#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৯
শুভ ফিরে আসার পরপরই ফুল ও তাদের ছোট পরিবার নিয়ে একদিনের ভ্রমণের পরিকল্পনা করলো। জায়গাটা ছিল শহর থেকে বেশ দূরে, পাহাড়ি পথ আর নদীর ধারে এক সবুজ পরিবেশ। ভোরবেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো তারা। ফুলের মুখে আনন্দের ঝিলিক। শুভ ড্রাইভ করছিল, আর ফুল জানালা দিয়ে প্রকৃতির মুগ্ধতা উপভোগ করছিল। হাওয়ার ঝাপটা তার চুলে খেলা করছিল।
চারদিকে শীতের হালকা কুয়াশা, পাখির কিচিরমিচির আর ঝরনার কলকল ধ্বনি। নদীর তীরে ছোট ছোট নৌকা বাঁধা। পথের পাশে গাছের ছায়ায় বসে ছিল স্থানীয় মানুষজন। শুভ গাড়ি থামায় একটি খোলা জায়গায়। ফুল নেমে নদীর কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পানি ছুঁয়ে দেখে।
নদীর পাড় জুড়ে যেন এক টুকরো স্বর্গ নেমে এসেছে। সূর্যের প্রথম রশ্মি নদীর জলে পড়ে ঝিকিমিকি করছে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা চারপাশ ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হচ্ছে। বালুর ধারে ছোট ছোট ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু সূর্যের আলোয় মুক্তার মতো ঝলমল করছে।
নদীর পাশে সারি সারি বাঁশ আর তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। পাখিরা ডালে বসে মিষ্টি সুরে গান গাইছে। বাতাসে যেন মাটির গন্ধ মিশে আছে। সাগরিকা পানি দেখেই উচ্ছাস বেড়ে গেল। পিয়ালকে নিয়েই নদীর ধারে চলে আসলো। নদীর চিকচিক পানিতে হাত পা ডুবিয়ে দিলো। পিয়াল তার ছোট ছোট হাতজোড়া দিয়ে পাড়ে শামুক কুড়িয়ে নিতে থাকলো। যেনো এটাই তার কাজ, এই কাজেই আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে।
জলধারার কলকল শব্দ। মাঝে মাঝে সেই সুরকে ছাপিয়ে যায় পাড়ে বসা পাখির ডাক। পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শাপলা ফুলের ঝোপে একটা মাছরাঙা হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়ে আবার উড়ে যায়। দূরে দেখা যায় নৌকা বাইছে এক জেলে। তার গলায় বাঁধা একটা ঝুড়ি, আর নৌকার পাটাতনে পড়ে আছে কিছু সদ্য ধরা মাছ।
সুইটি খানম সঙ্গে কিছু খাবার নিয়ে এসেছিল। খোলা মাঠে বসে সকালের নাস্তা করতে করতে গল্প শুরু হয় তাদের। শুভ আর ফুল দুজনেই হাসিতে মেতে ওঠে। সাগরিকা তার গম্ভীর স্বামীকে আড়ালে জ্বালাতে থাকলো। কখনো পায়ে সুড়সুড়ি দিতে থাকলো তো কখনো সকলের আড়ালে গাল টিপে দিলো। সাগরিকার কাজে আদিল বিরক্ত হলো না বরং হেসে ফেলল। চারপাশে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য যেন তাদের মনের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল। ফুলের চোখজোড়ায় আনন্দের সীমা রইলো না। ফুল উচ্ছসিত হয়ে শুভকে বলল, “তুমি জানো শুভ, প্রকৃতির মাঝে এভাবে সময় কাটানোর আনন্দটাই আলাদা। মনে হয় জীবনের সব চাপ ভুলে গেছি।”
শুভ মৃদু হেসে বলল, “তোমার হাসিটাই তো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য।”
তাদের কথায় গভীর ভালোবাসা ও উষ্ণতা মিশে ছিল। শুভ ভাবতে থাকলো আর কীভাবে তার ফুলবউয়ের মুখে হাসি ফোটানো যায়।
বিকেলের নরম রোদ নদীর জলে পড়ে যেন সোনালি ঝিলমিল তৈরি করে। নদীর পানির ঢেউগুলো তখন ধীরে ধীরে চলতে থাকে, মনে হয় যেন রোদের আলোয় সেগুলো খেলা করছে। পাড়ের ঘাস আর ছোট ছোট গাছগুলো বাতাসে দুলছে, তাদের ছায়া এসে পড়ছে পানির ওপর।
দূরে গবাদি পশু চরছে, তাদের সঙ্গে স্থানীয় শিশুদের হইচই কানে আসে। মাঝেমধ্যে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে উঠে আসছে বড় কোনো মাছ, আর পাড়ে বসে থাকা বকগুলো সুযোগ খুঁজছে শিকার করার।
নদীর পাড়ের রাস্তায় বিকেলের দিকে মানুষের আনাগোনা বাড়ে। কেউ আসে হাঁটতে, কেউবা ছোট্ট নৌকায় চেপে নদী পার হতে। জেলেরা দিনের শেষ জাল তুলে নৌকায় মাছ ভরছে। একপাশে কিছু কিশোর ফুটবল খেলায় ব্যস্ত, তাদের চিৎকারে পরিবেশ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। শুভ ফুলের হাত ধরে হাঁটছে। অদূরেই সুইটি খানম নাতিকে শামুক কুড়িয়ে দিচ্ছে। সাগরিকা আদিলকে দিয়ে নিজের ছবি তোলাচ্ছে। সুখী পরিবারে আর কীসের প্রয়োজন পড়ে?
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছে এলে রঙের খেলা শুরু হয়। আকাশ ধীরে ধীরে কমলা, গোলাপি আর বেগুনি রঙে মিশে যায়। সেই রঙ নদীর জলে প্রতিফলিত হয়ে পুরো দৃশ্যটাকে এক অনন্য সৌন্দর্য দেয়। সূর্যের শেষ কিরণ নদীর ওপর পড়লে মনে হয় যেন কোনো শিল্পী তার তুলিতে আঁকছেন প্রাকৃতিক এক চিত্রকর্ম। পাড়ে বসা চায়ের দোকান থেকে ভাঁজ করা চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে। সেই সঙ্গে ভেসে আসে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে শালিকের ডাকে মিষ্টি সুর। শুভ দুইকাে চা এনে ফুলের হাতে ধরিয়ে দিলো। তাদের দুষ্ট মিষ্টি মুহূর্তের কথা বলতে লাগলো।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে নদীর পাড়ের রূপ যেন আরো গভীর হয়। সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে চারদিক লালচে কমলা রঙে ভরে যায়। নদীর জলে সেই রঙের প্রতিফলন দেখে মনে হয় যেন পুরো নদী আগুনের মতো জ্বলছে।
পাড়ের মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটছে গরুর গাড়ি। বাতাসে ভেসে আসছে দূরের গ্রামের মাটির চুলোর ধোঁয়া। ধীরে ধীরে অন্ধকার নামছে, আর নদীর ওপারে ঝোপের মধ্যে জোনাকির আলো জ্বলে উঠেছে।
নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুভ ও ফুল একটু দূরে একটি ময়লা কাপড়ে ঢাকা মানুষকে দেখতে পেলো। সে মাটি চষে কিছু খুঁজছিল। ফুল প্রথমে তাকে খেয়াল করলেও পাত্তা দেয়নি। শুভ ভাবলো জীর্ণশীর্ণ মানুষটাকে সাহায্য করা যায়। সে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে মহিলাটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” চাচী, এই টাকাটা রাখুন। কিছু কিনে খেয়ে নিবেন।”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মহিলাটি ফিরে তাকালো। শুভ তখন অবাক হলো। ফুলকে ডেকে বলল, “ফুল, ওই মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে না?”
ফুল ভালো করে তাকায়। তার চেহারা ক্লান্ত, মলিন। মাথার চুলগুলো এলোমেলো, পোশাক ময়লা, ভাঙা স্যান্ডেল তার পায়ে। ফুলের মনে হলো এই মুখ কোথাও দেখেছে। একটু এগিয়ে যেতেই ফুলের গলার স্বর যেন আটকে গেল। তার মনে কোনো সাড়া জাগছিল না। কিন্তু যখন সেই মানুষটি ফুলের দিকে এগিয়ে এসে তার পায়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে, তখন ফুল ধীরে ধীরে মনািষটি কে, বুঝতে পারে। ফুল চমকে ওঠে। শুভর হাত ধরে চলে যেতে নেয়। মানুষটি আবারও ফুলের পায়ে পড়ে আহাজারি করতে শুরু করে,” আমারে মাফ কইরা দে, মা। তোর সাথে খুব অন্যায় করছি। আমার পাপ আমারে শেষ কইরা দিছে। আমি যা করেছি তার জন্য আমায় শাস্তি পাইতাছি। তুই আমার জীবনে একমাত্র আশীর্বাদ ছিলি। আমি বুঝতে পারিনাই তখন।”
ফুল কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। লিপির কথাগুলো তাকে তার পুরোনো দিনের কষ্টের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। সেই ভয়ানক রাতগুলো, সেই অমানুষিক অত্যাচার—সব যেন একসঙ্গে ফিরে আসে। ফুলের চোখে ক্রোধ জ্বলে উঠল। লিপি, যে তাদের জীবনের সুখ কেড়ে নিয়েছিল, যার জন্য তাদের সম্পর্কের মাঝেও ঝড় উঠেছিল। লিপি, যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠেছিল।
লিপি কেঁপে কেঁপে উঠে দাঁড়াল। তার চোখে এক ধরনের অনুশোচনা, আর মুখে একটি দীনতাপূর্ণ ভঙ্গি। সে বলে উঠল, “শুভ, ফুল, তোমগোর সামনে মুখ দেখানোর সাহস আমার নাই। কিন্তু আমি… আমি শুধু ক্ষমা চাইতে চাই।”
শুভ তার কাঁধে হাত রেখে তাকে সামলানোর চেষ্টা করে। ফুলের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ফুল নিজেকে সামলে নিলো। শুভ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকার পর শান্ত গলায় বলল, ” অতীতের সব ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া যদি আপনার জন্য শান্তি আনতে পারে, তাহলে আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম। আপনার জন্যই আমি ফুলকে পেয়েছিলাম। কিন্তু মনে রেখবেন, আপনি যা করেছেন, তার ক্ষত আমরা সারাজীবন বয়ে বেড়াব।”
ফুল হঠাৎই কঠোর কণ্ঠে বলে উঠল, “না শুভ, আমি ওনাকে ক্ষমা করতে পারব না। যে নিজের স্বার্থের জন্য এত নিচে নামতে পারে, তার জন্য আমার মনে কোনো জায়গা নেই। আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে এই নারী। আমি ওনাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না।”
লিপি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। সে বলল, “আমি জানি, ফুল। আমি জানি। আমার জন্যই তোর জীবনে এত অন্ধকার নাইমা এসেছে। আমার শাস্তি আমি পাইতাছি। তিন বছর জেলে কাটাইছি। এখন আমি রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। স্বামীর বাড়ি নাই। বাবার বাড়িতে ঠাঁই পাইনাই। আমি অভিশপ্ত মানুষ হাইয়া গেছি। তবু আমি চাই, তোমরা জীবনে সুখী হও। পারলে আমারে মাফ কইরা দিও।”
এই বলে লিপি ধীরে ধীরে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করল। তার মলিন চেহারা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। শুভ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, আর ফুল নিজের মনে তোলপাড় অনুভব করছিল। তার হৃদয়ে ক্রোধ, বেদনা, আর কিছুটা সহানুভূতি মিশ্রিত হয়ে যেন এক অদ্ভুত ভার তৈরি করল।
নদীর হাওয়া বইতে থাকল। শুভ ও ফুল সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, জীবন ও অতীতের বোঝা বয়ে নিয়ে।
চলবে……..