঈম ওর চোখ মুছিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে -“পাগলি আমি তো আছিই। যতক্ষণ তুমি আমার সাথে আছ আমিও বেঁচে আছি। তুমি আমাকে ছেড়ে গেলেই আমি মারা যাব সত্যি। এখন রেস্ট নাও। নইলে আমার বাবু বলবে বাবা পঁচা। মাকে খালি কষ্ট দেয়।”

কেটে যায় ৩ মাস। ইতি ফিরে আসায় তুলিকেও সাথে নিয়ে যান খাদিজা বেগম। তুলির সাথে নাজমা বেগমের প্রতিদিন ফোনে কথা হলেও খাদিজা বেগম ওকে বাপের বাড়ি আসতে দেয়না। জানেই যে সে গেলেই ইতির সাথে অশান্তি করবে। যদিও উনার সাথেও কম অশান্তি করছেনা তা না।

ইতির ৩ মাসের সময় একদিন ওর মা আসেন ইতিকে নিয়ে যেতে। গর্ভবতী মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চান। নাঈম প্রথমে আপত্তি করলেও নিজের মায়ের আচরণ আর ইতির যত্নের কথা ভেবে যেতে দিতে রাজি হয়। কথা হয় ডেলিভারি পর্যন্ত ইতি মায়ের বাড়িই থাকবে, নাঈম যাওয়াআসা করবে। যেহেতু কয়েকমাসের জন্য যেতে হবে সেহেতু কিছু প্রস্তুতির ব্যাপার আছে সেজন্য ইতি পরদিন যেতে চায়। ওর মাও বুঝে রাজি হয়। ইতি কয়েকমাসের জন্য যাচ্ছে তাই নাজমা বেগম খাদিজা বেগমকে বলে কয়ে তুলিকে ক’দিনের জন্য আনান।

পরদিন ইতি স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিল তাই দেরিতে ঘুম থেকে উঠে, ইদানীং মর্নিং সিকনেস বেড়ে গেছে ওর। ঘুম থেকে উঠে দেখে ওয়াশরুমে পানি নাই। কি হয়েছে জানতে রুম থেকে বের হয়ে শুনে পানির মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। ততক্ষণে নাঈম অফিসে চলে গেছে, ইলিয়াস সাহেব তখন বাজারে। এদিকে ঘুম থেকে উঠে তলপেটে চাপ, পানি নাই, বিশ্রী অবস্থা। নাজমা বেগমের ওয়াশরুমে সারাবছর পানি মজুদ করা থাকে কিন্তু এখন ইতির প্রয়োজনে উনি দিবেন না। তাই বাধ্য হয়ে ইতি যায় উঠোনের অপরপ্রান্তে প্রায় পরিত্যক্ত টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে। টিউবওয়েলের চারপাশটা ছোট ছোট আধলা ইট দিয়ে রাখা। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে টিউবওয়েলটা অনেক শক্ত হয়ে গেছে। ইতি ছোট এক বালতি পানি তুলে নিয়ে ঘুরে আসতে নিতেই হঠাৎ পায়ের নিচের ইটটা একপাশে দেবে যায় আর সে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় বালতির উপরেই। সাথে সাথে এক চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

কতক্ষণ সেভাবে পড়ে ছিল কেউ জানেনা। ইলিয়াস সাহেব বাজার থেকে ফিরে ইতি মামনি বলে ডাকতে ডাকতে বাসায় ঢুকেন। উনি ইতির প্রিয় কিছু খাবার এনেছেন বাজার থেকে। ইতির রুমের দরজায় কড়া নাড়েন কিছুক্ষণ। সাড়া না পেয়ে ভাবেন ঘুম থেকে উঠেনি। কিচেনে খাবার রেখে হাতমুখ ধুতে গিয়ে দেখেন পানি নাই। টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধোয়ার উদ্দেশ্যে কলপাড়ে গিয়ে দেখেন ইতি বেকায়দা ভাবে অজ্ঞান পড়ে আছে আর ওর শরীরের নিচের দিক র/ক্তে ভেসে যাচ্ছে।

সাথে সাথে চিৎকার করে স্ত্রী কন্যাকে ডাকেন উনি, কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। এম্বুলেন্সে কল দিয়ে আসতে বলে নাঈমকে কল দিয়ে জানান। এরমধ্যে উনি চেষ্টা করেন ইতিকে কোলে করে ঘরে আনার। কিন্তু উনার বার্ধক্য আর ইতির অজ্ঞানজনিত ওজনবৃদ্ধির জন্য পেরে উঠেন না। পাগলের মতো দৌড়ে স্ত্রীর ঘরে গিয়ে দেখেন নাজমা বেগম নাই আর তুলি কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে আর তালে তালে নাচছে। এক ধাক্কা দেন তিনি মেয়েকে। তখন তুলি কান থেকে হেডফোন খুলে জানতে চায় কি হয়েছে?

ইলিয়াস সাহেব তুলিকে নিয়ে ধরাধরি করে ইতিকে বারান্দায় এনে শুইয়ে দিতেই এম্বুলেন্স চলে আসে। এরমধ্যে অনেকবার চেষ্টা করেছেন ইতির জ্ঞান ফেরাতে, পারেন নাই। ভয়ে বারবার শুধু ইতির পালস পরীক্ষা করছেন আর আল্লাহকে ডাকছেন।

এতোকিছু হয়ে গেল নাজমা বেগমের কোন খোঁজ নাই। ফোন দিয়ে দেখা যায় ফোন বাসায় ফেলে উনি গেছেন পাড়া বেড়াতে। এম্বুলেন্সের আওয়াজে গলির এক বাসা থেকে বের হয়ে দেখেন এম্বুলেন্স এটেন্ডেন্ট স্ট্রেচার নিয়ে উনার বাসার দিকেই যাচ্ছেন। হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ঢুকে দেখেন ইতি বারান্দায় শুয়ে, তার পাশে বসে নি:শব্দে কেঁদে যাচ্ছেন ইলিয়াস সাহেব, ইতির শরীরের নিচের দিক র/ক্তে ভেসে যাচ্ছে।

এম্বুলেন্স এসে ইতিকে নিয়ে যায়, সাথে যান ইলিয়াস দম্পতি। ক্লিনিকে পৌঁছে দেখেন নাঈম ও ইতির মা-বাবা মাত্র এসে পৌঁছেছে। নাঈম পৌঁছেই আগে কেবিন ঠিক করে। এম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে ইতিকে নিয়ে যাওয়া হয় ইমার্জেন্সিতে। ডাক্তার প্রাথমিক ভাবে দেখে ওটিতে দেয়ার নির্দেশ দেন। তার আগে একটা হোল এবডোমেন আলট্রাসনোগ্রাম করাতে বলেন।

শরীর থেকে প্রচুর র/ক্ত পড়ে যাওয়ায় খুবই দুর্বল হয়ে যায় ইতি। জ্ঞান ফিরে আসলেও খুব দুর্বল। আমার বাচ্চা বলে তলপেটে হাত দিয়ে কাপড় থেকে হাতে র/ক্ত লাগতে দেখে আবারও অজ্ঞান হয়ে যায়।

প্রচুর ব্লাডডোনার যোগাড় করতে বলে ইতিকে নিয়ে ওটিতে যায় ডাক্তার। জরুরিভাবে আগে র/ক্ত বন্ধ করতে চেষ্টা করেন। এদিকে নাঈম সবাইকে ফোন দিয়ে ও পজিটিভ র/ক্তের কেউ আছে কি না খোঁজ নিতে থাকে। ফেসবুকে বড় বড় র/ক্তের গ্রুপগুলোতে পোস্ট দেয় ডোনার চেয়ে।

দুজন ডোনার এগিয়ে আসে। দ্রুত তাদের র/ক্ত নিয়ে স্ক্যানিং করে ওটিতে পাঠানো হয়। ওটির বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। খাদিজা বেগম খবর পেয়ে এসেই তুলিকে সপাটে এক চ/ড় লাগান। সবাই অবাক হয়ে যায় শান্ত খাদিজা বেগমের এই আচরণে। উনি তুলিকে জিজ্ঞেস করতে থাকেন -“কি করেছ তুমি স্বীকার কর তুলি। এতোদিন ইতির কিছু হলনা আর তুমি গেলে সাথে সাথে এতোবড় দুর্ঘটনা? কি করেছ স্বীকার কর এক্ষুনি।”

গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তুলি বলে -“আমি কি করছি? যা কিছু হয় খালি আমারই দোষ?”

-“হ্যাঁ তোমার দোষ হবেই। তুমি কাকে ফোনে বলেছ যে আমি আসি আগে তারপর সব ঠিক করে দেব, আমাকে চিনেনা। কাকে বলেছ বল? নিশ্চয়ই মা মেয়ে পরামর্শ করছিলে। আমি পাশে থেকে সব শুনেছি। এতো শয়/তানি কেন তোমাদের মনে? ছিহ।” আরো কিছু বলতেন খাদিজা বেগম কিন্তু নার্স ওটি থেকে বের হয়ে নাঈমকে খুঁজে দেখে চুপ হয়ে যান। নার্স কি বলতে চায় নাঈমকে?

চলবে