ইতি তোমার সুখফুল(দুখীফুলের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব-১৩+১৪

0
87

#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৩

অনেকদিন পর ফুল মনভরে নিঃশ্বাস নিতে ছাঁদে আসলো। ফুলের শাশুড়িও সে সময় ছাঁদে ছিল। ছাঁদে বেড়ে ওঠা গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল। ফুলকে প্রথম খেয়াল করেনি। ফুল শাশুড়িকে দেখতে পেয়ে পেছন থেকে ভয় দেখালো। সুইটি খানম ভয় পেল বেশ। হাতের খন্তা উঁচিয়ে তেড়ে আসলে ফুল দৌড়ে দূরে সরে গিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো। ফুলের শাশুড়ি সেই হাসি দেখে গলে গেল। খন্তা নামিয়ে কাজে মনোযোগ দিল। ফুল দোলনায় গিয়ে বসলো। অনেকদিন শাশুড়ির সাথে সুখ দুখের গল্প করা হয় না। ফুল ভাবলো শাশুড়ির মন ভালো করার জন্য কিছু করা দরকার। সে দোলনায় দুলে শাশুড়িকে প্রশ্ন করল,” কেমন আছো, মা?”

ফুলের শাশুড়ি অবাক হলেন। হওয়ারই কথা। সারাদিন ছেলেমেয়েদের সামনে থাকেন। ছেলেমেয়েদের সুখ দেখে তিনিও সুখী থাকেন। ফুল দেখলো তার শাশুড়ি অন্যরকম চোখে তার দিকে তাকাল। ফুল হেসে বলল,” বলো না, মা?”

ফুলের শাশুড়ি উত্তর দিলেন,” তোদের সুখে থাকতে দেখলেই আমি ভালো থাকি।”

ফুল আবারও হাসলো। দোলনা থেকে উঠে শাশুড়ির সাথে অনেক গল্প করল ও গাছগুলো পরিচর্যা করলো।

নিচে নামতেই ফুল দেখলো সাগরিকা সকলাের নাস্তা তৈরী করে রেখেছে। ফুল গুনগুন করে গান গেয়ে সাগরিকার কাছে আসলো। সাগরিকা তখন টেবিল সাজাচ্ছিল। ফুল পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে শাশুড়িকে করা প্রশ্নটাই করল,” কেমন আছো, ভাবী?”

সাগরিকা ফুলের হাত ধরে হেলেদুলে উত্তর দিল,” গত চার বছর একটু একটু খারাপ ছিলাম। এখন খুব ভাল আছি।”

ফুল দুষ্ট স্বরে আওড়াল,” ভাইয়ার কাছে থেকেও খারাপ ছিলে? কেনো, আদর কী এতো বছর কম করেছিল?”

সাগরিকা ফুলকে ছেড়ে পিঠে দুইটা ঘা বসিয়ে বলল,” বড়ো হয়েছিস না তো! বাঁদর হয়েছিস। কী নির্লজ্জ কথা!”

ফুল খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। আদিল আসলে ফুল একই প্রশ্ন করল,” কেমন আছো, ভাইয়া?”

আদিল অবাক হলো। পরমুহূর্তে যথাযথ উত্তর দিল। ফুলের ভীষণ ভালো লাগলো। পরিবারের মাঝে আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। সম্মান, ভালোবাসা পাওয়া যায়। ফুল সম্মানের সাথে অসীম ভালোবাসা পাচ্ছে।

———-

ফুলের সংগঠন শুরু করার পর থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে দুখী ও অসহায় মেয়েরা ফুলের কাছে এসেছে। ফুল তাদের জন্য সংগঠনের দুয়ার খুলে দিয়েছে। আজ সংগঠন শুরু করার পাঁচ মাস পূর্ণ হয়েছে। ফুল যখন একাহাতে শুরু করে তখন পকেট শূন্য ছিল। শাশুড়ি খরচ বাবদ নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিল আর সাগরিকা সাহস জুগিয়েছিল। দূরে থেকেও জায়গা নিয়ে আদিলের অনেকদিন ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। সবার পরিশ্রমের ফল আজ এই সংগঠন। সেলাই মেশিন কিনেছিল পাঁচটা। অসহায় মেয়েদের সেলাই, কাঁথা সেলাই, ব্লক প্রিন্টিং, এবং গয়না তৈরির মতো হাতের কাজ শেখানোর পাশাপাশি বেকারি পণ্য, আচার, এবং ফাস্ট ফুড তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, ফুল। কম্পিউটার অপারেশন, গ্রাফিক ডিজাইন, এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মতো আইটি স্কিলস শেখানোর জন্য আদিল শহর থেকে শিক্ষকের ব্যবস্থা করছে। ফুলেরও কম্পিউটার শেখা প্রয়োজন। এই সুযোগে সেও শিখে নিবে। বিউটি পার্লার ও শিশু যত্নের কাজেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে ফুলের। এগুলো আস্তে আস্তে করবে।

প্রায় তিনদিন পর ফুল সংগঠনে এসেছে। আজ পাঁচ মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে ফুল সংগঠনের নাম নির্ধারণ করবে। অফিসিয়ালি কাজ চলছে। জেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি না পেয়ে নিজের মতো সংগঠন পরিচালনা করা অন্যায়। আদিল দেশে আসার পর থেকে এই কাজের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে। শুভ সময় পেলেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে, কখনো কাগজে লেখালিখি করে মাঝেমধ্যে রাত জেগে বই পড়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে ভুলে না, সেটা হলো ফুলকে ভালোবাসা। গতরাত শুভর জীবনের প্রিয় রাতগুলোর মধ্যে একটি রাত ছিল। অবশ্য ফুলের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত শুভর কাছে প্রিয়।

শুভ এখনো ঘুমাচ্ছে। শুভকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই ফুল সংগঠনে এসেছে। অবশ্য আসার আগে সুন্দর একখানা চিঠি লেখে এসেছে। ফুল জানে, চিঠি পড়ে উড়ে শুভ চলে আসবে। ফুল কেবিনে বসে মুচকি হাসছিল। তার সামনের দুই চেয়ারে নীরব ও তৃণা বসে আছে। দুজন ফুলকে মুচকি হাসতে দেখে। দুজনেই জানে, ফুলের হাসির কারণ। তবুও নীরব প্রশ্ন করে বসলো,” আপা হাসছেন কেনো? সুন্দর কিছু মনে পড়েছে? আমাকে একটু বলা যাবে? আসলে আমি অনেকদিন ধরে হাসি না। হাসি না বললে ভুল হবে, হাসতে পারি না। সঙ্গে এমন একজনকে কাজের জন্য রেখেছেন যার সামনে হাসলেই মুখে আপনাআপনি পাগলা ঘোড়া ক্ষেপেছে কবিতা চলে আসে। যা রাগ! বাবাহ!”

তৃণা দাঁতে দাঁত চেপে নীরবের উদ্দেশে বলল,” মা’র খেতে না চাইলে চুপচাপ কাজকরেন আফসোসের বাচ্চা।”

আফজাল থেকে আফসোস নামটা কোন প্রেক্ষিতে তৃণা রেখেছে, নীরবের জানা নেই। তৃণা এই নামে ডাকলেই পৃথিবীর থেকে বিদায় নিতে ইচ্ছে করে নীরবের। গাল ফুলিয়ে, মুখ বাঁকা করেও লাভ হয়না। তৃণা ঐ নামেই ডাকে। প্রত্ত্যুত্তর দিল নীরব,” আমার এতো সুন্দর নামটাকে হত্যা না করলে ভালে লাগে না, তৃণা ম্যাডাম!”

তৃণা দাঁত বের করে হেসে বলল,” আপনার আফসোসময় জীবনে আফসোস নামটাই মানায়, আফসোস স্যার!”

নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়ে মানুষেরা বড়ো কাজের। ভালো কাজের সাথে আফসোসের কাজও করে থাকে। ফুল দুজনের খুনসুটি দেখে হা করে তাকিয়ে রয়। উত্তর দপয়, ” আমাকে কিছু বলেছিলে, নীরব?”

নীরব মাথা দোলায়। উত্তরের জন্য পুনরায় প্রশ্ন করে। ফুলের মুখাবয়বে তখন কঠোররূপ চলে আসে। সে টেবিলের উপর দুইহাত ভর দিয়ে বলে,” কাজের সময় আপনারা এসব করেন, নীরব? আমি আপনাদের ভরসায় সংগঠন ছেড়ে বাইরে যাই। আপনারা কাজকে এভাবেই অবহেলা করেন, তাই না?”

নীরবের মুখ এইটুকু হয়ে গেল। বুঝলো, তাদের আপা এখন রেগে আছে। নীরব সরি বলে কাজ শুরু করল।এদিকে তৃণা, নীরবের ভোঁতা মুখ দেখে হেসে ফেলল। ফুলও তখন তাল মেলালো। নীরন দুই নারীর হাসির কারণ বুঝতে না পেরে মাথা চুলকাতে থাকলো।

——————-

শুভর ঘুম ভাঙলো তিনটায়। একরাত না ঘুমিয়ে এতো সময় ঘুমিয়ে নিয়েছে সে। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়লো শুভ। আয়নার সামনে দাড়িয়ে মাথার এলোমেলো চুল গুছিয়ে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। বিছানার একাংশ ফাঁকা দেখে বুঝলো, ফুল তার সাথে ঘুমায়নি। মনে প্রশ্ন জাগলো, কোথায় গেল মেয়েটা? উত্তর পেলো না। একেবারে গোসল সেড়ে অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসলো শুভ। তখনই বালিশের পাশে চোখ যায় শুভর। একটি গোলাপ ফুল রাখা আছে সেখানে। ফুল হাতে নিয়ে দেখলো সেখানে একটি কাগজ পড়ে আছে।চুভর ঠোঁটের কোণে তখন হাসি ফুটে উঠলো।
ফুল লেখেছে,

প্রিয় ডাক্তারবর,

তোমার জন্য একটুকরো ভালোবাসার টুকরো পাঠাচ্ছি। শুনলাম, তোমার প্রিয় ফুল গোলাপ, তাই তোমার কাছে এই লাল গোলাপটি পাঠালাম। এই গোলাপটা আমার সেই ভালোবাসার প্রতীক, যা চার বছর আগে শুরু হয়েছিল এবং আজও ঠিক আগের মতোই সতেজ।

গতকাল নদীর পাড়ে তোমার সাথে কাটানো সময়টা ছিল সত্যিই বিশেষ। শান্ত নদীর কলকল ধ্বনি, বাতাসে ভেসে আসা জলছোঁয়া গন্ধ, আর তোমার পাশে বসে থাকা সব মিলিয়ে যেন এক পরিপূর্ণতা। গতকালের রাতটা ছিল আমার জীবনের প্রিয় রাতগুলোর একটি। তুমিই তো আমার দিনগুলোকে এমন সুন্দর করে তুলো।

তুমি জানো, শুভ, এই চার বছরে সময়ের গতিপথ বদলেছে, কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বদলায়নি। বরং প্রতিদিন তোমাকে নতুন করে ভালোবাসি।

তবে আজ একটা আবদার করতে চাই, আমার সংগঠনে কাজ নিয়ে কেমন যেন আটকে আছি। তোমার সঙ্গ ছাড়া আর ভালো লাগছে না। প্লিজ, আমাকে তোমার হাত ধরে এই জায়গা থেকে নিয়ে এসো। জানি, তুমি এসেছেই আমার জীবনে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

সবশেষে বলি, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার। আমাদের এই ভালোবাসা যেন চিরকাল অমলিন থাকে।

ইতি,
তোমার সুখফুল।

শুভ চিঠিতে চুমু দিল। টেবিলে বসে ফুলকে একটি চিঠি লেখল,

প্রিয় সুখফুল,

নিজেকে যখন এই নামে ডাকো মনে হয় তুমি পৃথিবীর সুখী নারী। অবশ্য আমি চাই, তুমি সবসময় সুখে থাকো। তোমার সুখে আমিও সুখ অনুভব করি।

শুনো ফুলবউ, তোমার কণ্ঠে বাবুবর ডাকটা বেশি মানায়, ডাক্তারবর ডাকলে নিজেকে বড়ো মনে হয়। ।অবশ্য আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি। আমরা বড়ো হয়েছি। আজ সেই বাবুবর থাকাকালীন যেভাবে চিঠি লেখতাম সেভাবে লেখতে ইচ্ছে করছে। তোমার সাথে চিঠিতে চিঠিতে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। ভাবছি, এখন থেকে তিনবেলা খাবার খাওয়ার পরিবর্তে চিঠি লেখব এবং সেটা পানিতপ গুলিয়ে খেয়ে ফেলব। এই যাহ! খেয়ে ফেললে তুমি চিঠি পড়বে কীভাবে?

আমার একটা আবদার আছে ফুল। একটা না দুইটা আবদার। প্রথমটা বলি, তুমি আমার সামনে বসে আমাকে চিঠি লেখবে। আমার মতো রোজ তিনবেলা চিঠি লেখবে। চিঠি লেখার সময় আমি তোমাকে মন ভরে দেখব। মাঝে মাঝে কিন্তু জ্বালাতনও করব।
এবার দ্বিতীয় আবদার বলি! তুমি মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যাও। আমি চাই, তুমও আরো বড়ো হও। কিন্তু এবার আমি তোমার হাত ছেড়ে দিব না। পাশে থেকে তোমাকে পড়াবো।

একটু দুষ্ট কথা বলি ফুল? আমি না! তোমার অনেক কিছুই খুব মিস করছি। তোমার সেই মিষ্টি কণ্ঠস্বর, যা শুনলেই মনে হয় সারা দুনিয়া থেমে গেছে, আর আমি শুধু তোমার কথাতেই ডুবে আছি। সেই কণ্ঠস্বরের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত শান্তি, আর তোমার প্রতিটি শব্দ যেন আমার হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

আমি তোমার শরীরের মাতাল ঘ্রাণ মিস করছি। আমার এখন তোমাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। তোমার ঘ্রাণ সবসময় আমার গায়ে থাকা চাইই চাই। তোমার কাছে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে আমার কাছে বিশেষ। তুমিহীনা জীবনটাই অসম্পূর্ণ লাগে।

তুমি যখন পাশে থাকো না, তখন এই ছোট ছোট অনুভূতিগুলো আরও বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। তোমার অস্তিত্বের সব ছোট্ট ছোট্ট জিনিস আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কতটা ভালোবাসি আমি। তোমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তোমার হাসি, তোমার কথা, তোমার গন্ধ; সবই তো আমার জীবনের একটা অংশ।

ফুলবউ, তোমার থেকে দূরে থাকলে আমি যেন এক অন্য পৃথিবীতে চলে যাই। আমার সব কিছু, সব কিছু শুধু তুমি। তোমার ছোঁয়া ছাড়া আমার জীবন যেন সুনসান, নিঃসঙ্গ।
আমি আসছি ফুল, কবে যেনো তোমার বিরহে পাগল হয়ে যাই। ভেবেছিলাম ঘুম ভাঙলে তোমাকে কাছে পাবো, কিন্তু!

আর লেখব না। আমি আসছি!

ইতি,
ফুলের পাগল বর।

শুভ সত্যিই পারলে উড়ে যায় ফুলের কাছে।

————-

সংগঠনে পৌঁছে শুভর চোখ ছানাবড়া। বাড়ির সকলেই সেখানে উপস্থিত আছে। তাড়াহুড়ো করে আসার সময় বাড়ির ভেতরে কে আছে কে নাই খেয়াল করেনি। এমনকি প্রাইভেট কার ছাড়াই সকলে চলে এসেছে যেনো শুভ কিছু বুঝতে না পারে। সংগঠনে ছোটোখাটো আয়োজন করা হয়েছে। পিয়ালকে নিয়ে আদিল দাড়িয়ে আছে।হয়তো শুভর জন্য অপেক্ষা করছিল।শুভ আসতেই ভেতরে নিয়ে গেল। পুরুষের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে গিয়ে দেখলো, নাফিস সহ অনেকেই উপস্থিত আছে। নাফিস চোখ কচলে এগিয়ে এসে বলল,” তোর বউকে কেনো বড়ো হতে বললি, শুভ! আমাকে সেই সকালে এনে কাজের লোকের মতো খাটালো।”

শুভ দাঁত বের করে হেসে উত্তর দিল,” প্রতিশোধ নিচ্ছে, বুঝলি? মেয়ে জাত মানেই প্রতিশোধের ভাণ্ডার।”

নাফিস ভাবনায় ডুবে গেলো। তার মনে পড়লো না ঠিক কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছে মেয়েটা। নাফিস তো তেমন কিছু করেনি। শুভকে জিজ্ঞেস করতে তখনই দেখল, শুভ সামনে নেই। দরজার কাছে চলে গেছে ছেলেটি। নাফিসের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বুঝালো, ” বোকা বানাইছি!”

নাফিস কপাল চাপড়াল। কে বলবে, এই শুভ কয়েকদিনের মধ্যে ডাক্তার হয়ে বেরোবে?

ফুলকে শুভ পেলো না কিন্তু বাহিরে সেলাই প্রশিক্ষণ ঘরের সামনে মা ও ভাবীকে দেখতে পেলো। দুজনই সুতি শাড়ি পরেছে।তবে আজকের শাড়ি অন্যরকম। খেয়াল করলে বুঝা যাবে, শাড়ির গায়ে সুঁইসুতার কাজ করা। শুভ কাছে আসতেই সুইটি খানম ছেলের উদ্দেশে বললেন,” এসেছিস, বাবু? দেখ তো! শাড়িটা কেমন হয়েছে? ফুল উপহার দিয়েছে। ওর মেয়েরা নিজের হাতে শাড়িতে কাজ করেছে।দেখ তো! কেমন হয়েছে?”

শুভ এবার বুঝলো, কেনো তার কাছে অন্যরকম লাগছিল। চমৎকার কারুকাজে শাড়িটাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শুভ খুশি হলো। সুইটি খানমের চোখজোড়া চিকচিক করছে আনন্দে। সন্তানের প্রথম উপার্জনের টাকায় কেনা পোশাক পরলে যেমন আনন্দ হয় ঠিক তেমন আনন্দ হচ্ছে। শুধু শুভর মা নয়, আগন্তুক সকলকেই ফুল মেয়েদের হাতে করা কারুকাজের পোশাক দিয়েছেন। শুভ ফুলের তাদের জন্য গর্ব হল।

শুভ ফুলকে দেখতে পেলো অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পূর্বে। ফুলের হাতে একটি শপিং ব্যাগ ছিল। শুভকে দেখামাত্রই হাসিমুখে এগিয়ে আসলো। শুভর মনে হলো, তার হৃৎস্পন্দন কিছু সময়ের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিল। ফুলও শাড়ি পরেছে। চোখে আজ চশমা পরেছে। মুখে কৃত্রিম কোনে সাজসজ্জা নেই অথচ অপূর্ব লাগছে। শুভ শুঁকনো ঢোক গিলে নেয়। ফুল কাছে আসা মাত্রই নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়ায়, ” এটা তোমার জন্য। ঝটপট পরে ফেলো দেখি?”

শুভ আশেপাশে তাকিয়ে উত্তর দিল,” এখানেই পরতে হবে?”
ফুল বলল,” জামা খুলতে সমস্যা কই? আমি কী পরনারী?”

শুভ বিড়বিড় করে বলল,” তুমি তো আগুন নারী। এক ঝলকে শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া নারী। আমার মনকে ভস্ম করে দেওয়া নারী।”

ফুল হাসলো। হাতের ইশারায় পোশাক পালটানোর স্থান দেখালো। শুভ যাওয়ার আগে ফুলের হাতে চিঠি গুঁজে দিয়ে চলে গেল।

জেলা প্রশাসন থেকে লোকজন এসেছেন। তারা পুরো সংগঠন ঘুরে উদ্যোগদাতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। অফিসিয়ালি ফুল সংগঠন চালাতে পারবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। ফুলের সংগঠনের নামকরণ করা হলো, ” প্রেরণা সংঘ” যেখানে অনেক অনেক মেয়েরা জীবন যাপনের অনুপ্রেরণা পায়।

———————–

তৃণা ও নীরবকে দায়িত্ব বুঝিয়ে ফুল বাড়ি ফিরে এলো। এই সপ্তাহে নাফিস ও আরিফার বিয়ে। আগামীকাল থেকেই আরিফার সাথে ফুলের থাকতে হবে। ফুলের এতো সময় কই? কাজের চাপে আজ শুভকেও সময় দেয়া হয়নি।

রাত তখন দশটার ঘরে। ক্লান্ত শরীরে ফুল নিজের ঘরে আসে। কাঁধের ব্যাগ পাশে ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। গায়ের শাড়ি পরিবর্তন করার ইচ্ছে নেই, ফুলের। এভাবেই ঘুমিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। ফুল মাথা উঁচিয়ে শুভর ঘরের দিকে তাকালো। ঘরের বাতি বন্ধ দেখে বুঝলো, তার ডাক্তারবর ঘরে ফিরেনি। একসাথে পুরো পরিবার বাড়ি ফিরলেও ফুল প্রথমে ঘরে আসেনি। নিচে শাশুড়ির সাথে সময় কাটিয়ে উপরে এসেছে। ফুল পাশফিরে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে গেল।শুভ তো তার ঘরেই চেয়ারে বসে আছে। ক্লান্ত থাকায় ফুল খেয়াল করেনি। শুভ হেসে ফুলের দিকে আগালো। ফুল নিজের এলোমেলো শাড়ি ঠিক করতে তখন ব্যস্ত ছিল। ফুল শাড়ি ঠিক করতে চাইলে শুভ বাঁধা দিল। ফুলের পেটের কাছের শাড়ি নিজ দায়িত্বে ঠিক করে পাশে শুয়ে পড়লো। ফুল তখন নাড়াচাড়া করছিল কিছু ভয় ও কিছু সংশয়ের কারণে। শুভ বুঝে মুচকি হেসে বলল,” আমাকে ভয় পাচ্ছে?”

ফুল নাড়াচাড়া থামিয়ে বলল,” ভয় নয়, লজ্জা করছে।”

” লজ্জা পাওয়ার কারণ?”

ফুল দুইহাতে মুখ ঢেকে বলল,” তোমার নির্লজ্জ ঐ চোখজোড়া। আমাকে নিস্তেজ করে ফেলে। মনে হয়, অন্য জগতের হারিয়ে যাচ্ছি।”

শুভ মাথা উঁচিয়ে ঢেকে রাখা হাতজোড়ার উপর ঠোঁট ছোঁয়ায়। ফুল তখন হাতজোড়া নিচে নামিয়ে চোখ বের করে রাখে।শুভ চোখজোড়ায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,” তুমি আমার দেখা প্রিয় সর্বনাশ।”

ফুল লজ্জায় নুইয়ে পড়লো। শুভ ফুলের পাশ থেকে উঠে বিছানা ছাড়লো। ফুল ভাবলো, হয়তো রাগ করেছে মানুষটা। পিছন থেকে ডাকলো ফুল, ” কোথায় যাচ্ছো?”

শুভ স্বাভাবিক সুরে উত্তর দিল,” ঘরে যাচ্ছি। তুমি বিশ্রাম নাও।”

ফুল তখন ভয়ংকর কথা বলে ফেলল,” আজ রাত আমার ঘরে থেকে গেলে হয় না?”

শুভর পা জোড়া থেমে গেল। শরীর ঘুরিয়ে ফুলের দিকে তাকালো। প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” ভেবে বলছো তো?”

ফুল মিনমিন করে বলে,” এতে ভাবাভাবির কি আছে? আমরা তো প্রেমিক প্রেমিকা না। স্বামী স্ত্রী। আসো তো?”

” শুনেছি, স্ত্রী যদি আহ্বান করে তবে পরিপূর্ণভাবেই আহ্বান করে। স্বামী তখন প্রকাশ্যে আহ্বান ফেলতে পারে না। আমিও পারলাম না, আদরবউ। আজকের রাতের জন্য পরিপূর্ণ দোষী শুধুই তুমি, বলে রাখলাম।”

ফুল চোখ বড়ো করে ফেলল। শুভর ঠোঁটে তখন দুষ্ট হাসি। কথা বলা শেষ করে ঘরের দরজা আটকে দিল। এদিকে ফুল ভাবতে লাগল, শুভ কোন আহ্বানের কথা বলল!

চলবে……….

#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৪

নাফিসের সাথে ফুলের এত বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। অথচ গুনে গুনে নাফিসের বাড়িতে ছয়বার আসা হয়েছে ফুলের। একবার সেই কলেজ জীবনে। শুভ নিয়ে এসেছিল। বাকী পাঁচবার আরিফার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে এসেছে। তাছাড়া ইদানীং নাফিসের মায়ের সাথে ভালো সখ্যতা তৈরী হয়েছে, ফুলের। মুঠোফোনেও কথা হয় সময় করে। শুভকে দেখবে বড্ড মন ভদ্রমহিলার। আজ নাফিস ও আরিফার হলুদ। দুই বাড়িতে একদিনই হলুদের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। সকাল সকাল ফুল গোসল সেড়ে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছে নিল ফুল। বিছানায় শুভ উপুড় হয়ে বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে। ফুল, শুভকে ডাকলো না। পরিপূর্ণ ঘুম হলে নিজেই জেগে যাবে।
ফুল শাড়ি নিয়ে শাশুড়ির ঘরের দিকে ছুটলো। শাশুড়ির হাত থেকে শাড়ি পরতে পরতে নিজের শাড়ি পরতে ইচ্ছে করে না। সুইটি খানম ঘরের ফার্নিচার পরিষ্কার করছিলেন।ফুলকে দেখে হাতের কাজ ফেলে সুন্দরকরে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। সাগরিকা শাশুড়ির ঘরে এসে ফুলকে দেখে হা করে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা দারুণ লাগছে। সাগরিকার মাঝে মাঝে ফুলের সাথে খুব হিংসা হয়। এতো আদুরে মেয়েটা! ওর জায়গায় সাগরিকা হলে আসমান ছুঁয়ে দিত।অথচ মেয়েটা একদম সরল। সবসময়ের মতো চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে দিল ফুলের শাশুড়ি। চুলগুলো খোলা রাখলো। ফুলই খোলা রাখতে বলল। শুভর খোলা চুল পছন্দ। সুযোগ পেলেই ফুলের চোখে মুখ ডুবিয়ে দেয়, ফুল সেই সময়টা খুব উপভোগ করে।

সাজগোজ শেষ করে উপরে গেল, ফুল। শুভর সাথে বেরোবে অথচ জনাবের ঘুম ভাঙার নাম নেই। ফুল শুভর পাশে বিছানায় বসলো। শুভর মাথার ঘন চুলে হাত চালিয়ে আস্তেধীরে ডাকলো। শুভ চোখ মেলে সাজসজ্জায় মোড়ানো ফুলকে দেখে বুকে হাত রাখলো। ফুল বেশ লজ্জা পেল। শুভ আধো চোখে ফুলের উরুর উপর মাথা রাখলো। অস্পষ্ট সুরে বলল,” তুমি সুমন্দভাষিণী, আমার মনের রাণী। মিষ্টিভাষায় ডাকা পাখি।”

ফুল লজ্জা পেলেও নিজেকে সামলে নিল। শুভর মাথার চুলগুলো জোরে টেনে বলল,” ডাক্তাররা কবিও হয় বুঝি! উঠো না! নাফিস অপেক্ষা করছে।”

শুভ নড়েচড়ে ফুলের পেটে মুখ গুঁজে উত্তর দিল,” মিথ্যা বলিনি।”
” হয়েছে, এবার উঠো।”

শুভ উঠলো না। ফুলকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,” তোমাকে সুন্দর লাগছে, ফুল। মনে হচ্ছে, এক পবিত্র ফুলকে ছুঁয়ে দিয়েছি।”

ফুল, শুভর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,” তুমি সবসময় সুন্দর। আমার মনের মতো,আমার শুদ্ধ পুরুষ।”

দুজনের দুষ্ট মিষ্টি মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দী করে রাখলে মন্দ হতো না কিন্তু কে করবে, শুনি?
——————-

নাফিসের বাড়ি ছিল একটু পুরনো আমলের, বড় উঠোনে নারকেল ও আমগাছ ছায়া দিয়ে আছে। গাছের নিচে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আলপনা করা মঞ্চ। মঞ্চে বসে আছে নাফিস, তার পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা আর গলায় ফুলের মালা। চারপাশে সবাই খোশ মেজাজে। শুভ ও ফুল একসঙ্গে হাজির হল। শুভ কিছুটা শান্ত, কিন্তু ফুল বেশ চনমনে। বাড়িতে প্রবেশ করে খুঁজে খুঁজে নাফিসের মাকে ধরে আনলো। ভদ্রমহিলার হাতে এক ঝুড়ি ফল ধরিয়ে দিয়ে বলল,” আমার সে এসেছে, আন্টি! দেখবে না?”

ভদ্রমহিলা ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে দূর থেকে শুভকে দেখলো। শুভর দিকে তাকিয়েই ফুলের বাহু ঝাঁকিয়ে বলল,” তোর স্বামী তো একেবারে সিনেমার নায়ক রে, ফুল!”
ফুল লজ্জা পেলো। গাঢ় চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো। নাফিসের মায়ের চোখ যায় ছেলের দিকে। আজ তার ছেলেও খুব খুশি। ছেলের বিয়ে হবে নাফিসের মাও খুশি। ফুলের দিকে তাকালো নাফিসের মা। মনে পড়লো ছেলের কলেজের জীবনের কথা,

কলেজে পড়াকালীন উনার ছেলে একদিন মায়ের কাছে বাদাম ভাজার আবদার করতো তো আরেকদিন সুঁই সুতা চাইতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো, বকুল ফুলের মালা গাঁথবে। নাফিসের মা তখন ভাবুক নয়নে তাকিয়ে থাকতো। কোনোদিন তো কৌটায় থাকা দুইয়ের অধিক বিস্কুট লুকিয়ে নিয়ে যেতো। শুরুতে নাফিসের মা বুঝতে না পারলেও একদিন বুঝে ফেলে। ছেলেকে হাজারবার প্রশ্ন করার পর ফুলের কথা জানালো। নাফিস সেদিন প্রথম তার মাকে ফুকের প্রতি দুর্বলতার কথা জানায়। একমাত্র নাফিসের মা জানতো, নাফিস ফুলের প্রতি দুর্বল। যেদিন নাফিস শুনলো, ফুলের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে সেদিন সে কি কান্না! নাফিসের মা সেদিন প্রথম ছেলের মন ভাঙার কান্না দেখেছিলেন। দিনের পর দিন চোখের সামনে ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখেছেন। এরপর একদিন বলল আরিফার কথা। ফুলের বিয়ে হয়েছে রাজপুত্রের মতো ছেলের সাথে।সেখানে ফুল সুখী ছিল। নাফিস মেনে নেয়। আরিফার কথা জানায়।নাফিসের মা সেদিনই আরিফাকে আংটি পরিয়ে আসেন। ছেলেকে নিয়ে ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না তিনি।

আজ ফুল ও শুভকে দেখে অনুধাবন করলেন, ফুল তার স্বামীর সাথে সুখে আছে। নাফিসের ভাগ্যে ফুল ছিল না। ফুলকে তো শুভর সাথেই মানায়।

নাফিসের কাছে ফুল আসলো অনেক পরে। নাফিস মঞ্চে বিরক্ত হয়ে বসেছিল। বন্ধুরা মিলে শীতের মধ্যে একপালা হলুদ লাগিয়েছে নাফিসকে। ফুল ঢুকতেই বলে উঠল, “আরে নাফিস ভাই! তোমাকে তো মনে হচ্ছে হলুদ ছোঁয়া নয়, হলুদ দিয়ে গোসল করিয়ে ফেলেছে!”

নাফিস বিরক্ত হয়ে বলল, ” সব তোর বদ বরের কাজ।”
ফুল বলল,” একদম আমার বরকে উলটা পালটা বকবি না। আমার বর খুব ভালো।”
” ছাই ভালো। ঐ শুভ একটা মিচকে শয়তান। দেখতে বাঁদরের মতো।”
ফুল গাল ফুলিয়ে রাখলো। নাফিসের সামনে রাখা হকুদের বাটি নাফিসের মাথায় ঢেলে দিল।

উপস্থিত সকলের মধ্যে হাসির রোল পড়লো। এদিকে, শুভ মজা করে নাফিসের পাশে গিয়ে বসে বলল, “ভাই, আমার হলুদের সময় তুই ভুলেও কাছে থাকবি না। আমার বউয়ের করা কাজের প্রতিশোধ তো নিবিই না। বল নিবি না!”

নাফিস চোখ ছোট করে বলল,” তোর মুখে হলুদ মাখার আগে এক বালতি পানি মেরে দিব তারপর হলুদ লাগাবো। পানির কল বন্ধ করে রাখবো যেনো গোসল করতে না পারিস। শালা আমাকে বলদা পেয়ে তুই আর তোর বউ হলুদে ডুবিয়েছিস।”

সবাই হেসে উঠল। কিছুক্ষণ পর নারীরা নাচে-গানে মেতে উঠল। একজন গান ধরল,
” হলুদ বাটো মেহেদী বাটো!”

ফুল এক পিস মিষ্টি নিয়ে নাফিসের মুখের সামনে ধরল। নাফিস হা করতে নিতেই সরিয়ে ফেলল ফুল। সকলে হাসতে লাগল। কয়েকবার মজা করার পর নাফিস ফুলের হাত ধরে মিষ্টি খেয়ে ফেলল। ফুল তখন বলল,” নতুন জামাই দেখি রাক্ষস বের হয়েছে। এই জামাইয়ের হাতে আমাদের মেয়েকে দিব না।”

নাফিস চোখ ছেট করে বলল,” মীরজাফরের নানী! তুই কবে থেকে মেয়ে পক্ষ হলি?”

ফুল উত্তরে বলল,” ছেলেদের বাড়িতে আমি মেয়েপক্ষ। আর মেয়েদের বাড়িতে ছেলে পক্ষ। দুই পক্ষেই আমি আছি।”

ফুলের কথদ শেষ হতেই আবার সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। গানে-আনন্দে হলুদের মঞ্চ কাঁপছে। নাফিস এক পর্যায়ে উঠে গিয়ে শুভকে বলল, “শুভ, তুই কিন্তু আরিফার হলুদে তোর বউকে কাছে যেতে দিবি না। তোর বউ হলো ঘরের শত্রু। দেখা যাবে আমার বউয়ের কানে আমার বিরুদ্ধে ফুসলিয়ে দিচ্ছে।

শুভ ফিসফিস করে বলল,” আমি এসবে নেই। আমার বউয়ের হাত থেকে আরিফা বেঁচে গেলেই ভালো। ফুল যদি বেশি দুষ্টুমি করে তবে আমার দোষ দিতে পারবি না।

নাফিস কপালে হাত রাখলো। কপালেও বেশিক্ষণ হাত রাখতে পারল না, বন্ধুরা মুখের কোনো অংশ ফাঁকা রাখেনি। আপাতত, নাফিসের চিন্তা হচ্ছে আরিফাকে নিয়ে। ফুল নাফিসকে বেশি হলুদে ডুবাতে না পারলেও আরিফাকে ডুবাবে। এই চিন্তা সেই চার বছর আগে থেকেই করা। নাফিস আরুফার কাছে শুনেছে। নাফিস বিড়বিড় করল,” এ যাত্রায় আমার চঞ্চলতা বেঁচে গেলেই হয়।”

———————

নাফিসের হলুদ শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সবাই চলে গেল আরিফার বাড়িতে। আরিফার বাড়ির উঠোন রঙিন আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে। সামনে প্যান্ডেলে সাজানো মঞ্চে বসেছে আরিফা। তার পরনে গাঢ় হলুদ শাড়ি, আর মাথায় ফুলের টায়রা। শুভ আর ফুল ঢুকতেই আরিফা চেঁচিয়ে উঠল, “তোমাদের দুইজনকে দেখে মনে হচ্ছে, নাফিসের হলুদে বেশি মজা করেছ!”

ফুল বাঁকা হেসে চোখ টিপে বলল, ” বান্ধবী, তোর বরের জন্য খুব কষ্ট করে হলুদের রঙ বানিয়েছি, বেচারাকে লাগাতেই পারিনি। এলার্জি আছে বলল। তুইও কী এমন করবি? বান্ধবীকে ঠিকমতো লাগাতে দিবি তো?”

আরিফার সন্দেহ হলো। নাফিসের হলুদে এলার্জি নাই। ফুল নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে। আরিফা বলল, “তোর মনে কোনো ভয়ংকর পরিকল্পনা চলছে, ফুল। আমি আগেই সাবধান করে দিচ্ছি, ফুল! বেশি হলুদ লাগাবি না। কাল কিন্তু পার্লারে সাজতে যাব। ”

এদিকে, ফুল একটা থালা নিয়ে এগিয়ে গেল। থালায় হলুদ, পানপাতা, আর কি যেনো মেশানো আছে। ফুল হাতে সামান্য নিয়ে বলল, “এটা ঐতিহ্যগত ভাবে তোর দুই গালে লাগাতে হবে, নইলে হলুদ জমবে না।”

আরিফা মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে থাকলো, তুই নিজেই লাগা, বান্ধবী। এই শুভ, তোর বউকে বাড়ি নিয়ে যা। আমাকে বাঁচা।”

আরিফা না করতে করতে এই সময় নাফিস উপস্থিত হলো। তার মুখে হলুদের আবরণে ঢাকা। মুখে পানি ছিটিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে চলে এসেছে। নাফিস মঞ্চের দিকে এসে চিৎকার করে বলল, “সবাই শুনে রাখো, এটা শেষবারের মতো সিঙ্গেল বউয়ের সাথে হলুদ লাগানোর সুযোগ। পরে শুধু বরের অধিকার! আমার স্পেশাল বান্ধবী ছাড়া সবাই বউকে হলুদ লাগাতে আসো।”

আরিফার বাড়ির উঠোনে হইহই করে হাসির রোল পড়ে গেল। এক পর্যায়ে, ফুল আরিফার হাত ধরে বসে বলল, আরিফা, তুই কিন্তু চিটিং করছিস। নাফিসকে আসতে বললি কেনো?”
আরিফা উত্তরে বলল,” আমি বলতে যাব কেনো? তোর বন্ধু তুই এনেছিস। এখন আমাকে দোষ দিচ্ছিস।”

ফুলের ভাবনার উপর নাফিসকে এভাবে পানি ফেলতে দেখে ফুল হলুদের বাটি নাফিসের মাথায় ঢেলে দিল। শুভ তখনই হেসে ক্যামেরা বের করে বলল ” গ্রুপ ছবি হয়ে যাক!”

ফুল গাল ফুলিয়ে আরিফার পাশে বসে পোজ দিল। আরিফা নাফিসের দিকে তাকিয়ে হেসে। আর নাফিস! সে মাথায় দুই হাত রেখে পোজ দিল তখনই শুভ ছবি তুলল।
হাসি মজার মাঝেই হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো।

গানের তালে নাচ আর মজার কথাবার্তায় রাত গভীর হলো। শুভ, ফুল, নাফিস, আর আরিফা মিলে ছবি তুলল। শুভ মজা করে বলল,” “এই ছবিগুলো আমাদের ছেলেমেয়েদের দেখি বলব, দেখ বাচ্চারা আমর কতো ভদ্র ছিলাম।”
সবাই মিলে হেসে দিনশেষে ঘরে ফিরল। দুই বাড়ির গায়ে হলুদ হয়ে উঠল স্মরণীয়!

———————

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে ফুল আর শুভ বাড়ি ফিরছিল। শীতের রাত, চারপাশে হালকা কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাস। গাড়ি থাকা সত্ত্বেও দুজনেই হেঁটে ফিরছিল। গাড়ি ড্রাইভার নিয়ে সামনে আগাচ্ছে। ফুলের হাতজোড়া শুভর বাহু জাপটে ধরেছে। ফুল প্রফুল্লচিত্তে বলল, “গাড়ি না নিয়ে হাঁটার মজাই আলাদা। কতদিন পর এভাবে গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটছি!”

শুভ ফুলের আনন্দ দেখে হেসে উত্তর দিল, ” ঠিক বলেছ। এই শীতের মিঠে বাতাস, আর তার সাথে তোকে পাশে পাওয়া, এটার মতো শান্তি আর কোথাও নেই।”

ফুল একটু হেসে নুয়ে পড়ল, শুভর হাত ধরল। রাস্তার পাশেই ছোট একটা দোকানে একজন মহিলা চিতই পিঠা বানাচ্ছিল। খড়ের আগুনে মাটির হাঁড়ি থেকে ভুরভুর করে ভাপ উঠছিল। ফুলের চোখ চকচক করে উঠল। ফুল হাত উঁচিয়ে বলল, “ওই দেখো, পিঠা! খাই না?”

শুভ মজার ছলে বলল, “তুমি আর পিঠা? এই তো নাফিসের বাড়িতে কতো কিছু খেয়ে আসলে। জায়গা আছে তো?”

ফুল গাল ফুলিয়ে বলল,” এটা চিতই পিঠা। আলাদা জিনিস! এইটুকু জায়গা আছে তে!”

দুজনে দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। মহিলা হাসিমুখে তাদের বসতে বলল। ফুল শুভ গা ঘেঁষে বসলো। মহিলাটি দেখে বলল, “মনে হচ্ছে নতুন দম্পতি! এমনিতে শীতের রাতে এখানে কেউ খুব বেশি আসে না।”

ফুল লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলল। শুভ মুচকি হেসে বলল, ” চাচী, দম্পতি হোক বা না হোক, পিঠা কিন্তু ভালো বানাতে হবে!”

মহিলা একটা নতুন বানানো চিতই পিঠা আর গুড় এগিয়ে দিল। ফুল এক কামড় দিয়ে বলে উঠল, “আহা! এর স্বাদই আলাদা। শুভ,খেয়ে দেখো তো!”

শুভ পিঠা খেতে খেতে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “পিঠার চেয়ে তুমি বেশি মিষ্টি।”

ফুলের মুখে তখন গুড় লেগে ছিল। শুভ মজা করে গুড়ের উদ্দেশে বলল, ” ঐ ঠোঁট শুধুই আমার। আমার জায়গায় তোর কি কাজ গুড়? আয় আমি মুছে দিই?”

ফুল লজ্জায় চুপ হয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর শুভ তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “জানো ফুলবউ, তোমার হাসি শীতের রাতেও গরম এনে দেয়। তুই এমন মিষ্টি হাসি দিলে আমি সারাজীবন এভাবেই হাঁটতে পারি।”

ফুল চুপচাপ বসে রইল, তারপর লজ্জায় মাথা নুয়ে মাটির দিকে তাকাল। শুভ আবার বলল, “আমি তোমার পাশে থাকতে চাই এভাবেই। সব সময়।”

ফুলের চোখে একটুখানি জল চিকচিক করে উঠল, কিন্তু সে তাড়াতাড়ি সেটাকে লুকিয়ে হাসল।

পিঠা খাওয়া শেষে দুজনেই দোকানদারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল। রাত গভীর হলেও রাস্তার শীতল বাতাস আর তারার আলো যেন আরও উজ্জ্বল লাগছিল। শুভ আর ফুল পাশাপাশি হাঁটছিল, আর এই মায়াময় রাত তাদের জীবনে নতুন এক সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি হয়ে রইল।

চলবে……..