#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১১তম_পর্ব
নিশী চুপ করে থাকলো। সহানুভূতি তার বরাবর ই অপছন্দ। কিন্তু নেতাগোতা মানুষ, উপরন্তু ঈশানের সাথে তার সম্পর্ক বরাবর ই ভালোও নয়, মন্দ ও নয়। তাই উত্তরে শুধু নিশী অমলিন হাসি হাসলো। এদিক ওদিক কথা বলে শেষমেষ ঈশান বললো,
“মাহাদীর ভরসা নেই, ও তোমাকে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। শুনেছি তার জ্ঞান ফিরেছে। তুমি সাবধানে থেকো কিন্তু”
মাহাদীর কথাটা কর্ণপাত হতেই মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো, নিউরণের রেষারেষি শুরু হয়েছে। মনের গহীনে সুপ্ত ভয়টা আবারো মাথাচড়া দিলো। পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো নিশীর মুখশ্রী। গতরাতের আক্রমণটি কি মাহাদীর নিকৃষ্ট মস্তিষ্কের কোনো চাল ছিলো! নিশীকে চুপ থাকতে দেখে ঈশান রয়ে সয়ে বললো,
“আমার নম্বরটা রাখো, যদি কখনো মনে হয় এই অধমের সাহায্য প্রয়োজন একটা ফোন করো”
ঈশানের কথায় বেশ অবাক হলো নিশী। তার সাথে সখ্যতা খুব বেশি নয় নিশীর, তাই এমন সমবেদনা বা দরদের কারণ খুঁজে পেলো না নিশী। সন্দীহান কন্ঠে বললো,
“আমার সাথে আপনার নাম জড়িত বলেই কি এতো সহানুভূতি?”
“তোমার কি মনে হয়?”
একটু গাম্ভীর্যের সাথেই উত্তর দিলো ঈশান। নিশী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কাঠকাঠ কন্ঠে বললো,
“আমার যা মনে হয়েছে সেটাই বললাম, চিন্তা করবেন না। আমি এখন একজন উদবাস্তুমাত্র, উদবাস্তুদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হয় না”
ঈশান চুপ করে রইলো, গভীর নয়নে তাকিয়ে রইলো নিশীর পানে। কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে গেলো। নিশী বই নিলো। তারপর স্মিত কন্ঠে বললো,
“আসি ঈশান ভাই”
ঈশান প্রতিত্তরে কেবল ই হাসলো, স্বচ্ছ হাসি তবে হাসির মাঝে কোথাও একটা চাঁপা বিষাদের ছাপ আছে। কিন্তু নিশী সেই ছাপের কারণ খোঁজার চেষ্টা করলো না। অহেতুক কিছুই ভালো লাগে না তার। সম্পর্ক জিনিসটা খুব বাজে, গভীর সম্পর্ক গুলোও বিপদে পিঠে ছু*রি মেরে পালিয়ে যায়। তাই নতুন কাউকে ভরসা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। আর ঈশানের মতো মানুষগুলো সর্বদাই একটা মুখোশের আঁড়ালে থাকে। তাদের বাস্তবচিত্র বোঝা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ইতোমধ্যে জীবনটা এতোটাই কঠিন হয়ে গিয়েছে যে নতুন করে কোনো কঠিন কাজ করতে ভালো লাগে না নিশী। লাইব্রেরি থেকে বের হতেই মুখোমুখি হলো প্রত্যুষীর। প্রত্যুষীকে দেখতে ক্ষণিকে জন্য থেমে গেলো নিশীর পা। প্রত্যুষী পাশ কাটাতে পারলো না। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হয়ে যেত। ক্লাসে অদেখা করলেও এখন মুখোমুখী সে নিশী। বেশ অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ। ইতস্ততভাবে প্রত্যুষী শুধালো,
“কেমন আছিস?”
প্রশ্নটি বেশ জটিল নয়। তবুও কেনো যেনো কাঁটার মতো বিধছে নিশীর অন্তস্থলে। একটা তিতো অনুভূতি। এই অনুভূতিটি বড্ড বিচিত্র। প্রত্যুষী মেয়েটি আজকের বান্ধবী নয়। একই সাথে টিফিন খাওয়ার কাহিনী যে বান্ধবীর সাথে থাকে তার সাথে বন্ধুত্বের গভীরতা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। প্রত্যুষীর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই নিশীর, আছে শুধু একদলা অভিমান। অভিমানের পাথর শক্ত হলে সেটা হয়তো ভাঙ্গা অসম্ভব। বিদ্রুপের একটা হাসি ঠোঁটে ফুটে উঠলো নিশীর। গাল ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। টিটকারীর স্বরে বললো,
“আছি, খারাপ না”
প্রত্যুষীর মাঝে বেশ অস্থিরতা, পালাতে পারলেই যেনো বাঁচে। নিশী তাই স্মিত স্বরে বললো,
“তোর বেশ তাড়া মনে হয়। চাইলে যেতে পারিস”
“দেখ নিশী আমি জানি তুই রাগ করেছিস, কিন্তু আমার দিকটা একবার ভেবে দেখ। আজ যদি আমি তোর জায়গায় থাকতাম তুই কি করতি বল? যতই হোক একটা সমাজে থাকি আমরা”
“আমি কি করতাম আমি জানি না, তবে এটুকু জানি বান্ধবীকে এড়িয়ে চলতাম না। যতই হোক আমার সমাজ তো আমার চারপাশের একদল মানুষ ই। বান্ধবীটাও সেই সমাজের ই একজন। যার সাথে টিফিন ভাগ করেছি, তার বিপদ ভাগ না করলেও তার বিষাদটুকু ভাগ করে নিতে চাইতাম। বাদ দে, কথায় কথা বাড়ে। তুই বরং তোর কাজে যা। আসছি”
বলেই নিশী হনহন করে বেড়িয়ে গেলো।প্রত্যুষী দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। গ্লানিবোধ পৃথিবীর সর্বোনিকৃষ্ট অনুভূতি, আজ সেই অনুভূতিটাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে প্রত্যুষীকে। তবুও বান্ধবীর প্রতি এগোতে পারছে না সে, কারণ আর কাঠামোগত সমাজে নিশী কেবল ই একজন ন*ষ্টচরিত্রের, উদ্ধত স্বভাবের, অস*ভ্য মেয়ে_____
*****
শ্রাবণের মেঘলা বিকেল, দক্ষিণকোনে জমেছে নিকষকালো মেঘ। আকাশও যেনো গলা ফাঁটিয়ে বলছে,
“আকাশ এতো মেঘলা, যেও নাকো একলা
এখনি নামবে অন্ধকার”
তবুও এই ঘোলাটে আকাশের দিকেই উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছে নীরা। তার চোখে নেই কোনো আগ্রহ, নেই কোনো আনন্দ। মিয়ে যাওয়া দৃষ্টি, তবুও পলক পড়ছে না। নিশী ঠিক পাশেই বসে আছে তার, নিশীর কাজ প্রতিদিন চারঘন্টা নীরার সাথে অতিবাহিত করা। বিনিময়ে তাকে দেওয়া হবে পনেরো হাজার টাকা। অংকটা অনেক বড়, মাত্র তিনশত ষাট মিনিটের বিনিময়ে যদি এতো টাকা পাওয়া যায় মন্দ কি! নীরা এখনো নির্বিকার। নিশীর সাথে তার কথা বলার আগ্রহ নেই। সে তার নিজস্ব দুনিয়ায় থাকে যেখানে নিশী এখনো প্রবেশপত্র পায় নি। আকাশ তীব্র গর্জন করে উঠলো। নিশীর ধ্যান ভাঙ্গলো। কিন্তু নীরা ভয় পেলো না। বরং আকাশের গর্জনে তার মিয়ে যাওয়া দৃষ্টি একটু চকচক করে উঠলো। যেনো সে এই গর্জনের অপেক্ষাই করছিলো। নিশী একটি কাগজে কিছু একটা একে নীরার দিকে এগিয়ে দিলো। নিশীর কাগজটা নীরা একবার দেখলো। নিশীর সাথে বন্ধত্ব না হলেও, সেই ডিফেন্সিভ মুডটা এখন খানিকটা হলেও ক্ষীন। নিশী তার ঘরে পায়চারী করলে তার কপাল কুঞ্চিত হয় না, দৃষ্টি ধাঁরালো হয় না। সে ছবিটা দেখলো, দুটো মেয়ে বৃষ্টিতে লাফালাফি করছে। নীরা একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে। যেনো সে এই অনুভূতিটি কখনোই উপলদ্ধি করে নি। নিশী স্মিত কন্ঠে বলল,
“ভিজবে?”
নীরা মাথা বাম কাথে দোলালো। এই প্রথম নিশীর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে নীরা, মুখে না দিলেও ইশারায়। বাসায় এখন কেউ নেই, প্রণয় তার চেম্বারে, পৃথা কলেজে। বাহিরে দারোয়ান আছেন তবে তিনি ঘরের ভেতর কি লক্ষ্য করবেন? নিশী নীরাকে নিয়ে পা টিপে টিপে ছাঁদে গেলো। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝড়ো বৃষ্টি। শীতল ছোঁয়ায় তপ্ত ধরণীকে করলো পরিতৃপ্ত। নিশীর হাত ধরে প্রথমবার বর্ষার পরশ পেলো নীরা। প্রথমে কেঁপে উঠলো সে। পৃথা কখনোই তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেয় নি। বৃষ্টির অনুভূতি কেমন সেটা আজ প্রথমবার উপলদ্ধি করছে নীরা। অবাক নয়নে দেখলো নিশী দুহাত খুলে চোখ বুজে রয়েছে। নীরাও ঠিক তাই করলো। দুহাত খুলে ভিজলো। এ যেনো নতুন বন্ধুত্বের শুভারম্ভ_____
বেশ কিছুসময় ভিজেছে নিশী এবং নীরা, অবাধ্য কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ সবসময় ই। তাই তো আজ দূরত্বের দেয়াল ঘুচিয়ে দিয়ে অবাধ্য কাজটি করেছে নীরা। নিশী টাওয়াল এগিয়ে বললো,
“তোমার চুল ভেজা, আসো মুছে দেই”
নীরা প্রথমে একটু অনাগ্রহ প্রকাশ করলো ঠিক, কিন্তু নিশী তখন বললো,
“চুল না মুছলে ঠান্ডালাগবে, বাসার সবাই জেনে যাবে। তখন আমাদের বকবে, তুমি বকা খেতে চেলে আমার আপত্তি নেই। তবে আমি বকা খেতে চাই না”
নিশীর কথা কি বুঝলো জানা নেই, তবে নীরা একটু একটু করে এগিয়ে এলো তার কাছে। নিশী স্মিত হেসে মাথাটা মুছে দিলো তার। চুল বেশ ঘন নীরার। একটা সময় মুছতে মুছতে বললো,
“জানো, আমার বাবাও আমাকে ছোট বেলায় বৃষ্টিতে ভিজতে দিতেন না। ঠান্ডা লেগে যেতো কি না! আমি কি করতাম জানো? আমার একজন বড় আপু ছিলো, আমি তার সাথে বন্ধুত্ব করে সেই কাজগুলো করতাম। তুমি কি আমার সাথে বন্ধুত্ব করে অন্যান্য বাচ্চাদের মতো কাজগুলো করতে চাও? আমি কাউকে বলবো না, এটা শুধু আমাদের মধ্যে থাকবে। কি নীরা আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে?”
নীরা গুটিয়ে গেলো। হয়তো তার মস্তিষ্ক ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। নিশীও জোর করলো না। সে ইন্টারনেটে দেখেছিলো, এসব বাচ্চাদের সাথে কখনই জোর করা উচিত নয়, বেশি জোর করলে হিতে বিপরীত হয়। নিশী চায় নীরা যেনো তার সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় তবে তা ধীরে ধীরে। এসব বাচ্চারা খুব চট করে কাউকে বিশ্বাস করে না। তাদের ব্রেইনের স্নায়ু গুলো থাকে প্রচন্ড জটিল। সকল মানুষের মতো তারা চিন্তা করে না। তাই নীরার বিশ্বাসটা জোগানোই নিশীর প্রথম কাজ। সে নীরার ডাক্তারদের সাজেশনটাও মাথায় রেখেছে। নীরার যখন মনে হবে এই মানুষটি আমাকে ক্ষতি করবে না তখন নীরা নিজ থেকে এই অদৃশ্য দেওয়াল ভেঙ্গে দিবে। জামা কাপড় বদলে নীরা নিজে নিজে খেলো। নুডুলস রান্না করেছিলো নিশী। খাওয়ার সময় নিশী খেয়াল করলো সে স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো খেতে পারে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খায়, কিন্তু নিশী তাকে কিছুই বললো না। বরং নিজের খাবারটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলো। ফলে নীরার বেশ মজা লাগলো। সে আরোও উৎসাহিত হয়ে খেলো। খাওয়া শেষে কিছুসময় আকাউকি করে নীরা ঘুমিয়ে পড়লো। ততসময়ে পৃথাও চলে এসেছে। নীরাকে ঘুমন্ত দেখে বেশ অবাক হলো পৃথা, অবাক কন্ঠে বললো,
“ও আপনাকে জ্বালায় নি?”
“না তো, বরং আজ আমি অনেক মজা করেছি। আপনার সেদিনের দেওয়া জামা পড়েছি, রাগ করেন নি তো?”
পৃথা হাসলো। তারপর বললো,
“না না, সমস্যা নেই”
নিশী স্মিত হেসে বললো,
“আজ আমি উঠছি, রাত হয়ে গেছে। এখন না বের হলে দেরি হয়ে যাবে”
“ভাইয়া চলে আসবে, একটু অপেক্ষা করুন”
“না থাক, অন্য কোনদিন দেখা হবে। আমি তো রোজ ই আসছি”
বলেই বেরিয়ে গেলো নিশী। নিশী বাড়ি পৌছালো নয়টা নাগাদ। জামা কাপড় ছেড়ে গোসল দিলো সে। তারপর আদা, লবঙ্গ দিয়ে চা বানালো সে। চা বানিয়ে পড়তে বসলো। এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো তার। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো প্রণয় ফোন করেছে। বেশ কবার মিসড কল উঠে আছে। নিশী ফোনব্যাক করলো। একবার বাজতেই ফোনটা ধরলো প্রণয়। তার কন্ঠে গাম্ভীর্য। নিশী “হ্যালো” বলতেই কড়া স্বরে বললো,
“আপনি নীরাকে বৃষ্টিতে ভিজিয়েছেন?”
“জ্বী?”
কথাটা শুনতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হলো নিশী। তারপর বললো,
“জ্বী, আমরা বিকেলে ভিজেছিলাম”
নিশীর কথায় প্রণয়ের কন্ঠের রেশ আরোও ঝাঝালো হলো। ক্রোধ চেপে বললো,
“আজ আপনার জন্য নীরা হাসপাতালে ভর্তি…………
চলবে……