#ইতি_নিশীথিনী
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
কলেজের মাঠে সকলের সম্মুখে প্রখ্যাত ছাত্রনেতার গালে সজোড়ে চ’ড় বসিয়ে দিলো নিশী। সকলের চোখে আতঙ্ক। তবে নিশী অবিচলিত। ক্রোধে তার গা কাঁপছে ঈষৎ তবে ভয়ের ছিটেটুকু নেই। কিছুক্ষণ পূর্বের কথা, সে তার বান্ধবীদের সাথে বাড়ি ফেরার জন্য হাটছিলো। তার মুখে হাসি। এর মাঝেই তাদের পথ আটকায় এই কলেজের ছাত্রনেতা মাহাদী। নিশী পাশ কাটিয়ে যাবার জন্য উগ্রীব হলেই তার হাত টেনে ধরলো মাহাদী। মাহাদীর এরুপ আকস্মিক কাজে চমকে উঠলো সে৷ ভ্রু কুঞ্চিত করে তপ্ত দৃষ্টি প্রয়োগ করলো নিশী। তবে এতে মাহাদীর বেশ একটা গায়ে লাগলো না। সে তার ঠোঁটে বিশ্রী কামুক হাসি অক্ষত রাখলো৷ নিশী কিঞ্চিত জোরালো কন্ঠে বললো,
“হাত ছাড়ুন, কি অসভ্যতা হচ্ছে এগুলো?”
প্রত্যুত্তরে মাহাদী বললো,
“যাকে ভালোলাগে তার হাত ধরতে কি অপরাধ। আমি তো আর তোমার সাথে অশ্লীলতা দেখাই নি”
মাহাদীর বিদ্রুপাত্মক উক্তিতে নিশীর রাগ বাড়লো। মাঠে মানুষের ভিড় জমলো, যেনো এখানে কোনো সিনেমার শুটিং হচ্ছে। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি নিশী এবং মাহাদীর দিকে। কারোর চোখে ভয়, কারোর চোখে বিস্ময়। কেউ কেউ এই অ’রা’জ’ক’তা দেখেও শান্ত৷ মুখে টু শব্দ নেই। রা’জ’নৈ’তি’ক নেতা হবার মাহাদীকে এই কলেজের ছাত্র থেকে শুরু করে সকলে ভয় পায়। স্যারেদের কাছে কমপ্লেইন করলেও বেশ একটা লাভ হয় না। কারণ সে শুধু এই কলেজের প্রবীণ ছাত্র এবং পলিটিক্যাল দলের নেতাই নয় বরং এই ওয়ার্ড এর ওয়ার্ড কমিশনারের একমাত্র পুত্র। তার প্রভাব ই অন্যরকম। ভয়ের দরুন কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। উপরন্তু মাহাদীর প্রভাবটি বেশ অন্যরকম। তার একটি বিশাল দল রয়েছে যাদের কাজ সকলের ভেতর ভয়টা অব্যাহত রাখা। নিকষকালো বিশ্রী ভয়। কথিত আছে, একবার তার বিরুদ্ধে একটি ছেলে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। তারপর থেকে ছেলেটিকে কোথাও দেখা যায় নি। বাবার অগাধ কালোধন এবং অসামান্য ক্ষমতা তাকে আজ এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাই তো সকলের সম্মুখে একটি মেয়ের হাত টেনে ধরলেও কারোর মুখ থেকে শব্দটি বের হচ্ছে না।
নিশীর বিরক্তি বাড়লো। তার গা ঘিনঘিন করছে। ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে মাহাদীর দিকে। চোখ মুখ খিঁচে হাত ছাঁড়াবার চেষ্টা এখনো চলছে। তবে পুরুষের কঠিন হাতের মুঠো থেকে ছাঁড়ানো বোধহয় এতোটা সহজ নয়। নিশী এবার অস্থির কন্ঠে বললো,
“মাহাদী ভাই হাত ছাড়েন”
“আচ্ছা, তুমি এমন বেসরিক কেনো নিশী? একটু হাত ধরছি তাতে ছ্যাত ছ্যাত করছো! আরে হবু বররা এমন একটু আকটু হাত টাত ধরে। এতো ধোঁয়া তুলসী সেজো না”
‘হবু বর’ উক্তিটি শুনতেই নিশীর কপালে ভাঁজ পড়লো। ক্রোধ, অপমান, ঘৃণা যেনো আকাশ ছুঁলো। এই মানুষটাকে কখনোই যেনো সহ্য হয় না নিশীর। সর্বদা ক্ষমতার বড়াই, সর্বদা অহমিকা, বেয়াদবি। একখানা ভালো গুন মানুষের মাঝে থাকে, কিন্তু এই পুরুষটির মাঝে সেটা নেই। এই কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই তার উপর লোলুপ দৃষ্টি মাহাদীর। সর্বদা বিরক্ত করাটা যেনো তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বলা নেই কওয়া নেই, হুটহাট পথ আটকায়, কথা বলার চেষ্টা করে। আজ তো সীমাই পার করে ফেললো হাত ধরে। নিশী নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলেও আজ যেনো ব্যর্থ হলো। প্রচন্ড ক্রুদ্ধ গলায় বললো,
“বারবার একটা কথা বলতে ভালো লাগে না, কেনো অযথা আমাকে উত্ত্যোক্ত করছেন। বলেছি তো, আমার পক্ষে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়”
নিশীর কথাটা শুনতেই মাহাদীর শান্ত চোখজোড়া ধপ করে জ্বলে উঠলো। মুখশ্রী হয়ে উঠলো কঠিন। বা ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“মাহাদী শেখের যা ভালো লাগে, সেটা সে আদায় করতে জানে। অহেতুক আমাকে খারাপ হতে বাধ্য করো না নিশী। আমি খারাপ হলে সইতে পারবে না”
নির্ভীক কন্ঠে কথাটা বলতে বলতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো মাহাদী। তারপর বা হাতটা আলতো করে বোলালো নিশীর গালে। নিশীর সংযমের বাঁধ যেনো ভাঙ্গলো। রাগে কাঁপছে তার শরীর। আর সহ্য করতে পারলো না সে। সজোড়ে চ’ড় বসিয়ে দিলো মাহাদীর গালে। নিশীর এরুপ কার্যে হতভম্ব উপস্থিত সকলে। এমনকি নিশীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী প্রত্যুষীও চমকে উঠেছে। মাহাদী জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। নিশীর হাত জ্বলছে। বাবা সর্বদা একটি কথা বলে,
“কখনো অন্যায়কে প্রশয় দিবে না৷ অন্যায় যত সহ্য করবে ততই তা তোমার গ’লা চেপে ধরবে”
কথাটা যেনো মিলে গেছে। এতোকাল মাহাদীর অসভ্যতা সহ্য করাতেই সে এতোটা স্পর্ধা দেখাচ্ছে। তাই তো আজ তার শরীরে স্পর্শ করতেও দ্বিধাবোধ করছে না সে। আজ আর ভয় পাবে না নিশী। এই অসভ্যতামি আর নয়। মাহাদী হাতের বাঁধন আলগা করতেই হাত ঝাঁড়া দিয়ে হাতটা ছাড়ালো সে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“আগামীতে কোনো মেয়ের গায়ে হাত দিতে হলে চ’ড়টার কথা স্মরণ করবেন। চুপ থাকি মানে এটা নয় যে আমি দূর্বল”
বলেই অপেক্ষা করলো না নিশী। হনহন করে হাটা দিলো নিজ গন্তব্যে। প্রত্যুষীও পিছু নিলো। উপস্থিত সকলের মাঝে কানাগোসাশুরু হয়েছে। মাহাদী এখনো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। তার সাগরেট ইমাদ ছুটে এলো। দলের বাকিরা মানুষের ভিড় কমালো। মাহাদীর কাছে আসতেই ইমাদ বললো,
“মাহাদী ভাই, মাইয়াটারে বেশি ছাড় দিয়ে দিছেন। ওর সাহস কত! আপনেরে থা’প্প’ড় মারে! ওর একটা ব্যাবস্থা করতে হইবো”
ইমাদকে চমকে দিয়ে মাহাদী হাসলো। বিচিত্র বিদঘুটে হাসি। তারপর গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“আমি তো ভেজা বিলাইকে পছন্দ করি নি রে, বাঘিনীকে করছি। এই সামান্য আঁচড় তো খাবোই। ওর লেজ কা’টা’র সময় আসছে। এতো ভাবিস না। মাহাদী শেখের বউ তো নিশীই হবে”
*******
বাড়ি ফিরতে দুপুর গড়ালো নিশীর। হাত এখনো জ্ব’ল’ছে। তবে এই জ্ব’ল’নে একটা শান্তি আছে। প্রত্যুষী যখন ভীত কন্ঠে বলছিলো,
“দোস্ত কাজটা ঠিক করিস নি, মাহাদীর ক্ষমতা তো জানিস। তোকে মে’রে গু’ম করে দিলেও কেউ টের টি পাবে না”
“তাই বলে ওর প্রাইভেট প্রোপার্টি হয়ে যাবো! ভয় ভালো, কিন্তু এতোটা ভয় পাওয়া ভালো নয় যে নিজের আত্মসম্মানকে ব’লি দিতে হয়”
প্রত্যুষী থেমে গেলো। আর কথা বাড়ালো না। নিশীর সাথে তর্কে যাওয়া আর কলাগাছে মাথায় টা’ক দেওয়া একই কথা। সে তার জিদ, বিশ্বাসে অটল।
বাসায় ফিরতেই মুখোমুখি হতে হলো রাহেলা বেগমের। সম্পর্কে সে নিশীর চাচি। মাতাপিতার ভাগ্যটি নিশীর ভালো নয়। তার বয়স যখন তিন নিশীর মা তাকে এবং তার বাবাকে ছেড়ে চলে যান। অনেকের ভাষ্যমতে তিনি তার প্রেমিকের সাথে পলায়ন করেছেন। অবশ্য নিশীর পিতা কখনোই তা বিশ্বাস করতেন না। নিশীর বয়স যখন তেরো তখন তার বাবাও পরলোকগমন করেন। ফলে তেরো বছরের নিশীর আশ্রয় হয় তার বড় চাচা জামশেদ সাহবের ঘরে। নিশীর আচারণ বরাবর ই উদ্ধত। তার বিশ্বাস, চিন্তাধারা সর্বদাই পরিষ্কার এবং অবিচল। ফলে তার এমন ঠোঁটকাটা এবং অবিচল স্বভাবটি বরাবর ই অপছন্দ রাহেলা বেগমের। তাই দুজনের মাঝে বাক্যযুদ্ধ লাগেই। নিশী চাচীর চাহনীতেই বুঝে গেলো তিনি কি চান! মৃদু হাসি একে বললো,
“রিক্সা পাই নি চাচী তাই দেরী হয়েছে”
“রিক্সা পাও নি নাকি বন্ধু বন্ধঅবের সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করছিলা! আমি তো জানি তোমার কলেজ শেষ হয় একটার সময়, এখন বাজে তিনটা। তা বলি এতো সময় লাগে বুঝি রিক্সা পেতে”
নিশী খোলা চুলগুলো খোঁপায় বাঁধতে বাঁধতে বললো,
“আমি কি করে বলবো চাচী? আমি তো রিক্সাওয়ালাদের মনের কথা জানি না। আমি আমার মনের কথা জানি”
“মুখ তো না যেনো ব’টি। চলতেই থাকে চলতেই থাকে, মায়ের স্বভাব পেয়েছে যতসব।”
নিশী আর উত্তর দিলো না। কারণ এখন উত্তর দেওয়া মানেই চাচীর রাগ আকাশ ছোঁয়ানো। আর একবার রেডিও শুরু হলে সেটা রাত গড়াবে। কাপড় খানা ছেড়ে রান্নাঘরে ঢুকলো সে। থালাবাসনের আস্তানা বেসিনে। এগুলো তার ই পরিষ্কার করতে হবে। চাচীর বাড়ি তো বিনা মূল্যে থাকা যায় না। খাওয়াচ্ছেন, বস্ত্র দিচ্ছেন, থাকার আশ্রয় দিয়েছেন, আবার এখন পড়াশোনাও করাচ্ছেন। যদিও নিশীর পড়াশোনার খরচ সে নিজেই চালায় তবুও একটু আকটু কাজ না করলেই নয়। নিশী বাসন গুলো ধুচ্ছিলো ই অমনি নিহিতার আগমন ঘটলো। নিশীকে কাজ করতে দেখেই সে প্রতিবাদী স্বরে বললো,
“নিশীপু, তুমি এগুলো করছো কেনো! রহিমা তো আসবে। ও করবে”
নিহিতা মেয়েটিকে নিশীর সাগরেট ও ধরা যায়। সে তার চাচার মেয়ে। বয়সে নিশীর তিন বছর ছোট। কিন্তু নিশীর একমাত্র সেনাপতি সে। নিশী হাসলো আর বলল,
“আমি যদি এগুলো না ধুই, রেডিও থামবে না। তুই পড়তে বয়। নয়তো রেডিও তে যুদ্ধের ঘোষণা হবে”
নিহিতা নিশীর কথা শুনে একটা ছোট নিঃশ্বাস গোপন করলো। তারপর মলিন কন্ঠে বললো,
“মায়ের সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। আমি তো ছোট তাই তোমার পক্ষ নিলেই গাল জ্বা’লি’য়ে দেয়। তুমি চিন্তা করো না, এখন দূর্বল কিন্তু সবল হলেই আমি এর প্রতিবাদ করবো”
নিশী হাসলো। প্রথম প্রথম কিশোরী নিশীর চাচীর ঠেস দেওয়া, বিদ্রুপ, বিরুপ আচারণ বেশ কষ্ট লাগতো। এখন লাগে না। এখন যেনো চাচী না চেঁচালেই মনে হয় এই মহিলার কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। এর মাঝেই নিহিতা প্রশ্ন ছুড়লো,
“তুমি কি হাতে ব্যাথা পেয়েছো? এমন লালচে হয়ে আছে কেনো”
নিহিতার প্রশ্নে হাতের দিকে তাকায় নিশী। পরক্ষণে মনে পড়লো কলেজের ঘটনা। নিশী হাসলো। মৃদু স্বরে বললো,
“একটা মশা প্রতিদিন কানের কাছে ভো ভো করতো। তার ওটাকো মে’রে’ছি তাই হাত লাল”
নিশীর কথার মর্মার্থ বুঝলো না নিহিতা। একই মশাই প্রতিদিন ভো ভো করতো, ব্যাপারখানা যেনো একেবারে হজম হলো না। তবুও সে পালটা প্রশ্ন করলো না নিশীকে। নিশীর ঠোঁটের হাসি অমলিন। সে এখনো মাহাদীর স্তম্ভিত মুখখানা ভেবেই মজা পাচ্ছে।
****
কলেজে এখন নিশীর ভাব আলাদা, ছাত্রনেতাকে মে’রে’ছে সে। তার সাহস আকাশচুম্বী। এমন রটনা রটছে। তবে এতে নিশীর কিছুই যায় আসে না। তার একটা স্বপ্ন রয়েছে। তার ইচ্ছে ওকালতি করা। তাই তো সারাক্ষণ পড়াশোনার মাঝেই ডুবে থাকতে চায় সে। জামশেদ সাহেবকে হাজারভাবে মানিয়ে এই ল কলেজে ভর্তি হওয়া। কিছুতেই স্বপ্নকে বেরঙ হতে দিবে না সে। ক্লাস শেষে বাড়ি যাবার পথে আড়চোখে খেয়াল করলো মাহাদীকে দেখা যাচ্ছে না। তার আড্ডার স্থলে ইমাদ থাকলেও সে নেই। প্রত্যুষী ঠেস মেরে বললো,
“তোর ভয়ে বাঘ গুহায় ঢুকেছে”
নিশী উত্তর দিলো না। সে ভেবেছিলো আজ হয়তো মাহাদী তাকে অপদস্ত করার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেটা হয় নি। বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো নিশীর। এক অজানা শান্তি কাজ করছে। ছয়মাসের যন্ত্রণার পরিত্রাণ পেয়েছে সে। কিন্তু ভাগ্যের কলকাঠি যে তার অজানা। ভবিষ্যতের কথা সামান্য মানুষ কিভাবে বুঝবে। বাড়ি ফিরতেই দরজা খুললো রাহেলা বেগম। গলা খাদে নামিয়ে বললেন,
“মাথায় কাপড় দেও, তোমারে দেখতে পাত্রপক্ষ আসছে। আর এই পাত্রপক্ষে যে সে আলু পটল না। বিশাল পরিবার, তোমার প্যা পু বন্ধ রাখবা”
রাহেলা বেগমের কথা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে প্রবেশ করতে সময় নিলো নিশীর। সে ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে রইলো। রাহেলা বেগম নিজ থেকেই তার ওড়না টেনে ঘোমটা দিয়ে দিলেন। ভেতরে যেতে আরেকদফা বিদ্যুৎ গর্জে উঠলো নিশীর মস্তিষ্কে। পাত্রটি যে মাহাদী…….
চলবে