#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১১
শুভ ফুলকে ছেড়ে দিল। ভীতি ভাবটা তার চোখে মুখে স্পষ্টত। ফুল একগাল হেসে চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত এতটা চুপ থাকা ফুলের স্বভাব না। শুভ বাড়িতে এসে সেই আগের ফুলকে দেখেনি। শুভ গলার স্বর নামিয়ে বলল,”কী হয়েছে? তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে?”
ফুল মুখ তুলল। গভীর এক দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকাল।
“আমি শর্ত বলব। তবে আগে কথা দাও, কোনো প্রতিক্রিয়া করবে না।”
শুভর বুকের ভেতর ধক করে উঠল। ফুল কোন শর্তের কথা বলতে চাইছে। তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলবে না তো! শুভ ভীতু স্বরে প্রশ্ন করল, “কী কথা? বলো না, এমন করে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করো না!”
ফুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ধীর গলায় বলল,
“তোমাকে এই শর্ত মানতেই হবে।”
শর্তের কথা শুনেই শুভর মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। এখন তো মানতেই হবে এমন শর্ত দিল, ফুল। পূর্বের তুলনায় তার মনে আরো বেশি ভয় চেপে বসল। ফুল কি শুভকে আর চায় না? নাকি সে দূরে সরে যেতে চায়? শুভর কণ্ঠ কাঁপতে লাগল, “ফুল, তুমি কী আমার থেকে দূরে চলে যেতে চাও, বলো? আমি জানি তুমি এমন কিছু বলবে না, তাই না?”
ফুল কিছুক্ষণ চুপ রইল। যেনো শুভর ধৈর্য পরীক্ষা নিচ্ছে। এরপর একটু হাসল, “তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন?”
শুভ দ্রুত বলে উঠল, “না, মানে! বলো তো, কী শর্ত?”
ফুল তার চোখের ভেতর তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
“আমি তৃতীয়বারের মতো তোমার বউ সাজতে চাই। তুমি নিয়ম মেনে আবার আমাকে বিয়ে করবে।”
শুভ কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রফুল্লচিত্তে বলল, “এটাই তোমার শর্ত?”
ফুল শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। শুভ যেন এক বিশাল বোঝা নামিয়ে ফেলল বুক থেকে। একটা হাসি লেগে গেল তার ঠোঁটে। “তুমি জানো, কীভাবে মানুষকে পাগল বানাতে হয়!”
ফুল হেসে বলল,”তাহলে রাজি তো?”
শুভ ঝটপট বলল, “তোমাকে বিয়ে করতে আমি যে কোনো দিন রাজি!”
ফুল মাথা নিচু করে হাসলো। শুভ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফুলের হাতজোড়া ধরল, খুব আদরে, খুব শক্ত করে। ফুল বুঝল, তার সুখের দিন পুনরায় ফিরে এসেছে। এবার ফুল, কোনো ভুল করবে না। প্রিয়জনক দূরে যেতে দিবে না। আঁচলের সাথে বেঁধে রাখবে।
——————–
ফুল, শুভর কাছ থেকে ছাড়া পেলো বেলা এগারোটায়। এতক্ষণ ফুলকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল। কখনো ফুলের কপালে শব্দ করে চুমু খাচ্ছিল তো কখনো হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছিল। ফুল বিরক্ত হবে কী? শুভ সেটার সুযোগ দিলে তো! ফুল চলে যেতে নিলেই শুভর অভিমানী কণ্ঠে বলো উঠে,” এতোদিন পর আমাকে কাছে পেয়েও দূরে সরে যাচ্ছো। তুমি নিষ্ঠুর থেকেও নিষ্ঠুরতম হয়ে যাচ্ছো, ফুল। ”
ফুল হেসে শুভর নাকে কামড় বসায়। শুভ মিথ্যা রাগ করে ফুলকে ছেড়ে দেয়।
নিচে নেমে বাড়িতে কাউকে দেখতে না পেয়ে ফুল অবাক হয়ে যায়। বাইরে নাসিমা এমনিতেই বসেছিল। তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি গেইটের দিকে। কারো অপেক্ষা করছে মেয়েটা। ফুল মাথা ঘামালো না। উঁচু আওয়াজে ডাকলো মেয়েটাকে। নাসিমা ফুলকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে আসলো। ফুল কিছুটা ইতঃস্তত হলো। নাসিমা এসেই প্রথম জিজ্ঞেস করল,” ছোট ভাইয়ার জ্বর কী কমেছে?”
ফুল ভীষণ লজ্জা পেলো। লাজুক ভাবটা স্পষ্ট হলো তার গালদুটোর জন্য। নাসিমা মুখটিপে বলল,” এতে বছর পর বউকে কাছে পেলে যেকোনো পুরুষের জ্বর উধাও হয়ে যাবে।”
ফুল নিজেকে সামলে নিলো। কথা ঘোরানোর জন্য বলল,” মা আর ভাবী কোথায় গেছে? ”
নাসিমা উত্তর দিল,” আমারে বাইরে বসিয়ে রেখে তারা গরুর খামারে গেছে। এই দিন দুপুরে কেউ খামারে যায়, বলো তো আপা?”
ফুল উত্তর দিল না। আলগোছে মাথার চুল খোঁপা করে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো। পিছন থেকে নাসিমা বলে উঠলো, ” রান্না করা হয়ে গেছে, ফুল আপা।”
ফুল অবাক হলো। রান্নাঘরের পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে সত্যতা নিশ্চিত করে নিল। ফুল তবুও চুলা ধরালো। ডিম ভাজি করলো। গরম ভাতের উপর সামান্য ঘি ঢেলে দিল। ডিমভাজি ভাতের উপর নিয়ে উপরে চলে গেল। শুভ ততক্ষণে গোসল সেড়ে বের হয়েছে। উন্মুক্ত বক্ষস্থল খালি করে বের হয়ে এসেছে। ফুল ঘরে প্রবেশ করে শুভকে এই অবস্থায় দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নজর এদিকসেদিক ঘুরিয়ে খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রেখে বের হতে নিলে শুভ বাঁধা দিয়ে বলে উঠে,” কোথায় যাচ্ছো? খাইয়ে না দিলে আজ সারাদিনও না খেয়ে থাকবো বলে দিলাম।”
ফুল পড়ল মহা বিপদে। যেই লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য পালাতে চেয়েছিল সেই লজ্জায় পড়তে হলো। শুভ আয়নার সামনে দাঁড়ালো। মাথার চুল উলটে পালটে ঝেড়ে আয়নার প্রতিবিম্বে ফুলের লাজরাঙা মুখখানা দেখলো। শুভর ইচ্ছে করল, ফুলকে আরেকটু লজ্জায় ফেলতে। ফুল ভাত মাখাচ্ছিল। শুভর দুষ্ট চোখজোড়া দেখে মতলব বুঝতে পারল। শুভ কাছে আসতেই মাখানো হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,” খবরদার! আর কোনো দুষ্টুমি করবে না। নাহলে আমি খুব রাগ করব।”
শুভ মাথা চুলকে টিশার্ট পরে বিছানায় বসলো। কি যেনো মনে করে ল্যাপটপ খুলল। প্রয়োজনীয় কিছু ইমেল দেখতে দেখতে ফুলের হাতে ভাত খেয়ে নিলো। খাওয়ার পর ফুল চলে আসতে নিলে শুভ ফুলের ওড়না টেনে ধরে বলল,” নতুনকরে অভ্যাস তৈরি করে নাও, ফুলবউ? পাগল তার পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। এতো সহজে ছাড়া পাবে না।”
ফুলের ওড়না দিয়ে ঠোঁট মুছে নিল। ফুল লাজুক হেসে চলে আসলো। কিছুক্ষণ পর দুইকাপ চা নিয়ে শুভর ঘরে ঢুকলো। শুভ এতে ভীষণ খুশি হলো। ল্যাপটপ বন্ধ করে ফুলের হাত ধরে বারান্দায় আসলো। শুভ আর ফুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দুপুরের কড়া রোদ এসে বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে দুজনের মুখে পড়ছে। হাতে গরম চায়ের কাপ, চুমুক দিতে দিতে দুজনেই নীরব। হঠাৎ শুভ একটু বাঁকা হাসি দিয়ে বলে উঠল, “জানো, ফুল, তোমার বানানো চা আর তোমার মধ্যে একটা দারুণ মিল আছে।”
ফুল চোখ কপালে তুলে বলল, ” মিল? কী রকম মিল? আবার কী দুষ্টুমি করছো?”
শুভ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ” দুটোই একেবারে মিষ্টি। তবে কখনো কখনো একটু তেতো লাগে।”
ফুল লজ্জায় মুখ লুকাতে চায়। শুভটা আগের মতোই ঠোঁটকাটা স্বভাবের রয়ে গেছে। ফুল লাজুকমুখে বলল,”তেতো? কী বলতে চাইছো তুমি?”
শুভ হাসি চেপে উত্তর দিল, “তোমার ওই ছোট ছোট রাগগুলো না, ঠিক এই চায়ের মশলার মতো। একটু হলেও চায়ের স্বাদ বাড়ায়। আর তেতো বলতে, তোমার অভিমানগুলো, যেগুলো ছাড়া তুমি অসম্পূর্ণ।”
ফুল কাপ হাতে শুভকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, “তোমার কথা শুনলে মনে হয়, চা খাওয়া বন্ধ করে দিই।”
শুভ জোরে হেসে বলল,”না না, এমন অন্যায় করবে না। এই চা আর তুমি দুটোই আমার জীবনের আসল রঙ। তোমার চায়ের কাপটা না হলে, আর জীবনটা তোমার মতো না হলে, আমার দিন তো ফিকে হয়ে যাবে!”
ফুল লাজুক হাসে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক বসানোর আগে বলে উঠল, “তোমার দুষ্টুমির কোনো শেষ নেই।”
শুভ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উত্তর দিল, “শেষ নেই বলেই তো তোমাকে চিরকাল ভালোবাসি। তোমার দুষ্টু-মিষ্টি সবকিছুই যে আমার প্রিয়!”
ফুলের মুখে লাজুক হাসি। রোদ গড়িয়ে গিয়ে বিকাল নামে, কিন্তু তাদের বারান্দার সেই মুহূর্ত যেন প্রেমের আরেকটা অধ্যায় হয়ে থাকে।
———————
চা খাওয়ার পর শুভর মনে হলে, ফুলকে এই বিশেষ দিনে চিঠি লেখতে। ফুল চলে যাওয়ার পর শুভ চিঠি লেখল,
প্রিয় নিষ্ঠুরফুল,
তোমার নিষ্ঠুরতায় বড্ড ক্লান্ত শুভ আজ কলম হাতে নিয়েছে। জানি, তুমি এই চিঠিটা পড়তে পড়তে হয়তো মুচকি হাসবে, কিংবা বলবে, “এই শুভ কী নাটক শুরু করল আবার!” কিন্তু নাটক নয়, ফুল। এটা আমার সত্যি সত্যি অভিমান।
তুমি কি জানো, তুমি যখন কথা বলো আমি ঠিক কীভাবে তোমার চোখের দিকেই তাকিয়ে থাকি? যেন তোমার প্রতিটা শব্দের ভেতরে আমার নাম লেখা থাকে। অথচ তুমি তুমি বলবে, আমি নাকি তোমার কথা শুনিই না! এ কেমন বিচার, নিষ্ঠুরফুল?
লাজুকফুল শোনো, তোমার ওই চা বানানোর কৌশল আমি মোটেও পছন্দ করি না। এতটা মিষ্টি চা কি কেউ খায়? কিন্তু জানো, যখনই তোমার বানানো চা খাই, মনে হয় জীবনটা একটু বেশিই মিষ্টি হয়ে গেল। এখন ভাবছি, এই অভিমানটাও কি তবে মিথ্যে?
তুমি যখন রেগে যাও, তখন তোমার কপালের ভাঁজ দেখে আমি বড্ড ভয় পাই। মনে হয়, যদি এই নিষ্ঠুরফুলটা হঠাৎ ঝরে যায়? কিন্তু তারপরও জানি, আমার প্রতি তোমার রাগ যতই থাকুক, তোমার ভেতরের ভালোবাসা সেটা ঢাকতে পারে না।
তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটা বলতে বলতে আমি কখনো ক্লান্ত হইনি। অথচ তুমি যেন আজকাল একটু বেশি ব্যস্ত, তাই না? একটুখানি সময় আমাকেও দিও। নইলে ভাবব, আমার ফুলটা সত্যিই নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে।
ইতি,
তোমার শুভ।
পুনশ্চঃ তোমার হাসিটা একটু কম নিষ্ঠুর হতে পারে, ভাবনা করে দেখো। কে জানে, হয়তো তখন আমি আরও বেশি অভিমান করব!
শুভ
—————
সন্ধ্যায় ফুল, সাগরিকার মুখোমুখি হলো। সাগরিকার সামনে অপরাধীর মতো ফুল দাঁড়িয়ে রইলো। সাগরিকা খুব কষ্ট হসি আটকে রেখেছে। ফুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা মূলত মজার ছলে করছে অথচ বোকা ফুল ভয়ে লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। সাগরিকা গম্ভীরমুখে বলতে লাগল,” এই তোর রাগ? স্বামীর আদর পেয়ে গলে গেছিস! খুব তো বলতি, আমাকে সময় দাও আমাকে সময় দাও।চারদিনেই তোর সময় চেষ?”
ফুল লজ্জায় মাথা নত করে বলল,” রাগ তো করেছিলামই তোমার দেবর রাগ ধরে রাখতে দিলে তো! আমাকে জাপটে ধরে!
ফুল চুপ হলেও সাগরিকা চুপ হলো না। সে ফুলের কথার বিপরীতে বলল,” কি বললি কি বললি, জাপটে ধরে! তারপর কী?”
ফুল, ভাবীর মুখের দিকে তাকালো। সাগরিকা এবার হাসি আটকাতে পারল না। হু হা করে হেসে ফেলল।ফুলও সাথে হাসলো সাগরিকার পাশে বসে মিনমিন সুরে বলল,” তোমার দেবর এক নাম্বার নাটকবাজ। নাটক করে আমার মনকে গলিয়ে ফেলেছে।”
সাগরিকা হেসে উত্তর দিল,” তোরা সবসময় এক হয়ে থাকবি। এটাই আমাদের চাওয়া। আর ভুল করিস না,ফুল। একটু ভুল, চার বছরের অভিমান। দুজন মানুষের জীবন থেমে গিয়েছিল। আর করিস না, বোন!”
ফুল সাগরিকাকে জড়িয়ে ধরলো। বুঝালো এমন সুযোগ আর কখনো আসতে দিবে না সে।
” আমার অধিকার আমাকে ফেরত দাও, ভাবী!”
বাড়িতে প্রবেশ করে দুই জাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে দেখে বলল শুভ। সাগরিকাকে ফুল ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। শুভ পিয়ালকে নিয়ে বাহিরে বের হয়েছিল। পিয়ালকে নিচে নামাতেই মাম্মা বলে সাগরিকার কাছে চলে গেল। সাগরিকা ছেলেকে কোলে বসিয়ে বলল,” এত বছর পর আবার কীসের অধিকার চাইতে হাজির হলি?”
শুভ ফুলের পাশে ধপ করে বসে ফুলের হাতের মুঠোয় হাত রেখে বলল,” এই যে, এই অধিকার! আমার ফুলকে জড়িয়ে ধরার অধিকার। আমি ছাড়া ফুলকে অন্য কেউ জড়িয়ে ধরতে পারবে না।”
সাগরিকা মুখ বাঁকাল। আদিল উপরে ছিল। নিচে শোরগোল শুনে নেমে আসলো। আদিলকে দেখে ফুল উঠে যেতে নিচ্ছিল। শুভ উঠতে দিল না। সে সকলের আড়ালে ফুলের হাতে একখণ্ড কাগজ গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,” তোমার পত্র এসেছে ফুলবউ, পত্রদাতা অধীর আগ্রহে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে।”
আদিলকে দেখে শুভ ফুলের পিছনে হাত রেখে সটান হয়ে বসলো। চোখের ইশারায় বুঝালো, সে তার বউয়ের রাগ ভাঙাতে সক্ষম হয়েছে। আদিলের হিংসাত্মক মনোভাব জাগ্রত হয়ে গেল। সে সাগরিকার কাছে এসে পিয়ালকে কোলে তুলে নিলো। আব্বু আব্বু করে উলু উলু করে সাকরিকার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। একহাতে পিয়ালকে আদর করার পাশাপাশি অন্যহাতে সাগরিকাকে আগলে ধরল। বাঁকা চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বুঝালো, তারা হলো সুখী পরিবার।
শুভ আগের মতো গাল ফুলালো। ফুলের কোমরে চিমটি কেটে বলল,” আমাদের খুব শীঘ্রই একটা ফুটবল ও একটা ক্রিকেট টিম বানাতে হবে। টিম মানে বুঝো তো! বাচ্চার কথা বলছি। আমি কোনোভাবেই ভাইয়ার থেকে পিছিয়ে যেতে চাই না। হোক সেটা বউ নিয়ে অথবা বাচ্চা নিয়ে।”
ফুলের চোখজোড়া বড়ো হয়ে আসলো। হাতের আঙুলের সাহায্যে গুনতে থাকলো ফুটবল ও ক্রিকেট টিম মিলিয়ে মোট কতজন হয়!
চলবে………..
#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১২
সন্ধ্যার লগন যেন প্রকৃতির এক জাদুকরী মুহূর্ত। দিনের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে, সূর্য অস্ত যেতে যেতে আকাশে ছড়িয়ে দেয় কমলা, লাল আর গোলাপি রঙের বিস্তার। পাখিরা আপন নীড়ে ফেরার তাড়া নিয়ে ঘরে ফেরে, গাছের পাতাগুলো হালকা বাতাসে মৃদু দুলতে থাকে। দূর থেকে ভেসে আসে কোনো মসজিদের আজানের ধ্বনি। পথের ধারে জ্বলে ওঠে ল্যাম্পপোস্টের আলো। এ সময়টা যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দিন শেষ হলেও জীবনের প্রতিটি সন্ধ্যায় নতুন করে আলো জ্বালানোর সুযোগ থাকে।
সন্ধ্যা লগন তাই শুধু প্রকৃতির নয়, আমাদের মনেরও এক প্রশান্তির সময়। ফুলের মনেও প্রশান্তির ছায়া বইছে। শুভকে পাওয়ার প্রশান্তি। অপেক্ষার ফল যে মিষ্টি হয় তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ শুভ ও ফুলের সম্পর্ক। ফুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সংগঠনের কাজে কথা বলছে। গতমাসেই দুইজন বিশ্বস্ত কর্মী নিয়োগ দিয়েছে যাদের একজনের নাম তৃণা ইসলাম অপরজনের নাম আফজাল হক নীরব। সংগঠনের ম্যানেজার পদে আছে নীরব আর ভেতরের কাজে তৃণা। ফুল তৃণার সাথেই কথা বলছে। নিজের অনুভূতি মনের গহীনে লুকিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সে।
ফুলের কথার মাঝেই একজোড়া হাত তার কোমর চেপে ধরলো। কিছুক্ষণের জন্য ফুলের কথোপকথন বন্ধ হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে কথা চালিয়ে গেল। হাতজোড়ার মালিক এবার ফুলের অপর কানে ফু দিল। ফুল কেঁপে উঠলো। শরীর অসার হয়ে আসলো। পিঠ হেলিয়ে দিল মানুষটার উপর। ফুলকে আগলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। কথা শেষ করে ফুল পেটের কাছে থাকা হাত জোড়ার উপর হাত রাখলো। নরম সুরে শুধালো,” কিছু বলবে?”
শুভ গুনগুন করে গানের লাইন গাইল,
“চাঁদের সাথে আমি দিব না, তোমার তুলনা।
নদীর সাথে আমি দেবো না, তোমার তুলনা।
তুমি চাঁদ হতে যদি, দুরেই রয়ে যেতে
তুমি নদী হতে যদি, দুরেই চলে যেতে
এ কথা যেনো ভুলো না,
তুমি যে তোমারি তুলনা।”
ফুল হাসলো। শুভর হাতে চিমটি কেটে বলল,” আমি জানতাম ডাক্তাররা সবসময় সিরিয়াস মুডে থাকে কিন্তু আমার ডাক্তার বর সবসময় রোমান্টিক মুডে থাকে। কারণ কী?”
শুভ ফুলকে ছেড়ে দিল। ফুলকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,” ঘরে সুন্দরী বউ থাকলে আমার মতো ডাক্তাররা সবসময় হৃদয়ের ডাক্তার হতে চাইবে, ফুলবউ! আমি আমার ফুলবউয়ের হৃদয় ডাক্তার তাই এতো রোমান্টিক।”
ফুল খিলখিল করে হাসতে লাগল। তার হাসির ছন্দে সারা বাড়ি মুখরিত হয়ে যাচ্ছে। শুভ মোহিত দৃষ্টিতে তার ফুলবউকে দেখছে। বিগত বছরগুলোতে একদিনও ফুল এভাবে হাসেনি। শুভ জানে, ফুল এতগুলো বছর ভালো থাকেনি। হঠাৎই শুভ ফুলকে জড়িয়ে ধরলো। ফুল এরজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। শুভর নিঃশ্বাস ফুলের ঘাড়ে পড়ছে। ফুলও শুভকে আবেশে জড়িয়ে ধরেছে। শুভ, ফুলের ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,” আমাকে ক্ষমা করে দিও, ফুল।”
ফুল শুভর বুকে চুমু খেলো। বুঝালো সে তার ডাক্তার বরকে সেই কবেই ক্ষমা করে দিয়েছে।
শুভ ফুলের জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছে। ফুলকে নিয়ে নিজের ঘরে এসে বলল,” সন্ধ্যায় তৈরী হয়ে থেকো। আমরা বের হবো।”
ফুল অমত করলো না। হোক না! কিছু শুভর ইচ্ছেতে!
———-
সন্ধ্যার আবহ শুরু হয় এক নরম আলোয়, যেখানে শুভ ফুলকে নিয়ে বের হওয়ার পরিকল্পনায় মগ্ন। ফুল সেজেছে তার প্রিয় সাদা চন্দ্রমল্লিকা ফুলের রঙের শাড়িতে। শুভ পরেছে একটি নীল পাঞ্জাবি, যাতে তার ব্যক্তিত্ব যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সাগরিকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শুভ গাড়িতে উঠে বসলো। ফুল তখনো বাহিরে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল গুছিয়ে নিচ্ছে। শুভ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। এমন দৃশ্য দেখার জন্যই হয়তো ফুলের কাছে এসেছে সে। শুভ গাড়ির জানালার বাইরে তাকিয়ে মাতাল সুরে বলল,” আজকের সন্ধ্যাটা তোমার জন্য একটু বিশেষ, ফুলবউ!”
ফুল কিছুটা অবাক হয়ে হাসে। গাড়িতে ঢুকে সিটবেল লাগিয়ে বলে, “বিশেষ কেন? কী করছো শুভ?”
শুভ এক গাল হেসে ফুলের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল, “একটু ধৈর্য ধরো ফুলবউ! সব বলব।”
শুভ রহস্যময় হাসি দিয়ে গাড়ি চালু করে। পথিমধ্যে ফুলের জন্য গোলাপ ফুলের তোড়া নিয়ে নেয়। ফুলের আড়ালে তা গাড়ির পিছনের সিটে ফেলে রাখে৷ ফুল অবশ্য দেখেছে ফুলগুলো কিন্তু প্রতিক্রিয়া করেনি। কি দরকার তার ডাক্তারবরের আনন্দ নষ্ট করার!
গাড়ি থামলো বড়ো নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ে পৌঁছানোর পর ফুল বুঝতে পারে, এই সন্ধ্যা শুধু তাদের দুজনের নয়। আরো দুজন আছে, যাদের জন্য ফুলদের সন্ধ্যা আরো রঙিন হয়ে উঠবে। অদূরেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তার প্রিয় বন্ধু নাফিস এবং তার হবু স্ত্রী আরিফা। ফুল গাড়ির কাচ দিয়ে দেখতে পেলো দুজনের হাসিমাখা মুখ। একে অপরের হাতে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে। ফুলদের জন্যই অপেক্ষা করছে। ফুল মনভরে দোয়া করে দুই বন্ধুর জন্য। আরিফার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, মেয়েটার মুখের ভুবন ভুলানো হাসি। নাফিস পাশে থাকলেই মেয়েটা এভাবে হাসে। ফুলেরও খুশি খুশি লাগে। গাড়ি থেকে নামতেই আরিফা দৌড়ে আসলো। সেও শাড়ি পরেছে। দৌড়ানোর ফলে হড়কে যাবে নাকি স্বাভাবিক থাকবে তা ভাবে না মেয়েটা। এগিয়ে এসে ফুলকে জড়িয়ে ধরল। ফুলও প্রিয় বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরল। আরিফাকে ছেড়ে দুজনের উদ্দেশে বলল, ” তোরা আমাকে চমকে দিলি। কার বুদ্ধিতে এসব আয়োজন করলি?”
ফুল কণ্ঠে অবাকস্বর। নাফিস হেসে উত্তর দিল, “শুভই তো প্ল্যানটা করেছে। শুনে আমরাও ভেবেছিলাম, তোর সঙ্গে এমন চমৎকার একটি সন্ধ্যা কাটালে মন্দ হবে না।”
শুভ গলাখাঁকারি দিয়ে মনোযোগ নেওয়ার চেষ্টা করল। নাফিস শুভকে জড়িয়ে ধরে বলল,” শা’লা এবার বউকে ছেড়ে আমাদেরকেও দেখ।”
শুভ নাফিস ছেড়ে উত্তর দিল,” মাত্রই বউয়ের রাগ ভাঙালাম। আগামীকাল এক বছর ঘর ছেড়েই বের হব না।”
” আগামী সপ্তাহে আমার বিয়ে। আগামী এক সপ্তাহ যদি তোকে বউয়ের কাছ থেকে দূরে না সরিয়েছি তাহলে আমি নাফিস না।”
শুভ নাফিসের কাঁধে হাত রেখে বলল,” হিংসা হচ্ছে, ব্রো!”
নাফিস শুভর পিঠ চাপড়ে বলল,” হিংসে পেট, পিঠ ফুলে যাচ্ছে। খুলে দেখাবো?”
দুই বন্ধুর দুষ্ট কথা শুনে ফুল লজ্জা পেলো। আরিফা ষাঁড়ের মতো হাসতে লাগলো। ফুল প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলল,” আমার খুব ইচ্ছে ছিল, খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানোর।”
শুভ মুচকি হেসে বলল,” মনে করো ফুলবউ, আজ তোমার এই আশা পূরণ হতে যাচ্ছে।”
ফুল হাসলো। তার চোখজোড়া বিস্তৃত আকাশ জুড়ে ঘুরতে লাগল।
—————
আড্ডা জমে ওঠে। হাসি, গল্প, আর পুরনো দিনের স্মৃতিচারণে সময় কেটে যাচ্ছে। ফুলের মুখে প্রশান্তির ছাপ, চোখে আনন্দের ঝিলিক। শুভ নীরবে ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে, এই মুহূর্তগুলোই জীবনের আসল সৌন্দর্য। সন্ধ্যাটার শুরুতেই ছিল এক ধরনের প্রশান্তি। শুভ ফুলকে নিয়ে যখন নদীর ধারে পৌঁছায়, আকাশে তখনো শেষ বিকেলের মায়াবী আলো ছড়িয়ে ছিল। নদীর ঢেউয়ের মৃদু ছন্দ আর পাখির ডাক যেন তাদের আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছিল। শুভ মাদুর নিয়ে এসেছিল। নদীর পাশে সবুজ ঘাষের উপর সেটা বিছিয়ে দুজন বসে থাকলো। নদীর ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ফুলের হাসি দেকৈ যাচ্ছে শুভ। দূরে একটু ফাঁকা জায়গায় দেখা যাচ্ছে নাফিস ও তার হবু স্ত্রী আরিফাকে। তাদের চোখেমুখে ছিল স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস।
শুভ ফুলের জন্য নিয়ে এসেছিল গোলাপের তোড়া। গাড়ি থেকে একঝাঁক লাল গোলাপ হাতে তুলে দিয়ে সে বলল, ” আমার সুখফুলের জন্য আরেকটি ফুল।”
ফুলের চোখে অল্প বিস্ময়, আর মুখে সেই চিরচেনা হাসি। সে জানতো ফুলগুলো তার জন্যই নেয়া। ফুল গোলাপের ঘ্রাণ শুঁকে বলল,” কিন্তু আমার তো শিউলিফুল পছন্দের।” শুভর মুখে লাজুক কিন্তু আত্মবিশ্বাসী এক অভিব্যক্তি। ঠোঁটে চিরচেনা হাসি এনে বলল,” আজ না হয়, আমার পছন্দে নিজেকে রাঙিয়ে নাও।”
ফুল হাসলো। ফুলের তোড়া নিয়ে মাদুরে শুয়ে পড়লো। শুভ আশেপাশে থাকলে এতো প্রশান্তি আসে কেনো? জীবনটা রঙিন লাগে। সবকিছুই নতুন লাগে। অথচ ফুলের মধ্যে কতো পরিবর্তন এসেছে। শরীরের গঠন পরিবর্তন হয়েছে। মন মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। ফুলের মাঝে মাঝে মনে হয়, শুভ যেই ফুলকে পাগলের মতো ভালবাসতো সে তো ছিল কিশোরী মেয়ে। বর্তমানে শুভর সামনে থাকা ফুল তো পরিপূর্ণ নারী। শুভ কী এই ফুলকেও আগের মতো ভালোবাসবে? ফুল শুনেছিল, শহরের মেয়েটা অনেক আধুনিক। আধুনিকতার ছোঁয়া কী শুভর গায়ে লাগেনি? শহরের কোনো মেয়েকে কী মনে ধরেনি?
ফুল নিজের বোকা ভাবনায় হাসে। মনকে বোঝায়, তার শুভ এমন না। বাবুবর এখন ডাক্তার বর হলেও সবসময় ফুলকে ভালোবাসবে।
শুভ ও ফুলের সাথে নাফিস আর আরিফা গিয়ে বসলো মাদুরে। শুভ নিজের হাতে রান্না করা খাবার গাড়ির ডিকি খুলে বের করতে করতে বলল, ” নাফিস ধর এগুলো।”
নাফিস এগিয়ে এসে শুভকে সাহায্য করলো। একে একে কয়েকটি বক্স বের করল শুভ। কয়েক মিনিটেই খালি মাদুরের উপর হরেকরকম খাবারে সজ্জিত হয়ে গেল। তাছাড়া স্ন্যাকসের মধ্যে চিপ্স, চকলেট,বিস্কুটও এনেছে শুভ। নাফিস সবকিছু এনে মাদুরে বসলো। সর্বশেষ শুভ বড়ো একটি কেক নিয়ে মাদুরে বসলো। আলো জ্বালানোর জন্য মোমবাতি জ্বালালো। খাবারের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশ। এক মুহূর্তেই সবার মুখে আলাদা একটা উচ্ছ্বাস এনে দিল। ফুল নিজেই খাবারের বক্স খুলে খাবার দেখে নিল। ফুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিজে রাঁধলে?”
শুভ হেসে মাথা নাড়ায়। কেকের উপর মোমবাতি জ্বালিয়ে ফুলের সামনে আনলো। মুচকি হেসে বলতে শুরু করল,” অতীতের দুঃখ ভুলে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে তোমার সাথে বাঁচতে চাই, ফুল! দুখ সুখ মিলিয়েই তো জীবন। ছোট্ট এই জীবনে একটাই প্রত্যাশা। আমার সুখফুলের জীবনে সুখের আলো জ্বালিয়ে দিব। অনুমতি দিবে?”
ফুলের চোখ টলমল করছে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক ইশারা করে। এদিকে আরিফা হাত তালি দিয়ে যাচ্ছে। প্রিয় বান্ধবীর দুখের সময়ের সাক্ষী সে। সুখের সময়টায় এসে প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে তার মন। ফুল দেখল কেকের উপর লেখা, ‘ভালোবাসার অনন্ত যাত্রা।’
ফুল অবাক হলো।শুভ হেসে জানালো,” আমাদের নতুন পথচলার শুভেচ্ছা জানাই, ফুলবউ!”
শুভ ও ফুল দুজন মিলে কেক কাটলো। নাফিস খুশি হলো। মনের কোণে সেই আগের মতো খারাপ লাগা কাজ করে না। তার জীবনে ফুল ছিল না বরং আরিফা ছিল। আরিফাকে ফুলের ব্যপারে জানায়নি নাফিস। দরকার কী? নাফিস আরিফার সাথে সুখেই আছে।
খাওয়া-দাওয়া শুরু হতেই দুষ্টু-মিষ্টি কথোপকথনে ডুবে গেল চারজন। নাফিস আর আরিফা তাদের বিয়ের পরিকল্পনা নিয়ে গল্প করতে থাকলো। মাঝেমধ্যে শুভ আর ফুলকে নিয়ে ঠাট্টা করতে ভোলে না। ফুল কখনো মুচকি হাসে, কখনোবা লাজুকভাবে মাথা নিচু করে। শুভর দিক থেকে মাঝে-মধ্যে দারুণ কৌতুক বের হয়, যা শুনে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে।
বিয়ের আগে রাতে একসাথে থাকা দৃষ্টিকটু। নাফিস, শুভ ও ফুলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরিফাকে নিয়ে চলে গেলো। নাফিসরা চলে যেতেই নদীর ধারে এই সময়টা যেন একটু থমকে গেল। রাত যতই গভীর হচ্ছে, ততই চারপাশের নীরবতা তাদের কথার সুরে মিশে যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর ঢেউগুলো চকচক করছে, আর শুভর চোখে দেখা মিলে এক ধরনের অদ্ভুত তৃপ্তি। ফুলও তার হাসি দিয়ে রাতটাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলল। নদীর ধারের সেই রাতটুকু হয়তো সবার মনে একটা মিষ্টি স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। দুজন খোলা আকাশের নিচে মাদুরের উপর শুয়ে আছে। পাশাপাশি, একদম কাছাকাছি। ফুল, শুভর হাতের উপর শুয়ে আছে। শুভর দিকে ফিরে চাঁদের আলোয় শুভকে মনভরে দেখছে, ফুল। শুভ চোখ বন্ধ করে রেখেছে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ফুল এই সুযোগে তার ডাক্তারবরকে দেখে যাচ্ছে। ‘ডাক্তার’ পেশার ব্যপারটা স্মরণে আসতেই ফুলের সারিকার বলা কথা মনে পড়লো। সাগরিকা বলেছিল, শুভ নাকি একমাসের জন্য এসেছে। ফুলের মস্তিষ্কে বিষয়টা গেঁথে যাওয়ার পর থেকে শুভকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি। ফুল ভাবল, এখনই জিজ্ঞেস করে নিবে। ভাবনা অনুযায়ী ফুল মাথা তুলল। শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,” তুমি আর কতোদিন আমার কাছে থাকবে?”
বুজে থাকা চোখজোড়া হঠাৎ খুলে গেল। শুধু খুলে যায়নি বরং বড়ো হয়ে গেলো। মাথা তুলে ফুলের দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি কোথায় যাব?”
ফুল অভিমানী কণ্ঠে উত্তর দিল,” তুমি একমাসের জন্য এসেছো, ভাবী আমাকে বলেছে।”
শুভ মাথা মাদুরে রাখলো। তার দৃষ্টি দূর আকাশে। ফুল বুঝলো সাগরিকা সত্যি বলেছে। ফুলের মন খারাপ হয়ে গেলো। সে মাথা পুনরায় শুভর বুকে রাখলো। শুভর একটি হাত তখন ফুলের ঘন চুলে প্রবেশ করে। শুভ বলল,” আমি তোমাকে একা ছেড়ে কোথাও যাব না, ফুল। আমি যেখানে থাকব, তুমিও সেখানে থাকবে।”
ফুলের মনে প্রাণে দোলা খেলো। আনন্দে আত্মহারা হয়ে শুভর বুকে নাক ঘষলো। শুভর শরীর কেঁপে উঠলো। ফুলের চুলে রাখা হাতটার কাজ থেমে গেল। মনে নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগ্রত হলো। শুভ এই ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিতে চায়। ফুলকে নিজের করে পেতে চায় একান্তে, অতিমাত্রায়।
রাতের শেষভাগ। অদূরে মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। শুভ দেখল ফুল ঘুমায়নি। তার মতো রাতটা উপভোগ করেছে। শুভ ফুলের চুলে বিলি কে’টে বলে,” ফুল, আজকের রাতটা তোমার জন্যই এতো মধুর হয়েছে। তোমার অনুভূতি কেমন?”
ফুল মৃদু হেসে উত্তর দিল, ” আমার অনুভূতি আকাশ পরিমান। আমার জীবনে আসল বিশেষ কিছু তুমি। তুমি থাকলে চাঁদনী রাত আরো মধুর হয়ে উঠে।”
চাঁদনী রাত আরও গভীর হয়, আর ভালোবাসার আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
চলবে…………..