ইতি তোমার সুখফুল(দুখীফুলের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
105

#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#সমাপ্তি_পর্ব

শুভ তার কথা রেখেছে। ফুলকে তৃতীয়বারের মতো বঁধু বেশে ঘরে তুলবে। তবে, অন্যান্য বর বঁধুর মতো শুভ ও ফুলের বিয়ের অনুষ্ঠান পৃথক জায়গায় হবে না। বরঞ্চ একই বাসায় হবে। নানান ঝামেলা ঝড়ঝাপটা পাড় করে শুভ ও ফুলের বিয়ের দিনতারিখ এগিয়ে আসলো।

আজ শুভ ও ফুলের গায়ে হলুদ। শুভ ও ফুলের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ঘরেই আয়োজন করা হবে, তবে সেজে উঠবে একেবারে জমকালো। পুরো আয়োজনটা হবে প্রেম, আনন্দ আর ঐতিহ্যের মিশেলে।

ফুলের ইচ্ছে অনুযায়ী অনুষ্ঠানের পরিবেশটির আয়োজন করা হয়েছে একেবারে প্রাণবন্ত এবং আনন্দমুখর।
শুভ ও ফুলের বিশেষ দিনটিকে আরও বিশেষ করে তুলতে ঘরের সাজ-সজ্জায় রয়েছে হলুদ ও সবুজের মিশ্রণ। বাড়ির বাগানে শিউলি গাছের নিচে বড় স্টেজ করা হয়েছে। সেখানে ঢাকের তালে তালে গানের রিমিক্স বাজানো হচ্ছে। অতিথিরা সবাই মেতে ওঠেছে সেই তালের সুরের সঙ্গে। এক কোণে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা হবে মঞ্চ, যেখানে বর-কনে বসবে। মঞ্চের পিছনে আছে ফুলের ব্যাকড্রপ বা কাপড়ের সজ্জা। মঞ্চের চারপাশে গাঁদা ফুল এবং রজনীগন্ধার মালা ঝুলানো আছে, এবং ফেয়ারি লাইট দিয়ে পুরো পরিবেশ আলোকিত হয়ে আছে।

প্রবেশপথ সাজানো হয়েছে ফুলের তোড়া ও রঙিন আলোকসজ্জা দিয়ে। অতিথিরা প্রবেশ করতেই এক ভিন্ন রকম অনুভূতি পাচ্ছে। আরিফার দুই মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে প্রিয় বান্ধবীর হলুদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলো। বাচ্চাকে নাফিসের কোলে তুলে দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। এদিকে এতো ছোট বাচ্চাকে কোলে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে নাফিস। তার মনে হচ্ছে, এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে ধরতে গেলে ব্যথা দিয়ে দিবে। তাছাড়া বাহিরের সাউন্ড বক্সের আওয়াজও বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে হচ্ছে নাফিসের কাছে। দেখা গেল, চঞ্চল বউয়ের পিছু পিছু নাফিসও বাড়ির ভেতর চলে আসে।

শিউলি ফুলের স্নিগ্ধ গন্ধে মোড়া সন্ধ্যা। গাছের নিচে সাজানো হলুদের মঞ্চ যেন একখণ্ড স্বপ্নের মতো। মঞ্চের চারপাশে রাখা হয়েছে কাঁচি কাঁচি শিউলি ফুল, মাটিতে শিউলির সাদা আর গেরুয়া রঙ যেন একসঙ্গে মিলে একটা রঙিন কার্পেট তৈরি করেছে। মঞ্চে বসেছে শুভ আর ফুল। দুজনেই কাঁঠালি রঙের পোশাকে যেন সোনালি আলোর ঝলক।

শুভর পাঞ্জাবি আর ফুলের শাড়িতে সূক্ষ্ম কাজ, রূপালি আর সোনালি জরি মিলে আলোর খেলা করছে। শিউলির পাতার তৈরি টোপর আর গহনা তাদের সাজকে আরও মায়াময় করে তুলেছে। চারদিকে আলোর মালা ঝুলছে, বাতাসে মিষ্টি বাঁশির সুর, আর অতিথিদের খিলখিলানো হাসি সন্ধ্যার উষ্ণতা বাড়িয়ে তুলেছে।

তারা হাত ধরাধরি করে বসে আছে, চোখে মুখে একটা মধুর লাজুক হাসি। শিউলির নিচে এই মঞ্চ যেন শুধু তাদের ভালোবাসারই নয়, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতারও এক অপূর্ব উদযাপন।

সাগরিকা বরণডালা নিয়ে হাজির হলো। আনুষ্ঠানিকভাবে হলুদের কাজ শুরু করলো সে। সাগরিকা অতি যত্নে বরণডালাগুলো সাজিয়ে এনেছে। পিতলের থালা থেকে তুলে আনা পাকা আমপাতাগুলো দিয়ে সাজানো হলো বরণডালার প্রধান কাঠামো। প্রতিটি শাখার গিঁটে গিঁটে বাঁধা হলো রঙিন সুতা—লাল, হলুদ, আর সাদা। আমপাতার সবুজের সঙ্গে এই রঙের মিলন যেন প্রাণের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।

ডালাগুলোর মাথায় বাঁধা হলো তাজা শিউলি ফুলের মালা। ফুলের সাদা আর গেরুয়া মিশ্রণ ডালার প্রতিটি কোণে একরকম মাধুর্য এনে দিল। পাশাপাশি, প্রতিটি ডালার গায়ে ছোট ছোট শঙ্খ বাঁধা হলো, যাতে শব্দে সন্ধ্যা ভরে ওঠে।

বরণডালার নিচের অংশে ঝোলানো হলো রঙিন কাগজের ঝালর, আর কিছু জায়গায় ছোট ছোট ঘণ্টা লাগানো হলো। অতিথিরা যখন মঞ্চের দিকে এগোবে, ঘণ্টার মিষ্টি শব্দ আর শিউলির গন্ধে যেন তাদের পথ নিজেই সজ্জিত হয়ে যায়। পুরো আয়োজনটা যেন শুধু শুভ আর তার স্ত্রীর জন্য প্রকৃতির এক অভিনব উপহার।

আরিফার খুশি যেনো শেষ হয় না। উচ্ছসিত হয়ে এখানে সেখানে দৌড়াচ্ছে। কখনো ফুলের শাড়ি ঠিক করে দিচ্ছে তো কখনো ডালা গুছিয়ে দিচ্ছে। নাফিস ছেলেকে কোলে নিয়ে অদূরে চেয়ারে বসে আছে। ফুলকে দেখে নাফিসের ভাঙা মনে কোনো প্রভাব পড়লো না। আরিফা সেই স্থানটা পূরণ করে দিয়েছে। নাফিসের চোখ শুধু আরিফাতেই নিবদ্ধ আছে।

কাঁচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে আদিল মঞ্চে উঠে আসলো। ভাইকে হলুদ মাখার পরিবর্তে হলুদে গোসল করিয়ে দিল। ফুল, শুভকে দেখে হেসে শুয়ে পড়ার অবস্থা। সাগরিকা ক্যামেরা হাতে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো, শুভর। ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েদের দেখাবে বলে।

শুভ সকলের আড়ালে ফুলের গালে হলুদ ছুঁয়ে দিল। কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে বলল, ” তোমাকে কি নামে ডাকব? হলুদ ফুল নাকি শুভর সুখী ফুল।”

ফুল মিষ্টি হেসে উত্তর দিল,” আমি শুভর সুখফুল।”

শীতের হালকা আমেজ। ঘরজুড়ে আলোর ঝলকানি, ফুলের মিষ্টি গন্ধে পরিবেশটা যেন অন্যরকম। শুভ আর ফুলের বিয়ে। বিয়েটা হচ্ছে ওদের নিজেদের বাড়িতেই—একটা বিশাল বাগান জুড়ে সাজানো আয়োজন।

বাগানের মাঝখানে বড় করে স্টেজ সাজানো হয়েছে। সাদা আর লাল রঙের ফুল দিয়ে সাজানো। স্টেজের ঠিক উপরে ঝোলানো বর্ণিল জরি-ঝালর আর আলোর মালা। পুরো বাড়িটা যেন উৎসবের আনন্দে ভরে উঠেছে। ঘরের এক কোণে বসে ফুল তার আরিফার সঙ্গে গল্পে মগ্ন। তার গায়ে লাল বেনারসি আর চুলে ফুলের মালা। লাজুক মুখটা দেখে আরিফা বারবার খোঁচা দিয়ে বলছে, “ফুল, আজ কিন্তু তোর দিন! এভাবে লজ্জা করলে চলবে? অবশ্য, তোর বাসর তো আগেই করা শেষ। এই ফুল রে, তোর কোথায় কোথায় চুমু খেয়েছিল। বল না!”

ফুল চোখ রাঙায়। লজ্জায় মাথা নত করে বলে,” বেয়াদব মেয়ে।”
আরিফা ক্ষান্ত হলে তো? সে তার মতো বকবক করেঔ যাচ্ছে। ফুলকে লজ্জায় ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাবছে না।

শুভর জন্যও আলাদা রকমের প্রস্তুতি চলছে। বড় ভাই আদিল তাকে নিয়ে হাসি-তামাশায় মেতে আছে। কালো শেরওয়ানি আর সোনালি পাগড়ি পরে শুভ নিজেও যেন রাজপুত্রের মতো লাগছে। নাফিস ঠাট্টা করে বলল, “এই শুভ, ফুল তোকে দেখে চমকে যাবে!”

শুভ হেসে মাথা নোয়াল, কিন্তু তার চোখে দেখা গেল একরাশ উত্তেজনা।

রাতের তারার মতো ঝলমলে আলোতে পুরো বাগান ভরে উঠেছে। শুভ আর ফুলকে স্টেজে বসানো হলো। চারপাশে সবাই হাততালি আর মৃদু হাসিতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। শুভর হাতে যখন মালা তুলে দেওয়া হলো, তার হাত একটু থমকে গেল। তারপর নিজের হাতে মালাটা ফুলের গলায় পরিয়ে দিল। ফুলও এক ঝলক লজ্জা সামলে শুভর গলায় মালা দিল। সেই মুহূর্তে যেন সবার মুখে একটাই শব্দ—”সাজানো রাত শুরু হলো!”

স্টেজের পাশেই বড় ডাইনিং এরিয়া। নানা রকমের খাবার সাজানো। কাবাব, পোলাও, রোস্ট, মিষ্টির বিশাল আয়োজন। পরিবারের ছোটরা খাবারের দিকে বারবার দৌড় দিচ্ছে, আর বড়রা তাদের ধরে আনছে। অতিথিরা একে একে বসে খাবার উপভোগ করছে।

রাতের শেষদিকে বিদায়ের সময় এল। বাড়ির মধ্যেই ফুলের জন্য সাজানো হলো নতুন ঘর। শাশুড়ি মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুল বসে আছে। সুইটি খানম ফুলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। শুভ সকলের আড়ালে ফুলের হাতে চিঠি গুঁজে দিল। তাতে লেখা ছিল,

প্রিয় আসল বউ,

তোমাকে যখন লাল বেনারসিতে দেখি, মনে হয়, যেন পুরো পৃথিবীর সব রঙ একসঙ্গে মিলে তোমায় সাজিয়েছে। তোমার শাড়ির পাড়ের সোনালি কাজগুলো ঠিক তোমার হাসির মতোই ঝলমলে। আর আঁচলটা? মনে হয়, যেন একটা লাল আকাশ, যেখানে তোমার সব স্বপ্নগুলো উড়ছে।

তোমার হাসির কথা বললে কোথা থেকে শুরু করব জানি না। তুমিই তো সেই মিষ্টি হাসি, যা আমার সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেয়। তোমার চুড়ির ঝুনঝুন শব্দ যেন একটানা বেজে চলা এক অদ্ভুত সুর, যা আমি সারাক্ষণ শুনতে চাই। সেই শব্দে যেন ঘরটা শুধু মুখরিত নয়, আমার মনও ভরে ওঠে।

তোমার চোখের আনন্দ, তোমার কথার মিষ্টি সুর, সবকিছুতে মনে হয়, তুমি শুধু আমার জন্যই এতটা রঙিন আর সুন্দর। তুমি জানো, তোমার এই খুশি আমাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়।
আমার কল্পনা জগতের তুমির কথা শুনবে? তবে শোনো, তুমি এখন আয়নার সামনে বসে আছো, আমি চুপচাপ তোমাকে দেখছি। তোমার চুলের খোঁপা, গলায় সেই সোনার হার, আর কপালের মাঝখানে টিপটা—সবকিছুতেই তুমি যেন একটা জাদু। তোমার ঐ টিপটা আমাকে হিংসায় পুড়িয়ে ফেলে। মনে হয়, আমার চোখের জন্যই তো এই জায়গা!

তুমি আমার জীবনে এসেছো, আর আমার রঙহীন দিনগুলো রাঙিয়ে তুলেছো। তুমি আছো বলেই আমি আজও স্বপ্ন দেখতে পারি। তুমি আমার জীবন, আমার ভোরের আলো, আমার সবটুকু।

ইতি,
তোমার আসলবর

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে শুভ ড্রাইভারের সঙ্গে নাফিস আর আরিফাকে গাড়িতে তুলে বিদায় দিল। গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই পিয়াল দৌড়ে এসে শুভকে জড়িয়ে ধরল। শুভ হাসিমুখে পিয়ালকে কোলে তুলে নিল। আদিল ভাইয়ের ছেলেটা সবসময়ই খুব আদরের।
“চাচু, এটা আপনার জন্য!”

পিয়াল ছোট্ট হাত বাড়িয়ে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। শুভ চিঠিটা নিয়ে মুচকি হাসল। সে বুঝল, এটা ফুলের পাঠানো।
পিয়ালকে আদর করে মা’র ঘরে শুইয়ে দিয়ে শুভ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠল। একা বসে চিঠিটা খুলে পড়ল,

প্রিয় পত্রবর,
আমাদের জীবন যেন এক গল্প। তুমি সেই গল্পের নায়ক, আর আমি হয়তো এক ছায়াময় চরিত্র। তবুও, প্রতিটি মুহূর্তে তোমার ছায়ায় থাকার অনুভূতি আমাকে অমূল্য সুখ এনে দেয়। আমাদের জীবনের পথচলার প্রতিটি বাঁক আজ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কেমন করে তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল, কীভাবে অজান্তেই তুমি আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কতটা গভীর হয়েছে, তা লিখে বুঝাতে পারব না।

তুমি শুধু আমার স্বামী নও, তুমি আমার বন্ধুও। প্রতিটি সাফল্যে তোমার উচ্ছ্বাস, প্রতিটি দুঃসময়ে তোমার ভরসা—সবকিছু আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। তুমি এমন একজন, যাকে সম্মান করতে গিয়ে আমি নিজের হৃদয়কে আরেকবার ভালোবাসতে শিখেছি।

তোমার প্রতি আমার মুগ্ধতা কখনো কমেনি। তোমার উদারতা, ভালোবাসা আর নিঃস্বার্থ মনোভাব আমাকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখায়। আমি কৃতজ্ঞ, কারণ তোমার মতো একজন মানুষ আমার জীবনে আছে।

আজকের এই বিশেষ দিনে আমি চাই তোমাকে মনে করিয়ে দিতে—তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার। আমাদের জীবনের এই নতুন যাত্রা যেন আরও রঙিন হয়। আজ রাত শুধু আমাদের। আমাদের ভালোবাসার এই বিশেষ দিনটিকে স্মৃতির সেরা অধ্যায় করে তুলব।

আজকের এই বিশেষ দিনে তোমার জন্য আমার ভালোবাসা আর সম্মানের কথা আরও একবার বলছি। তুমি আমার জীবনের আশ্রয়, আমার নির্ভরতা। আমাদের নতুন পথচলা যেন ভালোবাসায় ভরা হয়। আমি চাই, এই ভালোবাসা সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হোক।

আজ রাতে শুধু তোমার। এই রাত যেন আমাদের জীবনের এক সুন্দর গল্পের শুরু হয়ে থাকে। চলো, একসঙ্গে সেই গল্প লিখি।

ইতি,
তোমার সুখফুল

চিঠি পড়ে শুভর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। চিঠিটা পকেটে গুঁজে নিজের ঘরে প্রবেশ করল। আজকের রাত যে শুধু তার আর ফুলের। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ফুল ও শুভ এক হয়েছে। দেরীতে হলেও তাদের জীবনে সুখ ধরা দিয়েছে। শুরুটা দুখীফুলের হলেও, তার দুখের সাথে শুভও জড়িয়ে গিয়েছিল। আজ তারা এক হলো। ফুলের সুরভি ছড়িয়ে পড়ুক ফুল ও শুভর জীবনে। বেঁচে থাকুক শুভরফুল শুভর ভালোবাসার চাদরে।

————————–

” এই অনু মনু, তোর মাথার চুলের একপাশে বিনুনি করা আরেকপাশ খোলা কেনো রে? তোর মা কী চুল বেঁধে দেওয়ার সময় পায় না?”

অনুপ্রিয়ার চোখে পানি টলমল করছে। যেনো এক্ষুণি কেঁদে দিবে। সে নাক টেনে উত্তর দিল,” আজ পিয়াল ভাইয়া বেঁধে দিছে। আম্মু না করেছিল তবুও বেঁধে দিছে।”

সায়ন বন্ধুদের সাথে মিলে অনুপ্রিয়ার চুল টেনে ধরলো।অনুপ্রিয়া চিৎকার করে বলতে থাকলো, ” ছেড়ে দাও, সায়ন। আরিফা মামীকে তোমার নামে নালিশ করবো।”

সায়ন শুনলে তো? সে ছোট্ট অনুপ্রিয়ার মাথার চুল ছিঁড়তে ব্যস্ত। ক্লাস শেষ করে পিয়াল অনুপ্রিয়াকে দেখতে এসেছিল। সায়নের অসভ্যতামো দেখে পিয়াল অনুপ্রিয়াকে জাপটে ধরলো। অনুপ্রিয়া ভাইকে পেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। নাক টেনে নালিশ ছুড়লো,” সায়ন আমাকে মে’রে’ছে। তোমাকে চামচিকা ডেকেছে। আর বলেছে, আমি নাকি বুচি।”

পিয়াল রেগে সায়নকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তাকে চামচিকা বলার কারণে নাকি অনুপ্রিয়াকে বুচি ডাকার কারণে কে জানে? সাথে সাথেই সায়নের বন্ধুরা প্রিন্সিপালের কাছে বিচার দিয়ে আসলো।

প্রিন্সিপাল তিনজনকেই ডেকে পাঠালো। সায়ন ও অনুপ্রিয়া একই ক্লাসে পড়ে কিন্তু পিয়াল পড়ে তিন ক্লাস উপরে। প্রিন্সিপাল নাকের ডগায় চশমা এনে তিনজনকো ডেকে পিয়ালকে প্রশ্ন করল,” তুমি সায়নকে মে’রে’ছো কেনো? ”

পিয়াল ভয়হীনভাবে উত্তর দিল,” প্রিয়ার চুল ধরে টেনেছিল, তাই।”

প্রিন্সিপাল স্যার এবার অনুপ্রিয়ার দিকে তাকালো। মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে বাঁধা আছে। চুলের সাথে যুদ্ধ করার কারণে পাগল পাগল লাগছে। প্রিন্সিপাল স্যার অনুপ্রিয়াকে প্রশ্ন করল, তোমাকে কে মে’রে’ছে,মামণি?”

“সায়ন মে’রে’ছে।”

” তুমিও কি সায়নকে মে’রে’ছো”

” না তো! পিয়াল ভাইয়া ধাক্কা মে’রে’ছে। ও অনেক ব্যথা পেয়েছে স্যার।

কথাটা বলেই ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করলো অনুপ্রিয়া। প্রিন্সিপাল স্যার মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন। দুজনের প্রতি মায়া মহাব্বত দেখে তিনি কার বিচার করবেন ভুলে গেলেন। প্রিন্সিপাল স্যার সায়নকে প্রশ্ন করল, “তুমি অনুপ্রিয়ার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়েছো কেনো”

সায়ন উত্তর দিল, “ওর মাথার চুল আম্মু বেঁধে দিবে, পিয়াল ভাইয়া কেন বেঁধে দিয়েছে? ওর কি হাত নেই?”

প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, ” হাত-পা সবই আছে কিন্তু ও তো ছোট। একা একা চুল বাধতে জানে না। তুমি আর ওকে মে’রো না বাবু।”

“আমি ওকে হাজার বার মা’র’বো, মা’র’তে মা’র’তে ওর চোখ বন্ধ করে ফেলব।”

প্রিন্সিপাল সামনে আরেক দফা মা’রা’মা’রি হয়ে গেল। সায়ানের কথা শেষ হতেই পিয়াল গিয়ে সায়ানের মাথার চুল টেনে ধরল। সায়ানো কম যায় না পিয়ালের প্যান্ট খুলে দিল। মাঝখানে অনুপ্রিয়া এসব দেখে দুই হাতে চোখ ঢেকে রাখল।

প্রিন্সিপাল স্যার তিন জনকেই বেত্রাঘাত করলেন। তিনজনের হাত লাল টকটকে বানিয়ে দিলেন। ছুটির পর পিয়াল ও অনুপ্রিয়াকে নিতে বকশি কাকা আসলেন। দুজনের মন খারাপ দেখে চিপস কিনে দিলেন। পিয়াল অনুপ্রিয়া কেউই চিপস নিলো না। গাড়িতে গিয়ে বসলো। অনুপ্রিয়ার মন খারাপ করা দেখে পিয়াল বলল,” তোর জন্য মা’র খেলাম।”

অনুপ্রিয়া প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” সব দোষ সায়নের।”
” থাক, কাদিস না। বাসায় গিয়ে বরফ লাগিয়ে দিব।”

সায়ন কোথায় থেকে দৌড়ে গাড়ির কাছে এসে অনুপ্রিয়ার হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে বলল,” হাতে চেপে ধর, অনু। ব্যথা কমে যাবে।”

পিয়াল দেখে সেই বরফ অদূরে ছুঁড়ে বলল,” প্রিয়া শুধু আমার কথা শুনবে।”

সায়ন মন খারাপ করে চলে গেল।

বকশি কাকার তিনজনের ভালবাসা দেখে মন ভরে এলো। অনুপ্রিয়া শুভ ও ফুলের মেয়ে। মায়ের স্বভাব পেয়েছে মেয়েটা। একটু ভীতু স্বভাবের কিন্তু মন ভালো। সায়ন নাফিস ও আরিফার ছেলে, দুষ্টের রাজা। অনুপ্রিয়া তার জান। পিয়াল হলো রক্ষাকবজ একমাত্র অনুপ্রিয়ার জন্য। তিনজন তিনরকম কিন্তু বড়ো হলে কেমন হবে তা আমি আর লেখব না, আপনারাই কল্পনা করে নিন!

সমাপ্ত