#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৭
মধ্যরাত, আদিল স্ত্রী বাচ্চার কথা বেমালুম হয়ে কাগজ ও কলম নিয়ে ডুবে আছে। এই অভ্যাসটা বাড়িতে এসে হয়েছে। দুনিয়ার সব কাজ সে একাই করে এমনভাব। সাগরিকা ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে স্বামীর কাছে আসলো। আদিলের মতিগতি বুঝার উপায় নেই। সাগরিকাকে দেখতে পেয়ে আদিল কাগজ কলম রেখে উঠে দাঁড়ালো। সাগরিকা মুচকি হেসে বলতে শুরু করল,” ভয় পেলে বুঝি?”
আদিল চোখ থেকে চশমা খুলে উত্তর দিল,” আমি মনে করি, প্রতিটা ছেলের কাছে মেয়ে মানুষ হলো বাঘিনী। আর বাঘিনী যদি স্ত্রী হয় তাহলে সব পুরুষরাই, ভীতুর রাজা।”
সাগরিকা হাসলো। আদিলকে একসাথে চা পান করার অফার করল। আদিল স্ত্রীর আবদারের কাছে নত শালিক। একাসাথে চা পান করতে করতে নিজেদের সময় দিতে থাকলো।
——————–
সময় খুব দ্রুতই আগাতে শুরু করল। শুভর যাওয়ার সময় এগিয়ে আসলো। বাকী দিনগুলো পরিবারকে সময় দিল। শুভ ও ফুলের বিয়ের ব্যপারটা নিয়ে কেউ কথা বলল না। দুজনের মতামতই সবার মতামত হলো। শুভর চলে যাওয়ার আগেরদিন ছোটোখাটো একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। যেখানে নব দম্পতি নাফিস ও আরিফাকে দাওয়াত করা হলো। প্রেরণা সংঘের দুইজন কর্মকর্তাকেও দাওয়াত দেয়া হলো। তারা হলো তৃণা ও নীরবকে।
শুভর চলে যাওয়া নিয়ে অন্যকারো মাথা ব্যথা না থাকলেও নাফিসের মন ক্ষুণ্ণ হলো। ফুলকে রেখে শুভর চলে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারছে না। নাফিসের ধারণা, দূরে থাকলে ভালোবাসা কমে যায়। ফুল ও শুভর সম্পর্কের শেষ পরিণতি সুখের হবে না বলে শংকা হলো কিন্তু কিছু বলল না।
শুভ সকালেই চলে গেল। ফুল একটুও কাঁদলো না। ফুলের শাশুড়ি ছেলেকে ধরে খুব কাঁদলেন। সাগরিকা মজার ছলে তখন বলল,” এতো কান্নাকাটি না করে ছেলের সাথে চলে যাও। এল ছেলে যাচ্ছে আমরা তো আছি! এতো বছর আমরা তোমার পাশে থেকে মেয়ে হতে পারলাম না।”
ফুলের শাশুড়ি চোখ মুছে বলেন,” তোরা শান্তিমতো কান্না করতে দিবি না। এই চোখ মুছলাম। আর কাঁদবো না।”
শুভ যাওয়ার আগে ফুলকে সকলের সামনে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,” তোমার জন্য আমাদের ঘরে একটি সারপ্রাইজ আছে। চলে গেলে দেখে নিও।”
শুভ হাসলো। পিয়ালকে কোলে তুলে বলল,” আমার বড়ো আব্বু, তোমার সাথে একমাসের কোনো স্মৃতিই নিয়ে যেতে পারলাম না। কথা দিচ্ছি , চাচ্চু ফিরে আসলে অনেক খেলবো।”
পিয়াল চাচকে জড়িয়ে ধরলো। আদিল শুভর সাথে শহরে যাবে। শুভকে ঠিকঠাক মতো পৌঁছে দিয়ে মেডিকেলের কাগজপত্র ঠিকঠাক করে আসবে।
শুভ চলে গেলো ফুলকে একা করে। শুভর শাশুড়ির বুক হাহাকার করছে। মনে হচ্ছে, ছেলে যতোদিন বাড়ি ছিল, যত্নাদিই করতে পারেনি।
ফুল ঘরে আসলো। শুভর বলা আমাদের ঘর হলো, শুভর ঘর। ফুল এই ঘরেই বিগত একমাস থেকেছে। ফুল বিছানার উপর কৃত্রিম বানানো শিউলি ফুলের মালা দেখতে পেলো। ফুল মালা একপাশে রেখে চিঠি খুঁজলো। বিছানায় বসে চিঠি পড়া শুরু করল,
প্রিয় সুন্দর নারী,
তোমাকে কী নামে ডাকি? ফুল বলি? নাকি আমার হৃদয়ের অব্যক্ত কাব্য? প্রতিটি নামেই যেন তুমি। তবু, আজ চিঠি লেখার শুরুতেই তোমার সেই মুখখানা মনে পড়েলো। চিঠি লেখার সম তুমি আমার আশেপাশে আছো কিন্তু চিঠি পড়ার সময় আমি খুবই দূরে থাকবো। কি এক যন্ত্রণা বলো!
তুমি আমার সূর্যমুখী ফুল, যেখানে ভোরের শিশির মিশে থাকে সূর্যের আলোয়। তোমাকে কাছে পাওয়ার এই এক মাস যেন আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে।
তোমার হাত ধরে যখন প্রথমবার পথ চলেছিলাম, মনে হয়েছিল, যেন সময় থেমে গেছে। সেই বিকেলগুলো, যখন আমরা একসঙ্গে বসেছিলাম—তোমার মায়াবী চোখে আমার স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি দেখতাম। তোমার হাসির শব্দ যেন বাতাসে ভেসে থাকা কোনো সুর, যা এখনোও আমার কানে বাজছে অথচ কিছুক্ষণ পর আমরা খুব দূরে!
তোমার ভালোবাসার গভীরতা আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে জীবনকে আরও সুন্দর করে দেখা যায়। তোমার প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি কথা, প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। তুমি যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
কিন্তু এই এক মাসের স্মৃতির পর, একটি বছরের অপেক্ষার বাস্তবতা সামনে দাঁড়িয়ে। ভাবছি, এই এক বছর কেমন হবে? কেমন করে প্রতিটি দিন পার করব তোমাকে ছাড়া? তবু, জানি, আমাদের ভালোবাসা অপেক্ষার পরীক্ষায় টিকে থাকবে। কারণ তুমি আমার হৃদয়ের সেই ফুল, যার গন্ধ আমাকে দূর থেকেও পূর্ণ রাখে।
তোমাকে কথা দিচ্ছি, এই এক বছর শুধু তোমার মুখের হাসি আর আমাদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করব। আমি ফিরব, আবার তোমার হাত ধরব। সেদিন যেন আরও নতুন স্বপ্ন বুনব আমরা।
একটি বছর আমরা চিঠি লেখব। চিঠিতে চিঠিতে ভালবাসবো। চিঠিতে মনের অনুভূতি ব্যক্ত করব। বলো, আমায় চিঠি লেখবে না?
তুমি ভালো থেকো, ফুল! মায়ের খেয়াল রেখো। তোমার মায়ায়, তোমার ভালোবাসায়, আর তোমার প্রার্থনায় আমাকে শক্তি দিও।
ইতি,
ফুলের সুখীবর শুভ।
ফুল চিঠি পেয়ে খুব কাঁদলো। বিগত একমাস শুভ ফুলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আজ থেকে ফুলকে একা থাকতে হবে। একা বিছানায় ঘুমাতে হবে। একাকী কথা বলতে হবে।
———————
নাফিস ফুলকে পেল শুভ চলে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর। ফুলই নাফিসের বাড়ি আসলো আরিফাকে দেখার জন্য।
ফুলকে পেয়েই নাফিস জিজ্ঞাসা করল।ফুল বিষয়টা জানার পর হেসে উড়িয়ে দিল। শুভর উপর পরিপূর্ণ আস্থা আছে বলেই ফুল এক বছর সময় দূরে থাকতে রাজি হয়েছে। নাফিস কিছু বলল না। তবে আহত হলো।
সময় এভাবেই চলতে থাকলো। সপ্তাহে দুইবার ফুলের শ্বশুর বাড়িতে ডাকপিয়ন আসতে শুরু করল। আবার ফুলেরও সপ্তাহে দুইবার ডাকঘরে যেতে হতো।
একবার তো শুভর চিঠি আসতে বড্ড দেরী হলো।ফুলের তখন সে কী রাগ! রাগে একটা চিঠি লেখল,
প্রিয় ভুলে যাওয়া প্রিয়জন,
দেশের মাটিতে ফুলকে রেখে কীভাবে সুখে আছেন? আপনার কী মন পুড়ে না? ফুলের মন তো পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আজ অনেক অভিমানের সঙ্গে তোমাকে এই চিঠি লিখছি। জানি না তুমি এই চিঠি পড়বে কি না, কিংবা পড়লেও কোনো উত্তর দেবে কি না। তবু মনের ভার কিছুটা হালকা করার জন্য লিখছি।
এই দুই সপ্তাহে কতবার ভেবেছি, তুমি নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছো, কাজে ডুবে আছো। তবু, এই মনের এক কোণে কেমন জানি একটা প্রশ্ন জেগে উঠেছে—তোমার কি মনে পড়ে আমি আছি? আমার কথা ভাবো কি?
তোমার লেখা চিঠিগুলো আমার দিনের সবচেয়ে আনন্দের সময় হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি শব্দে তোমার উপস্থিতি অনুভব করতাম, তোমার প্রতিটি বাক্যে যেন আমার একাকীত্ব ভেঙে যেত। আর এখন সেই চিঠির অপেক্ষা করতে করতে দিন কাটছে, রাত পেরোচ্ছে।
তুমি কি জানো, অভিমানটা কেমন অনুভূতি? না জানলে আজ বলি—এটা ভালোবাসার আরেকটা রূপ। কারণ যাকে সত্যি ভালোবাসি, তার কাছ থেকেই তো কিছু না কিছু আশা করি। আর সেই আশা পূরণ না হলে অভিমান হয়।
তোমার চিঠি লেখার সময় পাওয়া না-হোক, কিন্তু একবার কি মনে হয়নি, দূরে থেকেও আমি তোমার পাশে আছি? তোমার প্রতিটি কাজের সঙ্গী হতে না পারলেও, তোমার চিন্তার অংশ হতে চাই।
জানি না, এই অভিমান মুছে দিয়ে তুমি আবার আমাকে তোমার কোনো চিঠির অক্ষরে কাছে আসার সুযোগ দেবে কি না। তবে যত দিন তোমার নাম মনে করতে পারব, তত দিন চিঠি লিখব। আর অপেক্ষা করব, যদি কোনো দিন ভুলে যাওয়া প্রিয়জন আমার এই চিঠি পড়তে বসে।
ইতি,
তোমার সুখফুল
—————–
সুখ, দুখ ও অভিমানে কেটে গেল আট মাস। আর কয়েকমাস পর শুভর ইন্টার্নিশিপ শেষ হয়ে যাবে।এরমধ্যেই নাসিফ সুখবর দিল। আরিফা গর্ভবতী। ফুলের খুশির অন্ত রইলো না। সে খুশিতে ডগমগ হয়ে আরিফার জন্য উপর কিনলো। সংগঠন থেকেও কিছু উপহার নিলো। রিকশা দিয়ে নাফিসের বাড়ি যাওয়ার সময় শাহিন পথ আটকে দাঁড়ালো। আজ সে একা আসেনি। দলবল নিয়ে এসেছে। ফুল রিকশা থামাতে বলল। রিকশা থেকে নেমে শাহিনের দিকে এগিয়ে আসলো।শাহিন তখন দলবলদের উদ্দেশে বলল,” তোরা তৈরি তো?”
চলবে…….
#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৮
আজ শাহিনকে ভয় পাচ্ছে না ফুল। জীবনের এই সময়ে এসে মনে হচ্ছে, ভয়কে জয় করতে পারলেই বিজয়ী হওয়া যায়। ফুলের মুখশ্রীতে ভোলাভালা আভাসটা নেই আছে অদম্য উত্তাপ। সম্মুখে দাঁড়ানো শাহিনকে ভয় পাচ্ছে না সে কিন্তু একাকীও তো কিছুই করতে পারবে না। মুঠোফোন বের করে আদিলকে কল করল কিন্তু কথা বলল না। ফোন পুনরায় ব্যাগে ঢুকিয়ে আদিলকে কলে রেখেই ফুল রিকশা থেকে নেমে আসলো। দূরে নয় একদম শাহিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পিছনের ছেলেদের উপর কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেরা নড়েচড়ে বসলো। বয়সে তারা ফুলের থেকে অনেক ছোট। ফুলের চোখজোড়ায় আক্রোশ দেখতে পেলো। ফুল শাহিনের উদ্দেশে বলতে শুরু করল,“ একটা সময় দুর্বল ছিলাম তখন আপজন পিষতে পেরেছে। এখন আমি দুর্বল নই, আমি আমার রাজ্যের একমাত্র যোদ্ধা। সব নিয়ম ভেঙে ময়দানে আসুন, আমি তৈরী আছি। দেখি কে আমাকে টক্কর দিতে চান!”
শাহিন মোটরযানে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিল। ফুলের কথা শেষ হতেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ফুলের মাথা থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত দেখো বলল,” আমি টক্কর দিতে চাই, তবে শত্রু হিসাবে না। মনের রাণী করার জন্য। বাঁধা দিলে একদম তুলে নিয়ে যাব। আপনাকে আমর খুব ভালো লাগে। বিয়ে করতে চাই।”
ফুল বিরক্ত হলো না, ভয়ও পেল না। শাহিনের চোখে চোখ রেখে বলল,” বয়সে আপনার থেকে অনেক ছোট হতে পারি কিন্তু বউ হওয়ার উপযুক্ত নই। আমার বিয়ে আরো পাঁচ বছর আগে হয়ে গেছে।”
” আমার তাতে সমস্যা নাই। আমার সাথে চলো মেয়ে! রাণী করে রাখবো।”
ফুল বুঝলো, সুন্দর ভাষায় এরা বুঝবে না। এদের বুঝাতে হবে তাদের ভাষা। ফুল শাহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। শাহিন বুঝলো, ফুল হয়তো পটে গিয়েছে। পুরুষরা যতোই শক্তিশালী হোক না কেনো বুদ্ধির দিক দিয়ে মেয়েরাই এগিয়ে তা আবারো প্রমাণ হলো। ফুল হেসে ক্ষান্ত হয়নি হাত ব্যাগ খুলে গিফটগুলো রাখলো। শাহিন নড়েচড়ে দাঁড়ালো। উচ্ছাসের সাথে বলল,” এতো তাড়াতাড়ি তুমি মেনে নিবে ভাবতেও পারিনি।”
তারপর ছেলেদের উদ্দেশে বলল,” তোদের ভাবীকে পাওয়ার জন্য, আজ তোদের আমার পক্ষ থেকে কাচ্চিবিরিয়ানির পার্টি দিব। ছেলেপেলেদের নিয়ে আসিস।”
ছেলেদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সকলেই একজন অপরজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। ফুল এই সুযোগে ব্যাগ থেকে কেরোসিনের ছোট্ট শিশি বের করলো। সরাসরি শাহিনের মুখ বরাবর নিক্ষেপ করে গ্যাস লাইট জ্বালিয়ে ধরলো। এতো নিখুঁত ও সুনিপুণভাবে ফুল কাজটা করলো যেনো এই কাজে সে ট্রফি জিতেছে। ফুল হেসে বলল,” সংগঠন চালাই। মেয়েদেরকে সেখানে নিজেকে রক্ষা করার ট্রেনিং শেখানো হয়। প্রতিষ্ঠাতা হয়েছি, শত্রু তো থাকবেই! আপনাদের মতো কুলাঙ্গার বখাটেদের শায়েস্তা করার জন্য ব্যাগে কেরোসিন নিয়ে ঘুরেফিরি। এক কদম পা বাড়ালে আগুল জ্বালিয়ে দিব।”
শাহিন নিজের শক্তি খাটাতে আসতে চাইলো, ফুল তখনই শাহিনের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। পিছনের ছেলেরা ভাই ভাই করে শাহিনের মাথায় বালি দিতে থাকলো। ওরাও বেশ ভয় পেয়েছে। সামান্য টাকা ও একবেলা বিরিয়ানির লোভে মোটরবাইক নিয়ে এসব নেতাদের পিছনে ঘুরে বেড়ায়। জানের মায়া তো অবশ্যই আছে। এরা ফুলের সাথে লাগতে আসলো না। শাহিনের মাথার চুল অনেকখানি পুড়ে গেছে। শাহিন মাথায় হাত রেখে মা** বলে এগিয়ে আসছিলো। তখনই আদিল এসে উপস্থিত হয়। ফুলের সাহসিকতায় গর্ব হয়। আদিলকে দেখে ফুল বলল,” তুমি না আসলেও হতো, ভাইয়া। আমি এদের শায়েস্তা করে নিতাম।”
” কোথায় যাচ্ছিলে?”
আদিল বলল। তার কণ্ঠের নিগুঢ় প্রশ্নে ফুল উত্তর দিল,” নাফিসদের বাড়ি।”
আকিল বলল,” যাও, সন্ধ্যার আগে ফিরে এসো।আমি এদের দেখছি।”
ফুল বাচ্চাদের মতো গ্যাস লাইট জ্বালিয়ে নিভিয়ে খেলতে খেলতে প্রস্থান নিলো। এদিকে শাহিনের অবস্থা তখন করুণ। আদিলকে ভয় পায় সে। কারণও আছে। স্কুলের গণ্ডি পর্যন্ত এগিয়েছিল শাহিন। আদিল ছিল তাদের সিনিয়র। একবার সিনিয়র আপুদের ডিস্টার্ব করার জন্য যা মা’র দিয়েছিল তা আজও ভুলেনি। আদিল শার্টের হাতা উপর করলো। শাহিনের উদ্দেশে বলল,” তুই আর ভালো হলি না, শাহিন্না।”
তারপর! তারপর আর কি? শাহিনের আপ্যায়ন আদিলই করতে থাকলো। শাহিন ও বাবা ও মা বলে আদিলের আপ্যায়ন সানন্দে গ্রহণ করতে থাকলো। আর শাহিনের ছেলেপেলেরা! তারা সেই কখন পালিয়ে গেল! শাহিন ছেলেদের দিকে তাকিয়ে দুঃখী হয়ে বলল,” শা’লা সব কটা হা’রা’ম’জা’দা।”
——————
কোনো এক গোধূলি লগ্নে ফুল বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। দিনের একটি অংশে শুভকে নিয়ে ভাবতে বেশ পছন্দ করে ফুল। আজকে ফুল ভাবলো, প্রকৃতির সাথে মিশে শুভকে নিয়ে ভাববে। ভাবনা অনুযায়ী পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। ফরিদ তখন খামার থেকে বের হচ্ছিল। ফুলকে দেখে এগিয়ে এলো। মুখভরে সালাম জানিয়ে বলল,” ভাবী, কেমন আছেন? কোথায় যান?”
ফুল হাসলো। ফরিদের সাথে তার তেমন কথা হয় না। আসার পর থেকে এক কি দুইবার কথা হয়েছে। ফুল জানালো, ” ভালো আছি। এমনিতেই হাঁটছিলাম। কিছু বলবে?”
” একটা কথা বলতাম। ভয় পাচ্ছি, যদি রাগ করেন?”
ফুল হেসে বলল,” রাগ করব না। তুমি নির্ভয়ে বলতে পারো।”
” ভাইজান যে তিনটা চিঠি পাঠাইছিল, সবগুলোই কী পড়ছিলেন?”
ফুল মনে করার চেষ্টা করল, ঠিক কোন চিঠিগুলোর কথা বলছে ফরিদ। ফুলের মুখাবয়বে চিন্তার আভাস পেয়ে ফরিদ বলতে শুরু করলো,” শহরে থাকতে আপনার চিঠির উত্তরে তিনটা চিঠি এসেছিল।সেই চিঠিগুলোর কথা বলছি।”
ফুলের মনে পড়লো সেই চিঠিগুলোর কথা। ফুল জানালো, ” দুইটা পড়িনি। কেনো, সেই চিঠিতে কি আছে?”
ফরিদ আহত সুরে উত্তর দিল,” সেই চিঠি পড়লে আপনাদের মাঝকার দূরত্ব কবেই ঘুচে যেতো।”
ফুল বুঝলো, চিঠির মধ্যে কিছু তো একটা আছে। ফুল পালটা প্রশ্ন করল,” খামের উপর তো শুভর হাতের লেখা ছিল না। তবে সেই চিঠি কে পাঠিয়েছিল?”
ফরিদ উত্তর দিল,” খামের উপরের লেখা দেখলেন কিন্তু ভেতরের লেখা দেখলেন না? খামের উপর আমার বন্ধুর হাতের লেখা ছিল। ভেতরের চিঠি ভাইজানের ছিল।”
ফুলের চোখজোড়া বড়ো হয়ে আসলো। সে হন্তদন্ত পায়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। কাউকে কিছু না বলে নিজের ঘরে প্রবেশ করে ড্রয়ার থেকে সেই চিঠিদুটো বের করে পড়তে শুরু করল।
ফুলের চোখজোড়া দিয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝড়ছে।চারটা বছর সে একা কষ্টে থাকেনি।শুভও তার মতো কষ্টে ছিল। ফুল চিঠি দুটোতে অসংখ্যবার চুমু খেলো। অপেক্ষা করতে থাকলো শুভর বাড়ি ফেরার।
———————-
শুভর ফিরে আসার একমাস বাকী তখন। একদিন ফুল,বকশি কাকার সাহায্যে বাড়ির বাহিরে অর্থাৎ নেমপ্লেটের সাথে একটা চিঠিরবাক্স লাগালো। নিজের হাতেই চিঠির বাক্স সাজালো। শুভর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে ভেবে মুচকি হাসতে থাকলো।
ফুল নিজেদের ফ্ল্যাটে দুই ঘরের মাঝ বরাবর আরেকটি চিঠির বাক্স লাগালো। সুন্দরভাবে সাজিয়ে ঘরে গিয়ে চিঠি লেখতে বসলে,
পত্রবর,
আজ একটু সময় পেয়েই তোমার জন্য লিখতে বসলাম। জানো, বাড়ির সবাইকে নিয়ে কত মজায় দিন কাটছে। মা সবসময় যেনো ঠিক আমার মনের কথা বুঝে ফেলেন—তিনিই আমার জন্য সকালে লেবুর চা বানিয়ে আনেন। বলেন, “ফুল, তোমার গলায় একটু শীত শীত ভাব দেখলাম, এটা খাও। ভালো লাগবে।”
আদিল ভাইয়া তো বড্ড খেপাটে, কাল আবার আমার রান্নায় লবণ কম পড়েছে বলে কেমন অভিনয় করলেন! বললেন,!” স্বামীর শোকে নাকি আমি দিনে তারা গুনি তাই খাবারে লবন কম দিয়ে ফেলি। সাগরিকা ভাবী হাসতে হাসতে চোখের পানি ফেলে দিলেন। সত্যি, এদের সবাইকে নিয়ে একটা ছোট পরিবার মনে হয়। পিয়াল আজকাল বড্ড পেকে গেছে। আমাকে বলে কী? চাচীমা তুমি দেখতে খুব সুন্দর। আমি এতো লজ্জা পেলাম!
কিন্তু জানো শুভ, এতো কিছুর মধ্যেও তোমার জায়গাটা একেবারেই খালি খালি লাগে। যখন ভাবী আর আমি সন্ধ্যায় ছাদে গিয়ে বসি, তখন মনে হয় তুমি থাকলে গল্পটা আরেকটু মজার হতো। তোমার হাসি আর কথার জাদু এখানে কতটা প্রয়োজন, সেটা যে কীভাবে বলি! তোমায় বড্ড মিস করছি।
হ্যাঁ, একটা নতুন কাজ করেছি। বাড়ির বাহিরের দেয়ালে একটা চিঠিরবাক্স বসিয়েছি। ভাবছি, তুমিও তো চিঠি লিখে রাখতে পারো সেখানে! আর আমাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে একটা ছোট্ট চিঠিরবাক্স রেখেছি। ভাবছি, এটা দিয়ে আমরা নিজেরা চিঠি আদান-প্রদান করব। তুমি বাইরে চিঠি রাখবে, আমি ঘরের বাক্সে। তারপর সন্ধ্যাগুলোতে চিঠি পড়ার মজা নিতে পারব। কেমন লাগবে ভাবো তো!
তবে শর্ত আছে। আসার সময় আমার জন্য একটা সুন্দর চিঠি লিখে আনবে। চিঠিটা অবশ্যই বাইরে চিঠিরবাক্সে রেখে আসবে। আমি তা নিজের হাতে তুলে নেব।
শেষে বলি, তোমার ফুলের মন যে কতখানি তোমার কাছে পড়ে থাকে, তা বোঝানোর জন্য আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি? তোমায় ভালোবাসি। আরেকটু তাড়াতাড়ি ফেরো, প্লিজ।
ইতি,
তোমার সুখফুল।
———–
একমাস পর,
শুভর ফেরার দিন। ব্যাগ পোটলা নিয়ে শুভ বাড়ির সামনে এসে হাজির হলো। আগের থেকে স্বাস্থ্য বেড়েছে। হয়তো বয়সের ব্যবধানে শারীরিক গঠন পরিবর্তন হয়েছে। গাঠনিক পরিবর্তন হলেও শুভর মনে ফুলের জন্য ভালোবাসা একটুও কমেনি। সে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির নেমপ্লেটের সাথে সত্যি সত্যিই একটা চিঠির বাক্স দেখতে পেল। শুভ মুচকি হেসে পকেট থেকে চিঠির খাম বের করে তাতে চিঠি রাখলো।
আদিল ভাইকে আনতে শহরে গিয়েছিল। শুভকে চিঠি রাখতে দেখে বলল,” নিজেদের ক্যারিয়ার গঠন করতে গিয়ে দুজনই কষ্ট পেলি। ফুলকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে দূরে রাখিস না।”
শুভ তাদের ফ্ল্যাটের বারান্দার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,” প্রশ্নই আসে না। আমি ফুলকে এমনভাবে তৈরি করেছি, আমি না থাকলেও যেনো সে ভেঙে মুচড়ে না পড়ে। এখন আমরা প্রতিষ্ঠিত, দূরে থাকবো না। সবসময় কাছাকাছি থাকবো।”
আদিল কিছু বলল না। সত্যিই এই ফুলকে আদিল চেনে না। শাহিনকে শায়েস্তা করার পদ্ধতি দেখে আদিল অবাক হয়েছিল। মেয়েটার পরিবর্তন চোখে লাগার মতো।
শুভর চোখজোড়া এখনো বারান্দার দিকে নিবদ্ধ। আদিল সেই কখন ব্যাগ পোটলা নিয়ে ভেতরে চলে গেছে। শুভর দৃষ্টি আটকে রইলো বারান্দায় পর্দার আড়ালের মানবীয় ছায়ার উপর। শুভকে নড়তে না দেখে ছায়া মানবী নিজেই একপর্যায়ে সরে গেল। শুভ মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করলো।
সুইটি খানম প্রতিবারের মতোই ছেলেকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলেন। সাগরিকাকে বলে কয়ে খাবার পানীয়র ব্যবস্থা করতে বললেন। শুভ এদিকসেদিক তাকিয়ে ফুলকে খুঁজে চলছে। সাগরিকার ছোট ভইয়ের মতো দেবরকে দেখে ঠাট্টা-তামাশা শুরু করল,” বউয়ের খোঁজ করছো? সে তো বাসায় নেই। বর আসবে শুনেও চলে গেল। এমন বউ কোথাওই দেখিনি বাপু! বর আসবে অথচ মহারাণী কাজে ব্যস্ত। না করেছিলাম শুভ, বউকে মাথায় তুলো না। এবার ঠেলা বুঝো।”
সাগরিকার রসিকতার প্রত্ত্যুত্তরে শুভ বলল,” বউকে মাথায় তুলিনি, ভাবি। মনের কোণে জায়গা দিয়েছি। এতো সহজে আমার থেকে দূরে যাবে না।”
সাগরিকা হাসতে থাকলো। এরমধ্যে আদিল পিয়ালকে নিয়ে আসলো। চাচুকে দেখে দৌড়ে আসলো পিয়াল। হাত বাড়িয়ে কোলে উঠতে চাইলো। শুভ ভাইয়ের ছেলেকে কোলে তুলে গালে চুমু দিয়ে বলল,” আমার ছোট বাবাটা কেমন আছে?”
পিয়াল উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,” তুমি দেখি ছোট চাচীর মতো আদর করো। ছোট চাচীও আমাকে এভাবে আদর করে।”
শুভ সহ উপস্থিত সকলেই হেসে উঠলো। শুভ পিয়ালকে কোলে তুলে সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।
——————
ফুল জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দেখছিল, শুভ বাইরের চিঠির বাক্সে কিছু রেখে ঘরে ঢুকছে। স্বামীকে এভাবে চিঠি রাখতে দেখে ফুলের মনের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি হল। লজ্জা আর সংকোচে তার গাল লাল হয়ে গেল। শুভ বাড়িতে ঢুকে পিয়ালকে কোলে নিয়ে খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ফুল নিচে নামল না।
সে জানালার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়েই শুভর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। শুভ ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই নিশ্বাস আটকে আসলো ফুলের। সে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখলো। শুভ দেখল, পর্দার আড়ালে তার ফুলবউকে। সে মুচকি হাসলো। শুভ, ফুলের উপস্থিতি টের পেলেও কিছু বলল না, যেন অপেক্ষা করছিল কখন ফুল নিজে থেকে তার কাছে আসবে। কিছুক্ষণ পর শুভ পিয়ালকে কোলে নিয়ে পর্দার দিকে এগোলো।
ফুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার ভেতর কোথাও যেন সংকোচ আর দ্বিধা আটকে রেখেছে তাকে। শুভ একটু থেমে পিয়ালকে মেঝেতে বসিয়ে দিয়ে ফুলের পর্দার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, “ফুলবউ, আমাকে দেখতে দিবে না?”
শুভর কণ্ঠে ছিল মৃদু অনুরোধের সুর। ফুল কিছু বলল না। শুভ হাসল। শুভ বুঝলো, ফুলের লুকোচুরির ব্যপারটা। শুভ উপভোগ করতে চাইলো এই সময়টুকু। সে পর্দার আড়ালে থেকেই ফুলের মুখাবয়বের উপর হাত ছুঁয়ে দিতে চায়। ফুল সরে দাঁড়ায়। ধীর স্বরে বলে, “ এতদিন পর দেখার জন্য একটা উপহার চাই। দিবে তো?”
শুভ কপালে ভাঁজ ফেলে একটু রাগ দেখিয়ে বলল, “উপহার আবার কী?”
ফুল একটু কাছে এগিয়ে বলল, “ কপালে একটা চুমু। অনেকদিন হলো তোমার মুখ দেখা হয়নি, তোমার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলা হয়নি। দিবে না?”
ফুল তার কথায় আরো লজ্জা পেয়ে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, “ তোমার ইচ্ছে না হলে! আচ্ছা থাক।”
শুভ আর কথা না বাড়িয়ে পর্দার আচ্ছাদনের উপর ফুলের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। তারপর পর্দা সরিয়ে দিল। ফুলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুভর চোখে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল। সে বলল, “তুমি এখনো আগের মতোই সুন্দর, জানো ফুলবউ?”
শুভর কথা শেষ হতেই ফুল সংকোচে মুখ ফিরিয়ে বলল, “এই সব কথা না বললেই নয়?”
শুভ একটু হেসে তার কপালের কাছে ঝুঁকল। ফুল মাথা নুইয়ে রাখলো। শুভ, ফুলের মাথায় উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে বলল, “আমার স্ত্রী এত লাজুক কেন? আমার মনে হয়, তুমি ইচ্ছে করেই আমাকে দেখতে দিচ্ছো না, যাতে আমি বারবার তোমাকে দেখতে চাওয়ার জিদ ধরি।”
ফুল এবার হাসি থামাতে পারল না। হেসে বলল, “তোমার কথাগুলো সবসময়ই অতিরঞ্জিত। কিন্তু তুমি আস্তো….!
“আমি কী?”
শুভ প্রশ্ন করল। ফুল শুভর চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল,
“ তুমি আমার অতি আপনজন।”
শুভ হাসল। ফুলকে নিজের সাথে মিশিয়ে বলল,” আমার প্রিয়তমা, তোমার ভালোবাসাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
পিয়াল চলে গিয়েছিল। কোথায় থেকে দৌড়ে এসে দুজনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় ডাকল, “ ছোট চাচু, ছোট মায়ের সাথে আর কত কথা বলবা? এবার আমার সঙ্গে একটু খেলো না!”
ফুল পিয়ালের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “চলো আব্বু আমরা একসঙ্গে খেলব।”
শুভ ফুলের লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখশ্রী দেখলো। লজ্জায় মেয়েটা শুভর দিকে তাকাচ্ছে না। শুভ, ফুলের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল, “তুমি জানো, ফুল! আমি তোমার এই লাজুক স্বভাবটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। আর কিছু না হোক, তোমাকে এভাবেই দেখতে আমার দিনটা সুন্দর হয়ে যায়।”
ফুল কিছু বলল না। শুভ তার হাত ধরে নিচে নিয়ে গেল, পিয়ালের সঙ্গে নিচে নেমে আবার মেতে উঠল খেলায়। আর ফুল একমনে শুভকে দেখে ভাবতে লাগল, এই মানুষটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।
চলবে……….