ইতি নিশীথিনী পর্ব-১২

0
753

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১২তম_পর্ব

নিশী “হ্যালো” বলতেই কড়া স্বরে বললো,
“আপনি নীরাকে বৃষ্টিতে ভিজিয়েছেন?”
“জ্বী?”

কথাটা শুনতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হলো নিশী। তারপর বললো,
“জ্বী, আমরা বিকেলে ভিজেছিলাম”
“আজ আপনার জন্য নীরা হাসপাতালে ভর্তি”

প্রণয়ের কথাটা শুনতেই থমকে গেলো নিশী। মস্তিষ্কে কথাটা ধারণ করতে সময় লাগলো। সে ও বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে এসেছে দেড়ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে, এই দেড় ঘন্টায় কি এমন হলো যে নীরা এখন হাসপাতালে! ধাতস্থ হতে সময় লাগলো নিশী। ব্যগ্র কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে নীরার?”
“হাই ফিভার, শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন স্যাচুরেশনও কমে গেছে। এখন অক্সিজেন দেওয়া লাগছে। আপনাকে আমি দায়িত্ববান ভাবতাম নিশী, কিন্তু আমার ভাবনায় একেবারে বরফগলা পানি ঢেলে দিয়েছেন। কাল থেকে আমাদের বাড়িতে আপনার আসার প্রয়োজন নেই। আমার মেয়ে প্রতিব*ন্ধী ঠিক আছে, অন্তত শারিরীকভাবে তো সুস্থ থাকবে”

প্রণয়ের কন্ঠস্বরে ক্রোধের সু্ক্ষ্ণ রেশ রয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে তা কাঁপছে। সেই সাথে মেয়ের প্রতি তার চিন্তার ও আভাস পরিলক্ষিত। বেশ কড়াভাবেই সে নিশীকে কথাগুলো বললো। নিশী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তার কথাগুলো নিঃশব্দে হজম করলো। দোষ তো তার ই, বৃষ্টি ভেজার তালটি সেই তুলেছিলো। সে ভেবেছিলো হয়তো নীরার সাথে একটু হলেও তার বন্ধুত্ব হবে। নীরাও তার গতানুগতিক জীবন থেকে কিছুটা বের হবে। কিন্তু তার এই বিশাল পদক্ষেপের ফলস্বরুপ নীরাকে এতোটা ভোগান্তি সহ্য করতে হলো। প্রণয় ফোন কাটতে যাবে তখন ই ধীর গলায় নিশী শুধালো,
“কোন হাসপাতালে আসেন আপনারা?”
“কেনো?”
“আমি জানি যেখানে এসে আমার করণীয় কিছুই নেই, তবুও অনুরোধ করছি হাসপাতালের নামটি বলুন”

প্রণয় কিছুসময় চুপ করে রইলো, নিশীর ভেতরটাও অস্থিরতায় ছেয়ে গেলো। নীরাকে একটিবার চোখের দেখা না দেখলে যে কিছুতেই শান্তি পাবে না সে। কাজটা চলে যাওয়াটাতে তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই, আক্ষেপ হচ্ছে সেই দশ বছরের শিশুটির জন্য। না জানি কতোটা কষ্ট পাচ্ছে!

****

হাসপাতালটি নিশীদের বাসা থেকে মিনিট বিশেকের দূরত্বে। রাত বেশ হয়েছে বিধায় সুহা তাকে একা ছাড়ে নি। হাসপাতালে পৌছেই ন তালায় গেলো নিশী। আইসিউ এর বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়। তার মুখশ্রী কঠিন হয়ে আছে, কিন্তু চোখজোড়া সিক্ত। না চাইতেও উত্তরী হাওয়ার মতো কিছু ভয় এসে উঁকি দিচ্ছে তার দু নয়নে। ভয়টি হারাবার। বাবারা হয়তো সবথেকে অসহায় থাকে যখন তার সন্তান বিপদের সাথে লড়াই করে, হাতজোড়া ক্ষমতাহীনতায় বাঁধা থাকে। শুধু প্রার্থনার মাঝে আকুতি করতে পারে তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে। আজ প্রণয়ের অবস্থাটিও ঠিক তেমন। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত নয়ন অধীর হয়ে নিজ সন্তানের সুস্থতার প্রতীক্ষায় আছে। হয়তো সে নীরার জন্মদাতা নয় কিন্তু বাবা তো বাবাই হয়, পিতৃস্নেহ তো সর্বদা একইরকম। নিশী এগিয়ে প্রণয়ের মুখোমুখি হলো, প্রণয় তাকে একবার দেখলো। তারপর চোখজোড়া মুছে নিলো। থমথমে গলায় বললো,
“আপনার গাফেলতির শাস্তি আমার মেয়েকে সহ্য করতে হচ্ছে, এতোটা বেখেয়ালি আপনি নিশী? স্বাভাবিক বাচ্চাদের ই চুল ভেজা থাকলে তাদের ঠান্ডা লাগে। সেখানে নীরা তো স্পেশাল ওয়ান। আমি ওকে কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে দেই নি। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না আমার জন্য নীরা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ”

প্রণয়ের কথা শেষ হতেই নিশী অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
“চুল ভেজা মানে? আমি নিজ হাতে নীরার চুল মুছে দিয়েছি। সেখানে ভেজা থাকার প্রশ্ন ই উঠে না। আর এখন বাজে রাত দশটা পঁচিশ। ও আর আমি ভিজেছি বিকালের দিকে। এতো সময়ে চুল ভেজা থাকলেও তা শুকিয়ে যাবে। হ্যা, মানছি আমি দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি তবে আমি এতোটাও বেখেয়ালী নই প্রণয় সাহেব যে একটা বাচ্চা মেয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে ছেলেখেলা করবো। ভেজার পর ওর জামা বদলিয়ে ওকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়েই আমি বাড়ি ফিরেছি, সেখানে ভেজা চুল থাকার তো প্রশ্নই উঠে না”

নিশীর কথায় বিস্মিত হলো প্রণয়। কারণ সে যখন নীরাকে দেখতে ঘরে গিয়েছিলো তখন ইতোমধ্যে নীরা জ্বরে কাঁপছিলো। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। নীরা স্বভাবতই কাউকে ডাকে নি, কারণ তার মস্তিষ্ক সেই ব্যাপারগুলোর সাথে পরিচিত নয়। একা একাই সহ্য করেছে কষ্টগুলো। তখন ই প্রণয় খেয়াল করেছিলো নীরার চুল ভেজা। পৃথাকে জিজ্ঞেস করতেই সে স্পষ্টস্বরে বলে,
“আমি জানি না”

নীরাকে নিয়ে গাড়িতে তোলার সময় বাড়ির দারোয়ান জানায় সে নীরা এবং নিশীকে ছাঁদে ভিজতে দেখেছিলো। কথাটা শোনামাত্রই রাগ, ক্রোধে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লো প্রণয়। নীরার প্রতি কেউ অবহেলা করুক মোটেই সহ্য হয় না তার। সেখানে আজ তো নীরা মুমূর্ষুপ্রায়। হাসপাতালে আনতেই ডাক্তার জানায়,
“আপনারা এতো কেয়াললেস কেনো? একটা বাচ্চাকে কি এই রাতে কেউ গোসল করায়। দোয়া করুন যেনো নিউমোনিয়া না হয়”

প্রণয়ের মনে হচ্ছিলো তার চেয়ে অসহায় হয়তো এই জগতে কেউ নেই। তাইতো সকল ক্রোধের বর্ষণ হলো নিশীর উপর। কিন্তু এখন নিশীর বক্তব্যে প্রণয়ের এলোমেলো লাগছে। সন্দিহান কন্ঠে বললো,
“আপনি সত্যি বলছেন?”
“আমি মিথ্যে বলি না, বললে প্রথমেই অস্বীকার করে নিতাম। আর পৃথাও তো দেখেছে ওকে, আপনি পৃথাকে জিজ্ঞেস করুন”

প্রণয় কিছু বলার পূর্বেই একজন নার্সের আগমণ ঘটলো। বিনয়ী কন্ঠে বললো,
“এখানে ৮ নম্বর বেডের রোগীর এটেন্ডেন্স কে আছেন?”
“জ্বী আমি”
“আপনি এখন চাইলে রোগীর সাথে দেখা করতে পারেন”

নার্সের কথাটা শোনামাত্র ই ছুটে প্রণয়ের চোখ চকচক করতে লাগলো। সে একমিনিট অপেক্ষা করলো না, সাথে সাথেই নার্সের পেছন পেছন ছুটলো সে। নিশী সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। সুহা একটু এগিয়ে এসে বললো,
“তুই কি রাতটা এখানে থাকবি?”
“বুঝতে পারছি না”
“মেয়েটার জন্য খারাপ ই লাগছে, তবে আবার প্রশ্ন ও জাগছে কে তার সাথে এমন কাজটা করলো। নিজের দায়িত্বহীনতা তোর উপর ঢেলে দিলো?”

নিশী উত্তর দিলো না। তার মনেও যে একই প্রশ্ন_____

আট নম্বর বেডে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে নীরা। ডাক্তার ইঞ্জেকশন দেওয়াতে জ্বর এখন নিয়ন্ত্রণে। নোজাল মাস্ক পড়ানো তার নাকে। এতো সময় সে সজ্ঞানে ছিলো না সে। এখন একটু হলেও তার জ্ঞান ফিরেছে। প্রণয় এগিয়ে গিয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়ালো। সুঠাম বাহুতে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু অসহায় সে। মেয়ের এমন করুন চিত্রে চোখে নোনাজল ভিড় জমালো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। তারপর কোমল কন্ঠে বললো,
“নীরা মা, কেমন আছো?”

নীরা চোখ বুজে ছিলো। প্রণয়ের কন্ঠ শুনতেই চোখ মেলে চাইলো সে। শুষ্ক ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক মলিন হাসি। মাথা একটু দোলালো সে। যার অর্থ ভালো আছে সে। প্রণয় অনেক কথা বললো নীরার সাথে। নীরা কিছু কথার উত্তর দিলো না। কিছু কথার উত্তরে শুধু মাথা দোলালো। নার্স কিছুসময় পর আসলো। নরম কন্ঠে বললো,
“সময় শেষ, এখন আপনাকে যেতে হবে”
“আর দু মিনিট”

নার্স আর কিছু বললেন না, নিজ কাজে চলে গেলেন। প্রণয় তখন ধীরে ধীরে নীরাকে শুধালো,
“বিকালে বৃষ্টিতে ভিজেছিলে?”

নীরার মুখ চুপসে গেলো, ভয় তার চোখে। যেনো খুব খারাপ একটা কাজ করেছে সে। প্রণয় মৃদু হেসে বললো,
“আমি বকবো না, ভিজেছিলে”

নীরা গলা থেকে একটা শব্দ করলো। যার অর্থ হ্যা, সে ভিজেছিলো। প্রণয় তখন আবার শুধালো,
“নিশী তো তোমার গা মুছিয়ে দিয়েছিলো, তাহলে আবার ভিজলে কি করে?”

নীরা আবারো চুপ করে গেলো। প্রণয় তার স্যালাইন লাগানো হাত ধরে বললো,
“আমি বকবো না, বলো”

নীরা মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে বলবে না। প্রণয় তখন একটু থেমে বললো,
“পৃথা তোমাকে ভিজিয়েছে তাই না?”

নীরার চোখের বাসা বদলে গেলো। যেনো চোর না চাইতেই ধরা পরে গেলো। এক ভয়ার্ত দৃষ্টি যেনো এই কথাটা জানতে পারায় খুব ক্ষতি হয়ে গেলো নীরার। প্রণয় মেয়ের মাথায় একটা ছোট চুমু একে বললো,
“পৃথা জানবে না”

তারপর সে বেড়িয়ে গেলো। বাহিরে এখনো নিশী দাঁড়ানো। প্রণয়ের নিজেকে অপরাধী লাগছে। একটু ইতস্তত কন্ঠে বললো,
“তখন একটু বেশি বলে ফেলেছিলাম, কিছু মনে করবেন না। বাবা তো, মেয়ের এই অবস্থায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছিলাম। তাই না বুঝেই আপনাকে কথা শুনিয়েছি। ক্ষমা করবেন নিশীথিনী”

প্রণয়ের মুখে নিশীথিনী নামটি কেনো যেনো শুনতে ভালো লাগে নিশী। নামটিতে কি যেনো আছে, অব্যক্ত এক মায়া। এই মায়া অনুভুতিটা চাইলেও যেনো অগ্রাহ্য করতে পারে না নিশী। কেনো নিজেও জানে না______

রাত বারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরলো সুহা এবং নিশী। অবশেষে চাকরিহারা হলো না নিশী। আরোও মজার ব্যাপার সে নীরার সাথে দেখা করেছিলো। নীরা কথা বলে নি কিন্তু যাবার সময় তার ওড়নাটা টেনে ধরেছিলো। নিশী তার মুখশ্রী দেখে যা আন্দাজ করলো তা হলো সে নিশীকে আবারো দেখতে চায়। নিশী কিছু বললো না, শুধু হাসলো নীরার ছেলেমানুষীতে। মেয়েটি একটু একটু করে খোলশ ছাড়ছে যা নিশীর জন্য আনন্দের ব্যাপার। সুহা ফিরেই বললো,
“আমি খাবার গরম করছি, তুই ফ্রেশ হয়ে আয়”
“আচ্ছা”

এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো নিশীর। নাম্বারটি অপরিচিত, নিশী সাতপাঁচ ভেবে ফোনটা ধরলো। তখন অপরপাশ থেকে একটা আর্তনাদ শোনা গেলো। কন্ঠটি পরিচিত, নিশীর চোখ বিস্ফারিত হলো, মুখশ্রী পাংশুটে। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“নিহিতা”………………

চলবে……