#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৫
নাফিসের বাড়ির সাজসজ্জা জমকালো। আত্মীয়-স্বজনের ভীড়, হাসি-তামাশা চলছে। নাফিসের আজ বিয়ে। সকাল থেকে বাড়িতে উৎসবের আমেজ। আত্মীয়স্বজনদের হাসি-খুশি মুখ, রঙিন পোশাকে বাড়িটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঠিক এগারোটায় শুভ ফুলকে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে পৌঁছায়। আসার সময় গাঁদাফুলের মালা কিনে নিয়ে এসেছে নাফিসকে জ্বালাতন করার জন্য। ঘরভর্তি আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনায় শুভ একটু ইতস্তত করলেও নাফিসকে দেখে সে স্বস্তি পায়।
নাফিস বর সাজে প্রস্তুত হচ্ছে। তার মুখাবয়ব বেশ গম্ভীর। কিছু ভাবছে হয়তো। শুভ কাছে গিয়ে খোঁচানো শুরু করে, “এই বরসাহেব, গম্ভীর মুখটা এবার একটু হাসিখুশি কর! তোর এমন ভুতুড়ে চেহারা দেখলে, আরিফা ভয়ে স্টেজ থেকে পালিয়ে যাবে।”
নাফিস কিছু বলতে যায়, কিন্তু শুভ ততক্ষণে তার গলায় মালা পরাতে ব্যস্ত। হালকা রসিকতায় তাদের বন্ধুত্বের গভীরতা প্রকাশ পায়। নাফিসের সাজগোজের ছোটখাটো কাজগুলোতে শুভ হাত লাগায়, যেনো সব নিখুঁত হয়।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার সময় ঘনিয়ে আসছে। পরিবারের সবাই নিয়মকানুন নিয়ে ব্যস্ত। সব প্রস্তুতি শেষে, বরযাত্রীর দল বউ আনতে রওনা দেয়। চারপাশে উচ্ছ্বাস আর আনন্দের আবহে শুভ-নাফিসের বন্ধুত্বের এই দিনটিও হয়ে ওঠে বিশেষ।
গাড়িতে ফুল নাফিসের পাশে উঠে বসলো শুভ বসলো সামনে। লুকিং গ্লাসে ফুলকে দেখে নিল। শুভ তাদের বিয়ের মুহূর্তর কথা ভাবছে, এবার বিয়েতে ফুলকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিবে। তারপর, সিনেমার মতো লুকিয়ে ফুলের সাথে দেখা করতে যাবে। ব্যাপারটা কতো রোমাঞ্চকর হবে! ভাবতেই শুভর গা কাটা দিয়ে উঠলো।
নাফিসের ছোটবেলা থেকেই একটা স্বপ্ন ছিল, তার জীবনের সঙ্গী হবে এমন কেউ, যাকে সে হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসে। প্রথম ভালোবাসা অপূর্ণ হলেও দ্বিতীয় ভালোবাসায় সে সুখী হয়েছে। আজ নাফিসের স্বপ্ন পূরণের দিন। গাড়িতে বসে আছে নাফিস, পাশে ছোটবেলার বন্ধু ফুল। সামনে শুভ। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে নাফিস, কিন্তু তার মন পড়ে আছে আরিফার কাছে। পছন্দের মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার উত্তেজনায় তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ।
ফুল নাফিসকে খোঁচা দিয়ে বলল, “কী রে নাফিস, এত চুপচাপ কেন? ভয় পাচ্ছিস নাকি?”
নাফিস হেসে উত্তর দিল, “ভয় পাওয়ার সময় নেই। বরং মনের ভেতর এমন অনুভূতি, যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না। আরিফা শুধু আমার ভালোবাসা নয়, সে আমার জীবন। আজ সেই জীবনের শুরু।”
শুভ সামনের সিট থেকে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে হেসে বলল, ” আরে ভাই, বউকে নিয়ে কবিতা লিখতে গেলে বিয়েটাই মিস করে ফেলবি!”
ফুল হাসতে লাগল। শুভর মাথা সামনের দিকে ঘোরাতে বলে বলল,” শুদ্ধ পুরুষ, আপনি বরং আপনার পত্রীফুলের জন্য পত্র সাজান। পত্রীফুল অধীর আগ্রহে পত্রের জন্য অপেক্ষা করছে।”
শুভ গালভর্তি হেসে উত্তর দিল,” আপনার আদেশ চিরধার্য।”
নাফিস, শুভ ও ফুলের ভালবাসাময় সম্পর্ক দেখে মুচকি হাসে। জীবনের নতুন অধ্যায়ের জন্য অপেক্ষা করছে সে।
গাড়ি পৌঁছায় আরিফার বাড়িতে। সেখানে কনের বাড়ির লোকজন বরণদ্বার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। নাফিসকে গেটের কাছে নিয়ে আসা হয়। দরজায় দাঁড়িয়ে শালিকারা শুরু করে দুষ্টুমি, “মৌচাকের মধু খেতে হলে টোল দিতে হবে।”
নাফিস সবার হাসাহাসির মাঝে টাকার খাম এগিয়ে দেয়, আর সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ে।
ভেতরে এসে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। কবুল বলার জন্য মোল্লা সাহেব নাফিসকে প্রশ্ন করেন। নাফিস প্রথমে ফুলের দিকে তাকায়। তারপর শুভর দিকে। দুজনের হাসিমাখা মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে তারপর আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, “কবুল।”
উপস্থিত সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠলো।
আসছে কনে বিদায়ের মুহূর্ত। সবার চোখে একসঙ্গে আনন্দ আর বিষাদের ছাপ। আরিফা তার বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। নাফিস পাশে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, কীভাবে তাকে সাহস জোগাবে। শুভ পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলে, “ভাই, এখন থেকে তোকে বউয়ের কান্না সামলাতে হবে।”
নাফিস হালকা হাসে, তারপর আরিফার হাত ধরে বলে, “তোমার চোখের জল সামলানোর দায়িত্ব এখন আমার। চলো, আমরা নতুন জীবনের পথে যাই।”
গাড়ি ছাড়ে, আর তাদের গল্প শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের।
————————
বিয়ের কার্যক্রম শেষ করে শুভ ফুলকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তাদের ফিরে আসতে প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়লো। ক্লান্ত শরীর, ফুল এসেই নিজের ঘরে চলে গেল। শুভ বাইরেই ছিল। আজ খামারে পা রাখতে ইচ্ছে হলো তার। খালিদেরও তেমনভাবে খবর নেয়া হয় না। একসাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আসবে সাথে ছেলেটার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে আসবে। ভাবনা অনুযায়ী শুভ খামারের দিকে এগুলো।
” আপনি বিয়ে করবেন না?”
নাসিমার কথা শুনে ফরিদ কাজ থামিয়ে দিল। তার চোখের মুখের আবির্ভাব বদলে গেল নিমিষেই। ফরিদ বলল,” বিয়ে করার জন্য মনের মানুষের দরকার। আমার তো মনের মানুষ নাই।”
নাসিমার চোখ দেখে বুঝা গেল সে খুবই ব্যথিত হলো। মুখের অদল পরিবর্তন করে বলল,” মনের মানুষ ছাড়া কী বিয়ে করা যায় না?”
” নাহ।”
নাসিমা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। তার জীবনে ভালেবাসার খুবই অভাব। বিয়ে বসেছিল পরিবারের পছন্দে। মাস ঘোরাতেই শুরু হয়েছিল অমানবিক জুলুম। নাসিমা সহ্য করে নিয়েছিল। কতোদিন সহ্য করবে? বছর যেতে না যেতেই পেটে বাচ্চা এসেছিল। সেই বাচ্চাটাকে জালেমরা মে’রে ফেলল। হ্যাঁ, নাসিমার বাচ্চা মা’রা যাওয়ার জন্য শ্বশুর বাড়ির লোকেদের দোষারোপ করে। একমাত্র সন্তানকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল কিন্তু তারা সন্তানকেও কেড়ে নিল। নাসিমা একাকীই লড়ই করতে থাকলো। এরপর নাসিমার জীবনে ফুল নামক মানবীর আগমন ঘটলো। নাসিমার জীবন পরিবর্তন হয়ে গেল। বড়ো আপার ছায়াতলে এসে উপলব্ধি করল, তারও বাঁচতে হবে। পৃথিবীর সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। ফুলের অনুপ্রেরণা পেয়ে নাসিমা অনেক কাজ শিখেছে। তারমধ্যে সেলাইকাজ অন্যতম। নাসিমা সবসময়ই ফুলের সাথে থাকতে চেয়েছিল। এজন্য ফুল তাকে বাড়িতেই নিয়ে আসলো।
নাসিমার খুব মন খারাপ হলো। ফরিদকে তার কেনো যেনো আপন লাগে। হয়তো তাদের দুজনের দুঃখ একই বলে! নাসিমার মন খারাপ একটু বেশিই বেড়ে সে নাস্তা আনার বক্স হাতে নিয়ে বলল,” আমি যাই, ফুল আপায় হয়তো এসে পড়েছে।”
নাসিমা চলে যেতেও ফরিদের কথায় থেমে গেল। ফরিদ বলল,” তবে নতুন মনের মানুষ মনে হয় পাইয়া গেছি। তারে বিয়ে করলে খারাপ হবে না৷ সে যদি বুঝে তাহলেই কথা আগামু।”
ফরিদের দিকে থেকে স্পষ্ট বিয়ের ইঙ্গিত। নাসিমা দেখল, ফরিদ ঘাস কাটছে আর মুচকি হাসছে। নাসিমা দাঁত দিয়ে ওড়নার একাংশ কামড়ে ধরে লাজুক হাসলো। মনে মনে নাসিমা বলল,” আমিও রাজি।”
————–
নাসিমাকে লাজুক হেসে খামার থেকে বের হতে দেখে অবাক হয়, শুভ। নাসিমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি না, ভাবতে ভাবতে নজর যায় নাসিমার হাতে থাকা বক্সের দিকে। শুভ বুঝলো, নাস্তা নিয়ে এসেছিল কিন্তু হাসির কারণ বুঝলো না৷ খামারে ঢুকে কাজ ফেলে ফরিদকেও হাসতে দেখলো,শুভ। ভ্রু যুগল কুঁচকে ফরিদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,” কি হয়েছে রে ফরিদ? নাসিমাকে দেখলাম হেসে বের হয়ে যাচ্ছে এদিকে তুইও হাসছিস? ব্যপারটা কি? তোদের দুজনের মধ্যে কি চলছে?”
ফরিদ লজ্জা পেলো যেনো। মাথা নুইয়ে লাজুক স্বরে উত্তর দিল,” ও আর আমার দুখ একই। আমাদের দুজনের মধ্যে কষ্টের পরিমাণের কাছে ভালোবাসার পরিমাণ খুবই কম। আমি ওরে বিয়ে করতে চাই, ভাইজান। তুমি অমত করবে না তো?”
শুভর চেখ বড়ো হয়ে গেল। পরক্ষণে চোখেমুখে আনন্দ চিকচিক করে উঠলো। সে ফরিদকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আমি অনেক খুশি। এই সপ্তাহেই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।”
ফরিদের চোখে পানি চলে আসল। তারও পরিবার হবে ভাবতেই অন্তরে প্রশান্তির ভেলা ভাসলো।
চলবে………..
#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৬
বিয়ের সিজন শুরু হয়ে গেছে। ফুলদের বাড়িতেও বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে। ফরিদ ও নাসিমার বিয়ে। নাসিমা, বিয়ের ব্যপারটা জানার পর থেকে সংকোচ করছিল। ইনিয়েবিনিয়ে ফুলকে নিজের বয়সের কথা জানালো। ফুল হিসাব করে দেখলো। নাসিমা ফরিদের থেকে দেড় বছরের বড়ো। সতেরো বছর বয়সে নাসিমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। পরের বছরই শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো। নাসিমার বয়স প্রায় উনিশ বছর। ফরিদ আঠারোতে পা দেওয়ার কয়েকমাস বাকী। ফরিদকে জানালো হলো। নাসিমাকে স্ব জ্ঞানে বিয়ে করতে রাজি ফরিদ। এদিকে নাসিমা, ফরিদের থেকে আশাতীত সাড়া পেয়ে লাজ ভর করলো। পরেদিনই কাজি ডেকে ঘরোয়া ভাবে নাসিমা ও ফরিদের বিয়ে পরিয়ে দিল।
পাত্র পাত্রী রাজি থাকলে বিয়ে নামক শুভকাজে দেরী করা ঠিক না। শুভর কাজে পুরো পরিবার খুশি হলো। ফুলের আনন্দ দেখে কে? শুভ ইচ্ছেকৃতভাবে হোক অথবা অনিচ্ছেকৃতভাবে হোক ফুলের সাহায্য করেছে। নাসিমা ফুলের প্রেরণা সংঘের একজন সদস্য। সেই সুবাদে ফুলের কর্তব্য পালন করেছে শুভ। প্রেরণা সংঘের সদস্যকে সুন্দর জীবন দান করেছে সে।
_______________
সময় তার নিয়মে চলে। সময়কে থামিয়ে দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব না। শুভ বাড়িতে এসেছে প্রায় বিশদিন হয়ে গেছে। আর দশদিন বাড়িতে থাকবে তারপর ইন্টার্নিশিপের জন্য চলে যাবে। শুভ বাড়িতে এসেছিল মাত্র এক মাসের জন্য। এই এক মাসের ছুটিতে ওর পরিকল্পনা ছিল পরিবারকে সময় দেওয়া, কিছুটা বিশ্রাম নেওয়া, আর ফুলের অভিমান ভাঙানো। কিন্তু সময় বয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বিশ দিন পেরিয়ে গেছে। ফুলকে দেওয়া কথা রাখতে পারছে না সে। দশদিনে ফুলের দেখা স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। শুভ ফুলকে তৃতীয়বার ধুমধামের সাথে বিয়ে করতে চায়। একজন মেয়ে যেমন স্বপ্ন দেখে তেমনভাবে।
শুভ একাকী বসে আছে। জীবনের হিসাবনিকাশ মিলানোর জন্য সবসময় একাকীত্ব সময় বেছে নেয় সে। আজও তাই। নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্য বাড়ির ছাঁদ বেছে নিয়েছে শুভ। অবশ্য ফুল বাড়িতে নেই বলেই ভাবতে বসেছে। তার ভাবনার মূল কারণ হলো তার ও ফুলের বিয়ে নিয়ে। তৃতীয়বার বিয়ের কথা উঠলেই চার বছর আগের সেই দিনের কথা মনে পড়ে শুভর। শুভ চোখ বন্ধ করে নিলো। শুভর স্মৃতির পাতায় সেই দিনগুলোর স্মৃতি ভেসে আসলো।
চার বছর আগে,
সেই রাতে বাড়িতে ফিরে শুভ। জীর্ণশীর্ণ হয়ে ভাঙা মন নিয়ে মায়ের কাছে আসে। কৈফিয়ত চায়, ফুলকে একাকী যাওয়ার অনুমতি দেয়ার কারণটার জন্য। শুভর মা সেদিন কিছুই বলতে পারেননি। শুভ নিজের সিদ্ধান্ত জানায় তার মাকে। ছেলের হাত ধরে অনুরোধ করেছিল যেনো বিয়ে পর্যন্ত বাড়িতে থাকে। শুভ বাড়ি থাকেনি। সেই বিয়েতে বর কনেকে হলুদের ছোঁয়া দেয়া হয়নি। আর না হয়েছে সুর তালে নাচগান। আত্মীয়স্বজনের ফিসফিস গবেষণায় দুইদিন পার হয়েছে। ফুল, শুভর কাছে এসেছিল। রাতের আঁধারে বকশি কাকার দুয়ারে কড়া নেড়েছিল। বকশি কাকা শুভকে কোনোভাবেই ফুলের সাথে দেখা করার জন্য রাজি করাতে পারেনি। ফুলের কান্নামাখা কণ্ঠস্বর ঠিকই কানে এসেছিল শুভর কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি। একবুক কষ্ট নিয়ে ফুল বাড়ি ফিরেছিল।
বিয়েতে কবুল বলা মুহূর্তে শুভকে ফুলের পাশে বসানো হলো তখনও ফুল শুভর হাত ধরতে চেয়েছিল। শুভর মনের অদম্য রাগ তীব্র বেড়ে গিয়েছিল যার কারণে শুভ ফুলের হাত স্পর্শ করেনি সেদিন। ফুল সবার সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। ফুলের কান্না শুভর শক্ত অন্তর ছুঁতে পারেনি সেদিন। শুভ কবুল বলে চলে এসেছিল। আর ফিরে আসেনি। বিয়ের সেইরাতেই ঢাকা চলে এসেছে।
অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলো শুভ। সেসময়কার কথা স্মরণ করতে চায় না, শুভ। অতীত কষ্টের ছিল কিন্তু এখন ভেবে সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। শুভ ভাবলো, একা ভাবার চেয়ে ফুলের পরামর্শ তার জন্য জরুরি। শুভ একই ভুল দ্বিতীয়বার করতে চায় না। ফুল ছাঁদ থেকে নেমে আসলো। ফুলের জন্য নিজের ঘরে সুন্দর চমক বন্দোবস্ত করতে শুরু করল।
নতুন দম্পত্তির জন্য আপাতত আদিল খামারের পাশেই দালান উঠালো। নব দম্পতির বাস করার জন্য সমস্ত জিনিস কিনে দিল। যেহেতু ফরিদ ও নাসিমার কেউ নেই আদিল তাদেরকে নিজেদের কাজের জন্য রেখে দিল। অবশ্য তারা যদি চলে যেতে চায়, আদিলরা আপত্তি করবে না।
লাল সুতি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নাসিমা আজকের রান্না করল। এই ইচ্ছেটা তার একান্তের। আজকের দিনটায় বাড়ির সকলের জন্য রান্না করার। এবাড়ির মানুষদের উপকার সে কখনোই ভুলবে না। ফুল প্রেরণা সংঘ থেকে ফিরতে ফিরতে বিকাল হয়ে গেল। ক্লান্ত হয়ে সে সোফায় বসে পড়লো। নাসিমা এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলল,” আজ আমি রান্না করছি বলে, খাইতে আসলেন না।”
নাসিমার কণ্ঠে স্পষ্ট অভিমানের আভাস! ফুল হেসে উত্তর দিল, ” সব খেয়ে ফেলেছিস নাকি? আমর জন্য রাখিসনি? আমি তো না খেয়ে বেলা পার করলাম, তোর হাতের রান্না খাবো বলে।”
নাসিমা এক গাল হাসলো। ফুলকে তাগাদা দিয়ে বলল,” গোসল করে আসো, আপা। আমি খাবার দিচ্ছি।”
ফুল সোফা ছাড়তেই শাশুড়ির আগমন ঘটলো। ফুলকে দেখে এগিয়ে এসে বলল,” অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না,মা?”
ফুল শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।”
ফুলের শাশুড়ি মুচকি হেসে মাথায় হাত রাখলেন। তখনই সাগরিকা কোথায় থেকে হুড়মুড় করে চলে আসে। অপরপাশ থেকে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলে,” এই মেয়েটা সবসময় আমার আদরে ভাগ বসায়।”
ফুল ভেংচি কে’টে বলে,” চুপ, হিংসুটে মহিলা।”
বিকালটা বউ শাশুড়ির আহ্লাদে, আদরে চলে গেল। শুভ তখনো ফুলের জন্য চমক বন্দোবস্ত করছে। সে ঠিক কি করছে, সেই জানে।
————————
শুভ আজ সারাদিন এক অন্যরকম উত্তেজনায় কাটিয়েছে। কোনো বিশেষ দিন নয়, তবু সে ঠিক করেছে ফুলকে একটু অন্যরকম ভালোবাসার অনুভূতি দেবে। ঘরটা সাজানোর জন্য একগুচ্ছ বেলুন আর লাল-নীল বাতি এনে রেখেছিল আগেই। দুপুরের পর থেকে শুরু করল তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। ছোট্ট ঘরটা ধীরে ধীরে সাজিয়ে তুলল নিজের মতো করে। বেলুনগুলো এক দেয়ালের কোণ থেকে অন্য দেয়ালের কোনাগুলোতে বাধা। জানালার গ্রিল থেকে ঝুলছে কয়েকটা ছোট রঙিন বাতি। লাল-নীল আলোয় ঘরটা যেন অন্য এক রূপ নিয়েছে। শোবার ঘরের বিছানায় গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে লিখেছে ছোট্ট করে, ” ফুলবউ “। টেবিলের মাঝখানে এক গুচ্ছ তাজা লাল গোলাপ রাখা।
লাল রঙের একটা শাড়ি কিনে এনে সুন্দর করে প্যাকেট করেছে শুভ। সেটি রেখে দিল বিছানার একপাশে। এরপর সাউন্ড সিস্টেমে একটা মৃদু, রোমান্টিক গান চালিয়ে নিজেই অপেক্ষা করতে লাগল।
ফুল যখন ঘরে ঢুকল, প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিল না। ঘরের এমন সাজসজ্জা দেখে তার মুখটা বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ চুপচাপ চারপাশে তাকিয়ে বুঝল, শুভ তার জন্যই এই আয়োজন করেছে। শুভকে দেখে তার চোখ চকচক করে উঠল।
সে এগিয়ে এসে শুভকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। শুভ মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ” তোমার হাসিটাই আমার পুরস্কার, ফুলবউ।”
ফুল কোনো কথা বলল না, শুধু অনুভবে মিশে গেল শুভর। বিছানার উপর থেকে শাড়ির প্যাকেটটা ফুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,” এটা পরে আসবে, প্লিজ ফুলবউ?”
ফুল মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে শুভ বাঁধা দিয়ে বলল,” এই ঘরেই পরো। আমি দেখব।”
ফুল লজ্জা পেলো। শুভর কাছে এসে চোখদুটো ওড়না দিয়ে বেঁধে দিলো। শুভ দাঁত বের করে হেসে বলল,” তোমার লজ্জা দেখে আমিই লজ্জা পাচ্ছি, ফুল! আমি চলে যাচ্ছি, তুমি শাড়ি পরে নাও।”
ফুলের ওড়না গলায় প্যাঁচিয়ে শুভ ঘর থেকে বের হয়ে গেল।প্যাকেট খুলে দেখল, লাল রঙের জরজেটের শাড়ি। শাড়ি পরে ফুল আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।পাতলা শাড়িতে সাদা দৃশ্যমান পেট বের হয়ে আছে। ফুল হাত দিয়ে পেট ঢেকে রেখে বিড়বিড় করল,” দুষ্ট লোক।”
কিছুক্ষণ পর শুভ ঘরে প্রবেশ করলো। মোমবাতির আলোয় ফুলকে দেখতে পেলো আয়নার সামনে। শুভ দরজা আটকে ফুলের কাছে আসলো। দুজনের নিঃশ্বাসই আটকে রেখেছে। একজন ভয়ে অপরজন অস্বস্তিতে। শুভ ফুলকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো। ফুলকে নিজপর সাথে মিশিয়ে বলল,” আজকের রাতটা বিশেষ করার জন্য তোমাকে স্বাগতম, ফুলবউ!”
ফুল লজ্জায় লালনীল হলো। ফিরে শুভকে জড়িয়ে ধরলো।
————
শুভ আর ফুল একসঙ্গে বসে আছে। একজন অপরজনের শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। ঘরটা তখনো রঙিন আলো আর ভালোবাসার উষ্ণতায় ভরা। শুভ একটু অন্যমনস্ক ছিল, যেন কিছু বলতে চাইছে কিন্তু শুরু করতে পারছে না। ফুল এটা বুঝতে পেরেই বলল, ” তুমি কী চিন্তায় আছো, শুভ? আমাকে বলতে পারো।”
শুভ মৃদু হাসল, তারপর গভীর দৃষ্টিতে ফুলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ইন্টার্নশিপের জন্য প্রোগ্রাম ঠিক করেছি, ফুল। হয়তো একটা বছর দূরে থাকতে হবে। জানি, এটা তোমার জন্য সহজ হবে না, কিন্তু এটা আমার ক্যারিয়ারের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
ফুল কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে শুভর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, “শুভ, আমি তোমার স্বপ্ন বুঝি। তোমার পথচলায় আমি বাঁধা হব না। বরং এই এক বছর আমরা দুজনেই আমাদের লক্ষ্যগুলোর পেছনে ছুটব। তুমি ইন্টার্নশিপ শেষ করো, আমি আমার সংগঠনকে আরো বড় করব। আমরা একে অপরকে শক্তি দেব। আমাদের দেখা না হোক, বার্তা বাহকদের উপর ভরসা করব। বলো, আমায় চিঠি লেখবে না?”
শুভ যেন একটু হালকা অনুভব করল। ফুলের এই সমর্থন তার জন্য অমূল্য। সে বলল, “তুমি সবসময় এতটা বুঝদার কেন, ফুলবউ? তুমি জানো না ফুল, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।”
ফুল হেসে বলল, “তোমার সাফল্যই আমার অনুপ্রেরণা।”
শুভ ফুলের কপালে শুভ ঠোঁট ছোঁয়াল। নির্বিঘ্নে বলতে শুরু করল, “আমার সঙ্গে এত সাদামাটা বিয়ে কেন হলো? ধুমধাম করে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি!”
ফুল অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, কিছুক্ষণ পরে শুধুই বলেছিল, “সময়টা তখন অন্য রকম ছিল, শুভ।”
ফুলের দিকে তাকিয়ে শুভ নির্দ্বিধায় বলে উঠল, “শোনো, আমি এবার এক বছর সময় নিতে চাই। পুরো এক বছর। এই সময়টা শুধুই আমাদের জন্য। আমি সব ঠিকঠাক করব, তোমার ইচ্ছে মতো। ধুমধামে বিয়ে হবে, তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে। তুমি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারবে তো?”
ফুল চুপ করে শুভর কথাগুলো শুনছিল। কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা মুগ্ধতা মেশানো ছিল তার চোখে। মনের ভেতর শুভর কথা বিশ্বাস করল
শুভ ধীরে ধীরে ফুলের হাত ধরে বলল, “ফুল, আমি সত্যিই চাই, আমাদের গল্পটা সুন্দর হোক। তবে তার জন্য সময় দরকার। তোমার জন্য যা করব, সেটা তাড়াহুড়ো করে নয়, মনের মতো করে করব। আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ।”
ফুল এবার মৃদু হেসে মাথা নুইয়ে বলল, “আমি অপেক্ষা করব, শুভ। কিন্তু ভুলে যেও না, স্বপ্নগুলো তোমার দেওয়া প্রতিশ্রুতির মতোই বড়।”
ঘরের আলো তখনো মিটমিট করে জ্বলছে, আর তাদের স্বপ্নগুলো মিশে যাচ্ছে এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতিতে।
চলবে…..