ইতি তোমার সুখফুল (দুখীফুলের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব-০৭

0
91

#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৭

সূর্যের রশ্মি পৃথিবীতে পড়ে। আলোর আভায় ভরে ওঠে সমস্ত প্রকৃতি। ঘাসের কণা থেকে শিশির ঝরে পড়ে রূপার মতো, পাখিদের কিচিরমিচিরে দিন শুরু হয়। মানুষের ঘুম ভাঙে নতুন আশায়, নতুন উদ্যমে। সূর্যের প্রতিটি রশ্মি যেন মনে করিয়ে দেয়, অন্ধকার যত গভীরই হোক, আলো আসবেই। জীবন ঠিক এভাবেই এগিয়ে যায়—উঠে দাঁড়ানো, আলো ছড়ানো।

ফুলের জীবনের আরো একটি দিনের সূচনা ঘটলো। সকাল সকাল ফুল রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল।
এই সময়ে ফুলের প্রিয় বান্ধবী আরিফা ঢাকঢোল পিটিয়ে বাসায় আসলো। মুখভরা হাসি, চোখে দুষ্টু চাহনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে উঠলো, “কি রে ফুল, এত চুপচাপ কেন?”

সঙ্গে থাকা মিষ্টির বাক্সটা টেবিলে রেখে বললো, “চা বানা ফুল, আজ তোর জন্য একটা বড়ো খবর নিয়ে এসেছি!”

তার উদ্দীপনা দেখে মনে হলো যেন পুরো বাড়িটাই তার আনন্দে নেচে উঠেছে। ফুলের শাশুড়ি ঘড় থেকে বের হয়ে আরিফাকে দেখতে পেয়ে খুশি হলো। আরিফা লম্বা সালাম জানিয়ে ফুলের শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে মিষ্টির বক্স খুলে একটা মিষ্টি সুইটি খানমের মুখে ঢুকিয়ে দিল। সুইটি খানম কোনরকম মিষ্টি গিলে প্রশ্ন করল,” কি উপলক্ষে মিষ্টি খাওয়ালি রে আরিফা? বিয়েটি ঠিক হয়ে গিয়েছে নাকি?”

রান্নাঘর থেকে ফুল বের হয়ে ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন করল,” এই যে, তোর মুখটা দেখেই বুঝতে পারছি, আবার নতুন কোনো বুদ্ধি নিয়ে এসেছিস। জলদি কারণটা বল!”

হাসতে হাসতে আরিফা বলল, ” আমাকে দেখে তোর এতো খারাপ মনে হয়?”

” তুই কি জানিস, তোর মতো বান্ধবী থাকলে শত্রুর প্রয়োজন হয় না? চল, তাড়াতাড়ি বল, এবার কি ফন্দী আঁটলি?”

আরিফা চোখ টিপে বলল,” উপরে চল, সব বলব।”

ফুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরে উঠলো। সুইটি খানম হাসলো। আরিফা প্রায় সময় এবাড়িতে আসে। ফুলের সাথে সময় কাটায়। সুইটি খানমকেও খুব ভালোবাসেন। ফুল ও তার শাশুড়ি ব্যতীত বাড়ির কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। দীর্ঘ পথ জার্নি করে আসার জন্য তাদের ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হয়ে যাচ্ছে। ফুল চাপা নিঃশ্বাস ফেলে আরিফাকে নিয়ে উপরে আসলো। সে জানে মেয়েটা কেনো নিচে থাকেনি।গতকাল রাতের জন্য নিশ্চয়ই ওকে জ্বালিয়ে মা’র’বে এটা সেটা প্রশ্ন করে!

আরিফাকে নিয়ে নিজের ঘরে আসতে দেখে আরিফা প্রশ্ন করল,”তুই কি এই ঘরেই ছিলি? তোদের মাঝে গতকাল কিছু হয়নি? নাকি আদর বেশি হয়ে গেছে? এই, তোর মুখটা এমন লাল টমেটো হয়ে আছে কেনো?”

ফুলের মনে হলো, কেউ তার সারা অঙ্গে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আরিফা তো এমন ঠোঁটকাটা স্বভাবের ছিল না। হঠাৎ কি হলো? এক চুমুতে কী মেয়েটার স্বাভাবে পরিবর্তন এনে দিলো? ফুল বলল,” তুই এতো নির্লজ্জ হলি কবে থেকে, আরিফা? গতকাল রাত থেকে যা তা বকে যাচ্ছিস।”

” আমি কিন্তু জানতাম যে, শুভ গতকাল আসবে কিন্তু আমার ফোনকলে থাকা অবস্থায় চলে আসবে জানলে!”

ফুল ভাবলেশহীন হয়ে উত্তর দিল,” জানালে ক্ষতি হতো না রে! আমি বরঞ্চ আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিতাম।”

ফুল কথোপকথনের পর্বটাকে আমিষহীন বানাতে চাইলেও আরিফা হতে দিল না। সে এক চামচ মসলাগুঁড়া ঢেলে দিল তার কথার দ্বারায়,” কি রে ফুল! বললি না কোথায় কোথায় চুমু খেলি?”

ফুল আরিফার পিঠে দুটো ঘা বসিয়ে বলল,” তুই খেয়েছিস বলে কী আমারও খেতে হবে? বাজে বকিশ না, আরিফা। আমাদের মধ্যে ঐসব কিছুই হয়নি।”

” আমাদের মধ্যে ঠিক কী হয়নি? কি নিয়ে আলোচনা করছো, ফুল?”

ফুল শুঁকনো বিষম খেলো। আরিফার মুখ খানা এক হাত পরিমাণ হা হয়ে গেল। শুভকে দেখে কণ্ঠনালীতে আপনাআপনি আসল,” এই নায়ক কই থেকে আসলো?”

শুভ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। তার আপাতদৃষ্টি ফুলের দিকে নিবদ্ধ। ফুলের বলা গতকাল রাতের একটি কথাও তার উপর প্রভাব ফেলেছে কী সন্দেহ রইলো। আরিফা জবাব দিল, ” কেমন আছো, শুভ?”
” ভালো। তোমার বান্ধবীকে জবাব দিতে বলো,আরিফা। আমাদের মধ্যে কি হয়নি, বলতে বলো।”

ফুল রাগী চোখে শুভর দিকে তাকালো। শুভর মুখে তখনো দুষ্ট হাসি লেগে আছে। ফুল দেখল, শুভকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে। চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছে অনেকদিন পর তৃপ্তির ঘুম হয়েছে। কিন্তু ফুল তো ঘুমাতে পারেনি। দীর্ঘ চার বছর তার ঘুম হয়নি। ফুল উত্তর দিল,” আঁড় পেতে কারো কথা শোনা ঠিক না। বিশেষ করে মেয়েদের পার্সোনালা কথাগুলো।”

শুভ স্বাভাবিক সুরে উত্তরে বলল,” আমি তো তোমার পার্সোনাল মানুষ। আমার থেকে কীসের লুকোচুরি, ফুল?”

আরিফার মনে হলো সে ভুলক্রমে কোনো অভিমানের পাল্লায় ঝুলে পড়েছে। যেখানে একপাল্লা ভারী অপর পাল্লা হাল্কা। দুইজনের মধ্যে কারটা ভারী আর কারটা হাল্কা বুঝা মুশকিল।
আরিফা বলল,” আমি চুমুর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। কে কাকে কয়টা,,,,,!

ফুল আরিফার মুখ চেপে ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার মুখ লাগাম ছাড়া। পুরুষদের সামবেও লজ্জা পাচ্ছে না। এদিকে শুভ হেসে ফেলল। অস্পষ্ট সুরে আওড়ালো,” যখন দেয়া শুরু করব তখন গুনার সময় পাবে কী না সন্দেহ।”

ফুল স্পষ্ট শুনলো। সে অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
——————-

আরিফার পিছু পিছু নাফিসও আসলো। তবে একঘণ্টা পরে। ততক্ষণে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙলো। ফুল সাগরিকার সাথে নাফিস ও আরিফার পরিচয় করিয়ে দিলো। অভ্যাসমতো নাফিস আজও ফুলের জন্য কিছু আনতে ভুলল না। ফুল যখন নাফিসের পাশে বসলো তখন পকেট থেকে বাদাম বের করে ফুলের হাতে দিয়ে বলল,” আসার পথে বাদাম ওয়ালা পেলাম। ভাবলাম, তোর জন্য বিশ টাকার নিয়ে নেই।”

ফুল হাসিমুখে নাফিসের হাত থেকে নিলো। শুভ নিচে আসছিল। দুই বন্ধুর মধুর সম্পর্ক দেখে মুখ বাঁকালো। বিড়বিড় করে বলল,” অন্যের বউয়ের জন্য বাদাম নিয়ে আসা। যত্তসব আদিখ্যেতা। এজন্যই আমার বউ আমার থেকে এত দূরে। শালা নিজে তো বিয়ে করে না,আমার ঘরেও শান্তি আসতে দেয় না। বুঝাচ্ছি মজা।”

কলেজ জীবনের বন্ধুদের পেয়ে শুভর মধ্যে সেই আগের চাঞ্চল্যভাব ফিরে আসলো। শুভকে নিচে নামতে দেখে নাফিস দাড়িয়ে পড়লো। এতোদিন পর বন্ধুকে দেখতে পেয়ে আলিঙ্গন করল। ফুলও তাদের সাথে উঠে দাড়িয়েছিল। ফুলের কানে তখন শুভর কণ্ঠস্বর আসলো,” আর কতোদিন সতিন হয়ে আমার বউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করবি, শালা?”

নাফিস শুভকে ছেড়ে দিয়ে পেটে গুঁতা দিয়ে বলল,” ভালো হবি না?”

ফুল সরে আসলো। সকলের জন্য টেবিল সাজালো। খাওয়ার পর্ব শেষ করে নাফিস আদিলের হাতে কার্ড ধরিয়ে দিল। আগামী সপ্তাহে আরিফা ও নাফিসের বিয়ে। পরিবার সহ নিমন্ত্রিত করল নাফিস। ফুল অবাক হয়ে গেল। বিয়ের ব্যপারে ফুল কিছুই জানতো না। আরিফার দিকে তাকালে ফুল দেখতে পেল, মেয়েটার লাজুকমাখা চেহারায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফুল রাগ করলো না বরঞ্চ কাছে এসে জড়িয়ে ধরল। শুভ দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে আফসোসের সুরে বলল,” ইশ, কবে যে আমাকে ফুলবউ এভাবে জড়িয়ে ধরবে!”

প্রশ্ন হলো শুভর ইচ্ছে আদৌও পূরণ হবে?

—————–

সময় তখন মধ্য দুপুর, রান্নার কাজ সাগরিকা করল। ফুল বাঁধা দিল না। এতোদিন পর সাগরিকা ফিরে এসেছে। করুক না কিছু কাজ নিজের ইচ্ছেমতো। ফুল নিজের ঘরের দরজা আটকে রেখেছে। অবশ্যই শুভর কারণে। দরজা খোলা পেলেই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে চলে আসবে। ফুল যা চাচনা। ফুলের হাতে বিশেষ কোনো কাজ নেই। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে অদূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভকে দেখে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে ফুল। সকাল থেকে গুনে গুনে পঞ্চাশবার ফুলের ঘরে এসেছে, শুভ। ফুল কখনো ইগনোর করে নিজের কাজ করেছে। আবার কখনো ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। শুভর পাগলামো ফুলের উপর প্রভাব ফেলছে। ফুলের একবার মনে হয়, শুভকে ক্ষমা করে দিতে। পরমুহূর্তে নিজের দুর্দিনের স্মৃতি স্মরণ করে মনকে বিষিয়ে তুলে। কী এমন ক্ষতি হতো শুভ সেদিন চলে না যেতো! ফুলকে আঁকড়ে ধরে রাখতো। ভেঙেচুরে যাওয়া ফুলকে প্রতিবাদী নারী হিসাবে গড়তো।

নাফিসরা চলে যাওয়ার পর সাগরিকা এসেছিল। দূরে থেকে ফুলের প্রতি দয়া দেখানোর ঘটনাগুলো জানালো। ফুল, শুভর এসব কাজকে দয়া বলেই মেনে নিল। শুভ দয়া না করলে হয়তো ফুল আজ এতোদূর এগিয়ে যেত না। শুভর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেই ফুল খারাপ আচরণ করছে না। ফুলের ভাবনার মাঝে কেউ দরজায় কষাঘাত করল। আলসেভাব নিয়ে ফুল মাথার এলেমেলো চুলগুলো খোঁপা করে দরজার কাছে আসতেই দেখতে পেল, দরজার নিচের ফাঁকা অংশ দিয়ে একটি কাগজের টুকরো আসলো। ফুল আধো খোঁপা আধো রেখেই কাগজ খানা হাতে তুলে নিল। কাগজ খুলতেই দেখতে পেল, একপৃষ্ঠার চিঠি। সেই আগের লেখার স্টাইল। ফুল একবার ভাবলো পড়বে না। পরমুহূর্তে এতো বছরের নেভানো লোভ জেগে উঠলো। জানালার পাশে আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়া শুরু করল,

প্রিয়
সুমন্দভাষিণী,

তোমাকে এই নামে ডাকার অধিকার আমার আছে কি না, জানি না। তবু লিখছি, কারণ দীর্ঘ চার বছরের বোবা সময়ের ভার আর বইতে পারছি না। তোমার অভিমান যত আকাশসমানই হোক না কেন, আমি জানি, সেটার প্রতিটি কারণ আমি নিজেই।

তুমি কি জানো, সেদিন যখন বাড়ি ছেড়েছিলাম, তখন মনে হয়েছিল সব ঠিক করে ফেলব? ভেবেছিলাম, কিছুদিন দূরে থাকলে সব মিটে যাবে। কিন্তু আসলে যা করেছি, তা হলো আমাদের ভালোবাসার অমূল্য সুরটাকে ছিঁড়ে ফেলেছি। তোমার কষ্ট বোঝার বদলে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। আমার অপরিণত মানসিকতা, অহংকার—এসবই আমাদের দূরত্বের কারণ।

এতদিন পরে ফিরে আসার সাহস কীভাবে করলাম, সেটাও তোমায় ভাবাতে পারে। আমি বুঝেছি, তোমার ছাড়া এই পৃথিবীটা আমার কাছে শূন্য। তোমার গলায় অভিমানের ঝাঁজ থাকুক, কিন্তু সেই স্বরের মধ্যেও যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে, সেটা ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।

তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। জানি, ক্ষমা এমন সহজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তবু আমি তোমার পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বলতে চাই—আমাকে একবার সুযোগ দাও। ভুলগুলোর মেঘ সরিয়ে তোমার জীবনের আলো হয়ে ফিরে আসতে দাও।

তোমার অভিমানী চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে চাই—তোমাকে ছাড়া আমি এক নিঃসঙ্গ পথিক। তুমি যদি চাও, আমি প্রতিটি মুহূর্তে তোমার পাশে থেকে তোমার অভিমানকে যত্নে লালন করব, যতদিন না সেটা আমার ভুলের ভার মুছে ফেলে।

ইতি,
তোমার অপরাধী স্বামী।

পুনশ্চঃ তোমার অশ্রুগুলো আমাকে নিঃশেষ করার প্রধান হাতিয়ার। যেদিন তা ফুরিয়ে যাবে সেদিন আমিও মুছে যাব। তোমার চোখের প্রতিটা ফোঁটা আমার ভুলগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমি তোমার অপরাধী। শা’স্তি দিতে চাইলে শরীরে আ’ঘা’ত করো। তোমার নিঃশব্দের আঘাতগুলো সহ্য করতে পারছি না।

চলবে…..