#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৫তম_পর্ব
মধ্যদুপুর। আলিশান ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিশী। হাতে ফুলের তোঁড়া৷ তাতে লেখা “গেট ওয়েল সুন”। ভবনের নেমপ্লেটটা একবার দেখলো সে। ” শেখভিলা”। ওয়ার্ড কমিশনারের রমরমা দেখে বিতৃষ্ণায় মন বিষিয়ে উঠলো তার। তারপর পা বাড়ালো গেটের দিকে। তখন ই বাঁধা দিলো দারোয়ান।
“কই যাবেন?”
“মাহাদী শেখের সাথে দেখা করা যাবে?”
দারোয়ান সন্দীহান দৃষ্টি প্রয়োগ করলো। চোখ মুখ খিঁচে বললো,
“কেডা আপনে? কি কাজ?”
“উনি আমাকে ভালো করেই চেনেন, শুধু বলেন নিশী হক এসেছে”
দারোয়ান বিশ্বাস করলো না। খানিকটা খিঁচে বললেন,
“নাহ, এখন দেখা করন যাইবো না। আপনে চলে যান। ভাইজান ব্যাস্ত”
“ভাইজান ই আমাকে আসতে বলেছে। বিশ্বাস না হলে তাকে জিজ্ঞেস করুন”
এবার দারোয়ানের চেহারা বদলে গেলো। কঠিন, বিরক্ত মুখশ্রী খানিকটা নরম হলো। নিশী যেহেতু নাছোড়বান্দা, তাই বাধ্য হয়েই ইন্টারকোম দিয়ে ভেতরে ফোন দিলো সে। সাথে সাথেই তার মুখের রঙ আরোও গাঢ় হলো। থমথমে মুখে বললেন,
“ভেতরে যান”
*********
বসার ঘরে বসে রয়েছে নিশী। ফুলের তোড়াটা এখনো তার হাতে। ইমাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে এক কোনে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিশীকে দেখে যাচ্ছে। নিশীও প্রতুত্তরে বাঁকা হাসিমুখে তার দিকে তাকালো৷ নিশীর চোখ জ্বলজ্বল করছে। নেই কোনো ভীতি, জড়তা। সোনা তপ্ত আগুনের ভেতরথেকে তোলার পর যেমন চকচক করে, তার চোখের দীপ্তিটাও তেমন। ইমাদ বেশী সময় তাকাতে পারলো না। চোখ সরিয়ে নিলো৷ এর মাঝে সোলাইমান শেখের আগমণ ঘটলো। পাঞ্জাবী টেনে তিনি বসলেন। ভ্রু কুঞ্চিত করে কিছুসময় তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“এখানে আসার কারণ?”
“শুনেছি আপোষে আসতে চান আপনারা”
নিশীর শান্ত কথায় ভড়কে গেলেন সোলাইমান শেখ। সামলাতে সময় লাগলো নিজেকে। তারপর তাচ্ছিল্যের সহিত বললেন,
“আপোষ? এই মেয়ে ভেবে জানো কার সামনে কথা বলছো?”
“জানি, একজন হতাশ, দুর্ভাগা পিতার সাথে। বাবা বলতেন, সন্তানরা বাবা মায়ের সম্পদ, অলংকার, অহংকার। তবে মাহাদী তো ছেড়া নোট। তাই ও সম্পদ, অলংকার বা অহংকারের পর্যায়ে পড়ে না। তাই হতাশ, দুর্ভাগা বাবা একজন সাধারণ মেয়েকে দমাতে চানক্য নীতি চালাচ্ছে। প্রথমে আমাকে মা*রার চেষ্টা, তারপর আমার চাচা-চাচীর জীবন দূর্বিষহ করা। সেটাতেও লাভ হয় নি এখন আমার বোনটিকে ভয় দেখাচ্ছেন। এটা আপোষ ছাড়া কি ভাববো?”
সোলাইমান শেখের মুখ থমথমে হয়ে আছে। তার মস্তিষ্ক খানিকটা থমকে আছে। কথা খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। নিশীর ধারালো কথার সামনে সব যেনো অকেজো। সে নিশীকে দমাতে চেয়েছে, তবে সেটাকে আপোষের নাম দিবে নিশী এটা কখনোই ভাবতে পারেন নি৷ হ্যা, নিশীকে দমাতেই নিশীর দূর্বল স্থানে আঘাত করেছে তারা। চাচা-চাচীকে নানা ভাবে কোনঠাসা করার প্রচেষ্টা করেছে। যেনো নিশী ভয় পায়, কিংবা চাপের মুখে পড়ে। কিন্তু তেমন কিছুই হয় নি। উলটো নিশী, তোড়া সমেত এখানে হাজির হয়েছে। তবে নিশীকে আক্রমন সে করে নি। অবাক কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার হামলা করি নি”
“কেনো মিথ্যে বলছেন? সে রাতে আমার বাসায় হামলা তো আপনার ওই পোষা ইমাদ দিয়েছে”
সোলাইমান শেখ এবার ভদ্রতার মুখোশ ছিড়ে ফেললেন। মুখশ্রীতে ক্ষীপ্রতা ফুটে উঠলো। সেটাকে দমিয়ে পৈশাচিক হাসি একে বললেন,
“কি চাই তোমার?”
“প্রশ্নটা আমার, আমার কি চাই আপনাদের?”
“কেস তুলে নাও”
“বিনিময়ে আমি কি পাবো?”
“যন্ত্রণা থেকে মুক্তি”
নিশী শব্দ করে হাসলো। হাসিতে মিশে আছে তাচ্ছিল্য। তারপর দায়সারা ভাবে বললো,
“আপনার মনে হয় আমি আপনাকে বিশ্বাস করবো? নেতাদের কথায় বিশ্বাস করা যায়?”
“তোমার সাহস দেখে আমি সত্যি শিহরিত। আমার এক মিনিট লাগবে না তোমাকে গায়েব করে দিতে”
“ফাঁকা কলসি বাজে বেশী, আপনি তার জীবন্ত প্রমাণ। আপনি ভালো করেই জানেন আমার কিছু হলে আপনার ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন না। পুলিশ কোমড়ে দড়ি দিয়ে তাকে নিয়ে যাবে”
“আমার ছেলেকে নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও হবে”
“সে বটেই, তবে কি জানেন। আমি যে এখানে আসবো এটা আমি অনেককে জানিয়ে এসেছি। এখান থেকে আঁধা ঘন্টার মধ্যে ফোন না আসলে থানায় মিসিং রিপোর্ট করা হবে৷ আমি যখন এই বাড়িতে ঢুকছিলাম। সেটার ছবি তোলা আছে। যদিও সেটাকে মিথ্যে প্রমাণ করাই যায়। তবে আপনার নিজ হাতে লাগানো ল্যাম্পপোস্টের উপর সিসি ক্যামেরা সেটা তো মিথ্যে বলবে না। আর সেই ক্যামেরার ফুটেজ ডিলেট করতে যে সময় লাগবে সেটা আপনার কাছে নেই। এখন বলুন, কি করবেন আমার সাথে”
সোলাইমান শেখ ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ রক্তিম হয়ে আছে। রাগে কপালের শিরা লাফাচ্ছে। হাটুর বয়সী মেয়ে তাকে হু*মকি দিচ্ছে। নিশী হেসে বললো,
“মাহাদীর নাকি জ্ঞান ফিরেছে। এই তোড়াটা ওর জন্য। আমি মন থেকে চাই ও সুস্থ হয়ে উঠুক। নাহলে ওর শাস্তি কিভাবে হবে?”
“তোমাকে আমি ছেড়ে দিবো ভেবেছো, আজ তোমার জন্য আমার ছেলে বিছানায়। কথা বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। জ্ঞান আসা না আসা সমপর্যায়ে”
“আমিও চাই না, আপনারা আমাকে ছেড়ে দিন। তবে কি এই বিড়াল, ইঁদুরের খেলাটা থামান। এভাবে হু*ম*কি ধ*ম*কিতে আমি দমবো না। বরং লস আপনার। এরপর ও যদি আপনাদের মনে হয় এসব করবেন। করুন, আমি বলার কে! আজ উঠি, মাহাদীকে একবার চোখের দেখা দেখতাম। কিন্তু যা মনে হচ্ছে আপনি সেটা এলাও করবেন না। আসি”
বলেই উঠে দাঁড়ালো নিশী। তোড়াটা রাখলো টেবিলের উপর। নিশী চলে গেলো, সোলাইমান শেখ এখনো সেখানেই বসা। ইমাদ একটু এগিয়ে এসে বললো,
“চাচা, হুকুম দেন খালি”
“এখন না, তেলাপোকা উড়তে চায়। উড়তে দাও। যখন পাখা ছিড়বো, ছটফট করে ম*রবে”
দাঁতে দাঁত পিষে কথাটা বললেন সোলাইমান শেখ। পলি বেগম তখন বসার ঘরে প্রবেশ করলেন, ধীর কন্ঠে বললেন,
“ছেলেটা এখনো সুস্থ হয় নি, তাই অন্যের খারাপ চাইয়েন না”
“তোমার ছেলের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী ওই মেয়ে”
“ভুল বললেন, আমার ছেলের নিজের কৃতকাজের ফল এটা। তাই তো জ্ঞান ফেরার পর ও সে বিছানায়”
তাচ্ছিল্যের সাথে কথাটা বললো পলি বেগম। তারপর তোড়াটা নিয়ে গেলেন তিনি।
শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে মাহাদী। চোখ খোলা কিন্তু কোনো সাড়া নেই। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সিলিং এর দিকে। মাথার পেছনে চোটের কারণে তার শরীর প্যারালাইজড হয়ে আছে। সে সব শুনতে পারে, অনুধাবণ করতে পারে কিন্তু তার সাড়া দিতে পারে না। ডাক্তার অবশ্য বলেছেন এটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে সময় লাগবে। সোলাইমান শেখ সেই সময়ের সুযোগটাই নিচ্ছেন। সেই সময়ে কেসটা তুলে নিলেই রক্ষা। নয়তো একবার শুনানি হলে ছেলেকে কালাপানির সাজা হবে৷ সচ্চার দেশে এখন ধ*র্ষণের শাস্তি মারাত্মক। কিন্তু সেই শাস্তি পর্যন্ত যায় না মানুষ। তার আগেই হাটু গেড়ে দেয় অন্যায়ের সামনে। কেউ প্রাণ হারানোর ভয়ে তো কেউ সম্মান হারানোর ভয়ে। পলি বেগম মাহাদীর মাথার উপর রাখলো তোড়াটা৷ ধরা গলায় বললেন,
“আব্বা, তুই সুস্থ হয়ে ওঠ। প্রায়শ্চিত্ত এখনো বাকি।”
******
“শেখ ভিলা” থেকে বের হয়েই গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো নিশী। তার পা এখনো কাঁপছে। সোলাইমান শেখের মুখোমুখি হয়ে কথা বলাটা এতোটা সহজ ছিলো না তার জন্য। বুকটা কাঁপছিলো তার। প্রণয়ের কথা মতোই আজ “শেখ ভিলা” তে এসেছে। শত্রুর মুখোমুখি তাকে জানান দিতে এসব করে লাভ নেই, আমি দমবো না। এতে শত্রু বিচলিত হবে। তবে তার ধরণ বদলাবে। যদিও নিশী নিশ্চিত নয়। সোলাইমান শেখের মতো মানুষ কি আদৌ বিচলিত হবে! তবুও প্রণয়ের কথা মত এসেছে সে। তবে একটি ব্যাপার বেশ খটকা লাগলো, তা হলো মাহাদী। তার জ্ঞান ফিরে এসেছে অথচ সে এখনো শয্যাশায়ী। ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না৷ উপরন্তু সোলাইমান সাহেব রীতিমতো অস্বীকার করলেন আক্রমণ করার ব্যাপারটা। ইতোমধ্যেই এক পুরুষালী কন্ঠ কানে এলো,
“নিশী, তুমি এখানে?”
কন্ঠস্বরটি শুনেই পেছনে ফিরলো নিশী। ঈশান দাঁড়িয়ে আছে। ঈশানকে দেখে স্মিত হাসলো সে। তারপর বললো,
“কাজে এসেছিলাম”
“শেখ ভিলায়?”
নিশী উত্তর দিলো না। ঈশান অধৈর্য হয়ে বললো,
“তুমি ভয় পাও না কেনো নিশী? ওরা কতটা মারাত্মক জানো না? একবার তোমার উপর হামলা করেছে। তবুও তুমি নির্ভীক হয়ে এখানে এসেছো!”
“আপনি কিভাবে জানলেন আমার উপর আক্রমণ হয়েছে?”………..
চলবে……
#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৬তম_পর্ব
নিশী উত্তর দিলো না। ঈশান অধৈর্য হয়ে বললো,
“তুমি ভয় পাও না কেনো নিশী? ওরা কতটা মারাত্মক জানো না? একবার তোমার উপর হামলা করেছে। তবুও তুমি নির্ভীক হয়ে এখানে এসেছো!”
“আপনি কিভাবে জানলেন আমার উপর আক্রমণ হয়েছে?”
সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্নটি শুধালো সে। প্রণয় ব্যাতীত কেউ জানে না তার উপর হামলা হয়েছিলো। এমন কি সুহাকেও বলে নি সে। তাহলে এই লোকটি কি করে জানে! ঈশান বিচলিত হলো না। বরং তার ঠোঁটের কোনায় স্মিত একখানা হাসির রেখার জন্ম হলো। বড্ড বিচিত্র সেই হাসি, দূর্বোধ্য মনের প্রতিচ্ছবি যেনো! নিশী কন্ঠ কঠিন হলো,
“বললেন না তো! কি করে জানলেন? আমি তো আপনাকে বলি নি”
“কেনো সবসময় তোমাকেই বলতে হবে! শহরটা তো ছোট, আমি কি জেনে নিতে পারি না!”
ঈশানের কথাটা বড্ড বেখাপ্পা শোনালো। এক অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে আছে কথায়, সাথে এক মুঠো হতাশা। যেনো নিশী তার বুকে আঘাত হেনেছে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নিশী কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
“সে জানতেই পারেন, কিন্তু ঘটনা হচ্ছে জানার উৎস তো থাকা লাগবে। হ্যা, এখন যদি আগ থেকে জানা থাকে সেই ব্যাপার আলাদা”
“আমায় সন্দেহ করছো?”
“আপনি কি আমার আপন কেউ? সন্দেহ করাটা কি স্বাভাবিক নয়?”
ঈশানের হাসিটা প্রসস্থ হলো বটে তবে তার চোখে গাঢ় বিষাদের ছাপ লক্ষ্য করা গেলো। নিশী তার চোখের ভাষাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ঈশান বিড়বিড়িয়ে বললো,
“কেউ হবার জন্য কেউ হবার সুযোগ দিতে হয়”
“কিছু বললেন?”
“না, কিছু না”
“আসলে আসি”
নিশীর বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তির কারণ ঈশানের গাঢ় দৃষ্টি। যা নিশীকে অপলক ভাবে দেখছে। চাহনীটা বড্ড আলাদা। চোখের দিকে চাইলেই কেমন যেনো ধক করে উঠছে হৃদয়টা। বদড কাতর তার চাহনী। নিশী চলে যেতে চাইলেই ঈশান বলে উঠে,
“আমি পৌছে দেই?”
“প্রয়োজন নেই, আমি একা যেতে পারবো”
“জানি পারবে, তবুও”
ঈশান একটু জোর দিয়েই কথাটা বললো। ব্যাপারটা নিশীকে আরোও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলছে। সে ঈশানের সাথে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করছে না। তাই বিনয়ের সাথে ঈশানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললো,
“ঈশান ভাই, জোর করছেন কেনো? আমি তো বললাম আমি পারবো”
ঈশান আর জোর করলো না। কাতর নয়নে তাকিয়ে রইলো নিশীর দিকে। বুকচিরে একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। মনআকাশে মেঘমেদুর জমেছে। কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করলো না সে। খুব করে চাইছিলো মেয়েটি যেনো একবার পাশে থাকার সুযোগ দেয়৷ সঙ্গী না হলো পথচারী তো হওয়াই যায়। কিন্তু সেই সুযোগ দিলো না নিশী। ফলে অতৃপ্ত ঈশান নরম কন্ঠে বললো,
“সাবধানে থেকো, জীবন একটাই। চলে গেলে আর ফিরে আসার উপায় নেই”
নিশী কিছুসময় তাকিয়ে রইলো ঈশানের দিকে। লোকটির মতিগতি বোঝা যায় না। কথাবার্তাগুলো কেমন যেনো ঘোলাটে। এক অবিচ্ছেদ্য টান অনুভূত হয় নিশীর। কিন্তু সেই অনুভূতিগুলোকে অচিরেই নাকোচ করে দেয় সে। কি দরকার এই অনুভূতিগুলোকে প্রশয় দেওয়া। বলা তো যায় না যদি হিতে বিপরীত হয়। এর মাঝেই একটি কালো গাড়ি ঝড়ের গতিতে এসে নিশীর সামনে ব্রেক কষলো। আকস্মিক ঘটনায় নিশী এবং ঈশান উভয় ই চমকে উঠলো। গাড়িটি ঠিক নিশীর সামনে ব্রেক কষেছে। মিনিট খানেকের মধ্যেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো প্রণয়। তাকে কেমন যেনো বিধ্বস্ত লাগছে। সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সাদা শার্টটা ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে। চোখজোড়া রক্তিম, কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘামের রেখে। তাকে দেখে একদফা অবাক হলো নিশী। প্রণয় হনহন করে এগিয়ে এলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে গমগমে কন্ঠে বললো,
“একটা ফোন দেওয়া যায় না? আপনি জানেন আমি এতোটা সময় কতোটা চিন্তিত ছিলাম?”
নিশী আরোও একদফা অবাক হলো। লোকটিকে এতোটা বিধ্বস্ত লাগছে কি কেবল তার জন্য! এটা ঠিক শেখ ভিলা থেকে বের হবার পর একটা ফোন করার কথা ছিলো নিশীর। ঈশানের সাথে কথা বলতে যেয়ে সেটা ভুলে গেছে। তবে এই সামান্য কারণে প্রণয় গাড়ি হাকিয়ে আসবে ব্যাপারখানা বিশ্বাস হচ্ছে না। নিশী কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার পূর্বেই প্রণয়ের সাথে ঈশানের চোখাচোখি হলো। প্রণয় নিশ্চুপ। শুধু তীর্যক দৃষ্টিতে ঈশানকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো সে। ঈশান খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“আপনাকে চিনলাম না”
“আমি নিশীর শুভাকাঙ্ক্ষী”
ছোট করে বললো প্রণয়। তারপর নিশীর উদ্দেশ্যে বললো,
“চলুন”
“কোথায়?”
“বাসায়, নীরা অপেক্ষা করছে”
বলেই নিশীর হাত খানা নিজ হাতের ফাঁকে পুরলো, তারপর হনহন করে এগিয়ে গেলো গাড়ির পানে। ঈশান শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো তাদের যাওয়ার পানে।
নিশী হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। নিস্তব্ধ গাড়িতে ক্ষীন আওয়াজে গান বাজছে। প্রণয়ের হাত স্টেয়ারিং এ, দৃষ্টি সামনের দিকে। চুলের গোড়া থেকে ঘামের রেখা কপালে গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার ভ্রুক্ষেপ নেই। শক্ত, কঠিন মুখশ্রী শুধু রাস্তার পানে চেয়ে আছে। আজ প্রণয়ের কাজে শুধু অবাক ই হচ্ছে নিশী। প্রথমে তার জন্য ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে আসা, তারপর নিজের বিশাল হাতের ফাঁকে নিশীর হাতখানা গলিয়ে বেশ অধিকারের সাথে তাকে গাড়ি অবধি নিয়ে আসা। নিশী অবাক হবার জন্য ভুলেই গিয়েছিলো হাতটি ছাড়াতে হবে। গাড়ির কাছে আসতেই বেশ গম্ভীর কন্ঠে প্রণয় বললো,
“গাড়িতে উঠুন, নীরা অপেক্ষা করছে”
নীরা নামটি জড়িয়ে থাকার জন্য নিশী দ্বিতীয় কোনো কথা বলে নি। নিঃশব্দে গাড়িতে উঠলো। তার পর থেকেই নিস্তব্ধতা। মুখে কুলুপ এঁটে গাড়ি চালাচ্ছে বান্দা। এদিকে নিশীর বিস্ময়, প্রশ্নটা আকাশ ছাড়াচ্ছে।
“আমাকে দেখতে কি খুব সুন্দর লাগছে?”
প্রণয়ের ত্যাড়া কথায় হকচকিয়ে উঠলো নিশী। তারপর মনে পড়লো সে বেশ কিছুসময় ধরেই লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নিশী দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বাহিরে নজর ফেরালো সে। তখন ই আবার প্রণয় শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
“ছেলেটি কি ঈশান মাহমুদ ছিলো?”
প্রণয়ের কথায় ফিরে তাকালো নিশী। ধীর গলায় বললো,
“জ্বী”
“আপনার সাথে বেশ সখ্যতা আছে বোধ করি”
“মোটেই না, পথে দেখা হয়েছে বিধায় কথা বলছিলাম”
“কোনো কাজে এতোটা জড়িয়ে পড়া ঠিক নয় যে আশেপাশেই সবকিছুই অদেখা হয়ে যায়। ফোন আছে যখন সেটাকে ব্যাবহার করা উচিত। একটা মানুষকে সতেরো বারের অধিক ফোন করার পর ও যদি সে না ধরে, তাহলে অপরপাশের মানুষটির চিন্তা হতে পারে, সেটা বোঝা উচিত”
নিশী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। সে এবার খানিকটা আন্দাজ করতে পারছে প্রণয়ের রাগের উৎস। তাই তর্কে না যেয়ে বিনয়ী স্বরে বললো,
“ফোনটা সাইলেন্টে রেখেছিলাম। তাই শুনতে পাই নি। সরি। আর মিশন সাক্সেসফুল। হ্যা, উনার সম্পূর্ণ ভাষ্য উনি রাখেন নি। তবে চাচা-চাচী এবং নিহিতার সাথে উনারা যা করছে সেটাকে অস্বীকার করে নি, আমাকে কেউ সন্দেহ করে নি। তাই চিন্তা করবেন না”
বলেই নিজের ব্যাগের সাথে লাগোয়া ছোট ক্যামেরাটা বের করে প্রণয়ের সামনে ধরলো। প্রণয় এবার ব্রেক কষলো। শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো নিশীর দিকে। তারপর কিঞ্চিত নরম কন্ঠে বললো,
“আমার চিন্তা মিশন নিয়ে নয়, আপনাকে নিয়ে। আজ বড্ড চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন নিশীথিনী”
“কেনো? ভেবেছিলেন ফিরবো না?”
প্রণয় উত্তর দিল না। নিশী হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপর বললো,
“একা মানুষের ভয় কিসের? একদিন না একদিন তো হারিয়ে যাবোই! মুক্ত বিহঙ্গিনীর মতো উড়াল দিবো। তখন এই ভয়ের কি হবে! আমার জন্য তো কেউ অপেক্ষায় নেই, তাহলে ফেরার তাড়া কিসের?”
“অপেক্ষায় নেই কিভাবে বুঝলেন?”
“কে আছে অপেক্ষায়?”
“সময় হলে ঠিক জানবেন”
নিশী কথা বাড়ালো না। প্রণয় ও খোলসা করে বললো না কিছু। তবে প্রণয়ের কন্ঠ অন্যরকম ঠেকলো। কেমন যেনো মায়ায় ঘেরা, আবেগসিক্ত। মুখে কিছু না বললেও দুজনের চোখ এক অপরকে অপলকভাবে দেখতে লাগলো। একে অপরের চোখে একে অপরের প্রতিবিম্ব। নিস্তব্ধ পরিবেশ। নিস্তব্ধতা চিরে আকাশে গর্জে উঠলো মেঘ। এই বৃষ্টি নামলো বলে। মৃদু শব্দে গান বাজছে,
“খোলা জানালা দখিনের বাতাসে
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে
তখন তুমি এসে হেসে বলে দাও
আছি তোমার পাশে”
********
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অঝর শ্রাবণধারায় কুপোকাত ব্যস্ত শহর। জানালা বদ্ধ তবুও বৃষ্টি ছোঁয়ায় ইচ্ছে নিশীকে অস্থির করছে। কিন্তু কিছুদিন আগেই হাসপাতাল থেকে এসেছে নীরা। তাই ছেলেমানুষীকে বাধ্য হয়েই আটকে রাখলো নিশী। নীরার ঘরে বসে রয়েছে সে। নীরা আঁকছে। সে সর্বদা আঁকতেই যেনো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। অন্যদিকে নিশীর হৃদয়ে বিষন্নতা। কিছুই যেনো ভালো লাগছে না তার। উপরন্তু মহাবিরক্তির কারণটি প্রণয়। প্রণয়ের আচারণ তাকে বড্ড বেশি বিরক্ত করছে। লোকটি তার উপর অধিকার জমাচ্ছে। আর নিশীর হৃদয়ও সেই অধিকারে বাঁধ সাধছে না। যেমন গতকালের কথা, বলা নেই কওয়া নেই কোথা থেকে একগাদা বাজার সমেত হাজির হয়েছে নিশীদের বাসায়। সুহাও অবাক। মানুষের মন কল্পনা করে, সুহার মন কল্পনাতে বাঁচে। হুট করে নিশীকে টেনে বললো,
“তোর বয়ফ্রেন্ড?”
অমনি নিশী গালজোড়া রক্তিম হয়ে উঠলো। কান থেকে ধোঁয়া বের হবার যোগাড়। কোনো মতে বললো,
“কি যা তা বলছিস? আমার স্টুডেন্টের বাবা সে”
কথাটা শুনতেই সুহার মুখ কালো হয়ে গেলো। মিনমিন করে বললো,
“ধুর, সব হ্যান্ডসাম পোলাগুলো বিয়ে করে কেনো এতো তাড়াতাড়ি। তাহসান, অর্নব, আরেফিন শুভ। এখন এই লোকও”
নিশী মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েকে বলে লাভ নেই। এসব কারণেই বড্ড বিরক্ত নিশী। সে প্রণয়কে মানা করলে সে দায়সারা চিত্তে বলে,
“আমার ইচ্ছে”
সেখানেই আটকে যায় নিশী। তবে সে এখন ঠিক করেছে, প্রণয়ের মুখোমুখি হবে সে। প্রণয়ের অদ্ভুত আচারণে তার হৃদয় ভুল স্বপ্নকে লালিত করতে পারে। যা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। তাই প্রণয়কে সাফ বাংলায় বুঝিয়ে দিতে হবে। এসব করা আজ থেকে বন্ধ। এর মাঝেই একটা কাগজে নিশীর পায়ের কাছে উড়ে আসে। এই কাগজেই ছবি আকছিলো নীরা। কাগজ হাতে নিতেই মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায় নিশীর। বিস্ফারিত হয়ে যায় তার নয়নজোড়া। রীতিমতো বুক কেঁপে উঠে তার। তারপর নীরার দিকে তাকায়। নীরা নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে আছে। অথচ এই ছোট মেয়েটি এই সাংঘাতিক ছবিটি একেছে……..
চলবে……